শাহবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয় গণকবর, মৌলভীবাজার
থানার একটি সুপ্রাচীন বিদ্যাপীঠ শাহবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়। ‘লাতু’ ক্যাম্পের সন্নিকটে বিদ্যালয়টি অবস্থানের কারণে পাকহানাদারদের দখলে চলে যায় যুদ্ধের প্রথমভাগেই। হানাদারদের মর্টারের আঘাতে বিদ্যালয়গৃহের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে এ বিদ্যালয়ের একজন নন্দিত শিক্ষক আবদুল মতিন বি.এ. শহীদ হন।
বিদ্যালয়ের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে বধ্যভূমিতে অনেক লোককে হত্যা করেছে বর্বর পাকহানাদাররা। এ বধ্যভূমিতে সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডটি ঘটে জুলাই মাসে। করমপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা ছিল। বলা চলে এ এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ ছিল মুক্তিসেনাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পের পাশে কয়েকজন রাজাকার টহল দিতে গেলে মুক্তিসেনারা এদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে কয়েকজন রাজাকার জখম হয়। মুক্তিসেনারা রাজাকারদের অস্ত্র কেড়ে নেয়। এ পরাজয়ে রাজাকাররা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। নিরীহ জনসাধারণের ওপর পরাজয়ের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। রাজাকাররা নিরীহ এসব বাঙালিকে ধরে নিয়ে এসে তাদের পাক প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট হয়।
রাজাকার বর্বরেরা একে একে পাবিজুরি গ্রামের ১. মো. লালচান্দ, পিতা আজফর আলী, ২. জমির মিয়া (৩০), পিতা জড়াই মিয়া, ৩. ইসাদ আলী (৫০) ৪. ইসাদ আলীর পুত্র হারি মিয়া (২৫), ৫. তোতা মিয়া, পিতা ইসরাক আলীকে ধরে নিয়ে আসে হানাদার ক্যাম্পে। এছাড়া নয়াগাঁওয়ের ৬. মতিউর রহমান, পিতা আবদুল লতিফ; আলাপুর গ্রামের ৭. তৈমুছ মিয়ার পুত্র মাখন মিয়াকে একই সময় বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসে ক্যাম্পে। এ সাতজনকে শাহবাজপুর পাক ক্যাম্পে জড়ো করা হয়। শুরু হয় তাদের ওপর বর্বরোচিত অত্যাচার, আঘাতে আঘাতে বিদ্ধ করা হয় তাদের সারা দেহ। অবশেষে বিকেলে শাহবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন বধ্যভূমিতে তাদের নিয়ে আসা হয়। সারিবদ্ধভাবে সাতজনকে দাঁড় করানো হয়। তারপরই ব্রাশফায়ার।
আওয়ামী লীগ নেতা দৌলতপুর গ্রামের ডাক্তার আবদুন নূর, নুনু মিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গোপন যোগাযোগ ছিল। প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং তথ্য প্রদান করতেন দেশপ্রেমিক ডা. আবদুন নূর। শুরু থেকে স্থানীয় রাজাকার চক্র তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখত; কিন্তু ডাক্তার নূর শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। জুলাইয়ের শেষভাগে ডাক্তার নূরের লেখা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পত্র ফাঁস হয়ে যায় রাজাকারদের কাছে। ডাক্তার নূরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাজপুর ক্যাম্পে। ইতিপূর্বে আরেকবার তাঁকে ক্যাম্পে আনা হলেও সেবারে অলৌকিকভাবে ছাড়া পেয়ে যান। জঘন্যতম অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েও যখন কোনো তথ্যপ্রাপ্তির সম্ভাবনা মিলল না তখন তাঁকে হত্যা করার ব্যবস্থা করল। বর্বররা ভিন্নতর পদ্ধতিতে হত্যা করল তাঁকে। পাকহানাদাররা কোমরসমান একটি গর্ত করিয়ে সেখানে নেমে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। কোমর অবধি মাটির গর্তে আড়াল হলেও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অকুতোভয় দেশপ্রেমিক ডাক্তার নূর। কালেমা পাঠ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের অধীর প্রতীক্ষায় ছিলেন তিনি। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘাতকের অস্ত্রের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে প্রাণঘাতক গুলি। শহীদ হলেন তিনি পাকহানাদাররা ডা. নূরের মৃতদেহ সেখানে সেভাবেই মাটিচাপা দিয়ে রাখে।
[১২] গোপাল দত্ত
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত