লক্ষ্মীখালী গণহত্যা, বাগেরহাট
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থানার লক্ষ্মীখালী গ্রামটি মতুয়া ধর্মসম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মগুরু গোপালচাঁদ সাধুঠাকুরের জন্মভূমি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর এ সম্প্রদায়ের অসংখ্য ভক্ত এসে লক্ষ্মীখালীর সাধুবাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। গোপাল সাধুঠাকুরের দুই পৌত্র দেপালচাঁদ সাধুঠাকুর ভক্তদের দিয়ে দিনরাত পাহারার ব্যবস্থা করেন। চারদিকে লুটতরাজ ও গণহত্যার খবর শোনার পর থেকে অন্যদের মতো তাঁরাও দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়ার কথা ভাবছিলেন। তার ফলে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে উক্ত সম্প্রদায়ের কয়েক শত ভক্ত লক্ষ্মীখালী সাধুবাড়িতে এসে জড়ো হয়েছিলেন। বাড়িটিতে শত শত লোক একত্র হয়েছে খবর পেয়ে বাগেরহাটের রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বাধীন রাজাকারদের একটি দল ২৩ মে রোববার সাধুবাড়ি আক্রমণ করে এবং লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ একটি মর্মান্তিক গণহত্যার ঘটনা ঘটায়।
ঘটনায় দুই দিন আগে ২১ মে বাগেরহাটের রাজাকার বাহিনী ডাকরায় একটি বড় ধরনের গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছিল। ঐ অভিযানে তারা শরণার্থীদের নিকট থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল বলে এই ধরনের আরো অভিযান সংগঠনের ব্যাপারে তারা উৎসাহিত হয়। লক্ষ্মীখালী সাধুবাড়ি আক্রমণের সিদ্ধান্ত সেই উৎসাহেরই পরিণতি বলে অনুমান করা হয়।
ডাকরা অভিযানের মতো একই প্রক্রিয়ায় কয়েকটি ছিপ নৌকা নিয়ে রাজাকার বাহিনী লক্ষ্মীখালী গ্রামের কাছে গিয়ে নামে এবং দুপুরের মধ্যেই সাধুবাড়ি আক্রমণ করে। রাজাকার বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে ঐ বাড়ির লোকজন এবং অবস্থানরত শরণার্থীরা যে যেখানে পারেন আত্মগোপনের চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু হীরামন সরকার নামের একজন মতুয়াভক্ত কিছুতেই মন্দির ছেড়ে অন্যত্র যেতে রাজি হন না। মন্দিরে হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ও গোপালচাঁদের মূর্তির সামনে বসে তিনি মতুয়া সংগীত গাইতে থাকেন। রাজাকাররা বাড়ির মধ্যে ঢুকে প্রথমেই মন্দিরের উপরে চড়াও হয়। কয়েকজন মিলে হীরামনকে ধরে এবং তাঁকে জবাই করে। হীরামনের রক্ত ফিনকি দিয়ে মন্দিরের দেয়ালে গিয়ে লাগে। একজন রাজাকার হীরামনের রক্ত হাতে মাখিয়ে দেয়ালে ছাপ দেয়।
সাধুবাড়িতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের বড় একটি অংশ দিঘির তীরের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে ছিলেন। রাজাকার বাহিনী তা বুঝতে পেরে সেদিকে এগিয়ে যায় এবং লুকিয়ে থাকা লোকজনকে ঝোপঝাড় থেকে টেনে বের করে হত্যা করতে থাকে। দেপাল সাধুঠাকুর তখন পার্শ্ববর্তী কাঁকড়াতলী গ্রামে গিয়ে সেখানকার ইয়াকুব আলী মেম্বরকে ঘটনার কথা জানানোয় ইয়াকুব আলী মেম্বর কয়েকজন সশস্ত্র লোক নিয়ে রাজাকারদের প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু ইয়াকুব আলী তাঁর দলবল নিয়ে সাধুবাড়ির কাছাকাছি আসতে না আসতেই রাজাকার বাহিনীর একটি অংশ তাঁদের তাড়া করে এবং গুলি ছোড়ে। এক পর্যায়ে ইয়াকুব আলী মেম্বার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
এরপর রাজাকার বাহিনী গণহত্যার কাজে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করার সুযোগ পায়। সোনাতলা গ্রামের অভিমন্যু শিকদার তাঁর দুই ছেলে নিয়ে একটি ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন রাজাকাররা তাঁদের তিনজনকে ধরে আনে এবং মন্দিরের সামনে এনে বলি দেয়। এক মহিলা তাঁর দুই শিশুসন্তান নিয়ে কামনা- সাগরের তীরে একটি গাছের আড়ালে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন। রাজাকাররা অত্যন্ত নৃশংসভাবে শিশু দুটোকে হত্যা করে। অধ্যাপক দিলীপ কুমার মণ্ডল সেই হত্যাকান্ড সম্পর্কে লিখেছেন:
ঐ মহিলা এক দস্যুর নজরে পড়ে এবং দস্যুটি সেখানে ছুটে যায়। মহিলাটির কাছে টাকা-পয়সা সোনাদানা যা ছিল তা নিয়ে নেয়। সে দেখতে পায় বাচ্চা দুটি পুরুষ বাচ্চা। দস্যুটি ‘শত্রুর বীজ কোনো অবস্থায় রাখা যাবে না’ বলেই বাচ্চা দুটিকে ঐ মহিলার কোল থেকে কেড়ে নেয় এবং ঠ্যাং ধরে গাছের সাথে পরস্পর দুটি আছাড়ে ঐ মহিলার সামনে বাচ্চা দুটিকে মেরে ফেলা হয়। সে কী ভয়ানক করুণ দৃশ্য।
এক পর্যায়ে ঝোপঝাড় লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করা হয়। তাতে অসংখ্য নারী- পুরুষ-শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। অনেকে পানির পিপাসায় পুকুরের মধ্যে নামতে চেষ্টা করে পানির কাছাকাছি গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বিকেল ২টার দিকে খবর পাওয়ামাত্র রাজাকারদের প্রতিরোধ করতে লক্ষ্মীখালী গ্রামের দিকে রওনা হন। সাড়ে তিনটার দিকে গ্রামটির কাছাকাছি পৌঁছে তাঁরা দেখতে পান যে, রজ্জব আলীর বাহিনী চলে যাওয়ার পরও নিকটবর্তী গ্রামগুলো থেকে আগত লুটকারীরা লুটতরাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে লুটকারী ও ডাকাত সর্দার আকাব্বার শরিফ নিহত হয়। এছাড়া বাড়িটি থেকে আরো ২২ জন লুটকারীকে ধরে জিউধরা গ্রামের প্রান্তে গোড়ারহাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পথিমধ্যে তুচ্ছ একটি জিনিস নিয়ে বিদ্যমান দুই লুটকারীর পায়ে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করেন এবং তাদের সহযোগীদের ঘাড়ে তুলে দেন। যে ২২ জন রাজাকারকে গোড়ারহাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সারারাত ধরে তাদের জিকির করানো হয়। শাস্তি প্রদানের এই পদ্ধতিকে মুক্তিযোদ্ধারা তখন নাম দিয়েছিলেন ‘কলব ছাপ’।
মুক্তিবাহিনী চলে যাওয়ার পর দেপাল সাধুঠাকুর এবং ভূপাল সাধুঠাকুর বাড়িতে ফিরে আসেন। ইয়াকুব আলী মেম্বারের লাশ কাঁকড়াতলী গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। অন্য লাশগুলোকে একত্র করে একটি ছোট ডোবার মধ্যে গণকবরের ব্যবস্থা করা হয়। সব মিলিয়ে নিহতদের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। [১২৪] স্বরোচিষ সরকার
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত