রায়েন্দা অঞ্চলের গণহত্যা, বাগেরহাট
শরণখোলা থানা সদর রায়েন্দায় রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই পাকবাহিনী এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষ সদস্যদের হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা তাদের প্রথম অভিযান চালায় ৮ জুন মঙ্গলবার। রায়েন্দার রাজাকার বাহিনী ঐদিন বানিয়াখালী, নলবুনিয়া, বাধাল, মালশা, আমড়াগাছিয়া প্রভৃতি গ্রামের হিন্দু যুবকদের হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু আগে থেকে খবর পেয়ে ঐসব গ্রামের অধিকাংশ যুবক পালিয়ে আত্মরক্ষা করেননি, রাজাকাররা তাঁদের ধরে বাধাল রাস্তার মোড়ে এনে গুলি করে ও জবাই করে হত্যা করে। এসব হতভাগ্যের মধ্যে বাধাল গ্রামের যোগেশ সুতার, জহরলাল মিস্ত্রি, যশোদা বালা; আমড়াগাছিয়া গ্রামের গোপাল হালদার, বানিয়াখালী গ্রামের বিধান বালা এবং নলবুনিয়া গ্রামের বিমল গাইনের নাম জানা যায় এঁদের মধ্যে শেষোক্ত দুজনকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল।
কাছাকাছি সময়ে মালশা গ্রামের চান্দুয়া নামের এক মহিলাকে রাজাকাররা নির্মমভাবে হত্যা করে। রায়েন্দায় রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার পর চান্দুয়া রাজাকার ক্যাম্পে রান্না-বান্নার কাজ পেয়েছিলেন। অনেকের ধারণা চান্দুয়ার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ ছিল এবং গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট খবরাখবর সরবরাহ করতেন। সম্ভবত তেমন কোনো যোগসূত্র জানতে পেরে রাজাকাররা চান্দুয়াকে বাধাল রাস্তার মোড়ে অবস্থিত গাজীর ব্রিজের ওপরে তোলে। তারা সেখানে চান্দুয়ার শরীরের বিভিন্ন অংশ টুকরা টুকরা করে কাটে এবং মাথাটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে খালের মধ্যে ফেলে দেয়।
শরণখোলা থানায় দ্বিতীয় গণহত্যার ঘটনা ঘটে ২৪ জুন বৃহস্পতিবার আলী ফকিরের নেতৃত্বাধীন বাগেরহাটের রাজাকার বাহিনীর দ্বারা। ডাকরা ও লক্ষ্মীখালীতে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটনের পর ঐদিন তারা লঞ্চযোগে রাজাপুর গ্রামের পাশে ভোলা নদীর তীরে অবস্থিত বান্ধাঘাটের দক্ষিণে মোশাররফ তালুকদারের বাড়ির কাছে নামে। প্রথমে তারা রায়বাড়িতে ঢুকে সর্বানন্দ রায়কে গুলি করে হত্যা করে। জমাদ্দারের বাড়ি যাবার পথে সতীশ মণ্ডলকে মারে। তারপর তারা রাজাপুর বাজারে যায়। সেখানে মোট ১৬ জন পুরুষকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করে ছেড়ে দেয়। বাজারের দক্ষিণে মাঠে কাজ করছিলেন কুঞ্জবিহারি শিকদার, মহেন্দ্রনাথ হালদার, সুলতান মুন্সী প্রমুখ কৃষক। রাজাকাররা তাদের হত্যা করে পুনরায় লঞ্চে করে বাগেরহাটে ফেরে।
শরণখোলা থানায় তৃতীয় গণহত্যার ঘটনা ঘটে ২৫ জুন শুক্রবার রায়েন্দার পার্শ্ববর্তী কদমতলা গ্রামে রায়েন্দার রাজাকার বাহিনীর হাতে। ঐদিন তাঁরা ঐ গ্রামের অটলবিহারি কুলু, মনোরঞ্জন কুলু, ভোলানাথ হওলাদার, মহানন্দ সমাদ্দার, কলম সাধক, বিমল সাধক প্রমুখকে ধরে এবং গুলি করে হত্যা করে। কদমতলা গ্রামে অটল বিহারি কুলুর মা কৈলাসমণি কুলু পুত্রকে গুলি করার সময়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে রাজাকাররা তাঁকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রহার করে। সেই আঘাত এৰং পুত্রশোক— দুটো মিলিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে তিনিও মৃত্যুবরণ করেন।
রাজাকাররা তাদের চতুর্থ গণহত্যার ঘটনা ঘটায় ২৮ জুন সোমবার। ঐদিন তারা বিশাল এক লুটেরা বাহিনী নিয়ে রাজাপুর, রাজেশ্বর ও লাকুড়তলা গ্রামে অভিযান চালায়। সেদিন তারা রাজেশ্বর গ্রাম থেকে গোপাল হাওলাদার, ক্ষিরোদ কুলু, মনোহর কুলু, কুঞ্জ বেপারীকে রাজাপুর গ্রাম থেকে যতীন্দ্রনাথ এদেরকে গুলি করে হত্যা করে। হত্যা করার পর লাশগুলোকে রাজাকাররা নদীতে ভাসিয়ে দেয়, রীতি অনুযায়ী লাশগুলোকে কবর দেয়া বা দাহ করা সম্ভব হয়নি।
জুন মাসের মধ্যে এই ঘটনাগুলো এলাকায় খুবই আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ফলে ঐ এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন জুন মাসের শেষার্ধ থেকে ভারতে শরণার্থী হওয়ার জন্য দেশত্যাগ করতে শুরু করেন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে রায়েন্দার রাজাকার বাহিনী পুনরায় একটি বড় ধরনের গণহত্যার ঘটনা ঘটায়। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য রাজাকারদের এই সর্বশেষ আক্রমণের টার্গেট ছিলেন গ্রামবাসী সাধারণ মুসলমান।
সেদিন ছিল ১৩ নভেম্বর শনিবার। ঐদিন ভোররাতে রায়েন্দা থেকে আসা রাজাকার ও আলবদর বাহিনী সম্মিলিতভাবে রাজাপুর গ্রাম আক্রমণ করে। হানাদার বাহিনীর আক্রমণে সেদিন প্রায় ২০ জন সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান। রাজাকারদের একটি দল প্রথমে রাজাপুর গ্রাম থেকে নুরুজ্জামান আকন, আবদুল গনি আকন, মোজাম্মেল হক আকন, সেকেন্দার আলী খাঁ, মো. কাসেম হাওলাদার প্রমুখকে ধরে নিয়ে ওয়াপদা রাস্তার উপরে ওঠে। এ সময়ে সুন্দরবনের ভেতর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের উদ্দেশ করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। রাজাকাররা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাল্টা গুলি ছোড়ে ধৃত বন্দিদের ওপর, তাতে ধৃত সকলেই প্রাণ হারান। রাজাকারদের একটি দল আমড়াগাছিয়া নলবুনিয়া হয়ে ছুটু খাঁর বাজার দিয়ে রাজাপুর গ্রামের আঠারোগাতি এসে মিশেছে। এখানে ভাণ্ডারিয়া নিবাসী কয়েকজন কৃষকের কিছু জমি ছিল। তাঁরা রাজশাইল ধান মাড়াই করে শ্রীপুর খাল দিয়ে ধানবোঝাই নৌকা নিয়ে রায়েন্দার দিকে যাচ্ছিলেন। নৌকার ৮ জন যাত্রীর ৭ জনের বাড়ি ছিল ভাণ্ডারিয়া এবং রাজাপুর গ্রামের নেছার উদ্দিন তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। রাজাকাররা নৌকাটি ধরে এবং ৮ জনকেই গুলি করে হত্যা করে।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত