You dont have javascript enabled! Please enable it!

রামপুরা খাল বধ্যভূমি, নাটোর

নাটোর থেকে পাবনার পথে ১৩ মাইল দূরে বনপাড়া। রোমান ক্যাথলিকদের একটি মিশন রয়েছে এখানে। হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকে উপেক্ষা করে ভারতে আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে পাশের গ্রামাঞ্চল থেকে বহু সংখ্যক নর-নারী মিশনে আশ্রয় নেয়। উদ্দেশ্য ছিল এক রাত কাটিয়ে পরদিন ভারতের পথে পাড়ি দেয়া। সফল হয়নি সে পরিকল্পনা। ৩ মে ১৯৭১ কুখ্যাত পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মদ মাতাল মেজর শেরওয়ানী গোপনে খবর পেয়ে সমগ্র মিশন এলাকা ঘিরে ফেলে। সঙ্গে ছিল ধর্মান্ধ উন্মাদ অবাঙালি ধর্মীয় নেতা হাফেজ আবদুর রহমান। জল্লাদ আবদুর রহমান বিগত নয় মাসে নাটোরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম রেখেছিল লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে। মিশনের ফাদার পিনস এবং গ্যারলিরো সমগ্র মিশন এলাকা হানাদার বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। মেজর শেরওয়ানী ও হাফেজ রহমান একটি জিপে করে মিশনের গেটে থামলেন।
ফাদার পিনস ও গ্যারলিরো এগিয়ে যান। ক্রুদ্ধ মেজর শেরওয়ানী ব্যক্ত করল, তোমরা ভারতের দালালি করছ। পাকিস্তানের শত্রুদের আশ্রয় দিয়েছ। বিনা বাধায় আশ্রিত ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে যেতে না দিলে বলপ্রয়োগে বাধ্য করব।
ফাদার পিনস ও গ্যারলিরো প্রমাদ গুনলেন। শেরওয়ানীকে শান্ত করতে বৃথা চেষ্টা করলেন। আশ্রিত ব্যক্তিদের সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করে আঁতকে ওঠেন। শেরওয়ানী ও জল্লাদ আবদুর রহমানের পায়ে লুটিয়ে পড়েন। প্রাণভিক্ষা চাইলেন আশ্রিত সহায়-সম্বলহীন নারী-পুরুষের। মিশন কর্মকর্তাদের প্রতি ভয়ানক দুর্ব্যবহার করেছে আবদুর রহমান। বহুদিন থেকেই উক্ত নরপিশাচ নাটোরের মুসলিম সমাজে বিশেষ আসনে অধিষ্ঠিত, সমাদৃত। এমনকি হিন্দু ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের দ্বারাও সম্মানিত। ধর্মের কাল্পনিক নেশায় বুঁদ হয়ে এই জল্লাদ অসংখ্য নর-নারীর প্রাণ ও মান হরণ করেছে। ফাদার পিনস শত বিনয়-অনুনয় করেও আবদুর রহমানকে তার পৈশাচিক সিদ্ধান্ত থেকে বিন্দুমাত্র পিছপা করতে ব্যর্থ হলেন। নিরুপায় ফাদার পিনস বললেন, আপনারা মিশনে ঢুকতে পারেন, তবে কোনো অবস্থাতেই গির্জার পবিত্রতা লঙ্ঘন করবেন না। মানবতার প্রাণকেন্দ্র গির্জায় আপনার সৈন্য দল যেন প্রবেশ না করে। ফাদারের অনুরোধ সম্পূর্ণরূপে পালিত হয়নি। মিশনের বিভিন্নাংশ থেকে খানসেনারা ধর্মীয় ছবিগুলো ভেঙে ফেলে। মিশনের পবিত্রতা লঙ্ঘন করে হানাদার পশুরা মিশনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে এক করুণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। …
মিশনের দক্ষিণাংশে দ্বিতল ছাত্রী আবাস। অসহায় নর-নারী এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। ওরা সর্বহারা। লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগে ব্যতিব্যস্ত। কেবল জৈবিক প্রাণটিকে বাঁচাবার তাগিদেই আশ্রয় নিয়েছিল মিশনে। কিন্তু এ যে চোরাবালি। রক্ষা ওরা কেউই পায়নি, হায়নাদের রক্তপিপাসা মিটিয়েছে মাত্র।
বিভোর রক্তপায়ী হায়েনার দল। ফাদার পিনস কেঁদে ফেললেন। মেজর শেরওয়ানীকে পুনরায় বললেন, আপনি আমাকে হত্যা করুন। নির্দোষ এই অসহায় নর-নারীর প্রাণ বৃথা হরণ করবেন না। কঠোরভাবে ফাদার পিনসকে শাসিয়ে দিল শেরওয়ানী। পৈশাচিক উন্মাদনায় ব্যক্ত করল, কোনো ধর্ম নাই ওদের। তাই বাঁচার অধিকারও তাদের নেই। বিক্ষিপ্ত ভীত নিষ্পাপ নারী-পুরুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল খানসেনারা। বেঁধে ফেলল একত্রে। বুটের নিষ্পেষণ, রাইফেলের বাঁট, সঙ্গিনের ! তীক্ষ্ণ খোঁচা অসহ্য। মুমূর্ষু ওরা। ফাদার গ্যারলিরো হাফেজ আবদুর রহমানকে অনুরোধ করলেন অন্তত নারীদের অব্যাহতির জন্য। সফল হলো না প্রচেষ্টা। কয়েকজন পুরুষ দেয়াল টপকিয়ে পালাবার চেষ্টা করে। দুর্ভাগ্য। দেয়ালের ওপারে অপেক্ষা করছিল নরপশুর রক্ত-তৃষ্ণার্ত সূচ্যগ্র সঙ্গীন। ঠিক কতজন এভাবে প্রাণ হারিয়েছেন, জানা যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শী একজন সিসটারের মতে, দেয়াল টপকানো ২০ ব্যক্তিকে রক্তরঞ্জিত দেহ, মৃত ও প্রায় মৃতাবস্থায় ট্রাকে উঠানো হয়েছে। অবৈধভাবে আটককৃত ব্যক্তিদের চোখ ও হাত বেঁধে দেয়া হয় পরনের কাপড় ছিঁড়ে। বলপূর্বক সবাইকে ওঠানো হলো তিনটি ট্রাকে। খানসেনা পরিবেষ্টিত মৃত্যুপথযাত্রী ওরা। কেউই রক্ষা করতে পারেনি।
মিশনের উত্তরাংশের ছাত্রাবাসে তিনজন শিক্ষক অবস্থান করছিলেন। ভুল করে ছেড়ে যায় ওদের। অপর দুজন মিশনের সিসটার কোয়ার্টারে আত্মগোপন করে। খানসেনারা ব্যাপক তল্লাশি চালায়। প্রতিটি গৃহ তছনছ করে। বুদ্ধিমতী দুজন সিসটার কিচেনে প্যাকিং বক্স-এ লুকিয়ে থাকেন। খানসেনারা তাদের নাগাল পায়নি। হাফেজ আবদুর রহমান জাতে বিহারি। ধর্মীয় নেতা হয়েও অহসায় নিষ্পাপ নর-নারী ও শিশু আর্তনাদে কর্ণপাত করেনি। টলেনি তার ভণ্ড হৃদয়। প্রত্যক্ষ গণহত্যায় লিপ্ত ছিল এই ধর্মান্ধ জল্লাদ। অপর একজন সিসটার প্রত্যক্ষ করেছেন, উপরোক্ত ২০ ব্যক্তি ছাড়াও ৮৫ জন নারী-পুরুষকে ট্রাকে উঠানো হয়। অবশ্য একটি ট্রাক থেকে একজন অশীতিপর বৃদ্ধাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ট্রাকগুলো গোঁ গোঁ শব্দে বুনো উল্লাসে মিশন ছেড়ে যায়। অসহায় নর-নারী ও শিশুর আর্তচিৎকারে সমগ্র মিশন এলাকা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ফাদার গ্যারলিরো গভীর মর্মাহত হলেন। এই ঘটনা তার হৃদয়ে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। চিন্তাশক্তি লুপ্ত হয়েছে। কয়েক দিন পরই ফাদার গ্যারলিরোর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। তাঁকে ইতালিতে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
মেজর শেরওয়ানী ও জল্লাদ আবদুর রহমান বনপাড়া মিশনে আটককৃত ব্যক্তিদের নিয়ে আসে দোয়াতপাড়া গ্রামে। নাটোর থেকে তিন মাইল পশ্চিমে 1 ইতিপূর্বে জনৈক দস্যু ক্যাপ্টেন নলবাতা এবং গোকুলনগর থেকে আরও ৬০ জন মুসলমান ও হিন্দু ব্যক্তিকে নিয়ে আসে একই স্থানে। জ্যোৎস্না রাত। সময় ৮ ঘটিকা। চারদিকে নিস্তব্ধ। পাশের গ্রামগুলোর নর-নারী ও শিশু সেনাবাহিনীর ৬- ৭টি গাড়ি একত্রে দেখে আতঙ্কে ঘর-বাড়ি ফেলে ঝোপ-ঝাড় ও পানির খালে আশ্রয় নেন। এজিদ আবদুর রহমান নিকটবর্তী গ্রামে প্রবেশ করে জমির উদ্দীনসহ ৮ ব্যক্তিকে কোদাল এবং মাটি কাটা ডালি (ঝুড়ি) নিয়ে আসতে বাধ্য করে।
জমিরুদ্দিন (৩৩) বেঁচে আছে। গ্রাম্য কৃষক। প্রত্যক্ষ করেছে স্বচক্ষে কী করে ঐ রাতে খানসেনারা নির্দয়ভাবে ১৫৭ জন নর-নারীকে হত্যা করেছে। দোয়াতপাড়ার অর্ধমাইল দক্ষিণে বড়াই গ্রামে সড়কের দুধারে দুটি খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে। ওরাও প্রত্যক্ষ করেছে নিষ্ঠুর হত্যালীলা। অদূরে একটি ছাইতন গাছ। গাছটিকে বাঁয়ে ফেলে প্রবাহিত হয়েছে রামপুরা খাল। এই খালেই বহু নর-নারীকে হত্যা করেছে হিংস্র হায়েনার দল। জমিরুদ্দিন অপর সাতজনসহ বোবার মতো দাঁড়িয়ে দেখছিল নর-পশুদের হত্যালীলা। প্রথমে তিনজন লোককে ট্রাক থেকে নামানো হলো। ওদের হাত পরস্পর বাঁধা। বাঁধন খুলে দিল। মৃত্যুভয়ে তিনজন একত্রে সড়কের বাঁ দিকে লাফিয়ে নেমে দৌড়াতে থাকে। পূর্বে বৃষ্টি হওয়ায় চারদিকে পানি কিংবা কাদায় পরিপূর্ণ ছিল। খানসেনারা পিছু নিতে ভয় পায়। জমিরুদ্দিন ও অপর দুই ব্যক্তিকে নির্দেশ দেয়া হয় পলাতকদের ধরে আনতে। জমিরুদ্দিন বাধ্য হয়ে পিছু নেয়। ততক্ষণে বনের পাখি খাঁচার বাইরে মুক্ত। নির্মল নীল আকাশ। ট্রাক থেকে নামিয়ে আর কাউকেই বাঁধনমুক্ত করা হয়নি। ট্রাক থেকে দুজন করে একত্রে নামানো হলো। দুজন খানসেনা রাইফেলের বাঁট ও সঙ্গিন দিয়ে নির্যাতন চালায় ওদের ওপর। ওদের কোনো আর্জিই জল্লাদদের হৃদয়ে বিন্দুমাত্র করুণার উদ্রেক করেনি। কত কাকুতি-মিনতি। কিন্তু কে শোনে। হাফেজ রহমান দণ্ডায়মান। নিরীহ মানুষগুলোর ওপর অকথ্য অত্যাচার এই নরপশুর হৃদয়ে নাটকীয় আনন্দের সৃষ্টি করে। অর্ধমৃতাবস্থায় এবার খালের দিকে নিয়ে যায় অপর দুজন খানসেনা বলপূর্বক। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ওরা মরিয়া হয়ে চিৎকার করতে থাকে। দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় খালের ভেতর। একজন জল্লাদ টর্চের কৃত্রিম আলো নিক্ষেপ করে ওদের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে গুলি চালায় দুজন খানসেনা। নিস্তব্ধ তাদের কণ্ঠ। চিরতরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে খালে। এমনি নৃশংসভাবে সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাপর্ব সমাপ্ত। এজিদ আবদুর রহমান জমিরুদ্দিনকে কঠোর ভাষায় জানিয়ে দিল, যদি একটি মৃতদেহ অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়, সমগ্ৰ গ্ৰাম ভস্মীভূত হবে আগুনে। তোমাদের অবস্থাও অনুরূপ হবে।
অপর সাতজনসহ জমিরুউদ্দিন মাটি কেটে মৃতদেহগুলো ঢেকে দিতে উদ্যত হয়। কিন্তু একি! পানি চাইছে আহত কয়েকজন হতভাগ্য আদম সন্তান। ওরা মরেনি। রক্তাক্ত দেহ। জমিরুদ্দিন কান্নায় ভেঙে পড়ে। হাফেজ রহমান ও শেরওয়ানী বাধ্য করে জীবন্ত মুমূর্ষু মানুষগুলোকে মাটিচাপা দিতে। হৃদয়বিদারক দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে জমিরের কণ্ঠ বাষ্পায়িত। অত্যন্ত পৈশাচিক। মাটিচাপা পড়ে জীবন্ত আহত ব্যক্তিগণ বাঁচার প্রচেষ্টা চালায়। হাত দিয়ে মাটি সরাতে থাকে। মাটির ওপর কম্পন অনুভূত হয়। দুর্ভাগ্য। জল্লাদেরা পুনরায় মাটিচাপা দেয়। এভাবে মাটিচাপা দিয়ে জীবন্ত ব্যক্তিদের বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করে দেয়া হয়।
[৩৫৪] সুকুমার বিশ্বাস

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!