You dont have javascript enabled! Please enable it!

রমনা কালীমন্দির গণহত্যা, ঢাকা

২৫ মার্চের কালোরাত্রে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পর ২৬ মার্চ সকাল এগারোটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথম মন্দির ও আশ্রম অঙ্গনে প্রবেশ করে। তারা মন্দির ও আশ্রমবাসীদের মন্দির থেকে না বেরোনোর জন্য বলে যায়। এ সময় পুরনো ঢাকা থেকে সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগ প্রার্থী এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অন্যতম দোসর খাজা খয়েরউদ্দিনকে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে দেখা গেছে। ২৭ মার্চ গভীর রাতে রমনায় ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড প্রধানত তারই উদ্যোগে সংঘটিত হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সহযোগীদের নিয়ে ২৭ মার্চ রাত দুটোর দিকে সান্ধ্য আইন চলাকালীন রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ঘেরাও করে। সেনাবাহিনীর সার্চলাইটের আলোয় গোটা রমনা এলাকা আলোকিত হয়ে যায়। এরই মধ্যে শুরু হয় গোলাবর্ষণ। রমনা কালীমন্দিরে ঢুকে পাকিস্তানিরা মূর্তির দিকে এক ধরনের বিস্ফোরক ছুড়ে দেয়। অবশ্য কারো কারো মতে গোলাবর্ষণ করা হয়। ফলে মূর্তিসহ মন্দিরের পেছনের অংশ উড়ে যায়। পরে মন্দির ও আশ্রম ধ্বংস করা হয়।
মন্দির ও আশ্রম এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাতকরা ঢোকার সময় অনেকে ঘুমিয়ে ছিলেন, কেউ কেউ উৎকণ্ঠায় জেগে ছিলেন। কয়েকটি পরিবারে তখনো রাতের খাবার চলছিল। এই সময় আচমকা পাকিস্তানি বাহিনী হানা দিলে প্রাণভয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। মেয়েরা শাঁখা খুলে ফেলেন, সিঁন্দুর মুছে ফেলেন। মন্দির ও আশ্রমের বিভিন্ন স্থানে অনেকে লুকিয়ে পড়েন। পাকিস্তানি সেনারা বন্দুকের মুখে তাঁদের খুঁজে বের করে এবং মন্দিরের সামনে এনে দাঁড় করায়। পুরুষদের এক লাইনে এবং মহিলা ও শিশুদের অন্য লাইনে দাঁড় করানো হয়।
পাকিস্তানি সেনারা সবার সামনে রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে কলেমা পড়তে বাধ্য করে এবং তারপরেই পেট বেয়নেট দিয়ে ফেঁড়ে তাঁকে হত্যা করে। এভাবে আরও অনেককে কলেমা পড়িয়ে হত্যা করা হয়। কুৎসিত আনন্দ-উল্লাস করতে করতে পাকসেনারা বলে, নৌকায় ভোট দেয়ার মজা বোঝ এবার। এরপর বাকি পুরুষদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। সাক্ষ্য- বক্তব্যে জানা যায়, এখানে প্রায় ৮৫ থেকে ১০০ জনকে হত্যা করা হয়। ভয়াল এ দৃশ্য দেখে মহিলাদের আর্তচিৎকার আরম্ভ হলে তাঁদের বন্দুক দিয়ে পেটানো হয়। এতে অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পাকিস্তানিরা মৃতদেহগুলো জড়ো করে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আহতদের অনেকে এতে পুড়ে মারা যান। সাক্ষ্যে কয়েকজন মহিলা ও শিশুর পুড়ে মারা যাবার কথা বলা হয়েছে। পাকসেনারা দুজন যুবককে ধরে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করে এবং মুখের ভেতর গুলি করে তাদের হত্যা করে।
আশ্রম ও মন্দিরের গোয়ালে প্রায় ৫০টির মতো গরু ছিল, গরুগুলোকেও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। ভয়াবহ আগুন, গোলাগুলি, মাংসপোড়া গন্ধ ও ভয়ার্ত চিৎকারে গোটা রমনা এলাকায় এক নারকীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী রমনা অপারেশন শেষ করে ভোর চারটার দিকে ফিরে যাবার সময় লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা মহিলাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়নি। এদের সংখ্যা প্রায় এক ডজন বলে সাক্ষ্যদাতাদের কয়েকজন জানিয়েছেন। পাকিস্তানিরা রমনা ত্যাগ করার আগে নির্দেশ দেয়, যাদের বাঁচিয়ে রাখা হলো তারা যেন পরদিনই
ভারতে চলে যায়।
মন্দিরের পুরোহিত স্বামী পরমানন্দ গিরি মন্দির ও আশ্রমবাসীদের বরাভয় দিয়েছিলেন, পবিত্র ধর্মস্থান নিরাপদ। এখানে কোনো হামলা হবে না। তিনি বুঝতে পারেননি ‘৭১-এ বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মসজিদ যেমন রক্ষা পায়নি- মঠ, মন্দির, গির্জাও রক্ষা পেতে পারে না।
রমনা কালীমন্দির গণতদন্ত কমিশনের নিকট প্রদত্ত কয়েকজনের জবানবন্দির কিছু কিছু এখানে তুলে ধরা হলো :
রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে সে সময়ে বসবাস করতেন কমলা রায়। তিনি কমিশনকে বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী চারদিক ঘিরে ফেলার পর মেয়েরা প্রাণভয়ে কপালের সিঁদুর মুছে ফেলেন এবং হাতের শাঁখা খুলে ফেলেন। পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা আলাদা করে লাইনে দাঁড় করানো হয়। তারপর পুরুষদের গুলি করলে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অনেকে আধমরা অবস্থায় ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনী মৃত ও অর্ধমৃতদের জড়ো করে এবং ঘরের বেড়া তাদের ওপর ফেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। কয়েকটি শিশু ভয়ে চিৎকার করে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল দেখে পাকিস্তানি সেনারা ওদের আগুনে ছুড়ে ফেলে পুড়িয়ে মারে।
অপর বাসিন্দা শংকর লাল ঘোষ বলেন, রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে পাকিস্তানিরা জিজ্ঞেস করে, তিনি হিন্দু না মুসলমান। পরমানন্দ হিন্দু ও এই মন্দিরের পুরোহিত বলে নিজের পরিচয় দিলে তাঁকে জোর করে কলেমা পড়ানো হয় এবং পরে বেয়নেট দিয়ে পেট ফেঁড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
স্ত্রী হারা রঘুবীর চৌহান বলেছেন, আমার ঘরে পাকিস্তানিরা আগুন লাগিয়ে দিলে আমি ও আমার ছেলে পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে গেলেও আমার স্ত্রী বেরোতে পারেননি। তিনি আগুনে পুড়ে মারা যান।
স্বামীহারা গেনিয়া দাস বলেন, আমার স্বামী রঘুলাল দাসকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা লাইনে দাঁড় করাল। আমার স্বামীকে পাকিস্তানিরা জিজ্ঞেস করে তুমি কী খাবে? আমার স্বামী সিগারেট খেতে চাইলে তাকে সিগারেট দেয়া হয়। সিগারেট শেষ হওয়ার পর গুলি করে হত্যা করা হয়।
পিতৃহারা লক্ষ্মী রানী ঠাকুর জানান, ২৫ মার্চ রাতে তার বাবা কিশোরী ঠাকুর তাকে দেখতে এসেছিলেন। কিশোরী বাবুর বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। তিনি লক্ষ্মী রানীকে বিয়ে দেন ঢাকায়, স্বামীর সঙ্গে লক্ষ্মী রমনা মন্দিরে থাকতেন। ২৭ মার্চ পাকিস্তানিরা কিশোরী বাবুকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে লাইনে দাঁড় করায় এবং গুলি করে হত্যা করে। পরে তার লাশ আগুনে ফেলে দেয়া হয়।
দৈনিক ইত্তেফাকের সহ-সম্পাদক আহসানউল্লাহ গণতদন্ত কমিশনে প্রদত্ত সাক্ষ্যে বলেছেন, রমনার ধ্বংসযজ্ঞের তিন দিন পর আমি সেখানে এসে আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের স্তূপীকৃত কঙ্কালের পাশাপাশি প্রায় ১৪টার মতো বিকৃত লাশ দেখতে পাই। সেগুলো ফুলে পচা গন্ধ বেরিয়েছিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির ও আশ্রমের ভেতরেও আরও ১০টির মতো লাশ দেখতে পাই।
রমনার কালীমন্দিরের অদূরে শাহবাগ মসজিদের খাদেম প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল আলী ফকির বলেছেন, রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা শুরু করার পর সবাইকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা হু’ বলতে বলে। লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো পুরুষ-মহিলা সবাই তা সমস্বরে উচ্চারণ করেন। এরপরই গুলি করা হয়।
রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে একাত্তরের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলায় নিহত শহীদদের তালিকা-
১. শ্রীমৎ স্বামী পরমানন্দ গিরি, ২. রঘুলাল দাস, ৩. ধীরেন লাল ঘোষ, ৪. শ্রীমতী লক্ষ্মী চৌহান, ৫. হীরালাল পাশী, ৬. বাবুলাল, ৭. সূর্য, ৮. রামগোপাল, ৯. সন্তোষ ঘোষ, ১০. সুনীল ঘোষ, ১২. রাম বিলাস দাস, ১৩. জয়ন্ত চক্রবর্তী, ১৪. বিরাজ কুমার, ১৫. ভোলা পাশী, ১৬. বাবুলাল দাস, ১৭. গণেশ চন্দ্ৰ দাস, ১৮. সরযু দাস, ১৯. বসন্ত মালী, ২০. শৈবল্লি, ২১. রমেশ চন্দ্র বর্মণ, ২২. সুরত বল্লি, ২৩. কিশোরী ঠাকুর, ২৪. রঘুলাল ঘোষ, ২৫. বারিক লাল ঘোষ, ২৬. বাবুল দাস ধ্রুপতি, ২৭. বাদল চন্দ্র রায়, ২৮. রবি দাস, ২৯. ত্রিদিব কুমার রায়, ৩০. রামপতি, ৩১. শিব সাধন চক্রবর্তী (সাংবাদিক), ৩২. পুরণ দাশ, ৩৩. মানিক দাস, ৩৪. বিভূতি চক্রবর্তী, ৩৫. নান্দুলাল, ৩৬. সরোজ, ৩৭. রাজকুমার, ৩৮. গণেশ মুচি, ৩৯. মুখার্জি, ৪০. সুরুজ বল্লি, ৪১. রঘুরাম, ৪২. বরজ রাম কানু ৪৩. বালোয়া, ৪৪. সরযু তাঁতি, ৪৫. বলিরাম, ৪৬. অনু ধোপা, ৪৭. রমেশ ধোপা, ৪৮. বাবু নন্দন, ৪৯. সমীর সরকার, ৫০. হিরুয়া।
[৫০৮] সংকলন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!