মোল্লাহাট গণহত্যা, বাগেরহাট
১০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার পিরোজপুর জেলার মাটিভাঙ্গা কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক প্রতুলচন্দ্র কর্মকার পরিবার-পরিজনসহ বাগেরহাটের মোল্লাহাটের পাশ দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে মোল্লাহাটের রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। দলটির পুরুষ সদস্যদের হত্যা এবং নারী সদস্যদের ওপর নানা রকম নির্যাতন চালানো হয়।
প্রতুলচন্দ্র কর্মকারের আত্মীয়-স্বজনরা মিলে দুটি ঘাসি নৌকা জোগাড় করে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। দ্বিতীয় নৌকাটি যখন মোল্লাহাট বাজারের কাছে মধুমতী নদী দিয়ে যাচ্ছিল, তখন মোল্লাহাটের রাজাকার বাহিনীর তা চোখে পড়ে। নৌকাটিকে তীরে ভেড়াতে বাধ্য করা হয়। এই নৌকায় সতীন্দ্রনাথ কর্মকার, মনীন্দ্রনাথ কর্মকার এবং অহীন্দ্রনাথ কর্মকারের পরিবার ছিল। এছাড়া প্রথম নৌকার সুনীল কর্মকার তাঁর শ্যালক কার্তিক কর্মকার এবং সতীন্দ্রনাথের প্রতিবেশী কেশব কর্মকার তাস খেলতে কিছু সময়ের জন্য দ্বিতীয় নৌকায় এসেছিলেন। মাঝিরা ছাড়া ঐ দুজনকে ধরে নৌকাটির যাত্রী সংখ্যা ছিল মোট ১৬ জন। এর মধ্যে ১৩ বছরের বেশি বয়স্ক পুরুষ সদস্য ছিলেন ৮ জন, বাকিরা মহিলা ও শিশু। বহরের সকলেই ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের এবং সকলের জাত-ব্যবসা ছিল সোনা- রূপার কাজ। এঁদের সঙ্গে প্রচুর নগদ অর্থ এবং স্বর্ণালঙ্কার ছিল।
নৌকাটি তীরে ভেড়ানোর পর রাজাকাররা নৌকা থেকে যাবতীয় স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ হস্তগত করে, তারপর নৌকার সকল যাত্রীকে প্রথমে রাজাকার ক্যাম্পে এবং পরে মোল্লাহাট থানায় সোপর্দ করে। একজন সিন্ধি পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন তখন মোল্লাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সহকারী পুলিশ ইন্সপেক্টরের (জমাদ্দার) বাসভবন খালি থাকায় সেখানকার দুটি আলাদা ঘরে পুরো পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
মনীন্দ্রনাথের কিশোরী কন্যা অনুভার ওপর সিন্ধি দারোগার চোখ পড়ে। রাজাকারদের পক্ষ থেকে বলা হয়, অনুভাকে দারোগার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি থাকলে দলটিকে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এরপর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে রাজাকারদের বিশেষ উৎসাহে অনুভাকে দারোগার কোয়ার্টারে তুলে দেয়া হয়।
কথা অনুযায়ী দলের সকলের জন্য রিলিজ লেটার তৈরি হয়। দলটি নৌকায় ওঠার জন্য যখন নদীর তীরে জড়ো হয়েছে, ঠিক সেই সময়ে মওলানা ওলিউল্লাহর নেতৃত্বে একদল রাজাকার সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে দলটিকে ঘিরে ফেলে। মুহূর্তের মধ্যে পুরুষ সদস্যদের আলাদা করে ফেলা হয়। একজন রাজাকার সতীন্দ্রনাথকে নদীর খুব নিকটে নিয়ে একটি সিগারেট খেতে দেয় এবং ধূমপানরত সতীন্দ্রনাথকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করে। মুহূর্তের মধ্যে মনীন্দ্রনাথ তার কোলের শিশুপুত্রকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এবং রাজাকারদের বেষ্টনী ভেদ করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন এবং রাজাকারদের গুলি উপেক্ষা করে নদী সাঁতরে ওপারে চলে যেতে সক্ষম হন। এ সময়ে রাজাকাররা দলের অবশিষ্ট পুরুষ সদস্যদের দড়ি দিয়ে বেঁধে মোল্লাহাটের উত্তরে উদয়পুর গরুর হাটের পার্শ্ববর্তী একটি ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে তারা একে একে ছয়জনকে জবাই করে হত্যা করে।
এ সময়ে দলের মহিলা ও শিশু সদস্যরা কান্নাকাটি শুরু করতে থাকলে অন্যতম রাজাকার সুফি সাহেব এবং তাঁর পুত্র তাদের জন্য বলেন, কোনো ব্যবস্থা হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা যেন উদয়পুরে তাদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। অগত্যা ৬ জন অসহায় মহিলা ও শিশুকে নিয়ে উদয়পুর সুফি সাহেবের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। মাটিভাঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ নাসিরউদ্দিন সাহেব খবর পেয়ে লোক পাঠানোর আগ পর্যন্ত প্রায় দুই সপ্তাহ নাগাদ তাদের ঐ বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। নাসির উদ্দিন সাহেব তখন নিয়মিতভাবে তাঁদের খোঁজখবর নিতেন এবং অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা করতেন।
উদয়পুর থাকার সময়ে গোলাপ রানী কর্মকার একবার থানায় এসে সিন্ধি দারোগা এবং অনুভার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। দারোগা তাঁকে বলেছিলেন যে, পরিস্থিতি শান্ত হলে অনুভাকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করবেন এবং তখন তাঁদের দাওয়াত করা হবে।
অনুভাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা এবং তাঁকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন থানা মসজিদের ইমাম মওলানা ফজলুর রহমান। থানায় একদিন বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়। বিয়ে পড়ান অন্যতম রাজাকার মওলানা কাসেম, তাঁকে ৪০০ টাকা বকশিশ দেয়া হয় এবং অনুভাব ওস্তাদ মওলানা ফজলুর রহমান পান ১৫০ টাকা। পয়লা ডিসেম্বর সিন্ধি দারোগা বেতন তুলতে খুলনা যান, অনুভাকে সেদিন তিনি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, পরে আর মোল্লাহাটে ফিরে আসেননি।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত