You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তাগাছা নির্যাতন, গণহত্যা ও বধ্যভূমি, ময়মনসিংহ

মুক্তাগাছা পাকবাহিনীর করাল ধ্বংসযজ্ঞ থেকে অব্যাহতি পায়নি। মুক্তাগাছার বুকে পাকবাহিনীর সীমাহীন নৃশংস গণহত্যাও ধ্বংসযজ্ঞের অগণিত ঘটনার মাঝ থেকে মাত্র কয়েকটি ঘটনা হলো-
মধুপুর বনাঞ্চলে মুক্তিকামী জনতার প্রতিরোধ পেরিয়ে পাকবাহিনী অগ্রসর হতে না পেরে এ প্রতিরোধকে পাশ কাটিয়ে ‘৭১-এর ২৩ এপ্রিল জামালপুর হয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে মুক্তাগাছায় প্রবেশ করে। সেদিন শুক্রবার বেলা ১২টার দিকে জিপ ও ট্রাকের বিশাল কনভয় নিয়ে পাকবাহিনী দখল করে নেয় মুক্তাগাছা। মুক্তাগাছায় প্রবেশ করার সময় রাস্তার দু পাশের লোকালয়ের ওপর পাকবাহিনীর কনভয় থেকে অবিরল গুলিবর্ষণে এবং মুক্তাগাছা শহরের হিন্দুপ্রধান বিভিন্ন এলাকাসহ জমিদার বকুল বাবুর বাড়িতে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণে শহীদ হন অনেকে। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন মুক্তাগাছা শহরের লক্ষ্মীখোলার মনিরুদ্দিন, টানবাজারের সুরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ ও অমিয়বালা সাহা।
আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রতিরোধ সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক বাবু শিশির কুমার রক্ষিতের সন্ধানে পাকবাহিনী ২৫ এপ্রিল তাঁর গ্রাম মুজাটিতে আক্রমণ চালিয়ে তাঁকে না পেয়ে তাঁর অসুস্থ ভাই সুবোধ বাবুসহ ৬ জনকে ধরে ফেলে এবং রক্ষিত বাড়িসহ আশপাশের বাড়িগুলিতে লুটপাট করার পর আগুন লাগিয়ে দেয়। ফেরার পথে ধৃত ৬ জনের মধ্যে পরেশ দাস, ব্রজেন দাস, হরিদাস বৈরাগী ও বসুয়াকে নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করে। সুবোধ বাবু ও দীনেশ ভাটকে নিয়ে যায় ধনবাড়ি ক্যাম্পে এবং ২-৩ দিন নৃশংস অত্যাচার করে সুবোধ বাবুকে হত্যা করার পর মোটর মেকানিক দীনেশ ভাটকে দিয়ে গাড়ি মেরামত করিয়ে ছেড়ে দেয়। একই দিনে ধরগ্রাম ও গাবতলী ঋষিপাড়ায় লুটপাটের পর আগুন লাগিয়ে দেয়।
২৮ এপ্রিল গভীর রাতে পাকবাহিনীর স্থানীয় সহযোগীরা মুজাটী গ্রামে শ্রীশ চন্দ্র দেব-এর বাড়িতে হামলা চালায় এবং শ্রীশ বাবু ও তাঁর বড় ছেলেকে হত্যা করে। এদের গুলিবর্ষণে শ্রীশ বাবুর স্ত্রী-কন্যা, ভাইসহ অনেকেই মারাত্মক আহত হন। চলে যাওয়ার আগে অবশ্য এরা যথারীতি লুটপাট চালানোর কথা ভোলেনি।
১৩ মে সকালে পাকবাহিনী মুক্তাগাছা শহরের চৌরঙ্গী মোড় থেকে মিছরিয়া হরিজনকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন বিকেলে পাথালিয়া গ্রামে ব্রজগোপাল দত্তের বাড়িতে হামলা চালিয়ে মুক্তাগাছার অন্যতম জমিদার বকুল আচার্য্য চৌধুরী তাঁর নেপালি দেহরক্ষী অমর বাহাদুর রানা ও মুক্তাগাছা পৌরসভার সচিব ত্রৈলোক্যনাথ সরকারকে ধরে ফেলে এবং লুটপাট করার পর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
জমিদার বকুল বাবু ২৩ এপ্রিল তাঁর ম্যানেজার ব্রজগোপাল দত্তের বাড়িতে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একই দিনে পাকবাহিনী গাবতলী বাজারের বাসা থেকে ব্যবসায়ী নকুল চন্দ্র দেকে ধরে নিয়ে যায় ও ভিটাবাড়ি গ্রামে আশ্রয় নেয়া লোকজনের ওপর আক্রমণ চালানোর উদ্যোগ নিয়েও রাস্তা খারাপ থাকায় ব্যর্থ হয়। সেদিন পাকিস্তানিদের হাতে আটক এই ৫ জন আর আত্মীয়-পরিজনদের মাঝে ফিরে আসতে পারেননি। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছেন।
২৩ মে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা শ্রীপুর মাজিহাটি গ্রামে হামলা চালিয়ে অন্য জায়গা থেকে ধরে আনা পাঁচ যুবককে দাস বাড়ির ঘরের ভেতর বেঁধে ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারে। এ আগুনে দাস বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অবশ্য এর আগে পাকবাহিনী ও সহযোগীরা তাদের অন্যতম নিত্যকর্ম লুটতরাজ চালাতে ভোলেনি। এই নির্মম হত্যার শিকার এই পাঁচ যুবকের নাম পরিচয় আজও জানা যায়নি। মে মাসের শেষ দিকে পাকবাহিনী ও সহযোগীরা বিলসিংনা গ্রামে ব্যাপক লুটতরাজ ও নির্যাতন চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।
আষাঢ় মাসে পাকবাহিনীর সহযোগীরা মুজাটি গ্রামে ভাটবাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে লুটতরাজ ও আগুন লাগানোর পর প্রখ্যাত মোটর মেকানিক দীনেশ ভাট ও সে বাড়িতে আশ্রয় নেয়া যতীন মোদককে গুলিতে আহত করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। কালিবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে সুবোধ বাবুর বাসা পারুলীতলা গ্রামের আলহাজ জহর উদ্দিন সরকারের বাড়িসহ কালাঘোগা গ্রামে ব্যাপক লুটতরাজ ও আগুন লাগিয়ে কুমুদ বাবু ও দামু বাবুকে হত্যা করে।
আষাঢ় মাসের শেষ দিকে পাকবাহিনী ও সহযোগীরা তারাটি তেরী পাড়ায় হামলা চালিয়ে লুটপাট করার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বনবিহারি বাবুসহ চারজনকে নৃশংস নির্যাতন করে শিরোখালী নদীতে নামিয়ে গুলি চালালে বনবিহারি বাবুসহ তিনজন নিহত হলেও আত্মীয় বাড়িতে আগত অনিল চন্দ্র দে তরফদার নদীর বড় কচুরিপানার আড়ালে ডুবসাঁতার দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও আবারো ধরা পড়লে আত্মীয়স্বজনেরা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁর প্রাণ রক্ষা করে। এই আক্রমণ চালাতে যাওয়ার পথে তারা হত্যা করে বিকৃত মস্তিষ্ক ভরত রাজভরকে।
মুক্তাগাছার বুকে হানাদার বাহিনীর অগণিত গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্যে নৃশংসতম মর্মন্তুদ ঘটনা হচ্ছে বিনোদবাড়ি মানকোণগ্রামের গণহত্যা। শ্রাবণের কোনো এক সোমবার বেলা ১১টার দিকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে গ্রামবাসী যখন প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত তখন পাকবাহিনী ও সহযোগীরা গ্রামের বাজারে প্রবেশ করলে অনেকে আশ্রয় নেয় গ্রামের মোক্তার বাড়িতে এবং অন্যরা পার্শ্ববর্তী দড়িকৃষ্ণপুর ও বলরামপুরের গ্রামবাসীদের সাথে গ্রামের ঝোপঝাড় ও ধানক্ষেতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু লুটপাট ও আগুন লাগানোর পর মোক্তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া গ্রামবাসীদের বের করে এনে হত্যা করে ও ঝোপঝাড়, ধানক্ষেতে নির্বিচার অবিরাম গুলি চালিয়ে নারী, শিশু নির্বিশেষে অগণিত গ্রামবাসীকে হত্যা করে স্তব্ধ করে দেয় গ্রামের জীবনধারা। মায়ের আহাজারি, শিশুর কান্না, বৃদ্ধের আর্তনাদ রোধ করতে পারেনি নরপশুদের এ হত্যাযজ্ঞকে। এক নিমেষে নিরপরাধ গ্রামবাসীর রক্তে রক্তিম হয়ে যায় গ্রামের পথ-ঘাট-মাঠ-প্রান্তর। এই শ্রাবণের শেষেই গাবতলী ঋষিপাড়া আবারো অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের শিকার হয়।
ভাদ্র মাসে বনবাংলা গ্রামে সন্তোষ ধর ও জগদীশ সিং-এর বাড়ি লুট করার পর তাদের শরীর চিরে লবণ মাখিয়ে নৃশংস নির্যাতন করে হত্যা করে পাকবাহিনী ও সহযোগীরা। বিকৃত মস্তিষ্ক সিদ্ধি দাসকে পতিতালয়ের পেছনে আয়মানের তীরে আগস্টের ১২-১৩ তারিখে হত্যা করে পাকবাহিনীর সহযোগীরা। দূর-দূরান্ত থেকে পালিয়ে আসা আশ্রয় প্রার্থীদের আশ্রয় দেয়া ও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসহ সাহায্য করার জন্য বড় গ্রামের ডা. অনিল বাবুকে নৃশংস নির্যাতনের পর গুলি চালিয়ে হত্যা করে জমিদার বকুল বাবুর বাড়ির ইঁদারায় ফেলে দেয়।
পাকবাহিনীর সহযোগীদের নৃশংস গণহত্যা ও লুটতরাজের শিকার হয় বেজবাড়ি গ্রাম। কোনো এক কাকডাকা ভোরে শশা গ্রামে অতর্কিত হামলা চালিয়ে পাকবাহিনী ও সহযোগীরা লুটপাটের পর এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ১০-১৫ জনকে। এরপরও বিভিন্ন সময়ে শশায় লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। মায়ের স্তন্যপানরত শিশুও এ নরপিশাচদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। কান্দাপাড়া গ্রামে লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড চালানোর সময় নিয়ামত মাস্টারের বোন ছমিরনকে বেয়নেট চালিয়ে তার বুকের দুধ পানরত শিশুসহ হত্যা করে হিংস হায়েনারা। একই গ্রামের ওসমান মুন্সী, তার পিতা ও মকবুল হোসেন মক্কু ও এক সাথে নিহত হন। পাকবাহিনীর সহযোগীদের হুমকির ফলে কয়েক দিন পর এঁদের গলিত লাশ সমাহিত হয়।
ভিটেবাড়ি গ্রামে ৩ রমজানের সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাজিত হওয়ার শোধ নেয়ার নামে পাকবাহিনী ও সহযোগীরা মুক্তাগাছা শহরের ঈশ্বরগ্রাম- মাঝিপাড়ায় ৪ রমজান ব্যাপক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ চালিয়ে স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের পাঁচজনকে হত্যা করে। এ দিনেই তারাটি তেরীপাড়ার বিনোদ বকশীকে তাঁর মুক্তাগাছা শহরের বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয় ময়লাখানা বধ্যভূমিতে। গন্ধর্বপুরের আ. সাত্তার ও পাইকা শিমুলের মনসুর আলীকে বাজারে আসার পথে ধরে নিয়ে ময়লাখানা বধ্যভূমিতে হত্যা করে নিরপিশাচদের সহযোগীরা। ক্ষুদ্র সবজি ব্যবসায়ী পাড়াটঙ্গীর তোরাব আলীকে গুলি করে হত্যা করার পর জমিদার বকুল বাবুর বাড়ির ইঁদারায় ফেলে দেয়া হয়। জয়বাংলা বাজারে (তৎকালীন পাকিস্তান বাজার) নাড়ু ও মোয়া বিক্রেতা গোবিন্দ সাহা নিহত হন এদের হাতে। এভাবে হাট-বাজারে আগত ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই হিংস্র হায়েনা পাকবাহিনী ও সহযোগীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও ঔষধপত্র দিয়ে সাহায্য করার অভিযোগে হরিপুর দেউলী ডিসপেন্সারির কম্পাউন্ডার আ. আজিজকে তাঁর লক্ষ্মীখোলার বাসার সামনে হত্যা করা হয়।
অবিরাম অগ্নিসংযোগ-লুটপাটে শহরের দরিচারিআনি বাজার, আটানীবাজার, হরিজনপল্লী, বড়হিস্যা বাজার ও জমিদার বকুল বাবুর বাড়ি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। পাকবাহিনীর সহযোগীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক বাড়ি দখল করে নেয় ও বহু হিন্দুকে নির্যাতন ও প্রাণহানির ভয় দেখিয়ে বাধ্য করে ধর্মান্তরিত হতে।
অন্যান্য জায়গা থেকে জনপদ মুক্তাগাছায় আশ্রয় নেয়া অনেকে যেমন এখানে শহীদ হয়েছেন, তেমনি শরণার্থী শিবিরসহ অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নেয়া মুক্তাগাছা বাসীদের অনেকেই আহত ও শহীদ হয়েছেন। যেমন মধুপুর-ধনবাড়ী এলাকার অমিয় বালা সাহা তার মেয়ের বাড়ি মুক্তাগাছা শহরের টানবাজারে আশ্রয় নিয়েও বেঁচে থাকতে পারেননি। বেঁচে থাকতে পারেননি ময়মনসিংহ শহরের নীহাররঞ্জন ঘোষ: তারাটি তেরীপাড়া আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে। বড় গ্রামের দুর্গাচরণ পোদ্দার জামালপুর থানা এলাকায় আশ্রয় নিয়েও নিহত হয়েছেন। ময়মনসিংহ সদর থানার ময়না দেব শশা গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে এসে স্ত্রীর বড় ভাইসহ নিহত হয়েছেন। আটানী বাজারের ভারতী রানী ঘোষ ও ঈশ্বর গ্রামের সন্তোষ কুমার দেসহ অনেকেই ডালু শরণার্থী শিবিরে পাকবাহিনীর আক্রমণে নিহত হন এবং একই ঘটনায় বিনোদবাড়ি মানকোণের ইন্দুবালা দেবীসহ অনেকেই আহত হন। সেনাবাহিনী ও ইপিআরে কর্মরত কয়েকজন মুক্তাগাছাবাসী ২৬ মার্চে প্রতিরোধের প্রথম প্রহরে শহীদ হয়েছেন যুদ্ধরত অবস্থায়। এদের মধ্যে রয়েছেন নিমুরিয়ার আব্দুল কাদের, মানকোণের মেহের আলী। মুক্তাগাছার বাইরের যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখযুদ্ধে মুক্তাগাছার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন। যেমন ঈশ্বরগঞ্জ থানার উচাখিলা বাজারে শহীদ হয়েছেন সেনাবাহিনীর হযরত আলী। নেত্রকোনা জেলার নাজিরপুরের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ইয়ার মামুদ, নুরুজ্জামান, ভবতোষ চন্দ্র দাস ও দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস। তন্তরসহ অন্যান্য যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন আব্দুল খালেক, আব্দুস ছাত্তারসহ অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা।
উপরের আলোচিত ঘটনাবলির বাইরেও প্রতিনিয়ত পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে মুক্তাগাছার অগণিত মানুষ।
বধ্যভূমি ও গণকবর
ক) বধ্যভূমি : অবরুদ্ধ মুক্তাগাছায় পাকহানাদার বাহিনী ও তার স্থানীয় সহযোগীরা যে স্থানগুলোকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে তার মাঝ থেকে মাত্র পাঁচটি বধ্যভূমির কথা এখানে আলোচিত হলো।
১। মানকোণ ইউনিয়নের শ্রীপুর মাজিহাটি গ্রামের দাসবাড়িতে ২৫ মে পাকবাহিনী নাম না জানা পাঁচ যুবককে পুড়িয়ে হত্যা করে চলে যাবার পর দাসবাড়ির লোকেরা একটি কবরে লাশ সমাহিত করে। স্বাধীনতার পরে কীর্ত্তন দাসের নেতৃত্বে কবরটি বাঁধানো হয়েছে।
২। মুক্তাগাছার বৃহত্তম মর্মন্তুদ গণহত্যার শিকার বড়গ্রাম ইউনিয়নের বিনোদবাড়ি মানকোণ গ্রামটি হঠাৎ করেই আষাঢ়ের বৃষ্টিভেজা সকালে চঞ্চল উচ্ছল গ্রাম থেকে নিমেষেই পরিণত হয়েছিল বিরান বধ্যভূমিতে।
৩। মুক্তাগাছা-বেগুনিবাড়ি সড়কে আয়মানের তীরে পৌর এলাকার ময়লাখানা নামে পরিচিত স্থানটিতে অসহনীয় নির্যাতন করে হত্যা করা হয় অসংখ্য ব্যক্তিকে।
৪। জমিদার বকুল বাবুর বাড়ির একটি ইঁদারায় সিঁড়ি বেয়ে নামা যেত। বাইরের ও স্থানীয় অসংখ্য ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয় সে ইঁদারায়। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অস্ত্রাগারের কিছুটা পেছনে অবস্থান ছিল ইঁদারাটির। এখন সেখানে ব্যাটালিয়ানের স্টোররুম ও মোটর গ্যারেজ।
৫। তারাটী ইউনিয়নের শশা গ্রামে একই সাথে ১০-১৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
খ) গণকবর : অগণিত গণকবরের মাঝ থেকে উল্লেখিত হচ্ছে মাত্র নটি গণকবরের কথা।
১। তারাটী ইউনিয়নের শশা গ্রামে একই গণকবরে সমাহিত রয়েছেন তেরজন শহীদ।
২। মানকোণ ইউনিয়নের শ্রীপুর মাজিহাটি গ্রামে দাসবাড়িতে একসাথে সমাহিত হয়েছেন পাঁচজন শহীদ।
৩। তারাটী ইউনিয়নে তারাটী তেরীপাড়ায় মতি চৌকিদারের বাড়ির কাছে এক সাথে সমাহিত রয়েছেন শহীদ বনবিহারি দে, কুমুদ কান্ত ধর ও নীহাররঞ্জন সোম।
৪। মুক্তাগাছা পৌরসভার মুজাটি দরিপাড়ার ভাটবাড়িতে একত্রে সমাহিত রয়েছেন শহীদ দীনেশ চন্দ্র ভাট ও যতীন্দ্ৰ চন্দ্ৰ মোদক।
৫। মুক্তাগাছা পৌরসভার ঈশ্বর গ্রাম মাঝিপাড়ায় দীনেশ দাসের বাড়ির আঙিনায় একত্রে সমাহিত আছেন শহীদ দীনদয়াল দাস, বীরেন্দ্র দাস, দীনেন্দ্র দাস, সুরেন্দ্র দাস।
৬। মুক্তাগাছা পৌরসভায় বেগুনবাড়ি-মুক্তাগাছা সড়কের ধারে ময়লাখানা বধ্যভূমিতে সমাহিত রয়েছেন কয়েকজন শহীদ।
৭। তারাটী ইউনিয়নে কান্দাপাড়া গ্রামে কয়েকজন শহীদের কবর রয়েছে।
৮। বড়গ্রাম ইউনিয়নের বিনোদবাড়ি মানকোণ গ্রামে যতীন্দ্র কুমার রায়ের (ধনা রায়) বাড়ির আঙিনায় একত্রে সমাহিত আছেন শহীদ যতীন্দ্র কুমার রায়, দিলীপ কুমার ঠাকুর ও জীতেন্দ্রপ্রসাদ ঠাকুর।
৯। কাশিমপুর ইউনিয়নের বনবাংলা গ্রামে শহীদ সন্তোষ ধর ও জগদীশ সিং-এর কবরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে তাদের পরিবার।
মুক্তাগাছায় রয়েছেন অগণিত শহীদ। রয়েছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর।
[৫৭৫] দেবাশীষ রঞ্জন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!