মাসদাইর গণহত্যা, নারায়ণগঞ্জ
২৭ মার্চ, শনিবার দুপুর ১২টার সময় পাকসেনারা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, পঞ্চবটী হয়ে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর শ্মশানঘাট ও কবরস্থানের সামনে ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হন সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে। তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা দোলনা বন্দুক দিয়ে কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ করার পর গুলি ফুরিয়ে গেলে পিছু হটতে বাধ্য হন। সংবাদপত্রেও এ সংক্রান্ত সংবাদ ছাপা হলো ‘অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল নরপশুরা’ শিরোনামে-
‘ওরা যখন ওদের ফুপার রক্তাক্ত লাশ জড়িয়ে কাঁদছিল তখন পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনটি নরপিশাচ অট্টহাসি দিয়ে ওদের বিদ্রূপ করছিল। ২৭ মার্চ শনিবার। হানাদার বাহিনীর ৬টি জিপ ঢাকা থেকে নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়ে দীর্ঘ ১০ মাইল পথের দু পাশেই চালিয়েছিল হত্যাযজ্ঞ। কামানের গোলা আর মর্টারের শেল দিয়ে জ্বালিয়ে একাকার করে দিয়েছিল অসংখ্য ঘরবাড়ী। অবশেষে নারায়ণগঞ্জ শহর উপকণ্ঠে এসে জেটি মাসদাইরে প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
পরে হানাদার দস্যুরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল নিরস্ত্র নিরীহ নারী-পুরুষের ওপর। এতে অনেক জীবন অকালে ঝরে পড়ে পৃথিবীর বুক থেকে। মাসদাইরেই ছিল জনাব জসিমুল হকের বাড়ি। তিনি ছিলেন জামিল ডকইয়ার্ডের মালিক। নারায়ণগঞ্জ শহরে সকলের পরিচিত। জনাব জসিমুল হক ও তার স্ত্রীর হত্যা সম্পর্কে কিছু জানার জন্য আমি তাদের মাসদাইর গ্রামের বাড়িতে যাই। বাড়িতে কেউ ছিল না। ছেলেমেয়েরা সবাই অন্যত্র আত্মীয়স্বজনের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। ঘটনাটি আমাকে জানিয়েছিল হীরা নামে একটি কিশোরী।
মিসেস হক তার ফুফু। হীরাও সেদিন জনাব হক এবং ফুফুর সাথে মৃত্যুর সারিতে দাঁড়িয়েছিল। তার চোখে আজও সেদিনকার ভয়ঙ্কর দৃশ্য ছবি হয়ে আছে। কেমন করে হীরা বেঁচে গিয়েছিল এখন সে তা আর ভালো করে বলতে পারে না। কিন্তু সেদিনকার ভয়ঙ্কর দৃশ্য ভুলতে পারেনি মোটেই। হীরা বলেছিল, ২৭ মার্চে দুটোয় সাত-আটজন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িতে হানা দিয়ে চারদিকে গুলি করতে থাকে। তখন ঘরের মেঝেতে আমরা সবাই শুয়ে পড়ি।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার সামনে রাইফেল ও এলএমজি নিয়ে এসে হানাদারেরা গালাগালি দিতে দিতে আমাদের ঘরের বাইরে আসতে বলে। আমরা একে একে বাইরে আসি। হানাদারেরা আমাদেরকে বাইরে এসে আঙিনায় দু সারিতে দাঁড় করায়। পাশের বাড়ির লোকজনও ওদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। ওদের সবাইকে ওরা হত্যা করে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে। অবশ্য তার আগে টাকা- পয়সা লুট করতে ওরা ভুলেনি। হীরার ফুফু আসমাও রেহাই পাননি। তার বুকে বেয়নেট চার্জ করে পরে গুলি করে তাকে হত্যা করে।
আমি আর শেলী (ফুফাতো বোন) তখন ফুফার লাশের কাছে থেকে বাড়ির ভেতরে ফুফুর খোঁজে এসে এই ঘটনার সম্মুখীন হই। আমাদের দেখে ফুফু আম্মা ডাক্তার ডাকতে বলে। আলমারি থেকে ‘নভালজীন’ ট্যাবলেট দিতে বলেছিলেন। তখন ফুফু আম্মার শরীর থেকে রক্তের স্রোত বইছিল। শেষে কাপড়চাপা দিয়ে ক্ষতস্থানে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিল। আমি টেলিফোনে ডাক্তার ডাকছিলাম। ডাক্তার পেয়েছিলাম, কিন্তু এলাকাটার নিরাপত্তার কথা ভেবে ডাক্তার আসেননি। তখন চারদিকে গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ আর মৃত্যুপথযাত্রীদের যন্ত্রণা ও চিৎকার যেন এক প্রলয় বইছিল বাইরে।
ইতিমধ্যে আমাদের অপর একটি ঘরে হানাদারেরা আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ফুফু আম্মা তখন বেদনায় গোঙাচ্ছিলেন। বাঁচার চেষ্টায় তিনি অস্থির।
হানাদার বাহিনী পৌরসভা অফিসে তাদের ক্যাম্প করে। পাকসেনাদের ভয়ে পৌরসভার বিপরীত দিকের বাড়ির মালিক আমেনা বেগম ছাদ থেকে বাংলাদেশের পতাকা নামাতে থাকে। জল্লাদরা এ দৃশ্য দেখামাত্র তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
‘পাকসেনাদের এই দুষ্কর্মের সহায়ক হয় রাজাকার গুলজার ও মনির। ঐ দিন জোয়ানরা পাইকপাড়া পুলের ওপর দিক থেকে আগুন লাগানো শুরু করে। একদিকে আগুন অন্যদিকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে করতে তারা জল্লারপাড়া, ১নং বাবুরাইল, ২নং বাবুরাইলের গ্রামগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। হত্যা করে নিরীহ গ্রামবাসীকে।
ঐদিন রাত্রে নরপশুরা রহমতউল্লাহ ক্লাব, দেওভোগ সমাজ উন্নয়ন সংসদে আক্রমণ করে। ‘নারায়ণগঞ্জে দুজন ছাত্রের হত্যা কাহিনী’ শিরোনামে পত্রিকায় প্ৰকাশ-
“ওরা আমাকে গুলি করেছে। ডাক্তার ডাকো ডাক্তার” বলেছিল নারায়ণগঞ্জ টানবাজার ছাত্রলীগের সভাপতি ১৮ বছরের তরুণ মোশাররফ হোসেন মাশা। ২৭ মার্চ হানাদার বাহিনীর গাড়ির শব্দে নারায়ণগঞ্জের স্তব্ধ পরিবেশ ভেঙে গেল। শহরের উপকণ্ঠ জামতলায় সবাইকে নিয়ে মোশাররফ হোসেন মাশা প্রস্তুত হয়েছিল। ওদের রাইফেল গর্জে ওঠে। হানাদার বাহিনী থমকে দাঁড়ায়। ২৯ মার্চ হানাদার বাহিনী শহরে প্রবেশ করলে মর্টারের গর্জনে ট্যাঙ্কের নিনাদে ভীতসন্ত্রস্ত শহরবাসী পালাতে থাকে শহর ছেড়ে।
তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। হানাদার বাহিনীর গাড়িগুলো ঘুরছে এদিকে সেদিকে। মাশা টানবাজারে ওদের কার্যালয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে সহকর্মীদের নিয়ে ভাবছে কী করা যায়। এমন সময় নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন জনৈক কুখ্যাত দালালের ইঙ্গিতে হানাদার বাহিনী ওদের কার্যালয়ে প্রবেশ করে ওদের আক্রমণ করল। হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে মাশা বুক চেপে ছুটে যায় ওর মা বাবার কাছে। বলে, ডাক্তার ডাকো, আমি বাঁচব, আমাকে বাঁচাতে হবে আমার সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ভাইবোনকে। কিন্তু কোথায় ডাক্তার। শহরে তখন ভীতির রাজত্ব, চারদিকে তখন আর্তমানুষের মরণ হাহাকার। ডাক্তারের অভাবে রাত ১টায় এই তরুণ দেশপ্রেমিকের প্রাণবায়ু বেদনা ব্যথিত বাংলার আকাশে মিলে গেল।
হানাদার বাহিনী একটি গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি, পরপর চারটি গুলি করেছে, ওর মৃতদেহটি কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে তার মধ্যে ছুড়ে দিয়েছে।
১ মে মোহাম্মদ সফিউদ্দিনকে নারায়ণগঞ্জ হতে পাকহানাদার দস্যুরা ধরে নিয়ে হত্যা করে। কাশীপুর ইউনিয়নে এসে রাজাকাররা গ্রামবাসীদের ওপর নির্যাতন চালাত। যুবতী নারী, স্কুলের ছাত্রীদের ওপর চালানো হতো পাশবিক নির্যাতন। এখানে জল্লাদবাহিনীকে তারা পথ দেখিয়ে নিয়ে আসত। জল্লাদরা আগুন ধরিয়ে বিপুলসংখ্যক বাড়িঘর ও সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করে। এছাড়া নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজের মধ্যে দিয়ে গ্রামবাসীকে অতিষ্ঠ করে তোলে।
তৎকালীন কাশীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দাইমুদ্দীন আহম্মেদকে ধরার জন্যে তার বাড়িতে হামলা চালায় রাজাকাররা। রাজাকারদের আগমন টের পেয়ে দাইমুদ্দীন পালিয়ে যান পেছনের দরজা দিয়ে। তাকে ধরতে না পেরে রাজাকাররা তার বাড়ি লুট করে জিনিসপত্র, স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায়।
[১১০] রীতা ভৌমিক
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত