মালীগ্রাম গণহত্যা, সিলেট
সিলেট জেলা শহর থেকে ৩২ মাইল পূর্বে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে কানাইঘাট উপজেলা। সেখান থেকে সাড়ে তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে একটি নিভৃত পল্লী মালীগ্রাম। মালীগ্রামের পাশে সড়কের ওপর রয়েছে দু-দুটি সেতু। একটি বাজারবন্দর সেতু, অন্যটি নাপিতখালের সেতু। রাতে রাজাকার বাহিনীর বড়সড় গ্রুপ এই দুটি সেতুর প্রহরার কাজে নিযুক্ত থাকত। এছাড়া গ্রামের নিরীহ জনগণকে প্রহরায় থাকতে বাধ্য করাও হতো। শুধু তাই নয়, পাকবাহিনী তাদের সহযোগী রাজাকারদের নিয়ে মালীগ্রাম ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রায়ই হানা দিত। জোর করে নিয়ে যেত গ্রামবাসীদের গরু, ছাগল, মুরগি ইত্যাদি। মা- বোনদের ওপরও চালাত নির্যাতন। এসব সংবাদ সীমান্তের ওপারে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর কাছে অচিরেই পৌঁছে যায়। ফলে মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা পাকহানাদারদের জবাব দেয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
১৮ আগস্ট রাতে ২৪ জন রাজাকার ছিল রাজারবন্দের সেতু প্রহরার কাজে নিয়োজিত। মুক্তিসেনারা এসে আশ্রয় নেয় সেই সেতু থেকে মাত্র দুই ফার্লং দূরে মালীগ্রাম। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে গর্জে ওঠে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল। রাজাকাররাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা গোলাবর্ষণে মারা যায় দুজন রাজাকার। পরদিন ১৯ আগস্ট সকালে কানাইঘাট ডাকবাংলো থেকে পাকহানাদার বাহিনীর একটি বিরাট দল মালীগ্রাম আসে। সেতুর পাশে জড়ো করে গ্রামের সমস্ত পুরুষ মানুষকে। কিশোর-যুবক-প্রৌঢ়-বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রায় ৩০০ মানুষকে একত্র করে প্রত্যেকের হাত পিছ-মোড়া করে বাঁধার পর তাঁদের নিয়ে কানাইঘাটের দিকে রওয়ানা হয়। এখান থেকে প্রায় মাইল দেড়েক দূরে বিষ্ণুপুরের খাল। সেই খালের ওপর নির্মিত পুল অতিক্রম করেই বন্দিদের ভেতর থেকে তিনজনকে পৃথক করে তারা। নিতান্ত খেলাচ্ছলেই গুলি চালায় পাকবাহিনী তাঁদের বুকে। শহীদ হন তিনজন স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র মালীগ্রামবাসী। কানাইঘাট দরবস্ত সড়কের পাশে এই বধ্যভূমিতে একটি গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দেয়া হয় এই তিনজন শহীদের লাশ।
এর আগে মালীগ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বড়চতুলেও আক্রমণ চালায় তারা। সে গ্রাম থেকে প্রায় দুশ লোককে ধরে নিয়ে আসে। এই অভিযান চলাকালেও পাক জল্লাদদের সাথে ছিল রাজাকারদের এক বিরাট বহর। বিকেলে আবার আসে পাকবাহিনী মালীগ্রামে। এবার এসে তারা এখান থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ লুট করে। গ্রামে তখনো থেকে গিয়েছিলেন পাঁচজন পুরুষ। তাঁরাও হলেন তাদের হাতে বন্দি। এবারে শুরু হলো তাঁদের ওপর মানসিক নির্যাতন। বন্দিদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো সুরমা নদীর তীরে। প্রত্যেকের বুকে বন্দুক তাক করে এবং গুলি চালিয়ে মেরে ফেলা হবে বলে মানসিক যন্ত্রণা দেয়া হতে থাকে। অনেকেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। এ সময় কয়েকজনকে দিয়ে কবর খোঁড়ায় পাকবাহিনী। এই রকম ঘটনার মুখে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে বাদবাকি সবাই। বেশ কজন বৃদ্ধ ও কিশোর আতঙ্কে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। সারারাত একাত্তরের পাক গেস্টাপোরা এভাবে মৃত্যুর মহড়া দিল। ভোরে আবার তারা কবর খোঁড়ানোর কাজ শুরু করে। ওই সময়ে পাক দালালদের আত্মীয়স্বজনদের বেছে বেছে ছেড়ে দেয়া হয়। আবার বড় অঙ্কের টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতির বিনিময়েও কোনো কোনো দালাল দু-একজন বন্দিকে পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করিয়ে দেয়। এভাবে উভয় গ্রামের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্দি সেদিন মুক্ত হলেও বাদবাকিদের নিয়ে রওয়ানা হয় তারা মালীগ্রামের দিকে। না নিজেদের গ্রামে আর পা রাখা হলো না কারো। বিষ্ণুপুরের পুলের কাছে আসা মাত্র তাদের যাত্রাবিরতি ঘটে। পুলের নিচে একটু উত্তর-পশ্চিমে খালের পাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো সবাইকে। প্রত্যেকের হাতের বাঁধন মুক্ত করে তাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে কোদাল তারা তুলে দিল। বন্দিদের দিয়েই খোঁড়ানো হলো বড় একটি গর্ত। তখনও তারা জানত না যে, এ গর্তেই তারা শায়িত হবে অনন্ত কালের জন্য।
পাকসেনারা নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে তখন বিভক্ত করল দুটি দলে, একটি দলের ২৪ জনকে আলাদা করে একই কাতারে দাঁড় করানো হলো তাদের নিজেদের হাতে খোঁড়া সেই গর্তের পাশে। তার পরেই গর্জে উঠল হায়েনাদের আগ্নেয়াস্ত্র। সাথে সাথে মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়লেন ছয়জনের দেহ। বন্দিদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হলো, তাঁরা যেন মৃতদেহগুলো গর্তে ফেলে মাটিচাপা দিয়ে দেয়। আপনজনদের এভাবে মাটিচাপা দিতে গিয়ে অসহায় বন্দিদের বুক ফাটার উপক্রম হলেও মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারেনি। এদিকে গর্ত ভরাট করার কাজে নিয়োজিত বন্দিরা আহত ছয়জনকে পাক জানোয়ারদের অলক্ষ্যে নদীর পানিতে ফেলে দেয়। ফলে প্রাণে বেঁচে যায় তারা।
পাকসেনারা আবারও বড় চতুল ও মালীগ্রামে প্রবেশ করে আগুন ধরিয়ে দেয় গ্রাম দুটির বাড়িঘরে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় অল্পক্ষণের মধ্যেই বাড়িঘর, গরু-ছাগল ইত্যাদি লুণ্ঠিত হয় কয়েক লক্ষ টাকার সম্পদ। এরপর দেশ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রায়ই গ্রামে আসত পাকবাহিনী। নির্যাতন চালাত নির্বিচারে পথে-ঘাটে আশ্রয়গ্রহণকারী মা-বোনদের ওপর। আর এ কাজে তাদের সর্বদা সহায়তা করত জামায়াত ও মুসলিম লীগের ধর্ম ব্যবসায়ীরা
মাটিচাপা দেয়া ১৯ জনের সেই গণকবরটিকে দেয়াল দিয়ে বেষ্টন করা হয়েছে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত