মালিনিছড়া চা বাগান হত্যাকাণ্ড, সিলেট
সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সড়ক পেরিয়ে কিছু দূর এগোলেই হাতের বামদিকে বিখ্যাত গলফ ক্লাব। ক্লাবেরই বিপরীত দিকে বিমানবন্দর সড়ক ঘেঁষে সুউচ্চ এক টিলার কিনারে একটি স্মৃতিসৌধ। ‘৭১-এর মালিনিছড়া চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি আই এ সিদ্দিকী। সহকারী ম্যানেজার শওকাত নাওয়াজ ছিলেন দেশপ্রেমিক বাঙালি। তার দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় তারই একটি চিঠিতে। ৮ মার্চ তার বোনের উদ্দেশে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘বাঙালিদের জীবনে একটা চরম ভাগ্য নির্ধারণের দিন আজ বোধহয় এসেছে। যদি আমরা বেঁচে থাকি তবে দেখা হবে। আর দেশের জন্য যদি প্রাণ হারাই তার জন্য দুঃখ নাই। তবে ভীরু কাপুরুষের মতো মরব না। আমরা এখান থেকে যতদূর সাধ্য কাজ করে যাব।’
চিঠিখানি বোনের কাছে পৌঁছায়নি। সম্ভবত সময়াভাবে ডাকে দিতে পারেননি। মৃত্যুর পর এ চিঠি তার শয়নগৃহ থেকে উদ্ধার করা হয়। চিঠিখানি বর্তমানে মালনিছড়া চা বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে রক্ষিত আছে বলে জানালেন বর্তমান ম্যানেজার।
বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ‘৭১-এর ৫ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি কয়েকজন অফিসার শহর থেকে মালনিছড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে গিয়ে হানা দেয়। তারা খানাপিনা ও ফুর্তির আয়োজন করার জন্য ম্যানেজার শওকাত নাওয়াজকে নির্দেশ দেয়। শওকাত পাকিস্তানিদের ঘৃণা করতেন। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি ও দেশপ্রেমিক। সেদিন বাসায় তার ভাই ও দুজন বন্ধু ছিলেন। শওকাতের বিয়ের আয়োজন চলছিল। এ নিয়ে আলোচনা করার জন্যই তারা এখানে এসেছিলেন। প্রচণ্ড ঘৃণা সত্ত্বেও নিজের এবং ভাই ও বন্ধুদের জীবন রক্ষার জন্য তিনি ঘরে যা আছে তাই খেতে দেন হানাদার খানসেনাদের। খানাপিনা শেষেও খানসেনারা যাওয়ার নাম করছিল না। তাদের হাবভাব শওকাত নাওয়াজের কাছে ভালো ঠেকেনি। তিনি বাঁচার পথ খুঁজছিলেন। এরই মাঝে সম্ভবত বোনকে লেখা সেই চিঠি পেয়ে যায় তারা। সেই সঙ্গে একটি অজুহাত খুঁজে পায় তারা চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার। শওকাত, তার ভাই ও বন্ধুরা ছাড়াও বাগানের কয়েকজন শ্রমিক সে রাতে বাংলোয় অবস্থান করছিল। এরা শওকাতের রান্নাবান্না এবং অন্যান্য কাজ করে দিত। হায়েনারা সবাইকে ধরে বেঁধে বাংলোর পেছন দিকে নিয়ে গেল। বাংলোটি একটি উঁচু টিলার ওপর অবস্থিত। টিলার ঢালের কিনারে নিয়ে সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। তারপর বন্দুক তাক করে টান দেয় তারা ট্রিগারে। মুহূর্তেই নিথর হয়ে যায় ১০টি তাজা প্রাণ। পরদিন টিলার ঢালুতে পড়ে থাকতে দেখা যায় তাদের মৃতদেহ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাগান কর্তৃপক্ষ এই মহান শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন।
[৩৯৪] ইখতিয়ার উদ্দিন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত