You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাছদিয়া ও মাছপাড়া গ্রাম গণহত্যা ও গণকবর, পাবনা

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রেলওয়ে জংশন ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র ঈশ্বরদী। এর দক্ষিণে সমগ্র পশ্চিমাঞ্চল রেলের বিভাগীয় কেন্দ্র পাকশী। মাছপাড়া, মাছদিয়া গ্রাম। এক দিন এই গ্রাম দুটিতে ছিল সরল অনাড়ম্বর মাটির মানুষ কুমার সম্প্রদায়। ঘরে ঘরে তৈরি করত মাটির জিনিস হাঁড়ি পাতিল আর সরাই-বাংলার প্রসিদ্ধ মাটির সরাই। ঈশ্বরদীর মাটির সরাই বাংলাদেশ ছাড়া বিদেশেও নাম করেছে যথেষ্ট।
ঈশ্বরদী পাকসেনা কবলিত হয়েছিল ১১ এপ্রিল এবং সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল পাকসেনা ও তাদের দোসর অবাঙালিদের হত্যাযজ্ঞ। অবাঙালি গ্রাম দুটিতে এসে দু-একজন যারা ছিল, তাদের অভয় দিয়েছিল-‘আমরা গ্রামের মানুষের কোনো অনিষ্ট করব না।’ এভাবে ভদ্রতার মুখোশ পরে অবাঙালিরা মাঝে মাঝে কিছু কিছু বাঙালিকে খাদ্য দ্রব্যাদি শহর থেকে সরবরাহ করে নিরীহ গ্রামবাসীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে এবং যারা সংগ্রামের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাঁদের সন্ধান দেবার জন্য গ্রামবাসীদের প্রলুব্ধ করে। এতে গ্রামবাসী যারা প্রাণের ভয়ে আশপাশে পালিয়েছিল, তারা ক্রমে একে একে এসে আবার গ্রামে বাস করতে থাকে।
২২ এপ্রিল, ভোর না হতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। গ্রামের চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। দিশেহারা হয়ে গ্রামবাসী স্ত্রী-পরিবার ছেড়ে জীবন বাঁচাবার তাগিদে ছুটল। কিন্তু কোথায় পালাবে। পশ্চিমে পদ্মার শাখা নদী আর তিন দিক ঘিরে হাজারো অবাঙালি। হাতে তাদের রাইফেল, তরবারি আর বল্লম। গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশ বাতাস। শত শত মানুষ বুলেটের আঘাতে লুটিয়ে পড়ল। সেই সাথে চলল লুণ্ঠন আর নারী ধর্ষণ।
জনৈক বিত্তবান গ্রামবাসী বাতান বাড়ির এক বটগাছের ছায়ায় মাথায় হাত দিয়ে পাথরের মতো বসে ছিলেন। তাঁর কাছেই শুনেছিলাম মাছদিয়ার ঘটনা। সচ্ছল গ্রামবাসী। এগারো জন তাঁর বাড়ির মোট লোক। হাসিখুশি পরিবার। বৃদ্ধ লোকটির দু চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছিল। বলেছিলেন, এই যে হাত দুটো দেখছো বাবা, এই হাত দিয়ে দশজনকে মাটিচাপা দিয়ে এসেছি। ওরা আমারই ছেলে, ছেলে-বৌ ও আদরের নাতিরা। মাটিচাপা দিয়েছি ওদেরই খোঁড়া গর্তে। বিমান হামলার জন্য ওরা যে ট্রেঞ্চ খুঁড়েছিল, সেই গর্তেই এক এক করে সবাইকে পুঁতে রেখেছি। গ্রামের ভেতর আমাদের বাড়িটাই প্রথম বলে বিহারিরা প্রথমেই ওটা ঘিরে ফেলেছিল। তখনও গ্রামের কেউই ঘরের দরজা পর্যন্ত খোলেনি। আমারই সামনে এক এক করে কাটতে দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন প্রায় সন্ধ্যে। দেখলাম ওদের মেরে পালা দিয়ে রেখেছে। সারারাত ধরে ওদের কবর দিয়ে আমি চলেছি কোথায় জানি না। ঐ পাশের টিউবওয়েলটা দেখে মনে হলো তেষ্টা পেয়েছে।
এর আর দশ দিন পর বিশেষ এক কাজে আমাকে ঢুকতে হয়েছিল ঈশ্বরদীতে। মাছদিয়া গ্রামের ওপর দিয়ে গভীর রাতে আমি পার হয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, আজ আমার বাম পা-টা কিসের মধ্যে যেন ঢুকে পড়েছে। টর্চলাইট জ্বালিয়ে যা দেখেছিলাম, সে কথা মনে হলে, আজও আমার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। দেখলাম, একটা গলিত লাশে আমার পা-টা ঢুকে গেছে। পরে শুনেছিলাম, এই ২২ এপ্রিল বিহারিরা ঐ গ্রামে প্রায় পাঁচ শ জন লোককে হত্যা করেছিল।
[৩৫৭] মজিদ আহসান পাশা

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!