You dont have javascript enabled! Please enable it!

মধ্যপাড়া ও রুদ্রকর গ্রামের গণহত্যা, শরীয়তপুর

একাত্তরের ২২ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আঙ্গারিয়া মধ্যপাড়া, কাশাভোগ, নীলকান্দি, পশ্চিম কাশাভোগ, মনোহর বাজার ও রুদ্রকরের হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোতে ঢুকে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তানি সেনারা মেশিনগান, মর্টার, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল ও থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে অতর্কিতে হামলা করে প্রায় ৩৫০ জন হিন্দু নরনারীকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়। এই দানবীয় তাণ্ডবের কথা মনে করে শরীয়তপুরবাসী আজ শিউরে ওঠেন।
সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা রুদ্রকর গ্রামের জমিদার প্রমথ বাবুর বাড়িতে নবাব আমলে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু মঠে মর্টার সেল ও ব্রাশফায়ার করে উপর্যুপরি। কিন্তু মঠটির কোনোই ক্ষতি করতে পারেনি তারা। কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রকরের ঐতিহাসিক মঠটি। ঐদিন পাকিস্তানি হানাদাররা মনোহর বাজারের সাথী বিড়ির মালিক রমণী সাহা, তার মেয়ে শোভা, শোভারানীর দেবর, ননদসহ একই পরিবারের ৯ জনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে এদেশীয় রাজাকারদের সহযোগিতায়।
হিন্দুপ্রধান এলাকা মনোহর বাজারের রুহুল আমিন নিকারির বাড়ির সামনের একটি টিনের মসজিদ ঘরের ভেতরে ১০-১২ জন হিন্দু মহিলাকে ধরে এনে বাংলাদেশী রাজাকার আলবদররা তাদের প্রভু হানাদার পাঞ্জাবিদের হাতে তুলে দেন। এছাড়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রুদ্রকর নীলমনি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক সুখদেব সাহা, গৌরাঙ্গ চন্দ্র পোদ্দার, কানাই, মালো, পার্শ্বনাথ, নারায়ণচন্দ্র, চিত্তরঞ্জন সাহা, হরিসাহা, রামমোহন সাহা, উপেন্দ্র মোহন নাগ, মনমোহন চক্রবর্তী, রুহিদাস, নিপা পোদ্দার, জয়দেব সাহা, মহাদেবসহ প্রায় ৩০ জন পুরুষ ও ৫০ জন তরুণী ও গৃহবধূকে ধরে নিয়ে যায়।
মধ্যপাড়া গ্রামের একটি পরিত্যক্ত ঘর ও মন্দিরে নিয়ে নারীদের পালাক্রমে ধর্ষণ ও নির্যাতন করার পর সবাইকে ব্রাশ ফায়ারে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঐদিনই দুপুরে ২৫-৩০ জন তরুণী ও গৃহবধূকে পাঞ্জাবিরা পুনরায় একত্রিত করে। এদের অধিকাংশই ছিলেন অবিবাহিতা হিন্দু মেয়ে। এদের মাদারীপুর এ আর হাওলাদার জুটমিলে নিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণের পর লাইন দিয়ে ব্রাফশায়ার করে মিলের পেছনে আড়িয়াল খাঁ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এক প্রসূতি মহিলা, যার ১৩ দিনের শিশু সন্তানকে পাকিস্তানি হানাদাররা লাথি মেরে ফুটবলের মতো ছুড়ে ফেললে শিশুটি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। জানা গেছে, এ সময় বাংলাদেশী রাজাকার-আলবদরদের অট্টহাসিতে কায়কাউসের আকাশ বাতাস শিউরে ওঠে। পাকিস্তানি হানাদাররা মধ্যপাড়া গ্রামের শখীবালা দাসকে ঘরের ভেতর আটকে রেখে বাইরে থেকে ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় রাজাকাররা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আর বলতে থাকে, ‘এবার বোঝ, শালার মালাউনকা বাচ্চা!’ চলতে থাকে রাতভর ও পরের দিন বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের প্রতিযোগিতা। শরীয়তপুরের সাবেক সাংসদ সরদার এ কে এম নাসির উদ্দিন কালুর বর্ণনা মতে, তাদের বিনোদপুরের বাড়িতে পাঞ্জাবিরা অগ্নিসংযোগ করে এবং তার দুই চাচাতো ভাই আবু তালেব ও আবুল ফজলকে ধরে নিয়ে যায়। তারা আর ফিরে আসেননি। ঐ বাড়ির মালামালও লুটে নেয় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা। প্রবীণ রাজনীতিক সিরাজ সরদারের ভাতিজা মেডিকেল কলেজের ছাত্র কাঞ্চনকেও পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছে। এ সকল হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজে নেতৃত্ব দেয় কাশিপুরের ফতোয়াবাজ রাজাকার প্রশিক্ষক স্বাধীনতা ও বিরোধী কুখ্যাত সোলায়মান মওলানা।
[৪৩২] আব্দুস সামাদ তালুকদার

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!