মহিষপুরা গণহত্যা, বাগেরহাট
পিরোজপুর শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত বলেশ্বর নদীর অপর তীরেই বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ থানার হোগলাপাশা ইউনিয়ন। ১২ মে বুধবার, ২৮ বৈশাখ, ১৩৭৮ তারিখে এই ইউনিয়নের মহিষপুরা, ছোটহরিপুর, বড়হরিপুর, বৌলতলী, দাসখালী প্রভৃতি গ্রামে ব্যাপক লুটতরাজ, নারী নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনা ঘটে। পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন অঞ্চলটিকে এক নামে মহিষপুরা হিসেবে জানে। ঐ দিনের ঘটনায় গ্রামগুলোতে কমপক্ষে পঁচিশ জন গ্রামবাসীর প্রাণহানি ঘটে, বেশ কয়েকজন মহিলাকে অপমান করা হয় এবং ঘটনার পরপরই একজন মহিলা আত্মহত্যা করেন।
পিরোজপুর শহর পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পরপরই মোরেলগঞ্জ থানার গোলবুনিয়া ইউনিয়নের দালাল ও লুটকারীরা পিরোজপুরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং জানায় যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসংখ্য লোক ঐ এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। খবর পেয়ে পিরোজপুরে অবস্থানরত পাকবাহিনী ঐদিন দুপুর দুইটার দিকে হোগলাপাশা ইউনিয়নের দালালদের সঙ্গে নিয়ে বলেশ্বর নদী পাড়ি দিয়ে মহিষপুরা খেয়াঘাটে পৌছায়। তারপর পিরোজপুর- বাগেরহাট সড়ক ধরে অগ্রসর হতে থাকে। কিছুদূর এগিয়ে পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ দক্ষিণ দিকে বৌলপুর গ্রামে ঢোকে, একটি গ্রুপ আরো পশ্চিমে বনগ্রাম গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করে এবং অন্য একটি গ্রুপ বনগ্রাম পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসে মহিষপুরা গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে। পূর্ব যোগাযোগ অনুযায়ী হোগলাপাশা ও বনগ্রাম ইউনিয়নের লুটকারীগণ পাকবাহিনীর অনুগামী হয়।
গ্রুপ তিনটি অতঃপর বৌলপুর, হরিপুর, দাসখালী এবং মহিষপুরা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষ সদস্যদের বেছে বেছে হত্যা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও যুগপৎ চলে। পাকবাহিনীর যে গ্রুপটি মহিষপুরা গ্রামে ঢোকে, রাস্তার পাশে বাঁধা দুটো পালিত শূকর প্রথমে তাদের চোখে পড়ে। একজন সৈনিক সে দুটোকে গুলি করে মারে। গুলির ঐ শব্দে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে বসবাসকারী লোকজন পাকবাহিনীর আগমন সম্পর্কে বুঝতে পেরে যে যার মতো আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে শুরু করে দেয়। তা সত্ত্বেও পাকবাহিনীর সামনে পড়ে যাওয়ায় পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসে আশ্রয় নেয়া ৯-১০ জন শরণার্থী এবং গ্রাম তিনটির বেশ কয়েকজন পুরুষ সদস্যকে প্রাণ দিতে হয়। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে মহিষপুরা চিত্তরঞ্জন হালদারের বাড়ি। চিত্তরঞ্জনের সামনেই তাঁর নববিবাহিতা স্ত্রীকে লাঞ্ছিত করা হয় এবং চিত্তরঞ্জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শোকে দুঃখে ও লজ্জায় চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত