You dont have javascript enabled! Please enable it! ভূয়াপুর ছাব্বিশা গণহত্যা | গাজীপুর - সংগ্রামের নোটবুক

ভূয়াপুর ছাব্বিশা গণহত্যা, গাজীপুর

গাজীপুর এলাকায় ভূয়াপুরের গ্রামগুলোকে টার্গেট করেছিল পাক সেনাবাহিনী। খবর গিয়েছিল গ্রামগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছে এবং গ্রামবাসী তাঁদের সহায়তা করছে। ভূয়াপুর থানার মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ করার জন্য কালিগঞ্জ নদীর ঘাটে পাকবাহিনী তাদের লঞ্চ ভেড়ায়। এর পরদিন তারা ভূয়াপুরের দিকে রওনা হয়। এদিন মুক্তিযোদ্ধারা ছাব্বিশা গ্রামের উত্তর পাশের খালে পজিশন নিয়ে অবস্থান করছিলেন। পাকবাহিনী বামনহাটায় পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। কিন্তু পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের তুলনায় তাঁদের অস্ত্র ছিল হালকা ধরনের। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা বেশিক্ষণ যুদ্ধ চালাতে সক্ষম হননি। তাঁরা ক্রমশ পিছু হটতে থাকেন। এ সময় পাকবাহিনী ছাব্বিশা গ্রামের দিকে চলে আসে। গ্রামে ঢুকে তারা নির্বিচার গণহত্যা শুরু করে। বিশেষ করে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন এমনকি যেসব মহিলা রান্নার কাজ করতেন তাঁদেরও বেছে বেছে হত্যা করে তারা। তারিখটা ছিল ১৭ নভেম্বর। মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান। তিনি জানান, সেদিন পাঞ্জাব ও বেলুচ রেজিমেন্টের সদস্যরা আক্রমণ করে। গ্রাম জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় এবং বহু নারী তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।
ছাব্বিশা গ্রামের বৃদ্ধ মরিয়ম বেগম (৭০) এদিনের হত্যাযজ্ঞে হারিয়েছেন তাঁর স্বামী ইসমাইল হোসেন, ১০-১২ বছরের মেয়ে ও ৯ বছরের নাতিকে। তিনি জানান, ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গুলি করে পাকসেনারা। ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে ঘরের মধ্যে পুড়ে মরে তাঁর মেয়ে আর নাতিকে।
মসিরন বেগম (৫০) তাঁর স্বামীর প্রাণ বাঁচাবার জন্য হাতে-পায়ে ধরে অনেক অনুনয় করেছিলেন পাকসেনারাদের। কিন্তু তাঁর অনুরোধে কান দেয়নি তারা। তাঁর স্বামী মোমতাজ আলী তখন ঘরেই ছিলেন। তাঁকে টেনে বের করে গুলি করে হত্যা করে তারা। এরপর পাক আর্মিরা মৃতদেহের ওপর পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এস এম আনিসুর রহমান ঘটনার সময় ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন। সেখান থেকেই দেখতে পান মুহূর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে যাচ্ছে তাদের চির পরিচিত গ্রামটি। গুলি চলছে নির্বিচারে, চলছে বাড়িঘর পোড়ানো। মো. সেকেন্দার আলী (৭০) নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন কচুরিপানার মধ্যে। সেখান থেকে প্রত্যক্ষ করেন পাকবাহিনীর তাণ্ডবলীলা। তিনি গৃহবধূদের ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন। এর মধ্যে হায়দারের বউ বলে একজনের কথা মনে করতে পারেন তিনি।
মো. আবদুল কুদ্দুস মিয়া তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তাঁর বাবা তাঁকে মা ও বিশ দিনের ছোট্ট বোনকে নিয়ে দক্ষিণে খড়গ গ্রামের দিকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি নিজে থেকে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য। মা-বোন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালানোর ঘণ্টা দুয়েক পর খবর পান তার বাবাসহ গ্রামের অনেককে হত্যা করা হয়েছে। পাকবাহিনী গ্রাম ছেড়ে যাবার পর ফিরে আসেন কুদ্দুস। এসে দেখেন বাড়ির উঠানে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন তাঁর বাবা। তাঁর বাবার শরীরে দুটো গুলির আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান। কোনোমতে বাড়ির মধ্যেই দাফন করেন তাঁকে।
গৃহবধূ ভানু বেগম (৫০) পাকবাহিনীর পাশবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ঘন সবুজ পোশাক পরা ৮-৯ জন পাকসেনা তাঁকে ঘিরে ধরে। বাড়ির ভেতর গুলি করে মারে তাঁর ভাশুরকে। তাঁর স্বামী ইয়াকুব আলী তখন সেখানে ছিলেন না। পাক আর্মিরা তাঁর গায়ে হাত দিলে তিনি ‘বাবা সোনা, গতরে হাত দিয়েন না’ বলে অনেক অনুনয় করেন। কিন্তু কিছুতেই শোনেনি পাকসেনারা। তারা বাড়িতে আগুন দিয়েছে ততক্ষণে। ভয় দেখাল ছেলেকে আগুনে ফেলে দেবার। অবশেষে নিজেকে পাকবাহিনীর বিকৃত লালসার কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য হন ভানু বেগম। যাবার সময় তারা কানের দুল, গলার মালাটা পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং তাঁকে ছুড়ে ফেলে আগুনে। আজও সে পোড়া দাগ রয়েছে তার হাত, পা ও পিঠে। ভানু বেগম জানান, রাজাকার আনিস তাদের দেখিয়ে দিয়েছিল।
আবদুল মান্নান জানান, তার মা সজিরণ বেগমের অত্যাচারিত হবার সেই দুঃখজনক ঘটনা। সে সময় ১৫ বছরের কিশোর ছিলেন তিনি। এদিন বাড়িতে তাঁর বাবা ওমর আলী কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। রাজাকারদের সঙ্গে একদল পাকসেনা তাদের বাড়িতে আসে, তখন বারান্দায় কোরআন শরিফ পাঠরত অবস্থায় তাঁর বাবাকে গুলি করে। এ সময় পাকবাহিনীর গুলির আঘাতে তাঁর চাচা দরজার কাছে মাটিতে পড়ে যান। ঘরে মেয়েরা ছিল, পাকবাহিনী তাদের বের করে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় ঘরে। সেই আগুনে পুড়ে যায় তাঁর বাবার মৃতদেহ। ৪ ভাই, ৩ বোন ছিলেন মান্নানরা। মার গর্ভে তখন সন্তান ছিল। সেই অবস্থায় তাঁকে পাশবিক নির্যাতন করে পাকসেনারা। শুধু তাই নয় আগুনের মধ্যে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মারে তাঁর মাকে। কাঁদার সময়ও পাননি তাঁরা। দাদির হাত ধরে ধানক্ষেতের ভেতর গিয়ে লুকিয়ে ছিলেন ভাইবোনেরা।
শবজান (৭৫), সেদিনের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলায় হারিয়েছেন স্বামী সেকান্দার আলী এবং পুত্র রমজান আলীকে। বেলা বারোটার দিকে ৬০-৭০ জন পাকসেনা এসে তাঁদের বড়িতে ঢোকে। প্রথমে তাঁদের ধরে কিল, ঘুষি, লাথি মেরে ফেলে দিয়ে পরে গুলি চালায়। পরে আবার বিশ-পঁচিশ জনের অন্য একটি দল এসে বাড়িতে আগুন দিয়ে যায়। চোখের সামনে স্বামী আর পুত্রকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন শবজান।
নূরজাহান বেগম হারিয়েছেন তাঁর স্বামী দানেশ আলী, এক ছেলে ও দেবরকে। গুলি করে চোখের সামনে হত্যা করা হয় তাঁদের। ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন বছর খানেক আগে। সেই বউ রওশন আরাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় পাকসেনাদের মধ্যে। কিছুতেই তাদের হাত থেকে রেহাই পেল না মেয়েটি। নূরজাহান জানান, তখন আমি মরা স্বামী-সন্তান সামলাব, না বউকে বাঁচাব তার কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। ওদিকে গুলি খেয়ে পড়েছিল ছোট ছেলে নিজামুদ্দিন।
নদীর ভাঙনে সব হারিয়ে ছাব্বিশা গ্রামে ভাই সেকান্দার আলীর বাড়িতে এসে উঠেছিলেন সজিরন। স্বামী কোরবান আলী ও ছোট ছোট বাচ্চাসহ ছাব্বিশা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাঁচার আশায়। কিন্তু এখানেও বাঁচতে পারেননি তাঁরা। পাকসেনাদের গুলিতে নিহত হলেন সজিরণের দুই ভাতিজা। স্বামীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সজিরণ। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন। কত হাতে-পায়ে পড়লেন খানসেনাদের, কিন্তু কানেও নিল না ওরা তাঁর কথা। স্বামী কোরবান আলীকে গুলি করে পাকহানাদাররা সজিরণের বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও ধ্বংস করে দেয়।
সাহেবানু তাঁর মা আলোকজানের সঙ্গে লুকিয়েছিলেন দক্ষিণ পাড়ায়। বিশ- পঁচিশজন মহিলা একটি ঘরে লুকিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানিরা সেখানে এসে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে। মেয়েদের তারা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। এরপর তাদের ভয়ে পালিয়ে অনেকেই শামসু মাতব্বরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানেই সাহেবানু দেখেন হায়দারের বউকে ঘরে নিয়ে খিল আটকে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। আলোকজান মেয়েকে নিয়ে মানসম্মানের ভয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। গ্রামের এক বাড়ির ছেলে পাকিস্তানে চাকরি করত। এ কথা শুনলে সে বাড়িতে অত্যাচার হবে না ভেবে অনেকে ঐ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু সে বাড়িতেও সাহেবানু দেখেছেন হাজেরা নামের একটি মেয়েকে নিয়ে পাকবাহিনীর পৈশাচিক উল্লাস। এরপর তারা মারফতের বউয়ের ওপর অত্যাচার চালায়। ৮-৯ বছরের সাহেবানুর স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে নিরপরাধ মেয়েদের আর্তচিৎকার।
ছাব্বিশার তোফাজ্জল হোসেন সে সময় ছিলেন বালক। পাকবাহিনীর পেছন পেছন ঘুরছিলেন কৌতূহলে। কিন্তু এই কৌতূহল তাঁকে মারাত্মক সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। পাকবাহিনী একের পর এক অত্যাচার করে চলল। তাঁর চোখের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের বাবা-মায়ের ওপর নির্মম অত্যাচার, বাড়িঘরে আগুন দেয়া, হত্যাযজ্ঞ চলতে লাগল। জব্বার মুনশীর চারটি ছেলেকে মরতে দেখলেন পাকসেনাদের গুলিতে। এক ছেলে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে নিশান উড়িয়ে ঘরের বার হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে লাথি মেরে পানিতে ফেলে দিয়ে মাথায় গুলি করে। এভাবে মারা যান চার ভাই ইউসুফ, মোতালেব, শফিকুল ও আয়নাল। কোরবান আর সেকান্দারকেও হত্যা করতে দেখেছেন তোফাজ্জল। পাকবাহিনীরা এরপর একে একে হত্যা করে আবুল, হায়দার, কাশেম, সিরাজ আলী মুন্সী, তাঁর মা, মন্তাজসহ আরও একজনকে। গ্রামের সবচেয়ে তাগড়া পুরুষ মনির উদ্দীনকে ও হত্যা করে পাকসেনারা। হত্যার পর অনেককে বাড়িঘরে লাগানো আগুনের মধ্যে ফেলে দিতে দেখেছেন। বাড়ি ফিরে এসে তোফাজ্জল দেখেন তাঁর বাবা মাহমুদ আলী শেখ ও মা নিহত হয়েছেন পাকবাহিনীর হাতে।
ছাব্বিশায় সেদিনের হামলায় হবিরন বেগম (৫০) হারিয়েছেন তাঁর স্বামী ইয়াকুব আলীকে। ঘর থেকেই দেখেন বন্দুক দিয়ে তাঁকে প্রথম বাড়ি দেয় একজন খানসেনা, এরপর তাঁর কপালে একটা গুলি করে। পরে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলে হবিরন বেগম অনেক কষ্টে টেনে টেনে স্বামীর লাশ সরিয়ে এনেছিলেন যাতে পুড়ে না যায়। রাতে বাড়ির সামনেই কবর দেয়া হয় তাঁকে।
[৩৪] ডা. এম.এ. হাসান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত