মংলা বধ্যভূমি, বাগেরহাট
২৪ এপ্রিল পাকবাহিনী বাগেরহাটে গণহত্যা হয়েছে শুনতে পেয়ে মংলা বন্দরের পিস কমিটির সভাপতি অত্যন্ত পুলকিত বোধ করেন। ২৫ এপ্রিল সারা দিন ধরে তাঁরা মিটিং করে ঠিক করেন যে, নাছিম খানের নেতৃত্বে তাঁদের প্রথম অপারেশন চালানো হবে মেহারাবুনিয়া পোদ্দার বাড়ি। সেই অনুযায়ী ২৫ মে এপ্রিল রোববার খান তার দলবল নিয়ে সন্ধ্যার পরপরই শেহালাবুনিয়া পোদ্দারবাড়ি আক্রমণ করে। শতাধিক সশস্ত্র লোক বাড়িটিকে ঘিরে ফেলে, যাদের মধ্যে মংলায় কর্তব্যরত বিহারি শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি ছিল। খুলনায় তাঁদের কিছু আত্মীয়-স্বজন বাঙালিদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে বলে তারা তাদের মনের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ লালন করে যাচ্ছিল। তাই নাছিম খানের আহ্বানে তারা প্রতিশোধ গ্রহণের একটা সুযোগ পেয়ে যায়। আক্রমণের এক পর্যায়ে পোদ্দার পরিবারের সবাইকে একে একে ধরে ঘরের পাশের নারকেল গাছ তলায় ১ জন, রান্নাঘরের পাশের ছোট পুকুরের ঘাটে ২ জন এবং ঘরের মধ্যে ২ জনকে জবাই করে হত্যা করা হয় এবং লুট করা হয় ঘরের যাবতীয় মালামাল।
মংলা বন্দরের বৃহত্তম বধ্যভূমি ছিল বন্দরের পশ্চিমাংশে পশুর নদীর পূব তীরে সিগনাল টাওয়ার এলাকায় ইসমাইল সাহেবের জেটিতে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো সময়টা পাকবাহিনীর সদস্যরা তাদের সন্দেহভাজন লোকদের এখানে এনে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত। পাকবাহিনীর সেই গণহত্যার যাঁরা শিকার হয়েছিলেন, তাঁদের একটি বড় অংশ ছিল চট্টগ্রাম-নোয়াখালী অঞ্চলের শ্রমিক। যেসব শ্রমিক তখন আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশকেই এখানে জীবন দিতে হয়েছে। এঁদের নাম ঠিকানা উদ্ধার করা এখন বেশ কঠিন। ১৯৭১ সালে যেখানটায় ইসমাইল সাহেবের জেটি ছিল এখন সে জায়গাটা ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ঘরবাড়ি।
যেসব হতভাগ্যকে হত্যা করার জন্য এখানে নিয়ে আসা হতো বৈদ্যমারী গ্রামের মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস তাঁদের একজন। তিনি মুজিব বাহিনীর বৈদ্যমারী ক্যাম্পের স্থানীয় ট্রেনিংপ্রাপ্ত একজন যোদ্ধা ছিলেন। ১৬ অক্টোবর তারিখে মুজিব বাহিনীর বৈদ্যমারী ক্যাম্পের কমান্ডার শেখ আবদুল জলিল তাঁকে একটি পত্র দিয়ে তা কালেখারবেড়ে অবস্থিত কমান্ডার আফজালের নিকট পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। বৈদ্যমারী থেকে আসার পথে মিঠাখালী এলাকায় তিনি পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এক পর্যায়ে তিনি দালালদের হাতে ধরা পড়েন এবং দালালরা তাঁকে সুকৌশলে রামপাল রাজাকার ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। তাঁর নিকটে তখন যে চিঠিখানা ছিল বুদ্ধি করে তা তিনি খেয়ে ফেললেও তাঁর নিকটে যে গ্রেনেড ছিল নৌকা দিয়ে ফেরার সময়ে দালালদের তা চোখে পড়ে। পরিণতিস্বরূপ রামপাল ক্যাম্প থেকে তাঁকে মংলাগামী গানবোটে তুলে দেয়া হয়। মংলায় এনে আরো ১০ জনের সঙ্গে তাঁর ওপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়েছিল। হতভাগ্য সঙ্গীদের মধ্যে যাঁদের তিনি চিনতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিল কালেখারবেড়ের ২ জন, কৈলাসগঞ্জের ২ জন এবং তেঁতুলবাড়িয়ার একজন। ঢাকা অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়- পড়া একজন ছাত্রও সেই দলে ছিলেন। গানবোটের ওপর রোদের মধ্যে চিত করে শুইয়ে রেখে দুজনকে মেরে ফেলার দৃশ্য তিনি দেখেছিলেন। ৩০ অক্টোবর রাতে আরো ৮ জনসহ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইসমাইলের জেটিতে। সকলের লুঙ্গি খুলে সেই লুঙ্গি দিয়েই তাঁদের চোখ বেঁধে কাঠের পুলের ওপর সারি করে বসিয়ে গুলি করা হয়। পরের দিন সকালে আবদুল কুদ্দুস নিজেকে আবিষ্কার করেন কাইনমারীর দক্ষিণ চরে হাশেম মিয়ার বাড়িতে। হাশেম মিয়ার স্ত্রীর (মান্নানের মার) সেবাযত্নে তিনি জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলেন। একটি গুলি তাঁর গলার পাশ দিয়ে ঢুকে পিঠের কাছ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত