You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৮ই এপ্রিল, সোমবার, ২৫শে চৈত্র, ১৩৮০

বাংলাদেশ-ভারত সাংস্কৃতিক সম্পর্ক

যখনই কোন দুটি পৃথক দেশ বা জাতি বা কোন দুটো ভাব ও ভাবনার মানুষ নিজেদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও অসম্পূর্ণ উদ্দীপনা নিয়ে পারস্পারিক ভাব, ভাষা, সাহিত্য, সংলাপ, গুঞ্জন রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও অন্যান্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মূল্যবোধের ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি পারস্পারিক শ্রদ্ধাশীলতা গড়ে তোলে, তখনই ঐ দুটি পৃথক দেশ বা জাতি বা ওই দুটো ভাব ভাবনা মানুষ নিজেদের মধ্যে একটা সুন্দর ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে বলে নিঃসংকোচে বলা চলে।
সৃষ্টি সর্বত্রই সুন্দর। অনাসৃষ্টি যত জঞ্জালের মূল কারণ। যা কিছুই মানবকল্যাণের সহায়ক, যা কিছুই মানুষের অন্ধত্ব ঘুচিয়ে সত্য ও ন্যায়ের আলোর সন্ধান দেয়, তাই সুন্দর। তাই রাম-শ্যাম, রহিম-করিম। যে জ্ঞান মানুষকে আঘাত করে, যে আলোয় মানুষের মাঝে বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ রোপন করে তা কখনই সুন্দর নয়। তাতে কারোই গর্বের কিছু নেই। সে বিষ নরক-জ্বালা। আবার খেয়ালী স্রষ্টার এ বিরাট খেলাঘরে সুন্দর কোথাও একক কুণ্ডলী পাকিয়ে কারো কুক্ষিগত নেই। সৃষ্টির প্রতিটি আনাচে-কানাচে রন্ধ্রে রন্ধ্রে সত্য ও সুন্দর নানারূপে নানা গৌরবে সৌরভে ও দারুন স্বর্গীয় আভিজাত্যে ছড়িয়ে রয়েছে। সুন্দরের প্রত্যেকটি মলিফিউলিই সুন্দর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। আবার, প্রত্যেকের সম্মিলিত রূপ আরো বিরাট সৌন্দর্যের মহিয়ান।
তাই যুগ যুগ ধরে মানুষ শুধু হন্যে হয়ে বেরিয়েছে এই বিরাট অপরূপ সৌন্দর্যের অন্বেষণে। জন্ম নিয়েছে পারস্পারিক আন্তঃযোগাযোগ, সৃষ্টি হয়েছে ন্যায়, সত্য ও জ্ঞানালোকের নতুন নতুন স্বর্ণোজ্জ্বল কচি মুখ। ধন্য হয়েছে মানুষ জীবন আর সৃষ্টির পরমানন্দ। আর এভাবেই সমস্ত সৃষ্টি এগিয়ে চলেছে এক অন্তিম সাধারণ প্রান্তে, পরমাত্মার বিসর্জন পাবে বলে।
আমাদের উপ-মহাদেশ বিভক্ত হয়ে যখন দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রে ভাগ হয়, তখন থেকেই সাবেক পাকিস্তানি প্রভুরা ইসলাম তাহজিদ ও তামুদ্দুমের দোহাই দিয়ে আমাদের সুপরিকল্পিতভাবে কোণঠাসা করে রেখেছিল যাতে আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক তথা আত্মিক কোন রকমের হৃদয় যোগাযোগ গড়ে না ওঠে। কারণ, তারা জানত যে, এই দুই বাংলার জীবন, ভাষা ও সংস্কৃতিকে এত মিল যে এর অপর এদের দুজনের মধ্যে যদি সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ও গড়ে ওঠে তবে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক মিশরীয়দের উভয়কে পৃথক রেখে সাবেক পূর্ব বাংলাকে শোষণে যাতা কলে নির্দিষ্ট করে পশ্চিম পাকিস্তানের ধূসর মরুভূমিকে শ্যামল মরুদ্যানে রূপান্তর করা যাবে না।
কিন্তু বাংলার আত্মসচেতন সংগ্রামী মানুষ দীর্ঘ ২৫ বছরের বিশেষ করে, শোষক্ত ন’মাসের রক্তমাখা সংগ্রামের মাঝে পশুর সে কুটিল সাধকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এখন আর সে বিষাক্ত বায়ুর কোনই স্থান নেই।
দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই আমাদের সরকার অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে নানারকম পরিকল্পনা নিয়েছেন যাতে আমাদের বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্র সমূহের সাথে আমাদের এক আহ্বান প্রানের ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইতিমধ্যেই ভারত-রাশিয়া সহ অন্যান্য বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র সমূহ থেকে কত যে কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, সমালোচক, অধ্যাপক, শিল্পী, আমাদের দেশে মেহমান হয়ে এসে আমাদের ধন্য করেছেন, তা’না গুনে বলা মুশকিল।
বিশেষ করে, পশ্চিমবাংলা ও ভারতের অন্যান্য মেহমানেরা আমাদের মাঝে এসে যে ভাব বিনিময় করে গেছেন তাতে নিঃসন্দেহে এদেশে এক নতুন স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণচাঞ্চল্যের সঞ্চার হয়েছে। তারাও আমাদের প্রাণের উত্তাপে উল্লেখিত ভাবাপ্লুত।
সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশ সরকার একটি নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন। এ পরিকল্পনা অনুসারে ভারতের বা পশ্চিমবাংলায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এবং বাংলাদেশের ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হবে। এই পরিকল্পনার ফলশ্রুতি হিসেবে ঢাকার কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় চলচ্চিত্রের দারুন মহোৎসব চলছে। এসব চলচ্চিত্র দেখার জন্য রাজধানীর মানুষের মাঝে এখন দারুণ ছোটাছুটি ভাব। কারণ আপাতত মাত্র এক সপ্তাহের উৎসব। দিল্লিতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হবে আগামী ২৫শে এপ্রিল থেকে।
ঢাকার উৎসবের উদ্বোধনকালে আমাদের বেতার ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বলেছেন যে, “এই দুটি দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সাযুজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভারতীয় ছবির প্রদর্শনী প্রথম পদক্ষেপ।”
আমরাও আশা করি, আমাদের এই উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গঠনের পথে আজকে যে ক্ষুদ্র চারাগাছটি রোপন করা হলো, তা একদিন নিশ্চয়ই মহীরুহ হয়ে দেখা দেবে।

কথা ও কাজের সঙ্গতি থাকা চাই

কিছুদিনের মধ্যেই অসাধু ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে বলে সংবাদপত্র সূত্রে খবর পরিবেশিত হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রের উল্লেখ করে এই সংবাদমাধ্যম আরো জানাচ্ছে যে, ইতিমধ্যেই বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর নাম তালিকা প্রণয়ন করা সম্পন্ন হয়েছে এবং সরকার এবার শুধু এদের শনাক্ত করেই ক্ষান্ত দেবেন না, সকল প্রকার মুনাফাখোর ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নিবেন।
তালিকা প্রণয়নের কাজে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতিটি মহকুমায় তদন্ত ও উপদেষ্টা কমিটি নামে দুটি পৃথক কমিটি গঠন করেছেন। মহকুমা প্রশাসক, মহকুমা পুলিশ প্রধান, মহকুমা দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রধান ও আনসার এ্যাডজুটেন্টের সমন্বয়ে এসব তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এই তদন্ত কমিটি বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রণয়ন করেছেন।
সংবাদ সূত্রটি আরো জানায় যে, এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেশের এক হাজার তেইশ জন সিমেন্ট ব্যবসায়ীর মধ্যে ৫৪২ জনের লাইসেন্স বাতিল করে দেয়া হয়েছে এবং অনুরূপভাবে ৬৮৪ জন ঢেউটিন লাইসেন্সধারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৪২ জন এর লাইসেন্স বাতিল করে দেয়া হয়েছে।
এরই প্রেক্ষিতে বলা যায়, অসাধু ব্যবসায়ীরা বিচিত্র রূপে আজ দেশ ছেয়ে গেছে। নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি থেকে শুরু করে শিশুখাদ্য, প্রাণ রক্ষাকারী ওষুধ পত্র, বাড়ি ঘর নির্মাণের যাবতীয় সরঞ্জামাদিসহ পরিধেয় বস্ত্রের সর্বত্রই তাদের গতিবিধি। এদের অসাধুতা দুই রকম। এক-ব্যবসায়ের অধিক মুনাফার অবলম্বন করা, দুই-ভুয়া লাইসেন্স সংগ্রহ করা। ফলে প্রকৃত ব্যবসায় যার মূল কথা হলো সততা তার বদলে আজ ব্যবসার মূলধন হয়েছে ‘অসততা’। তাই ব্যবসায়ীর লক্ষ্য আজ উৎপাদন, সরবরাহ ও সময়সাপেক্ষ ন্যায্য মুনাফা। লাভের পরিবর্তে শুধু হাতবদলের মারফত তড়িৎ অর্থপ্রাপ্তির নেশায় উদ্বেগ। সেখানে নীতি নেই, ধর্ম নেই, সমাজ দেশ ভবিষ্যৎ ঐতিহ্য কিছুই নেই। তাই প্রায়ই সংবাদপত্রে পরিবেশিত খবর জানতে পারা যায়, বেকারির আটা-ময়দার বরাদ্দের অধিকাংশ যায় ভুয়ো লাইসেন্সধারীদের হাতে, যার ফলে প্রকৃত বেকারির দোকানগুলো বন্ধ থাকে। নায্য মূল্যের দোকানের দ্রব্যগুলি ন্যায্যমূল্যে ক্রেতাসাধারণের আয়ত্তে না এসে চলে যায় অসাধু ব্যবসায়ীদের খপ্পরে। টিসিবি’র দ্রব্যাদি নির্দেশিত দোকানের পরিবর্তে শোভা পায় মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের দোকানে দোকানে।
এরই প্রেক্ষিতে আবার পাল্টা সংবাদ পরিবেশিত হয় অসৎ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, যে কোনো মূল্যে দুষ্কৃতিকারী ও ভূয়ো সংকট সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিতে হবে, অসাধু ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের কঠোর সাজা দেয়া হবে ইত্যাদি। বলা বাহুল্য আজ পর্যন্ত আমরা কোন কথার সঙ্গে কাজের বাতি আত্মীয়তা দেখতে পাইনি। অথবা বলা যায় এ পর্যন্ত প্রকৃতই দুর্নীতি দমনের জন্য কোন গঠন মূলক কাজের দৃষ্টান্তকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা হয়নি যার উপর জনসাধারণ আস্থা স্থাপন করতে পারে।
লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, একদিকে যখন দেশবাসী গঠনমূলক কাজে দৃষ্টান্ত দেখার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে, অপরপক্ষ তখন শুধু কথা ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে এবং নিত্য নতুন উপায় অসাধু ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে ভাষণ করে উপস্থিত চমক সৃষ্টি করতে প্রয়াসী। কিন্তু একথা সত্য যে, দেশবাসী দেশের সার্বিক স্বার্থে আজ গঠনমূলক কাজের নমুনা রাখতেই হবে। তাই কথা বলার আগে কাজের প্রতি প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। কারণ ‘হচ্ছে হবে’ শুনতে আর কেউ রাজি নয়। তাদের জিজ্ঞাসা কবে হবে? এ প্রসঙ্গে বলা যায় কাজের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই শুধু চলবেনা, তার ব্যাখ্যাও আজ সচেতন জনসাধারণ দেখতে চায়। তাই প্রথম কথা অসাধু ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রণয়ন করার পর তাদের জন্য কি শাস্তি বিধান করা হচ্ছে এবং তার যথার্থ তাদের জন্য শাস্তিমুলক কিনারে প্রশ্নও থেকে যায়।
দ্বিতীয়তঃ সে মহকুমা তদন্ত কমিটি এইসব দুর্নীতি পরায়ন ব্যবসায়ীদের নাম তালিকা প্রণয়ন করবেন তারা কিসের ভিত্তিতে তা করবেন এবং তারা যে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না এমন নির্দেশের রূপরেখা কোথায় এও সাধারণভাবেই জিজ্ঞাসা থেকে যায়।
তৃতীয়তঃ কঠোর শাস্তি বিধানের উল্লেখ থাকতে হবে। অপরাধী কোন অপরাধে কতটা শাস্তি পেল সে কথাও জনসাধারণ জানতে চাইবে বৈকি! অর্থাৎ কথা ও কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতেই হবে। না হলে হতাশাগ্রস্ত জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে তাই এ কাজ পবিত্রই শুধু নয়, পবিত্রতম।
পরিশেষে আশা কুহকিনী হলেও তাকে ছাড়া জীবন অচল। তাই চরম হতাশার মধ্যেও আশার বাণী শুনলে আমরা একটু চাঙ্গা হওয়ার চেষ্টা করি। আশা করছি সরকারের তৎপরতায় এবার দেশ থেকে অসাধু ব্যবসায়ীদের উৎখাত অবশ্যভাম্বি হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভাটা পড়বে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতি আসবে এবং দুর্দশাগ্রস্ত জনজীবনের হতাশার ধুম্রজাল ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসবে। আশার আনন্দে আবার দেশবাসী হাসবে, বাঁচার শপথে নতুন দিগন্তের উদ্বোধন করবে। অতএব আর হচ্ছে হবে নয়-এর শরব উত্তর হোক নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!