You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.09 | বৈটপুর গণহত্যা | বাগেরহাট - সংগ্রামের নোটবুক

বৈটপুর গণহত্যা, বাগেরহাট

৯ অক্টোবর শনিবার ২২ আশ্বিন গভীর রাতে বাগেরহাট রাজাকার বাহিনীর অর্ধশতাধিক সদস্য সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে বৈটপুর হিন্দুপাড়া আক্রমণ চালায়। এই গ্রামের হরিশ গুহ ওরফে ধলু গুহ ছিলেন খুবই প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। তবে যুদ্ধের সময়ে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে বাগেরহাট বাসাবাড়ির মওলানা সাহেবের নিকট গিয়ে আপন জ্ঞাতি-গোষ্ঠীসহ কলেমা পড়ে মুসলমান হয়েছিলেন। রাজাকার বাহিনীর একটি গ্রুপ এই নওমুসলিমদের প্রতি মোটেই খুশি ছিল না। কেননা হিন্দুরা দেশ ছেড়ে চলে গেলেই তাদের সবচেয়ে বেশি লাভ হতো-তাদের জায়গা-জমি, সহায়-সম্পত্তি সহজে দখল করা যেতো। কিন্তু হিন্দুরা মুসলমান হয়ে থেকে গেলে সেই সুযোগের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। অগত্যা সিরাজ মাস্টারসহ কয়েকজন রাজাকার ঐ নওমুসলিমদের দুনিয়া থেকেই বিদায় করে দেয়ার কথা ভাবতে শুরু করে।
রাত প্রায় তিনটার দিকে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হরিশ গুহের বাড়িটা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে হরিশ গুহ ও তাঁর পুত্র প্রদীপ গুহ ওরফে নীলু গুহকে ডাকাডাকি করতে থাক। প্রদীপ গুহ সিরাজ মাস্টারকে দেখে বাড়ির ছাদের ওপর উঠে একটা গাছ বেয়ে নেমে যখন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তখন রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজাকার বাহিনী দরজা ভেঙে বাড়ির মধ্যে ঢুকে হরিশ গুহ এবং তাঁর ছোট ভাই গৌরপদ গুহকে ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। রাজাকাররা একইভাবে পাশের বাড়ি থেকে বোবা একটি কাজের লোকসহ সুশীল মজুমদারকেও ধরে আনে। এরপর একদল নওমুসলিমকে জবাই করার কাজে লোকসহ সুশীল মজুমদারকেও ধরে আনে। এরপর একদল নওমুসলিমকে জবাই করার কাজে ব্যস্ত হয় এবং অন্যদল লুটপাটে মনোনিবেশ করে। কবি আবুবকর সিদ্দিক এই গ্রামের বাসিন্দা। ঘটনার দিন তিনি বাড়িতে ছিলেন। সকাল বেলা সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান।
প্রথম স্পটে গৌরদা অর্থাৎ হরিশ গুহর ছোটভাই শুয়ে আছেন রাস্তার ওপর আড়াআড়ি। গলা কাটা। দু ফাঁক। চোখ সাদা ফ্যাকাসে। তার কোমরের কাছে পড়ে আছে হরিশ গুহর যুবক পুত্র নীলুর গলাকাটা লাশ। কিছু দূর গিয়ে গদা মালোর বাড়ির পেছনে রাস্তাজুড়ে সুশীল মজুমদার ও তার বাড়ির বোবা কাজের ছেলেটা, যার সঙ্গে আমি প্রায়ই ক্যারাম খেলতাম গ্রামে এলে, দুজনেরই গলা কাটা। সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রাজেডি অপেক্ষা করছিল আরো কয়েকশ গজ এগিয়ে মিত্তিরদের বাড়ির সামনেকার খোয়া ওঠা রাস্তায়। হরিশ গুহর লাশ চিত হয়ে পড়ে আছে। তাঁরও চিবুকের নিচ দিয়ে মোলায়েম করে কেটে দু ফাঁক করা। রক্ত ঝরে ঝরে কাটা মাংস রবারের মতো ফ্যাকাসে। সাদা মণি বের করা চোখ। গালও ফাঁক হয়ে আছে। কিন্তু মাথার খুলির উপরের চাড়া নেই। তছনছ ঘিলু। কিছুটা হলুদ ঘিয়েরঙা ঘিলু পাশের কচুপাতার সবুজ চাতালে। আর বেশ কিছুটা দূরে খুলির চাড়াটা চুলসুদ্ধ ছিটকে পড়ে আছে লাল খোয়ার ওপর।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত