You dont have javascript enabled! Please enable it! বৈদ্যডাঙ্গী ও ভাঙ্গীডাঙ্গী হত্যাকাণ্ড | ফরিদপুর - সংগ্রামের নোটবুক

বৈদ্যডাঙ্গী ও ভাঙ্গীডাঙ্গী হত্যাকাণ্ড, ফরিদপুর

বৈদ্যডাঙ্গী ও ভাঙ্গীডাঙ্গী লাগোয়া গ্রাম। বৈদ্যডাঙ্গী ফরিদপুরের চরভদ্রাসন ও ভাঙ্গীডাঙ্গী কোতোয়ালি থানায়। ঐ দুই গ্রামে দুই শতাধিক লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গ্রাম দুটির বাসিন্দারা ছিল প্রায় সবাই হিন্দু। ফরিদপুর পতনের পর ঐ দুই গ্রামের বাসিন্দারা গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে। তখন হাটে ঢোল পিটিয়ে বলা হয়, হিন্দু-মুসলমান কারো কোনো ভয় নেই। সবাই নিশ্চিন্তে বাড়িতে থাকবেন। সরকার তাদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেবে।
এটা প্রচারের পর অনেকেই বাড়ি ফিরে এলো। এ ঘটনার পর এপ্রিল মাসেই শতাধিক পাকসেনা অতর্কিতে গ্রাম দুটিতে হাজির হলো। সঙ্গে দোসর রাজাকারদের একটি বিরাট দল।
এই বহর দেখে লোকজন বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করে। তখন পাকসেনারা মানুষ শিকারের হিংস্র নেশায় মেতে ওঠে। যাকে সামনে পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করল। বন্দুক উঁচিয়ে ধাওয়া করতে করতে গুলি করল। গ্রাম থেকে পদ্মার পাড়ে যাওয়ার জন্য একটি খাল, তার ওপর একটি সাঁকো ছিল। ঐ সাঁকোর ওপর দিয়ে শতাধিক আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ওপার যাচ্ছিল। ওদের নিক্ষিপ্ত বুলেটে এসব নারী-পুরুষ লাশ হয়ে নদীতে লুটিয়ে পড়ল। খালের পাড়ে ছিল কাশবন। অনেকেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানেও মেশিন দাগা হয়। কাশবন রক্তাক্ত হয়। কেউ কেউ বুলেট ক্ষত নিয়ে বেঁচে যায়।
বাড়িগুলোতে ব্যাপক লুটপাট করে আগুন দেয়া হয়। অনেক লাশের ভিড়ে তিনি দেখতে পান প্রতিবেশী হীরালাল বিশ্বাসের পত্নী কাননবালার লাশ। আর সেই লাশের দুধ পান করছিল তার দু বছরের শিশু অধীর। তৎকালীন স্কুল শিক্ষক জীবনচরণের ঘটনার মধ্যে ভয়াবহ অবস্থার একটি চিত্র পাওয়া যায়। পাকসেনাদের চলে যাওয়া দেখে পড়ন্ত বেলায় বাড়ি ফিরে দেখতে পান, রাজাকাররা লুট করছে। তাদের দলপতি ছিল তারই ছাত্র। অন্যরা তেড়ে এলে ছাত্রটি তার প্রাণ ভিক্ষা দিয়ে চলে যায়। অনাহারে ক্লিষ্ট শিক্ষক জীবনচরণ নিভে যাওয়া চুলার হাঁড়ি থেকে আধাসিদ্ধ ভাত খেতে শুরু করেন। পাকসেনারা তাকে বাড়িতে দেখে পেট্রোল বোমা ছুড়ে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং বাড়ির সামনে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু তিনি তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
ভাঙ্গীডাঙ্গীর সুধীন চন্দ্র সিকদার তার পিতাকে কোলে করে কাশবনের মধ্যে শুইয়ে রেখে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। ঘাতকের বুলেট তার বাবাকে স্পর্শ করতে পারল না। পরে বৃদ্ধ পিতাসহ তিনি বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন, সব লুটপাট হয়ে গেছে, এমনকি ঘরের চালও নেই। তবুও তিনি বৃদ্ধ পিতাকে রেখে দেশ ছাড়লেন না। যে মাত্র স্বল্পসংখ্যক হিন্দু পরিবার দেশে ছিল তারা তাদের মধ্যে অন্যতম। তার অভিজ্ঞতার দুই দিকই আছে। তিনি লুটেরা রাজাকার দেখেছেন, আবার সৎ প্রতিবেশী পেয়েছেন। যারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়েও তার ও এ দেশে অবস্থানরত হিন্দু পরিবারগুলোর জন্য অনেক করেছেন। প্রতিবেশীরাই বাড়ি থেকে হাঁড়ি- পাতিল, চাল এবং তার পরিবারের থাকার জন্য টিনের ছাপড়া করে দিয়েছিলেন। ঐদিন বৈদ্যডাঙ্গী-ভাঙ্গীডাঙ্গীর পলায়নরত মহিলাদের নদীর পাড়ে জড়ো করে রাখল বিহারি ও বাঙালি রাজাকাররা। তারপর হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট শেষে পাকসেনাদের কাছে আটক মহিলাদের তুলে দেয়া হয়। পড়ন্ত বিকেলে ঐসব অসহায় নারীকে নিয়ে পৈশাচিক উন্মাদনায় মেতে উঠল পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকাররা।
বৈদ্যডাঙ্গী ও ভাঙ্গিডাঙ্গীতে নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক। এসব শহীদদের নদীর ধারে গণকবর দেয়া হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন সময় জমি চাষ করতে গিয়ে মানুষের হাড় ও কঙ্কাল পাওয়া গেছে। স্থানটি আজ পদ্মা গর্ভে বিলীন।
[১৫] আবু সাঈদ খান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত