You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাগেরহাট বধ্যভূমি, বাগেরহাট

বাগেরহাট শহরের একাধিক স্থান এবং শহরের উপকণ্ঠে বেশ কয়েকটি জায়গায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরগণ গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। বাগেরহাটে গণহত্যার প্রথম ঘটনা ঘটে ২৪ এপ্রিল। পাকবাহিনী এদিন বাগেরহাট এলাকায় প্রথম পদার্পণ করে। সেদিন তারা বাগেরহাট শহরে প্রবেশের মুখে ভুলক্রমে তাদের দুজন দোসরকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। এছাড়া এদিন তারা মির্জাপুর, কাড়াপাড়া, বাদেকাড়াপাড়া, ফুলতলা, দশানী ও বাগেরহাট শহরে অর্ধশতাধিক সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর ১০ মে থেকে বাগেরহাট আমরাপাড়ায় অবস্থিত ওয়াপদা রেস্ট হাউসে পাকবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হওয়ার পর বাগেরহাট ডাকবাংলার ঘাটকে বধ্যভূমি হিসেবে বেছে নেয়া হয়। তবে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে খুন করার ব্যাপারে পাকবাহিনীর সদস্যদের বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না। বাগেরহাটের এই বধ্যভূমিটি ছিল সেই অর্থে রাজাকারদের ব্যবহৃত বধ্যভূমি। ১৭ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত রাজাকাররা এখানে অসংখ্য লোককে এনে জবাই করে হত্যা করেছে।
বাগেরহাট শহরে আরো কয়েকটি বধ্যভূমির কথা জানা যায়। একটি মোজাম ডাক্তারের চেম্বাররের পেছনে অবস্থিত রসিক পরামাণিকের বিল্ডিং এবং অন্যটি পাকবাহিনীর ক্যাম্প মদনের মাঠের ওয়াপদা রেস্ট হাউস চত্বর। সাধারণ রাজাকাররা ডাকবাংলোয় থাকলেও রাজাকার-মেজর রজ্জব আলী রসিক পরামাণিকের বিল্ডিংটিকে রাজাকার বাহিনীর হেড কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করতেন এবং সেখানে তিনি অবস্থান করতেন। স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের এখানে ডেকে এনে হত্যা করা হতো। এই বিল্ডিংয়ের নিচে ছিল ব্যবসায়ী বলরাম সাহার দোকান। ৬ মে সকালে বলরাম সাহা এবং তাঁর তিনজন সঙ্গীকে রজ্জব আলী ফকির নিজে গুলি করে হত্যা করার পর দড়াটানা নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডে কোনো প্রকার গুলি খরচ করা হতো না, ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে মারা হতো। এ কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল রাজাকার বাহিনীর একাধিক ব্যক্তিকে, নৃশংসতা এতটা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে তা অনেকটা মিথে পরিণত হয়ে গেছে। বাগেরহাট রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা দিনের পর দিন বাগেরহাটের ডাকবাংলোয়, রসিক পারমাণিকের বিল্ডিংয়ে এবং মোজাম ডাক্তারের চেম্বারের নদীর ঘাটে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জবাই করে হত্যা করেছে।
মে মাসের মাঝামঝি সময়ে মোজাম ডাক্তারের চেম্বারের ঘাটে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন চরগ্রাম গ্রামের অধিবাসী আক্কাস আলী হালদার। ঘটনার দিন বাগেরহাটের ভৈরব নদীর অপর তীরের চরগ্রামে খোকা মালোদের বাড়িতে এসে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে রাজাকার বাহিনী খোকা মালোকে গুলি করে হত্যা করে এবং খোকা মালোর ছেলে পীযূষকেসহ বাগেরহাট মালোপাড়ার পলাশ ও রতনকে বাগেরহাটে ধরে নিয়ে যায়। তারপর মোজাম ডাক্তারের চেম্বারের ঘাটে এই তিনজনকে জবাই করে হত্যা করা হয়। নওমুসলিম তাহমিনা বেগম ওরফে দীপালি গুহ (বসু) একদিন দড়াটানা নদীর ঘাটে দড়িবাঁধা অবস্থায় চার-পাঁচটি গলাকাটা লাশ দেখতে পেয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, মদনের মাঠের ওয়াপদা রেস্ট হাউসে অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প চত্বরে যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার সংখ্যা খুব একটা বেশি ছিল না। স্পট থেকে মানুষ টেনে এনে কোনো একটা নির্দিষ্ট স্থানে খুন করার হাঙ্গামা অনেক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনাও তা প্রমাণ করে। ২৪ এপ্রিল তারা মির্জাপুর-কাড়াপাড়া হয়ে বাগেরহাট আসার পথে আসতে আসতে এভাবে প্রায় অর্ধশত মানুষকে হত্যা করে, তাদের ১০ মে তারিখের অভিযানেও বেশ কয়েকজন বাগেরহাটবাসীর জীবনাবসান ঘটে। শেষোক্ত দিনে আমলাপাড়া ফগ ডাক্তারের বাড়ির সামনে ফগ ডাক্তার এবং যশোদা দর্জিকে একসঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!