You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.06 | বাজুয়া গ্রাম গণহত্যা | খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

বাজুয়া গ্রাম গণহত্যা, খুলনা

৬ মে বৃহস্পতিবার রামপালে স্বাধীনতা বিরোধীদের এক বিশাল জনসমাবেশে রামপাল থানার পিস কমিটি গঠিত হবার দিন বিকেলে রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী ও লুটকারীদের সম্মিলিত দল রামপাল ও পার্শ্ববর্তী ওড়াবুনিয়া গ্রামের অনেকগুলো হিন্দু বাড়ি লুটতরাজ করে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ঐদিন রাত থেকে রামপাল থানার গ্রামগুলোর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতে আশ্রয় নেয়ার উদ্দেশ্যে গ্রাম ত্যাগ করে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ১১ মে মঙ্গলবারে বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার শরণার্থী পশুর নদীর অপর তীরে খুলনা জেলার দাকোপ থানার বাজুয়া নামক বাজার ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এসে জড়ো হয়।
বাজুয়া বাজার, স্কুল ও স্কুলমাঠে সমবেত শরণার্থীদের সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক। বিশাল এই দলটির মধ্য থেকে কয়েকজনকে নির্বাচন করা হয়েছিল, ভারতে যাওয়ার জন্য কোনো পথ বেশি সুবিধাজনক এগিয়ে গিয়ে তা দেখে আসার জন্য। কয়েক জনের সেই দলটি ফিরে না আসা পর্যন্ত শরণার্থীদের অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। শত শত শরণার্থী অবস্থান নিয়েছিল বাজুয়া বাজারের আশপাশে নৌকা ভিড়িয়ে। বাজুয়া বাজারের লালু বেদের নিকট এই দৃশ্য অসহ্য মনে হয়। শীর্ণ, ফসা ও ঋজু দেহের অধিকারী কুমিল্লা অঞ্চলের এই লোকটি এখানে সপরিবারে বসবাস করত এবং বাজারে তার একটি মুদির দোকান ছিল। সাম্প্রদায়িক কথাবার্তায় তার জুড়ি ছিল না এবং সেই গুণে সে দাকোপ থানার পিস কমিটির সদস্য হতে পেরেছিল। বাজুয়ার জনসমাগম সম্পর্কে পাকবাহিনীকে অবগত করানোর জন্য ১২ মে বুধবার খুব সকালেই সে খুলনার উদ্দেশে রওনা হয়। তারপর বেলা তিনটার দিকে পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বাজুয়া আসে।
১২ মে বুধবার ২৮ বৈশাখ বেলা তিনটার দিকে পাকবাহিনী বাজুয়া বাজারের কাছে এসে পৌঁছায়। লঞ্চে থাকতেই পাকবাহিনী গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছিল। প্ৰথম গোলাটির প্রচণ্ড শব্দ শরণার্থীদের নিকট বজ্রপাতের মতো মনে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকবাহিনী লালু বেদেকে সঙ্গে নিয়ে শরণার্থীদের আশ্রয় স্থানগুলোর দিকে অগ্রসর হয়। গুলির শব্দ শোনামাত্রই হাজার হাজার শরণার্থী প্রাণপণে পশ্চিম দিকে অবস্থিত গ্রামগুলোর দিকে ছুটতে শুরু করে। পাকবাহিনী গুলি করতে করতে তাদের অনুসরণ করে। স্কুলমাঠে সমবেত অর্ধশতাধিক শরণার্থী পালানোর চেষ্টা করার আগেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সেখানে তখন পিপুলবুনিয়া, জয়নগর, ভাসা, ভেকটমারী, নদের হুলা প্রভৃতি গ্রামের লোকজন অবস্থান করছিলেন। এদের মধ্যে পিপুলবুনিয়া গ্রামের হরিপদ মুখার্জি ছাড়া সকলকেই গুলি করে মারা হয়। হরিপদ মুখার্জিকে পাকবাহিনী ধরে এবং তার কাছে মুক্তিবাহিনীর লোকদের খবরাখবর জানতে চায়। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তাঁর সমস্ত শরীরে বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হয় এবং খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাঁকে মেরে ফেলা হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আরো অনেক লোক মারা যান।
হত্যাকাণ্ড সমাপ্ত হওয়ার পর লালু বেদে তার স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে লুটতরাজ পর্ব শুরু করে। লুটপাটের এক পর্যায়ে লুটকারীরা বজুয়া মাছ কোম্পানির দক্ষিণ পাশের মুচি পাড়ায় আগুন লাগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর মাছ কোম্পানির পশ্চিম পাশে অবস্থিত সুন্দরবাবুর বাড়িতেও আগুন লাগানো হয়। এর পরপরই পাকবাহিনীর নির্দেশে লুটকারীরা লাশগুলোকে পশুর নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত