বরগুনা গণহত্যা, বরগুনা
পাকবাহিনীর হামলার পর অনেকে বরগুনা শহর ত্যাগ করেছিল। পরে পাকসেনা ও শান্তি কমিটির আশ্বাস পেয়ে বরগুনা শহরের কয়েকশ হিন্দু পরিবার ফিরে আসে। কিন্তু পেছনে ছিল যড়যন্ত্র। ২৬ মে বিকেলে পাকসেনারা ও শান্তি কমিটির ইদ্রিস বিহারি কয়েকশ হিন্দু নারী-পুরুষকে বন্দি করে বরগুনা জেলখানায় রাখে। ২৮ মে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন শওকত পাথরঘাটার থানা ম্যাজিস্ট্রেট বজলুর রহমান সিকদারকে গ্রেফতার করে বরগুনা জেলে পাঠায়। পাকসেনারা ২৭ ও ২৮ মে হিন্দুদের কলেমা পড়ায়। ২৮ মে নারী ও শিশুদের মুক্ত করে দেয় এবং ঐদিন রাতে নারী নির্যাতন চলে। ২৯ মে পটুয়াখালী থেকে আগত মেজর নাদের পারভেজ এবং বরগুনায় অবস্থানকারী ক্যাপ্টেন শওকতের নির্দেশে পাকসেনারা বরগুনা জেলখানার ভিতরে ৫৬ জনকে হত্যা করে। নিহতদের ওয়াপদা রাস্তার পাশে কয়েকটি গর্ত করে মাটিচাপা দেয়া হয় গুলি খেয়ে অনেকে তৎক্ষণাৎ মারা যায়নি। তাদেরও জীবন্ত মাটিচাপা দেয়া হয়। পাকসেনাদের গুলি ডা. কৃষ্ণকান্তের চোয়াল ভেদ করে চলে যায়। তাকে মাটিচাপা দিলে উঠে আসার চেষ্টা করে। তখন তাকে কোদাল দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পুনরায় ৩০ মে বরগুনা জেলখানায় অনেককে হত্যা করে। বরগুনা এসডিওর লঞ্চঘাট ও বরগুনা ক্লাবের পেছনে ছিল বধ্যভূমি। এ বধ্যভূমিতে বরগুনা থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুর রশীদ মাজেদকে হত্যা করে। ১৪ আগস্ট বরগুনা পাতাকাটার লেহাজ উদ্দিন বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে চেয়েছিল এবং সে জন্য পাকসেনারা তাকে হত্যা করে। পাকসেনারা হত্যা করে লাশগুলো খাকদন নদীতে ফেলে দিত। আত্মীয়েরা অনেক সময় লাশ নিয়ে যেত। এসডিও লঞ্চঘাটের নাম দিয়েছিল বাংলাদেশ। পাকসেনারা হত্যার নির্দেশ দিয়ে বলত “উসকো বাংলাদেশ মে ভেজো’। গুলি করে চিৎকার করে পাকবাহিনী বলত-আর একবার জয়বাংলা বলো। পাকসেনারা পাথরঘাটা থানায় কয়েক হাজার লোক হত্যা করে এবং স্থানীয় দালালেরা তাদের সহায়তা করে। ২৪ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করায় পাথরঘাটা থানা নাচনাপাড়া গ্রামের মালেক মাস্টার ও তার পুত্র শাহজাহানকে গ্রেফতার করে। সুবেদার রব পাথরঘাটা বন্দরে লোহার পুলের নিকট মালেক মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করে। পিতার লাশ সামনে রেখে পুত্র শাহজাহানকে সুবেদার জিজ্ঞেস করল- তোমার কিছু বলার আছে? বিপ্লবী শাহজাহান পিতার মৃত্যু ও নিজের আসন্ন মৃত্যু উপেক্ষা করে উত্তর দিল, “তোমার মতো খুনির নিকট কী বলব? আমাকেও হত্যা করো—আমার রক্ত থেকে হাজার শাহজাহান জন্ম নেবে এবং তারা বাংলাকে স্বাধীন করবে”। সাথে সাথে শাহজাহানকে গুলি করে। জয়বাংলা উচ্চারণ করে শাহজাহান পিতার লাশের নিকট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। পাকসেনারা বরগুনা ক্লাবের পেছনে খাকদন নদীর তীরে হত্যা করলো কাকচিরার মুজিবুর রহমান কনককে। এমনিভাবে বেতাগী, বামনা, মির্জাগঞ্জ, গলাচিপা, খেপুপাড়া ও পটুয়াখালী থানায় পাকসেনারা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয় এবং স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের হত্যা করে। বাকেরগঞ্জ-পটুয়াখালী জেলায় পাকবাহিনীর বধ্যভূমি ছিল – সাগরদী ক্যান্টনমেন্ট, গৌরনদী কলেজ, রহমতপুর পাবলিক স্কুল, ভোলা খেয়াঘাট, ওয়াপদা অফিস, ঝালকাঠি শ্মশানঘাট, পিরোজপুর খেয়াঘাট ও হুলারহাট, পটুয়াখালী জেলখানা, বরগুনা জেলখানা প্রভৃতি। পাকসেনারা এ সকল বধ্যভূমিতে হাজার হাজার লোককে হত্যা করে। অন্যদিকে দালালেরা বন্দিদের মুক্তির নামে আত্মীয়দের নিকট থেকে অর্থ আদায় করত। শান্তি কমিটির সুপারিশে বা অর্থের বিনিময়ে দু- একজন মুক্তি পেলেও প্রায় সকলকে হত্যা করা হয়। মাত্র কয়েকজন বন্দি অবস্থায় ছিল এবং স্বাধীনতার পর তারা মুক্তি পায়। বরিশালবাসী যারা চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা প্রভৃতি স্থানে অবস্থান করছিল- তারাও অনেকে গণহত্যার শিকার হয়। পাকবাহিনী, শান্তি কমিটি ও রাজাকারের অত্যাচারে বরিশাল-পটুয়াখালীর লক্ষাধিক হিন্দু, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও ছাত্র পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। যাবার পথে এক এক সময় বিলের মধ্যে কয়েক মাইল পানি ও কাদার মধ্যে হাঁটতে হতো। পথে কলেরায়, না খেয়ে, রাজাকার এবং পাকবাহিনীর হাতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
[১৩৫] সিরাজউদ্দীন আহমদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত