You dont have javascript enabled! Please enable it!

বসুরাবাদ, ফুলতলা ও দেবীতলা গ্রাম এবং বাদামতা বাজারে গণহত্যা, খুলনা

বটিয়াঘাটা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত থানা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা উত্তরকালে খুলনা ও পার্শ্ববর্তী বাগেরহাট এলাকায় ব্যাপকহারে গণহত্যা ও লুটপাট শুরু হলে এসব এলাকার মানুষ এপ্রিলের প্রথম থেকেই জীবনের নিরাপত্তার জন্য ভারত যাওয়া শুরু করে। কিন্তু বটিয়াঘাটার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সুসংগঠিতভাবে এলাকায় অবস্থান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উৎসাহে, উদ্যোগে ও নেতৃত্বে এলাকাবাসী এ সিদ্ধান্ত নেয়। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা খান এ সবুরের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সবুর তাদের নিরাপত্তা বিধানের আশ্বাস দেন। বটিয়াঘাটা বাজারসহ থানার ফুলতলা, বাদামতলা, দেবীতলা, বসুরাবাদ প্রভৃতি গ্রামের লোকজন সবুর কানের ওপর ভরসা করে থেকে যায়। তবে তারা একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তারা নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে এবং বিভিন্ন ধরনের দেশজ অস্ত্রসহ এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বন্দুক সংগ্রহ করে। এ এলাকাটি নদী পরিবেষ্টিত হওয়ায় প্রতিরোধ ব্যবস্তা গড়ে তোলা অনেকটা সহজ হয়। তারা এলাকার চারপাশে নদীর কিনারায় দিন-রাত পালাক্রমে পাহারা দিতে থাকে। এ সময় বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত লোক এখানে এসে আশ্রয় নেয়। এত এখানকার লোকদের শক্তি-সামর্থ্য আরো বেড়ে যায়। ফলে বিভিন্ন লুণ্ঠনকারীরা প্রবেশের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
বটিয়াঘাটাবাসীর সুদৃঢ় প্রতিরোধ ব্যবস্থা মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাফল্যের সাথে অব্যাহত থাকে। ইতিমধ্যে অন্যান্য এলাকার জনসাধারণ ভারতে চলে যাওয়ায় ঐ সকল এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে এই এলাকার প্রতিরোধ ব্যুহ রচনাকারীদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় অনুচরদের দৃষ্টি পড়ে। ক্রমেই এ এলাকার ওপর তাদের চাপ বাড়াতে থাকে। এ অবস্থায় ১৯ মে হঠাৎ রাজাকার ও পাকসেনারা আক্রমণ চালিয়ে এলাকাটিকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করে। প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের দেয়া সাক্ষ্য থেকে এই আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ নিম্ন দেয়া হলো :
এ দিন ভোরে গানবোট এসে থামে কিসমত ফুলতলা গ্রামসংলগ্ন নদীর ঘাটে। গানবোট থেকে রাজাকার কমান্ডার হাবিবুর রহমান জোয়ারদার ও তার বাহিনীর সদস্য খোরশেদ, জাফর, কামালসহ বেশ কয়েকজন দ্রুত নেমে বাজারের মধ্যে চলে আসে। তাদের অনুসরণ করে পাকবাহিনীর কয়েকজন সদস্য। তারা এ গ্রামে প্রবেশ করে প্রথমেই এতদঞ্চলে ধনী ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত লক্ষণ মণ্ডলের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ করতে করতে এগিয়ে যায় গ্রামের ভেতর। এখানে ইজারাদার বাড়িতে প্রবেশ করে একজনকে হত্যা করে ও বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাস্তায় মস্তিষ্কবিকৃত এক ব্যক্তিসহ তিনজকে তারা হত্যা করে। এখান থেকে তারা প্রবেশ করে পার্শ্ববর্তী গ্রাম দেবীতলায়। এখানে তাদের হাতে খুন হয় হৃদয় ঘোষাই ও পার্বতী। এরপর তারা গ্রামের সমস্ত বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়। দেবীতলার পর প্রবেশ করে বটিয়াঘাটার আর একটি গ্রাম বসুরাবাদে। ঘাতকরা গুলি করতে করতে এ গ্রামে প্রবেশ করে। তাদের এ আকস্মিক আক্রমণে গ্রামবাসী দৌড়ে পালাতে থাকে। ফলে অনেকেই পলায়মান অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। গ্রামের আনাচে-কানাচে, রাস্তা, খাল প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে লাশ পড়ে থাকে। গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করে তারা প্রথমে মণ্ডল বাড়িতে আগুন দেয়। এ বাড়ির ১২টি ঘরের সবগুলোই পুড়ে যায়। এরপর গ্রামের অন্যান্য বাড়ি-ঘরেও আগুন দেয়। তাদের এ আক্রমণে এ সকল গ্রামের লোকজনসহ আশপাশের গ্রামসমূহের লোকজন সহায়-সম্বল ফেলে রেখে যে যেভাবে পেরেছে পালিয়ে ভারতের উদ্দেশে চুকনগরের দিকে চলে যেতে থাকে। উদ্দেশ্য সেখান থেকে ভারতে চলে যাবে। চুকনগরে যাওয়ার অনেক পথ থাকলেও সহজ পথ ছিল বাদামতলা হয়ে নৌকায় যাওয়া। তখন বাদামতলায় অনেক নৌকা ভাড়ায় পাওয়া যেত তাই অধিকাংশই বাদামতলায় জড়ো হয়।
বটিয়াঘাটা থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বাদামতলায় একটি বড় গ্রাম্য হাট ছিল। এ হাটের জন্যই এ গ্রামটি খ্যাত। এ গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত খালটি ভদ্রা নদীতে গিয়ে পড়েছে, যার মধ্য দিয়ে সহজে চুকনগরে যাওয়া যেত। ১৯ মে সাপ্তাহিক হাটের দিনে আগত হাটুরে এবং ভারতের উদ্দেশ্যে মাতৃভূমি ত্যাগকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ভিড় বাদামতলা তখন লোকে লোকারণ্য। ভারতগামী অনেকে ইতিমধ্যে যুগপৎ নৌকাযোগে এবং পদব্রজে চুকনগরের দিকে রওয়ানা হয়। এমন সময় বেলা ১০-১১টার মধ্যে পাকসেনা ও রাজাকাররা বসুরাবাদ থেকে এ গ্রামে প্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। আকস্মিক এ আক্রমণে সবাই দিগ্বিদিক পালিয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও ৫০-৬০ জন নর-নারীকে তারা ধরে ফেলে। সেনারা তাদের ধরে হাটের নিকটবর্তী নলিনীর ভিটায় নিয়ে প্রথমে তাদের নগদ অর্থ ও অলংকার কেড়ে নেয় এবং পরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
বাদামতলার হত্যাকাণ্ডের সময় বীরেন নামক ৮-৯ বছরের একটি বালক দৌড়ে পালানোর সময় রাজাকারদের সামনে পড়ে গেলে তাকেও তারা গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা মানুষের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আশপাশের গ্রামসমূহে প্রবেশ করে এবং বাড়ি-ঘরে নির্বিচারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই গণহত্যায় জনৈক অমূল্য চক্রবর্তী ও তার শিশুকন্যাকে দুগ্ধপানরত অবস্থায় তার স্ত্রী নিহত হয়। মিনি নটী এই শিশুটিকে হাবিবুর রহমান গোলদার নামক জনৈক রাজাকার আশ্রয় দেয় এবং যুদ্ধশেষে মাতৃভূমি ত্যাগকারী জনগণ এলাকায় প্রত্যাবর্তন করলে শিশুটিকে নিকট আত্মীয়দের নিকট ফেরত দেয়। ১৯ মে বাদামতলার পার্শ্ববর্তী গ্রাম আউসখালীতে ১৪ জন লোক নিহত হয় বলে জানা যায়। এভাবে কয়েক ঘণ্টার হত্যাযজ্ঞ ও অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে এলাকা ধ্বংস্তূপে পরিণত করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ খানসেনা ও তাদের সহায়তাকারীদের কাছে কীভাবে অসহায়ভাবে জীবন উৎসর্গ করেছে বাদামতলা বাজারের এই ঘটনা তার হাজারো উদাহরণের একটি মাত্র। কিন্তু এই সকল ঘটনায় সাক্ষাঃ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে কেউ কেউ সেই লোমহর্ষক স্মৃতি ধারণ করছে। করুণ আকুতি নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে এ রকম একজনের নাম প্রাণকৃষ্ণ হালদার। তার স্মৃতিচারণে-
বাজারে এসেই খানসেনাদের সামনে পড়ে যাই। বাজারে একপাশে জড়ো করে বসিয়ে রাকা ৫০-৬০ জন লোকের সাথে আমাকেও বসিয়ে দেয়া হয়। সামনে একজন খানসেনা আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে থাকে। আর একজন সকলের কাছ থেকে টাকা-পয়সা, সোনা-দানা হাতিয়ে নিতে থাকে। এ সময় ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল সামসু নামক একজন মুসলমান। তিনি আমাদের বাঁচানোর জন্য খানসেনাদের কাছে অনুরোধ করলে তাকে সাথে সাথে গুলি করে হত্যা করে। তখন আমি ভয় পেয়ে যাই। পাশের লোকদের কানে কানে বলি যে, ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। তার চেয়ে চল, সবাই মিলে ওদের জাপটে ধরি। কিন্তু ওরা আমাকে পাত্তা দিল না। এ সময় আাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করায়। আমি পিছনের দিকে দাঁড়াই। হঠাৎ ওরা আমাদের ওপর গুলি ছোড়া শুরু করলে আমি দৌড় দিয়ে পাশের খালে গিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর টের পাই যে, আমার পেটে একটি ছিদ্র। দেখি রক্ত বেরোচ্ছে।
এভাবে প্রাণকৃষ্ণ তাৎক্ষণিকভাবে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষার করতে সক্ষম হলেও পানিতে ভাসমান অবস্থায় তিনি যখন বুঝতে পারেন যে, তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং ক্ষতস্থান থেকে অনর্গল রক্ত ঝরছে তখন মানুষের সাহায্য পাবার আশায় কাল থেকে তাড়তাড়ি উঠে তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটি বাড়িতে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেখানে লোকজন না পেয়ে অন্য এক বাড়িতে যান। সেখানেও কোনো লোক নেই। এভাবে কাছাকাছি কোনো বাড়িতে লোক না পেয়ে অতি কষ্টে হাঁটতে হাঁটতে পাশের গ্রামে যেয়ে তার এক আত্মীয় বাড়িতে ওঠেন। এখানে এসে তিনি তাঁর বড় ভাই-ভাবীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দেখা পান। তারা ইতিমধ্যে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি তাদের সহযোগিতায় রক্ত বন্ধের প্রাথমিক ব্যবস্থা সেরে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙলে তিনি দেখেন যে, ঐ বাড়িতে কোনো লোকজন নেই এবং পাশের বাড়িতে আগুন জ্বলছে তাঁর ভাই- ভাবীকেও তিনি খুঁজে পেলেন না। পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হলে চলে যেতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই পালিয়েছে বুঝতে পেরে তিনি পাশের গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আস্তে আস্তে হেঁটে চলেন এবং জনশূন্য এ লোকালয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময়তিনি অসুস্থ হয়ে রাস্তার ওপর পড়ে থাকেন। এ সময় একজন পথিক তাঁকে পিঠে তুলে নিয়ে তাঁর কথামতো পাশের গ্রামে তাঁর এক আত্মীয় বাড়িতে পৌঁছে দেয়। তখন সে বাড়ির লোকজন ভারতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। প্রাণকৃষ্ণ তাদের সাথে নৌকাযোগে চুকনগর হয়ে ভারতে চলে যান। এবং সেখানে চিকিৎসা লাভ করে সুস্থ হন এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
[৯২] মোল্লা আমীর হোসেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!