বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৮ই এপ্রিল, শুক্রবার, ৫ই বৈশাখ, ১৩৮১
বৈদেশিক সহযোগিতা
স্বাধীনতার পর বিধ্বস্ত মাটির বুকে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জনের জন্য লড়াই করে চলেছে। কিন্তু রক্তাক্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি স্বাধীন স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের পক্ষে রাতারাতি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া একবারে ‘জলের মতো সহজ’ ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড চাঙ্গা করে তোলার জন্য প্রথমত পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে, এখন এই পাঁচশালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর অর্থনৈতিক সম্পূর্ণ নির্ভর করছে। স্বাধীনতার পর বহু বৈদেশিক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছে সাহায্য ও সহযোগিতার ক্ষেত্র পরীক্ষা করে অনেক দেশই বাংলাদেশকে আর্থিক ও কারিগরি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপান ভ্রমণের পর একটি জাপানি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছিল এবং বাংলাদেশকে নানাভাবে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে সেসব সহযোগিতা বাস্তবায়নে খবর ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত কতো দেশের কতো প্রতিনিধি দলই এলেন এবং সব দেখে শুনে চলে গেলেন। কিন্তু আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি এসব প্রতিনিধিদলে প্রতিশ্রুতি কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে? বৈদেশিক প্রতিনিধিদল বহুবার এসেছেন এবং তারা যথারীতি বাংলাদেশকে সাহায্য ও সহযোগিতা দানের কথাও ঘোষণা করেছেন। কিন্তু আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা কি এইসব সাহায্য সহযোগীতা মূলক মনোভাবকে সত্যিকার অর্থে কাজে লাগাতে পেরেছেন? বৈদেশিক প্রতিনিধিরা সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের ঘোষণা করেন, তাতে আন্তরিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের সরকার তাদের মধ্যে বৈদেশিক সহযোগিতা কাজে লাগানোর ব্যাপারে বড় একটা তৎপরতার লক্ষিত হয় না। ফলে অবস্থাটা পুরোপুরি একটি ‘কাগজে’ ব্যাপারে পরিণত হয়। বৈদেশিক সাহায্যের আশ্বাস আমরা প্রায়ই অবগত হই। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, ঐতিহাসিক সহযোগিতার অগ্রগতি সম্পর্কে কোন তথ্যই আমাদের গোচরীভূত হয়না। এই না হওয়ার নেপথ্যে অবশ্য আমাদের নিজেদের শৈথিল্য এবং গাফিলতিই প্রধানত দায়ী। তাই বৈদেশিক প্রতিনিধিরা যখন সহযোগিতা প্রদানের ঘোষণা করেন তখন আশ্বস্ত, হই আনন্দিত হই। কিন্তু সে আনন্দ স্থায়িত্ব লাভ করে না। দিনের পর দিন কেটে যায় বৈদেশিক সহযোগিতার কোন চাক্ষুষ প্রমাণ আমাদের হাতের কাছে থাকে না। এমনি যখন অবস্থা, তখন সফররত সোভিয়েত অর্থনৈতিক প্রতিনিধি দলের নেতা মিঃ সেরজিয়েভ বাংলাদেশের প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক ও কারিগরি সাহায্যের দিতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে ঘোষণা করেছেন। প্রতিনিধি দলের নেতা, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছেন। অর্থনৈতিক প্রতিনিধি দলের নেতা মিঃ সেরজিয়েভ বাংলাদেশেকে অর্থনৈতিক এবং কারিগরি দিকে সক্রিয় সহযোগিতা দেবেন বলে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রতিনিধি দলের নেতা বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা দানে আগ্রহী। নির্দিষ্ট কয়েকটি যোগাযোগ প্রকল্পে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহযোগিতা প্রদানের প্রস্তুত। প্রতিনিধি দলের নেতার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ মন্ত্রীর আলোচনা হয়েছে তাতে প্রকাশ, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে উপর দুটি সেতু নির্মাণ, ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের উপর দুটি সেতু নির্মাণ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ডবল লাইন বসানোর ব্যাপারে সোভিয়েত সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছেন।
একথা সত্যি যে, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও মসৃণ হয়ে ওঠেনি। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সংকটের জন্য দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিঘ্নিত হচ্ছে। যোগাযোগ ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত করার জন্য আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সক্রিয় ভূমিকা প্রতিপালন করা দরকার। নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সোভিয়েত প্রতিনিধিদের এই আশ্বাসবাণী বাস্তবে পরিণত করার জন্য আমাদের তৎপর হতে হবে। কারণ, নিতান্ত বন্ধুভাবাপন্ন না হলে কেউ কোনদিন সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করে না। কিন্তু আমরা যেন এই সহযোগিতামূলক মনোভাবের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন না করি, আমাদের এ ব্যাপারে বরং পৃষ্ঠপোষকতায় করা উচিত এবং যাতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়, সে ব্যাপারে তীক্ষ্ণ নজর রাখা দরকার। এতে আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্বের বন্ধনও দিন দিন দৃঢ়তর হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
এ প্রসঙ্গে আমরা অন্য আরেকটি বিষয়ের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশ ও সেনেগালের যৌথ উদ্যোগে একটি পাটকল প্রতিষ্ঠিত হবে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেনেগালের শিল্পমন্ত্রী মিঃ লুই অলেকজান্দ্রিয়ানের বাংলাদেশ সফরের পরিপ্রেক্ষিতে। তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছেন এবং আমাদের পাটমন্ত্রীর সঙ্গে তার আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এবং দুজনেই সেনেগালে পাটকল প্রতিষ্ঠার প্রশ্নের নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছেন। পাট মন্ত্রী জনাব শামসুল হকের সঙ্গে আলোচনার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সেনেগালের পাটকলের যাবতীয় কাঁচাপাট এবং বাংলাদেশ প্রস্তুত যন্ত্রপাতি দিয়ে বাংলাদেশে সেনেগালকে সাহায্য করবে। তাছাড়া সেনেগালে পাটকলের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
নিঃসন্দেহে এ সংবাদ শুভ সংবাদ। আমরা আশা করব এ উদ্যোগ যেন সাফল্য মন্ডিত হয়। কেননা এ উদ্যোগের সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতার প্রশ্নটি জড়িত আজকের দিনে শুধুমাত্র একতরফা হয় না। যারা দান করবেন দেখবেন দান ফেরত দেবার মত সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে কিনা। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সেনেগালে পাটকল প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করবে।
ঘটনা যদি সত্যি হয়
কৃষিপ্রধান অর্থনীতির দেশ আমাদের। কৃষি উৎপাদনের ঘাটতি আমাদের গোটা জাতীয় অর্থনৈতিক অস্তিত্বের উপরই আঘাত হানে। তাই আমাদের কৃষি উৎপাদন কে সকল প্রকারের রাহুমুক্ত রাখার সার্বিক প্রচেষ্টা চালানো সকলের কাম্য। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনকালে তা কীটের আক্রমণে বিনষ্ট হতে পারে কীটনাশক ওষুধের প্রয়োজন সে জন্যই। প্রতিবছরই আমাদের দেশকে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশ থেকে কীটনাশক ওষুধ আনতে হয়-এবং এ ক্ষেত্রেও চলে নানান ধরনের কারচুপি। বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন এর পরিকল্পনা সেলের চেয়ারম্যান এক সাংবাদিক সম্মেলনে কারচুপি সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে প্রকাশ।
তিনি বলেছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ১৯৭৩-৭৪ সালে যে কীটনাশক ঔষধ আমদানির কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তাতে ছয় কোটি টাকা অপচয় হবে। কর্তৃপক্ষ দশটি বিভিন্ন ধরনের ৪২২৬ টন কীটনাশক ঔষধ ৯ কোটি ৯২ লাখ ১৪ হাজার ৩০৬ টাকা ব্যয়ে আমদানি কর্মসূচি নিয়েছেন। এই ঔষধ ৬৭ লাখ ৪২ হাজার একর জমিতে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এই দশটি কীটনাশকের মধ্যে কম মূল্যের একটি মাত্র কীটনাশক আমদানি করলে তাতে মাত্র তিন কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয় হবে এবং ওই টাকার ঔষধ আনা যাবে তা ৯৪ লাখ ৬৭ হাজার একর জমিতে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এতে সরকার একদিকে যেমন ২৭ লাখ ২৫ হাজার একর বেশি জমিতে কীটনাশক ওষুধ সরবরাহ করতে পারবেন, তেমনি ৬ কোটি টাকার বাড়তি খরচের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারবেন।
জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের পরিকল্পনা সেলের চেয়ারম্যান যে হিসেব দিয়েছেন এবং এর সাথে সাথে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, আমরা মনে করি অবিলম্বে তার একটা বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত হওয়া উচিত। কারণ তার এই বক্তব্য যদি সত্য হয়, তবে নিঃসন্দেহে সরকার তা গ্রহণ করতে পারেন। অর্থনৈতিক দুর্দশায় নিপীড়িত আমাদের জাতীয় জীবন। খাদ্য আমদানিতে দিশেহারা আমাদের সরকার এবং সেই কারণেই অনেকটা বাড়তি খরচে জর্জরিত। এমতাবস্থায় যদি ৬ কোটি টাকা বাঁচানো যায়, তবে তা চাট্টিখানি কথা নয়, হতে পারে না। অন্যদিকে এ বক্তব্য যদি সত্য হয়, তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের যারা সরকারকে অহেতুক বাড়তি খরচের দিকে ঠেলে দিয়েছেন তাঁদের সম্পর্কের দ্বিতীয় চিন্তা করা উচিত। কারণ তাদের এ কাজ আর যাই হোক দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য নিশ্চয়ই। ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা বলবো, যে কোন সরকারি দপ্তরে সরকারের কাছে তাদের যেকোনো হিসেবে পেশ করার আগে তার জন্য আরও কিছু ভাবনা-চিন্তা করুন। ঢালাওভাবে টাকা বরাদ্দ করে ঢালাওভাবে তা খরচ করার কোনও অর্থ নেই-দরকারও নেই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক