You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা কলেজ আমবাগান বধ্যভূমি, ঢাকা

রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত সরকারি বাংলা কলেজে পুরো একাত্তর জুড়েই চলেছে নারকীয় হত্যাকাণ্ড। টিচার্স কমনরুমের দক্ষিণে দুটি কুয়া ছিল, অধ্যাপকের বাসভবনের গেটের সামনে এবং একটি কুয়ার একাত্তরে ভর্তি ছিল শহীদদের লাশে। অধ্যক্ষের বাসভবনের পেছনে যে আমবাগানটি ছিল (এখন মাত্র কয়েকটি আমগাছ রয়েছে) সেখানে হত্যা করা হয়েছিল ব্যাপক সংখ্যক বাঙালিকে। ছাত্রাবাসের পশ্চিমে অবস্থিত নিচু ভূমিতে (যেখানে দুটি কুয়া রয়েছে) মুক্তিকামী বাঙালিদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। এছাড়া কলেজের বারান্দায় ও ক্লাসরুমে ধর্ষণ করা হতো এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হতো। ‘৭১- এর নয় মাস ধরে এমনই জঘন্য ঘটনা ও হত্যাকাণ্ড চলেছে বাংলা কলেজে।
‘পূর্বদেশ’ প্রতিনিধি বাংলা কলেজের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে লেখেন, “বাংলা কলেজের পেছনেও ছিল বধ্যভূমি। বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করা হতো। স্বাধীনতার পর এই স্থানটির নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিল নরকঙ্কাল। শাড়ি, ব্লাউজ, চুড়ি, মাথার চুল এসব পাওয়া গেছে এখানে। বাংলা কলেজের এই স্থানটিতে অনেক মা-বোনের লজ্জা হরণ করে পরে হত্যা করা হয়েছে। যে জায়গাটিতে এনে হত্যা করা হতো, সেটি একটি ছোট গর্তের মতো। তবে গর্তটি ছিল বেশি গভীর। খালি জায়গাটার লাগোয়া একটি গর্ত দেখতে পেলাম। বেশ গভীর গর্ত। তবে পরিধি বড় নয়। কাছে গিয়ে দেখলাম, চাপ চাপ রক্ত জমাট হয়ে আছে। এ গর্তের ওপর রেখেই হয়ত তারা বাঙালিদের বধ করত।” স্বাধীনতার পর মিরপুর ও হরিরামপুরের প্রথম চেয়ারম্যান বাংলা কলেজের বধ্যভূমির লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, বাংলা কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনে ও পেছনে পুরোটিই ছিল আমবাগান। সেখানে বহু পুরনো আমগাছের শেকড়ের গায়ে তখনও ধারালো কোপের চিহ্ন দেখেছিলেন। গাছের এক পাশের নিচুজমিতে মাথার খুলির স্তূপ ও অন্য পাশে উঁচু জমিতে দেহের বাকি অংশ কঙ্কালের স্তূপ দেখতে পেয়েছিলেন। তা থেকে ধারণা করেন, গাছের বড় বড় শেকড়ের ওপর মাথা রেখে জবাই করা হয়েছিল বাঙালিদের। ফলে জবাইয়ের পর গাছের পাশের নিচু জমিতে মাথাগুলো গড়িয়ে পড়ে যায়, আরেক পাশে পড়ে থাকে দেহ।
প্রাণিবিদ্যা ভবনের পশ্চিম পাশে খালি জায়গাটি ছিল মূলত গণকবর। বাংলা কলেজের ভেতরে ও আশপাশে পড়ে থাকা শহীদদের সব লাশ আনোয়ারা বেগম নিজে কাঁধে করে এনে এ জায়গাটিতে মাটিচাপা দিতেন। তিনি আরো জানান, বর্তমানে যেটি টিচার্স কমনরুম, তার দক্ষিণে দুটি কুয়া বোঝাই শহীদদের লাশ তিনি দেখেছেন। প্রিন্সিপাল কোয়ার্টারের দক্ষিণে দরজার কাছেই একটি কুয়া ছিল। বাংলা কলেজে যারা হত্যা করত, বেশির ভাগই ছিল বিহারি। এছাড়া কিছু বাঙালিও তাদের সাথে ছিল। ‘৭১-এ যুদ্ধকালীন সময়ে ১২-১৫ জনের একটি দল দুটি মেয়েকে তুলে নিয়ে আসে। তাদের চিৎকারে তার বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। মেয়েগুলোকে ধর্ষণের পর কলেজের একটি রুমে আটকে রেখে চলে যায় ধর্ষণকারীরা। তখন আনোয়ারা বেগম তাদের ছেড়ে দিলে সন্ধ্যায় সেই দলটি আনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞাসা করে, ‘মেয়ে দুটি কোথায় গেল’? যিনি প্রশ্ন করেছিল তিনি স্পষ্ট বাংলাতেই প্রশ্ন করেছিল। বাকিরা কেউ কেউ উর্দুতে ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলেছিল।
[৬৬] মিরাজ মিজু

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!