You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.05 | ফেঞ্চুগঞ্জ গণহত্যা | সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক

ফেঞ্চুগঞ্জ গণহত্যা, সিলেট

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের বিশাল সার কারখানায় একাত্তরের ৪ অথবা ৫ মে সিলেট থেকে কয়েকটি সামরিক জিপ আসে। দ্রুতবেগে কারখানা এলাকায় প্রবেশ করে পুরো অঞ্চল ঘুরে শেষত অফিস ভবনে প্রবেশ করে। এর পরপরই পাকবাহিনী ভয়ঙ্কর এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে। কারখানা চত্বরে ঢুকে তারা প্রথমে গুলি করে কারখানার পশ্চিম ফটকের মালীকে, পরে একইভাবে হত্যা করে পূর্ব ফটকের আরো একজন মালীকে। এরা দুজন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় স্বাধীনতার প্রথম বলি।
কারখানার কাছেই মনিপুর চা বাগান। এখানকার দুজন শ্রমিককেও একই দিনে একইভাবে প্রাণ দিতে হয় পাক জল্লাদ বাহিনীর হাতে।
নিরীহ নিরস্ত্র চারজনকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ থানায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সূচনা। তা অব্যাহত থাকে অঞ্চল মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত। এদিকে মে-জুন মাস থেকেই মুক্তিসেনারা দেশের ভেতর প্রবেশ করে বিভিন্ন স্থানে সুযোগ-সুবিধামতো অপারেশন শুরু করে। এ রকম একটি অপারেশন করতে আসা গ্রুপের সদস্য ছিলেন আবদুল মালিক। বাড়ি বিয়ানীবাজার উপজেলায়। একটি সেতুতে অপারেশন করার জন্যে তিনি অবস্থান করছিলেন কায়স্থ গ্রামে। কিন্তু কীভাবে যেন তাঁর অবস্থানের খবর গোপন থাকে না। শেষ পর্যন্ত খবরটা পৌঁছায় রাজাকার মকই মিয়ার কাছে। তার সহায়তায় আবদুল মালিককে পাকড়াও করতে সমর্থ হয় পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সার কারখানায়। শুরু হয় তাঁর ওপর অকথ্য অমানুষিক নির্যাতন। নখের নিচ দিয়ে সুই ঢোকায়। চামড়া তুলে মরিচ লাগায়। এভাবে শারীরিক নির্যাতন করেও কোনো তথ্য বের করতে পারেনি। অবশেষে সামরিক জিপের পেছনে বেঁধে সমস্ত কারখানা এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এ অবস্থায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁর দেহ।
ফেঞ্চুগঞ্জ থানার অসংখ্য দেশপ্রেমিককে শারীরিকভাবেও নির্যাতন করা হয়। এঁদের মধ্যে আছেন মল্লিকপুরের আলাউদ্দিন। তিনি প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে কাটখাইয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। অক্টোবর মাসে তাঁকে ধরার জন্যে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি বিরাট বহর সেই বাড়ি ঘেরাও করে। এর আগেই অবশ্য আলাউদ্দিন গা ঢাকা দিতে সমর্থ হন। কিন্তু রেহাই পাননি তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্য। রাজাকার জহির মিয়া আলাউদ্দিনের স্ত্রী আছিয়া বেগমকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বেদম প্রহার করে। পুত্র বোরহান উদ্দিন রিয়াজসহ তাঁর শ্যালকদের থানায় নিয়ে আসা হয়। বোরহানকে তিন দিন বন্দি করে রাখা হয় মানিককোনা গ্রামে। তারপর ৬০ টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়া পান তিনি। আর ১ হাজার ২০০ টাকা ঘুষ দিয়ে আলাউদ্দিন আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা বিশ্বাস করেনি তাঁকে। তাই বন্দি করে নিয়ে যায় তারা তাঁকে সালুটিকরে। সেখানে ১৭ দিন পর্যন্ত তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। শিক্ষক আবদুল গনিকেও ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তিন রাত বন্দি রাখা হয়। করা হয় তাঁর ওপর চরম শারীরিক নির্যাতন। অন্যদিকে আনফর আলীকে সিলেট নিয়ে গিয়ে অমানুষিক প্রহার করে তারা। তিন মাস পর্যন্ত আটক রাখে। গোলাঘাটের আওয়ামী লীগ কর্মী শফিকুল ইসলামকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে তাঁরা প্রহারে প্রহারে জর্জরিত করে। কুতুবপুরের আবদুল জব্বারের ওপর চালানো হয় চরম নির্যাতন। এছাড়া রাজনপুরের সৈয়দ লিয়াকত আলীকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কারণ, তাঁর ভাই সৈয়দ মকবুল আলী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মাইজগাঁওয়ের তাছাদ্দর আলীকে শারীরিক নির্যাতন করে পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা।
মশাহিদ আলী (জড়া মাস্টার) ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। তিনিও ধরা পড়েন। তাঁর ওপরও চলে নির্মম নির্যাতন। ফলে তাঁর জীবনীশক্তি লোপ পায় এবং শেষে মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
মাইজগাঁও স্টেশনের পশ্চিমের বাড়ির জোনাব আলী এক গরিব লোক। ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে তিনি চীনাবাদাম বিক্রি করতেন। তাঁকেও একদিন বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তারপর গুলি করে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
মল্লিকপুরের জোবেদ আলীকে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী কুশিয়ারার তীরে। সেখানে তাঁর ওপর চালানো হয় নানা অমানুষিক অত্যাচার। মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে যায় তারা তাঁকে। একইভাবে অত্যাচার করা হয় কুতুবপুরের আবদুল জব্বারের ওপর।
মাইজগাঁওয়ের আফতাব আলী শাহ্। এক সময় সার কারখানায় চাকরি করতেন। কিন্তু পেশাগত জীবন পরিত্যাগ করে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত হন। তাঁর ওপরও শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে তিনি শেলিংয়ে মারা যান।
রাজনপুর গ্রামের আনোয়ার আলী ছিলেন ইপিআরের একজন জমাদার। পুলিশের এএসআই বারি তাঁকে ধরে নিয়ে যায় কুলাউড়া। তাঁর ওপর চালানো হয় অকথ্য অত্যাচার। ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাক-ভারত যুদ্ধে নিজের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা সংবলিত প্রাপ্ত খেতাব দেখিয়ে পরে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ফরিদপুরের পানুলাল যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। যুদ্ধ শেষে মৌলভাবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর রেখে যাওয়া মাইন বিস্ফোরণ ঘটলে ফেঞ্চুগঞ্জের সুলেমান চৌধুরী এবং মানিক মিয়া শহীদ হন।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত