You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা আন্দোলনে টাঙ্গাইল
আন্দোলনে করটিয়া-মির্জাপুরের ছিল প্রধান ভূমিকা

ময়মনসিংহ জেলার আরেক রাজনীতিসচেতন মহকুমা টাঙ্গাইল। এ মহকুমার মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনীতির সঙ্গে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট। স্মর্তব্য, ১৯৫৭ সালের সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক কাগমারী সম্মেলন, এর নেপথ্যে প্রগতিবাদী রাজনীতি। অন্যদিকে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক-সংস্কৃতির মহকুমা হিসেবেও টাঙ্গাইলের রয়েছে পরিচিতি।
১৯৪৮ সালের মার্চের আন্দোলনের দিন কয় আগেই মুসলিম লীগ রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সংগঠক শামসুল হক ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল আসেন মার্চের আন্দোলন-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলােচনা করতে। দিনটি সম্ভবত ৮ মার্চ ১৯৪৮। নিবন্ধকার ফিরােজ মান্নার বিবরণমতে, ওই দিন রাতে এক বৈঠকে টাঙ্গাইলে ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আহ্বায়ক নুরুল হুদা। সদস্য হযরত আলী শিকদার, সৈয়দ নুরুল হুদা ও নুরুল ইসলাম।
এ পর্বে টাঙ্গাইলের আন্দোলনে করটিয়ার সা’দত কলেজের ছাত্ররা বিশেষ ভূমিকা রাখে। ১১ মার্চ সৈয়দ নুরুল হুদা ও বদিউজ্জামানের নেতৃত্বে ওই কলেজের ছাত্ররা মিছিল করে টাঙ্গাইল শহরে আসে। উদ্দীপ্ত হয় শহরের ছাত্রছাত্রীরা। তারাও ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানসহকারে মিছিলে যােগ দেয়। স্কুলগুলােতে ধর্মঘট পালিত হয়।
কিন্তু শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়। তাদের বেধড়ক লাঠিচার্জে ছাত্রনেতাদের অনেকে আহত হয়। গ্রেপ্তার হন কয়েকজন ছাত্রনেতা। ইতিপূর্বে আন্দোলনের প্রস্তুতি প্রক্রিয়ায় সামসুর রহমান খান, উপেন মালাকারসহ বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হলে আন্দোলন শুরুতেই বাধার মুখে পড়ে। আন্দোলন আর বেশি দূর এগােতে পারেনি। অবশ্য ইতিমধ্যে ১৫ মার্চ ঢাকায় মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের সমঝােতা চুক্তির ফলে ঢাকার বন্দীদের পাশাপাশি টাঙ্গাইলের ভাষাসংগ্রামীরাও মুক্তি পান। আন্দোলন স্থগিত করার বিনিময়ে এই মুক্তি।
এরপর ভাষা আন্দোলনের মূল পর্ব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। টাঙ্গাইলও এ পর্বে আন্দোলনের শরিক। টাঙ্গাইল মহকুমা সদরে কোনাে কলেজ না থাকলেও স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। নিকটবর্তী সা’দত কলেজ ও মির্জাপুরের কুমুদিনী মহিলা কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা নেয় মিছিল ও সভা-সমাবেশে যােগদান করে। মেয়েদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা জ্যোৎস্না, ঝরনা, ছালেহা খাতুন প্রমুখের।
এ আন্দোলনে (১৯৫২) বিভিন্ন স্তরের মানুষের ছিল উল্লেখযােগ্য সহযােগিতা, অর্থ সরবরাহে, সংবাদ সংগ্রহে এবং সাংগঠনিক পরামর্শ ও উৎসাহদানে। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মাওলানা ভাসানী এবং স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতাদের। প্রকৃতপক্ষে টাঙ্গাইলের ভাষা আন্দোলন টাঙ্গাইল শহরসহ করটিয়া ও মির্জাপুরের ছাত্রছাত্রী ও জনতার সম্মিলিত আন্দোলন। শহরবাসী স্কুলছাত্র-ছাত্রীরা প্রেরণা ও উৎসাহ পেয়েছে পূর্বোক্ত দুই উৎসের ছাত্রছাত্রীদের সংগ্রামী চেতনা ও আন্দোলন থেকে।
২১ ফেব্রুয়ারি একদিকে টাঙ্গাইলের ছাত্রছাত্রীদের ধর্মঘট, মিছিল, স্লোগান, সভা; অন্যদিকে একই দিনে কুমুদিনী কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্রীদের সভা। সভা পরিচালনা করেন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী কোহিনুর ইউসুফ শাহী। সভায় যথারীতি বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে, আরবি হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হয়। (আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
পিছিয়ে থাকেনি করটিয়া সা’দত কলেজ। ২১ ফেব্রুয়ারি করটিয়ার কলেজ, হাইস্কুল ও হাই মাদ্রাসার ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে। সেই সঙ্গে মিছিল, স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এবং মিছিল শেষে সভা। এতে সভাপতিত্ব করেন আবদুস সালাম খান। আন্দোলন চলেছে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে একই ধারাবাহিকতায়।
টাঙ্গাইল মহকুমার আন্দোলনও শুধু শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না, যে কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল থানাসহ প্রান্তিক এলাকায়—যেমন ভূঞাপুর, গােপালপুর, মির্জাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়। দৈনিক জাজাদ পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ‘২৪ ফেব্রুয়ারি মির্জাপুরে স্থানীয় সকল স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্র এবং দোকানদারগণ পূর্ণ হরতাল পালন করে। দুই হাজার লোকের এক সভায় বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার এবং ছাত্রদের উপর গুলী বর্ষণের জন্য যাহারা দায়ী তাহাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানানাে হয়।’ (আজাদ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
টাঙ্গাইলের গুরুত্বপূর্ণ থানা ভূঞাপুরে আন্দোলন জোরালাে রূপ গ্রহণ করে। দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদনে তেমনটি প্রকাশ পেয়েছে। সেই বিবরণমতে, ভূঞাপুর এম ই স্কুল ও ভূঞাপুর কলেজের ছাত্র ও জনসাধারণের সমবায়ে ঢাকায় ছাত্র ও জনসাধারণের ওপর গুলী বর্ষণের প্রতিবাদে এখানে এক বিরাট মিছিল ও জনসভা হয়। ভূঞাপুর কলেজের বাংলার অধ্যাপক সুলতান আহমদ ভুইয়া সভাপতিত্ব করেন।’ (৩ মার্চ ১৯৫২)।
বলা বাহুল্য, প্রতিটি মিছিলে যেমন নুরুল আমিন সরকারের নিন্দা ও পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান তােলা হয়েছে, তেমনি প্রতিটি সভায় একই রকম প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এককথায় প্রতাপশালী মুসলিম লীগ দল ও তাদের শাসনের তীব্র বিরােধিতা। এদিক থেকে টাঙ্গাইল ও তার প্রান্তিক অঞ্চল ছিল এক কাতারে।
টাঙ্গাইলে শহীদ স্মরণে শহীদ মিনার নির্মিত হয় ১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস পালন উপলক্ষে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন থেকে উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। এই মহতী কাজে অকাতর সহায়তায় যেমন খােদা বক্স মােক্তার, তেমনি বিন্দুবাসিনী স্কুল এবং বিন্দুবাসিনী মন্দির। পরিকল্পনায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। একাত্তরে ভেঙে ফেলা শহীদ মিনার নতুন করে নির্মিত হয় স্বাধীনতার পর।
টাঙ্গাইলের ভাষা আন্দোলনের প্রভাব পড়ে সেখানকার পরবর্তী রাজনীতিতে, নির্বাচনে এবং মুসলিম লীগের অভাবিত পরাজয়ে।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!