You dont have javascript enabled! Please enable it!

ফতুল্লা গণহত্যা, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার অধিবাসী আব্দুল করিম ভূঁইয়া পাক জল্লাদ বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলেছেন—
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর ২৬ মার্চ শুক্রবার বিকেল ৪টায় আমাদের নারায়ণগঞ্জ মহকুমার ফতুল্লা থানাধীন পাগলা বাজারে এসে হানাদার পাকবাহিনী প্রথমে খলিল নামক এক নিরীহ শ্রমিককে হত্যা করে। পরে বাজারের মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জেনসহ মোট ৭ জন লোককে একত্রে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পাগলা বাজারটিকে জ্বালিয়ে দেয়। চারদিকে বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছিল। বাজারের এক ঘরে জেলে হরিদাস প্রাণ ভয়ে লুকিয়েছিল। তার বোনসহ তাকেও হত্যা করা হয়। একটি ভলকানাইজিং ওয়ার্কশপের ভেতরে কয়েকজন শ্রমিক লুকিয়েছিল। দোকানসহ তাদের সকলকে পুড়িয়ে মারে।
পাগলা তেল কল হতে শুরু করে ফতুল্লা পিএনও পর্যন্ত নদীর কূল ভর্তি শুধু আদম সন্তানদের লাশের স্তূপ আর স্তূপ। এসব জায়গায় হত্যা করা হতো অসংখ্য মানুষকে। প্রত্যেক রাতে ৭-৮ খানা ট্রাক এই পাগলায় এসে থামত এবং এখানে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় খুন করে নদীতে ফেলে দিত। তেল কল হতে ফতুল্লা পিনএনও পর্যন্ত এই জায়গাটা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল।
৫ মে পাকবাহিনী মুসলিম লীগের দালাল এবং শান্তি কমিটির লোক আমাদের গ্রামের এক হিন্দু ভদ্রলোকের স্ত্রী ও দুটি মেয়েকে নিশ্চিন্তপুরের এক বাড়িতে নিয়ে যায়। দালালদের দখলবাড়ি বলে পরিচিত সেখানে সারারাত মদ্যপান ব্যভিচার ও অত্যাচার করে এবং পরে ওয়াসার বাঁধের ওপর দস্যু বাহিনী ও ১৬ জন শয়তানও ৩ জন মেয়ের ওপর পালাক্রমে অত্যাচার চালায়। পরে দালালদের সহযোগিতায় আরো একটি মেয়েকে সংগ্রহ করে পাগলায় তেল কলের ভেতর আটকে রাখে। এই মেয়েদের মধ্যে একটির বয়স ১৪ বছর। কয়েক দিন পর বুড়িগঙ্গা নদীতে ৫টা মেয়ের লাশ পানিতে ভাসতে দেখা যায়।
হানাদার বাহিনী ওয়াসা বাঁধের কাছে একটা গরিব মহিলার ঘরে ঢোকে। মহিলাটি তখন আসরের নামাজ পড়ছিল। নামাজের বিছানার উপরই দস্যুরা তাকে আক্রমণ করে এবং তার ১০-১১ বছরের মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ৫-৬ জন মিলে পর পর মেয়ের ওপর বলাৎকার করে।
১১ জুলাই পাগলার বালুরঘাটের কাছে ইটের স্তূপের পাশে ডিপোর ফাঁকে ফাঁকে ১২২ জন লোকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রত্যেকের বয়স ১৮ হতে ৪৫ বছর হবে।
১৩ জুলাই মুসলিম লীগের দালালরা এবং শান্তি কমিটির সদস্য যারা তখন রাজাকার ছিল ২০-২৫ জন মিলিটারি নিয়ে বাড়ি হামলা করে। আমাকে বাড়ি না পেয়ে আমার ছোট ভাই ও তার শ্বশুরকে ধরে নিয়ে যায়। দৈবাৎ আমি শহরে থেকে প্রাণ রক্ষা পাই। আমার ভাইকে অনেক মারধর করার পর আটক করে রেখে তার শ্বশুরকে ছেড়ে দেয় এবং আমার কাছে খবর পাঠায়। দালালদের একজনকে তখন আড়াইহাজার টাকা দিলাম। তবু তারা আমার ভাইকে ছাড়ল না। ফতুল্লা থানার ওসি মাসুদ সাহেব আমার বহু পরিচিত। তাঁর নিকট টেলিফোন করার পর বহু কষ্ট করে পাক পুলিশ রক্ষিত দালালদের বাড়ি থেকে আমার ভাইকে উদ্ধার করি।
১৪ জুলাই ১০-১২ জন পাক পুলিশসহ ঐ দালালরা আমার বাড়িতে হামলা করে। উদ্দেশ্য ছিল আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে ধরে নিয়ে যাবে। কারণ আমি মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করি।
ফতুল্লা পিএনও থেকে উপরোক্ত পাক পুলিশ তাদের দল নিয়ে আমার বাড়ি হামলা করে। পার্শ্ববর্তী ফাজিলপুরের দুজন মুক্তিবাহিনীর ভাই টের পেয়ে দৌড়িয়ে আমার বাড়ি এসে আমার স্ত্রীকে খবর দেয়। খবর পেয়ে আমার স্ত্রী পার্শ্ববর্তী গ্রামে গিয়ে আমার পরিচিত লোকের ঘরে আশ্রয় নেয়। ছোট দু বাচ্চাকে চৌকির ওপর শুইয়ে দেয় আর কোলের বাচ্চাকে নিয়ে চৌকির নিচে পালিয়ে থাকে। দস্যুবাহিনী দালালসহ সেই বাড়ির দিকে দৌড়িয়ে যায় এবং আমার স্ত্রী কোথায় লুকিয়ে আছে তা বলে দেবার জন্যে বাড়ির মালিক সবদর শেখকে প্রহার করে। তাঁকে মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে মাড়ায় আর রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাকে আঘাত করে।
অবশেষে হানাদার দল উক্ত ঘরে ঢোকে এবং চৌকির নিচ থেকে আমার স্ত্রীকে বাইরে টেনে আনে। তখন পার্শ্ববর্তী অন্যান্য বাড়ির স্ত্রীলোকেরা প্রাণের ভয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করেছে। তা দেখে হানাদার দল আমার স্ত্রীকে বসিয়ে রেখে তাদের পিছু ধাওয়া করে। এই ফাঁকে আমার স্ত্রী বাড়ির পার্শ্ববর্তী ধান ক্ষেতের পানির মধ্যে গিয়ে বসে থাকে। বেলা ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত দালালদের সহযোগিতায় হানাদার দল গ্রামের প্রায় ঘরেই বহু স্ত্রীলোকের ওপর অত্যাচার করে।
ফতুল্লা থানার মুক্তিযোদ্ধা থানা কমান্ডার এ কে এম ফজলুল হক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন-
২৭ মার্চ। কয়েক ঘণ্টার জন্যে আইন শিথিল। ভীতসন্ত্রস্ত চিত্তে ঢাকা থেকে ছুটে আসছে অগণিত মানুষ গ্রামের দিকে। পাকসেনারা বাস থামিয়ে পুরুষদের গাড়ি থেকে নামায়। আমাদের সাথে তাদেরও পঞ্চবটী রাস্তার ব্যারিকেড পরিষ্কার করার কাজে লাগায়। এমন সময় ঢাকা থেকে আগত একটি বেবিট্যাক্সি পাকসেনারা রাস্তা থেকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দিয়ে সরে যায়। আমরা স্থানীয় যুবকরা দৌড়ে গিয়ে বেবিট্যাক্সিটি সড়কে তুলি। বেবিট্যাক্সি থেকে মহিলা, পুরুষদের বের করে স্থানীয় ডাক্তার নুরুল হকের কাছে নিয়ে যাই।
ফতুল্লার নন্দখালী ব্রিজে একজন পাগলকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। ২৯ মার্চ। সকাল ১১টা। রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার সৈন্যরা হরিহরপাড়া জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করে। এখানে দারোগা বাবু বিশ্বেশর দে তাঁর পরিবারবর্গ নিয়ে বাস করতেন। বিশ্বেশর বাবু পাকসেনাদের ভয়ে ৫-১০ মিনিট আগে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। তাঁর বড় ছেলে প্রণব কুমার দে (ছাত্র) ও শ্যালক দরজা তালা লাগিয়ে উঠোনে দাঁড়াতেই পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে পড়ে যায়। সাথে সাথে তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করে। দুজনেই এলিয়ে পড়লেন মৃত্যুর কোলে।
শুরু হলো হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর নির্মম অত্যাচার। রাজাকার মোস্তফা, আব্বাস, মোক্তার, ইকবাল, ফিদা খান, মহিউদ্দিন সকলে দলবদ্ধভাবে লুটপাট করে।
হরিহর পাড়ার পাকিস্তান ন্যাশনাল অয়েল মিল ডিপোতে (বর্তমান যমুনা অয়েল মিল) পাকসেনাদের ক্যাম্প। এখানে মে মাসের ৬-৭ তারিখ থেকে ট্রাক বোঝাই বন্দি ইপিআরদের নিয়ে আসে। তাদের পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি ও হাফ প্যান্ট। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এদের একটি ঘরে আটকে রাখে। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত চলত পাকসেনাদের হত্যাযজ্ঞ। ন্যাশনাল অয়েল মিল ডিপোর প্যাকেড জেটির অগ্রভাগে ইপিআরদের দাঁড় করিয়ে কখনো হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একজনের কোমরের সাথে আরেকজনের কোমর দড়ি দিয়ে বেঁধে একসাথে ১০- ১৫ জনকে হাঁটুজলে দাঁড় করিয়ে গুলি করত। অসহায় বন্দি ইপিআরদের আর্তচিৎকারে হরিহরপাড়া প্রকম্পিত হয়ে উঠত। প্রতিদিন বুড়িগঙ্গা নদীর জল তাঁদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে আর মৃতদেহগুলো স্রোতের টানে ভেসে গেছে অনেক দূর।
[১১০] রীতা ভৌমিক

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!