ফাড়াবাড়ী হাটের বধ্যভূমি ও গণহত্যা, ঠাকুরগাঁও
“যে পাকা কুয়াটি এত দিন মানুষের পিপাসা মিটাতো, সেদিন খানসেনারা ১৮টি লাশ কুয়োর মধ্যে ফেলে কুয়োর পিপাসা মিটিয়ে চলে গেল।” বাক্যটি ১৯৭২ সালের ১৭ ডিসেম্বর তারিখে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ফিচারের একটি অংশ থেকে নেয়া। ফিচারের সঙ্গে একটি পরিবারের ছবিও দেয়া হয়েছে। ছবিটি ছিল একটি শহীদ পরিবারের। আর এই পরিবারের প্রধান কর্তা ছিলেন শহীদ সহর আলী, যিনি আরও ১৭ মানুষের সাথে শহীদ হয়েছিলেন ফাড়াবাড়ীতে।
ফাড়াবাড়ী হাট। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে বর্তমান সময়ের এক বর্ধিষ্ণু জনপদ।
৫ এপ্রিল থেকে শহরের অনেক মানুষ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। সবার ধারণা ছিল খানসেনারা ঠাকুরগাঁও শহর দখল করলেও সহসা নদী ভেঙে গ্রামে আসতে পারবে না। অনেকে পরিবার পরিজন আশপাশের গ্রামে রেখে শহরের বাড়ি ঘরে দোকানপাট পাহারা দেবার জন্য একজন বা দুজন রাতে শহরে কাটাত। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এভাবেই চলছিল।
১৫ এপ্রিল খানসেনাদের হাতে ঠাকুরগাঁও শহরের পতন হয়। ফাড়াবাড়ী আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে প্রায় ১৫০ জনের মতো শহুরে লোক আশ্রয় নিয়েছিল। এরা বেশিরভাগই ছিল শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পরিবারভুক্ত।
পহেলা জ্যৈষ্ঠ, ১৫ এপ্রিল। বেলা অনুমান আড়াইটা। জ্যৈষ্ঠের খর দুপুর শান্ত স্নিগ্ধ ফাড়াবাড়ীতে নেমে এলো মৃত্যুদূত। এক লরি ভর্তি খানসেনা ও তাদের সহচর অবাঙালি বিহারিরা প্রবেশ করল এই গ্রামে। হাটের মধ্যে লরি রেখে তারা এলাকা ঘিরে ফেলল। আশপাশের সব বাড়ি থেকে বের করে ধরে নিয়ে গেল সব পুরুষগুলোকে। ১৮ জনকে একত্রে হাত বেঁধে দাঁড় করাল এক বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণের একটি কুয়ার পাশে। তারপর সবাইকে একত্রে গুলি করে হত্যা করা হলো এবং লাশগুলোকে ফেলে দেয়া হলো কুয়ার মধ্যে। ১৮ জনের ভীতসন্ত্রস্ত পরিবার পরিজন পাশের থেকে মাটি কেটে কুয়াটি ভরাট করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পরবর্তীতে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। এখানে শহীদ ১৮ জনের মধ্যে সহর আলী, তার ছোট ভাই মো. বহর আলী, কালীবাড়ি এলাকার তিন সহোদর মো. আকতার হোসেন, আলতাফ হোসেন এবং মোক্তার হোসেনের নাম পাওয়া যায়।
[ ৯৫] মোহাম্মদ এমদাদুল হক
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত