ফুলতলা থানা গণহত্যা ও নির্যাতন এবং বাদামতলা গণহত্যা, যশোর
ফুলতলা থানার বাদামতলা গ্রামটি ফুলতলা বাজারের দক্ষিণ দিকে যশোর-খুলনা মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। এসব এলাকা থেকে হাজার হাজার সংখ্যালঘু পরিবার ইতিমধ্যে ভারতে চলে গেলেও বারুই সম্প্রদায়ের পান ব্যবসায়ী কিছু গরিব, অশিক্ষিত, নিরীহ ও সরল প্রকৃতির লোক তখনো পৈতৃক ভিটেমাটিতে থেকে যায়। মে মাসের শেষ দিকে এদের ১৪-১৫ জন লোক পানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে বাদামতলা অবস্থানরত পিস কমিটির লোকদের ইঙ্গিতে পাকসেনারা তাদের রাস্তার পাশে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। ফলে ঘটনাস্থলেই ১২-১৩ জন লোক নিহত হয় এবং বাকি ২- ১ জন আহত হয়ে বেঁচে যায়।
২৭ অক্টোবর শিরোমনির শেখ মাহাতাবউদ্দিন, শেখ ইন্তাজ আলী ও মাত্তুডাঙ্গার আকু হাওলাদারকে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অভিযোগে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করে হত্যা করে। এ ছাড়া শেখ মাহতাব ইদ্দনের বড় ছেলে শেখ এখলাক হোসেনকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর খুলনা সার্কিট হাউসে পাকসেনাদের হাতে সোপর্দ করে। সেখানে সে ডিসেম্বরে খুলনা বিজয় হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত হয়। আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে এখনো সে জীবিত আছে। [৯২] মোল্লা আমীর হোসেন ফুলপুর কংস নদীর পাড় নির্যাতন কেন্দ্র ও গণহত্যা, নেত্রকোনা নেত্রকোনা জেলার নান্দাইল থানার ফুলপুর কংস নদীর পাড়ে পাকবাহিনী ব্যাপক নির্যাতন ও গণহত্যা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শী হায়দার রহমান তালুকদার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘৭১-এ আমার বয়স ছিল ১৫-১৬ বছর। সে সময় স্কুলে পড়তাম। গরু চড়াতে মাঠে যেতাম, সেখান থেকে পাকসেনাদের ক্যাম্পের কার্যকলাপ দেখতে পেতাম। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ধরে এনে বরইগাছের সঙ্গে বেঁধে তাঁদের বেয়নেট দিয়ে খোঁচাত, বুট দিয়ে লাথি মারত, রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করত। সারাদিন এমন পাশবিক নির্যাতনের পর মাগরিবের আজানের পর তাঁদের গুলি করে হত্যা করত। এটা প্রায় প্রতিদিন চলতো। যুদ্ধের পুরো ন’মাস পাকহানাদাররা এভাবে অসংখ্য লোককে হত্যা করে। ২-৩ জন থেকে শুরু করে ৩০ জন পর্যন্ত লোককে আমরা প্রতিদিন নির্যাতন করতে দেখেছি। স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে তারা আরও বেশি বেশি লোক ধরে এনে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করত।
কংস নদীর পাড়ে নির্যাতন ও গণহত্যার আরও বিবরণ জানা যায় প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল হাই-এর বর্ণনা থেকে। তিনি বলেন, পাকসেনারা ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাট, হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহগামী বাসগুলো এ স্থানে থামাত। যাত্রীদের নামিয়ে তল্লাশি করত তাদের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাগজ আছে কিনা। যাদের সন্দেহ করত তাদের বরইগাছের সঙ্গে বেঁধে চড় থাপ্পড়, লাথি কিল ঘুসি মারত ও বেয়নেট চার্জ করত, তারপর রাতের বেলা এদের কংস নদীর ব্রিজের কাছে গুলি করে হত্যা করত। এভাবে ১৫-২০ জন থেকে ১০০ জন পর্যন্ত লোককে হত্যা করে। যুদ্ধের শেষদিকে এ হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। যুদ্ধের সময় রিয়াজউদ্দীন তালুকদার (৫৮) পাকবাহিনীর সাচ্চাপুর ঘাট ক্যাম্পে ছিলেন। তিনি বলেন, ক্যাম্পের মেজর লেফটেন্যান্ট, হাবিলদার ও সুবেদাররা পূর্ব ও পশ্চিম বাখাই অঞ্চলের হিন্দু এলাকা থেকে মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণ করত এবং ক্যাম্পে আটকে রাখত। কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ জন মেয়েকে ধরে এনে এখানে রাখে।
হালুয়াঘাট, মাইলতাবাড়ি, নেত্রকোনা এসব বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন অসংখ্য লোককে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করত। তিনি আরও বলেন, আমার পরিচিত যেসব লোককে এখানে হত্যা করে তাঁরা হলেন, মুর্শিনী পোদ্দার, তাঁর বাবা নারায়ণ (ডাক্তার) জুবাইর দাস, ইমাতপুরের কালসু, ভূপেন্দ্র তালুকদার, বীরেন্দ্র তালুকদার প্রমুখ।
এছাড়া মৌলভী মো. আব্দুল করিম (৭২) এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তাঁর গ্রাম ফুলপুরের রুবননাথ চৌধুরীর বাড়িতে পাকবাহিনী ৮-৯ জন নারী পুরুষকে হত্যা করে। মানিক চন্দ্র দাসের (৩৯) বাবা এবং কনকপ্রভা দাস, তাঁর স্বামী নরেন্দ্র চন্দ্র দাসকে নিদারুণ নির্যাতন করে পাক আর্মিরা সেদিন গুলি করে হত্যা করে। ২২ জনকে একত্রে নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে রাজাকার আবু বকর সিদ্দিক সবাইকে গুলি করে। তাদের মধ্যে ৯ জনের মৃত্যু হয়। বাকিরা পানির মধ্যে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে বাঁচেন। নয় জনের মধ্যে ছিলেন নরেন্দ্র চন্দ্র দাস ছাড়া উপেন্দ্র তালুকদার, নগেন্দ্ৰ বিশ্বাস, যোগেন্দ্র দাস, রমনীভদ্র, অবিনাশ দাস প্রমুখ।
আব্দুর রশিদ ১৯৭১ সালে কংস নদীর মাঝি ছিলেন। এখানকার ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকসেনাদের নদী পারাপারে কাজ করত। খুব কাছ থেকে তাদের নির্মমতা, অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বলেন, হালুয়াঘাট থেকে ট্রাকে করে মানুষ ধরে এনে একজনের পেছনে আরেকজন দাঁড়
করিয়ে এগুলোতেই ৫-৬ জনকে হত্যা করত। এখানে তারা প্রায় হাজার দুয়েক মানুষকে হত্যা করে।
[৩৪] দিলরুবা বেগম
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত