You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.06 | পিরোজপুর গণহত্যা | বরিশাল - সংগ্রামের নোটবুক

পিরোজপুর গণহত্যা, বরিশাল

মে মাসের ৩ তারিখে পাকবাহিনীর কমান্ডার কর্নেল আতিক মালিক, ক্যাপ্টেন মালেক, ক্যাপ্টেন এজাজ পিরোজপুর শহরে পৌঁছে। ট্রেজারির টাকা নিয়ে সুন্দরবনে আত্মগোপন করার জন্য ২ তারিখে পিরোজপুর ত্যাগ করে। কিন্তু পথে কয়েকজন রাজাকার খোকনকে ধরে পাকসেনাদের নিকট সমর্পণ করে, ক্যাপ্টেন এজাজ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পিরোজপুরের এসডিও আবদুর রাজ্জাক (কুমিল্লা), ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান (যশোর), এসডিপিও ফয়জুর রহমান (ময়মনসিংহ) মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেন। ৬ মে কর্নেল আতিক ও ক্যাপ্টেন এজাজের নির্দেশে বলেশ্বর নদীর তীরে আবদুর রাজ্জাক, মিজানুর রহমান ও ফয়জুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কয়েক দিন ধরে তাদের লাশ বলেশ্বর নদীতে ভাসছিল। পাকসেনারা দুর্নীতি দমন দারোগা হিরেন্দ্র মহাজনকে (রাউজান, চট্টগ্রাম) গুলি করে মৃত ভেবে নদীতে ফেলে দেয়। কিন্তু তখনও তিনি জীবিত এবং নদী সাঁতরে এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। শান্তি কমিটি জানতে পেয়ে তাকে পাকবাহিনীর নিকট ধরিয়ে দেয় এবং তাকে পুনরায় গুলি করে হত্যা করে। পিরোজপুরে কলেজের ছাত্র বিধানচন্দ্র হালদারকে ১৬ জুন হত্যা করে বলেশ্বর নদীতে ফেলে দেয়। পিরোজপুরের ভাগীরথী দেবী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিত। তাই পাকবাহিনী তাকে চলন্ত জিপের পিছনে বেঁধে পিরোজপুরের রাস্তায় হত্যা করে। সওগাতুল আলম সগীর ও তার সহযোদ্ধারা মঠবাড়িয়া ত্যাগ করার পর শান্তি কমিটি, সিআই পুলিশ জালাল উদ্দিন, ওসি সামাদ ৬ জুন জিয়াউজ্জামান, মোস্তফা, আনোয়ারুল কাদির, গণপতি হালদার, সুধীর রঞ্জন, মালেক, অমল, বীরেন, সামসুল হক আবুকে গ্রেফতার করে। ১০ জুন তাদের পিরোজপুরে পাঠানো হয় এবং ঐদিন রাতেই ক্যাপ্টেন মালেকের নির্দেশে তাদের বলেশ্বর নদীর খেয়াঘাটে পাকসেনারা হত্যা করে। গণপতি হালদারের পিতা নগেন্দ্ৰনাথ পণ্ডিত, গ্রাম কেয়াবুনিয়া। তিনি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় যশোর বোর্ডে প্রথম হয়েছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানের ছাত্র ছিলেন। আনোয়ারুল কাদির মঠবাড়িয়া কলেজের ভিপি এবং মোস্তফা দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। জিয়াউজ্জামান খুলনা কমার্স কলেজের ছাত্র ছিলেন। বরিশালের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট ললিত কুমার বল মঠবাড়িয়ার মিরুখালী গ্রামে পালিয়েছিল। মঠবাড়িয়ার রাজাকার বাহিনী ললিত কুমার বল ও নিওয়েত মাখনলাল দাসকে ধরিয়ে দেয়। পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন মালেকের নির্দেশে তাদের মঠবাড়িয়া পশু ডাক্তারের অফিসের নিকট খালের তীরে হত্যা করা হয়। এমনিভাবে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মঠবাড়িয়ার প্রায় গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং শত শত লোক হত্যা করে। তারা বামনা থানার হোগলপতি গ্রামে আবুল হাশেম জমাদারের মূল্যবান ঘর পুড়িয়ে ফেলে এবং গৃহশিক্ষককে হত্যা করে। পিরোজপুর ছাত্রলীগের সভাপতি ওমর ফারুক একজন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ছিলেন। ৩০ মে বরিশালে বিহারি পুলিশ হানিফ মামা ফখরুদ্দীনের নিকট হতে জোর করে ফারুককে ধরে নেয়। ৪ জুন তাকে সাগরদী খালের তীরে গুলি করে হত্যা করে। স্টিমার ঘাট ছিল বধ্যভূমি। গ্রাম থেকে ধরে এনে বাঙালিদের স্টিমার ঘাটে হত্যা করত। ২১ ও ২২ মে, ২২ আগস্ট শিয়ালকাটি ও কেউন্দিয়া গ্রামে অনেককে হত্যা করে। কেউন্দিয়া নিবাসী পিরোজপুর কলেজের ছাত্র মোক্তাদিরুল ইসলাম বেল্লালকে ২১ মে কাউখালী লঞ্চঘাটে হাত-পা ভেঙে হত্যা করে। কেউন্দিয়ার নুরুল মমিনকে গুলি করে হত্যা করার সময় তার ছোট বোন এ ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে মারা যায়। কাউখালীর সুভাষ চন্দ্র দত্তকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে স্টিমার ঘাটে পাকসেনারা হত্যা করে। পাকবাহিনী নাজিরপুর ও বানারীপাড়া থানায় কয়েক শত লোক হত্যা করে। ৫ অক্টোবর ও ৪ নভেম্বর পাকবাহিনী মজিরপুরের শ্রীরামকাটি, গিলাতলা, কলাদোয়ানিয়া গ্রামের অনেককে হত্যা করে এবং ঘরবাড়ি ও বাজার পুড়িয়ে দেয়। কলা দোয়ানিয়ার জহিরুদ্দীন বাহাদুরকে ৬ কার্তিক জিপের পেছনে বেঁধে পাকবাহিনী হত্যা করে। তার অপরাধ ছিল তিনি একজন আওয়ামী লীগার ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।
পিরোজপুর ছিল শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদরদের ঘাঁটি। তাই পিরোজপুর মহকুমায় হত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংস সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
একমাত্র পিরোজপুর জেটিতে ও হুলারহাটে পাকসেনারা ১০০০০ লোক হত্যা করেছে। তারা পিরোজপুর মহকুমার ৩০,০০০ লোক হত্যা করেছে। পিরোজপুরের উত্তর রাণীপুর নিবাসী কালু মহাজনকে কাউখালী স্টিমার ঘাটে হত্যা করে। প্রথমে কুড়াল দিয়ে পাকসেনারা কালু মহাজনের পা কেটে ফেলে এবং পরে কুড়াল দিয়ে তাকে চিরে হত্যা করে। ৪ মে খাদিমপুর, ৫ জুন কদমতলা, ৬ সেপ্টেম্বর জুজখোলা প্রভৃতি গ্রাম আক্রমণ করে কয়েকশ লোক হত্যা করে। তেজনকাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে খালের তীরে একসাথে ২৩ জনকে হত্যা করে। জুজখোলার ইউনুস আলী শেখ, তার পিতা, চাচা, ভাইসহ এক পরিবারের ১৪ জনকে হত্যা করে।
[১৩৫] সিরাজউদ্দীন আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত