You dont have javascript enabled! Please enable it!

পীরগঞ্জ গণহত্যা ও নির্যাতন কেন্দ্র, ঠাকুরগাঁও

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ থানা এলাকায় খানসেনারা প্রথম আগমন করে ১৭ এপ্রিল তারিখে অর্থাৎ ঠাকুরগাঁও দখল করার ২ দিন পরে। ১৭ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে খানসেনারা পীরগঞ্জ থানা সদরে প্রবেশ করে। ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগে পীরগঞ্জেও বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড দেয়া হয়েছিল। এদিন খানসেনারা ৭টি ট্রাকভর্তি লোকজন ও সৈন্য নিয়ে এসে ব্যারিকেড সরিয়ে পীরগঞ্জে হাজির হয়।
ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর শহর পতন হয়ে যাবার পর অনেকেই সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় সব বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। খানসেনাদের অতর্কিত আগমনে এসব পতাকা নামিয়ে প্রায় বাড়িতে দ্রুত পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। খানসেনাদের ট্রাকবহর প্রথমে পীরগঞ্জ বাজারে পূর্বপ্রান্তের চৌরাস্তায় অবস্থান নেয়। তারপর আস্তে আস্তে পশ্চিম চৌরাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। সেখানেও বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে চলে যাবার সময় অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, আব্দুল জব্বার, ডাক্তার সুজাউদ্দিন, মোজাফফর বানিয়া এবং সেলিমসহ আরো ২-৩ জনকে ট্রাকে উঠিয়ে নেয় এবং ঠাকুরগাঁও যাবার পথে জামালপুর ভাতারমারি ফার্মের পাশে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়।
পীরগঞ্জ ত্যাগ করার সময় খানসেনারা বাজার ও রাস্তার উভয় পাশের দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করেছিল।
খানসেনা ও বিহারিরা মিলে এখানে ৭-৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর এলাকার মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক গোলাম মোস্তফার নিহত হবার ঘটনা সাধারণ মানুষকে গৃহছাড়া হতে বাধ্য করে। খানসেনারা তাদের দোসরদের সহযোগিতায় পীরগঞ্জ কলেজে ঘাঁটি স্থাপন করে। স্বাধীনতাবিরোধী দালাল রাজাকারদের সহযোগিতায় খানসেনারা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষেও যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভারতে গিয়েছিলেন তাঁদের বাড়িঘর ও পরিবার পরিজনের লোকদের চিনিয়ে দেয়া, ঘরবাড়ি লুট করাসহ সর্বত্র অগ্নিসংযোগ করার কাজে এসব দোসরেরা জড়িত ছিল বলে জানা যায়। রাজাকারেরা ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়ুয়া মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনকে ধরিয়ে দেয়। খানসেনারা পরবর্তীতে সালাহউদ্দিনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সালাহউদ্দিনের দেহ খাবলে খেয়েছে বাঘ।
কলেজে ঘাঁটি স্থাপন করার পর প্রতি রাতেই তারা নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে আটকে রাখত এবং নানা উপায়ে নির্যাতনের পর কখনো গুলি করে আবার কখনো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করত। হত্যার পর পীরগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসের সামনের পুকুরে ফেলে দিত। জানা যায়, এখানে ৯ জনের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর এখান থেকে অসংখ্য কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ পুকুরটা ‘মুক্তিযোদ্ধা পুকুর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
পীরগঞ্জ থানা ভূমি অফিসের সামনে শহীদ আবু ইসাহাকে কবর এবং আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের সামনে যে ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে সেখানেও বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেছে খানসেনা ও তাদের দোসরেরা। তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ, গুরুদাস তালুকদার, বরদা চক্রবতীর জন্মস্থান ও কর্মক্ষেত্র স্বাভাবিকভাবেই অবাঙালি বিহারি ও খানসেনাদের আক্রোশের কারণ হয়েছিল। তাছাড়া শহীদুল্লাহ শহীদ, মো. মোখলেছুর রহমান, কমরেড মনসুরুল আলম, ডা. সুজাউদ্দিন, ডা. আব্দুল মালেক, ডা. আবদুর রাজ্জাক, প্রাক্তন এমপিএ মোখলেছুর রহমান, খলিলুর রহমান, এমপিএ একরামুল হকের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় খানসেনারা একদিকে যেমন ভীত ছিল অন্যদিকে সুযোগ পেলেই বাঙালি হত্যায় মেতে উঠত।
[৯৫] মোহাম্মদ এমদাদুল হক

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!