পুসাইনগর নির্যাতন ও গণহত্যা, মৌলভীবাজার
১৯৭১ সালের ৮ মে। সারা বাংলাদেশে তখন হত্যার তাণ্ডবলীলা চলছে। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানা সদর থেকে প্রায় দু মাইল উত্তরের পুসাইনগর গ্রামের নিরীহ গ্রামবাসী তখনও নিজেদের ঘরবাড়ির মায়া কাটাতে পারেনি।
সিদ্ধান্ত হয় ৮ মে পুসাইনগর ও জয়চণ্ডি গ্রামের বাসিন্দারা চলে যাবে ভারতে। কারণ ভারত ছাড়া নিরাপদ আশ্রয়স্থল আর নেই। এ সময় শান্তি কমিটির থানা আহ্বায়ক আবদুল বাতিল তাঁদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ওই রাতেই আহ্বান করা হলো শান্তি সভা। সুপাইনগরের সমস্ত অধিবাসীর জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের উপস্থিতিকে বাধ্যতামূলক বলেও নির্দেশ দেয়া হলো।
রাত তখন নয়টা প্রায়। সুপাইনগর জয়চণ্ডী, বিচরাকান্দি প্রভৃতি গ্রামের বহু অসহায় লোক সভাস্থলে উপস্থিত। যে কোনো মুহূর্তে শুরু হবে সভার কাজ। ঠিক এ সময়ে অসহায় গ্রামবাসীদের সন্দেহকে সত্য প্রমাণিত করে নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষের বাড়ি ঘেরাও করল একদল পাকহানাদার। স্তম্ভিত হয়ে যায় উপস্থিত জনতা। অনেকেই তখন অন্ধকারে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন; কিন্তু অধিকাংশ লোকই পালাতে ব্যর্থ হয়। পাকবাহিনীর পথপ্রদর্শক ও প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ নেতা মাহতাব চৌধুরীর বাড়িতে অবস্থানকারী কাবুলীর পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়ির চারদিকে তখন সৈন্য ও তাদের পদলেহী দালালদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। জলপাই রঙের উর্দিপরা এবং চীন-মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত জানোয়ারদের সর্দারের নির্দেশে উপস্থিত জনতাকে হিন্দু-মুসলিম দুভাগে বিভক্ত করা হলো। আলাদা করল তারা এক গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীকে। প্রথমেই মুসলিমদের নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির বাইরে। তবে তাঁদেরকে পাকিস্তান ও ইসলামের স্বার্থে সংহতি বিরোধীদেরকে নির্মূল করার উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় গোষ্ঠীর সকল হিন্দু সদস্যকে এক কাতারে দাঁড় করানো হয়। নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষের গোয়ালঘর থেকে সমস্ত গরু ছেড়ে সেই রশি দিয়ে বাঁধা হয় ভয়ার্ত নিরপরাধ গ্রামবাসীদের। এ সময় সারির ভেতর থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন সনৎকুমার ঘোষ। দালাররা তাঁকে অনুসরণ করে। প্রথমে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি এবং সেখান থেকেও পালিয়ে যান। পরে রাতের আঁধারে আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী গ্রামে।
এদিকে অসহায় বন্দিরা চিহ্নিত হন পাকিস্তান ও ইসলামের শত্রু হিসেবে। বিচারের জন্য তাঁদের নিয়ে আসা হলো পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে। বন্দিদের সাক্ষাৎ পাওয়া মাত্র জল্লাদ বিচারকদের চোখগুলো উল্লাসে চকচক করে উঠল। তাই সামান্য পথ পার হয়ে দিগেন্দ্র চন্দ্র দেব নামের একজন বন্দির ওপর চড়াও হলো তারা। বেয়নেটের খোঁচায় খোঁচায় জর্জরিত করে ফেলল তাঁরা তাকে।
বেয়নেটের উপর্যুপরি আঘাতে চলৎশক্তি রহিত হয়ে যায় তাঁর। ফলে রাস্তার ওপরেই পড়ে যান তিনি। তারপরও একই রকম দৈহিক নির্যাতন চলতে থাকে তাঁর ওপর। দিগেন্দ্রর প্রাণবায়ু যখন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর, সেই অবস্থায় তাঁকে পাক হানাদাররা টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে। তারপর তারা ফেলে রেখে দেয় তাঁর খণ্ড-বিখণ্ড দেহ। এবার চড়াও হয় তারা দয়াল মালাকারের ওপর। একই কায়দায় তাঁরও প্রাণ সংহার করা হয়। অনতিদূরে পড়ে থাকে তাঁর ক্ষতবিক্ষত হিমশীতল দেহ। বাকি ১৬ জন বন্দিকে নিয়ে যাওয়া হয় কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানেই তাদের ক্যাম্প। ক্যাম্পের এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে গাদাগাদি করে তাদের রাখা হয়। এখানে আনার পর দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তাদেরকে এক গ্লাস পানিও খেতে দেয়া হয়নি। পরদিন ৯ মে ভোরে বের করা হয় অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের রেল সড়কের পূর্বপাশে। অভুক্ত এই মানুষগুলো গর্ত খোঁড়া শেষ করলে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় দু মাইল দূরবর্তী কাপুরারপুলে। সেখান থেকে তাঁদের বহন করে আনতে বাধ্য করা হয় বড় বড় বোল্ডার। বহন করে আনা বোল্ডারগুলো স্তূপ করে রাখা হয় অস্ত্রের মুখে তাঁদের গর্তের পাশে।
এবার বুঝি একটু দয়া হয় পাকসেনাদের মনে। ফলে তারা ক্ষুধায় কাতর এবং দৈহিক নির্যাতনে জর্জরিত লোকগুলোকে সামান্য মুড়ি আর পানি খেতে দেয়। তারপর তাঁদের বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে তালাবন্ধ করে রাখে। ওই দিনই বিকেল প্রায় পাঁচটার সময় আবার তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় গর্তের পাশে এবং শুরু করে শারীরিক নির্যাতন। তখন প্রত্যেকের হাত বাঁধা। তাঁদের আর্তচিৎকারে আকাশবাতাস প্রকম্পিত হলেও হায়েনাদের হৃদয় বিন্দুমাত্র স্পর্শ করে না। ১৭ বছরের নদীয়া কোনো রকমে বন্ধনমুক্ত হয়ে পাশের একটি খাদের কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করে। এঁদের মধ্যে সুরেশ চন্দ্র পালাতে চেষ্টা করলে হায়েনারা তাঁকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। বাম হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে সুরেশচন্দ্র দেব পড়ে যান। তারপর তাঁকে ধরে এনে গর্তের মধ্যে শুইয়ে দিয়ে তাঁরই বহন করা পাথর দেহের ওপর চাপা দিয়ে রাখে।
নির্যাতনের এক পর্যায়ে নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ একজন পাক সৈন্যকে ধরে গর্ভে ফেলার চেষ্টা করলে তাঁর এক হাত, এক পা ও দুই কান কেটে শেষে তাঁকে গর্ত পাথরচাপা দেয়া হয়। অন্যদেরও শারীরিক নির্যাতনে জর্জরিত করা হয়। পরে প্রত্যেকের ক্ষতবিক্ষত দেহ তাঁদেরই বহন করা পাথরে চাপা দিয়ে রাখা হয়। পরপর দুদিন এভাবে পাথরচাপা থাকার পর গর্তটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলে পাকসেনারা। সেই গর্তে পাথর ও মাটিচাপা অবস্থায় প্রাণ দেয় ১৫ জন বীর বাঙালি।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত