You dont have javascript enabled! Please enable it!

পার্বতীপুর ইউনিয়ন টিকরামপুর গণহত্যা, দিনাজপুর

২৪ এপ্রিল, শনিবার বেলা প্রায় ২টার মধ্যে হানাদার বাহিনী পার্বতীপুর ইউনিয়নের টিকরামপুর গ্রামে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। হানাদার বাহিনীর ভয়ে রাজশাহী- নওগাঁ জেলার বিভিন্ন এলাকার নিরীহ মানুষ ভারতে যাবার অপেক্ষায় জানমাল নিয়ে পার্বতীপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ভারতে আশ্রয় নেয়ার রুট ছিল-পার্বতীপুর ইউনিয়ন পাড়ি দিয়ে রাধানগর ইউনিয়নের সীমান্ত পথ। এই এলাকাগুলো ছিল খুবই মফস্বল এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে দুর্গম।
ঘটনার দিন টিকরামপুর গ্রামে বর্তমান বধ্যভূমির দক্ষিণে তদানীন্তন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং ঐ স্থানসংলগ্ন পূর্ব-দক্ষিণ কর্নারে পোরশার ইয়াশিন শাহর খামারে নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার রামপুর-পাথার এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষ অবস্থান করছিল। এছাড়া পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পলায়নপর মানুষ অবস্থান করছিল। পাকবাহিনীর দখল অভিযান চালানোর খবর পাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকা থেকে নিম্নবর্ণের লোকেরা সবার আগে এলাকা ত্যাগ শুরু করে এবং ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হয়। ওই দিন রহনপুর থেকে হানাদার বাহিনীকে সাথে নিয়ে তাদের গাড়িতে চড়ে রাজাকার রাকিবসহ আরো অন্যান্য রাজাকার এবং পাকিস্তানপন্থী এসাহাক মৌলভী টিকরামপুর গ্রামে এসেছিল। তারা এসেছিল দামপুরা-চানপুর-ফাজিলপুর-করমজা হয়ে রোকনপুর এরপর টিকরামপুর অভিমুখে আসে। দূর থেকে হানাদার বাহিনীর গাড়ি দেখে ওই গ্রামের হযরত আলী আশ্রিত লোকদের পলায়নের কথা বললে সহজ-সরল ঐ লোকগুলো বলেছিল, “ভয় দেখিয়ে আমরা পালিয়ে যাব আর তোরা আমাদের মালপত্র লুট করবি।” এই কথা বলে তারা তাৎক্ষণিক পালানোর প্রস্তুতি নেয়নি। হানাদার বাহিনীর গাড়ি যখন তাদের আশ্রয়ের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে তখন তারা সহায় সম্বল ফেলে দিশেহারা হয়ে দিকবিদিক পলায়নের চেষ্টা করে। বিলের ভেতর থেকে পলায়নপর প্রায় ২০ জন লোককে ধরে এনে নিষ্ঠুর হানাদার বাহিনী টিকরামপুর গ্রামেরই ইলিয়াস আলীর জমিতে লাইন করে দাঁড় করায়। এরপর তারা রাইফেলের গুলি ছোড়ে। গুলি ছোড়ার সাথে সাথে কৌশলে পাশ কেটে ৬- ৭ জন লোক নিহতদের সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তারা কেউ কেউ গুলির আঘাতে জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যায়। আর হতভাগ্য ১৩ জন ব্যক্তি নিমর্মতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এরপর দখলদার বাহিনী অসহায় মানুষের মালামাল লুটপাট করে। তবে এই দিন পাকবাহিনী নারী-শিশুদের কিছু বলেনি। তারা লাশগুলো দ্রুত মাটিতে পুঁতে দেয়ার জন্য গ্রামের লোকজনকে নির্দেশ দেয়; অন্যথায় তাদেরও এদের ভাগ্য বরণ করতে হবে হুমকি দিয়ে রহনপুরে ফিরে যায়। হানাদারদের আগমনের সংবাদ দিয়ে সে সব লোককে পালিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়ার কারণে তারা হযরত আলীকে বর্বরোচিত নির্যাতন করে। তার পায়ের ফোলা ও কাটা দাগের চিহ্ন ৮০ বছর বয়সে আজ সে বহন করছে। সেদিন আরও অনেককেই নির্যাতন করেছিল হানাদাররা।
হানাদার বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে আসা এই সব হতভাগ্য এতই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে, এক মা তার চল্লিশ দিনের কোলের শিশুকে ফেলে কিংবা তার কাছ থেকে পড়ে গেলেও সে প্রাণ রক্ষার্থে পালিয়ে যায়। পরে গ্রামের দয়াশীল মানুষেরা শিশুটিকে বিল থেকে কুড়িয়ে এনে আদর-যত্নের ব্যবস্থা করে। কিন্তু পাষাণ রাজাকাররা জানতে পেরে গ্রামের মানুষকে হুমকি দেয় যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই শিশু বাচ্চাটিকে বিলের মধ্যে ফেলে না এলে পাঞ্জাবিদের নিয়ে এসে তাদেরও ওই পরিণতি ভোগ করতে হবে। অগত্যা শিশুটিকে বিলের মধ্যে রেখে আসতে হয়েছিল। গোলাগুলির আওয়াজ শুনে অবশিষ্ট নিম্নবর্ণের মানুষ বরেন্দ্র অঞ্চল হতে দ্রুত ভারতে চলে যায়। বেশ কিছু সাধারণ পরিবারও এলাকায় বসবাস করে। সাধারণ মানুষেরা ধান, চাল ও চাঁদার দাবিতে রাজাকারদের নিপীড়নের শিকার হয়।
[৫৮৭] মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!