You dont have javascript enabled! Please enable it!

এবং তাঁদের স্বার্থরক্ষার জন্য এক নিজস্ব বাসভূমি পাকিস্তানের দাবি। আর লীগকে সমর্থনের অর্থ পাকিস্তান প্রাপ্তি—এইটাই মুসলমান ভোটারদের অনুপ্রাণিত করে। পাকিস্তানের স্বরূপ জিন্না স্বয়ং কখনও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেননি বলে সে সম্বন্ধে তাঁর বিরূপ সমালোচনা হত। কিন্তু এটাও তাঁর এক রণকৌশল ছিল, যার কারণে তিনি অধিকাংশ মুসলমান ভোটারদের সমর্থন পান। কারণ হিন্দুপ্রভুত্বের আশঙ্কায় পীড়িত মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশের মুসলমানরা (যাঁরা লীগের প্রধান শক্তি) পাকিস্তানে তাঁদের আত্মরক্ষা ও আত্মাভিব্যক্তির সম্ভাবনা দেখলেন। সিন্ধু সীমান্ত প্রদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে যে মুসলিমরাজ বা পাকিস্তান হবে—এটা যেন স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। পাঞ্জাব ও বঙ্গের মতো যেখানে মুসলমানদের ঈষৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অথচ সুনির্দিষ্ট অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা বা অঞ্চল রয়েছে, সেখানে হিন্দু প্রভুত্বের ভয়কে তেমনভাবে উসকে দেবার সম্ভাবনা ছিল না। তাই সেখানকার মুসলমান অধিবাসীদের পাকিস্তান দাবির প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে প্রচার করা হল যে আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে গণভোটের অধিকার (ভারতীয় যুক্তরাজ্যে থাকবে কিনা) থাকবে কেবল মুসলমানদের এবং তাই সহজেই প্রদেশের বিভাজন ছাড়াই সমগ্র প্রদেশ পাকিস্তানভুক্ত হবে।
পাঞ্জাবের রাজনীতি সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ছোটলাট গ্ল্যান্সীর মতে, “মুসলমানদের জন্য উপযুক্ত রক্ষাকবচযুক্ত ভারতীয় যুক্তরাজ্য অথবা প্রদেশের বিভাজনের পর পাকিস্তান-এই দুই বিকল্প যদি পাঞ্জাবিদের সামনে থাকত তাহলে তাঁরা প্রথমোক্ত বিকল্প গ্রহণ করতেন।”(২৮) ওয়াভেলের আগ্রহ সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার সম্ভবত ইচ্ছা করেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তাদের সহায়ক জিন্নার পাকিস্তান দাবির অযৌক্তিকতা সম্বন্ধে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি। আসামে ছোটলাট (অ্যান্ড্রু ক্লো)-এর মতে, “পাকিস্তানের সমস্যাকে জিইয়ে রাখার ব্যাপারে ‘ব্রিটিশেরও কিছুটা অবদান আছে।” সীমান্ত প্রদেশের ছোটলাট কানিংহামের কথা সুবিদিত। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে সেপ্টেম্বর তিনি তদানীন্তন বড়লাটকে লেখেন, “আমাদের মুসলিম লীগপন্থীরা এখনও বেশ গোঁড়া এবং ঠিকমতো প্রচারকার্য চালিয়ে আমাদের প্রভূত সাহায্য করে চলেছেন। এছাড়া অত্যন্ত সুপরিচিত অনেক মোল্লাসহ নিজ নিজ এলাকায় প্রভাবশীল এমন বহুসংখ্যক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা আমাদের পক্ষে কাজ করছেন।”(২৯) ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে আগস্ট কানিংহাম লিনলিথগোকে লেখেন যে, “যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই আমরা প্রধানত ইসলামী ধারায় প্রচারকার্য শুরু করে যে পটভূমিকা তৈরি করি”, তাছাড়া নির্বাচনে লীগের এমন জয়লাভ “সম্ভবপর হত বলে আমার মনে হয় না”(৩০) (নিম্নরেখ বর্তমান লেখকের)। কংগ্রেস অথবা পাকিস্তান- বিরোধী অপর কোনো রাজনৈতিক দলও ঐ দাবির অযৌক্তিকতা সম্বন্ধে জনমত জাগ্রত করার ব্যাপক প্রয়াস করেনি।(৩১) পক্ষান্তরে নির্বাচনের প্রচারের সময় বহুক্ষেত্রে কংগ্রেস হয় সমস্যাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে(৩২) আর নচেৎ স্থানীয় স্বার্থের জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপোস করেছে। পাকিস্তানের বিরোধিতার ব্যাপারে ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধিত অপর একটি দল—আকালী পার্টির ভূমিকাও খুব উজ্জ্বল নয়। নির্বাচনে হিন্দুমহাসভার মুসলমানবিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রচার প্রকারান্তরে লীগের পাকিস্তান দাবিকেই শক্তিশালী করে।
১৯৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে যুদ্ধশেষে বরখাস্ত সৈনিকদের (যাদের বড় একটা অংশ ছিল মুসলমান) অসন্তোষ এবং যুদ্ধকালীন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহের অনটনের জন্য
পৃষ্ঠা: ২০১

সরকারি ব্যবস্থার (এর ব্যবসায়ী এবং অসামরিক সরবরাহ বিভাগের কর্মচারীদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু) প্রতি ক্ষোভ পাঞ্জাবের শাসকদল ইউনিয়নিস্টদের বিপক্ষে এবং লীগের অনুকলে যায়। এছাড়া ভারতীয় রাজনীতির সুবিধাবাদী চরিত্রও জিন্নার সহায়ক হয়। পাঞ্জাবের ইউনিয়নিস্ট পার্টি কোনো সুসংগঠিত অথবা সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বা আর্থিক কর্মসূচিভিত্তিক দল ছিল না। উভয় সম্প্রদায়ের জমিদার ও অভিজাত স্বার্থের সংরক্ষক দলের নেতা খিজির হায়াৎ খাঁ অবশ্য ব্যক্তিগত নেতৃত্বের কারণে জিন্নার বিরোধী ছিলেন। তবে তিনি এটা বুঝতেন যে তাঁর নেতৃত্বের ভিত্তি দুই প্রধান সম্প্রদায়কে একসঙ্গে নিয়ে চলা। জিন্নাকে মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি বলে স্বীকার না করায় সিমলা সম্মেলন ব্যর্থ হবার পর মুসলমান সমাজে জিন্নার মর্যাদা বৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং বিভিন্ন দল থেকে মুসলমানদের লীগে যোগদান করার হিড়িক পড়ে যায়। ইউনিয়নিস্ট দলের উপর দলত্যাগের এই হিড়িকের প্রভাব মারাত্মক হয়। এছাড়া পাঞ্জাবের সমাজ সংগঠনের তিন উপাদান—জমিদার, বিরাদরী (আত্মীয়কুটুম্ব সম্বন্ধ) এবং পীর বা সাজ্জাদনশীনের প্রভাবে ইউনিয়নিস্ট দুর্গ তাসের কেল্লার মতো ভেঙে পড়তে থাকে। পাঞ্জাবের কংগ্রেস সভাপতি মিঞা ইফতিকারউদ্দীন, পরিষদীয় দলের ভূতপূর্ব নেতা এবং সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেসের নেতা আবদুল কইয়ুম খাঁর নির্বাচনের প্রাক্কালে লীগে যোগদান এই সুবিধাবাদী রাজনীতির নমুনা। অন্যান্য দল ছেড়ে মুসলমান নেতৃবৃন্দের এইভাবে লীগে যোগদান মুসলিম জনমতে লীগের অনুকূল করার পক্ষে আরও সহায়ক হয়। বঙ্গেও কংগ্রেস ও কৃষকপ্রজা পার্টির যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তার থেকে বেনো জলের মতো লীগে যোগদান করার ঘটনা ঘটে। তপশিলী হিন্দু নেতাদের একটা অংশ পদ বা অর্থের লোভে লীগের সহযাত্রী হয়ে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি জলাঞ্জলি দেয়।
গ্ল্যান্সী বড়লাটকে জানান যে পাঞ্জাবের নির্বাচনে “ইসলাম বিপন্ন” এই ধুয়া প্রবল শক্তি। পীর এবং মোল্লা-মৌলভীদের সাম্প্রদায়িক প্রচার ও ফতোয়া তো ছিলই। ১৯৪৫- ৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে লীগ খোলাখুলি ভাবে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে জয়লাভের হাতিয়ার করে। ধর্মস্থান এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লীগের সপক্ষে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন-প্রচারের কাজে ব্যবহৃত হয়। লীগের অনেক প্রচারক বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে লীগকে ভোট না দিলে ভোটারের মুসলমানত্ব আর বজায় থাকবে না—তাঁদের বিবাহ অসিদ্ধ হবে, তাঁরা জাতিচ্যুত হবেন, সমবেত নমাজে ভাগ নিতে পারবেন না এবং মৃত্যুর পর মুসলিম কবরস্থানে তাঁদের মৃতদেহের স্থান হবে না। পাঞ্জাবে (পরে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে গণভোটের সময়ে সীমান্ত প্রদেশ ও শ্রীহট্ট জেলায়ও) মুসলমান ভোটারদের বলা হয় যে একদিকে পাকিস্তান এবং অন্যদিকে হিন্দুস্থান বা কাফেরস্থান—এ দুই-এর মধ্যে একটিকে তাঁদের বেছে নিতে হবে। জিন্না এজাতীয় প্রচারের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেননি। দুর্ভাগ্যক্রমে ইউনিয়নিস্ট বা অন্যান্য জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতৃত্বও রাজনৈতিক বা আর্থিক আদর্শ ও কর্মসূচির তুলনায় ধর্মগ্রন্থ, পীর, মোল্লা, মৌলভীদের সাম্প্রদায়িক ভূমিকাকেই নিজেদের সমর্থনে বেশি করে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছিলেন। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাই যদি নির্বাচন-বৈতরণী পারের কৌশল হয় তাহলে যাঁরা ঐ খেলায় সবচেয়ে বেশি রপ্ত তাঁদের আশ্রয় নেওয়াই মুসলিম ভোটারদের পক্ষে স্বাভাবিক।
সর্বোপরি, “… জিন্নার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল রণে ভঙ্গ দিতে তাঁর অনিচ্ছা। নিজের বন্দুক আঁকড়ে ধরে থাকার ক্ষমতা এবং ঐ প্রক্রিয়ায় এক ধর্মযুদ্ধের সৈনিকের আত্মবিশ্বাস বুকে নিয়ে নিজের বন্দুকের নলে যেটুকু ভিজে বারুদ তা চেঁছে ফেলে দেবার শান্ত সমাহিত মানসিকতা।
“অবিশ্বাস্য স্নায়ু-শক্তিসম্পন্ন জিন্না অতঃপর দাবি জানালেন যে আগামী নির্বাচনে মুসলমানরা যদি লীগকে সমর্থন জানান তাহলে লীগের ‘আর কোনো রকম তথ্যানুসন্ধান অথবা গণভোট ছাড়াই বর্তমান প্রদেশগুলির ভিত্তিতে পাকিস্তান দাবি করার’ অধিকার জন্মাবে।”(৩৩)
“নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবার অত্যল্পকালের মধ্যে (৯.৪.১৯৪৬) লীগের আইনসভার সদস্যগণ এক সম্মেলনে মিলিত হলেন যেখানে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ যুদ্ধং দেহী মার্কা বক্তৃতা দিলেন। বোম্বাই-এর ইসমাইল চুদ্রীগড় বললেন যে মুসলমানরা তাঁদের দ্বারা বিজিত যে জাতির উপর ৫০০ বৎসর শাসন করেছেন তাঁদের হাতে মুসলমানদের সমর্পণ করে যাবার কোনো অধিকার ব্রিটিশদের নেই। মাদ্রাজের মহম্মদ ইসমাইল ঘোষণা করলেন যে, মুসলমানরা এক জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। সৌকৎ হায়াৎ খাঁ (খিজির হায়াৎ খাঁর যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভার একদা সদস্য ও পরে বরখাস্ত) বললেন যে, মুসলমানরা ‘একটা সুযোগ পেলে’ তাঁরা ব্রিটিশ সৈন্যদল ভারতবর্ষে থাকতে থাকতেই কি করতে পারে তার নমুনা দেখিয়ে দেবে। স্যার ফিরোজ খাঁ নূন সগর্জনে ঘোষণা করলেন যে, তাঁদের যদি কোনো কেন্দ্রীয় সরকার বা হিন্দুরাজত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয় তাহলে মুসলমানরা যে ধ্বংসলীলার অনুষ্ঠান করবে তা চেঙ্গিস খাঁ বা হলাকুকে লজ্জিত করবে।
“সম্মেলনে নিম্নোদ্ধৃত প্রস্তাব গৃহীত হয়: ‘মুসলিম জাতি (nation) অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভিত্তিতে রচিত কোনো সংবিধানে কিছুতেই সম্মত হবে না এবং এতদুদ্দেশ্যে গঠিত একটিমাত্র সংবিধান রচনাকারী সংগঠনে কোনোমতেই অংশগ্রহণ করবে না।’ এ প্রস্তাবে দাবি জানানো হল যে উত্তর-পূর্বের বঙ্গ ও আসাম এবং উত্তর-পশ্চিমের পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান নিয়ে গঠিত অঞ্চলসমূহ… যেখানে মুসলমানরা প্রবলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাকে এক সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করা হোক এবং পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানের জনগণ নিজ নিজ সংবিধান রচনা করার জন্য দুটি পৃথক গণপরিষদ গঠন করুন। এই দাবি স্বীকার করে নেওয়া এবং অনতিবিলম্বে তার রূপায়ণ কেন্দ্রের এক অর্ন্তবর্তী সরকারগঠনের জন্য মুসলিম লীগের সহযোগিতা পাবার ব্যাপারে অপরিহার্য পূর্ব শর্ত।”(৩৪)
এইভাবে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ কোন্ পথে যাবে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকেই তা নির্ধারিত হয়ে গেল।

২৪
পাদটীকা

১. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); Some Recent Speeches; উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৩৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৬১৯ পৃষ্ঠা।
৩. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); Some Recent Speeches; পৃষ্ঠা ১১৬। জে.জে.পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১৫১ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৪. ১৯শে জানুয়ারির বিবৃতি। T.P.; পঞ্চম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৪২৩। তবে এ সম্বন্ধে খলিকুজ্জমাঁর বক্তব্য হল: “..হিন্দু প্রভুত্বের বিরুদ্ধে এক সংগ্রামের মধ্যে এবং জান পাকিস্তানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ এরকম আচমকা এসব প্রশ্ন কেন নবাবজাদা লিয়াকত আলী খাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তা সহজে বোধগম্য হয় না। আমি একথা হোলা মনে করতে বাধ্য হচ্ছি যে খুব সম্ভব ঐ বিবৃতি (এখানে লিয়াকৎ আলী খাঁর সেই বিবৃতির উল্লেখ করা হচ্ছে যেখানে তিনি বলেন যে এ ব্যাপারে তিনি জিন্নার সঙ্গে পরামর্শ করেননি—লেখক।) মিস্টার জিন্নার পরামর্শে দেওয়া হয়েছিল, যদিচ নবাবজাদা মিস্টার জিন্নার নীতি অনুসরণ করার অতিরিক্ত আর কিছুই করেননি। স্যার সিকন্দর এবং আমার বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রারব্ধ মিস্টার জিন্নার এই নীতি ছিল কেন্দ্রে একটা জাতীয় সরকার গঠনের জন্য চেষ্টা করা। (সমগ্রন্থ; ৩৩১ পৃষ্ঠা)।
সীতারামাইয়া তাঁর গ্রন্থে (দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪১-৬৫০) জানিয়েছেন যে এ প্রস্তাবে গান্ধীর আপত্তি ছিল না যদিও তিনি মনে করতেন যে এ-জাতীয় নিছক সাংবিধানিক প্রস্তাবে অচলাবস্থা দূর হবে বলে তাঁর ভরসা নেই। তবে “এতৎসত্ত্বেও গান্ধী ভুলাভাইকে তাঁর প্রয়াস চালিয়ে যাবার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন।” এ প্রসঙ্গে টেন্ডুলকরের গ্রন্থ (সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮-৯) এবং প্যারেলালের Last Phase (প্রথম খণ্ড, প্রথম অংশ, পৃষ্ঠা ১১৩)-ও দ্রষ্টব্য।
৫. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); Some Recent Speeches; পৃষ্ঠা ১৭০। অ্যালেন-হেইস মেরিয়াম কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১১৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৬. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৬২০ পৃষ্ঠা।
৭. পেনড্রেল মুন (সম্পাদিত); Wavell: The Viceroy’s Journal; অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস; করাচী; পৃষ্ঠা ১৫২-১৫৩। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৪৪ আগামী পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৮. এ সম্বন্ধে মৌলানা আজাদ বলেছেন: “দশ বছর পর ঘটনাবলী সম্বন্ধে পুনঃসমীক্ষা করতে গিয়ে মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য যে বিচিত্র অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল তার কারণে আমি বিস্মিত না হয়ে পারছি না। লর্ড ওয়াভেল স্বয়ং যে প্রারম্ভিক (tentative) সূচী তৈরি করেছিলেন তাতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পাঁচ-পাঁচটি নাম ছাড়াও অতিরিক্ত চারটি নাম ছিল। তার মধ্যে একজন ছিলেন শিখদের প্রতিনিধি, দুইজন তপশিলী হিন্দুদের এবং চতুর্থজন ছিলেন পাঞ্জাবের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খিজির হায়াৎ খাঁ। তালিকায় এমন দুইজন মুসলমানের নাম আছে…যাঁরা তাঁর মনোনীত নন জেনে জিন্না তার প্রবল বিরোধিতা করেন।…সুতরাং জিন্নার বিরোধিতার ফলে যদি সম্মেলন ভেঙে না যেত তাহলে ঐ সম্মেলনের পরিণাম স্বরূপ মুসলমানরা ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হওয়া সত্ত্বেও চোদ্দজনের শাসন পরিষদে সাতটি আসন পেতে পারত।…লীগ মুসলিম স্বার্থের প্রবক্তা রূপে দাবি জানাত। অথচ লীগেরই বিরোধিতার জন্য ভারতবর্ষের মুসলমানরা অবিভক্ত ভারতের শাসনকার্যে প্রভূত পরিমাণ অংশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হল।”(পৃষ্ঠা ১১৪) মৌলানার মতে অপর এক দিক থেকেও ঐ সম্মেলনের ব্যর্থতার অভিনবত্ব ছিল: “এই সর্বপ্রথম ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে কোনো কি রাজনৈতিক প্রশ্ন নিয়ে নয়, দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে বিভক্তকারী সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হল।”(সমগ্রন্থ, পৃষ্ঠা ১১০)।
৯. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩১৮। আমেরীর কাছে লীগের কৃতজ্ঞতাভাজন হবার বহুবিধ কারণের রীতার মধ্যে অপর একটির উল্লেখও এ প্রসঙ্গে করা যেতে পারে। সিন্ধুর লীগ মন্ত্রীসভা ভাঙনের মুখে। বিধানসভার অধিবেশন বসলেই মন্ত্রীমণ্ডলকে অপরিহার্য ভাবে অনাস্থা প্রস্তাবের সম্মুখীন হতে হবে। প্রদেশের ছোটলাট ফ্রান্সিস মুডি (খলিকুজ্জমাঁর মতে যিনি “পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন”) অধিবেশন না ডাকার পক্ষে, যদিও বড়লাট ওয়াভেল – চান যে বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান করা হোক। নিয়মানুসারে বড়লাট ও জাজের ছোটলাটের মতভেদের প্রশ্ন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ভারতসচিব আমেরীর কাছে গেল। তিনি মুডির পক্ষে রায় দিলেন। কৃতজ্ঞ লীগনেতা খলিকুজ্জমাঁ এ ঘটনা লিপিবদ্ধ করার প্রসঙ্গে বলেছেন: “তিনি (আমেরী) ছোটলাটের সঙ্গে সহমত হলেন এবং বিধানসভা ভঙ্গ করা হল। এসব তথ্য আমি দিচ্ছি স্বয়ং স্যার ফ্রান্সিস মুডি কর্তৃক ছাতা প্রদত্ত বিবরণের ভিত্তিতে। লীগের ইতিহাসের এক সংকটজনক মুহূর্তে তিনি সিন্ধুকে পাকিস্তানের জন্য রক্ষা করেছিলেন।”(সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩৩৩)।
১০. প্যারেলাল; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড, প্রথম অংশ; পৃষ্ঠা ১৩১। জিন্নার ঐ বিবৃতির নিম্নোদ্ধৃত অংশ উল্লেখযোগ্য: “ওয়াভেল পরিকল্পনাকে চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি যে ও হল এক ফাঁদ। একদিকে গান্ধী—হিন্দু কংগ্রেস, যা অখণ্ড ভারতের নামে ভারতবর্ষের হিন্দু জাতীয় স্বাধীনতার প্রবক্তা এবং অপর দিকে রয়েছেন ইদানীং ভৌগোলিক ঐক্যের ধ্বজাধারক লর্ড ওয়াভেল এবং গ্ল্যান্সী- খিজির চক্র যারা পাঞ্জাবের মুসলমানদের ভিতর বিভেদ সৃষ্টিতে কৃতসংকল্প। আমাদের এই ব্যবস্থার মধ্যে ঠেলে দেবার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাবানুযায়ী আমরা যদি এতে রাজী হতাম তাহলে আমাদের মৃত্যু-পরোয়ানা দস্তখত করার সমতুল্য হত।…১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমরা ব্রিটিশ সরকারের কাছে আমাদের ভূমিকার কথা স্পষ্ট করে এসেছি। আমাদের সেই ভূমিকা হল —ব্রিটিশ সরকার যতক্ষণ না মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের গ্যারান্টি ঘোষণা করছে এবং এই আশ্বাস দিচ্ছে যে যুদ্ধের পরই অথবা তার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করবে ততদিন আমরা কোনো সাময়িক ব্যবস্থায় রাজী হতে পারি না।…আমরা সংখ্যালঘু নই, আমরা একটি জাতি (নেশন) এবং যুদ্ধের সময়ে যে মা বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে তার প্রতি দৃষ্টি রেখেই কেবল আমরা কোনো সাময়িক ব্যবস্থায় রাজী হতে পারি।”(এম. এইচ. সঈদ; Sound of Fury: পৃষ্ঠা ৩০০)।
১১. ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৩২। জালাল প্রদত্ত উদ্ধৃতির উৎস — Indian Annual Register: ১৯৪৫; দ্বিতীয় খণ্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা।
২০৫
১২. T.P.: পঞ্চম খণ্ড; ১২৬২ পৃষ্ঠা।
১৩. সমগ্রন্থ; ১২৩৭ পৃষ্ঠা।
১৪. এইচ.ভি.হডসন; The Great Divide; করাচী (১৯৬৯); অনুসারে “সিমলা সম্মেলনে জিন্না কর্তৃক উদ্ধত শক্তির প্রদর্শন লীগের মনোবল বৃদ্ধির কারণ এবং তার মুসলমান বিপক্ষীয় দলসমূহের—বিশেষ করে পাঞ্জাবের লীগ বিরোধী মুসলমানদের উপর প্রবল প্রহার স্বরূপ হয়েছিল।”(পৃষ্ঠা ১২৭)। ভি.পি.মেননের মতে (সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২১৫) এর ফলে মধ্যপন্থী মুসলমানরা অতঃপর লীগকেই তাঁদের একমাত্র শরণ বলে মনে করেন। এছাড়া জাতীয়তাবাদী শক্তিসমূহের পক্ষে ঐটাই ভি শেষ সুযোগ হওয়ায় এরপর সাম্প্রদায়িকতা ও তার পরিণামে দেশ বিভাজন ছাড়া অপর কোনো বিকল্প রইল না। তবে এ সম্মেলনের ব্যর্থতার জন্য ব্রিটিশ শাসকদলের কিছুসংখ্যক নেতৃবৃন্দের ভূমিকাও ক্রিয়াশীল ছিল যাঁরা জিন্নাকে একরকম ভেটো দেবার জন্য বড়লাটের উপর চাপ দিয়েছিলেন (T. P.; পঞ্চম খণ্ড; পৃষ্ঠা ১২০১- ১২০২ ও ১২২১-১২২৪)। ভারতের ব্রিটিশ আমলাদের একাংশও যে জিন্নাকে সিমলা সম্মেলন ব্যর্থ করার জন্য প্ররোচনা দেন তার প্রমাণ জয়াকর (সন্ধ্যা চৌধুরী; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৪৮) ও ভি. পি. মেনন (Transfer of Power; পৃষ্ঠা ২১৫) কর্তৃক দেওয়া ছাড়াও দুর্গাদাস দিয়েছেন। সিমলা সম্মেলন ব্যর্থ হবার পরই দুর্গাদাস জিন্নার সঙ্গে দেখা করেন এবং “এই সাংবাদিক যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন যে তাঁর কংগ্রেসের সঙ্গে সংখ্যাসাম্যের দাবি স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি ওয়াভেলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন, জিন্না উত্তরে বললেন: আমি কি এতই বোকা যে যখন ___ আমাকে থালায় সাজিয়ে পাকিস্তান দেওয়া হচ্ছে তখন এই প্রস্তাব গ্রহণ করব।”(সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২১৬)।
১৫. T.P.; ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২-২৩।
১৬. তদেব; পৃষ্ঠা ৭১-৭২।
১৭. তদেব; পৃষ্ঠা ২৪৭-২৪৮।
১৮. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); Some Recent Speeches থেকে উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ২৪৮-এ উদ্ধৃত।
১৯. অ্যালেন-হেইস মেরিয়াম; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১১৭।
২০. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); Some Recent Speeches দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ২১৮। মেরিয়াম কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১১৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২১. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১১৭।
২২. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); Some Recent Speeches; থেকে উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৫১ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২৩. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); Some Recent Speeches থেকে মেরিয়াম কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১১৮ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২৪. উলপার্ট সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২৫০।
২৫. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); Some Recent Speeches থেকে উলপার্ট কর্তৃক নিজ গ্রন্থের ২৫৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২৬. এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্যের জন্য দ্রষ্টব্য ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৩৮-১৭৩।
২৭. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩০৪-৩০৫। তবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির ওয়ান মধ্যে কুত্রাপি লীগ নিজবলে মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করতে পারেনি। সিন্ধুতে লীগ মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের পিছনে ছোটলাট মুডির বদান্যতার পরিচয় ছিল। লীগের ও প্রধান বিরোধী সৈয়দ মৌলাবক্সের কোয়ালিশনে ২৮ জন করে ও ৪ জন নির্দলীয় সদস্য মন্ত্রীসভা গঠনের সময়ে থাকলেও ছোটলাট লীগকেই মন্ত্রীসভা গঠনের আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গেও লীগ মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হয় ইউরোপীয় সদস্যদের সহযোগিতায়। পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট, কংগ্রেস ও আকালীদের কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছিল। উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আসামে (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ না হলেও প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত) কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হয়।
২৮. ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৩৩।
২৯. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১১৪।
৩০. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১১৬।
৩১. অতুলানন্দ চক্রবর্তীর Call It Politics? স্যার আরদেশির দালালের An Alternative to Pakistan. হুমায়ুন কবীরের Muslim Politics, 1905-42, স্যার হোমি মোদী ও ডঃ জন মাথাই-এর A Memorandum on the Economic and Financial Aspects of Pakistan, ডঃ রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের An Economist Looks at Pakistan, কে. টি. শাহ-এর Why Pakistan? Why Not? প্রমুখ বুদ্ধিজীবীদের গ্রন্থের বক্তব্য স্বল্প কয়েকজন শিক্ষিত ব্যক্তির পরিধির বাইরে প্রচারিত হতে পারেনি। কংগ্রেসি নেতাদের মধ্যে রেজাউল করীমের Pakistan Examined, অশোক মেহেতা ও অচ্যুৎ পট্টবর্ধনের The Communual Triangle ইত্যাদি গ্রন্থের বক্তব্যের প্রভাবও অনুরূপভাবে সীমিত ছিল। ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের India Divided অত্যন্ত যুক্তিশীল ও তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা হওয়া সত্ত্বেও প্রথমত এই নির্বাচনী হিস্টিরিয়া কেটে যাবার পর (১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে) প্রকাশিত হয় এবং তার আবেদনও অন্যান্য গ্রন্থের মতো স্বল্পসংখ্যক শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
৩২. এ সম্বন্ধে ডঃ আয়েষা জালালের বক্তব্য: “১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে জিন্নার সাফল্যের পিছনে বহুলাংশে ছিল পাকিস্তান যে আসলে কি একথা ভোটারদের বলতে ব্রিটিশের অনিচ্ছা। এর জন্য কংগ্রেসও সমপরিমাণে দায়ী। ঐ প্রতিষ্ঠান লীগের আওতাবহির্ভূত প্রদেশগুলিতে সম্ভাব্য মুসলমান মিত্রদের সংগঠিত করতে পারেনি। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেস সভাপতি হবার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসি মুসলমানদের মধ্যে প্রমুখ ছিলেন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি প্রস্তাব দেন যে কংগ্রেস যেন প্রকাশ্যে ফেডারেল সংবিধান এবং সীমিত সংখ্যক বিষয়ের অধিকারবিশিষ্ট অপেক্ষাকৃত দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে নিজ অভিমত ব্যক্ত করে। আজাদ কেন্দ্রে মুসলমানদের সংখ্যাসাম্য (parity) মেনে নিতে প্রস্তুত হলেও লীগকে সমানসংখ্যক আসন দিতে রাজী ছিলেন না। (আজাদের পরিকল্পনার বিস্তৃত বিবরণের জন্য অ্যাবেলকে লিখিত জেনকিন্সের ২৫শে আগস্ট ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের পত্র দ্রষ্টব্য। T.P.. ষষ্ঠ খণ্ড; পৃষ্ঠা ১৫৫)। কংগ্রেসের পক্ষে অপর একটি বিকল্প ছিল জামা রাজাজির প্রস্তাবের সমর্থন করে স্পষ্ট ভাষায় দেশবিভাগ এবং পাঞ্জাব ও বঙ্গের বিভাজন সম্বন্ধে প্রচার করা। কিন্তু শক্তিশালী কেন্দ্রের প্রতি কংগ্রেসের আনুগত্যের গিচাসী নীতি এবং গান্ধীর বিচিত্র প্রভাবের কারণ আজাদের শিথিল ফেডারেশন ও সীমিত ভি ক্ষমতাযুক্ত কেন্দ্র অথবা শক্তিশালী কেন্দ্রের জন্য অপরিহার্য মূল্য—দুটি প্রধান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের বিভাজনের যুক্তিযুক্ত ভূমিকার কোনো একটিও কংগ্রেস চায় হাইকম্যান্ড গ্রহণ করতে পারল না।”(সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৩৫)।
৩৩. ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৩৪-১৩৫।
৩৪. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩০৫-৩০৬।

ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা—
অখণ্ড ও বিভক্ত ভারতের মধ্যে আপোষ ব্যবস্থা
২৫

পূর্বেই বলা হয়েছে যে নূতন নির্বাচন ঘোষণা প্রসঙ্গে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর ওয়াভেল বলেছিলেন যে এর পরবর্তী পদক্ষেপ হবে “যথাসম্ভব শীঘ্র এক সংবিধান রচনাকারী প্রতিষ্ঠানের সূত্রপাত” এবং “এমন এক শাসন পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা অবলম্বন করা যার প্রতি ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান দলের সমর্থন থাকবে”। নূতন প্রধানমন্ত্রী এটলীও পরদিবস অনুরূপ মর্মে ঘোষণা করলেন। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পথে এই দ্বিবিধ লক্ষ্যসাধনে সহায়তার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ মন্ত্রীমণ্ডলীর এক প্রতিনিধিদল বা ক্যাবিনেট মিশন প্রেরণের সিদ্ধান্ত ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টে ঘোষিত হয়। ইতিপূর্বে এক পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল সরেজমিনে অবস্থা দেখে যাবার জন্য ভারত ঘুরে গেছে। তাদের সদস্য মেজর ওয়াইআট-এর কাছে ৫ই ফেব্রুয়ারি জিন্না বলেন যে সার্বভৌম প্রদেশ ও তদুপরি আসামসহ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ নিয়ে পাকিস্তান ও বাকি অংশ নিয়ে হিন্দুস্থানের উপর সাময়িকভাবে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত এবং প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় তিনি রাজী। তবে তার সদস্যসংখ্যায় মুসলমান ও অমুসলমান সংখ্যাসাম্য থাকবে এবং সেই কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো বিধানসভা থাকবে না।(১)
১৫ই মার্চ পার্লামেন্টে এক বিবৃতি প্রসঙ্গে এটলী বলেন, “…যত দ্রুত এবং পরিপূর্ণভাবে সম্ভব ভারতবাসীদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে সম্ভাব্য সর্ববিধ প্রকারে সহায়তা করার উদ্দেশ্য নিয়ে আমার সহকর্মীরা ওদেশে যাচ্ছেন।” ভারতবর্ষের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল এবং গান্ধী-নেহরু প্রমুখের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত নূতন ভারতসচিব লর্ড পেথিক-লরেন্সের নেতৃত্বে প্রেরিত এই প্রতিনিধিদলের অপর দুই সদস্য ছিলেন ভারতবর্ষের সমস্যা সম্বন্ধে অভিজ্ঞ স্যার স্ট্রাফোর্ড ক্রিপস এবং অপর একজন মন্ত্রী স্যার এ. ভি. আলেকজেন্ডার। প্রতিনিধিদল ২৩শে মার্চ করাচীতে এবং পরদিবস দিল্লিতে উপনীত হলেন।
সাধারণ নির্বাচনের ফলে একথা স্পষ্ট হয়েছিল যে লীগই মুসলমানদের প্রতিনিধিস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এবং ভারতের মুসলিম জনমত প্রবলভাবে পাকিস্তানের সমর্থক।(২) যদিও কেউ কেউ মনে করতেন যে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের সীমাবদ্ধ ভোটের অধিকারের জন্য লীগের অধিকাংশ মুসলমান আসনে বিজয়ী হওয়াকে মুসলিম জনমানসের যথার্থ প্রতিফলন বলা যায় না। কিন্তু এই একই যুক্তি অন্যান্য দলের প্রতিনিধিত্বের অধিকার সম্বন্ধেও তোলা যেতে পারে। তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য এই পরিমাণে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল যে প্রাপ্তবয়স্কদের মতের ভিত্তিতে নূতন করে জনমত যাচাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবার মতো বিলম্ব করতে প্রস্তুত ছিল না। যাই হোক, পাকিস্তানের দাবির ভিত্তিতেই লীগ নির্বাচনে পূর্বোক্ত প্রকারে সাফল্য অর্জন করেছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্বন্ধে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তাঁর পূর্বোক্ত ঘোষণায় কেবল এইটুকুই উল্লেখ করলেন যে, “সংখ্যালঘুদের অধিকারাবলী সম্বন্ধে আমরা সচেতন এবং তাঁরা যেন নির্ভয়ে বসবাস করতে পারেন। অবশ্য সেই সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যাগুরুদের অগ্রগতির পথে সংখ্যালঘুদের ভেটো দেবার অধিকারও আমরা দিতে পারি না।”(৩) বলা বাহুল্য ঐ উক্তি লর্ড লিনলিথগো কর্তৃক বিশেষভাবে পুষ্ট ভেদনীতি থেকে ভিন্ন এই সত্য কূটবুদ্ধি জিন্নার দৃষ্টি এড়ায়নি। ১৬ই মার্চ এ সম্বন্ধে এক বিবৃতিদান প্রসঙ্গে তিনি নিজ অসন্তোষ ব্যক্ত করে বলেন যে, “লীগকে এড়িয়ে যাবার” যে কোনো প্রচেষ্টা “চূড়ান্ত বিশ্বাসভঙ্গের” নিদর্শন হবে। ৩১শে মার্চ নিউজ ক্রনিকলের বৈদেশিক সম্পাদকের কাছে তিনি নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করেন যে, ‘ভারতবর্ষ বলে কোনো দেশের অস্তিত্ব নেই এবং তিনি নিজে…আদৌ ভারতীয় নন।”(৪) এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত লীগের আইনসভার সদস্যদের সম্মেলনেও তিনি ১৬ই মার্চের মতো নূতন ব্রিটিশ নীতি সম্বন্ধে অপ্রসন্নতা ব্যক্ত করেন।
ক্যাবিনেট মিশন দিল্লি পৌঁছাবার পর থেকে ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত একক ও যৌথভাবে এবং আনুষ্ঠানিক ও ঘরোয়া ভিত্তিতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ,(৫) দেশীয় রাজন্যবর্গের প্রতিনিধি, বড়লাট ও তাঁর শাসন পরিষদের সদস্যবর্গ এবং উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আলোচনা করেন। ১৮২টি বৈঠকে ৪৭২জন ভারতীয় নেতার সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁরা ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা সর্বজনস্বীকৃত আধার খুঁজে বার করার চেষ্টা করেন। মিশনের সঙ্গে জিন্নার আলোচনার সময়ে তার অন্যতম সদস্য আলেকজেন্ডার তাঁর চরিত্র ও আলোচনা- পদ্ধতির যে বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেন তা চিত্তাকর্ষক। প্রসঙ্গত উল্লেখনীয় যে আলেকজেন্ডার অপর দুই মন্ত্রীর মতো কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার বদলে বরং জিন্না ও লীগের প্রতি অধিক আকৃষ্ট ছিলেন। ১৬ই এপ্রিল তিনি তাঁর দিনলিপিতে লেখেন, “স্পষ্ট উত্তর এড়াবার জন্য মনের এতটা ঘোরপ্যাচের পরিচয় দিতে আমি আর কাউকে ইতিপূর্বে দেখিনি। আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে কোটি কোটি মানুষের এজাতীয় জীবন-মরণের প্রশ্ন নিয়ে তাঁর এরকম খেলায় প্রবৃত্ত হবার উদ্দেশ্য প্রধানত আইনের এক আলাপ-আলোচনায় জয়ী হওয়া। তাঁর কৌশল হল প্রথমেই খুব বাড়িয়ে একটা দাবি পেশ করা এবং তারপর এই ভূমিকা নেওয়া যে ঐ দাবি তিনি কমাতে পারবেন না। ইতিমধ্যে অপর পক্ষ ঐ দাবির কতটা স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসবেন তার জন্য তিনি অপেক্ষা করবেন।”(৬)
মিশন ভারতীয়দের ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে এবারে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন এবং এর একটা পন্থাও তাঁরা ছকে নিয়েছিলেন। সবাইকে সে সম্বন্ধে আভাস দেবার পর এ ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করে প্রস্তুত হবার জন্য ভারতীয় নেতাদের সময় দেবার উদ্দেশ্যে ১৭ই থেকে ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত কাশ্মীরে অবকাশ যাপন করে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করার পর তাঁরা আলোচনার সূত্র পুনর্বার হাতে নেন।
ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ক্যাবিনেট মিশনের ছক ছিল ত্রিসূত্রী। এ সম্বন্ধে ক্রিপস এক অত্যন্ত গোপনীয় নোট তৈরি করেছিলেন। এর প্রথম সূত্র হল ত্রিস্তরীয় “ভারতের যুক্তরাষ্ট্র” যার সদস্য হবে পৃথক পৃথকভাবে হিন্দুসংখ্যাগরিষ্ঠ ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ এবং দেশীয় রাজ্যসমূহ। প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্বন্ধ এবং যোগাযোগের মতো সীমিত বিষয়ে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা থাকবে। দ্বিতীয় সূত্র এবং প্রথমোক্তের বিকল্প হল: “হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান নামে ব্রিটিশভারত ভেঙে দুটি ভারতবর্ষ গড়া এবং এর যে কোনো একটির সঙ্গে দেশীয় রাজাদের যুক্ত হবার আমন্ত্রণ জানানো।” উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সব কয়টি জেলার জনসাধারণের ধর্মের ভিত্তিতে
পৃষ্ঠা: ২১০

পাকিস্তানের সঠিক সীমানা নির্ধারিত হবে। যেহেতু নিছক ধর্মের ভিত্তিকে দ্বিজাতি তত্ত্বের আধারে পাকিস্তানের দাবি করা হচ্ছে, “অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির কথা বিবেচনা করে অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করা একান্তভাবে অযৌক্তিক হবে। তাছাড়া সেরকম করলে শেষ অবধি প্রস্তাবিত পাকিস্তান এলাকার ভিত্তি দুর্বল হবে। কারণ সেদেশে ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘু থেকে যাবে।” দুই, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো না কোনো ধরনের চুক্তি হবে যার বলে প্রয়োজনীয় আর্থিক প্রশ্ন এবং প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও যোগাযোগের মতো প্রস্তাবিত রাষ্ট্রদ্বয়ের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ব্যাপারে তারা বিলিব্যবস্থা করতে পারে। “দুয়ের কোনো পরিকল্পনাই যদি সবার মোটামুটি সমর্থন না পায়…তাহলে আমাদের প্রস্তাব হল যে যে-প্রস্তাবের পক্ষে সর্বাধিক সমর্থন পাওয়া যাবে তাই অবিলম্বে কার্যকরী হোক।…আর এ ব্যাপারেও যদি সবার সমর্থন না পাওয়া যায় তাহলে সর্বাধিক সমর্থনপুষ্ট প্রস্তাবকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য আমরা আমাদের সব রকমের প্রভাব খাটাব।”(৭)
প্রথম দুটি বিকল্পের কোনোটি সম্বন্ধেই কংগ্রেস ও লীগ একমত হতে না পারায় ক্যাবিনেট মিশন আর এক দফা নূতন প্রস্তাব রচনা করে কংগ্রেস ও লীগের তরফ থেকে সে সম্বন্ধে আলোচনার জন্য উভয় প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিধি মনোনীত করতে বলেন৷ কংগ্রেস প্রতিনিধিদলে ছিলেন সভাপতি আজাদ নিজে ছাড়া নেহরু, প্যাটেল ও বাদশা খাঁ। লীগের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জিন্না ছাড়া লিয়াকত আলী খাঁ, আবদুর রব নিস্তার ও নবাব মহম্মদ ইসমাইল খাঁ। আলোচনা ৫ই মে থেকে সিমলায় আরম্ভ হল। মিশনের অনুরোধে গান্ধী পরামর্শ দেবার জন্য সে সময়ে সিমলাতে থাকতে রাজী হলেও উভয় দলের প্রতিনিধিদের সংযুক্ত আলোচনায় যোগদানে বিরত ছিলেন। আলোচনার ভিত্তি ছিল ভারতসচিব কর্তৃক প্রেরিত মন্ত্রীমণ্ডলীর নিম্নোদ্ধৃত নূতন প্রস্তাব: “ব্রিটিশভারতের ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক কাঠামো নিম্নরূপ হবে: এক, ইউনিয়ন সরকার যার নিম্নোক্ত দায়িত্ব থাকবে—বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রদেশগুলিকে নিয়ে দুটি গোষ্ঠী তৈরি করা হবে। এদের একটি হবে হিন্দুপ্রধান এবং অপরটি মুসলমান প্রধান গোষ্ঠীর সদস্য প্রদেশসমূহ যেসব বিষয়ে নিজেদের গোষ্ঠীর হাতে সম্মিলিত বিলিব্যবস্থা করার জন্য ছেড়ে দিতে চাইবেন তা তাঁদের আওতাভুক্ত হবে। বাকি সব বিষয় প্রাদেশিক সরকারসমূহের হাতে থাকবে এবং অবশিষ্ট সার্বভৌম অধিকার থাকবে প্রদেশগুলির হাতে।”
সিমলার ত্রিপক্ষীয় আলোচনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও কংগ্রেস ও লীগ উভয় দলই আলোচনার পূর্বোক্ত ভিত্তি অস্বীকার করে। কংগ্রেসের আপত্তি ছিল ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশসমূহকে গোষ্ঠীবদ্ধ করাতে এবং লীগের বক্তব্য ছিল এই যে প্রস্তাবে স্বাধীন মুসলিম বাসভূমির সম্ভাবনা নেই। যাই হোক, আলোচনা তবুও হল এবং জিন্না কর্তৃক আজাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক করমর্দনে সম্মত না হওয়ার ঘটনা ছাড়া মোটামুটি ভালোভাবেই চলল। এর মধ্যে জওহরলাল ও জিন্না পৃথকভাবে মিলিত হলেন। এর পটভূমিকা হল, কংগ্রেস ও লীগের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তাবের উত্তরে জিন্না বলেছিলন যে তিনি কংগ্রেসের কোনো হিন্দু প্রতিনিধির সঙ্গে সানন্দে মিলিত হতে প্রস্তুত। তবু শেষ পর্যন্ত কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হল না। কারণ কংগ্রেস ও লীগের ভূমিকায় মৌলিক পার্থক্য ছিল। লীগ যেখানে দ্বিজাতি তত্ত্বকে আঁকড়ে আছে, কংগ্রেস সেখানে এক জাতি এবং তাই এককেন্দ্রিক সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার উপর জোর দিচ্ছে। অবশেষে লীগ ও কংগ্রেস তাদের পৃথক পৃথক বিকল্প পেশ করল।
লীগের প্রস্তাব ছিল নিম্নরূপ:
১. মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ ছটি (পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত বেলুচিস্তান, সিন্ধু, বঙ্গ ও আসাম) একত্র করে একটি(৮) গোষ্ঠীভুক্ত করতে হবে। বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়, প্রতিরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া আর যেসব বিষয়ের দায়িত্ব পাকিস্তান গোষ্ঠী এবং হিন্দু প্রদেশগুলির সংবিধান রচনাকারী সংগঠনসমূহের নেবার কথা, তা এই প্রস্তাবিত গোষ্ঠীরও কার্যপরিধির মধ্যে পড়বে।
২. ছটি মুসলিম প্রদেশের জন্য পৃথক একটি সংবিধান রচনাকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে।
৩. কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদ এবং যদি কোনো আইনসভা থাকে সেখানেও উভয় প্রদেশ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের সংখ্যাসাম্য থাকবে।
৪. কোনো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত প্রদেশের নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বাইরে যাবার অধিকার থাকবে যদি অবশ্য সেই প্রদেশের অধিবাসীরা রেফারেন্ডাম বা গণভোটের মাধ্যমে সেরকম ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
৫. পূর্বোক্ত দুই সংবিধান-সভা স্থির করবে যে কেন্দ্রে কোনো আইনসভা থাকবে কিনা। কেন্দ্রকে রাজস্ব দেবার জন্য কোন্ পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে তাও দুই সংবিধান- সভা স্থির করবে। তবে কোনোক্রমেই কেন্দ্রকে কর ধার্য করার অধিকার দেওয়া হবে না।
৬. উভয় সম্প্রদায়ের অধিকাংশের স্বীকৃতি ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাম্প্রদায়িক বিষয় সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে না।
৭. আইন রচনা, প্রশাসনীয় বা শাসন সংক্রান্ত কোনো বিবাদ-সম্পর্কিত বিষয়ে কেন্দ্র তিন-চতুর্থাংশের বহুমত ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত নেবে না।
৮. গোষ্ঠী এবং প্রাদেশিক সংবিধানসমূহে ধর্ম সংস্কৃতি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা থাকবে।
৯. দশ বৎসর কাল অতিবাহিত হবার পর কোনো প্রদেশের কেন্দ্র থেকে পৃথক হয়ে যাবার অধিকার হবে।(৯)
লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে যে তার সঙ্গে লীগের পূর্বোদ্ধৃত প্রস্তাবের মৌলিক পার্থক্য ছিল। লাহোর প্রস্তাব এবং লীগ আইনসভা সদস্যদের ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ই থেকে ৯ই এপ্রিলের সম্মেলনে তার যে সংশোধন করা হয় তাতে স্বাধীন ও সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু লীগের ১২ই মে তারিখের পূর্বোদ্ধৃত প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় আইনসভার পরিকল্পনা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে লীগ ও কংগ্রেসের ভূমিকার মধ্যে যে পার্থক্য তা কেবল পরিমাণগত, গুণগত নয়। লীগ যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারকে তিনটি মাত্র বিষয়ের উপর কর্তৃত্ব দিতে প্রস্তুত, সেখানে কংগ্রেসের বক্তব্য হল—এ জাতীয় ফেডারেল সরকার সাধারণত যেসব ক্ষমতা পেয়ে থাকে তার সবগুলিই প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় সরকারের থাকবে।
লীগের এই স্পষ্ট প্রতীয়মান পরিবর্তিত ভূমিকায় পিছন জিন্নার বিশেষ অবদান ছিল। ভারত ও পাঞ্জাব-বঙ্গের বিভাজনের সম্ভাব্য সমস্যা সম্বন্ধ সচেতন হয়ে তাঁর এই অপেক্ষাকৃত নমনীয় ভূমিকা কিনা—সেই বিতর্কে প্রবৃত্ত না হয়েও বলা চলে যে এর কারণে লীগ-নেতৃত্বের একাংশের তরফ থেকে তাঁর উপর চাপ পড়ছিল। ওয়াভেলের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে ৯ই মে জিন্না বলেন যে তিনি “যুক্তিনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছেন।” তবে তাঁর সমর্থকরা ইতিমধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা শুরু করেছেন যে তিনি “যে কোনো রকমের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব মেনে নিয়ে” “নতি স্বীকার করেছেন।” জিন্নার মতে, “এ একটা বিরাট সুবিধা করে দেওয়া।”(১০) এ প্রসঙ্গে একথাও স্মরণীয় যে সিমলা আলোচনার সময়ে ওয়াভেল লক্ষ করেছিলেন যে জিন্নার ভিতর “… কংগ্রেস ও তার যাবতীয় কার্যকলাপের প্রতি গভীর অবিশ্বাস বিদ্যমান। কংগ্রেস যে মুসলমানদের বিভক্ত করতে চায় এবং হিন্দু-প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠাভিলাষী—একথা জিন্না পূর্ণমাত্রায় বিশ্বাস করতেন।”(১১) ১৩ই মে ওয়াভেলের সঙ্গে অর্ন্তবর্তী সরকার সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গেও কংগ্রেস সম্পর্কে এজাতীয় আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন। ওয়াভেলের বর্ণনা অনুসারে সে সময়ে তাঁকে “ক্লান্ত ও অসুস্থ দেখাচ্ছিল” এবং “তাঁর মনে এই ভয় ক্রিয়া করছিল যে কংগ্রেসের পরিকল্পনা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব হাতে নেওয়া—এবং তারপর প্রদেশগুলির ক্ষমতা হস্তগত করার জন্য শক্তি সংহত করা।”(১২)
ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি সম্বন্ধে কংগ্রেস ও লীগের একমত হতে না পারায় মিশন ১৬ই মে তার প্রস্তাব ঘোষণা করল। মিশনের এতদসংক্রান্ত বিবৃতিতে তাঁদের ভারতবর্ষে উপস্থিতির পটভূমিকা থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটা সর্বজনগ্রাহ্য সূত্র উদ্ভাবনের জন্য তাঁদের দ্বারা যেসব প্রয়াস করা হয়েছে সে সম্বন্ধে সংক্ষেপে উল্লেখ করে বলা হয় যে যেহেতু ভারতবর্ষের মুসলমানদের মনে প্রবল হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটা ন্যায়সঙ্গত আশঙ্কা আছে, তাই তাঁরা ভারত বিভাজন বা পাকিস্তান দাবির প্রশ্নটি খুঁটিয়ে বিচার করেও তা অনুমোদন করতে পারেননি। কারণ প্রস্তাবিত এলাকায় যথেষ্ট মাত্রায় অমুসলমান থাকবেন (উত্তর-পশ্চিম এলাকায় ৩৭.৯৩ শতাংশ এবং উত্তর-পূর্বে ৪৮.৩৯ শতাংশ)। সুতরাং তাঁদের মতে “…মুসলিম লীগের দাবি অনুসারে পাকিস্তান নামক পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দ্বারা সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘুদের সমস্যার সমাধান হবে না। তাছাড়া সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রে পাঞ্জাব, বাংলা ও আসামের যেসব জেলার অধিবাসী প্রধানত অমুসলমান তাদের যুক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। পাকিস্তানের পক্ষে যেসব যুক্তি প্রদর্শন করা হয়ে থাকে আমাদের মতে তার প্রতিটি অমুসলমান এলাকাসমূহকে পাকিস্তানের বাইরে রাখার সপক্ষে প্রয়োগ করা যায়। এই বিষয়টি বিশেষ করে শিখদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।”
অমুসলমান এলাকাগুলি প্রস্তাবিত অঞ্চল থেকে পৃথক করে এক ক্ষুদ্রায়তন সার্বভৌম পাকিস্তানের প্রস্তাবও তাঁরা বাতিল করলেন। কারণ পাঞ্জাব ও বাংলার বিভাজন প্রদেশদ্বয়ের জনসাধারণের একটা বড় অংশের ইচ্ছা ও স্বার্থের পরিপন্থী হবে বলে তাঁদের ধারণা। দুটি প্রদেশের নিজস্ব ভাষা রয়েছে এবং তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যও সুপ্রাচীন। এছাড়া এর বিরুদ্ধে “জোরালো প্রশাসনিক, আর্থিক ও সামরিক কারণও” বিদ্যমান। আর “শেষ অবধি এই ভৌগোলিক বাস্তবতাও রয়েছে যে প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশদ্বয় প্রায় সাত শত মাইল দূরত্ব দ্বারা খণ্ডিত এবং শান্তিকাল বা যুদ্ধরত অবস্থায় উভয় অংশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা হিন্দুস্থানের উপর নির্ভরশীল হবে।”
অনুরূপভাবে তাঁরা কংগ্রেসের পরিকল্পনা, “…যার অধীনে বৈদেশিক ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগের মতো সীমিত সংখ্যক বিষয়ের অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ন্যস্ত করা ছাড়া প্রদেশসমূহকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেবার কথা বলা হয়েছে” এবং যাতে কোনো প্রদেশ “ব্যাপকভাবে আর্থিক ও প্রশাসনিক পরিকল্পনার সুযোগ নিতে ইচ্ছুক হলে তাকে বাধ্যতামূলক বিষয়সমূহ ছাড়া ঐচ্ছিকভাবে অন্যান্য বিষয়ের দায়িত্বও কেন্দ্রের হাতে সমর্পণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে” তাও অগ্রহণীয় বলে ঘোষণা করলেন। কারণ দুই ধরনের প্রদেশ (একদল কেন্দ্রকে অধিক ক্ষমতা দিতে ইচ্ছুক, অন্য দল নয়) নিয়ে কাজ করতে গেলে কেন্দ্রে শাসনতান্ত্রিক সংকট দেখা দেবার আশঙ্কা। তাছাড়া কোনো কোনো প্রদেশ যদি সাধারণ স্বার্থে গোষ্ঠীবদ্ধ হতে চায় তাতে বাধা দেওয়াও উচিত নয়।
তাঁরা তাই ঘোষণার ১৫নং অনুচ্ছেদে প্রস্তাব করলেন:
“১. ভারতবর্ষে এক কেন্দ্রীয় (ইউনিয়ন) শাসন-সংগঠন থাকবে যার অন্তর্ভুক্ত হবে ব্রিটিশভারত ও দেশীয় রাজ্যসমূহ। তার অধীনে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ থাকবে: “বৈদেশিক ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং এইসব দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কর হিসাবে ওঠানোর অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের থাকবে।
২. কেন্দ্রের প্রশাসন এবং আইন প্রনয়ণ—উভয় বিভাগই থাকবে যাতে প্রতিনিধিত্ব করবে ব্রিটিশভারত ও দেশীয় রাজ্যসমূহ। আইনসভায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে হলে উপস্থিত এবং মতদানে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের বহুমত ছাড়াও দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের সদস্যবর্গের প্রতিটির সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন প্রয়োজন হবে।
৩. কেন্দ্রের আওতাভুক্ত বিষয়াবলী ছাড়া আর সব বিষয় এবং অবশিষ্ট (রেসিডিউয়ারি) ক্ষমতা প্রদেশগুলির উপর বর্তাবে।
৪. কেন্দ্রকে যে সব ক্ষমতা দেওয়া হবে তা ছাড়া আর সব ক্ষমতা দেশীয় রাজ্যগুলিতে ন্যস্ত থাকবে।
৫. প্রদেশগুলির নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠী (গ্রুপ) গঠনের অধিকার থাকবে এবং এজাতীয় প্রদেশগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র প্রশাসন-ব্যবস্থা ও আইনসভাও থাকবে। কোন্ কোন্ প্রাদেশিক বিষয় কোন্ প্রদেশগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হবে তা স্থির করবে সেই গোষ্ঠী।
৬. কেন্দ্র ও প্রদেশগোষ্ঠীর সংবিধানে এই ব্যবস্থা থাকবে যে প্রথম দশ বছর পর এবং তারপর প্রতি দশ বছর অন্তর বিশেষভাবে আহুত বিধানসভার সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমর্থনে যে কোনো প্রদেশ সংবিধানের শর্তাবলীর পুনর্বিচার করতে পারবে।”
ভবিষ্যৎ গণপরিষদ গঠন করার প্রক্রিয়া ও তার আসনসংখ্যা ইত্যাদির কথা জানাবার পর অতঃপর ঐ ঘোষণায় বলা হয় যে “সাধারণ” ও মুসলমান—এই দুটি সম্প্রদায়ের (পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে এতদতিরিক্ত শিখ) প্রতিনিধি গণপরিষদে থাকবেন। সদস্য নির্বাচন এবং ভবিষ্যৎ প্রশাসনের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও প্রদেশগুলির মাঝখানে তিনটি প্রদেশগোষ্ঠী থাকবে (অনুচ্ছেদ সংখ্যা ১৯)। মাদ্রাজ, বোম্বাই সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হবে “ক” প্রদেশগোষ্ঠী। অনুরূপভাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধু হবে “খ” গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বঙ্গদেশ ও আসাম নিয়ে হবে “গ” প্রদেশগোষ্ঠী। ব্রিটিশ ভারতের ২৯২ জন সদস্যের সঙ্গে দেশীয় রাজ্যসমূহের অনধিক ৯৩ জন সদস্য যুক্ত হয়ে গণপরিষদ সম্পূর্ণ হবে।
গণপরিষদের কার্যপদ্ধতি বর্ণনা প্রসঙ্গে ঐ ১৯নং অনুচ্ছেদে বলা হল,:
“এইভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যথাসম্ভব সত্বর নূতন দিল্লিতে মিলিত হবেন। একটি প্রাথমিক সভার অনুষ্ঠান হবে।…অতঃপর প্রতিনিধিরা প্রদেশের ভিত্তিতে “ক”, “খ” ও “গ” গোষ্ঠীতে বিভক্ত হবেন।…এই বিভাগগুলি নিজেদের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রদেশের সংবিধান রচনার ব্যবস্থা করবে এবং সেইসব প্রদেশের জন্য কোনো গোষ্ঠীগত সংবিধান রচনা করা হবে কিনা ও হলে গোষ্ঠী কোন্ কোন্ প্রাদেশিক বিষয় নিজেদের হাতে নেবে তাও তারা স্থির করবে। প্রদেশগুলির গোষ্ঠীর বাইরে থাকারও ক্ষমতা থাকবে।…নূতন সাংবিধানিক ব্যবস্থা কার্যকরী হবার পর তাকে যে প্রদেশগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার বাইরে চলে আসার অধিকার যে কোনো প্রদেশের থাকবে। নূতন সংবিধান অনুসারে প্রথম সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যাবার পর নব নির্বাচিত আইনসভা এজাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।”
গণপরিষদ গঠন করে তার মাধ্যমে পূর্বোক্ত পদ্ধতিতে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা করার দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা হিসাবে (অনুচ্ছেদ সংখ্যা ২৩) – বড়লাটের উদ্যোগে দেশে এক অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হল. “…যাতে যুদ্ধের ভারপ্রাপ্ত সদস্যসহ যাবতীয় দপ্তরের দায়িত্ব জনসাধারণের পূর্ণ আস্থাভাজন ভারতীয় নেতাদের হাতে থাকবে।” এই প্রসঙ্গে একথাও জানানো হল যে বড়লাট ইতিমধ্যে বিভিন্ন দলের সঙ্গে এ সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা আরম্ভ করে দিয়েছেন।
ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ই মে তারিখের ঘোষণার এত দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেবার কারণ হল—এইটাই অবিভক্ত রূপে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির শেষ প্রয়াস। এর অপর এক বৈশিষ্ট্য, যা সহজেই দৃষ্টিগোচর তা হল, সীমাবদ্ধ ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্র ও অবশিষ্ট (রেসিডিউয়াল) ক্ষমতার আকর প্রদেশের মাঝখানে মুসলমান ও অমুসলমানের ভিত্তিতে তিনটি প্রদেশগোষ্ঠী গঠন করে অবিভক্ত ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানের পরস্পরবিরোধী দাবির মধ্যে একটি আপোস রফার প্রচেষ্টা। অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ আসামকে বাংলার সঙ্গে “গ” গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা অথবা কংগ্রেস শাসিত সীমান্ত প্রদেশকে পাঞ্জাব ও সিন্ধুর সঙ্গে “খ’ গোষ্ঠীতে দেবার প্রস্তাব লীগকে সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণে রাজী করাবার উদ্দীপক বলে মনে হয়। সম্ভবত এই কারণেই ১৬ই মে-এর ঘোষণার ভাষাতেও গুরুতর স্ববিরোধ ছিল। পঞ্চদশ অনুচ্ছেদের পঞ্চম ছত্রে যেখানে বলা হয়েছে যে ‘প্রদেশগুলির গোষ্ঠী গঠনের স্বাধীনতা থাকবে” ইত্যাদি, ঊনবিংশতম অনুচ্ছেদে সেখানে নূতন সংবিধান চালু না হওয়া পর্যন্ত প্রদেশগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রদেশগুলির পক্ষে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
১৭ই মে মিশনের নেতা পের্থিক-লরেন্স এই প্রস্তাব সম্বন্ধে দিল্লি থেকে এক বেতার- ভাষণে অন্যান্য বক্তব্যের সঙ্গে বললেন, “নূতন সংবিধান অনুসারে প্রথম নির্বাচন হবার পর প্রদেশগুলিকে অস্থায়ীভাবে যে প্রদেশগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার থেকে বেরিয়ে আসার স্বাধীনতা থাকবে।”(১৩) ১৭ই এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্রিপস এবং পরদিবস পেথিক-লরেন্স প্রদেশগুলির প্রথমে নির্ধারিত প্রদেশগোষ্ঠীর অঙ্গীভূত হবার বাধ্যবাধকতা এবং পরবর্তীকালে বেরিয়ে যাবার অধিকারের কথা ব্যক্ত করেন।(১৪)
পৃষ্ঠা: ২১৫

ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে প্রায় দেড় মাসের আলাপ-আলোচনায় জিন্নাকে বিগত ছয় বৎসরে অনুসৃত তাঁর কৌশল—পাকিস্তানের স্বরূপ ইচ্ছা করে অস্পষ্ট রাখা ত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়। মুসলমানদের স্বতন্ত্র বাসভূমি হিসাবে সার্বভৌম পাকিস্তানের সীমারেখা যে বর্তমানের পাকিস্তান ও বাংলাদেশের এলাকার অতিরিক্ত অপর কোনো অঞ্চল হবে না এবং এর ফলে পাঞ্জাব ও বঙ্গের বিভাজন অনিবার্য একথা আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁর এবং অন্যান্য অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১১ই এপ্রিল ব্রিটিশ মন্ত্রীমণ্ডল নীতিগতভাবে একথা স্বীকার করে নিয়েছিল যে যুধুধান পক্ষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এ কাজ নিষ্পন্ন করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে ভারত বিভাজন করেও ইংরেজ এ দেশ ত্যাগ করবে। মিশনের তাই জিন্নাকে তাঁর পাকিস্তান দাবির যথার্থ স্বরূপ বুঝিয়ে দিতে অসুবিধা হয়নি। সম্পূর্ণ পাঞ্জাব ও বঙ্গের প্রস্তাবিত পাকিস্তানে আসার সম্ভাবনা নেই—এই সত্য পাকিস্তানপ্রেমী অনেকের এবং বিশেষ করে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের মুসলিম নেতাদের মোহভঙ্গের কারণ হয়। তাছাড়া সীমান্ত প্রদেশের পাঠানদের মধ্যে পাঞ্জাবি মুসলমানদের প্রতি অবিশ্বাস তো ছিলই, সিন্ধুর পাকিস্তান-সমর্থকরাও পাঞ্জাবিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে পাকিস্তান গঠনের বদলে স্বতন্ত্র থাকাই অধিকতর বাঞ্ছনীয় মনে করতেন।(১৫)
এর উপর মিশন তার ঘোষণার ভূমিকাতেই সার্বভৌম পাকিস্তানের দাবিকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নস্যাৎ করে দিয়েছিল। ব্যাপারটা কেবল জিন্নার পক্ষেই আশাভঙ্গের কারণ ঘটায়নি, পাকিস্তানপ্রেমী তাঁর অনেক সমর্থকদের কাছেও মানসিক আঘাতের কারণ হয়েছিল। এঁদের মধ্যে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির মুসলিম নেতারা ছাড়াও মুসলমান ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নেতারাও ছিলেন যাঁদের কাছে হিন্দু-প্রভাব-মুক্ত পাকিস্তান তাঁদের ব্যবসায়ী স্বার্থের স্বর্গরাজ্য হবার কথা। ইতিপূর্বে জিন্নার উপর তাঁর অনুগামীদের তরফ থেকে চাপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মিশনের ঘোষণার পর তাঁর উপর এই চাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেল।(১৬)
মিশনের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে জিন্না তাই আভাস দিয়েছিলেন যে “খণ্ডিত ও কীটদষ্ট” পাকিস্তানের বদলে বৃহদায়তন পাকিস্তান এক সীমিত ক্ষমতাবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় ফেডারেল সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।(১৭) সুতরাং মিশনের ঘোষণা সম্বন্ধে সত্বর সিদ্ধান্ত নেবার জন্য বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত লীগ কাউন্সিলের সম্মুখীন হবার বদলে তিনি সময় নেবার পদ্ধতি গ্রহণ করলেন। প্রত্যুত ক্রিপস প্রস্তাবের সময় থেকেই তাঁর কৌশল ছিল পূর্বাহ্নে সে সম্বন্ধে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত জেনে নিয়ে অতঃপর নিজের পদক্ষেপ স্থির করা। এবার কিন্তু সে সুযোগ তিনি পাচ্ছিলেন না। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ২৪শে মে তারিখের প্রস্তাবে ক্যাবিনেট মিশনের ঘোষণাকে সরাসরি নাকচ করে এ সম্বন্ধে কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না নিয়ে কেবল ঐ প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে কতকগুলি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল। এদিকে প্রদেশমূহের বাধ্যতামূলক গোষ্ঠীভুক্তকরণ, “খ” ও “গ” গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসাবে কেন্দ্রীয় ফেডারেশনে যোগ দিলে ফেডারেল মন্ত্রীমণ্ডল ও আইনসভায় সংখ্যাসাম্যের সম্ভাবনা(১৮) (যার মৌখিক আশ্বাস জিন্না পেয়েছিলেন) এবং ফেডারেশনের কারণে মুসলমান সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশসমূহে মুসলমানদের স্বার্থের সংরক্ষক হবার সম্ভাবনা ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর পাকিস্তানের মূলতত্ত্ব স্বীকৃত হলেও(১৯) মিশনের ঘোষণায় জিন্নার বহু প্রকাশ্য দাবি নাকচ করা হয়েছিল। তিনি কেন্দ্রে সংখ্যাসাম্য চেয়েছিলেন ঠিকই, তবে কেন্দ্রে কোনো আইনসভা থাকুক অথবা কেন্দ্রের হাতে নিজ ব্যয়নির্বাহের জন্য রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার দেওয়া হোক—এ তিনি চাননি। তাঁর অপর এক দাবি ছিল যে, যেকোনো “বিতর্কমূলক” বিষয়ে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে। যেখানে তিনি দাবি করেছিলেন যে কেন্দ্রকে প্রদত্ত সীমাবদ্ধ অধিকার ছাড়া অপর সব বিষয়ে দেশীয় রাজ্যসমূহ ও প্রদেশগুলি সার্বভৌম থাকবে, মিশনের ঘোষণায় সেখানে বলা হল যে প্রদেশগুলির কেবল অবশিষ্ট (রেসিডিউয়াল) ক্ষমতা থাকবে। বছরের গোড়ায় লীগের আইনসভা সদস্যদের সভায় স্থিরীকৃত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের একটি মাত্র প্রশাসনিক একম্-এর বদলে মিশনের ঘোষণায় দুটি প্রদেশগোষ্ঠীর ব্যবস্থা ছিল। মিশন প্রস্তাব করেছিল যে নূতন সংবিধান চালু হবার দশ বছর পর যে কোনো প্রদেশের গোষ্ঠীর বাইরে যাবার অধিকার বর্তাবে। কিন্তু জিন্নার দাবি অনুসারে প্রদেশগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের অধিকার ছিল না। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের প্রথার জন্য প্রস্তাবিত গণপরিষদে মুসলিম আসনের সংখ্যার অধিকতর সুবিধা (weightage) পাবার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়েছিল।
মিশনের প্রস্তাবের প্রতিকূলতা, লীগের সহকর্মীদের কাছ থেকে বিরোধ এবং কংগ্রেসের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না গ্রহণজনিত অনিশ্চয়তার মধ্যে ৪ঠা জুন জিন্না ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণে প্রভাবিত করার জন্য তাঁর ওয়ার্কিং কমিটি ও তার পরই লীগ কাউন্সিলের সম্মুখীন হলেন। বাহ্যতঃ তাঁর প্রধান সহায় মিশনের তরফ থেকে বড়লাটের এই মর্মে ব্যক্তিগত আশ্বাস যে “উভয় পক্ষের কারও প্রতি আচরণে আমরা কোনো পক্ষপাত করতে চাই না…।” সমালোচক লীগ নেতৃবৃন্দকে তিনি বললেন যে, “আমি আপনাদের বলতে চাই যে পূর্ণ সার্বভৌম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছাড়া মুসলিম-ভারত তৃপ্ত হবে না…। এ এক বিরাট ও একটানা সংগ্রাম। প্রথম লড়াই ছিল লীগের প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের স্বীকৃতিলাভ। সে লড়াই মুসলমানেরা শুরু করেছিল এবং তাতে বিজয়ীও হয়েছে। মিশনের প্রস্তাব স্বীকার করে নেওয়া তাদের পাকিস্তানের জন্য সংগ্রামের সমাপ্তি নয়৷ পাকিস্তান অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।”(২০)
তিনি এই আশঙ্কাও ব্যক্ত করলেন যে যেহেতু সময় বদলে গেছে এবং লীগের পক্ষে আর ভারতের সাংবিধানিক অগ্রগতির পথে ভেটো প্রয়োগ করা সম্ভবপর নয় তাই এ প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত। কারণ লীগ এ প্রস্তাব বাতিল করলেও ইংরেজ সরকার নিরস্ত হবে না। এবং সেই পরিস্থিতিতে লাভবান হবে একমাত্র কংগ্রেস। ভবিষ্যতে সংখ্যাসাম্যের দাবি স্বীকার করিয়ে নেবার জন্যও বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত এবং তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন যে এই দাবি স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত লীগ কার্যত অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেবে না। বহু অনুনয়-বিনয় ও সম্ভাব্য ভীতিপ্রদর্শন ও যুক্তিজাল বিস্তারের পর অবশেষে কুশল বাগ্মীর জয় হল এবং ১৩জন সদস্য বিরুদ্ধে ভোট দিলেও ৬ই জুন লীগ কাউন্সিল জিন্নার প্রস্তাব অনুসারে মিশনের ১৬ই মে তারিখের ঘোষণার দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী—উভয় অংশই গ্রহণ করল। প্রস্তাবে বলা হল যে, “যেহেতু বাধ্যতামূলক গোষ্ঠীবদ্ধতার মাধ্যমে মিশনের পরিকল্পনায় পাকিস্তানের ভিত্তি ও বুনিয়াদ অন্তর্নিহিত, “লীগ এই আশা নিয়ে মিশন প্রস্তাবিত সংবিধান রচনার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক যে শেষ অবধি এক সম্পূর্ণ সার্বভৌম পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা এর দ্বারা হবে।”(২১) এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ৭ই জুন বড়লাটের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারে জিন্না নিজের জন্য প্রতিরক্ষা এবং তাঁর দলের অপর দুজন সদস্যের জন্য বিদেশসংক্রান্ত ও পরিকল্পনা বিভাগের দাবি জানালেন। আলোচনাকালে এবং তারপর ৮ই ও ১২ই জুনের চিঠিতে জিন্না সংখ্যাসাম্যের জন্যও চাপ দিতে থাকলেন।
ইতিমধ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে বড়লাট ও মিশনের আলাপ-আলোচনা চলছিল এবং ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তার বিচার বিবেচনাও হচ্ছিল। ১২ই জুন বড়লাট অন্তবর্তী সরকার গঠন সম্পর্কে জিন্না এবং কংগ্রেসের তরফ থেকে জওহরলালকে আমন্ত্রণ জানালেন। জিন্না কংগ্রেস সভাপতি আজাদের সঙ্গে আলোচনায় টেবিলে বসতে প্রস্তুত ছিলেন না বলে এই ব্যবস্থা। কারণ জিন্নার মতে হিন্দুরা কেবল “শত্রু”; কিন্তু লীগবহির্ভূত মুসলমানেরা “বিশ্বাসঘাতক” এবং তাই তাঁদের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা নয়। একটা বোঝাপড়ার পথ প্রশস্ত করার উদ্দেশ্যে গান্ধী কংগ্রেসকে প্রতিবাদ সহকারে এ প্রস্তাব মেনে নিতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জিন্না এই কারণে আলোচনায় যোগ দিলেন না যে সংখ্যাসাম্যের নীতি তখনও পর্যন্ত মেনে নেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে বড়লাট নেহরুর কাছে আবার প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকারের তপশিলী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিসহ হিন্দু-মুসলিম সংখ্যাসাম্যের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। ১৩ই ও ১৪ই জুন আজাদ বড়লাটকে দুটি পত্রে জানালেন যে এই শর্তে (এবং লীগ-বহির্ভূত মুসলমান প্রতিনিধি থাকবে না জেনে) কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে ইচ্ছুক নয়। ১৫ই জুন বড়লাট জানালেন যে প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিত্ব হবে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নয়, রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে এবং মুসলিম লীগের পাঁচ জন প্রতিনিধি ও কংগ্রেসের ছয় জন প্রতিনিধি থাকবে বলে সংখ্যাসাম্যের কথা ওঠে না। আজাদ উত্তরে জানালেন যে বর্তমান প্রস্তাব ভিন্নরূপে প্রথম সিমলা সম্মেলনের (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি। তফাত কেবল এইটুকু যে তখন কংগ্রেস নিজের জন্য নির্ধারিত সংখ্যা থেকে একজন জাতীয়তাবাদী মুসলমান নিতে পারত, এবারে তার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং কংগ্রেসের পক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয়। অবশেষে ১৫ই জুন ওয়াভেল তাঁকে জানালেন যে, “প্রধান দুটি দলের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করার আমার প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। ক্যাবিনেট মিশন ও আমি তাই স্থির করেছি যে অতঃপর আমরা কি করব সে সম্বন্ধে আগামী কাল একটি বিবৃতি জারি করব।”(২২)
ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ই জুনের ঘোষণায় জিন্নাসহ ১৪জন সদস্যবিশিষ্ট এক অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার কথা ঘোষণা করা হল। এতে লীগের পাঁচ জন মুসলমান কংগ্রেসের ছয় জন (১ জন তপশিলী সম্প্রদায়ের সদস্যসহ) হিন্দু সদস্য ছাড়াও শিখ, পার্শী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এক একজন করে সদস্যের নাম ছিল। সব দল চাইলে এই সরকার ২৬শে জুন থেকে কাজ আরম্ভ করবে বলে বলা হল এবং এও জানানো হল যে প্রদেশগুলির বিধানসভার অধিবেশন অবিলম্বে আহ্বান করা হচ্ছে যাতে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচন সম্পন্ন হয় এবং গণপরিষদ কাজ শুরু করতে পারে। ঘোষণার অষ্টম ধারায় উল্লেখ করা হল যে “প্রধান দলের দুটি-ই অথবা তাদের মধ্যে কোনো একটি যদি উপরোক্ত ধরনের কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিতে অনিচ্ছুক হয় তাহলে বড়লাটের অভিপ্রায় হল এই যে যাঁরা ১৬ই মে তারিখের ঘোষণাকে মেনে নিয়েছেন তাঁদের প্রতিনিধিদের নিয়ে যথাসম্ভব প্রতিনিধিত্বমূলক এক অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা।”
অন্তর্বর্তী সরকারে জাকির হোসেনের নাম বাদ দিয়ে কংগ্রেসকে মুসলমানদেরও প্রতিনিধিত্বের অধিকার না দেওয়ায়, বাস্তবে বর্ণহিন্দু ও মুসলমানদের সংখ্যাসাম্য মেনে নেওয়ায়, লীগ প্রদত্ত সদস্যতালিকা অপরিবর্তিত রেখে কেবল কংগ্রেসের তালিকায় রদবদল করায় (শরৎচন্দ্র বসুর স্থলে হরেকৃষ্ণ মহতাব) কোনো মহিলা সদস্যের নাম না রাখা (কংগ্রেসের প্রস্তাবিত নাম রাজকুমারী অমৃত কৌর, যিনি আবার খ্রিস্টানও), সরকারি বেতনভোগী এবং সরকারের তরফ থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা পরিচালনাকারী অ্যাডভোকেট জেনারেল এন. পি. ইঞ্জিনিয়ারকে মন্ত্রীমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত করা এবং কংগ্রেসের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ভোটারদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত লীগের আবদুর রব নিস্তারের নাম প্রস্তাবিত তালিকায় রাখা ইত্যাদির কারণে গান্ধী কংগ্রেসকে এ প্রস্তাব গ্রহণ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি কিন্তু নিজেদের জন্য নির্ধারিত সংখ্যার ভিতর একজন জাতীয়তাবাদী মুসলমান নিয়ে এবং আরও কিছু আপোস করে প্রস্তাব গ্রহণের পক্ষপাতী ছিল।
কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব গ্রহণের পূর্বে খবর পাওয়া গেল যে জিন্নার এক পত্রের উত্তরে ২০শে জুন বড়লাট তাঁকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন যে দুটি প্রধান পক্ষের সম্মতি ব্যতিরেকে নামের তালিকায় নীতিগতভাবে কোনো পরিবর্তন করা হবে না। এর অর্থ হল কংগ্রেস নিজের জন্য নির্ধারিত সংখ্যার ভিতরও মুসলমান সদস্য নিতে পারবে না(২৩) এবং তপশিলী হিন্দুসহ যে কোনো সংখ্যালঘু সদস্যের স্থান রিক্ত হলে সে আসন পূর্ণ করার জন্য দুই প্রধান দলের সঙ্গে পরামর্শ করা হবে। এর দ্বারা অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে লীগকে ভিটো দেবার অধিকার দেবার সঙ্গে সঙ্গে বড়লাট কংগ্রেস সভাপতিকে প্রদত্ত তাঁর পূর্বতন (১৫ই জুনের পত্রের পঞ্চম অনুচ্ছেদ) প্রতিশ্রুতি — কংগ্রেস লীগ সংখ্যাসাম্য হচ্ছে না, কারণ কংগ্রেস তপশিলীসহ ৬টি আসন পাচ্ছে—ভঙ্গ করে পিছনের দরজা দিয়ে সংখ্যাসাম্য প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করছিলেন। এর উপর ২২শে জুন বড়লাট কংগ্রেস সভাপতিকে লিখলেন যে কংগ্রেসের জন্য নির্ধারিত মন্ত্রীসংখ্যায় একজন মুসলমান সদস্য নেবার জন্য তাঁরা যেন আগ্রহ না করেন। তাঁর মতে, “ক্যাবিনেট মিশন অথবা আমার পক্ষে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভবপর নয় এবং এর কারণ আপনি ভালভাবেই জানেন।”(২৪) মিশনের এই ভূমিকা কেবল কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী চরিত্রের পক্ষেই ঘাতক ছিল না, কংগ্রেসে সভাপতিকে (আবদুর রব নিস্তার প্রসঙ্গে) লেখা তাঁর ১৪ই জুনের পত্রের প্রতিকূলও ছিল, যেখানে তিনি জানান, “মুসলিম লীগ কর্তৃক প্রস্তাবিত নামে কংগ্রেসের আপত্তি জানাবার অধিকার আমি মানতে পারি না, যেমন অপর পক্ষর তরফ থেকেও এজাতীয় আপত্তি মানতেও আমি অপারগ।” এছাড়া জিন্নাকে এই প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয় যে, “প্রধান পক্ষ দুটির যে কোনো একটির আপত্তি থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকবে” এবং কংগ্রেসের মতে বড়লাট কর্তৃক একান্ত আকস্মিকভাবে প্রস্তাবিত এমন গুরুত্বপূর্ণ এই নীতি আইনসভায় প্রতি দায়িত্বশীল কোনো সরকারের ক্ষেত্রে যদিও বা গ্রহণ করা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে তা গৃহীত হলে অচল অবস্থার সৃষ্টি হবে। মিশনের সদস্যদের সঙ্গে গান্ধীসহ কংগ্রেসের নেতাদের আরও অনেক আলাপ-আলোচনা ও পত্রবিনিময় হল। অবশেষে গান্ধী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে মিশনের দীর্ঘমেয়াদি (গণপরিষদ) এবং স্বল্পমেয়াদি (অন্তর্বর্তী সরকার)—কোনো প্রস্তাবই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে কংগ্রেস নেতাদের গান্ধী তাঁর পরামর্শ অনুসারে নয়, “তাঁদের বিবেকের নির্দেশ” অনুসরণ করার পরামর্শ দিলেন। ২৫শে জুন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বিবাদাস্পদ অনুচ্ছেদগুলি সম্বন্ধে তার নিজস্ব ব্যাখ্যাসহ (“সামগ্রিক বিচারে প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব সম্প্রসারণ ও তার শক্তিবৃদ্ধি করার যথেষ্ট অবকাশ থাকার সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীভুক্ত হবার ব্যাপারেও কোনো প্রদেশের নিজ অভিপ্রায় অনুসারে চলার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে এবং অন্য পরিস্থিতিতে যেসব সংখ্যালঘুরা অসুবিধায় পড়তেন তাঁদের সংরক্ষণ দেবারও অবকাশ বিদ্যমান”) দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করল ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বাতিল করল। আজাদ ঐদিনই কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মিশনকে জানিয়ে দিলেন।
জীবিকা মিশন বিবাদাস্পদ অনুচ্ছেদগুলি সম্বন্ধে কংগ্রেসের ভাষ্য স্বীকার না করে নিজের ভাষ্যে অটল থাকলেও ২৭শে জুন ঘোষণা করল যে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব গ্রহণ করে কংগ্রেস ১৬ই মে তারিখের ঘোষণাকে স্বীকার করে নিয়েছে বলে লীগের সঙ্গে সঙ্গে ঐ প্রতিষ্ঠানও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারী। তবে তাঁরা স্থির করলেন যে অতঃপর (২৯শে জুন) তাঁরা বিলাতে ফিরে যাবেন ও কিছুদিনের বিরতির পর ভবিষ্যতে বড়লাটই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্যোগ-আয়োজন করবেন। ইতিমধ্যে সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে এক অস্থায়ী কাজ চালাবার সরকার গঠিত হবে।
ক্যাবিনেট মিশনের তরফ থেকে ২৭শে জুনের ঐ ঘোষণার পূর্বে ২৫শে সন্ধ্যায় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত জানার পর বড়লাট মিশনের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার জন্য জিন্নাকে আমন্ত্রণ করেন। জিন্না আশা করেছিলেন যে কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে সম্মত না হওয়ায় কংগ্রেস বর্জিত ঐ সরকারে তাঁর ও লীগের প্রাধান্য থাকবে। কিন্তু মিশন তাঁকে সেরকম কোনো আমন্ত্রণ না জানিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা কেবল তাঁকে জ্ঞাপন করল। অতঃপর হতাশায় ক্ষুব্ধ জিন্নার সঙ্গে তাঁদের দীর্ঘ তিন ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা হল। কিন্তু অতীতে জিন্নাকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো অথবা সেই সময়ে তাঁকে এমনকি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেওয়া এক কথা। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে কেবল তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবার কথা ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিরা চিন্তা করতেই অসমর্থ ছিলেন। প্রত্যুত এমন এক পরিস্থিতির কথা অনুমান করে দিনকয়েক পূর্বেই আলোচনান্তে তাঁরা তাঁদের ভূমিকা স্থির করে ফেলেছিলেন।”(২৫)
ঐদিন বড়লাট এক “অত্যন্ত গোপনীয়” মেমোতে এ ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করলেন: “বলতে গেলে বুদ্ধির খেলায় আমরা কংগ্রেসের কাছে হেরে গেছি। শব্দাবলী ও বাক্যাংশের অর্থকে এইভাবে বিকৃত করার ব্যাপারে কংগ্রেসের ক্ষমতা এবং ভাষার কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতির সুযোগ নেওয়ার বৃত্তিকে মিস্টার জিন্না বারবার ভয় করে এসেছেন এবং তাঁর অসহযোগী মানসিকতার পিছনেও এই কারণ…। সবার মেজাজ উত্ত্যক্ত, মুসলিম লীগ মনে করে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে….।”(২৬) জিন্নার সঙ্গে সেই দীর্ঘ আলোচনা বড়লাটের মতে ছিল এক “শোচনীয় সাক্ষাৎকার…আসল কাজের কথা উপনীত হবার পূর্বেই…জিন্নার মেজাজ একেবারেই খিঁচড়ে গিয়েছিল; (তিনি) আমাদের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ ও কংগ্রেসের কাছে আত্মসমর্পণের অভিযোগ করলেন এবং বললেন যে তাঁকে সরকারে যোগদান করার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।”(২৭)
পৃষ্ঠা: ২২০

২৫
পাদটীকা

১. ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৭৪-১৭৫। পাঞ্জাব ও বঙ্গের নামমাত্র মুসলমান জাতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও বিপুল অমুসলমান জনসংখ্যা চিরকালই প্রস্তাবিত পাকিস্তানের মাথাব্যথার কারণ হবে বলে, “জিন্না একান্তভাবে উড্রো ওয়াইআটের কাছে স্বীকার করেন যে…তিনি আম্বালা ও বর্ধমান (বিভাগ)-কে যেতে দিতে প্রস্তুত, তবে ভাত ‘গুরুতর গোলযোগ’ এবং গৃহযুদ্ধ হলেও কলকাতাকে তাঁর পেতেই হবে।” বারি (সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৭৫)।
২. এই নির্বাচনকে জিন্না “ভারতের মুসলমানদের কাছে পাকিস্তানের জন্য “গণভোট” আখ্যা দিয়ে তাঁদের কাছে এই আবেদন জানিয়েছিলেন যে তাঁরা যেন “বিশ্বের কাছে এই কথা সপ্রমাণ করেন যে অখিল ভারত মুসলিম লীগই এদেশের মুসলিম জাতির প্রতিনিধি।” জমিলউদ্দীন আহমদ (সঃ); সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ২০২ পৃষ্ঠা।
৩. ভি. পি. মেনন; সমগ্রন্থ; ২৩৪-৩৫ পৃষ্ঠা।
৪. স্যার মীর্জা ইসমাইল; My PUnblic Life; ১৯৮ পৃষ্ঠা।
৫. চৌঠা এপ্রিল ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে আলোচনার সময়ে জিন্না বলেন যে কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে আলোচনার কোনো পরিণাম হবে না এবং তাই ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের মতো ব্রিটিশ সরকারেরই একটা রোয়েদাদ ঘোষণা করা উচিত। আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক ছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থার অধিকারযুক্ত এক কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। তিনি আরও জানান যে প্রস্তাবিত পাকিস্তান থেকে তিনি আসামকে বাদ দিতে এবং বাকি এলাকার সীমানা পারস্পরিক আলোচনার দ্বারা পুনঃনির্ধারণেও রাজী হতে পারেন। তবে কলকাতা তাঁর চাই-ই চাই। কারণ “কলকাতা ছাড়া পাকিস্তান কোনো মানুষকে তার হৃৎপিণ্ড বাদ দিয়ে বেঁচে থাকতে বলার মতো।”(T. P.; সপ্তম খণ্ড; পৃষ্ঠা ১১৮-২৪)। কিন্তু সুরাবর্দী (বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী), গোলাম হোসেন (সিন্ধুর প্রধানমন্ত্রী) এবং মামদোতের নবাব (পাঞ্জাব লীগের সভাপতি) প্রমুখ লীগের প্রাদেশিক নেতৃবর্গ বা পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী খিজির হায়াৎ খাঁ প্রমুখ কেউই জিন্নার প্রদেশ বিভাজনের প্রস্তাবের সমর্থক ছিলেন না। মিশনের কাছে তাঁরা বরং স্ব স্ব প্রদেশের বিশিষ্ট সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে চূড়ান্ত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেন। সীমান্ত প্রদেশের কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী যে পাকিস্তানের বিরোধিতা করবেন—একথা বলাই বাহুল্য। তবে মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলির লীগ নেতারা পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানান।
৬. ডঃ গোপাল কর্তৃক Jwaharlal Nehru – A Biography গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ৩১৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৭. T. P.; সপ্তম খণ্ড; ১৭৬-১৮০ পৃষ্ঠা।
৮. এখানে উল্লেখনীয় যে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লেখিত লীগের আইনসভার সদস্যদের ৭ই ভারত থেকে ৯ই এপ্রিলের সম্মেলনে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবের “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ ১৯। যার অংশভুক্ত একগুলি স্বয়ংশাসিত ও সার্বভৌম হবে”–এর সংশোধন করে তার পরিবর্তে নিম্নোদ্ধৃত অংশ গৃহীত হয়—“উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বঙ্গ ও আসাম এবং উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানকে নিয়ে এক সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র।” এই সংশোধনের কারণ হিসাবে বলা হয় যে এর দ্বারা লাহোর প্রস্তাবের “অস্পষ্টতা” দূর হবে। লীগের বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত এবং পরবর্তী সাধারণ অধিবেশনে পুনঃস্বীকৃত এই জাতীয় একটি মৌলিক এ সিদ্ধান্তের (রাষ্ট্রসমূহের বদলে রাষ্ট্র) পরিবর্তনের অধিকার আইনসভার সদস্যদের এক সম্মেলনের আছে কিনা এসব আইনগত বিতর্কের মধ্যে না গিয়েও বলা যায় যে ফজলুল হক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের এই সংশোধনের মধ্যে পৃথক ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের দাবির বীজ নিহিত ছিল। লাহোর প্রস্তাবের এই সংশোধন কৌশলী জিন্না অপর এক বাঙালি সুরাবর্দীকে দিয়ে উত্থাপন করিয়েছিলেন, বাংলার লীগ- জ্যাক রাজনীতিতে যাঁকে তিনি আদৌ নিজের লোক মনে করতেন না। একে এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদাহরণ বলা যায়।
৯. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ৩০৯ পৃষ্ঠা।
১০. T. P.; সপ্তম খণ্ড; ৪৮০ পৃষ্ঠা।
১১. পেনড্রেল মুন (সঃ); সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২৬০। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৬৫ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১২. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২৬৭-২৬৮। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৬৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। ১৩. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; clxxi পৃষ্ঠা।
১৪. সমগ্রন্থ; clxxiv ও clxxvi পৃষ্ঠা।
১৫. ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে সুরাবর্দী, গোলাম হোসেন, খিজির হায়াৎ খাঁ, জি.এম.সৈয়দ ও ডাঃ খাঁ সাহেবের আলোচনার বিবরণ; T. P.; সপ্তম খণ্ড; যথাক্রমে ১৬৩-১৬৬, ১২৬, ১৪৭-১৪৮, ৯২-৯৩ ও ৭৪-৭৫ পৃষ্ঠা।
১৬. জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৯৮, ২০০ ও ২০৩। উলপার্টের গ্রন্থের ২৭৪-২৭৫ পৃষ্ঠাও – দ্রষ্টব্য।
১৭. T. P.; সপ্তম খণ্ড; ১২৩-১২৪ ও ৩৪২ পৃষ্ঠা।
১৮. জিন্নার সঙ্গে মিশনের ১৬ এপ্রিলের আলোচনা; সপ্তম খণ্ড; ২৮১-২৮২ পৃষ্ঠা।
১৯. “কল্পনালোকের অবাস্তব পাকিস্তানের জন্য সাধারণ মানুষ অথবা মসজিদের মোল্লারা সোরগোল তুলতে প্রস্তুত ছিল না কিংবা ‘বিকলাঙ্গ বা কীটদষ্ট’ পাকিস্তানের জন্যও নয়… যা শেষ অবধি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে হাতে এল। তাঁর পাকিস্তান অবিভক্ত পাঞ্জাব চুলে ও বাংলার সুযোগ-সুবিধা জলাঞ্জলি দিতে চায়নি; হিন্দুস্তানের মুসলমানদের অরক্ষিত রেখে যাওয়াও সে পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল না। প্রদেশ দুটিকে অবিভক্ত রাখা ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা সম্ভব কেবল এক কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার অধীনে যেখানে লীগের সমান অধিকার থাকবে।” “জিন্নার যা প্রয়োজন ছিল তা হল এই যে সকল পক্ষ তখনকার কেন্দ্রীয় শাসন-ব্যবস্থাকে ভঙ্গ করে দেবে এবং বাস্তবে ॐ এমন না করে নীতিগতভাবে করলেও চলবে। তারপর অবিলম্বে এক সার্বভৌম পাকিস্তানের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় শাসন-ব্যবস্থাকে নূতন করে সৃষ্টি করা হবে। তাঁর মতে কেবল এই পন্থাই কেন্দ্রে মুসলমানদের সমান অধিকার পাবার নিশ্চয়তা দেবে। কারণ এর ভিত্তি হবে স্বাধীন জাতিসমূহের আইন দ্বারা সুনিশ্চিত সমানতা: সার্বভৌম রাষ্ট্রদের মধ্যে অনুষ্ঠিত চুক্তি…। কিন্তু কংগ্রেস যতক্ষণ না এর সপক্ষে স্পষ্টভাবে চাচা সম্মতি ব্যক্ত করে এগিয়ে আসছে, তিনি কতটা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ‘তা প্রকাশ করবেন না। কংগ্রেস যদি তার ভূমিকায় অনড় থাকে তাহলে জিন্না চাইছিলেন যে মিশনই যেন একটা ফয়সালা চাপিয়ে দেয় এবং তিনি ভেবেছিলেন যে মিশন এটা করতে সক্ষম’…। সুতরাং ব্রিটিশকে তাঁদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে হবে এবং সেটা যাতে কার্যকরী হয় তা দেখার জন্য আরও কয়েক বছর থেকে যেতে হবে। লীগ ও কংগ্রেস প্রদেশসমূহকে নিয়ে এখনই এক কেন্দ্র গড়াও ভাল যদি অবশ্য দুর্বল অংশীদার অর্থাৎ লীগের প্রতি ন্যায়বিচার হচ্ছে কিনা তার তদারকির জন্য ব্রিটিশ এদেশে থেকে যায়।” ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; ১৮৬-১৮৭ এবং ১৮৭-১৮৮ পৃষ্ঠা।
২০. Indian Register প্রথম খণ্ড (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬)/ পৃষ্ঠা ১৮১ থেকে জে. জে. পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১৪৫ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। ভারতসচিবের মতে এই প্রথম – জিন্না সার্বভৌম পাকিস্তানের কম কোনো কিছু বিবেচনা করতে প্রস্তুত হন। (ক্যাবিনেট মিশনের ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে এপ্রিলের বৈঠকের বিবরণ। T. P.; সপ্তম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৩৪২।)
২১. প্রস্তাবে আপাতদৃষ্টে পরাজয়কে এভাবে দৃশ্যতঃ বিজয়ের রূপ দেবার অন্তরালবর্তী ইতিহাসে পার্লামেন্টের ভূতপূর্ব সদস্য ও ক্রিপসের তদানীন্তন সহায়ক উড্রো ওয়াইআটের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ডঃ আয়েষা জালালের মতে: “এইজাতীয় গ্রহণের অযোগ্য পরামর্শের সম্মুখীন সেই অহঙ্কারী ব্যক্তিটি, অতীতে সর্বদাই যিনি নিজের সুষ্ঠু বিচার-বুদ্ধির উপর একান্তভাবে নির্ভর করতেন, তাঁকে ওয়াইআট নিষ্কৃতির একটা পন্থার হদিশ দিলেন। ওয়াইআট বললেন যে লীগ মিশন কর্তৃক পাকিস্তান দাবিকে ‘অত্যন্ত অবমাননাকর’ ভাবে প্রত্যাখ্যান করার নিন্দা করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করুক এবং তারপর সেই প্রস্তাবে বলুক যে মুসলমানরা অবশ্য আদৌ এ আশা করেনি যে ব্রিটিশ অথবা অপর কেউ থালায় সাজিয়ে পাকিস্তানকে তাঁদের হাতে তুলে দেবেন এবং তাঁরা ‘তাঁদের নিজের সবল দক্ষিণ হস্তের’ সাহায্যে নিজেদের দাবি আদায় করতে সক্ষম। নিজেদের সদিচ্ছার প্রমাণ দেবার জন্য লীগ ‘পাকিস্তানের অভিমুখে প্রথম পদক্ষেপের হিসাবে ঘোষণাকে স্বীকার করে নেবে।’ হতাশাপীড়িত জিন্না এই পরামর্শে স্পষ্টত ‘উল্লসিত’ হয়েছিলেন (ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২০০)।” ওয়াইআটের প্রস্তাবে জিন্নার প্রতিক্রিয়া তাঁর বিবরণ অনুসারে, “ঠিক ঠিক। আপনি ঠিক ধরেছেন।”( T..P.; সপ্তম খণ্ড; ৬৮৭ পৃষ্ঠা)। তবে ঔরঙ্গজেব খাঁ ও জমিলউদ্দীন আহমদের (লীগের লেখক সমিতির আহ্বায়ক) মতো জিন্নার সহযোগীরা খোলামনে মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। আহমদ লিখিতভাবে জিন্নাকে পরামর্শ দেন যে লীগ যেন “প্রদেশ গোষ্ঠী পর্যায় পর্যন্ত পরিকল্পনাকে কার্যকরী করে এবং তারপর এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যে হিন্দুরা ও ব্রিটিশ আমাদের মনোমতো পাকিস্তান দিতে বাধ্য হয়।” গণপরিষদে যোগ দিয়ে কিভাবে তার কাজ ভিতর থেকে বানচাল করা হবে তার বুদ্ধিও আহমদ জিন্নাকে দিয়েছিলেন। (মূর; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১২৯)।
২২. মূল পত্রের জন্য সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা cevi-ccxiii দ্রষ্টব্য।
২৩. জিন্না বড়লাটকে লেখা তাঁর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই মে-এর চিঠিতে জানান যে শক কংগ্রেসের বর্ণহিন্দু সদস্যদের একজনের পরিবর্তে ডঃ জাকির হোসেনকে নেবার প্রস্তাবে “মুসলিম ভারতের প্রতিক্রিয়া মারাত্মকভাবে প্রতিকূল হবে…এবং লীগের প্রতিনিধি ছাড়া অপর কোনো মুসলমান সদস্যকে আপনার দ্বারা মনোনয়নকে মুসলিম লীগ কখনো মেনে নেবে না। বিষয়টিকে আমি ওয়ার্কিং কমিটির সামনে উত্থাপন করেছিলাম। সেখানে এই অভিমত সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয়েছে এবং সদস্যরা একে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয় বিবেচনা করেন।”
২৪. এখানে কংগ্রেস সভাপতির মিশনের কাছে এই মর্মে লিখিত আশ্বাসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যা গান্ধীজীসহ কংগ্রেসের অপর সব নেতার অজ্ঞাতসারে খুব সম্ভব একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হবার সদিচ্ছা নিয়ে মৌলানা দিয়েছিলেন। মিশনের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে এই দ্বিতীয়বার আজাদ এইভাবে নিজের অপর সব সহকর্মীদের অজ্ঞাতসারে তাঁদের পত্র লেখেন। এর থেকে উদ্ভূত সমস্যার বিবরণের জন্য সুধীর ঘোষের Gandhiji’s Emissary; রূপা অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা (১৯৬৭); ১০৮- ১০৯ ও ১৬৫-১৬৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
২৫. মিশনের ২১শে জুনের আলোচনার বিবরণ; T. P.; সপ্তম খণ্ড; ৯৯৫ পৃষ্ঠা।
২৬. সমগ্রন্থ; ১০৩৯ পৃষ্ঠা।
২৭. পেনড্রেল মুন (সঃ); Wavell; The Viceroy’s Journal; পৃষ্ঠা ৩০৬। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৭৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।

নেহেরুর “বোমা”–জিন্নারও “পিস্তল” আছে
২৬

গুরুতর পীড়িত শরীর(১) ও অনুরূপ আহত মন নিয়ে জিন্না দ্বিতীয় সিমলা সম্মেলনের শেষে শূন্যহস্তে জুলাই-এর প্রথমে বোম্বাই প্রত্যাবর্তন করলেন। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই বোম্বেতে তাঁকে আরও এক গুরুতর আঘাত পেতে হল।
এ আঘাত কংগ্রেসের নেতা জওহরলালের কাছ থেকে বলে তার বিবরণ অপর এক কংগ্রেস নেতা মৌলানা আজাদের জবানীতে শোনাই ভাল। ওয়ার্কিং কমিটির ২৫শে জুনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য বোম্বেতে ৬ই ও ৭ই জুলাই অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির এক জরুরি সভা আহুত হয়েছিল।(২) ইতিমধ্যে নেহরু কংগ্রেসের নূতন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন এবং অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির ঐ সভাতেই তিনি আজাদের কাছ থেকে সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। অতঃপর একটু দীর্ঘ হলেও মৌলানার উদ্ধৃতি:
“এরপর সেই জাতীয় এক অতীব শোচনীয় ঘটনা ঘটল যা ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তিত করে দিয়ে থাকে। ১০ই জওহরলাল বোম্বাই-এ সাংবাদিক সম্মেলনের অনুষ্ঠান করলেন এবং তাতে এক আশ্চর্যজনক বিবৃতি দিলেন। কোনো এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক এই প্রস্তাব গৃহীত হবার পর কি কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন প্রণালীসহ (মিশনের) পরিকল্পনাকে পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করেছে?
“উত্তরে জওহরলাল বলেছিলেন যে কংগ্রেস ‘কোনো রকমের চুক্তির বন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে যখন যেরকম অবস্থার সৃষ্টি হয় তার মোকাবিলা করার স্বাধীনতা নিয়ে’ গণপরিষদে যোগদান করবে।
“সংবাদপত্র প্রতিনিধিরা অতঃপর জিজ্ঞাসা করলেন যে, এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনার রদ-বদল হতে পারে?
“জওহরলাল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উত্তর দিলেন যে কংগ্রেস কেবল গণপরিষদে যোগ দিতে রাজী হয়েছে এবং নিজেদের অভিরুচি অনুযায়ী ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের পরিবর্তন বা রদ-বদল করার স্বাধীনতা তার আছে।
“মুসলিম লীগ চাপে পড়েই ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। স্বভাবতই শ্রীযুক্ত জিন্না এর জন্য খুব খুশি ছিলেন না। লীগ কাউনসিলের সভায় শ্রীযুক্ত জিন্না স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে এর চেয়ে ভাল আর কিছু পাওয়া সম্ভব নয় বলে তিনি এ প্রস্তাব গ্রহণের জন্য সুপারিশ করছেন। তাঁর রাজনৈতিক পরামর্শদাতারা এই কথা বলে তাঁর সমালোচনা করা শুরু করেছিলেন যে তিনি নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়েছেন। তিনি স্বতন্ত্র ঐস্লামিক রাষ্ট্রের আদর্শ বর্জন করেছেন—এই মর্মে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছিল। সমালোচকরা এই বলে তাঁকে বিদ্রূপ করছিলেন যে লীগ যদি ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা (যাতে মুসলমানদের এক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের অধিকার অস্বীকার করা হয়েছিল) গ্রহণই করবে, তাহলে কেন শ্রীযুক্ত জিন্না এতদিন এক স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য এত হৈচৈ করলেন?
পৃষ্ঠা: ২২৫

“সুতরাং আলোচনার পরিণাম সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত জিন্না খুব খুশি ছিলেন না; কিন্তু অপর কোনো বিকল্প ছিল না বলে তিনি পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। জওহরলালের বিবৃতি তাঁর কাছে বোমার বিস্ফোরণের মতো প্রতীয়মান হল। অবিলম্বে এক বিবৃতি জারি করে তিনি বললেন যে কংগ্রেস সভাপতির পূর্বোক্ত ঘোষণার ফলে সমগ্র পরিস্থিতির পুনর্বিচার করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তিনি তাই লিয়াকৎ আলী খাঁকে লীগ কাউন্সিলের এক সভা আহ্বানের নির্দেশ দিয়ে এই ঘোষণা করলেন যে দিল্লিতে লীগ কাউন্সিল এই আশ্বাসের ভিত্তিতে ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল যে কংগ্রেসও ঐ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং ঐ পরিকল্পনা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সংবিধানের ভিত্তি হবে। এখন যখন কংগ্রেস সভাপতি ঘোষণা করেছেন যে গণপরিষদে নিজেদের সংখ্যাধিক্যের(৩) বলে কংগ্রেস এই পরিকল্পনাকে পরিবর্তিত করতে পারে—এর অর্থ এই হয় যে সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনুগ্রহ-নির্ভর হয়ে থাকতে হবে। তাঁর মতে জওহরলালের পূর্বোক্ত বিবৃতির অর্থ হল কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনাকে বাতিল করেছে এবং সেই কারণে বড়লাটের উচিত মুসলিম লীগ মিশনের পরিকল্পনার গ্রহণ করেছে বলে ঐ প্রতিষ্ঠানকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানানো।
“২৭শে জুলাই বোম্বাই-এ মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভা হল। উদ্বোধনী সভায় জিন্না লীগের পক্ষে একমাত্র পন্থা পাকিস্তানের দাবির পুনরুচ্চারণ করলেন। তিনদিন আলোচনার পর কাউন্সিল ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা অগ্রাহ্য করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করল। পাকিস্তান প্রাপ্তির জন্য প্রত্যক্ষ কর্মসূচির সিদ্ধান্তও ঐ সভায় গৃহীত হল।
“ঘটনাপ্রবাহ এইভাবে নূতন মোড় নেওয়ায় আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলাম।(৪) আমি দেখছিলাম যে, যে-পরিকল্পনার জন্য আমি এত পরিশ্রম করেছিলাম তা এইভাবে আমাদেরই কৃতকর্মের ফলে ধ্বংস হতে চলেছে। আমার মনে হল যে সমগ্র পরিস্থিতির পুনর্বিচারের জন্য অবিলম্বে ওয়ার্কিং কমিটির একটি সভা হওয়া প্রয়োজন। জওহরলাল প্রথমে রাজী হচ্ছিলেন না, কিন্তু আমি জোর করায় সম্মত হলেন। এইভাবে ৮ই আগস্ট ওয়ার্কিং কমিটির সেই সভা হল ও সমগ্র রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করল। আমি বললাম যে আমরা যদি পরিস্থিতি রক্ষা করতে চাই তাহলে স্পষ্ট করে বলতে হবে যে বোম্বাই-এর সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেস সভাপতির বিবৃতি তাঁর ব্যক্তিগত অভিমতের দ্যোতক এবং তা কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের অনুযায়ী নয়। আমি একথা বুঝিয়ে বললাম যে কংগ্রেসের অভিমত অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির প্রস্তাবে ব্যক্ত হয়েছে এবং কোনো ব্যক্তি—এমনকি কংগ্রেস সভাপতিও তা পরিবর্তন করতে পারেন না।(৫) জওহরলাল এই যুক্তি দেখালেন যে ওয়ার্কিং কমিটি যদি আবারও এই কথা বলতে চায় যে কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তাতে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু কংগ্রেস সভাপতির বিবৃতি প্রতিষ্ঠানের নীতির প্রতিনিধিত্ব করছে না—এই মর্মে ওয়ার্কিং কমিটি কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করলে তা প্রতিষ্ঠান এবং তাঁর নিজের পক্ষেও বিব্রতকারী হবে।
“ওয়ার্কিং কমিটির মনে হচ্ছিল যে তার সামনে উভয়সঙ্কট। একদিকে কংগ্রেস সভাপতির মান-মর্যাদার প্রশ্ন, অন্যদিকে এত পরিশ্রম করে আমরা যে বোঝাপড়ায় উপনীত হয়েছিলাম তার ভবিষ্যৎ বিপন্ন। সভাপতির বিবৃতির প্রতিবাদ করলে প্রতিষ্ঠান দুর্বল হবে, আবার ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা বর্জন করলে দেশের সর্বনাশ ঘটবে। শেষ পর্যন্ত আমরা এমনভাবে প্রস্তাবের খসড়া রচনা করলাম যাতে জওহরলালের বিবৃতির উল্লেখ না করে অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সিদ্ধান্তকে পুনঃস্বীকৃতি দেওয়া হল।…
“আমরা আশা করেছিলাম যে ওয়ার্কিং কমিটির এই প্রস্তাবের ফলে শেষরক্ষা হবে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই ছিল না যে কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা পুরোপুরি গ্রহণ করেছিল। মুসলিম লীগ যদি আমাদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করত তাহলে তার মর্যাদাহানি ব্যতিরেকেই পুরাতন অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে পারত। শ্রীযুক্ত জিন্না কিন্তু সেদিকে গেলেন না এবং বলতে লাগলেন যে জওহরলালের বিবৃতিই কংগ্রেসের আসল মনের কথা। তিনি এই যুক্তিজাল বিস্তার করলেন যে ইংরেজরা দেশে থাকাকালীনই এবং হাতে ক্ষমতা আসার পূর্বেই কংগ্রেস যদি এতবার তার ভূমিকা বদলাতে পারে, তাহলে একবার ইংরেজরা চলে গেলে কংগ্রেস যে আবার তার মত বদলাবে না এবং পুনর্বার জওহরলালের বিবৃতিতে ব্যক্তভূমিকা গ্রহণ করবে না, সে ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের কাছে নিশ্চয়তা কোথায়?”(৬)
আগস্টের ঘটনাবলী নিয়ে অগ্রসর হবার পূর্বে লীগ কাউন্সিলের ২৯শে জুলাই-এর সেই গুরুত্বপূর্ণ সভা এবং লীগের প্রত্যক্ষ কর্মসূচির প্রস্তাব সম্বন্ধে আর একটু আলোচনা করা প্রয়োজন। কেন্দ্রে সমান ক্ষমতা পাবার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেবার পর আকস্মিকভাবে তার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ, হতাশা ও তিক্ততার পরিবেশের মধ্যেও জিন্না প্রথমে নিজ কৃতকর্মের অর্থাৎ সার্বভৌম পাকিস্তানের বদলে সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় সরকার এবং ছটি প্রদেশের দুটি গোষ্ঠীর ব্যবস্থার সমর্থনে অকুণ্ঠ ভাষায় বলেন, “আমরা স্বেচ্ছায় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তিনটি বিষয় তুলে দিতে চেয়েছিলাম এবং এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেমন চলে তা দশ বছর দেখতে প্রস্তুত ছিলাম। আমাদের সিদ্ধান্তে কোনো ভুল ছিল না। এর দ্বারা মুসলিম লীগ উচ্চতম স্তরের রাজনৈতিক বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছিল। …আমাদের ভিতর সাহস ছিল—কেন্দ্রের হাতে ঐ বিষয়গুলি সমর্পণ করায় ভুল হয়নি।” একত্রে থাকার জন্য তিনি এবং লীগ এতটা আপোসের জন্য প্রস্তুত হলেও কংগ্রেস ও ব্রিটিশ সরকার তাঁদের সঙ্গে কেবল “বিশ্বাসঘাতকতাই” করেনি, কেন্দ্রে তাঁদের ক্ষমতা পাবার পথ রুদ্ধ করেছে। সেই জ্বালা ব্যক্ত করে অতঃপর জিন্না বললেন, “সততা ও ন্যায়বিচার পাবার মুসলিম লীগের তাবৎ প্রয়াস—এমনকি মিনতি ও প্রার্থনারও কোনোরকম সাড়া কংগ্রেসের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। ক্যাবিনেট মিশনও কংগ্রেসের ইঙ্গিতে চলেছে। তার খেলাও নিজস্ব ধরনের।…সমগ্র আলাপ-আলোচনাকালে ক্যাবিনেট মিশন ও বড়লাট কংগ্রেসের আতঙ্ক ও শাসানির প্রভাবাধীন ছিলেন…এবং তাঁদের প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন ও চূড়ান্ত প্রস্তাবে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা বর্জন করেছেন।…কংগ্রেস আদৌ কোনোদিন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। … ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, ক্যাবিনেট মিশন তেমনি সেই শর্তাধীন স্বীকৃতিকে….যথার্থ মনে করে।… বোম্বাই-এ ১০ই জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে…পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সম্বন্ধে কংগ্রেসের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গী পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন…যে কংগ্রেস কোনো শর্তই স্বীকার করেনি….। তাহলে কোনো কিছু কল্পনা করা বা স্বপ্ন দেখার সার্থকতা কোথায়?”(৭)
তিনি আরও বললেন, “প্রতিবাদের কোনোরকম আশঙ্কা না করে আমি আপনাদের একথা বলতে পারি যে সমগ্র আলোচনাকালে তিনটি পক্ষের মধ্যে একমাত্র মুসলিম লীগ সম্মানিত প্রতিষ্ঠানরূপে আলোচনা করেছে।…এই সমস্ত আলাপ-আলোচনায় ভিতর দিয়ে যে একমাত্র পক্ষ সম্মানসহ ও পরিচ্ছন্নভাবে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে তা হল মুসলিম লীগ।…এই সব তথ্য সন্দেহের তিলমাত্র অবকাশ না রেখে সুস্পষ্টভাবে একথা প্রমাণ করে যে ভারতবর্ষের সমস্যার একমাত্র সমাধান হল পাকিস্তান। কংগ্রেস ও শ্রীযুক্ত গান্ধী যতক্ষণ মনে করবেন যে তাঁরা সমগ্র ভারতবর্ষের প্রতিনিধি…যে পর্যন্ত তাঁরা এই বাস্তব তথ্য অস্বীকার করবেন যে মুসলিম লীগই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান এবং যতদিন পর্যন্ত তাঁরা এই দুষ্টচক্রে আবর্তিত হতে থাকবেন, ততদিন কোনো বোঝাপড়া বা স্বাধীনতার সম্ভাবনা নেই।…শ্রীযুক্ত গান্ধী এখন জগদগুরুর মতো কথাবার্তা বলছেন। তিনি জানিয়েছেন যে কংগ্রেস….ভারতবর্ষের জনসাধারণের ন্যাসী।… দেড়শো বছর ধরে যে একক ন্যাসী এদেশে বিদ্যমান তাঁদের সম্বন্ধে আমাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে। কংগ্রেস আমাদের ন্যাসী হোক এ আর আমরা চাই না। আমরা এখন যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি। মুসলমানদের একমাত্র ন্যাসী হল মুসলমান জাতি।”(৮)
ব্যক্তিগতভাবে ক্রিপস ও পেথিক-লরেন্সও তাঁর বাক্যবাণ থেকে রেহাই পেলেন না, যদিও তাঁরা যথাক্রমে পার্লামেন্ট ও লর্ডসভায় মিশনের পরিকল্পনা স্বীকার করার জন্য জিন্নার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। প্রথমোক্ত জন সম্বন্ধে তিনি বললেন, “দুঃখের সঙ্গে আমি একথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে স্যার স্ট্র্যাফোর্ড ক্রিপস তাঁর আইনজীবীর প্রতিভাতে খাদ মিশিয়েছেন।” “মুসলমান প্রতিনিধিদের মনোনয়নের একচ্ছত্রাধিকার (জিন্না) পেতে পারেন না”—লর্ডসভায় ভারতসচিবের এই উক্তির তীব্র প্রতিবাদ করে লীগের ঐ সভায় তিনি বলেন, “আমি ব্যবসায়ী নই। তেলের জন্য আমি কোনো সুবিধা চাইছি না অথবা বেনিয়ার মত দরাদরিও করছি না।”(৯) স্পষ্টত এক ঢিলে ইংরেজ ও গান্ধী—দুই পাখিকেই আঘাত করা ছিল তাঁর লক্ষ্য।
বলা বাহুল্য লীগের উগ্রপন্থী ও গোঁড়ারা এই সুযোগের পূর্ণ সদ্বব্যবহার করলেন। ফিরোজ খাঁ নূন, হসরৎ মোহানী, রাজা গজনফর আলী খাঁ প্রমুখ অনেকের প্রায় জেহাদি সুরের বক্তৃতা প্রতিনিধিদের হর্ষধ্বনি দ্বারা অভিনন্দিত হল। প্রতিনিধিদের মেজাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওয়ার্কিং কমিটি দুটি প্রস্তাব পেশ করল এবং তা গৃহীত হল। এর প্রথমটিতে গণপরিষদসহ ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনার স্বীকৃতি প্রত্যাহার এবং দ্বিতীয়টিতে ভবিষ্যতে “প্রত্যক্ষ কর্মসূচি” শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল।
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের উপর ঐ “প্রত্যক্ষ কর্মসূচি” প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে বলে এখানে তার প্রয়োজনীয় অংশ উদ্ধৃত করা প্রয়োজন “আপোস রফা ও সাংবিধানিক উপায়ে ভারতের সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বার করার মুসলিম ভারতের যাবতীয় প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। কংগ্রেস ব্রিটিশের প্রচ্ছন্ন সম্মতিতে ভারতবর্ষে এক বর্ণহিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী একথা সপ্রমাণ করেছে যে ভারতবর্ষের ব্যাপারে ন্যায়বিচার নয়, ক্ষমতার রাজনীতিই সব কিছুরই নির্ণায়ক। আর একথাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে অবিলম্বে এক স্বাধীন ও পূর্ণতঃ সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির কম কোনো কিছুতে ভারতে মুসলমানরা শান্ত হবেন না এবং মুসলিম লীগের অনুমোদন ও সম্মতি ব্যতিরেকে দীর্ঘমেয়াদি বা স্বল্পমেয়াদি কোনোরকম সংবিধান চাপিয়ে দেওয়া অথবা কেন্দ্রে এক অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের তাঁরা বিরোধীতা করবেন। অখিল ভারত মুসলিম লীগ বিশ্বাস করে যে পাকিস্তান প্রাপ্তি, নিজেদের ন্যায়সঙ্গত দাবি অর্জন, নিজেদের সম্মান রক্ষা এবং বর্তমানের ইংরেজের ও ভবিষ্যতের বর্ণহিন্দুদের দাসত্বের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য মুসলমান জাতির তরফ থেকে প্রত্যক্ষ কর্মসূচিতে প্রবৃত্ত হবার সময় এখন এসে গেছে।
“এই কাউন্সিল তাই মুসলিম জাতিকে তাঁদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগের পিছনে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে এবং সব রকমের আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছে। উপরে উল্লিখিত নীতি কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে এক প্রত্যক্ষ কর্মসূচি অবিলম্বে রচনা করার জন্য এই কাউন্সিল ওয়ার্কিং কমিটিকে নির্দেশ দিচ্ছে এবং যখন যেখানে প্রয়োজন আসন্ন সংগ্রামে যোগ দেবার জন্য মুসলমানদের প্রস্তুত করার জন্যও ওয়ার্কিং কমিটির উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছে। ইংরেজ শাসনের আচরণের প্রতিবাদ এবং তার প্রতি ক্ষোভ ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে এই কাউন্সিল মুসলমানদের অবিলম্বে বিদেশি সরকার প্রদত্ত উপাধিসমূহ বর্জন করার আহ্বান জানাচ্ছে।”(১০)
এইভাবে ভারতবর্ষের অবিভক্ত থেকে স্বাধীন হবার শেষ সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে গেল। ভারতবিভাজন অতঃপর কেবল সময়ের ব্যাপার।
যাই হোক, প্রস্তাব গৃহীত হবার পর উপসংহার ভাষণে জিন্না বললেন: “আমরা এক অত্যন্ত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। মুসলিম লীগের সমগ্র ইতিহাসে আমরা সাংবিধানিক ছাড়া অপর কোনো পন্থা গ্রহণ করিনি….আজ আমাদের এমন অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেওয়ার পিছনে কংগ্রেস ও ইংলন্ড উভয়েরই যোগাযোগ আছে। আমাদের দুই দিক থেকে আক্রমণ করা হয়েছে।…আজ আমরা সংবিধান ও সাংবিধানিক পদ্ধতিকে বিদায় জানিয়েছি। কষ্টকর আলাপ-আলোচনার পুরো সময়টায় যে দুইদলের সঙ্গে আমাদের দরাদরি করতে হয়, তারা আমাদের দিকে পিস্তল তাগ করে রেখেছিল। একদলের পিছনে ছিল ক্ষমতা ও মেশিনগান এবং অপর দল সর্বদা অসহযোগ ও গণআইন অমান্য শুরু করার শাসানি দিত। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। আমাদেরও এখন পিস্তল আছে।”(১১)
এখানে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে জিন্না পরিকল্পিত “প্রত্যক্ষ কমসূচির” স্বরূপ কি ছিল? কিন্তু সে প্রশ্নের সরাসরি জবাব খোঁজবার পূর্বে পূর্বোক্ত প্রস্তাবের তিনটি বাক্যাংশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে যা পরোক্ষভাবে এর উত্তর খোঁজার সহায়ক। প্রথম অনুচ্ছেদ “স্বাধীন ও পূর্ণতঃ সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের” অপরিহার্যতার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এ কথারও উল্লেখ করা হয়েছে যে “মুসলিম লীগের সম্মতি ও অনুমোদন ব্যতিরেকে” “দীর্ঘমেয়াদি বা স্বল্পমেয়াদি কোনোরকম সংবিধান চাপিয়ে দেওয়া অথবা কেন্দ্রে এক অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের” বিরোধিতা করা হবে। অর্থাৎ এর পরও ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ই মে ও ১৬ই জুনের মতো কোনো পরিকল্পনার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার ও গণপরিষদে যোগ দেবার সম্ভাবনা স্থায়ীভাবে নাকচ করা হচ্ছে না, যদি অবশ্য লীগের “সম্মতি ও “অনুমোদন” গ্রহণ করা হয়। এছাড়া ওয়ার্কিং কমিটিকে মুসলমানদের আগামী সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় যা “যখন যেখানে প্রয়োজন” (অর্থাৎ তখনও ঐ স্থিতি আসেনি) শুরু করা হবে। তৃতীয় বাক্যাংশটি হল “হয় আমরা ভারতকে বিভক্ত করব অথবা ধ্বংস করব।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
লীগ কাউন্সিলের সভার শেষে জনক বিদেশি সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে প্রত্যক্ষ কর্মসূচির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে প্রথমে তিনি বলেন যে এ হবে এক “গণবেআইনী (illegal) আন্দোলন।” কিন্তু ইতিমধ্যে সম্ভবত তাঁর আইনজীবী সত্তা প্রবল হয়ে ওঠার পরে ঐ “বেআইনী” শব্দের সংশোধন করে তিনি “অসাংবিধানিক” (unconstitutional) শশব্দ ব্যবহার করেন।(১২) ৩১শে জুলাই জনৈক ভারতীয় সাংবাদিকের এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এখন আমি আপনাকে সেকথা বলতে প্রস্তুত নই।”(১৩) দীর্ঘকাল যিনি সমগ্র পাকিস্তানের ধারণাকেই ইচ্ছা করে ধোঁয়াটে রেখেছিলেন—কারণ তাঁর নিজেরই এ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা ছিল না—তাঁর পক্ষে “প্রত্যক্ষ কর্মসূচিকে” অস্পষ্ট রাখা অস্বাভাবিক নয়। পরোক্ষ সাক্ষ্য এই সিদ্ধান্তের প্রতি চালিত করে যে এ সম্বন্ধে তাঁর মনে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। একথা সত্য যে “প্রত্যক্ষ কর্মসূচির” তালিকা তৈরি করার জন্য একটি উপসমিতি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ১৬ই আগস্ট মুসলমানদের সাধারণ ধর্মঘট করতে বলা ছাড়া সরকারিভাবে লীগ এর জন্য অপর কোনো কর্মসূচি রচনা করতে সক্ষম হয়নি।
তাই বলে তাঁর এক শ্রেণীর অনুগামীরা কিন্তু তাঁর মতো এ ব্যাপারে অন্ধকারে ছিলেন না। তাঁরা প্রত্যক্ষ কর্মসূচির নিজেদের মনোমতো অর্থ করে নিয়েছিলেন। লীগ সম্পাদক লিয়াকত আলী খাঁ বলেন যে এর অর্থ হল, “অসাংবিধানিক পন্থা গ্রহণ করা এবং তা যে কোনো রূপ গ্রহণ করতে পারে—আমাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী যে-কোনো রূপ… কোনো পদ্ধতিকেই আমরা বাতিল করতে পারি না। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অর্থ হল আইন-বিরুদ্ধ কার্য।” বাংলার অন্যতম লীগনেতা খাজা নাজিমুদ্দীন বললেন, “শতাধিক প্রক্রিয়ায় আমরা অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারি—বিশেষত আমাদের উপর যখন অহিংসার বন্ধন নেই। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অর্থ কী হবে তা বঙ্গের মুসলিম অধিবাসীরা জানেন এবং তাই তাঁদেরকে এ সম্বন্ধে নেতৃত্ব দিতে যাবার আবশ্যকতা নেই।” কলকাতার লীগপন্থী মেয়র মহম্মদ উসমান দিনটিকে জেহাদের সূচনা বলে ঘোষণা করেন। সর্দার আবদুর রব নিস্তার আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন যে একমাত্র রক্তপাতের দ্বারাই পাকিস্তান অর্জিত হতে পারে এবং প্রয়োজন পড়লে অমুসলমানদের রক্তপাত করতে হবে। কারণ “মুসলমানরা অহিংসায় বিশ্বাসী নন।”(১৪) লীগের ছোট মাঝারি আরও অনেক নেতা এই জাতীয় জঙ্গি ও হিন্দু-বিরোধী জেহাদি ভাষায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দিলেন। মুসলিম লীগের তরফ থেকে জনসাধারণের স্তরে সক্রিয় সংগঠন ছিল তার “লড়কে লেঙ্গে” মার্কা ন্যাশনাল গার্ড এবং স্বেচ্ছাসেবকের দল, যাদের রাজনৈতিক শিক্ষা দেবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। তারা সচরাচর পরিচালিত হত মসজিদভিত্তিক কট্টর মোল্লা ও পীর প্রভৃতিদের দ্বারা। মুসলিম সমাজে বা তাঁদের অর্থব্যবস্থায় সে সময়ে মধ্যবিত্তদের সংখ্যা যেমন অতীব ক্ষীণ ছিল তেমনি তাঁদের বৃহদাংশের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান লীগেও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের একান্ত অভাব। ইতিমধ্যে আহমেদাবাদ, বোম্বাই, এলাহাবাদ, আলীগড়, ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে নিরীহ ব্যক্তিদের উপর অতর্কিতে ছুরিকাঘাত ও অন্যান্য ধরনের আক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে আলোচনা চলাকালীন নানা জায়গায় পুলিশ কর্তৃক ছোরা-ছুরি ও অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের রহস্যজনক পুলিন্দা আবিষ্কার করেছে খবর পাওয়া যাচ্ছিল। ঈশান কোণে পুঞ্জীভূত ঐ সিঁদুরে মেঘের পরিপ্রেক্ষিতে লীগের উপরের দিকের নেতাদের(১৫) “প্রত্যক্ষ কার্যসূচি দিবস” সম্পর্কিত ব্যাখ্যা নীচের তলার সমর্থক ও কর্মীদের মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
ভারতবর্ষের কোণে কোণে অশান্তি ও উত্তেজনার চিহ্ন ফুটে বেরোচ্ছিল। লীগ কাউন্সিলের যুদ্ধং দেহি মনোভাবজনিত প্রতিক্রিয়া তার সঙ্গে যুক্ত হল। পেথিক-লরেন্সের
পৃষ্ঠা: ২৩০

পরামর্শ সত্ত্বেও ওয়াভেল লীগ কাউন্সিলের শাসানির পরিপ্রেক্ষিতে জিন্নার সঙ্গে নূতন করে আলোচনা করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। অথচ দেশের তদানীন্তন বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে ইংরেজ সরকার ভারতবর্ষের প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করার অপরিহার্যতা অনুভব করছিলেন। তাই ভারতসচিবের অনুমোদন নিয়ে ৬ই আগস্ট ওয়াভেল জওহরলালকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে আমন্ত্রণ জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁকে এ পরামর্শও দিলেন যে প্রস্তাবিত সরকারের সদস্য-তালিকা স্থির করার পূর্বে জিন্নার সঙ্গে আলোচনা করে লীগসহ কোয়ালিশন গঠন করা বাঞ্ছনীয় হবে। নেহরু এ দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে ১৫ই আগস্ট জিন্নার সঙ্গে লীগের সহযোগিতা পাবার আলোচনা করলেন।
“নেহরু জিন্নাকে এই আশ্বাস দিলেন যে উভয় পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া ব্যতিরেকে গণপরিষদে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে না। যাবতীয় মতভেদ ফেডারেল আদালতে সিদ্ধান্তর জন্য পাঠানো হবে এবং কংগ্রেস যদিও প্রদেশগোষ্ঠী গঠন অবাঞ্ছনীয় মনে করে এবং কেন্দ্রের অধীনে স্বায়ত্তশীল প্রদেশের অস্তিত্ব কাম্য বিবেচনা করে, ‘প্রদেশগুলি চাইলে (কংগ্রেস) তাদের গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়ার বিরোধিতা করবে না।’ লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে পাঁচটি আসন পাবে, তবে মুসলমান সদস্য মনোনয়নের ব্যাপারে একাধিপত্য দাবি করতে পারবে না।(১৬) জিন্না সে প্রস্তাব বাতিল করলেন এবং নেহরুর মনে এই ধারণার সৃষ্টি হল যে, ‘জিন্না যতটা চেয়েছিলেন তার থেকে বেশি অগ্রসর হয়ে পড়েছিলেন এবং এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল এই যে, আলোচনাকালে জিন্নার একমাত্র প্রস্তাব ছিল এই যে ছয় মাসের জন্য সর্ববিধ কার্যকলাপ স্থগিত রাখা উচিত। এইভাবে জিন্না একেবার কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন এবং আশা করছিলেন যে কোথা থেকে কোনোভাবে একটা কিছু ঘটে যাবে।”(১৭)
ছয় মাস নয়, অনতিবিলম্বেই সেই একটা কিছু ঘটল। তবে তা এমন ভীষণ, ভয়ঙ্কর ও বীভৎসভাবে যে দেশ-বিদেশের যাবতীয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে জিন্নার মতো মূলত মডারেট এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতাও নিশ্চয় তার স্বরূপ দেখে আতঙ্কিত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঘটনাটা হল “প্রত্যক্ষ কার্যসূচির” দিন কলকাতায় লীগ নেতৃত্ব ও বঙ্গের লীগ সরকারের কর্ণধার এবং প্রধানমন্ত্রী শহীদ সুরাবর্দীর প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ও প্রশ্রয়ে হিন্দু উৎপীড়ন ও নিধনযজ্ঞের সূত্রপাত। প্রথম তিন দিন একরকম একতরফা নিগৃহীত হবার পর হিন্দুরাও সংগঠিত হয়ে প্রতি-আক্রমণ শুরু করার পর কলকাতার বুকে দীর্ঘকালব্যাপী হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলল। এর জের বোম্বাই, করাচী, সীমান্ত প্রদেশ, নোয়াখালি ও বিহার হয়ে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ল এবং এই ঘটনার ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেকার পারস্পরিক বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেল। পরিণামে ভারত- বিভাজন অনিবার্য হয়ে পড়ল।
মনুষ্যত্বের সাময়িক পরাজয়ের অমানিশা-পর্ব কলকাতার দাঙ্গার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে পাঠকের মনকে পীড়িত করা নিষ্প্রয়োজন। তবে যে দাঙ্গায় কমপক্ষে পাঁচ হাজার (মতান্তরে দশ হাজার) নর-নারী-শিশু নিষ্ঠুরভাবে মৃত, পনের হাজার আহত এবং নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয় ও দীর্ঘকাল ব্যবসা-বাণিজ্যসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পর্যুদস্ত ও লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তি ভস্মসাৎ অথবা লুণ্ঠিত হয়, তার স্বরূপ উপলব্ধি করার জন্য তদানীন্তন ছোটলাট ব্যারোজের ঐদিনকার একটি প্রতিবেদনের অংশবিশেষই যথেষ্ট: “সকাল ৭টা থেকেই উত্তর-পূর্ব কলকাতার মানিকতলা এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে দিনের বাকি অংশে তা চলার সঙ্গে সঙ্গে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে।… অস্ত্র হিসাবে প্রধানত ইঁটের টুকরো ব্যবহৃত হয়েছিল বলে মনে হয়। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই বন্দুক ব্যবহার করেছিল এবং ছুরিকাঘাতের কয়েকটি ঘটনাও জানা গেছে।…এযাবৎ যেসব গোলযোগের খবর পাওয়া গেছে তা স্পষ্টত সাম্প্রদায়িক এবং কোনোক্রমেই ব্রিটিশ-বিরোধী নয়—আবার বলছি ব্রিটিশ-বিরোধী নয়।”(১৮) অনুগামীদের উপর নিয়ন্ত্রণবিহীন নেতাদের দায়িত্বজ্ঞানবিহীন উক্তি ও আচরণের কী পরিণাম হতে পারে কলকাতা থেকে প্রারব্ধ সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের একটানা ঘটনা তার প্রমাণ।
কলকাতার দাঙ্গা সম্বন্ধে জিন্নার প্রতিক্রিয়াও উল্লেখযোগ্য। জনৈক বিদেশি সাংবাদিকের কাছে ঐ মাসের শেষভাগে এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, “কংগ্রেসি সরকারগুলি যদি মুসলমানদের অবদমিত ও পীড়ন করা আরম্ভ করে, তাহলে গোলযোগ নিয়ন্ত্রিত করা অত্যন্ত দুরূহ হবে।…আমার মতে সোজাসুজি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।…ভারতবর্ষের যথার্থ স্বাধীনতা এবং এই উপমহাদেশের সকল অধিবাসীর কল্যাণ ও সুখের এই হল ত্বরিত পন্থা।”(১৯) যাবতীয় দায়িত্ব অপরের উপর চাপিয়ে দিয়ে তিনি “লীগ ও বঙ্গের লীগ সরকারের বদনাম করার জন্য হিন্দুদের সংগঠিত ষড়যন্ত্র বলে একে আখ্যা দিলেন এবং সবকিছুর জন্য ক্যাবিনেট মিশন, কংগ্রেস, ও গান্ধীজীর উপর দোষারোপ করলেন।”২০ জিন্না গান্ধী ছিলেন না, যিনি স্বসৃষ্ট আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠায় তার উত্তুঙ্গ অবস্থার মধ্যে প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে পারেন যে আন্দোলন শুরু করে তিনি হিমালয়- সদৃশ ভ্রান্তি করেছেন। অন্তরঙ্গ সহকর্মীদের প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও চৌরীচেরার ঘটনার পর গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন এবং তার থেকেও বড় কথা – এক গণআন্দোলন প্রত্যাহার করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে—রুচি শিক্ষা ও সংস্কারে স্বয়ং এ জাতীয় রক্তপাত এবং অন্যবিধ নিষ্ঠুর ও বর্বর ঘটনাবলীর সমর্থক না হলেও জিন্না কেন কলকাতার দাঙ্গার জন্য যথার্থ দায়ী ব্যক্তিদের প্রকাশ্যে নিন্দা করতে পারেননি? মৃত আহতদের পরিবারকে এমনকি কেবল মুসলমানদের সমবেদনা জানাতেও কলকাতা যাননি। আর কয়েক মাস পর যখন পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশে তাঁর দলের আন্দোলনের আড়ালে আইন অনুসারে গঠিত সরকার ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের উপর হিংসাত্মক ঘটনাবলীর অনুষ্ঠান হতে থাকে তখনও জিন্নার ভিতর এইভাবে সত্যের সম্মুখীন হবার শক্তির অভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর মতো প্রখর বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাছে ঐসব ঘটনার পিছনে যাঁদের গোপন হাত কাজ করছিল তা অবিদিত ছিল না। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে লীগের অসংযত, বিশৃঙ্খল অবস্থা দিয়ে কেবল এমন গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। ব্যাপারটায় পিছনে নেতৃত্বের চারিত্রধর্ম ক্রিয়াশীল বলে অনুমান হয়। অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা তাঁদের সম্ভাব্য সমর্থকদের মুখ চেয়ে, তাঁদের সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে প্রযত্ন করেন। জনতার মনোভাব দেখে তাঁরা কথা বলেন বা কাজ করেন যাতে জনসমর্থন বজায় থাকে। করতালিধ্বনি তাঁদের অস্তিত্বের আধার। লাহোরে মসজিদের বিবাদ মেটানোর প্রয়াসের দিনগুলি থেকে তিনি এর যে স্বাদ পেতে শুরু করেন ক্রমশ তা তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। কোটিতে গুটিক নেতা প্রয়োজনে জনমতবিরোধী কথা বলে জনতাকে অবাঞ্ছিত পথ থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার প্রয়াস করার সৎসাহস দেখাতে পারেন। উভয় শ্রেণীর নেতারই অস্তিত্বের ভিত্তি হল স্ব স্ব জীবন- দর্শন। এর সঙ্গে তাঁদের লক্ষ্যের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বিদ্যমান। জিন্নার লক্ষ্য কি ছিল? ইতিপূর্বে উল্লিখিত লীগের আইনসভার সদস্যদের এপ্রিলের সভায় তাঁদের সম্বোধন প্রসঙ্গে তিনি যা বলেন তার এক জায়গায় এর আভাস পাওয়া যায়:
“কীসের জন্য আমরা লড়াই করছি? আমাদের লক্ষ্য কি? ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থা অথবা রাষ্ট্র আমাদের লক্ষ্য নয়। ধর্মের ভূমিকা অবশ্যই আছে এবং ধর্ম আমাদের কাছে প্রিয়ও বটে। পার্থিব তাবৎ বস্তু আমাদের কাছে ধর্মের তুলনায় তুচ্ছ। কিন্তু এছাড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অন্য ব্যাপার আছে এবং এ হল আমাদের সামাজিক ও আর্থিক জীবন। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যতিরেকে কিভাবে আপনারা নিজ ধর্মবিশ্বাস ও আর্থিক জীবনকে রক্ষা করাতে সমর্থ হবেন?”(২১) জীবনের এই লক্ষ্য জিন্না কোনোদিনই গোপন করেননি। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে লীগের যে লখনউ অধিবেশন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পালা বদলের সূচক, সেখানেও তিনি উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন “এদেশের শাসনে অংশগ্রহণ করার আমার অধিকার যে কোনো হিন্দুর সমতুল্য”; এবং “আমাকে ক্ষমতার সমান, যথার্থ ও কার্যকরী ভাগ পেতেই হবে।”(২২)
সুতরাং প্রশ্নটা হল “রাজনৈতিক ক্ষমতার”।

২৬
পাদটীকা

১. তাঁর চিকিৎসক ডাঃ জাল প্যাটেলের মতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থাতেই জিন্না মিশনের সঙ্গে আলোচনার জন্য দিল্লি যান ও সেখানে বরাবর অসুস্থ ছিলেন। আবার ব্রঙ্কাইটিস: বারবারই ব্রঙ্কাইটিস হচ্ছিল। দশদিন যাবৎ তাঁর জ্বরও চলছিল। “সম্ভবত তাঁর ফুসফুসের অসুখ একটানাই ছিল: তিনি সম্পূর্ণ অবসন্ন, দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।” হেক্টর বলিথো; সমগ্রন্থ; ১৬০-১৬১ পৃষ্ঠা।
২. ঐ সভায় পক্ষে ২০৪ ও বিপক্ষে ৫১ ভোটে প্রস্তাব গৃহীত হয়। গান্ধীজীও কংগ্রেস নেতাদের বিশেষ আগ্রহে ঐ সভায় নিজ বক্তব্য পেশ করেন। এ প্রসঙ্গে ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য জেনে রাখা দরকার। পরিকল্পনাটি চার দিন ধরে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার পর ১৯শে মে তিনি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুত করা সর্বশ্রেষ্ঠ দস্তাবেজ।”(CWMG); ৮৪ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৯)। তবে গান্ধীজীর ঐ বক্তব্যে সতর্ক পদক্ষেপের ছাপ সুস্পষ্ট এবং বক্তব্যের এক স্থলে তিনি মন্তব্য করেন যে যা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ, তা ভারতের পক্ষে অনুরূপ নাও হতে পারে। এছাড়া পরিকল্পনায় প্রদেশ-গোষ্ঠী গঠন করা যে বাধ্যতামূলক নয়, এই মর্মে মন্তব্য করার সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে পরিকল্পনার ১৫(৫) ও ১৯ সংখ্যাক ধারার মধ্যে অসঙ্গতির প্রতিও তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বিশেষ করে আসামের বাংলার সঙ্গে বাধ্যতামূলক ভাবে গোষ্ঠীভুক্ত হবার বিরোধী দাবির প্রকাশ্য সমর্থন করেন। আসামের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের প্রভাবের কারণে এটা ঘটে। বরদলৈ-এর বিরোধিতার কারণ অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশকে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার অযৌক্তিকতা তো ছিলই। এর উপর একটি প্রকাশ্য কারণ ছিল। এযাবৎ আসামের বিধানসভায় নানারকমের রক্ষাকবচের জন্য জনসংখ্যার তুলনায় প্রতিনিধির সংখ্যা আনুপাতিকভাবে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু মিশনের পরিকল্পনায় গণপরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব নির্ধারিত হওয়ায় প্রস্তাবিত প্রদেশ-গোষ্ঠীর ৭০টি আসনের মধ্যে আসামের ভাগে পড়েছিল মোট ১০টি মাত্র। বিরোধিতায় একটি অপ্রকাশ্য কারণ অসমীয়া সমাজের দীর্ঘদিনের বাঙালি- প্রভাব-ভীতিও হওয়া সম্ভব।
৩. ইতিমধ্যে গণপরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেছে এবং লীগ মোট ৭৬টি মুসলমান আসনের মধ্যে (বেলুচিস্তানের একটি এবং বঙ্গের নির্দলীয় হিসাবে নির্বাচিত হবার পর লীগে যোগদানকারী একজনসহ) ৭৫টি আসন পেলেও কংগ্রেসের সদস্যসংখ্যা কালার ২০৮ জন ছিল। দ্রষ্টব্য: (Constituent Assembly); পি. আর. লেলে; ফিনিক্স কি পাবলিকেশান, বোম্বাই; ৪৯ পৃষ্ঠা।
৪. ভারতের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতি পরায়ন মার্কিন সাংবাদিক লুই ফিশার ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন শেষে জওহরলালের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে তাঁর দৃষ্টি মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করে কংগ্রেসের পূর্বতন সিদ্ধান্ত ও তাঁর তখনকার বক্তব্যর মধ্যে বিরোধের প্রতি আকর্ষণ করলে “তিনি স্মিতহাস্যে বলেন, ‘আমি এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন।”(আজাদের গ্রন্থের আমেরিকান সংস্করণের ভূমিকা; লংম্যানস গ্রীণ; নিউইয়র্ক, ১৯৬০)। সাংবাদিকদের কাছে নেহরুর ঐ বিবৃতির প্রতিক্রিয়া কংগ্রেসের অপর এক প্রথম সারির নেতা প্যাটেল তাঁর “লৌহ মানব” সদৃশ ভাষায় ব্যক্ত করেন। জিন্না কর্তৃক ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের সংবাদ প্রচারিত হবার দিন (২৯শে জুলাই) “কেন্দ্রীয় প্রদেশের” কংগ্রেস নেতা “দ্বারকাপ্রসাদ মিশ্রের কাছে এক পত্রে তিনি লেখেন যে জওহরলাল, “তাঁর শিশুসুলভ হাবাগোবা ভাবের জন্য হঠাৎ আমাদের সবাইকে প্রচণ্ড অসুবিধায় ফেলেন।…তাঁর আবেগতাড়িত কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকর্মের তাল সামলাতে আমাদের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। সাধ্যাতিরিক্ত কাজ ও তজ্জনিত চাপের জন্য তাঁর মন একেবারেই পরিশ্রান্ত। তিনি নিঃসঙ্গ বোধ করেন ও ভাবাবেগের দ্বারা চালিত হয়ে কাজ করেন এবং এই পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকে তাঁর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। মাঝে মাঝে কোনো প্রতিবাদের সম্মুখীন হলেই তিনি যেন পাগল হয়ে যান, কারণ তিনি অধৈর্য স্বভাবের।” জওহরলালের জীবনীকার ড. গোপাল অবশ্য তাঁর ঐ সাংবাদিক সম্মেলনের বিবৃতিকে কংগ্রেসের নীতির যথাযথ প্রতিফলন হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং আজাদের গ্রন্থের সংশ্লিষ্ট অংশ নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে নেহরুর ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারির এক বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়েছেন—“এ কি হল সে সময়ে ক্রিয়ারত ঐতিহাসিক শক্তিসমূহের বদলে একান্তভাবে ব্যক্তিগতভাবে চিন্তার নিদর্শন।” সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৩২৮।
৫. ইতিমধ্যে পার্লামেন্টে মিশনের প্রস্তাবের সরকারি ব্যাখ্যা দেওয়া সত্ত্বেও জওহরলাল দিল্লিতে ২২শে জুলাই এক জনসভায় আবার মিশনের প্রস্তাব সম্বন্ধে নিজের ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেন এবং স্বভাবতই লীগের ১৯শে জুলাই-এর প্রস্তাব গ্রহণের পক্ষে এই ঘটনাও প্ররোচনায় এক কারণ হয়।
৬. সমগ্রন্থ; (১৯৮৮ সংস্করণ) ১৬৪-১৬৭ পৃষ্ঠা।
৭. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৪০৭-৪১১ থেকে উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৮০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৮. পীরজাদা; Foundations of Pakistsn; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৫৪৬-৫৪৯ থেকে কাউলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৮১ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৯. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ২৮১ পৃষ্ঠা।
১০. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড, ccxxix পৃষ্ঠা।
১১. পীরজাদা; Foudations of Pakistan; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৫৬০। উলপার্ট কর্তৃক জ তাঁর গ্রন্থের ২৮২-২৮৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। এই অংশের রূপকশোভিত শেষ বাক্যটি অর্থাৎ “আমাদেরও এখন পিস্তল আছে”–অনেক সময়ে জিন্নার সমালোচকরা পূর্বাপর সম্বন্ধ ছাড়াই উদ্ধৃত করে তাঁর সম্বন্ধে ভুল ধারণা সৃষ্টির কারণ হন বলে এই উদ্ধৃতিটির সবিশেষ গুরুত্ব বিদ্যমান।
১২. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ২৮৩ পৃষ্ঠা।
১৩. প্যারেলাল; Last Phase; প্রথম খণ্ড; প্রথম অংশ, ২৪০ পৃষ্ঠা।
১৪. সমগ্রন্থ; ২৪০-২৪১ পৃষ্ঠা।
১৫. জিন্না নিজের ধারা অনুসরণ করে চলেছেন: “আটচল্লিশ ঘণ্টা পূর্বে জিন্না মুসলমানদের শান্ত থাকার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন; ‘প্রত্যক্ষ কার্যসূচি’ দিবস শান্তিপূর্ণভাবে বিচার-বিবেচনার দিন, ‘কোন আকার বা প্রকারে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হবার দিন’ কোনোক্রমেই নয়।” ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২১৬। বন্ধনীর রুমী অন্তর্ভুক্ত জিন্নার উক্তি চৌধুরী মহম্মদ আলীর The Emergence of Pakistan (লাহোর, ১৯৭৩) গ্রন্থের ৭৫ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত।
১৬. নেহরুর সুস্পষ্ট প্রস্তাব ছিল ক্যাবিনেট মিশনের অনুসরণে ১৪ জনের মন্ত্রীমণ্ডলে লীগ ও কংগ্রেসের ৫টি করে আসন এবং কংগ্রেসের ৫ জনের মধ্যে একজন পুরী জাতীয়তাবাদী মুসলমান গ্রহণ। ওয়াভেলকে লেখা নেহরুর ১৮ই আগস্টের চিঠি। মেTি.P.; অষ্টম খণ্ড; ২৪৮ পৃষ্ঠা।
১৭. ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; ২১৫ পৃষ্ঠা।
১৮. ওয়াভেলকে পাঠানো তারবার্তা। T.P.; অষ্টম খণ্ড; পৃষ্ঠা ২৩৯।
১৯. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ, দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৪৩৩ থেকে উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৮৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২০. প্যারেলাল; Last Phase; প্রথম খণ্ড, প্রথম অংশ; ২৪৫ পৃষ্ঠা।
২১. পীরজাদা (সম্পাদিত); Foundation of Pakistan; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৫২৩। মঈন শকীর কর্তৃক তাঁর Jinnah and Muslim Separatist Startegy প্রবন্ধে Role of Minorities in Freedom Struggle; অজান্তা; নূতন দিল্লি (১৯৮৬); পৃষ্ঠা ৩৭) উদ্ধৃত।
২২. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা ১৮৪।

পৃষ্ঠা: ২৩৫

অন্তর্বর্তী সরকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অগ্নি প্রশমনে অক্ষম
২৭

একটি প্রবাদ আছে যে মানুষ যখন নীচের দিকে পড়া শুরু করে তখন তার শেষ গন্তব্যস্থল হল একেবারে শেষতলা। রাজনৈতিক ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষাচালিত জিন্নার পরবর্তী কার্যকলাপ এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসের ভবিষ্যৎ-গতি ঐ প্রবাদবাক্যের অন্তর্নিহিত সত্যের দ্যোতক।
২৪শে আগস্ট বড়লাট ঘোষণা করলেন যে নেহরুর নেতৃত্বে ১৪ জনের অন্তর্বর্তী সরকার পরবর্তী মাসের গোড়ার দিকে কার্যভার গ্রহণ করবে। এর প্রতিবাদে জিন্না মন্তব্য করলেন যে বড়লাট “মুসলিম লীগ ও মুসলিম ভারতকে এক প্রবল আঘাত করেছেন। তবে আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে ভারতবর্ষের মুসলমানরা এ আঘাতকে বীরোচিত সহিষ্ণুতা ও সাহস সহকারে সহ্য করবেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারে আমাদের ন্যায়সঙ্গত ও সম্মানজনক স্থান পেতে ব্যর্থ হবার ঘটনা থেকে শিক্ষাগ্রহণে সমর্থ হবেন।…আমি এখনও মনে করি যে বড়লাট যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা অতীব অবিজ্ঞোচিত ও রাজনৈতিক বুদ্ধির অনুপযুক্ত। এর পরিণাম বিপজ্জনক ও গুরুতর হবার সম্ভাবনা। অন্তর্বর্তী সরকারে এমন তিনজন মুসলমান সদস্য বড়লাট মনোনয়ন করেছেন যাঁরা মুসলিম ভারতের শ্রদ্ধা ও আস্থাভাজন নন—একথা তিনি স্বয়ং জানেন। এ ব্যাপারটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবার মতো।”(১) এর দিনকয়েক পরই প্রস্তাবিত মন্ত্রীসভার জনৈক সদস্য স্যার শাফৎ আহমদ খাঁকে সিমলায় লীগের দুজন উগ্রপন্থী যুবক নিষ্ঠুরভাবে (সাতবার) ছুরিকাঘাত করার পর মৃতজ্ঞানে পরিত্যাগ করে। রফি আহমদ কিদওয়াই-এর ভ্রাতা সংযুক্ত প্রদেশের মন্ত্রী শফি আহমদকে মুসৌরীতে হত্যা করা হয়।
দোসরা সেপ্টেম্বর জওহরলাল ও তাঁর চারজন সহকর্মী অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। কিন্তু লীগ ও তার সমর্থকরা কৃষ্ণবর্ণ পতাকা উত্তোলন করে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানালেন। এর প্রতিক্রিয়া বৃহত্তর মুসলিম সমাজে দেখা দিল। প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিন্দু সমাজেও। সব মিলিয়ে ভারতবর্ষের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। মাঝে মাঝে চাপা উত্তেজনা অগ্নিস্ফুলিঙ্গরূপে ফুটে উঠছে বোম্বাই করাচী প্রভৃতি নানা শহরের বিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। ওয়াভেল তখন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে লীগকে দায়িত্বশীল করার জন্য মন্ত্রীসভায় আনা দরকার। সম্ভবত কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের উচ্চপদস্থ লীগহিতৈষীরা ভেবেছিলেন যে তাঁদের আশ্রিত লীগ অন্তর্বর্তী সরকারের বাইরে থেকে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে এবং তাই তাঁরা যে-কোনো মূল্যে লীগকে সরকারের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াসী ছিলেন। একই উদ্দেশ্যচালিত হয়ে ওয়াভেল কংগ্রেসের দাবি সত্ত্বেও অবিলম্বে গণপরিষদ আহ্বান করছিলেন না, যাতে লীগকে তাতে যোগদান করতে রাজী করানো যায়। ভারতসচিব বড়লাটকে পরামর্শ দিলেন যে গণপরিষদ আহ্বানকে বিলম্বিত করে যেন কংগ্রেসের সঙ্গে বিবাদ না করা হয়। এই সময়ে জনৈক বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে জিন্না তাঁর ক্ষোভ ও হতাশাকে ব্যক্ত করে বলেন, “আঘাত অত্যন্ত গভীর এবং আলাপ-আলোচনা প্রসঙ্গে আমাদের প্রতি এই পরিমাণ তিক্ততা ও বিদ্বেষ প্রদর্শন করা হয়েছে যে এই বাদ- বিবাদকে আরও দীর্ঘায়ত করার উৎসাহ আমাদের নেই।…আমার পক্ষের ওকালতি আমি কখনো করব না।… ব্রিটিশ সরকার যদি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তাঁদেরকে বেয়নেট দ্বারা সমর্থন ছাড়া আর কিছু না করেন, তাহলে আমি কেবল এইটুকুই বলতে পারি যে মুসলমানরা তা সহ্য করতে পারবে। তাঁরা যদি আমাকে এখন গ্রেপ্তার করতে চান তবে আমি অবিলম্বে জেলে যেতে রাজী আছি।”(২)
জিন্না কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার সিংহদ্বার থেকে প্রত্যাবর্তন করতেই বাধ্য হননি, যে ধরণের অর্থাৎ আইনসভার বক্তৃতা ও আলাপ-আলোচনার রাজনীতিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন তার সুযোগে বঞ্চিত হয়ে বাধ্যতামূলকভাবে যবনিকার অন্তরালে নির্বাসিত, সুতরাং পাদপ্রদীপের আলোকের সামনে আসার জন্য তাঁর এই মরীয়া হয়ে প্রয়াস — হয় আলাপ- আলোচনা, নচেৎ কারাবরণের বাসনা। রঙ্গমঞ্চের সম্মুখভাগে আসার এই অভিনেতাসুলভ কামনা সব রাজনৈতিক নেতার ভিতরই অল্পবিস্তর বিদ্যমান। আর পাঠক স্মরণ করবেন যে জিন্না শব্দার্থেও প্রথম সারির অভিনেতা, পিতার অনিচ্ছার কারণে যিনি পেশাদার অভিনেতার জীবন গ্রহণ করা থেকে বিরত হয়েছিলেন।
জিন্নার রাজনৈতিক জীবনেও তখন গভীর সঙ্কট। প্রস্তাবিত পাকিস্তানের প্রদেশগুলির মধ্যে কেবল সিন্ধু ও বঙ্গেই নূতন সাধারণ নির্বাচনের পর লীগ মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হয়েছিল। কিন্তু লীগ সংগঠন ও নেতৃত্বের দুর্বলতার জন্য সিন্ধুর গোলাম হোসেন মন্ত্রীসভার টলমল অবস্থা। বিধানসভায় সরকার ও বিরোধী দলের সংখ্যা সমান সমান। সুতরাং জি.এম.সৈয়দের গোষ্ঠীর কংগ্রেস ও নির্দলীয় সদস্যদের সহায়তায় গোলাম হোসেনের পরিবর্তে মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। জিন্নাকে কোণঠাসা করার জন্য কংগ্রেস ঐ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে কার্পণ্য করবে না—এ সত্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট ছিল। সৈয়দের গোষ্ঠী ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবিত প্রদেশ-গোষ্ঠী গঠনেরও প্রকাশ্য বিরোধী ছিল। ঐ অবস্থায় সিন্ধুর ছোটলাট স্যার ফ্রান্সিস মুডি লীগের ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিলেন। সৈয়দগোষ্ঠীকে কংগ্রেসের সহায়তায় ক্ষমতা নিতে দেবার বদলে মুডি বিধানসভা ভঙ্গ করে নূতন নির্বাচনের সুপারিশ করলেন এবং লীগকেই অস্থায়ী সরকারের দায়িত্ব দিলেন। স্বভাবতই নূতন নির্বাচনে লীগের কপাল ফিরে গেল এবং পূর্বেই (পাদটীকা সংখ্যা ৯, অধ্যায় সংখ্যা ২৪) বলা হয়েছে যে খলিকুজ্জমাঁ এর জন্য মুডির কাছে অজস্র কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। লীগের দ্বিতীয় দুর্গ বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দীর সঙ্গে জিন্নার সম্বন্ধ কোনোকালেই হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল না। প্রত্যক্ষ সংগ্রামকে উপলক্ষ করে সুরাবর্দীর প্রশ্রয়ে তাঁর আশ্রিত সমাজবিরোধী ব্যক্তিরা হিন্দু-নিধন-যজ্ঞে রত হলেও অনতিবিলম্বেই ঐ পদক্ষেপ ব্যুমেরাং হয়ে তাঁর ক্ষমতার উৎসকেই আঘাত করে। ফলে নিজের অবস্থা সম্বন্ধে সুরাবর্দী বিচলিত হয়ে পড়েন। সুতরাং ৬ই সেপ্টেম্বর তিনি জিন্নার কাছে অনুরোধ জানান যে তাঁকে যেন বাংলার কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশান সরকার গড়ার জন্য আলোচনা শুরু করার অনুমতি দেওয়া হয়। জিন্না ইতিপূর্বে কেন্দ্রসহ মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশসমূহেও কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গড়ার কর্মসূচির প্রবক্তা ছিলেন। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে অন্য প্রদেশে তো দূরের কথা, কেন্দ্রেও তিনি ক্ষমতাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত এবং মাত্র কয়েকদিন পূর্বে কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকারের কর্ণধার হয়েছে, সুতরাং তিনি সুরাবর্দীর প্রস্তাব এই বলে সরাসরি অগ্রাহ্য করলেন যে কেন্দ্রে লীগ ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত এ প্রশ্ন ওঠে না। (৩)
১৬ই সেপ্টেম্বর থেকে আরম্ভ করে দোসরা অক্টোবর জিন্নার সঙ্গে দফায় দফায় দীর্ঘ আলোচনা করার পর বড়লাট লীগকে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে রাজী করালেন। জিন্নার এই সময়কার ভূমিকা বর্ণনা প্রসঙ্গে আয়েষা জালাল বলেছেন, “গভীর রাজনৈতিক বিপর্যয়, প্রবল দুর্বিপাক এবং বিরামহীন নিষ্পেষণের খেলার সম্মুখীন হবার পরও জিন্না যে উল্লেখযোগ্য স্থিতিস্থাপকতার পরিচয় দিতেন তার অন্যতম রহস্য হল – যখন সাধারণ মানুষের মনে হবে যে সর্বনাশ হয়ে গেছে তখনও লড়াই চালিয়ে যাবার তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা। সুতরাং অতঃপর তিনি ঘোষণা করলেন যে, ‘স্লেটকে পরিষ্কার করে মুছে ফেলতে হবে এবং গোড়া থেকে আরম্ভ করতে হবে।’ লন্ডনে গিয়ে তিনি ‘অন্যান্য পক্ষের সঙ্গে সমান ভিত্তি’তে আলোচনা করতে প্রস্তুত। যে অচলাবস্থা আরও জটিল হয়ে উঠছিল তার সমাধানের জন্য এই প্রথমবার জিন্না প্রকাশ্যে নিজের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করলেন। জিন্না দেখিয়ে দিলেন যে কংগ্রেস কিছুটা দিতে রাজী হলে তিনি আরও বেশি দিতে প্রস্তুত এবং ‘তাঁর বর্তমান দাবির থেকে কম নিয়ে’ তিনি পিছনের দিকে ঝুঁকে যাবেন— ‘বিশেষত যখন কংগ্রেসের লক্ষ্য মনে হয় নিজের ক্ষমতা সংহত করা ও লীগকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা। তবে কংগ্রেসকে নড়ানো গেল না, কারণ ওয়াভেলের মতে সে দল তখন ‘ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে এবং দলের হাইকম্যান্ড ‘সে ক্ষমতার ভাগ আর কাউকে দিতে চায় না’। পক্ষান্তরে ওয়াভেলের মতে জিন্না (অস্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন ভারতীয় ও ব্রিটিশ লেখকদের মতে পিশাচসিদ্ধ অপদেবতা এবং পাকিস্তানের সন্ত উপাখ্যান রচয়িতাদের মতে বিজয়ী বীর) তখন অত্যন্ত শান্ত ও যুক্তিনিষ্ঠ এবং মর্যাদা জলাঞ্জলি না দিয়ে যদি সম্ভব হয় তবে একটা বোঝাপড়ার উপনীত হতে আগ্রহী।’ ওয়াভেলের মতে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে জিন্নার ‘প্রধান বক্তব্য’ হল ‘তাঁর ওয়ার্কিং কমিটিকে বোঝাবার মতো এমন কিছু চাই যে সব ব্যাপারে তিনি পরাজিত হন নি এবং কংগ্রেসের বশংবদ হিসাবে তিনি সরকারে যোগদান করছেন না।(৪) লীগকে অন্তর্বর্তী সরকারে আনার জন্য বড়লাটের আগ্রহের অপর একটি ভাষ্য হল গোড়ায় এর মাধ্যমে লীগকে দায়িত্বশীল করা ওয়াভেলের উদ্দেশ্য হলেও ইতিমধ্যে জওহরলাল ও প্যাটেলের সঙ্গে নানা উপলক্ষে তাঁর সংঘর্ষের জন্য ও মন্ত্রীমণ্ডলে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী খাড়া করার জন্য লীগের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনি ইচ্ছুক ছিলেন। ওয়াভেলের পরামর্শদাতা উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীরাও গতকাল পর্যন্ত যাঁরা বিদ্রোহী ছিলেন, সেই সব কংগ্রেসি নেতাদের অধীনে কাজ করতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তাঁরা বরং লীগ নেতাদের সঙ্গে কাজ করা অধিকতর অনুকূল মনে করতেন।(৫) তাঁদের দ্বারা ওয়াভেলের প্রভাবিত হবার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। কংগ্রেসের চাপে ওয়াভেল ৯ই ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম সভা আহ্বানের জন্য আপাতত রাজী হয়েছিলেন। এই সময়ে ওয়াভেলের ধারণা হয়েছিল যে গান্ধীসহ কংগ্রেসের তাবৎ নেতারা লীগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে ভোগ করতে ইচ্ছুক নয় এবং তাঁরা চাপ দিয়ে লীগকে গণপরিষদে আনতে চান। কংগ্রেসের নেতৃবর্গও ভারতসচিব ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে বড়লাটের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে দাবি জানিয়েছিলেন যে ওয়াভেলের বদলে আর কাউকে যেন বড়লাট করে পাঠানো হয়।
“তাঁকে স্বমতে আনার জন্য ওয়াভেলের আকুলতা অথবা অন্তর্বর্তী সরকারের তরণীতে ঠাঁই লাভে বঞ্চিত হওয়ার ফলে নেহরু আপাতদৃষ্টিতে যে পরিমাণ ক্ষমতা ও আড়ম্বর ভোগ করছিলেন তজ্জনিত জিন্নার তদানীন্তন হতাশার কারণেই হোক, অক্টোবরের সেই আলাপ-আলোচনা দ্রুত সেই উদেশ্য সাধন করল যা বছরের গোড়ার দিকে ক্যাবিনেট মিশনের তিন মাসের প্রয়াস সত্ত্বেও অলভ্য রয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত কলকাতার বিরাট নরমেধযজ্ঞ, বোম্বাই-এর রক্তাক্ত দাঙ্গা অথবা তাঁর কাউন্সিলের ধৈর্য্যচুতি কিংবা তাঁর নিজের ক্ষীয়মাণ স্বাস্থ্যজনিত বিয়োগান্তক প্রশান্ত বাস্তব অবস্থা জিন্নাকে রেকর্ড ভঙ্গকারী মাত্র দু’সপ্তাহের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে লীগকে কংগ্রেসের সঙ্গে এক অন্তর্বর্তী কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেবার ব্যাপারে একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হতে নমনীয় হবার চেয়েও অধিক অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। নেহরু ও কংগ্রেস না তাঁকে গললগ্ন করেছিলেন আর না তাঁর অহমিকার কথা চিন্তা করেছিলেন। পুরাতন প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঐরকম নেতিবাচক ইঙ্গিত জিন্নার মনে সম্ভবত এই ধারণার সৃষ্টি করেছিল যে অতঃপর আর দেরি না করে যতক্ষণ ধরার মতো একগাছা কাছি আছে এবং জাহাজের কর্তা তাঁকে এমন হৃদ্যতাসহকারে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত, তখন অতিরিক্ত মালপত্র ফেলে দিয়ে নৌযানে উঠে পড়াই বাঞ্ছনীয়।”(৬)
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরূপ এবং লীগের প্রতিনিধিদের কোন্ কোন্ দপ্তর দেওয়া হবে এ নিয়েও নেহরু, জিন্না ও বড়লাটের মধ্যে আরও কিছুদিন আলাপ-আলোচনা ও পত্র- বিনিময় হয়েছিল। অন্তত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হিসাবে লীগ প্রথমে স্বরাষ্ট্র দপ্তর চেয়েছিল। ঐ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্যাটেল দপ্তর ছাড়ার পরিবর্তে বরং পদত্যাগ করতে প্রস্তুত হন। ফলে কংগ্রেসের সম্মতিক্রমেই লীগের নেতা লিয়াকৎকে তাঁদের মতে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ অর্থদপ্তর দেওয়া হয়। অথচ প্রশাসনে অর্থদপ্তরের গুরুত্ব অপরিসীম। ঐ দপ্তরের অনুমোদন ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রক একেবারে শব্দার্থে একটি পয়সাও খরচ করতে পারে না। অর্থবিভাগের প্রবীণ অফিসার চৌধুরী মহম্মদ আলী এবং আরও কয়েকজন পদস্থ ঝানু মুসলিম আমলার পরামর্শে লিয়াকত আলী খাঁ কংগ্রেসি সদস্যদের প্রস্তাবে প্রতি পদে এমন বাধা সৃষ্টি করতে থাকেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজকর্ম অচল হবার উপক্রম হবার সঙ্গে সঙ্গে প্যাটেলের মতো কূটবুদ্ধিসম্পন্ন নেতাও নাজেহাল হয়ে যে-কোন মূল্যে লীগ প্রতিনিধিদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে মনে মনে প্রস্তুত হন। মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে সর্বাগ্রে প্যাটেলকে ভারতবিভাগে সম্মত করার পিছনে লিয়াকতের দ্বারা অর্থদপ্তরের পরিচালনার তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁর মনে ক্রিয়াশীল ছিল।
অবশেষে লীগ প্রতিনিধিরা “বড়লাটের অনুরোধে” (শাসনপরিষদের সহসভাপতি এবং কোয়ালিশনের নেতা জওহরলালের আমন্ত্রণে নয়) ২৬শে অক্টোবর শাসন পরিষদের সদস্যরূপে শপথ গ্রহণ করলেন। জিন্না স্বয়ং লীগের প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন না। সে দলে ছিলেন নেতা লিয়াকত‍ আলী খাঁ ছাড়া চুন্দ্রীগড়, আবদুর রব নিস্তার, গজনফর আলী খাঁ ছাড়া কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী মুসলমান প্রতিনিধির জবাব—তপশিলী হিন্দুসম্প্রদায়ের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। জিন্না কর্তৃক শ্রীযুক্ত মণ্ডলকে অন্যতম লীগ প্রতিনিধি করায় দেশবাসীর সঙ্গে সঙ্গে বহু লীগ নেতাও হতবাক হয়ে যান। নবাব ইসমাইল খাঁ এর ব্যর্থ বিরোধ করেন। খলিখুজ্জমাঁ প্রশ্ন তোলেন, দ্বিজাতি তত্ত্বের সঙ্গে এটা কি করে খাপ খায়?
জওহরলাল জিন্নাকে লিখেছিলেন যে, “সমগ্র ভারতবর্ষের তরফ থেকে এক সংযুক্তদল হিসাবে কাজ করার জন্য আমরা তাই লীগের অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাব।”(৭) কিন্তু উভয়পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাবের জন্য অবস্থা কিরকম দাঁড়াবে তার সূচনা লীগ প্রতিনিধিরা শাসনপরিষদে যোগ দেবার পূর্বেই পাওয়া গিয়েছিল। তাঁদের অন্তর্বর্তী সরকারের যোগদানের উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে লিয়াক‍ ২০শে অক্টোবর করাচীর এক জনসভায় বলেন যে, “কংগ্রেস মনে মনে লীগের যোগদানের বিরোধী” এবং তাই মুসলমানদের নিজ প্রয়াস বিন্দুমাত্র শিথিল করা চলবে না এবং পূর্বের মতোই মুসলমানদের নিজেদের চূড়ান্ত লক্ষ্য— পাকিস্তান প্রাপ্তির প্রস্তুতির জন্য লড়াই করতে হবে।(৮) শাসন পরিষদে যোগদানের জন্য মনোনীত অন্যতম সদস্য রাজা গজনফর আলী খাঁও অনুরূপ মনোভাবের পরিচয় দিলেন। লাহোরে ছাত্রদের সম্বোধন করে তিনি বললেন যে তাঁর লক্ষ্য হল, “আমাদের বাঞ্ছিত আদর্শ পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করার উদ্দেশ্যে পা রাখার মতো একটু জমি পাওয়া।… অন্তর্বর্তী সরকার হল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অন্যতম ফ্রন্ট।”(৯) সরকারের সদস্য হিসাবে শপথ গ্রহণ করার কয়েকদিন পূর্বে (১৯শে অক্টোবর) ভারতব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সমর্থনে তিনি আরও বললেন, “কেন্দ্রে কেবল কংগ্রেসিদের সরকার গঠিত হবার পর দেশের অনেক এলাকায় যেসব গোলযোগ ঘটেছে তা এই কথা সপ্রমাণ করে যে তাঁদের যথার্থ প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত না করলে ভারতের দশ কোটি মুসলমান কোনো সরকারের কাছে নতিস্বীকার করবে না।”(১০) আমেরিকায় প্রেরিত জিন্নার “ব্যক্তিগত প্রতিনিধি” বাংলার লীগ-নেতা ইস্পাহানীও অনুরূপ প্রকাশ্য মন্তব্য করলেন।
শাসন পরিষদে লীগ প্রতিনিধিরা কোয়ালিশনের সদস্য হিসাবে তার নেতা নেহরুর নেতৃত্বে যৌথ দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করলেন এবং স্বাভাবিক প্রশাসন পরিচালনার পথে পদে পদে সমস্যা সৃষ্টি করতে লাগলেন। তাঁরা বড়লাটের আমন্ত্রণে শাসনপরিষদে যোগ দিয়েছেন বলে তাঁদের আনুগত্য কেবল তাঁরই কাছে, কোয়ালিশনের নেতা নেহরুর প্রতি তাঁদের কোনো দায়িত্ব নেই—এই হল তাঁদের ভূমিকা। এমনকি নেহরুকে কোয়ালিশনের নেতা হিসাবে স্বীকার করতেও লীগ প্রস্তুত ছিল না এবং জিন্না বড়লাটের কাছে অন্তবর্তী সরকারে নেহরুর সভাপতি পদ সম্বন্ধেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া জিন্না লীগ প্রতিনিধিদের সরকারীভাবে মুসলিম স্বার্থের প্রহরী” হবার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে তাঁরা তদনুরূপ আচরণ করতে লাগলেন। প্রত্যুত সরকার সাম্প্রদায়িক বিবাদের আখড়া এবং সচিবালয় এক পক্ষের অপর পক্ষকে নাস্তানাবুদ করার গোপন ষড়যন্ত্র এবং কার্যকলাপের কেন্দ্র হয়ে উঠল। লীগের প্রতিনিধিদের অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান সব মিলিয়ে ভারত বিভাগের পথকে প্রশস্ত করল। তাছাড়া লীগ গণপরিষদে অংশগ্রহণ করতে অথবা কংগ্রেসের দাবি এবং বড়লাটের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও ১৬ই মে-র ঘোষণাকে নাকচ করে যে প্রস্তাব ইতিপূর্বে নিয়েছিল তা সংশোধন করতে রাজী হল না। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান করার তা ছিল অপরিহার্য শর্ত।
ইতিপূর্বে ১০ই অক্টোবর ভারতবর্ষ তথা বাংলার অগ্নিকোণে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল ক্রমশ তা দাবানলের রূপ পরিগ্রহ করে সমস্ত দেশকে ছারখার করার আয়োজন করেছিল। অসংখ্য নদী-নালায় সিঞ্চিত, নারিকেল-সুপারির ছায়াঘেরা নোয়াখালির (হিন্দুদের জনসংখ্যা শতকরা ১২ ভাগেরও কম, বাকি মুসলমান) হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলমান সমাজবিরোধীদের যে ব্যাপক আক্রমণ হয় তার খবর বঙ্গের লীগ সরকার পুরো এক সপ্তাহ প্রকাশিত হতে দেয়নি। নোয়াখালি, সন্দীপ ও ত্রিপুরার চর অঞ্চলের প্রায় ৫০০
পৃষ্ঠা: ২৪০

বর্গমাইল বিস্তীর্ণ এলাকায় লীগ সমর্থক সমাজবিরোধীদের নেতৃত্বে “কলকাতার প্রতিশোধ” নেবার জন্য প্রায় পনের দিন যাবৎ হিন্দুদের বাড়ি-ঘর-সম্পত্তির ব্যাপক লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সঙ্গে (ঐ পরিস্থিতিতে সঠিক সংখ্যা পাওয়া কঠিন) সহস্রাধিক নর- নারী-শিশু ক্ষমতাদ্বন্দ্বের শিকার হিসাবে ভবলীলা সাঙ্গ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু হত্যার চেয়েও বীভৎস ব্যাপার ছিল হিন্দু নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠনের এবং তাদের জোর করে মুসলমানদের সঙ্গে বিবাহ দেবার বহু ঘটনা। আর ছিল জবরদস্তি, হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করানোর অজস্র উদাহরণ। হাজার হাজার হিন্দু ঐ অঞ্চলে কেবল উদ্বাস্তুই হননি, যে মুসলমানদের পাশাপাশি তাঁরা শত শত বৎসর যাবৎ বাস করে এসেছেন, এইসব বীভৎস ও জঘন্য ঘটনায় তাঁদের সঙ্গে প্রতিবেশীসুলভ বিশ্বাস ও নির্ভরতার সম্বন্ধই লোপ পাবার উপক্রম হয়। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে (২৫শে অক্টোবর) “নোয়াখালির প্রতিশোধে” বিহারের ছাপরায় যে মুসলমানবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্ফুলিঙ্গ দেখা দেয়, ক্রমে ক্রমে তা দাবানলের মতো পাটনা, মুঙ্গের, ভাগলপুর ও সাঁওতাল পরগণা প্রমুখ জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বিহারে নিরীহ মুসলমান নর-নারী ও শিশুদের নোয়াখালির হিন্দুদের মতোই নিষ্ঠুর ও অমানবীয় অত্যাচার, অপমান ও উৎপীড়নের শিকার হতে হয়।
নোয়াখালির পটভূমিকার মতো বিহারেও প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং শাসকদলের একাংশের ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় প্ররোচনা দানের নিদর্শন পাওয়া যায়। অবশ্য জওহরলাল (বিহারে গিয়ে দাঙ্গাকারীদের উপর বিমান থেকে বোমা বর্ষণের শাসানী) সহ কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা বিহার সরকারকে দাঙ্গা দমনে সক্রিয় হতে প্রভাবিত করেন। অতঃপর গড়মুক্তেশ্বর, পাঞ্জাব বোম্বাই—প্রায় সমগ্র দেশেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দাবানল ছড়িয়ে পড়ে ভারত বিভাজনকে অনিবার্য করে তোলে। দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস ও লীগের নেতারা যখন দিল্লিতে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত, তখন শ্মশানে শিবের মতো গান্ধীর বিচরণ (২৭শে অক্টোবর তিনি নোয়াখালি যাত্রার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন) ও মানুষের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার প্রয়াস ভারতীয় উপমহাদেশের সেই ঘনকৃষ্ণ তমিস্রার পর্বে একমাত্র আলোকবর্তিতা ছিল।
জিন্নাও অবশ্য বিহারের দাঙ্গার পর (১২ই নভেম্বর) এক বিবৃতি প্রসঙ্গে হিন্দুদের দ্বারা ঠাণ্ডা মাথায় মুসলমানদের জবাই করার জন্য দুঃখ ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে বলেন, “…পাকিস্তানে মুসলমানদের মতোই—না, তাঁদের চেয়েও বেশি করে সংখ্যালঘুদের জীবন সম্পত্তি এবং সম্মানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। মুসলমানরা যদি তাঁদের চিত্তের স্থৈর্য হারান ও প্রতিশোধবৃত্তির পরিচয় দেন এবং এইভাবে আমাদের মহান ইসলাম ধর্মের শিক্ষা ও সুউচ্চ নৈতিক আচারবিধির অনুপযুক্ত প্রতিপন্ন হন তাহলে আপনারা কেবল নিজেদের পাকিস্তানের দাবিই হারাবেন না, আমাদের আচরণের ফলে রক্তপাত ও নিষ্ঠুরতার এমন এক দুষ্টচক্রের সূত্রপাত হবে, যা অনতিবিলম্বে আমাদের স্বাধীনতার দিনকে বিলম্বিত করবে।”(১১) জিন্নার এই শান্তির ললিত-বাণী তাঁর অনুগামীদের কতজনের কাছে পৌঁছেছিল বলা কঠিন। তবে ইতিমধ্যে “লড়কে লেঙ্গে” মনোভাবে ওতপ্রোত লীগ কর্মী ও সমর্থকদের কাছে যে তা ব্যর্থ পরিহাসে পর্যবসিত হয়েছিল, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
যাই হোক, একদিকে তখন দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বলছে এবং অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জন্য ক্ষতবিক্ষত অন্তর্বর্তী সরকার পঙ্গু ও ঘটনাবলীর অসহায় দর্শক। বঙ্গের হিন্দু-পীড়ন বন্ধ করার জন্য প্যাটেল সেখানকার লীগ মন্ত্রীমণ্ডলকে বরখাস্ত করে কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়িত্ব দেবার প্রস্তাব দিলেন। ঐ প্রস্তাব রাজনৈতিক কথার কথা হলেও তখনকার অবিশ্বাসপূর্ণ পরিস্থিতিতে জিন্না ও লীগকে উত্তেজিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। বিশেষ যখন অনুরূপ পরিস্থিতিতে বিহারের কংগ্রেস-প্রশাসন সম্বন্ধে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড একই নিদান দিচ্ছেন না। এ ছাড়া কংগ্রেসের দাবি হল—লীগকে হয় ক্যাবিনেট মিশনের দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তাব বাতিল করার সিদ্ধান্ত খারিজ করে গণপরিষদে যোগ দিতে হবে, নচেৎ অন্তর্বর্তী সরকার ছাড়তে হবে। কংগ্রেস কিন্তু বাধ্যতামূলক প্রদেশগোষ্ঠী গঠনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না দিয়ে এ ব্যাপারে ফেডারেল কোর্টের রায় মেনে নেবার অধিক অগ্রসর হতে প্রস্তুত নয়। লীগ না মিশনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রস্তাব গ্রহণ করবে আর না অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পদত্যাগ করবে। জিন্না বরং নভেম্বরের মধ্যভাগে এক বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বললেন যে তাঁর মতে ভারতবর্ষের তদানীন্তন সমস্যার একমাত্র সমাধান হল “পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান” প্রতিষ্ঠায়। তিনি আরও জানালেন যে অন্তর্বর্তী সরকারে লীগ প্রতিনিধিরা রয়েছেন “প্রহরী হিসাবে” এবং দৈনন্দিন প্রশাসনে তাঁরা মুসলিম স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রাখবেন। কংগ্রেসের চাপে এবং ভারতসচিবের অনুমোদনক্রমে বড়লাট গণপরিষদের সভা আহ্বান করায় জিন্না তার তীব্র প্রতিবাদ করে ২১শে নভেম্বর এক বিবৃতি প্রসঙ্গে জানালেন যে দেশের তখনকার অবস্থায় একাজ করা মারাত্মক ভুল হয়েছে এবং ৯ই ডিসেম্বর অর্থাৎ পরিষদের প্রস্তাবিত প্রথম বৈঠকে কোন লীগ প্রতিনিধি যোগ দেবে না। স্পষ্টত জিন্না বুঝেছিলেন যে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা আদায়ের পথে অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা ও গণপরিষদে যোগ না দেওয়া তাঁর হাতে তুরুপের তাস এবং সুকৌশলে তিনি তাই নিয়ে খেলছিলেন। ২৬শে নভেম্বর করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতবর্ষে তখনকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘুদের স্বার্থে জিন্না লোক বিনিময়ের প্রস্তাব করেন।
ওয়াভেলের পায়ের নীচে থেকে তখন মাটি সরে যাচ্ছে। ব্রিটিশ সরকার যথাসম্ভব শীঘ্র ক্ষমতা হস্তান্তরে ইচ্ছুক বলে এ ব্যাপারে কোনো বিলম্ব বরদাস্ত করতে রাজী নন। তাই লীগের বাধাদানের নীতিকে প্রশ্রয় দেবার বদলে কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ও পদক্ষেপ সম্বন্ধে বিরূপ প্রতিবেদন সত্ত্বেও তাঁরা বড়লাটকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে যেন কোনো বাধার প্রশ্রয় না দেওয়া হয়। ওয়াভেলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা অন্য বড়লাট পাঠাবার কথা ভাবছেন। লিয়াকতের মাধ্যমে লীগকে গণপরিষদে যোগ দিতে রাজী করতে অসমর্থ হয়ে বড়লাট তাঁর ব্যর্থতার কথা ২৩শে নভেম্বর ভারতসচিবকে জানালেন। অচলাবস্থা দূর করার জন্য তিনি ওয়াভেলকে ভারতীয় নেতাদের নিয়ে লন্ডনে এক আলোচনার জন্য আহ্বান করলেন। বড়লাট ছাড়াও জিন্না (প্রাথমিক অনিচ্ছার পর প্রায় শেষ মুহূর্তে), লিয়াকৎ, নেহরু ও বলদেব সিং সেই আলোচনায় যোগ দিলেন। বলা বাহুল্য অবিশ্বাসের ঐ পরিপ্রেক্ষিতে ৩রা থেকে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ঐ বিশদ আলোচনা সত্ত্বেও কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হল না।
জালি জিন্নার ঐ সময়কার মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় উড্রো ওয়াইআটের লিপিবদ্ধ করা তেসরা ডিসেম্বরে এক নোটে। জিন্নাকে আরও কয়েকজন পার্লামেন্টের সদস্যের সঙ্গে পরিচিত করবার জন্য ওয়াইআট এক ভোজসভার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর মতে জিন্না তীব্রভাবে বোধ করছিলেন যে কংগ্রেস যখন স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা বাতিল করেছিল তখন তাঁকে সরকার গঠন করতে দেওয়া উচিত ছিল। তাঁর দৃঢ় অভিমত এই যে “কংগ্রেস কদাপি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি; তার উদ্দেশ্যও কখনো এমন ছিল না বা ভবিষ্যতওে এমন হবে না। বারবার তিনি বলছেন যে কংগ্রেসের একমাত্র অভিসন্ধি হল ক্ষমতা করায়ত্ত করা এবং তাতে বাধাসৃষ্টির জন্য যা-কিছু প্রয়োজন তিনি করবেন। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবকে বর্তমানে তিনি প্রতারণা ও দমবাজি মনে করেন।…এখন তিনি এই যুক্তিতে প্রত্যাবর্তন করেছেন যে একমাত্র পাকিস্তান সৃষ্টির দ্বারাই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভবপর। সিমলাতে তিনটি বিষয়ের ক্ষমতাসম্পন্ন এক কেন্দ্রীয় সরকারের যে প্রস্তাব তিনি করেছিলেন তা চিরতরে অন্তর্হিত বলে মনে হয়।… এ ব্যাপারে তাঁর প্রধান বুলি হল তাঁর কথিত বিহারে হিন্দু কর্তৃক সজ্ঞানে মুসলিম নিধন। যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যে কোনো ব্যাপারে বোঝাপড়ায় উপনীত হবার দিক থেকে সেদিনকার মতো অত খারাপ মেজাজে আর কখনো তাঁকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। গাড়িতে চড়ার সময়ে শেষ যে কথা আমাকে তিনি বললেন তা হল তর্ক-বিতর্ক করার সময় আর নেই।”(১২)
পেথিক-লরেন্সও সেদিন অপরাহ্ণে জিন্না ও লিয়াকতের সঙ্গে কথা বলে অনুরূপ ধারণা লাভ করেন। পরদিবস জিন্নার সঙ্গে কথা বলার পর প্রধানমন্ত্রী এটলী তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যদের জানালেন, “মিস্টার জিন্নার বক্তব্যের সারমর্ম ছিল এই যে ভারতবর্ষে স্বায়ত্ত শাসন প্রবর্তন করার চেষ্টা করা ভুল হয়েছে।…মিস্টার জিন্নাকে এ বিষয়ে স্থিরনিশ্চয় মনে হল যে, গণপরিষদের ব্যাপারে কংগ্রেস আসল কাজ কিছুই চায় না, তাঁর নিজের লক্ষ্য হচ্ছে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভিতর শুধু পাকিস্তান লাভ, কংগ্রেসের সঙ্গে কোনোরকম বোঝাপড়ায় উপনীত হবার ব্যাপারে তাঁর আস্থা নেই।”(১৩) একই দিনে নেহরুর সঙ্গে আলোচনার সময় ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যত্রয় ও বড়লাট লক্ষ করলেন যে তিনিও জিন্না বা লীগের সঙ্গে একযোগে চলতে প্রস্তুত নন। এই অবস্থায় আরও আলোচনার কোনো অর্থ ছিল না। এছাড়া গণপরিষদের উদ্বোধনের দিন (৯ই ডিসেম্বর) নেহরু দিল্লিতে থাকতে ইচ্ছুক ছিলেন। সুতরাং ৬ই ডিসেম্বর আলোচনা শেষ হল এবং ধরি মাছ না ছুঁই পানি মার্কা এক বিবৃতিতে ব্রিটিশ সরকার কেবল এইটুকু বললেন যে, “এমন এক গণপরিষদ দ্বারা যদি সংবিধান রচিত হয়, যাতে ভারতীয় জনসাধারণের এক বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্ব ছিল না, তাহলে মহামান্য সম্রাটের সরকার অবশ্য… সেই সংবিধান দেশের কোনো অনিচ্ছুক অংশের উপর জোর করে চাপিয়ে দেবার কথা চিন্তা করতে পারে না।”
জিন্না ও লিয়াকৎ আরও কয়েকদিন বিলাতে রয়ে গেলেন। জিন্নার পারিবারিক বন্ধু কানজি দ্বারকাদাস আমেরিকা ফেরত লন্ডনে তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর সে সময়কার অবস্থা সম্বন্ধে লিখেছেন: “আমি দেখলাম তিনি অসুস্থ ও হতাশাগ্রস্ত।…আমি তাঁকে বললাম যে…দেশের কি হচ্ছে…তা আমি বুঝতে পারছি না। ‘দেশ, কোন্ দেশ?’ জিন্না প্রশ্ন করলেন, “দেশ বলে কোন কিছু নেই। আছে কেবল কিছু হিন্দু-মুসলমান।’ আমি লক্ষ করলাম যে পাকিস্তানের ভিত্তি ব্যতিরেকে জিন্না কোনোরকম বোঝাপড়ায় রাজী নন। কংগ্রেস নেতৃবর্গ তাঁর প্রতি অনুচিত আচরণ করেছেন এবং তাঁর বিরূপ সমালোচনা করেছেন বলে জিন্না লড়াই চালিয়ে যেতে চান।…আমি জিন্নাকে বললাম যে, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস সরকারের বাইরে নিজেদের বিবাদ চালিয়ে যেতে পারে…কিন্তু সরকারের ভিতর একযোগে কাজ করা এবং দেশের জন্য যতটা সম্ভব করা উভয় দলের পক্ষে কি অপরিহার্য নয়? জিন্না উত্তর দিলেন: কি বলেন? তা কি ভাবে সম্ভব হবে? আপনি কি বলতে চান যে, এই কামরার ভিতর আমরা পরস্পরকে চুম্বন করার পর কামরার বাইরে গিয়ে একে অপরকে ছুরিকাঘাত করতে পারি?”…আমার মনে হল যে কংগ্রেস নেতারা যদি তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিচ্ছেদ না করতেন তাহলে তিনি এতটা তিক্ত হতেন না। তাঁর আত্মমর্যাদা ও অহমিকা বোধ আহত হওয়ায় এবং তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করা হয়েছে এই ধারণা তাঁর মধ্যে সৃষ্টি হওয়ায় তিনি ঐরকম বিরূপ হয়েছিলেন এবং নিজের চতুর্দিকে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের অপচ্ছায়ার সৃষ্টি করেছিলেন।”(১৪)
জিন্নার তদানীন্তন মনোভাবের পরিচায়ক পূর্বোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ থেকে এই সত্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে রাজনীতি-ব্যবসায়ীর নিত্য আরাধ্য—ক্ষমতাপ্রাপ্তির জন্য তিনি উন্মুখ এবং তখনও পর্যন্ত তার থেকে বঞ্চিত থাকার জন্য তিনি অত্যন্ত তিক্ত। তাঁর ভিতর অপরের সহানুভূতি ও প্রীতি পাবার মানবীয় অভীপ্সা বিদ্যমান, যদিও তাঁর নিজের উক্তি ও আচরণ কদাচিৎ তার অনুকূল।
৯ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণপরিষদের উদ্বোধন হল। জিন্না লন্ডনে থাকলেও তাঁর দলের কোনো সদস্যই ঐ পরিষদের কার্যকলাপে যোগদান না করে ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর এবং তাঁর রণকৌশলের প্রতি আস্থাজ্ঞাপন করলেন। কংগ্রেস ও অন্যান্য দলের দুই শতাধিক সদস্য স্বাধীন ভারতবর্ষের সংবিধান রচনার কাজ শুরু করলেন।
বিলাতে ইতিমধ্যে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। ১৩ই ডিসেম্বর কমন্স সভায় ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিতর্ক প্রসঙ্গে বিরোধী দলের নেতা চার্চিল বললেন: “একথা নিশ্চিত যে চার মাস পূর্বে শ্রীযুক্ত নেহরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবার পর থেকে এযাবৎ ভারতবর্ষে হিংসার কবলে যতজনের প্রাণবিয়োগ হয়েছে বা যতজন আহত হয়েছেন তাঁদের সংখ্যা বিগত ৯০ বছরে অনুরূপভাবে মৃত ও আহতদের সংখ্যার চেয়ে বেশি। সুবিস্তীর্ণ এলাকায় এবং অসংখ্য অখ্যাত গ্রামে এই যেসব নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার শিকার হয়েছে প্রধানত মুসলমান সংখ্যালঘুরা। আমাকে নিজ বিশ্বাসের কথা নথিভুক্ত করাতেই হবে এবং তা হল এই যে, ভারতবর্ষে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার যে কোনো প্রয়াস গৃহযুদ্ধ ব্যতিরেকে সফল হবে না। আর এ গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত সেনাবাহিনী বা কোনো সংগঠিত গোষ্ঠীর এলাকায় হবে না, হবে হাজার হাজার পৃথক এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন লোকালয়ে। ভারতবর্ষের সৈন্যবাহিনীর অধিকাংশ…এই নকোটি মুসলমানের… বংশোদ্ভূত….এবং যখন বহু কোটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় তখন “সংখ্যালঘু” শব্দটির কোনো তাৎপর্য বা অর্থ থাকে না।”(১৫)
এ সম্বন্ধে উলপার্টের মন্তব্য হল: “চার্চিলের ঐ মন্তব্য ইতিপূর্বে এটলী, ক্রিপস অথবা উড্রো ওয়াইআটের কাছে জিন্না যে মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন তার থেকে অধিকতর কঠোর ও অনমনীয় ভূমিকা গ্রহণে প্ররোচিত করল। লন্ডনের এই শেষ প্রবাস তাঁর মনে এই বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করল যে এখনও রক্ষণশীল দলের সমর্থনের কী পরিমাণ শক্তি তাঁর পিছনে রয়েছে। এর পরিণামে তাঁর পূর্বতন সেই সিদ্ধান্ত পুষ্টিলাভ করল যে, নেহরু-কংগ্রেস গণপরিষদের ঘূর্ণিপাকে এককভাবে ঘুরপাক খেতে থাকুক এবং পদস্থ ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ও মুসলমান সম্প্রদায় —যাঁরা দূর থেকে অসম্পৃক্তভাবে এই খেলা দেখছেন তাঁদের বিরাগভাজন হতে থাকুন।”(১৬) জিন্নার প্রতি ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতৃবর্গের একাংশের গভীর সমর্থনের বিবরণ খলিকুজ্জমাঁর বিবরণেও মেলে: “লন্ডনে থাকাকালীন শ্রীযুক্ত জিন্না অত্যন্ত দায়িত্বশীল মহল থেকে খবর পেয়েছিলেন যে কংগ্রেস যদি ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনার নিজস্ব ভাষ্য পরিহার করে ঐ পরিকল্পনাকে হুবহু গ্রহণে স্বীকৃত না হয়, তাহলে ব্রিটিশ সরকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেশ বিভাজনে সম্মত হবে।”(১৭) দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ওয়াভেলের ভারত থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইংলন্ডের সরকার কর্তৃক ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে আসার সময়-সীমা নির্ধারণ। অতীতে (সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) এজাতীয় একটি প্রস্তাব ওয়াভেলের কাছ থেকে পেলেও ব্রিটিশ সরকার তাকে অহেতুক বিপদসঙ্কেত ঘোষণাকারী মনে করে তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেনি। কিন্তু ডিসেম্বরে বিলাতে থাকাকালীন ওয়াভেল (উনিও ৬ই ডিসেম্বরের পর রয়ে গিয়েছিলেন) আবার এজাতীয় এক প্রস্তাব (দফায় দফায় ব্রিটিশের প্রত্যাহার এবং অনতিবিলম্বে এই পর্বের সূত্রপাত) সরকারকে দেওয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পর্যুদস্ত ভারতবর্ষের প্রশাসনিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ সরকার এবিষয়ে গুরুত্ব সহকারে মনঃসংযোগে বাধ্য হয়। তবে সুয়েজ খালের পূর্বে স্থিত দেশসমূহে ব্রিটিশ ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং কমনওয়েলেথের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে কর্মকৌশলের দিক থেকে ভারতবর্ষের অবিস্থিতির গুরুত্ব ইত্যাদির জন্য ইংরেজ সরকার ভারতবর্ষকে অরাজকতার হাতে সমর্পণ করে চলে আসতে প্রস্তুত ছিল না। এছাড়া সরকারের আশঙ্কা ছিল যে ঐ জাতীয় অরাজকতার সুযোগে কেবল ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহই নয়, এমনকি রাশিয়া (ভারতীয় বামপন্থীদের সহায়তায়) বা ইংরেজের প্রতিকূল অপর কোনো বিদেশি রাষ্ট্র ভারতবর্ষে ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে। মন্ত্রীসভার ভারত-ব্রহ্ম কমিটিতে ১১ই ডিসেম্বর এই প্রস্তাব বিবেচনার সময়ে কোনো কোনো সদস্য ভারতবর্ষের বিভাজনের প্রস্তাব করলেন এবং ওয়াভেল মন্তব্য করলেন যে বর্তমান অবস্থায় সরকারের ঘোষণা করা উচিত যে নবগঠিত গণপরিষদের সংবিধান কেবল হিন্দু এলাকার প্রতি প্রযোজ্য হবে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেসমূহকে এক পৃথক গণপরিষদ গঠন করার জন্য উৎসাহিত করা যেতে পারে।(১৮) অনুমান করা যেতে পারে যে, তাঁর চিন্তা ও পরিকল্পনার অনুরণন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের উচ্চমহলে শুনতে পেয়ে নিজের পদক্ষেপ সম্বন্ধে জিন্না আরও নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।
ওয়াভেল কিন্তু ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বিভাজন-কেন্দ্রিক দেশবিভাগের প্রস্তাবের অনুকূল ছিলেন না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দফায় দফায় ব্রিটিশের ভারত থেকে প্রত্যাহারের প্রথম চরণের বাস্তব রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করিয়ে বিবদমান দুই পক্ষকে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হতে বাধ্য করা। মন্ত্রীমণ্ডল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৮ই জানুয়ারি এ প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত বাতিল করলেও ভারতবর্ষ ছেড়ে আসার একটা সময়-সীমা নির্ধারণ করা সাব্যস্ত করে। বড়লাট এবং পাঞ্জাব ও বঙ্গের মতো যে দুই প্রদেশের ব্রিটিশশক্তির অপসারণের প্রক্রিয়ায় সর্বাধিক প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা, তার ছোটলাটদের সুস্পষ্ট পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ২০শে ফেব্রুয়ারি কিয়দংশে ভবিষ্যৎ বড়লাট মাউন্টব্যাটেন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এটলী কর্তৃক সরকারিভাবে এই মর্মে ঘোষণা ভারত বিভাজন ও তজ্জনিত
পৃষ্ঠা: ২৪৫

গণহত্যাকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। তবে সে সম্বন্ধে যথাস্থানে আলোচনা করা হবে।
জিন্নার বিলাত থাকাকালীন ১৪ই ডিসেম্বর কিংসওয়ে হলে মুসলমানদের সভায় পাকিস্তান দাবির সপক্ষে জোরালো ভাষায় বলা ছাড়া অপর একটি ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন। আকালী নেতা সর্দার বলদেব সিং-এর মতে, ঐ সময়ে এক ব্যক্তিগত আলোচনা প্রসঙ্গে জিন্না বলেন: “বলদেব সিং, এই দেশলাই বাক্সটি দেখছেন তো! এর আকারের পাকিস্তানও যদি আমাকে দেওয়া হয়, আমি তা সানন্দে স্বীকার করে নেব। কিন্তু আমি আপনার সহায়তা-প্রার্থী। আপনি যদি শিখদের মুসলিম লীগের সঙ্গে হাত মেলাতে রাজী করতে পারেন তাহলে আমরা এমন এক গৌরবজনক পাকিস্তান পাব যার দেউড়ি খাস দিল্লিতে যদি নাও হয় অন্তত দিল্লির কাছাকাছি হবে।”(১৯) পরবর্তীকালে জিন্নার এজাতীয় এক প্রস্তাব আকালী দলের তদানীন্তন নেতা মাস্টার তারা সিং সরকারিভাবে অগ্রাহ্য করলেও শিখেদের সহযোগিতার বৃহত্তর পাকিস্তান প্রাপ্তির এই প্রস্তাবের মাধ্যমে দুটি প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাহলে মুসলিম বাসভূমি হিসাবে পাকিস্তানের দাবি কি শুধুই কথার কথা? না এ প্রস্তাব পাকিস্তানের জন্য অধিকতর এলাকা পাবার উদ্দেশ্যে ক্ষমতার রাজনীতি প্রভাবিত হয়ে আর এক প্রয়াস?
ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে জিন্না ও লিয়াকৎ প্যান-ইসলামিক সম্মেলন যোগ দেবার জন্য আরব লীগের অতিথিরূপে কায়রোতে কয়েকদিনের জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলেন। মিশরের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আলোচনা প্রসঙ্গে ১৭ই ডিসেম্বর তিনি বলেছিলেন: “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পরই কেবল ভারতীয় ও মিশরীয় মুসলমানরা যথার্থ স্বাধীন হবেন। তা না হলে হিন্দু সাম্রাজ্যবাদী রাজত্বের বিপদ মধ্যপ্রাচ্য পার হয়ে তার থাবা বাড়িয়ে দেবে।” মিশর ও প্যালেস্টাইনের আরব নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিবরণ দিতে গিয়ে ২০শে ডিসেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন: “মধ্যপ্রাচ্যের কাছে এক হিন্দুসাম্রাজ্য কী বিপদের কারণ হতে পারে এ সম্বন্ধে তাঁদের বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি এই আশ্বাসও দিয়েছি যে, পাকিস্তান জাতি ও গাত্রবর্ণ নির্বিচারে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামকারী সকল জাতির সঙ্গে সহযোগিতা করবে।…যদি এক হিন্দু-সাম্রাজ্যের পত্তন হয় তাহলে তার অর্থ হল, ভারতবর্ষে এবং এমনকি অন্যান্য মুসলিম দেশেও ইসলামের অবসান। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় সম্বন্ধ আমাদের মিশরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। আমরা যদি নিমজ্জিত হই, সকলেই ডুববেন।”(২০)
পাঠকের স্মরণ হবে যে, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক জিন্না একদা এই কারণে গান্ধীকে খিলাফৎ নিয়ে মাতামাতি করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন যে প্যান- ইসলাম-কেন্দ্রিক ঐ আন্দোলনের ঐস্লামিক অযৌক্তিক কুসংস্কারের পৃষ্ঠপোষকতা করার আশঙ্কা। সেই জিন্নার প্যান-ইসলামের প্রবক্তা হয়ে আরব দেশের মুসলমান নেতৃবৃন্দকে “হিন্দু সাম্রাজ্যবাদী রাজ্যের” বিভীষিকা প্রদর্শন অবশ্যই ইতিহাসের এক পরিহাস।
২১শে ডিসেম্বর ভারতবর্ষের মাটিতে পা রাখার পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে জিন্না ঘোষণা করেন যে কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের ৬ই ডিসেম্বরের ব্যাখ্যা মেনে না নেওয়া পর্যন্ত লীগের ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করার প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করার অবকাশ নেই। স্পষ্টত লন্ডনে প্রাপ্ত আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতিসমূহ তাঁর কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে।

২৭
পাদটীকা

১. জমিলউদ্দীন আহম্মদ (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ৪৪ পৃষ্ঠা। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৮৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২. T.P.; অষ্টম খণ্ড; ৪৭৮ পৃষ্ঠা।
৩. ওয়াভেলের ৮ই সেপ্টেম্বরের নোট; T.P.; অষ্টম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৪৫৩। উল্লেখনীয় যে ইতিপূর্বে (এপ্রিল ১৯৪৬) বাংলার ছোটলাট ব্যারোজের উদ্যোগে প্রারব্ধ লীগ-কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রীসভার প্রয়াস সুরাবর্দী ও কংগ্রেস নেতা কিরণশঙ্কর রায়ের সঙ্গে পনের দিন আলোচনার পরও ব্যর্থ হয় (আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৬২)। জিন্না-সুরাবর্দী প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে অনেকের মতে ঐ এপ্রিল মাসে দিল্লিতে লীগের আইনসভার সদস্যদের সভায় লাহোর প্রস্তাবের একাধিক পাকিস্তানের (States) বদলে একটিমাত্র পাকিস্তান (State) গঠনের সিদ্ধান্ত সুরাবর্দীর বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কবর দেবার জন্য জিন্নার এক কৌশল।
৪. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২২০-২২১। উদ্ধৃতির মধ্যে প্রদত্ত জিন্নার ৯ই সেপ্টেম্বরের বিবৃতি এবং ওয়াভেলের মন্তব্য T.P.; অষ্টম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৪৭৭, ৪৭৮, ৫৮৮ ও ৬৪৪ থেকে গৃহীত।
৫. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ৩৬৫ পৃষ্ঠা।
৬. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ২৯১ পৃষ্ঠা।
৭. ৬ই অক্টোবরের চিঠি; T.P.; অষ্টম খণ্ড; ৬৭১ পৃষ্ঠা।
৮. ২১শে অক্টোবরের Hindustan Times থেকে উদ্ধৃত। সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৭৭৯। এ প্রসঙ্গে এর দিনকয়েক পর প্রদত্ত জিন্নার বক্তব্য উল্লেখযোগ্য: “তাদের (কংগ্রেসকে প্রশাসনের একতরফা দায়িত্বে রাখা আমাদের স্বার্থের পক্ষে মারাত্মক হত। আমরা তাই আমাদের পাঁচজন প্রহরীকে মনোনীত করতে বাধ্য হই, যাঁরা মুসলিম স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রাখবেন এবং তা সুরক্ষিত করবেন।”(সন্ধ্যা চৌধুরী; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৮০)।
৯. প্যারেলাল; Last Phase; প্রথম খণ্ড; প্রথম অংশ; ২৬৯ পৃষ্ঠা।
১০. সমগ্রন্থ; ২৭৫ পৃষ্ঠা।
১১. জমিলউদ্দীন আহম্মদ (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৩৫৯-৩৬১ থেকে জে. জে. পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১২৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১২. T.P.; নবম খণ্ড; ২৪৬-২৪৭ পৃষ্ঠা।
১৩. সমগ্রন্থ; ২৬০-২৬১ পৃষ্ঠা।
১৪. Ten Years of Freedom; পৃষ্ঠা ১৯০-১৯১ থেকে উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৩০১-৩০২ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১৫. উলপার্ট; সমগ্রন্থ ৩০৩-৩০৪ পৃষ্ঠা। গোপনে জিন্নার সঙ্গে চার্চিলের যে পত্রব্যবহার হত তার একটির সন্ধান সম্প্রতি পাওয়া গেছে। চার্চিলের ৩। ৮। ১৯৪৬-এর “ব্যক্তিগত ও গোপন” পত্রের সম্পূর্ণ বয়ানের জন্য দিল্লির Hindusthan Times দৈনিকের ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুনের সংখ্যা দ্রষ্টব্য। পত্রটি লন্ডন থেকে প্রকাশিত ড. মার্টিন গিলবার্টের চার্চিলের জীবনী গ্রন্থের অষ্টম খণ্ড থেকে গৃহীত। চার্চিল ও সাইমন উভয়েরই জিন্নাকে লিখিত ১৬ই ডিসেম্বরের এক একটি চিঠির উল্লেখ করে মূরের সিদ্ধান্ত হল: “চার্চিলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটা গোপন তারবার্তায় ঠিকানা নির্ধারিত করা হয়েছিল। তিনি জিন্নাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের অঙ্গ হিসাবে পাকিস্তানের এলাকাকে কমনওয়েলথ থেকে বেরিয়ে যেতে দেওয়া হবে না।”(সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৩০)।
১৬. সমগ্রন্থ; ৩০৪ পৃষ্ঠা।
১৭. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ৩৭২ পৃষ্ঠা।
১৮. T.P.; নবম খণ্ড; ৩৩৩-৩৩৪ পৃষ্ঠা।
১৯. ডঃ গোপাল; Jwaharlal Nehru; প্রথম খণ্ড; ৩৩৮ পৃষ্ঠা।
২০. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ৩০৫ পৃষ্ঠা।

ক্ষমতা হস্তান্তরের নাটকের প্রমুখ চরিত্র
২৮

মাউন্টব্যাটেনের মতে, “স্পষ্টতঃ জিন্নাই ছিলেন সমস্ত ব্যাপারটার চাবিকাঠি।”(১) হডসনের বক্তব্য হল, “ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পুনর্জন্ম লাভ করার মহানাটকের শেষ অঙ্কের তাবৎ প্রমুখ কুশীলবদের মধ্যে জিন্না ছিলেন ‘সর্বপ্রধান’।”(২) “তাঁর নিজের লোক ছাড়া অপর কারও দ্বারা লিখিত ইতিহাস এম.এ. জিন্নাকে তাঁর সুউচ্চ কৃতিত্বের যথাযোগ্য স্বীকৃতি দেবে না। তবু গান্ধী বা অপর যে-কোনো নেতার হাতে নয়, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের সেই নববর্ষের দিনে ভারতবর্ষের ভবিতব্যের চাবিকাঠি ছিল জিন্নার হাতে।”(৩)
স্বাধীনতার প্রাক্কালীন ভারতবর্ষে জিন্নার ভূমিকা সম্বন্ধে আরও অনেকের এজাতীয় উক্তি উদ্ধৃত করা যায়।(৪) সুতরাং ঐ সময়কার ভারতবর্ষের পরিস্থিতির কথঞ্চিৎ পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
ভারতবর্ষকে আর ব্রিটেনের অধীনে রাখা সম্ভব নয় উপলব্ধি করে শ্রমিক দলের সরকার ভারতবাসীকে স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত। সুয়েজের পূর্বস্থিত বিশাল অঞ্চলে ইংলন্ডের বাণিজ্যিক স্বার্থে ঐ দেশের মিত্রভাবাপন্ন কোনো শক্তিশালী সরকার ভারতবর্ষে থাকা দরকার। সেই সরকারের কমনওয়েলথের সদস্যও হওয়া বাঞ্ছনীয় এইজন্য। সুতরাং শ্রমিক সরকার অন্তত ভারতের কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক। কিন্তু এজাতীয় সরকার গঠনের প্রথম ধাপ সংবিধান রচনাকারী গণপরিষদে দুই প্রধান দলের অন্যতম মুসলিম লীগ যোগ দিতে প্রস্তুত নয়, যদিও বড়লাটের কাছে জিন্নার এতদুদ্দেশ্যে মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেবার পর লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিয়েছে। লীগের দাবি—মুসলমানদের স্বতন্ত্র বাসভূমির কাছাকাছি একটা ব্যবস্থা ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ই মে তারিখের প্রস্তাবের বাধ্যতামূলক প্রদেশসমূহের গোষ্ঠী রচনার ভিতর ছিল। ঐ শর্তে লীগ তিনটি প্রদেশ-গোষ্ঠীর সমবায়ে গঠিতব্য সীমিত কর্তৃত্ববিশিষ্ট কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবেও রাজী ছিল। কিন্তু কংগ্রেস সে প্রস্তাব স্বীকার করেছে নিজ ব্যাখ্যাসহ। অর্থাৎ কংগ্রেস বাধ্যতামূলক প্রদেশগোষ্ঠী গঠনে সম্মত নয়। বড় বেশি হলে এ ব্যাপারে ফেডারেল আদালতের রায় মানতে প্রস্তুত। কারণ কংগ্রেস-শাসিত অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ আসাম ও নির্বাচনে লীগের কর্মসূচীকে প্রত্যাখ্যান করে কংগ্রেসের সঙ্গে নিজেদের ভাগ্যকে যুক্তকারী উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে জোর করে প্রস্তাবিত পাকিস্তান প্রদেশগোষ্ঠীতে ঠেলে দেওয়া—বাধ্যতামূলক প্রদেশগোষ্ঠী গঠনের প্রশ্নে মিশনের এই ব্যাখ্যা লীগের অনুকূল। (৫) সুতরাং লীগ গণপরিষদ বয়কট করার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিবাদের আখড়ায় পরিণত করে স্বাভাবিক প্রশাসন চালানো অসম্ভব করে দিয়েছে। অকার্যকারী সরকারের কর্ণধার নেহরু-প্যাটেল পর্যুদস্ত ও ক্ষিপ্ত। লীগ প্রতিনিধিরা যোগ দেবেন এই আশায় গণপরিষদ সংবিধান রচনার ব্যাপারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কারণ লীগ প্রতিনিধিদের সম্মতি বিনা সংবিধান সীমান্ত প্রদেশ ছাড়া অপরাপর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে প্রবর্তন করা যাবে না। ইংরেজ সরকার সেই সংবিধানকে স্বীকৃতি দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে তার সম্ভাবনা কম। লীগ হয় গণপরিষদে যোগ দিক, নচেৎ অন্তর্বর্তী সরকার ছাড়ুক——কংগ্রেসের এই দাবির প্রতি লীগ কর্ণপাত করছে না। বড়লাট এ ব্যাপারে মনস্থির করতে অক্ষম।
এদিকে কলকাতা, নোয়াখালি, ত্রিপুরা ও বিহারের বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সংখ্যালঘুদের উপর অমানবীয় উৎপীড়নের পর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। সাম্প্রদায়িক সদ্ভাব পুনঃস্থাপনের জন্য গান্ধী নোয়াখালি-ত্রিপুরার মাটিতে নিজেকে মিলিয়ে দেবার সদুশ্চর তপস্যায় রত। ক্ষমতা হস্তান্তরের কেন্দ্র দিল্লিতে সাময়িকভাবে যেতে পর্যন্ত তিনি রাজী নন। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশেও থেকে থেকে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং কংগ্রেস-লীগ বোঝাপড়া ছাড়া কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। লীগ এ বিষয়ে মনোযোগ দেবার বদলে পাকিস্তানের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কথাই বলে চলেছে। সুতরাং তখনকার সেই অচলাবস্থা দূর করার চাবিকাঠি জিন্নার হাতে—এ কোনো অত্যুক্তি নয়।
বিশেষ করে শ্রমিক দলের বাইরের এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ইংরেজের সমর্থন জিন্না পাচ্ছিলেন। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে ভারত-ব্রহ্ম কমিটির আলোচনার এবং খলিকুজ্জমাঁর বিবরণের যে উল্লেখ করা হয়েছে তাতে এর আভাস আছে। চার্চিলের পার্লামেন্টের বক্তৃতা থেকেও এর সমর্থন মেলে। পূর্ববর্তী অধ্যায়ের ১৫ সংখ্যক পাদটীকায় জানানো হয়েছে যে, ক্ষমতাচ্যুত হলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রবল প্রবক্তা চার্চিলের সঙ্গে জিন্না গোপন যোগাযোগ রেখে আসছিলেন। এমনকি বিভক্ত পাঞ্জাব ও বাংলার ভিত্তিতে “বিকলাঙ্গ ও কীটদষ্ট” পাকিস্তান যাতে অতঃপর জিন্না স্বীকার করে নেন তার জন্য মাউন্টব্যাটেন রোগে শয্যাশায়ী চার্চিলের সঙ্গে (২২শে মে ১৯৪৭ খ্রি.) দেখা করে জিন্নার জন্য এক বিশেষ বার্তা নিয়ে আসেন।(৬) পূর্ববর্তী অধ্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের এক শ্রেণীর উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীর ভূমিকার উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁরা কংগ্রেসি নেতাদের অধীনে কাজ করা সুখকর মনে করতেন না। অন্তর্বর্তী সরকারে লীগকে আনা এবং কংগ্রেস ও লীগ দুইদলের প্রতিনিধিদের যুযুধান শিবিরে বিভক্ত করে অচলাবস্থা সৃষ্টি করার পিছনে ঐ শ্রেণীর কর্মচারীদেরও হাত ছিল। ঐসব ইংরেজ রাজকর্মচারীদের মনোভাবের নিদর্শন পাওয়া যায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের তদানীন্তন ডিরেক্টর স্যার নরম্যান পি. এ. স্মিথ কর্তৃক ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বড়লাটকে পাঠানো তাঁর প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের নিম্নোদ্ধত অংশ উল্লেখযোগ্য:
“ব্রিটিশের দৃষ্টিকোণ (থেকে)…এ খেলা এযাবৎ সুচারুরূপেই খেলা হয়েছে … কংগ্রেস ও লীগ উভয়কেই কেন্দ্রীয় সরকারে আনা হয়েছে…এর দ্বারা ভারতের সমস্যাকে সাম্প্রদায়িকতার উপযুক্ত প্রেক্ষাপটে খাড়া করা সম্ভবপর হয়েছে…। শ্বাস নেবার এই যে সময় পাওয়া গেল তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে…। গুরুতর সাম্প্রদায়িক গোলযোগ ও যেন আমাদের বিচলিত করে সক্রিয় হতে প্ররোচিত না করে। কারণ (আমরা সক্রিয় হলে) ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের পুনঃপ্রবর্তন হবে।…গুরুতর সাম্প্রদায়িক গোলযোগ বীভৎস হলেও এ এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যার দ্বারা ভারতের সমস্যার সমাধান স্বতই হয়ে যাবে।”(৭)
কালী ক্যাবিনেটে মিশনের প্রস্তাবের উপর ব্রিটিশ সরকারের ৬ই ডিসেম্বরের ভাষ্য সম্বন্ধে কংগ্রেস সরকারিভাবে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল ৬ই জানুয়ারির নিম্নোদ্ধৃত প্রস্তাবে:
পৃষ্ঠা: ২৫০

“বিশেষতঃ আসাম এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের মতো কোন কোন প্রদেশ এবং পাঞ্জাবের শিখরা ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মে তারিখের পরিকল্পনা এবং তার থেকেও বেশি করে ব্রিটিশ সরকার কৃত তার ৬ই ডিসেম্বরের ভাষ্যের ফলে যে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন তা অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি উপলব্ধি করে। সংশ্লিষ্ট জনসাধারণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁদের উপর এভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া বা তাঁদের কোনো কিছু করতে বাধ্য করার প্রচেষ্টার সঙ্গে কংগ্রেস নিজেদের যুক্ত করতে পারে না। এ নীতি স্বয়ং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃকও স্বীকৃত। বিভিন্ন ভাষ্যের কারণে যে অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে তা দূরীকরণের জন্য অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি (তাই)…প্রদেশগোষ্ঠীগুলিতে যে পদ্ধতি অনুসৃত হবে সে ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের ভাষ্যকে মেনে নেবার পরামর্শ দিতে সম্মত হচ্ছে। তবে একথা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে এর পরিণামে কোনো প্রদেশকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করা হবে না…। কাউকে বাধ্য করার কোন প্রচেষ্টার নিদর্শন দেখা গেলে কোনো প্রদেশ বা তার অংশবিশেষের স্বীয় জনসাধারণের ইচ্ছাকে রূপ দেবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার থাকবে।”
এইভাবে কংগ্রেস বাধ্যতামূলকভাবে প্রদেশসমূহের গোষ্ঠীভুক্তির প্রস্তাব মেনে নিল বটে; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনিচ্ছুক প্রদেশ বা প্রদেশের অংশবিশেষের উপর তা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না ঘোষণা করে একই নিঃশ্বাসে প্রথমোক্ত স্বীকৃতিকে অস্বীকারও করল। এর ফলে যেমন লীগের সন্তুষ্টিবিধান হল না, তেমনি ভারত বিভাজনের স্বীকৃতির বীজও বপিত হল।(৮)
জিন্না ও লীগের উপর কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া যা হবার তা-ই হল। ৩১শে জানুয়ারি করাচীতে অনুষ্ঠিত লীগের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে কংগ্রেসের ঘোষণাকে, “অসাধু কৌশল ও শব্দের কারচুপির বাড়া আর কিছু নয়” আখ্যা দিয়ে গণপরিষদকেই অবজ্ঞাভরে “রাং” (rump) ও এর নির্বাচনকে “বেআইনী” অভিহিত করা হল। কারণ লীগের মতে গণপরিষদে কংগ্রেস ছাড়া আর কোনো দলের সদস্য নেই। লীগ দাবি জানাল, ব্রিটিশ সরকারকে ঘোষণা করতে হবে যে “কংগ্রেস…. ১৬ই মে তারিখের ঘোষণাকে মেনে নেয়নি” এবং এই কারণে গণপরিষদকে বাতিল করা হোক। ওয়ার্কিং কমিটির ঐ প্রস্তাবে আরও বলা হল যে, এ অবস্থায় ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ই মে তারিখের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্তকে পুনর্বিচার করার জন্য লীগ কাউন্সিলের সভা আহ্বান করার সার্থকতা নেই। ওয়ার্কিং কমিটি একথাও ঘোষণা করল যে ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা নিশ্চিন্ত ও চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভার কয়েকদিন পূর্বে অর্থাৎ ২৪শে জানুয়ারি অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল যা লীগের প্রভাব-বহির্ভূত পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের পরিস্থিতিতে গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টি করল। খলিকুজ্জমার জবানবন্দী অনুসারে ঘটনাটি হল, “…মালিক খিজির হায়াৎ খাঁর দিল্লি প্রবাসকালে ছোটলাটের আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্রসচিব কর্তৃক মুসলিম লীগ স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জনসাধারণকে উত্তেজিত করার রসদ সরবরাহ করা হল। অতঃপর এক জোরালো আন্দোলন শুরু হয়ে গেল এবং প্রধানমন্ত্রী দিল্লি থেকে প্রত্যাবর্তন করে দেখলেন যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।”(৯) ২৬শে জানুয়ারি জিন্না এক বিবৃতিতে পাঞ্জাব সরকারের ঐ কার্যের নিন্দা করার সঙ্গে সঙ্গে বড়লাটকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ জানালেন। নচেৎ এর পরিণাম গুরুতর হতে পারে বলে তাঁকে সতর্কও করে দিলেন।
পাকিস্তানের “পা” অর্থাৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ পাঞ্জাবের উপর বহুদিন যাবৎ জিন্নার দৃষ্টি থাকলেও, এমনকি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে লীগের হাওয়া বয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, ঐ প্রদেশে লীগ মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হয়নি। মুসলিম আসনে ইউনিয়নিস্ট পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও ঐ দলের নীতি অনুসারে মুসলমান, হিন্দু ও শিখদের প্রতিনিধি নিয়ে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছিল খিজির হায়াৎ খাঁরই নেতৃত্বে। পাঞ্জাবে লীগ মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য জিন্না এবং লীগের তীব্র ইচ্ছা সত্ত্বেও তা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই “প্রত্যক্ষ কার্যসূচি”র প্রস্তাবের আড়ালে পাঞ্জাবে লীগ এই উদ্দেশ্যসাধনে ব্রতী হয়েছিল এবং জিন্নার উদ্যোগে গঠিত ও তাঁর ব্যক্তিগত নেতৃত্বে চালিত লীগের আধাসামরিক সংগঠন ন্যাশনাল গার্ড প্রায় যুদ্ধের উদ্দেশ্যেই প্রস্তুত হচ্ছিল।(১০) ন্যাশনাল গার্ডকে পাঞ্জাবের ছোটলাট জেনকিন্স মুসোলিনী ও হিটলারের এজাতীয় বাহিনীর (কালো-কুর্তা ও ঝটিকা- বাহিনী) সমগোত্রীয় মনে করতেন। এই ন্যাশনাল গার্ডদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে পাঞ্জাবের তদানীন্তন ছোটলাট গ্ল্যান্সী ও বড়লাট ওয়াভেল উদ্বিগ্ন ছিলেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জুন ওয়াভেল মন্তব্য করেন যে এর জন্য “আমাদের জিন্নার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে, যাতে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ পরিহার করা যায়।” যাই হোক, লাহোরের ন্যাশনাল গার্ডের সদর কেন্দ্রে এক হাজারেরও বেশি লৌহ-শিরস্ত্রাণ পাওয়া গিয়েছিল এবং সংগঠনের প্রধান কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
খলিকুজ্জমার পূর্বোক্ত উদ্ধৃতিতে যার ইঙ্গিত আছে— ন্যাশনাল গার্ড প্রতিষ্ঠানকে বেআইনী ঘোষণা করা এবং তার প্রধান কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের ফলে লীগ “ব্যক্তি- স্বাধীনতা”র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রত্যক্ষ কার্যসূচি শুরু করল এবং নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে লীগ স্বেচ্ছাসেবকেরা সর্বত্র আইন অমান্য শুরু করলেন। খিজির অবশ্য শান্তি ক্রয়ের আশায় দ্বিতীয় দিনেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু যে আন্দোলন আসলে তাঁর মন্ত্রীমণ্ডলের পরিবর্তে পাঞ্জাবে লীগ শাসন কায়েমের উদ্দেশ্যে সংগঠিত, তা এতে থামবে কেন? আন্দোলনকারীরা তাই অতঃপর প্রকাশ্যেই খিজিরের পদত্যাগ দাবি করে দিকে দিকে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেন। ক্ষমতার জন্য বহুদিন যবনিকার অন্তরালে অপেক্ষমান সৌকৎ হায়াৎ খাঁ আইন অমান্যের জন্য দেড় কোটি মুসলমানকে পথে নামাবার হুমকি দিলেন। সদ্য কংগ্রেস ত্যাগ করে লীগে যোগদানকারী “সমাজবাদী” জমিদার নেতা ও সংবাদপত্রের মালিক মিঞা ইফতিকারউদ্দীন লীগের তরফ থেকে কংগ্রেসি ধরনের আইন অমান্য আন্দোলন চালাতে লাগলেন। মামদোতের নবাব, ফিরোজ খাঁ নূন, মিঞা মমতাজ দৌলতানা প্রমুখ লীগ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হওয়া সত্ত্বেও আন্দোলন পাঞ্জাবের প্রায় সব শহরে ছড়িয়ে পড়ল। লীগের আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ বলে ভূয়সী প্রশংসা করলেও একই নিঃশ্বাসে খলিকুজ্জমাঁ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, “বহু স্থলে হয়তো মুসলমানেরা মাত্রাজ্ঞান হারিয়েছিল এবং দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু করেন….” ইত্যাদি। পাঞ্জাব এবং তার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে জনমতকে মুসলমান বনাম অমুসলমান—এইভাবে দুই পৃথক শিবিরে বিভক্ত করার ব্যাপারে এ আন্দোলন প্রবল সহায়ক হয়েছিল এবং শেষ অবধি দোসরা মার্চ খিজিরের পদত্যাগের পর পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশে প্রায় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।
৩১শে জানুয়ারি লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ই মে তারিখের প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে নস্যাৎ করার পরের দিন জওহরলাল বড়লাটের সঙ্গে দেখা করে সঙ্গতভাবেই লীগ সদস্যদের অন্তর্বর্তী সরকার থেকে বরখাস্ত করার দাবি জানালেন এবং বললেন, নচেৎ কংগ্রেস প্রতিনিধিরাই সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন। ৬ই ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে এই দাবি চিঠির মাধ্যমে পেশ করল। তবে ইতিমধ্যে এটলী ওয়াভেলকে জানালেন যে পরবর্তী বড়লাট মনোনীত হয়ে গেছেন এবং তাই তিনি যেন অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করেন। অবশ্য বিগত ডিসেম্বরে লন্ডনে থাকাকালীনই তাঁকে আভাস দেওয়া হয়েছিল যে তিনি মন্ত্রীমণ্ডলের সিদ্ধান্ত অনুসারে ভারত সম্পর্কিত নীতির যথাযথ রূপায়ণ করতে পারছেন না বলে ব্রিটিশ সরকার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজছেন।
পাঞ্জাবের পরিস্থিতি দৃষ্টে ব্রিটিশ মন্ত্রীমণ্ডলের ৫ই ফেব্রুয়ারির সিদ্ধান্তের নিম্নোদ্ধৃত অংশ উল্লেখযোগ্য: “ভারতবর্ষে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। …(সম্ভবতঃ) মিস্টার জিন্নার উদ্দেশ্য হল ঐরকম স্থিতি সৃষ্টি করা।…পাঞ্জাবে তাদের (মুসলিম লীগের কার্যকলাপের কী পরিণাম হবে তা বলা কঠিন।…এর ফলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হবে কিনা, শেষ অবধি তার উপরই লীগ গুরুতর অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারবে কিনা তা নির্ভর করছে।”(১১) অসামরিক প্রশাসন ভারতবর্ষে বহু এলাকাতেই অকার্যকরী প্রতিপন্ন হয়েছিল। সরকারি কর্মচারী এবং পুলিশের বিরুদ্ধে দাঙ্গার সময়ে স্বীয় সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতের বহু অভিযোগ ছিল। যে কোনো আধুনিক সরকারের শেষ ভরসা- সামরিক বাহিনীতেও যদি বিভেদ ও বিপর্যয় শুরু হয়, তাহলে প্রশাসন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটলী মন্ত্রীমণ্ডলের দুশ্চিন্তার সম্যক কারণ ছিল।
লীগের গণপরিষদে যোগ না দেবার সিদ্ধান্তের জন্য যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে তেসরা ফেব্রুয়ারি ওয়াভেল ধাপে ধাপে কর্তৃত্ব প্রত্যাহারের এক প্রস্তাব ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার কাছে পাঠালেন। যেহেতু দেশে স্বাভাবিক প্রশাসন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল তাই এই পরিকল্পনা এবং এর পূর্ণাহুতি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের শেষে যখন ইংরেজ সৈন্য ভারত ছেড়ে চলে যাবে তখন। তবে দেশে যাতে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় তার জন্য ইংরেজ সৈন্যের ভারত ত্যাগ প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হবে না। কিন্তু কংগ্রেস ও লীগের নেতারা এটা জানবেন, যাতে অন্তত অতঃপর তাঁরা দায়িত্বশীল হয়ে ভবিষ্যৎ প্রশাসন পরিচালনার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। সাম্রাজ্যের স্বার্থে ওয়াভেল তখনও পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধী এবং প্রশাসনের শেষ শরণ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বিভাজনও তিনি চান না। তবে একান্তভাবেই তা যদি অপরিহার্য হয়ে ওঠে তবে সুপরিকল্পিতভাবে এবং যথোপযুক্ত সময় নিয়ে তা করা তাঁর প্রস্তাবের অন্যতম অঙ্গ। আকস্মিক ক্ষমতা হস্তান্তরে যে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবার আশঙ্কা, তা পরিহার করার জন্য তাঁর এই দফায় দফায় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব।
ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা নাকি ১৭ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ পরিকল্পনা পায়নি। ইতিমধ্যে এটলী সরকার একটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে ভারত থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার এক পরিকল্পনা রচনা করে ফেলেছে যা প্রধানমন্ত্রী ২০শে ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করবেন। শুধু ওয়াভেল নয়, যে দুটি প্রদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবার সর্বাধিক আশঙ্কা—সেই বঙ্গ ও পাঞ্জাবের ছোটলাটরাও যথাক্রমে ১৪ই ও ১৬ই ফেব্রুয়ারি ভারত ছেড়ে চলে আসার সময়-সীমা প্রকাশ্যে ঘোষণার বিরুদ্ধে অভিমত দিয়েছিলেন। তাঁদের মতে এতে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক আরও খারাপ হবে এবং বিবদমান প্রধান রাজনৈতিক দল দুটির একমত হবার সম্ভাবনা তিরোহিত হবে। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ওয়াভেল ভারতসচিবকে জোর দিয়ে অনুরোধ করলেন যে প্রস্তাবিত ঘোষণায় যেন ভারত ছাড়ার সময়-সীমা বেঁধে না দেওয়া হয়। এটলী কিন্তু সে অনুরোধে কর্ণপাত করলেন না।
২০শে ফেব্রুয়ারি এটলী তাঁর নূতন ঘোষণা প্রচার করলেন। তাতে বলা হল যে, ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে দায়িত্বশীল ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে আসতে চায়। তবে ঐ সময়ের মধ্যে “পরিপূর্ণভাবে প্রতিনিধিত্বমূলক গণপরিষদের দ্বারা” সংবিধান রচিত হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মতো পরিস্থিতি দেখা না দিলে “মহামান্য সম্রাটের সরকারকে চিন্তা করতে হবে যে নির্দিষ্ট দিনে ব্রিটিশ ভারতের ক্ষমতা কার হাতে হস্তান্তর করা হবে—ব্রিটিশ ভারতের সমগ্র অংশের কোনো রকমের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অথবা কোনো কোনো এলাকায় বর্তমান প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে কিংবা অপর কোনো ভাবে যা সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত এবং ভারতবর্ষের জনসাধারণের পক্ষে সর্বাপেক্ষা হিতকারী পরিগণিত হয়।”(১২) এর সঙ্গে সঙ্গে একথাও ঘোষণা করা হল যে নূতন বড়লাট হিসাবে লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন মার্চের মধ্যেই কর্মভার গ্রহণ করবেন।
এটলীর পূর্বোক্ত ঘোষণায় সরাসরি পাকিস্তান মেনে না নিলেও ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে বিগত ১৬ই মে তারিখের পর প্রথমবার প্রকাশ্যে সংশয় প্রকাশিত হয়েছিল যে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব নাও হতে পারে। প্রয়োজনে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হতে পারে, একথাও বলা হয়েছিল। ২১শে বড়লাট নেহরু ও লিয়াকতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে আলোচনা করলেন। বড়লাটের মতে নেহরু আসন্ন দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। তবে কংগ্রেস-লীগ বোঝাপড়া না হলে পাঞ্জাব ও বঙ্গের বিভাজনের সম্ভাবনার কথাও বললেন। লিয়াক‍ নিজে কোনো অভিমত দিলেন না। বড়লাট জিন্নাকে আলোচনার জন্য দিল্লিতে আসাতে অনুরোধ জানালেও, অসুস্থতার জন্য তিনি মার্চের মধ্যভাগের পূর্বে আসতে অপারগ জানা গেল। তবে ২৪শে জিন্না বোম্বাই থেকে এটলীর ঘোষণা সম্বন্ধে মন্তব্য করলেন: “মুসলিম লীগ তার পাকিস্তান দাবির তিলমাত্র ছাড়বে না। ১০ কোটি মুসলমানদের মুক্তির ঐ একমাত্র পথ।”(১৩) অতঃপর লীগের সামনে মুখ্য প্রশ্ন হল, বঙ্গ ও সিন্ধু (সেখানে নূতন নির্বাচনের ফলে ইতিমধ্যে শক্তিশালী লীগ মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হয়েছে) ছাড়া প্রস্তাবিত পাকিস্তান এলাকার বাকি প্রদেশগুলির শাসনভার কী করে হস্তগত করা যায়। আসামের অবস্থা অনিশ্চিত। পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা পাবার উপায় নেই। কারণ ঐ দুই প্রদেশের বিধানসভাতেই লীগের সংখ্যগরিষ্ঠতা নেই। সুতরাং নিয়ন্ত্রণ বহিভূত পন্থায় প্রাণপণ চেষ্টা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
“ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে লাহোর অমৃতসর সহ ছটি শহরে প্রবলতর হিংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ্যমে পাঞ্জাবে বিস্ফোট তীব্রতর হল। লীগের তরুণ সমর্থকদল ‘আদালত ও সাধারণ নাগরিকদের ঘর-বাড়ি আক্রমণ করে সেখানে ব্রিটিশ পতাকার বদলে মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করা শুরু করলেন।” কয়েকজন পুলিশ এবং বহু অসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু ও আহত হবার ঘটনার পর খিজিরের মনোবল ভেঙে পড়ল এবং তিনি যাবতীয় বন্দীদের মুক্তি দিয়ে একমাস কাল ব্যাপী সভাসমিতির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে এবং এক সর্বদলীয় কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠনের আশা নিয়ে—ছোটলাট জেনকিন্সের মতে যা ‘একান্তই অসম্ভব’—মুসলিম লীগের সঙ্গে একটা ‘বোঝাপড়া’র সিদ্ধান্ত করলেন। লীগ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও “প্রত্যক্ষ কার্যসূচি” শুরু করেছিল, ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী ডাঃ খাঁ সাহেবের পেশোয়ারের বাড়ি ঘেরাও করে তার সবগুলি জানালা ভেঙে চুরমার করল এবং পুলিশ নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ‘গুলি চালাবার আদেশ উপেক্ষা করল’।”(১৪)
ফেব্রুয়ারির শেষে লিয়াকৎ অন্তবর্তী বাজেট পেশ করলেন। মৌলানার মতে বাজেটের মূল নীতি সম্বন্ধে লিয়াকৎ পূর্বাহ্নে কংগ্রেসি সদস্যদের সম্মতি নিয়েছিলেন। বাজেটে (গান্ধীর আগ্রহে) লবণ-কর রদ করার সিদ্ধান্ত ও তার জন্য যে ঘাটতি তা দূর করার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর উচ্চহারে কর ধার্য করার প্রস্তাব করা হয়। অধিকাংশ ব্যবসায়ী হিন্দু ও কংগ্রেস সমর্থক। তাই তাঁদের উপর এই অতিরিক্ত করধার্যকে তখনকার অবিশ্বাসের পরিবেশে কেবল ব্যবসা বাণিজ্যের বিকাশের পরিপন্থীই নয়, হিন্দু বা কংগ্রেসবিরোধীও মনে করা হয়।
পূর্বে যেমন বলা হয়েছে, দোসরা মার্চ খিজির হায়াৎ খাঁ পদত্যাগ করলেন এবং এইভাবে লীগের হিংসাত্মক “প্রত্যক্ষ কার্যসূচির” জয় হল। পাঞ্জাবের জনমত সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত হবার উপক্রম হলেও লীগ কিন্তু তখনই পাঞ্জাবে মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করতে পারল না। লীগনেতা মামদোতের নবাব বিধানসভার তাঁর ৮০ জন সদস্যের অতিরিক্ত মাত্র ৩ জন দলত্যাগীর সমর্থন সংগ্রহে সমর্থ হলেন। কিন্তু তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয় না। লীগের সাম্প্রদায়িক ভূমিকায় হিন্দু ও শিখ সদস্যরা তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক নয়। সুতরাং ঐ প্রদেশে ৯৩ ধারা বা ছোটলাটের শাসন কায়েম হল।
“পাকিস্তান” বলতে ঠিক কি বোঝায় সে সম্বন্ধে অমুসলমানদের সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি না দেওয়া পর্যন্ত অবিভক্ত পাঞ্জাবের লীগের পক্ষে সরকারের কর্ণধার হওয়া সম্ভব ছিল না। নাজিমুদ্দীনকে পাঞ্জাব সরকারের সঙ্গে লীগের একটা বোঝাপড়া করিয়ে দেবার জন্য পাঠানো হয়েছিল। সমস্যার মূল ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি এক অবিশ্বাস্য স্বীকারোক্তি করেন: ‘পাকিস্তান বলতে কি বোঝায় তা (তিনি) জানেন না,’ প্রত্যুত ‘মুসলিম লীগের কেউ-ই তা জানে না এবং এইজন্য লীগের পক্ষে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কোনো দীর্ঘমেয়াদী আলোচনা চালানো কঠিন।’…পাঞ্জাবকে অবিভক্ত রাখার অনুকূল কোনো ফর্মুলা যে জিন্না প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে পারেননি তার থেকেই তিনি কোন বিষয়কে প্রাথমিকতা দিতে চেয়েছিলেন তা বোঝা যায়। এজাতীয় কোন ফর্মুলা পাঞ্জাবের অমুসলমানদের গ্রহণযোগ্য হতে হলে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার দরকার ছিল এবং সেই কারণে কেন্দ্রে জিন্নার ভূমিকাকে ব্যাহত করত। কেন্দ্রে জিন্নার ভূমিকা তখন অন্তত সাময়িকভাবে হলেও স্পষ্টতঃ সাম্প্রদায়িক ভঙ্গি যুক্ত। সুতরাং পাঞ্জাবকে বিশৃঙ্খলার অভিমুখে যেতে দেওয়া হল।”(১৫)
পাঞ্জাবের অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটতে থাকল। “জেনকিন্স ৭ই মার্চ ওয়াভেলকে লিখলেন, ‘গতকাল অমৃতসর নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা গেছে। সন্ধ্যা নাগাদ শহর একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।… মনে হয় শহরের অধিকাংশ অধিবাসী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে
পৃষ্ঠা: ২৫৫

ফেলেছে…বহু অট্টালিকা আগুনে পুড়েছে। শহর থেকে…পলায়নরত অসংখ্য নরনারী বিশৃঙ্খলাকে আরও বিকট করে তুলেছে এবং রাওলপিণ্ডি থেকে…লুট….ও প্রচণ্ড দাঙ্গার খবর পাওয়া গেছে, যেখানে ২৫ জন মৃত ও সম্ভবত ১০০ জন আহত। শিয়ালকোট ও জলন্ধরও দাঙ্গা কবলিত। এসব ঘটনা সর্বদাই তিনটি স্তরের ভিতর দিয়ে যায়— প্রবল উন্মাদনা, যৎপরোনাস্তি আতঙ্ক এবং অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ’।”(১৬) “আশেপাশের বিধ্বস্ত গ্রামাঞ্চল থেকে হাজার হাজার উদ্বাস্তু রাওলপিণ্ডিতে সমবেত হওয়া শুরু করলেন। অমুসলমানদের উপর আক্রমণ অত্যন্ত বর্বরতা সহকারে সংগঠিত করা হয়েছে।’— জেনকিন্স ১৭ই মার্চ এই মর্মে তারবার্তা পাঠালেন। ‘রাওলপিণ্ডির ডেপুটি কমিশনারের বিশ্বাস, একমাত্র তাঁর জেলাতেই হতাহতের সংখ্যা ৫০০০ হবে।’ ঐদিন ছোটলাট আরও লিখলেন যে, পাঞ্জাবের দূরবর্তী অঞ্চলসমূহ থেকে ক্রমশ যে খবর আসছে তার থেকে একটা ‘সংগঠন ও ষড়যন্ত্রে’র আভাস ফুটে উঠেছে। …রাওলপিণ্ডির বিভিন্ন অংশে কেন একযোগে…বিস্ফোরণ ঘটেছে….এবং সেসব যেন সুপরিকল্পিত ও নিখুঁত ভাবে কার্যকরী করা। প্রভাবিত জেলাসমূহের সব মুসলমানই মনে হয় এইসব ঘটনাবলীর সঙ্গে যুক্ত অথবা তার প্রতি সহানুভূতিশীল। সপ্তম ডিভিশনের সেনাধ্যক্ষ আমাকে বলেছেন…কোনো কোনো ক্ষেত্রে অমুসলমানদের প্রতি আক্রমণ সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার—পেনসন-প্রাপ্তদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে…। যেসব স্থানীয় সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সঙ্গে আমি কথা বলার সুযোগ পেয়েছি…তাঁদের মুখমণ্ডল চাপা ক্রোধে কৃষ্ণবর্ণ…অমুসলমানরা সরকারি কর্মচারী এবং বিশেষ করে পুলিশদের প্রতি তীব্রভাবে বিরূপ’।”(১৭)
পেনড্রেল মুনের মতে মুসলমান জনসাধারণ তখন, “…হঠাৎ যেন কোনো পূর্বনির্ধারিত ইঙ্গিত পেয়ে নিজেদের যথার্থ স্বরূপে বাইরে বেরিয়ে এবং হাতে অস্ত্র নিয়ে ও কোথাও কোথাও লৌহ শিরস্ত্রাণ মাথায় দিয়ে এমন ব্যাপকভাবে হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগে প্রবৃত্ত হল যার ব্যাপকতার তুলনা পাঞ্জাবের বিগত একশত বৎসরের ইতিহাসে বিরল।”(১৮)
উত্তর ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বঙ্গ ও বিহারের চিতা তখনও বহ্নিমান। গান্ধী এবারে (৫ই মার্চ, ১৯৪৭) মানুষের শুভবুদ্ধি ফিরিয়ে আনার আর শান্তি প্রতিষ্ঠার “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে” মিশন নিয়ে নোয়াখালি থেকে বিহারে। গান্ধীর একদল সহকর্মী নোয়াখালিতে তাঁর ব্রত চালিয়ে যাচ্ছেন। সীমান্ত গান্ধীসহ অপর একদল সহকর্মী বিহারে সাধনা-রত।
কিন্তু সীমান্ত গান্ধীর নিজের ঘরে ইতিমধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। “স্থানীয় লীগ” পরিচয়ের অন্তরালে লীগেরই ক্ষমতালিপ্সু এক গোষ্ঠী আইনসঙ্গত কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য “প্রত্যক্ষ কর্মসূচি” শুরু করে দিয়েছে। প্রদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে অমুসলমানদের উপর ব্যাপক নিপীড়ন ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। কাজ চালানো গোছের আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সেনাবাহিনীকে তলব করতে হচ্ছে। তবুও পেশোয়ারের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে অমুসলমানদের হত্যা লুঠপাট ও তাদের সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। হাজারা জেলাতে বলপূর্বক ধর্মান্তকরণ এবং মন্দির ও গুরুদ্বারা ভস্মসাৎ করার ঘটনার বিবরণ পাওয়া গেছে। ছোটলাট ক্যারো লীগের আন্দোলনকে প্রোৎসাহিত করেছেন বলে তাঁকে অবিলম্বে পদচ্যুত করার জন্য ১৯শে মার্চ নেহরু বড়লাটকে লিখলেন।
ভারতবর্ষে তখন যে রক্তগঙ্গা বইছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ৬ই মার্চ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত সম্পর্কিত বিতর্কে চার্চিলের বক্তৃতা জিন্নার পক্ষে দুই দিক থেকে উৎসাহবর্ধক বলা চলে। প্রথমত জওহরলালের নেতৃত্বে “বর্ণ-হিন্দু”দের সরকার গড়তে দেওয়া তাঁর মতে এক “মৌলিক ভ্রান্তি” হয়েছে, কারণ তা এক “সম্পূর্ণ সর্বনাশে” পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয়ত অতঃপর ভারত বিভাজন যখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে তখন ব্রিটিশ সরকারের ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ক্রিপস প্রস্তাব অনুসরণ করা উচিত ছিল। খলিকুজ্জমার মতে এই প্রস্তাব দ্বারা চার্চিল “মুসলমানদের অধিকতর এলাকা দেবার জন্য প্রদেশসমূহের বিভাজন এড়াবার চেষ্টা করেছিলেন।”(১৯)
৮ই মার্চ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এটলীর ২০শে ফেব্রুয়ারির ঘোষণায় ব্রিটিশের ভারত ছাড়ার নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে আসন্ন গুরুতর দায়িত্ব নেবার জন্য প্রস্তুতি জানাল। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্কিং কমিটি এই সিদ্ধান্তও ঘোষণা করল যে, লীগের অসহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে পাঞ্জাব ও বঙ্গকে স্বতন্ত্রভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সম্ভাবনা দেখা দিলে ঐ দুই প্রদেশেরও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভাজন করতে হবে। কংগ্রেস এও সিদ্ধান্ত করে যে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার থেকে লীগের পদত্যাগের জন্য আর চাপ দেওয়া হবে না। জওহরলাল বরং লিয়াকতের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাঁকেও সাড়া দেবার জন্য অনুরোধ জানালেন। ৯ই জওহরলাল এক পত্রে ওয়াভেলকে ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন।
অবশেষে কংগ্রেস সরকারি ভাবে প্রদেশ (এবং তাই স্বভাবতই ভারত) বিভাজনে সম্মত হল। অর্থাৎ পাকিস্তানের দাবি প্রচ্ছন্নভাবে স্বীকৃত হল। উল্লসিত জিন্না ১২ই মার্চ বোম্বের মুসলমান সংবাদিকদের বললেন, “আমাদের আদর্শ, আমাদের লক্ষ্য, আমাদের মূল ও বুনিয়াদী সিদ্ধান্তসমূহ… কেবল হিন্দু প্রতিষ্ঠানদের থেকে ভিন্নই নয়, তারা বরং পরস্পরবিরোধী…। একটা সময় ছিল যখন পাকিস্তানের কথাকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া হত। কিন্তু আমি আপনাদের একথা বলতে চাই যে অপর কোনো সমাধান নেই যা আমাদের জনসাধারণের পক্ষে গৌরব ও সম্মানজনক…ইনশা আল্লা আমরা পাকিস্তান পাব।”(২০)
ভারত ত্যাগের পূর্বদিন ওয়াভেল শেষবারের মতো তাঁর শাসন পরিষদের সদস্যদের সভায় সভাপতিত্ব করার শেষে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ প্রসঙ্গে বললেন, “এক অতীব দুরূহ সময়ে ও সন্ধিকালে আমি বড়লাট হয়েছিলাম। যথা সাধ্য আমি আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। তবে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হল যার জন্য আমি পদত্যাগে বাধ্য হলাম। এই প্রশ্নে পদত্যাগ করে আমি ঠিক করেছি কিনা তা ভবিষ্যৎ ইতিহাসই বিচার করবে। তবে আপনাদের কাছে আমার আবেদন এই যে আপনারা তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না।”(২১)

২৮
পাদটীকা

১. ল্যারি কলিন্স ও ডোমিনিক লাপিয়ার; Mountbatten and Partition of India; বিকাশ, নূতন দিল্লি (১৯৮২); ৪২ পৃষ্ঠা।
২. হডসন; The Great Divide; ৩৭ পৃষ্ঠা।
৩. ল্যারি কলিন্স ও ডোমিনিক লাপিয়ার; Freedom at Midnight (নিউইয়র্ক) ১৯৭৫; ৪২ পৃষ্ঠা।
৪. পেনড্রেল মুন, অধ্যাপক লরেন্স জিরিঙ্গ, স্যার সিরিল ফিলিপস ও অধ্যাপক নিকলাস মানসার্গের এজাতীয় মন্তব্যের জন্য মূর; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১০৬-১০৭ দ্রষ্টব্য।
৫. এই জটিল প্রশ্ন সম্বন্ধে আজাদের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য: “শ্রীযুক্ত জিন্নার যুক্তি ছিল কেন্দ্র, প্রদেশসমূহ এবং প্রদেশগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ক্ষমতা বিভাজনের ভিত্তিতেই তিনি লীগকে ঐ পরিকল্পনা গ্রহণে রাজী করিয়েছিলেন। আসামের কংগ্রেস নেতারা এতে সম্মত হননি এবং কিছুটা দ্বিধার পর গান্ধীজী…আসামের নেতাদের প্রস্তাবিত ভাষ্যকে সমর্থন করেন। ন্যায়বিচারের খাতিরে আমাকে স্বীকার করতে হবে যে এ ব্যাপারে শ্রীযুক্ত জিন্নার বক্তব্য মোটামুটি যথার্থ ছিল। ন্যায়বিচার ও আমাদের স্বার্থ— উভয়দিক থেকেই কংগ্রেসের ঐ পরিকল্পনাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করে নেওয়া জয়া উচিত ছিল।”(সমগ্রন্থ; ১৯৮৮ সং; পৃষ্ঠা ১৮৭)।
৬. T.P.; দশম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৯৪৫-৯৪৬।
৭. T.P.; নবম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৫৪২-৫৪৩। তারিখবিহীন এই প্রতিবেদনটির একটি নকল ২৪শে জানুয়ারি অ্যাবেল ভারতসচিবের অবগতির জন্য পাঠান।
৮. প্যাটেলের একান্ত বিশ্বাসভাজন ভি. পি. মেনন জানিয়েছেন যে (Transfer of Power; পৃষ্ঠা ৩৫৮-৩৫৯) সর্দারের সম্মতিতে জানুয়ারি মাসেই তিনি ভারত বিভাজনের এক পরিকল্পনা রচনা করেন। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের উপর সারির কোনো কোনো নেতা ভারত বিভাগ অবধারিত মনে করা শুরু করেছেন।
৯. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩৩৭। প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে এজাতীয় জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা অসন্তুষ্ট ইংরেজ সিভিলিয়ানদের আর একটি চাল কিনা তা আরও গবেষণার বিষয়। পাঞ্জাব সরকার অবশ্য এর সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলেন।
১০. অন্যত্রও পাকিস্তানের জন্য সামরিক পদ্ধতিতে প্রস্তুতি চলছিল। এ সম্বন্ধে খলিকুজ্জমাঁর সাক্ষ্য উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে লীগ সমর্থক বেলুচিস্তানের কালাতের খাঁ দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে সম্পত্তি সংক্রান্ত এক পরামর্শের জন্য দেখা করেন। “মুসলমানদের পাকিস্তান দেওয়া না হলে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য যে প্রস্তুতি করা হচ্ছে তার কথাও তিনি আমাকে জানান। তিনি এক গেরিলা যুদ্ধ সংগঠন করার কথাও জানান যার জন্য শ্রীযুক্ত জিন্না ইসকন্দর মীর্জার সহায়তা তা লাভ করেছিলেন।”(সমগ্রন্থ; ৩৮২ পৃষ্ঠা)। খলিকুজ্জমা আরও জানিয়েছেন যে লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে না জানিয়েই আসামে মৌলানা ভাসানী “প্রত্যক্ষ কর্মসূচি” শুরু করে দিয়েছিলেন এবং অবশেষে জিন্নার নির্দেশে তাল সামলাতে তাঁকে আসামে যেতে হয়েছিল।
১১. মন্ত্রীমণ্ডলীর বৈঠকের বিবরণ। T.P.; নবম খণ্ড; ৬১৮ পৃষ্ঠা।
১২. সমগ্রন্থ; ৭৭৪ পৃষ্ঠা।
১৩. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৬৩৭৷
১৪. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩০৯। উদ্ধৃতি চিহ্নের ভিতরস্থ অংশ ভারতসচিবের কাছে পাঞ্জাবের ছোটলাট জেনকিন্সের ২৫শে ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদন থেকে। দ্রঃ T.P.; নবম খণ্ড; ৮১৪-৮১৫ পৃষ্ঠা।
১৫. ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২৩৮-২৩৯। উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যস্থিত অংশ ছাজ পাঞ্জাবের ছোটলাট জেনকিন্সের বড়লাটকে পাঠানো ২৮শে ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদন থেকে।
১৬. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ৩৩১ পৃষ্ঠা।
১৭. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩১৩-৩১৪। উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যস্থিত অংশ বড়লাটের সচিব অ্যাবেলের কাছে পাঠানো জেনকি-স-এর ১৭ই মার্চের প্রতিবেদন থেকে। দ্রঃ T.P.; নবম খণ্ড; ৯৬১-৯৬২, এবং ৯৬৫-৯৬৯ পৃষ্ঠা।
১৮. Divide and Quit; ৮৭ পৃষ্ঠা।
১৯. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩৮৮। খলিকুজ্জমাঁর এই মন্তব্য অবশ্য ভারতের স্বাধীনতা বিলের প্রসঙ্গে চার্চিলের অনুরূপ অভিমতের উপর।
২০. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ৩১২ পৃষ্ঠা।
২১. আজাদ; সমগ্রন্থ; ১৯৮৮ সং; ১৯৩-১৯৪ পৃষ্ঠা।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা – পাকিস্তান জিন্দাবাদ
২৯

ওয়াভেলের উত্তরাধিকারী ভারতের সর্বশেষ ইংরেজ বড়লাট মাউন্টব্যাটেন কিন্তু তাঁর পূর্বসুরীর পরামর্শের বিপরীত তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত গ্রহণেরই নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশ সম্রাটের নিকটাত্মীয়, নৌবাহিনীর অতি উচ্চপদস্থ অফিসার, প্রখর বুদ্ধিমান এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন তাঁর সুন্দরী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্না স্ত্রী লেডি এডইউনা ২২শে মার্চ ভারতে পদার্পণ করে ২৪শে থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর পিছনে ব্রিটিশ মন্ত্রীমণ্ডলীর পূর্ণ সমর্থনের শক্তি। এই সমর্থন এত প্রবল ছিল যে তাঁর কাজ করতে সুবিধা হবে বলে ব্রিটিশ সরকার মাউন্টব্যাটেনের দাবিতে পেথিক-লরেন্সের বদলে লিস্টওয়েলকে নূতন ভারতসচিব নিযুক্ত করেন। প্রত্যুত ভারতের শেষ বড়লাট হতে রাজী হবার পূর্বে তেসরা জানুয়ারি এটলীর কাছে মাউন্টব্যাটেন এই শর্ত রেখেছিলেন যে, অবিলম্বে ইংলন্ডকে ভারত ছাড়ার সময়-সীমা ঘোষণা করতে হবে।(১) এর ফলে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে—এই আশঙ্কা পাঞ্জাব ও বাংলার ছোটলাটদের ছিল—এ আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দেখেছি। ওয়াভেলও এ ব্যাপারে দুই ছোটলাটের সঙ্গে সহমত ছিলেন বলে তাঁকে প্রায় অমর্যাদাকর ভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়।
কুশলী জনসম্পর্ক-আধিকারিকদের প্রচার এবং মাউন্টব্যাটেন দম্পতির মোহময় ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত বিশেষত জওহরলাল ও আরও কোন কোন কংগ্রেস নেতার তাঁদের সম্পর্কে দুর্বলতার জন্য মাউন্টব্যাটেনকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে প্রায় ত্রাণকর্তা বলে চিত্রিত করার প্রয়াস করা হয়েছে। একথা সত্য যে বিভাজিত স্বাধীন ভারতবর্ষের সেই সহস্র সমস্যাজড়িত জন্মলগ্নে মাউন্টব্যাটেন স্বভাবত অন্যান্য কুশীলবদের তুলনায় অসম্পৃক্ত হওয়ায় ধীর মস্তিষ্কে শিশুরাষ্ট্রের প্রভূত সেবাও করেন। কিন্তু জন্মগত অভিজাত অহঙ্কারের সঙ্গে রূপ, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি ও ক্ষমতা হস্তান্তরের নাটকে তাঁর কেন্দ্রীয় ভূমিকার কারণ এক প্রবল উন্নাসিকতা তাঁর চরিত্রের অঙ্গীভূত হয়েছিল। এর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সরকারি জীবনীকারের মতে তাঁর কার্যপদ্ধতিতে “কিছুটা স্বীয় উদ্দেশ্যসাধন বৃত্তি এবং এমনকি ছলনাও পরিত্যাজ্য ছিল না” এবং উদ্দেশ্য ও উপায়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন আরও অনেকের মতো মাউন্টব্যাটেন স্বয়ং জানতেন যে, “কখনও কখনও তাঁর কার্যকৌশল অনৈতিকতার সীমা স্পর্শ করলেও তিনি বিশ্বাস করতেন যে অপেক্ষাকৃত মঙ্গলের জন্য কিছুটা ছলচাতুরীর শরণ নেওয়া যেতে পারে।”(২) তাঁর পূর্বোক্ত স্বভাবের বাস্তব নিদর্শন ব্রিটেনের স্বার্থে এদেশকে কমনওয়েলথে রাখার জন্য নানা স্তরে কূটকৌশল অবলম্বনের প্রমাণ সম্প্রতি এক ঐতিহাসিক বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।(৩) তাঁর এই স্বভাবের ফলে ৪০ কোটি মানুষের দেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকে মাউন্টব্যাটেন প্রায় “এলাম, দেখলাম, জয় করলাম”-এর মানসিকতা চালিত হয়ে দেশবিভাগকে অপরিহার্য ও অশোভন ভাবে ত্বরান্বিত করেন যার ফলে হাজার হাজার নর-নারী-শিশুর মৃত্যু ও মৃত্যুযন্ত্রণা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের সহস্রবিধ দুর্দশা ঘটেছিল। ইতিহাসে ব্যক্তির কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, বড়লাট হিসাবে মাউন্টব্যাটেনের কার্যকলাপ তার অপর এক নিদর্শন।
পৃষ্ঠা: ২৬০

অবশ্য সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে হবে যে ভারত-বিভাজনের জন্য মন তৈরি করে নিয়ে মাউন্টব্যাটেন বড়লাটের দায়িত্বভার গ্রহণ করেননি, যদিও একজন বিখ্যাত ভারতীয় এদেশে পদার্পণ করার পূর্বেই তাঁর কাছে এর জন্য সুপারিশ করেন। ইনি হলেন লন্ডনের ভারতীয় লীগের সম্পাদক এবং নেহরুর অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ও ব্যক্তিগত দূততুল্য কৃষ্ণ মেনন। ১৩ই মার্চ মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে কৃষ্ণ মেনন বলেন যে, তদানীন্তন পরিস্থিতির সমাধান হল উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দুটি “পাকিস্তান” প্রতিষ্ঠা। কলকাতার বদলে পূর্ব পাকিস্তানের যে বন্দরের প্রয়োজন তার জন্য যত ব্যয়ই হোক, চট্টগ্রামকে উন্নত করে পাকিস্তানের হাতে দেওয়া উচিত—এই অভিপ্রায় কৃষ্ণ মেনন ব্যক্ত করেন। এরপরও তিনি একাধিকবার ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে জওহরলালের অভিমতের প্রবক্তা হিসাবে বড়লাট ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন।(৪)
১৮ই মার্চ ভারত রওনা হবার প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী এটলী ভবিষ্যৎ বড়লাটকে যে নির্দেশ দেন তাতে বলা হয়: “মহামান্য সম্রাটের সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হল, গণপরিষদের মাধ্যমে সম্ভব হলে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ্যে ব্রিটিশ-ভারত ও ভারতীয় দেশীয় রাজ্যসমূহ নিয়ে একটিমাত্র শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন।… সকল পক্ষকে সম্মিলিতভাবে এই উদ্দেশ্যসাধনে ব্রতী হবার জন্য আপনার শক্তিতে যতটা কুলোয় আপনি তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবেন…। পহেলা অক্টোবরের মধ্যে আপনার যদি মনে হয় যে এক-কেন্দ্রিক সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে কোনো বোঝাপড়ায় উপনীত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই…তাহলে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আপনার মতে কোন্ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত সে সম্বন্ধে মহামান্য সম্রাটের সরকারকে জানাবেন…ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া যাতে যথাসম্ভব নির্বিঘ্ন হয় তার জন্য এতদাভিমুখে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হবে তার প্রতি ভারতীয় নেতাদের পরিপূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া বাঞ্ছনীয়।”(৫)
মাউন্টব্যাটেনকে প্রদত্ত পূর্বোক্ত নির্দেশাবলী ভারতীয় রাজনীতির তদানীন্তন জটিল পরিস্থিতিতে একাধারে ক্রম-অপ্রচলিত ও পরস্পরবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ই মে তারিখের প্রস্তাবানুসারে সর্বজনস্বীকৃত সমাধান খুঁজে বার করার জন্য দায়িত্ব নেবার দিন থেকেই নেহরু ও লিয়াকতের সঙ্গে মাউন্টব্যাটেন আলোচনা শুরু করলেন। এছাড়া আলোচনার উদ্দেশ্যে দিল্লিতে আসার জন্য জিন্না ও গান্ধীকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন।
দাঙ্গাপীড়িত বিহারে সদ্ভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে সাময়িক ক্ষান্তি দিয়ে গান্ধী ৩১শে মার্চ থেকে তেসরা এপ্রিল পর্যন্ত দিল্লিতে বড়লাটের সঙ্গে আলোচনা করলেন। ১লা এপ্রিল আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য এক দুঃসাহসিক প্রস্তাব দিলেন। বললেন যে, বড়লাট যেন তদানীন্তন অন্তর্বর্তী সরকারকে ভঙ্গ করে দিয়ে জিন্নাকেই নিজ মনোমত সদস্যদের নিয়ে নূতন সরকার গঠন করতে আমন্ত্রণ জানান। গান্ধী প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, যতদিন সেই সরকার সকল ভারতবাসীর মঙ্গলজনক পন্থা অনুসরণ করবে ততদিন কংগ্রেস যাতে জিন্নার সরকারকে আন্তরিক সমর্থন জানার তার ব্যবস্থা তিনি করবেন। কোন্ পন্থা তাবৎ দেশবাসীর পক্ষে হিতকর তার সালিশী হবেন স্বয়ং মাউন্টব্যাটেন —একথাও গান্ধী বললেন। ভারত বিভাজন পরিহার করার এ প্রস্তাব জিন্না তখন গ্রহণ করতেন কিনা সন্দেহ। কারণ এতে সর্বদাই তাঁকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কৃপাপরবশ হয়েই থাকতে হত। তবে ৫ই এপ্রিল থেকে জিন্নার সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের যে আলোচনা হয়, সে- সময়ে তিনি তাঁর কাছে গান্ধীর ঐ প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেননি। এর সম্ভাব্য কারণ এই যে ঐদিনই নেহরুকে গান্ধীর প্রস্তাব জানাবার পর তিনি এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন যে, দীর্ঘদিন ক্ষমতা হস্তান্তরের আলোচনার সঙ্গে যুক্ত না থাকার জন্য গান্ধী এরকম অবাস্তব সমাধানের প্রস্তাব করেছেন। অবশ্য ১১ই এপ্রিল গান্ধী এক পত্রে বড়লাটকে জানান যে কংগ্রেস নেতারা তাঁর ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।(৬)
৫ই এপ্রিল থেকে শুরু করে ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত জিন্নার সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের একটানা আলোচনা চলে, যার শেষে বড়লাটের ধারণা হয় যে “শ্রীযুক্ত জিন্না মানসিক রোগগ্রস্ত”। প্রথম দিনের আলোচনার শেষে মাউন্টব্যাটেন তাঁর সচিবের কাছে মন্তব্য করেন, “ওরে বাবা! ভদ্রলোক হিমশীতল ছিলেন। সাক্ষাৎকারের অধিকাংশ সময় তাঁর জমে যাওয়া অবস্থা দূর করতেই কাটে।”(৭) প্রথম দিনের আলোচনায় মাউন্টব্যাটেন একটানা যুক্ত ভারতবর্ষের পক্ষে যুক্তিজাল বিস্তার করেন। “জিন্না ‘কোনো বিরুদ্ধ যুক্তি দেখাননি। তিনি এই ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন যে, কোনো কথা তিনি যেন শুনতেই পাচ্ছিলেন না।’ তবে ধারণারও বাড়া এ; তাঁর তাবৎ প্রয়াস ও লক্ষ্য ছিল না শোনা—তিনি তাঁর মনস্থির করে নিয়েছিলেন। মাউন্টব্যাটেনের এতদিনের বিশ্বাস—মানুষ যুক্তিচালিত, তার প্রতি প্রকাশ্য অবজ্ঞা তাঁর আচরণে ফুটে উঠেছিল। জিন্নার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পূর্বে মাউন্টব্যাটেন কখনো চিন্তা করতে পারেননি যে, ‘এজাতীয় সম্পূর্ণ দায়িত্ববোধের অভাববিশিষ্ট কোনো ব্যক্তির পক্ষে তাঁর মতো অত ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া সম্ভব।”(৮)
বড়লাটের কর্মচারীদের প্রধান জেনারেল ইসমের মতে তখন “শ্রীযুক্ত জিন্নার মানসিক গঠনের প্রভাবশালী উপাদান ছিল হিন্দুদের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা ও ঘৃণা। প্রত্যুত তিনি মনে করতেন যে, তাবৎ হিন্দু মনুষ্যেতর জীব যাদের সঙ্গে মুসলমানদের পক্ষে একত্র বসবাস করা অসম্ভব।”(৯) “প্রথম কয়েক সপ্তাহে মাউন্টব্যাটেন এক জিন্না বাদে আর সবার সঙ্গে ভারতবর্ষের ঐক্য সম্বন্ধে কিছুটা নাটকোচিত সংলাপ বলে কাটালেন। তবে গান্ধী ছাড়া আর সকলেই ভিতরে ভিতরে বুঝে গিয়েছিলেন যে, ভারতীয় ঐক্যের আদর্শ পরাজিত হয়ে গেছে। ১১ই এপ্রিল তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার সময়ে মাউন্টব্যাটেন স্বীকার করলেন যে জিন্নাকে তাঁর ভূমিকা থেকে সরানো সম্ভবপর নয় এবং তাঁর সম্মতি ব্যতিরেকে একমাত্র সেনাবাহিনীর অস্ত্রবলেই ভারতবর্ষে ঐক্য জোর করে চাপানো সম্ভব…। ইসমেকে ভারতবর্ষের বিভাজনের একটি পরিকল্পনা রচনা করার দায়িত্ব দেওয়া হল”(১০)
প্রথমোক্ত সুদীর্ঘ আলোচনা থেকে শুরু করে দোসরা জুনের মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব সরকারি ভাবে উপস্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত নানা আলোচনা প্রসঙ্গে জিন্না বড়লাটকে জানান যে তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া না করলে মুসলমানরা কোনো প্রস্তাব মানবেন না এবং তাঁর দাবি হল ভারতবাসীদের মধ্যে মতৈক্য স্থাপন করার ব্যর্থ প্রয়াস না করে ব্রিটিশ সরকারকেই একটা রোয়েদাদ দিতে হবে। সেই রোয়েদাদে পাকিস্তানকে নীতিগতভাবে মেনে নিতে হবে এবং পাকিস্তানের নিজস্ব সৈন্যবাহিনীও থাকবে। তারপর লীগ সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থায় যোগদান করতে পারে। মাউন্টব্যাটেন জানান যে জিন্নার সেই প্রস্তাব স্বীকার করে নিলেও নিছক সেনাবাহিনীকে ঐভাবে ভাগ করতে পাঁচ বছর সময় লাগবে। অথচ ইংরেজ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুনের পর কোনোমতেই ভারতে থাকতে প্রস্তুত নয়। ইংরেজ সত্যসত্যই এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ শুনে জিন্না বিস্মিত ও বিচলিত হন এবং অবিশ্বাসের হাসি হেসে বড়লাটকে প্রশ্ন করেন যে, তাহলে তাঁরা কি ভারতকে বিশৃঙ্খলা রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধের কবলে ফেলে চলে যাবেন? মাউন্টব্যাটেন অতঃপর বলেন যে জিন্নাকে হয় ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব স্বীকার করতে হবে আর নচেৎ খণ্ডিত পাঞ্জাব ও বিভক্ত বঙ্গসহ পাকিস্তান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। জিন্না বলেন যে, পাঞ্জাব ও বঙ্গ বিভাজনের দাবি কংগ্রেসের “ধাপ্পা”। এর উদ্দেশ্য হল “তাঁকে ভয় দেখিয়ে পাকিস্তানের দাবি থেকে নিরস্ত করা।” তাঁর মতে পাকিস্তানে যথেষ্ট অমুসলমান সংখ্যালঘু থাকলে পাকিস্তান হিন্দুস্থানের সঙ্গে দরাদরি করার ব্যাপারে অধিকতর শক্তিশালী অবস্থায় থাকবে। বড়লাটের কাছে তিনি মিনতি জানালেন যে “বঙ্গ ও পাঞ্জাবের ঐক্য যেন নষ্ট না করা হয়। কারণ (ঐ দুই প্রদেশের) সাধারণ জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান: এক ইতিহাস, এক ধরনের জীবনযাত্রা পদ্ধতি; এবং যেখানে হিন্দুদের ভিতর কংগ্রেসের সদস্যের তুলনায় বাঙালি বা পাঞ্জাবির মানসিকতা প্রবলতর।”(১১) বড়লাট জিন্নাকে জানিয়ে দিলেন যে ভারত বিভাগের পক্ষে তাঁর তাবৎ যুক্তি পাঞ্জাব ও বঙ্গ বিভাজনের পক্ষেও প্রযোজ্য এবং ঐ দুই প্রদেশের অমুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অস্বীকার করা সম্ভব নয়। জিন্না তখন পৃথক পৃথকভাবে প্রদেশগুলিকে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরামর্শ দিলেন, যাতে অন্তত কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতা লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। জবাবে মাউন্টব্যাটেন জিন্নাকে পৃথক পৃথক ভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তাঁকে সাহায্য করতে আমন্ত্রণ জানান। বলাবাহুল্য জিন্নার পক্ষে মাউন্টব্যাটেনের এই চালের জবাব দেওয়া সম্ভব ছিল না। পাকিস্তানের দুই প্রধান প্রদেশের বিভাজনের দায়িত্ব নিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। বড়লাটের সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিবরণ জানাবার জন্য তিনি লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা তো আহ্বান করলেনই না, বড়লাট অনুরোধ জানালেন যে প্রদেশগুলির অভিমত যাচাই-এর পদ্ধতি যেন খোলসা করে ব্যক্ত করা না হয়।(১২)
ইতিমধ্যে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও হানাহানির বিরতির কোনো নিদর্শন নেই। এপ্রিলের মাঝামাঝি এক সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে পাঞ্জাবে বিগত এক মাসে ৩৫০০ জনের মৃত্যু হয়, যার ছয় ভাগের এক ভাগ মুসলমান এবং বাকি হিন্দু ও শিখ। ছোটলাট জেনকিন্সের অভিজ্ঞতা এই যে, পাঞ্জাবের লীগ নেতারা তাঁদের যুব কর্মীদের দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করার মধ্যে নিন্দার কিছু দেখছেন না। তাঁর বক্তব্য—পারলে তিনি স্বয়ং এবং পাঞ্জাবের ইংরেজ কর্মচারীরা এই মুহূর্তে সে প্রদেশ ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তুত। কারণ “আমাদের মনে হচ্ছে যে আমারা এখন এমন মানুষদের মধ্যে বসবাস করছি যারা নিজেদের ধ্বংস করতে কৃতনিশ্চয়।”(১৩) উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে হিন্দু-শিখ নিধনযজ্ঞ বন্ধ করতে কংগ্রেস সরকার অক্ষম, উপরন্তু কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো জিন্না ৭ই মে এক বিবৃতি প্রসঙ্গে প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ডাঃ খাঁ সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন যে, তাঁর অনুগামীদের প্রতি সর্বতোভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে।(১৪) ডেরা ইসমাইল খাঁ শহরের অর্ধেকে ভস্মসাৎ। বোম্বাই ও বারাণসীতে কারফিউ। কলকাতায় থেকে থেকে দাঙ্গা। ভারতের জনমত দ্রুত মুসলমান অমুসলমান—দুই যুধুধান শিবিরে বিভক্ত হচ্ছে। দেশ বিভাজনের গুজব ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ব্যাপক বাস্তুত্যাগও শুরু হয়ে গেছে।
পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও লীগ নেতাদের এক যৌথ শান্তি-আবেদন জারি করার অনুরোধ করলেন। উভয় দলই এ প্রস্তাবে রাজী হলেও এবং আবেদনের বয়ান স্বীকৃত হলেও, কংগ্রেসের তরফ থেকে সে আবেদনে দলের সভাপতি কৃপালনী স্বাক্ষর করবেন শুনে লীগ সভাপতি জিন্না পিছিয়ে গেলেন। বললেন, কৃপালনীর মতো একজন “অজ্ঞাত সাধারণ ব্যক্তির” সঙ্গে একযোগে তাঁকে স্বাক্ষর করতে বলা লীগের অসম্মান। তাঁর মর্যাদা রক্ষার জন্য গান্ধীর চেয়ে কম দরের কারও সই করা চলবে না। কংগ্রেস প্রথমে এ দাবির বিরোধিতা করলেও শেষ অবধি নতিস্বীকার করল। জিন্না ইংরাজিতে সই করলেন এবং গান্ধী করলেন ইংরাজি ছাড়াও হিন্দি ও উর্দু—উভয় ভাষাতেই। ১৫ই এপ্রিল জারি করা ঐ যৌথ আবেদনে বলা হল:
“কারা আক্রমণকারী আর কারা তার শিকার ছিল—এ বিচারে না গিয়ে আমরা সাম্প্রতিক আইন-শৃঙ্খলার বিরোধী হিংসাত্মক ঘটনাবলীর জন্য গভীর পরিতাপ ব্যক্ত করছি। এই সব ঘটনা ভারতের সুনামের উপর দূরপনেয় কলঙ্ক লেপন করছে এবং নির্দোষ ব্যক্তিদের আত্যন্তিক দুঃখ-দুর্দশার কারণ হয়েছে।
“রাজনৈতিক লক্ষ্য সাধনের জন্য হিংসার সহায়তা নেওয়াকে আমরা সর্বথা নিন্দা করি এবং দল-মত-নির্বিশেষে ভারতবর্ষের সকল সম্প্রদায়ের কাছে এই আবেদন জানাই যে তাঁরা কেবল হিংসা ও বিশৃঙ্খলার যাবতীয় কার্যকলাপ থেকেই দূরে থাকবেন না, লেখায় এবং কথায়ও এজাতীয় পদক্ষেপের প্ররোচনাদানকারী শব্দাবলী পরিহার করবেন।”(১৫)
দাঙ্গাগ্রস্ত এলাকায় ঐ যৌথ আবেদন মুদ্রিত করে ব্যাপকভাবে ছড়ানো হলেও তার কোনো সুফল দেখা গেল না। পক্ষান্তরে লীগের মুখপত্র “ডন” এই প্রয়াসকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে তার ১৮ই এপ্রিলের সংখ্যায় মন্তব্য করল: “দুই জনগোষ্ঠী এবং দুই জাতি নিজেদের বিশিষ্ট নেতাদেরই মাত্র শ্রদ্ধা করবে—এ না হলে এজাতীয় এক আবেদনের কারণ কিসের জন্য দেখা গেল?” যাই হোক, ভারত বিভাজনের জন্য জিন্না বাহ্যত তৈরি হয়ে গেলেও এই পর্যায়ে জিন্না এক অভিমত ব্যক্ত করেন যে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানকে নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হতে হবে। কারণ “পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান শেষ পর্যন্ত কাছাকাছি এলেও—এবং তাঁর অনুমান ও বিশ্বাস এই যে এমনটা হবে—কোনো শক্তিশালী আক্রমণকারীর সম্মুখে এককভাবে দাঁড়াতে পারবে না।”(১৬) কিন্তু সম্ভবত গণপরিষদে ২৮শে এপ্রিল “ইউনিয়ন পাওয়ার্স কমিটি”র যে প্রথম প্রতিবেদন পেশ হয় এবং তার ফলে সীমিত ক্ষমতাযুক্ত এক কেন্দ্রের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগসূত্র স্থাপনের জিন্নার ক্ষীণ আশা চিরতরে লুপ্ত হয়।(১৭)
অতঃপর উভয় পক্ষের পক্ষে গ্রহণীয় একটা সমাধানসূত্র খুঁজে বার করার জন্য জিন্না ও গান্ধীর সঙ্গে বড়লাট ভবনে এক আকস্মিক সাক্ষাৎকার হল। এই ব্যর্থ আলোচনার বিবরণ দান প্রসঙ্গে অ্যালান-ক্যাম্পবেল জনসন লিখেছেন: “ঘটনাচক্রে সাক্ষাৎকার দুটির সময় অভিন্ন হয়ে গেল এবং মাউন্টব্যাটেনের ভিতর গত তিন বছরের মধ্যে এই প্রথম নেতৃদ্বয়কে মিলিত হতে দেবার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং সামাজিক সৌজন্যবোধ ছিল। কিন্তু পরস্পরকে নমস্কারাদি জানাবার আনুষ্ঠানিকতা একবার সমাপ্ত হবার পর উভয়ের মধ্যে সাক্ষাৎকার মাউন্টব্যাটেনের সব হিসাব-কিতাবকে মিথ্যা প্রমাণিত করল। কারণ বেশ কিছুটা ব্যবধানে উপবিষ্ট গান্ধী ও জিন্না তাঁদের কণ্ঠস্বরকে প্রয়োজনীয় উচ্চগ্রামে তুলতে অসমর্থ হলেন। এর ফলে তাঁদের দুজনকে দূর থেকে মূকাভিনয়ে নিরত দুই বৃদ্ধ ষড়যন্ত্রকারীর মতো প্রতীয়মান হতে লাগল।”(১৮) প্রথম প্রয়াসের ব্যর্থতার পর মাউন্টব্যাটেনের পীড়াপীড়িতে গান্ধী ৬ই মে আবার জিন্নার সঙ্গে মিলিত হলেন। এবার মিলনস্থল জিন্নার আগ্রহে তাঁর নিবাসে। প্যাটেলসহ গান্ধীর অন্তরঙ্গরা অনেকে এভাবে তাঁর (জিন্নার) বাসগৃহে গিয়ে মিলিত হবার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু গান্ধী মান-মর্যাদার প্রতি ভূক্ষেপ না করে জিন্নার বাড়িতে গিয়ে দ্বিতীয়বার ব্যর্থ আলোচনা করলেন। আলোচনা-শেষে জিন্না এক বিবৃতিতে জানালেন যে গান্ধী ভারত বিভাজনের নীতিতে বিশ্বাস করেন না, অথচ তাঁর নিজের বিশ্বাস হল, “পাকিস্তান কেবল অপরিহার্যই নয় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সমস্যাবলীর একমেব বাস্তব সমাধান।”(১৯) এই আলোচনার পর জিন্না মাউন্টব্যাটেনকে লিখলেন যে, “পাকিস্তানের প্রশ্ন আলাপ-আলোচনার বিষয় নয়।”(২০)
ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত পরবর্তী প্রসঙ্গে যাবার পূর্বে বঙ্গের মুসলিম লীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা অতঃপর বলা প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে বাংলা থেকে লীগের প্রতিনিধি করা ঐ প্রদেশের লীগের উভয় গোষ্ঠীর নেতা সুরাবর্দী ও নাজিমুদ্দীন কারও কাছেই প্রীতিপদ হয়নি। সুরাবর্দী ও শরৎচন্দ্র বসুর সার্বভৌম বঙ্গের প্রস্তাবের পটভূমি এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য। পরবর্তীকালে এই প্রস্তাব নিয়ে আন্তরিকভাবে অগ্রসর হবার জন্য যদিও সুরাবর্দীর নাম এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, এর যথার্থ জনক কিন্তু বঙ্গীয় লীগের সম্পাদক ও সুরাবর্দী-গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা আবুল হাশিম। হাশিম লীগের মধ্যে বিরল সংখ্যক প্রগতিশীল নেতাদের অন্যতম, কুশলী সংগঠক ও প্রভাবশালী বাগ্মী ছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়ে তাঁরা সার্বভৌম বঙ্গের প্রস্তাবের খসড়া রচনা করলেন। এর মূল কথা হল বঙ্গের বিভাজন নয়, এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে বিকাশ। ব্রিটিশ সরকারের ২০শে ফেব্রুয়ারি ঘোষণার পর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভার বঙ্গ বিভাজনের দাবি এবং ক্রমশঃ হিন্দু মালিকানার সংবাদপত্র কংগ্রেসের একাংশ ও অন্যান্য দলের নেতাদের কণ্ঠেও এর প্রতিধ্বনি ওঠে। কমিউনিস্ট পার্টি গোড়া থেকেই আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে পাকিস্তানের দাবির সমর্থন করছিল। চৌঠা এপ্রিলের এক প্রস্তাবে বঙ্গীয় কংগ্রেস ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গের যেসব এলাকা ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় তাদের সে অধিকার দেবার অর্থাৎ পাকিস্তানের পটভূমিকায় বঙ্গ বিভাজনের দাবি জানায়।
বঙ্গ বিভাজনের দাবি অতঃপর লীগের এক শ্রেণীর নেতাদের কাছে আকস্মিক আঘাতরূপে প্রতীয়মান হয়। বঙ্গের একাংশ নিয়ে পাকিস্তান গড়ার বদলে তাঁরা অখণ্ড বঙ্গের জন্য জনমত সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয় মনে করেন। সুরাবর্দীও কলকাতা ও নোয়াখালির দাঙ্গার পর উপলব্ধি করেছিলেন যে তাঁর নেতৃত্বের নিরাপত্তার জন্য হিন্দু-মুসলমানের মিলিত রাজনীতিই বাঞ্ছনীয়। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ৮ই মার্চের প্রস্তাবে পরোক্ষভাবে ভারত বিভাজন স্বীকার করে নেবার পর থেকে বঙ্গের কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসু প্রকাশ্যেই বঙ্গ বিভাগের বিরোধিতা করছিলেন। অপর এক কংগ্রেস নেতা কিরণশঙ্কর রায়ও এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গী হলেন। এর সঙ্গে সুরাবর্দীর প্রয়াস মিলিত হওয়ায় সার্বভৌম বঙ্গের আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। প্রথম দিকে নাজিমুদ্দীনও এর সমর্থক ছিলেন। সার্বভৌম বঙ্গে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুরা রাজনৈতিক ক্ষমতার যথোচিত অংশ পাবেন—এই
পৃষ্ঠা: ২৬৫

প্রতিশ্রুতি সুরাবর্দী ও আবুল হাশিম দিলেন। শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে সুরাবর্দী ও আবুল হাসিমের কয়েক দফা আলোচনার পর তেসরা মে প্রাদেশিক লীগের ওয়ার্কিং কমিটি বাংলার ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্বন্ধে হিন্দু নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ৬জন সদস্যের একটি উপসমিতি গঠন করল।
কিন্তু প্রাদেশিক লীগের আক্রাম খাঁ গোষ্ঠী সুরাবর্দী ও হাশিম প্রচারিত “বাঙালি জাতীয়তাবাদের” বদলে “মুসলিম জাতীয়তাবাদের” সমর্থক ছিল এবং তাই পাকিস্তানের কাঠামোর বাইরে বাংলার হিন্দুদের সঙ্গে কোনোরকম বোঝাপড়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাঁরাও বঙ্গ বিভাজনের বিরোধী, তবে অবিভক্ত বঙ্গকে পাকিস্তানের অঙ্গীভূত করার জন্য শরৎচন্দ্র বসু ও সুরাবর্দী এ ব্যাপারে পৃথক পৃথকভাবে গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তিনি রাজনৈতিক চুক্তির উপর গুরুত্ব দেবার বদলে হিন্দুদের মনের যে ভয় ও অবিশ্বাসের জন্য তাঁরা বঙ্গ বিভাগের পক্ষে, তা দূর করার জন্য চেষ্টা করার পরামর্শ দেন। প্রস্তাবের প্রথম প্রবক্তা আবুল হাশিমও গান্ধীর সমর্থন পাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি গান্ধীকে বিশেষ প্রভাবিত করতে পারেননি।(২১) সুরাবর্দী ১৪ই ও ১৫ই মে এ ব্যাপারে যথাক্রমে বড়লাট ও জিন্নার সঙ্গে আলোচনা করেন। মাউন্টব্যাটেনও ইতিপূর্বে (২৬শে এপ্রিল) এসম্বন্ধে জিন্নার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।(২২) তখন জিন্না এপ্রস্তাবের বিরোধী না হলেও পরবর্তীকালে বঙ্গীয় লীগের জিন্নাপন্থীরূপে পরিচিত আক্রাম খাঁ (ইনিও বঙ্গ বিভাজনের বিরোধী, তবে সম্পূর্ণ বঙ্গকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য) ও নাজিমুদ্দীন গোষ্ঠীর প্রভাবে সার্বভৌম বঙ্গের প্রকাশ্য সমর্থন করা থেকে বিরত থাকেন। এর ফলে ২৮শে মে প্রাদেশিক লীগের ওয়ার্কিং কমিটি সার্বভৌম বঙ্গের প্রস্তাবের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ সর্বতোভাবে জিন্নার উপর সমর্পণ করে। জওহরলাল ও প্যাটেলের মতো কংগ্রেস নেতারা তো এর বিরোধী ছিলেনই। হাইকম্যান্ডকে এড়িয়ে প্রাদেশিক স্তরে এরকম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তাঁদের পছন্দ ছিল না। তাঁদের মনে আশঙ্কা ছিল যে সমগ্র বঙ্গই তাহলে শেষ অবধি পাকিস্তানের কবলিত হবে। এছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল। কোন একটি প্রদেশকে এভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নীতি একবার মেনে নিতে দিলে অন্য যে কোনো প্রদেশ এমন দাবি করতে পারে। বিশেষ করে ত্রিবাঙ্কুর কোচিনের মত কোনো কোনো বৃহৎ দেশীয় রাজ্যের শাসক এরকম দাবি উচ্চকণ্ঠে তুলেছিলেন। সে অবস্থায় ভারতে এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এই একই কারণে কংগ্রেস সীমান্ত গান্ধীর দাবি—পাখতুনীস্তানের দাবিতে ঐ প্রদেশে গণভোট গ্রহণ সমর্থন করতে পারেনি। প্রাদেশিক লীগের মতো প্রদেশ কংগ্রেস কোনো স্তরেই সরকারিভাবে এ প্রস্তাবের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। সুতরাং সুরাবর্দী ও শরৎচন্দ্র বসুর প্রস্তাব অবশেষে পরিত্যক্ত হল।(২৩)
ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের বিভাজন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের এক পরিকল্পনা নিয়ে মাউন্টব্যাটেনের তরফ থেকে ইসমে বিলাতে গেছেন এবং ব্রিটিশ মন্ত্রীমণ্ডল তার কিছুটা পরিবর্তনের পর অনুমোদন করে ১০ই মে বড়লাটকে পাঠিয়ে দিয়েছে। মাউন্টব্যাটেন ভেবেছিলেন যে কংগ্রেস ও লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর পরিকল্পনা রচিত বলে তা উভয় পক্ষের গ্রহণযোগ্য হবে। তবু কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে তাঁর সন্দেহ ছিল বলে আর কাউকে সেই পরিকল্পনা না দেখিয়ে কেবল জওহরলালকে একান্তভাবে সেটি দেখতে দেন। বড়লাটের অতিথি হয়ে নেহরু তখন সিমলায়। এই “প্ল্যান বল্কানে” প্রদেশ অথবা প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিভক্ত প্রদেশের অংশবিশেষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রস্তাব ছিল যার পরে ইচ্ছামতো এক বা একাধিক কেন্দ্রের সঙ্গে তারা যুক্ত হতে পারবে। কিন্তু এতে এমনকি অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ অথবা প্রদেশের অংশগুলির জন্য একটি মাত্র শক্তিশালী কেন্দ্রের নিশ্চিত ব্যবস্থা না থাকায় নেহরু বড়লাটের কাছে তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করেন। কয়েকদিন পরে ঐ পরিকল্পনা সম্বন্ধে জিন্নার প্রতিক্রিয়া জানাতে বলায় তিনিও কঠোরভাবে তার বিরোধিতা করে লেখেন: “মুসলিম লীগ বঙ্গ ও পাঞ্জাবের বিভাজনে সম্মত হতে পারে না।…ঐতিহাসিক, আর্থিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক দিক থেকে এর যুক্তি নেই। এই প্রদেশ দুটি প্রায় এক শতাব্দী যাবৎ নিজ নিজ বিশিষ্ট জীবনযাত্রা-পদ্ধতির বিকাশসাধন করেছে…এবং এদের বিভাজনের যে একমাত্র যুক্তি উপস্থাপিত করা হচ্ছে তা হল যেসব এলাকায় হিন্দু ও শিখেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই সব অঞ্চলকে অন্যান্য অঞ্চল থেকে পৃথক করতে হবে।…এর পরিণাম প্রদেশদ্বয়ের জীবনে এবং সকল সম্প্রদায়ের পক্ষে সর্বনাশা হবে। … আপনারা যদি এজাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন—যা আমার মতে এক চরম সিদ্ধান্ত হবে—কলকাতাকে পূর্ববঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করা উচিত হবে না…সর্বনাশ যদি অবধারিত হয়ই, কলকাতাকে এক মুক্ত বন্দরে পরিণত করা উচিত।”(২৪) বাংলাকে অবিভক্ত রাখার জন্য জিন্না যেমন একসময়ে সুরাবর্দী ও শরৎচন্দ্র বসুর প্রস্তাবে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়েছিলেন, পাঞ্জাবকে অবিভক্ত-রূপে পাকিস্তানে পাবার জন্য তিনি শিখ-নেতাদের নেহরু-প্যাটেলের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধা দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বড় দেরিতে জিন্না ভারত বিভাজনের দাবির যুক্তিসঙ্গত পরিণতি—বঙ্গ ও পাঞ্জাব বিভাগের বিপজ্জনক পরিণামের কথা উপলব্ধি করেছিলেন।
“যে ‘দুই জাতি’ তত্ত্বের বলে জিন্না কেন্দ্রে লীগের জন্য ক্ষমতার অংশ পাবার আশা পোষণ করেছিলেন তা অতঃপর এক তলোয়ারে পরিণত হয়ে তাঁর পাকিস্তানকে যথাযথ আকারে কর্তন করা আরম্ভ করেছিল। জিন্নার রণকৌশলের পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপায় ছিল পাঞ্জাব ও বঙ্গকে অবিভক্ত রাখার জন্য ঐ দুই প্রদেশে প্রাদেশিক স্তরে একটা বোঝাপড়া হওয়া। কিন্তু সাত বছর যাবৎ ‘পাকিস্তানে’র জন্য উচ্চৈঃস্বরে প্রচার ও আসলে অর্থনৈতিক অভিযোগসমূহের ক্রমবর্ধমানহারে সাম্প্রদায়িক পরিভাষায় ব্যাখ্যা করার পরিণামস্বরূপ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ প্রত্যুত অসম্ভব ছিল।…পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় স্ববিরোধ ছিল এই যে জিন্নার পক্ষে তাঁর অনুগামীদের বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন হতে এবং কেন্দ্রে তাঁর দাবি স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত অন্যান্য সম্প্রদায়ের সদস্যদের প্রয়োজনীয় সুবিধা দিতে পরামর্শ দেবার উপায় ছিল না। অথচ পাঞ্জাব ও বঙ্গের লীগ নেতারা তাঁদের প্রদেশ অবিভক্ত রাখার কোনোরকম একটা সূত্র উদ্ভাবন করতে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রে তাঁর দাবি পূর্ণ করার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। যে নেতার দাবি এজাতীয় টলটলায়মান ভিত্তির উপর স্থাপিত, তাঁর পক্ষে চূড়ান্ত সমাধানের কোন শর্ত নির্দেশ করা সম্ভবপর নয়।”(২৫)
ভারতের পরিস্থিতি তখন এতই অগ্নিগর্ভ যে ১৯শে মে বড়লাট ব্রিটিশ মন্ত্রীমণ্ডলীকে জানান যে, “কোনো না কোনো রূপে পাকিস্তানের দাবি মেনে না নিলে মুসলিম লীগ অস্ত্র ধারণ করবে।”(২৬)
যাই হোক, বড়লাট তাই ভি. পি. মেননের সাহায্যে পূর্বোক্ত পরিকল্পনার সংশোধন করে তার অনুমোদনের জন্য আবার বিলাতে পাঠান এবং ইসমের পরামর্শে মন্ত্রীমণ্ডলীকে সে সম্বন্ধে বোঝাবার জন্য ১৮ই মে তিনি স্বয়ং বিলাতে যান। নেহরু লিখিতভাব সংশোধিত পরিকল্পনা সাধারণভাবে অনুমোদন করেন। জিন্না এতে মোটামুটি সম্মতি জানালেও কিছু লিখে দিতে অস্বীকার করেন। তবে ২১শে মে রয়টারের প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তিনি প্রস্তাবিত পাকিস্তানের উভয় অংশের সঙ্গে সংযোগের জন্য এক ৮০০ মাইল লম্বা করিডর বা সংযোগ-ভূমি দাবি করেন(২৭) এবং ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার কাছে এক তারবার্তা প্রেরণ করে পাঞ্জাব ও বঙ্গের বিভাজন সম্বন্ধে দুই প্রদেশের অভিমত গণভোটের মাধ্যম যাচাই করার দাবি করেন। ঐ বক্তব্যেই জিন্না ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের স্বরূপ সম্বন্ধে প্রথমবার একটা স্পষ্ট ধারণা দেবার চেষ্টা করেন এবং বলেন যে পাকিস্তান ধর্ম- ভিত্তিক রাষ্ট্র হবে না। পাকিস্তানে “হবে এক জনপ্রিয় প্রতিনিধিত্বমূলক ও গণতান্ত্রিক শাসন- ব্যবস্থা”– যেখানে মন্ত্রীমণ্ডল পার্লামেন্টের প্রতি দায়িত্বশীল থাকবে এবং উভয় প্রতিষ্ঠান “জাতি ধর্ম বা সম্প্রদায়ের পার্থক্য না করে শেষ পর্যন্ত নির্বাচকমণ্ডলী ও জনসাধারণের প্রতি দায়িত্বশীল থাকবে।” পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের প্রতি আশ্বাসবাণী দিলেন যে তাঁরা “সুরক্ষিত এবং নিরাপত্তাযুক্ত”। কারণ তাঁরা “জাতি ধর্ম বর্ণের পার্থক্য নির্বিশেষে… পাকিস্তানের নাগরিক” হবেন। সেইজন্য তাঁর মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে তাঁদের প্রতি “ন্যায়সঙ্গত সমুচিত আচরণ করা হবে” এবং “পার্লামেন্টের যৌথ বিবেক স্বয়ং এই বিষয়ের নিশ্চয়তা হবে যাতে সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো অবিচার করা হতে পারে—এমন কোনো আশঙ্কা তাঁদের মনে না থাকে।”(২৮) উভয় রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন যে তা হৃদ্যতাপূর্ণ হবে বলে তাঁর আশা। কারণ “পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানের মধ্যে উভয়ের পারস্পরিক স্বার্থে এবং যে কোনো আক্রমণেচ্ছুক বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে একটা জোট- বাঁধা চুক্তি বা সন্ধি হবে বলে আমি বিবেচনা করি।” ত্রিশের দশক থেকে একটানা কেবল মুসলিম অধিকার প্রচারের পর পুনরপি জিন্না ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন।
অবশেষে মাউন্টব্যাটেনের সংশোধিত প্রস্তাবেও ব্রিটিশ মন্ত্রীমণ্ডলীর সম্মতি পাওয়া গেল। ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনকে আরও এগিয়ে আনার উদ্দেশ্যে যথাসম্ভব শীঘ্র ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যাতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে তার জন্য মাউন্টব্যাটেন বিরোধী পক্ষের নেতা চার্চিলের সঙ্গে ২০শে মে কথা বলেন। ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে এবং উভয় উপনিবেশই ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ্যে থাকবে একথা জেনে চার্চিল প্রস্তাবিত আইন প্রণয়নে তাঁর দলের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। “মাউন্টব্যাটেন যখন জানালেন যে নেহরু ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনে এই শর্তে রাজী হয়েছেন যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে এবং জিন্না তখনও ইতস্তত করছেন, তখন চার্চিল গভীর বিস্ময় সহকারে বললেন, ‘ঈশ্বরের দোহাই তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ব্রিটিশের সাহায্য ছাড়া যাঁর চলে না।’ কোনো প্রকার দ্বিধার পরিণামে পাকিস্তানের কী বিপদ হতে পারে তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুসলিম নেতার কাছে চার্চিল এক ব্যক্তিগত বার্তা পাঠালেন।”(২৯) চার্চিলের পরামর্শের সারমর্ম ছিল: “দুই হাত বাড়িয়ে আপনি যদি এই প্রস্তাব গ্রহণ না করেন তবে ব্যাপারটা পাকিস্তানের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হবে।”
২৩শে মে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা সরকারিভাবে অনুমোদন করে। দোসরা জুন মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে স্বাধীনতা দেবার তাঁর ঐতিহাসিক প্রস্তাবে ভারতীয় নেতাদের সম্মতি পাবার জন্য তাঁদের সঙ্গে মিলিত হলেন। জিন্নাসহ লিয়াক‍ আলী খাঁ ও আবদুর রব নিস্তার ছিলেন লীগের পক্ষ থেকে। কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন জওহরলাল ও বল্লভভাই ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের সভাপতি কৃপালনী। এছাড়া আকালীদের তরফ থেকে ছিলেন সর্দার বলদেব সিং। প্রস্তাবের সারমর্ম হল পাঞ্জাব ও বঙ্গের বিভাজন করে মুসলমান ও অমুসলমানের ভিত্তিতে অবিলম্বে পাকিস্তান ও ভারতবর্ষ নামক দুই রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ কংগ্রেস শাসিত সীমান্ত প্রদেশ এবং কংগ্রেস শাসিত অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আসামের শ্রীহট্ট জেলা কোন্ রাষ্ট্রে যোগদান করতে চায় তা নির্ধারিত হবে গণভোটের দ্বারা। ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে বড়লাট বললেন যে প্রস্তাবের মূল বক্তব্য সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই তাঁদের জানানো হয়েছে এবং তাই সেইদিনই মধ্যরাত্রির ভিতর তাঁদের চূড়ান্ত অভিমত তাঁকে জানাতে হবে। “মাউন্টব্যাটেন এমন এক দ্রুত পদক্ষেপে তাঁদের সামনে ঠেলে নিয়ে যেতে দৃঢ়সঙ্কল্প হয়েছিলেন যে তাঁদের মধ্যে কারও পক্ষে এ ব্যাপারে পুনর্বিচার করা অথবা প্রস্তাবের বিশদ বিবরণ নিয়ে কোনোরকম হৈ-চৈ বাধাবার অবকাশ না জোটে।”(৩০)
কংগ্রেস প্রতিনিধিরা সীমান্ত প্রদেশের গণভোট এবং নূতন দুই ডোমিনিয়নের একটি কমনওয়েলথ না ছাড়লে অপরটি ছাড়তে পারবে কিনা সে সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলা ছাড়া মাউন্টব্যাটনের প্রস্তাব মেনে নিলেন। জিন্না কিন্তু পাঞ্জাব ও বঙ্গ বিভাজনের ব্যাপারে লীগ ওয়ার্কিং কমিটির আপত্তির কথা জানালেন এবং তাঁর কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর সম্মতি জানাতে প্রস্তুত হলেন না। মাউন্টব্যাটেনের খুব চাপাচাপির ফলে তিনি অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তাব সম্বন্ধে তাঁর স্বীকৃতি জানালেন। “মাউন্টব্যাটেনের কোনো কথাই তাঁকে বিচলিত করতে সমর্থ হল না।…এই যদি আপনার মনোভাব হয়, তাহলে কংগ্রেস ও শিখদের নেতারা আগামীকাল সকালের সভায় এ প্রস্তাবে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেবেন না। তার পরিণামে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে এবং সম্ভবত চিরকালের জন্য আপনি আপনার পাকিস্তান হারাবেন।’ ‘যা হবার তা-ই হবে’—এই ছিল তাঁর একমাত্র প্রতিক্রিয়া। ‘মিস্টার জিন্না! এই বোঝাপড়ায় উপনীত হবার জন্য যে প্রভূত পরিশ্রম করতে হয়েছে আপনি তা ভণ্ডুল করে দিন—এ আমি হতে দিতে পারি না। আপনি যখন মুসলিম লীগের তরফ থেকে এ প্রস্তাবে স্বীকৃতি দিতে রাজী হচ্ছেন না, তখন আমি নিজেই তাঁদের হয়ে কথা বলব।…আমার শর্ত কেবল একটিই এবং তা হল এই যে সকালের সভায় আমি যখন বলব যে, ‘মিস্টার জিন্না আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তা আমি স্বীকার করে নিয়েছি ও তাতে আমি সন্তুষ্টও বটে, আপনি তখন কোনোক্রমেই তার প্রতিবাদ করবেন না। আর তারপর আমি যখন আপনার দিকে তাকাব, আপনি স্বীকৃতিসূচক…মাথা নাড়বেন।’ এ প্রস্তাবের প্রত্যুত্তর দিলেন জিন্না ঐ মাথা নেড়ে।”(৩১)
পরদিবসের (তেসরা জুন) ভারতীয় নেতাদের আনুষ্ঠানিক সভায় পূর্বোক্ত পদ্ধতিতে মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবে জিন্নার সম্মতি পাওয়া গেল। সম্মতি পাওয়া মাত্রই বড়লাট দেশ বিভাগকে কার্যকরী করার জন্য অতঃপর যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে তার জন্য পূর্বেপ্রস্তুত এক দস্তাবেজ ভারতীয় নেতাদের হাতে তুলে দিলেন। ভারত ব্যবচ্ছেদের ভীষণ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তাঁদের মনে যে আলোড়ন সৃষ্টি হল তার বিবরণ মাউন্টব্যাটেন প্রায় অগ্নিশিখায় লেলিহান রোম নগরী দৃষ্টে নীরোর মত মানসিকতা-চালিত হয়ে লিপিবদ্ধ করে গেছেন: “উপস্থিত সকলে এই আঘাতের ফলে এমন প্রচণ্ডভাবে বিহ্বল হয়ে পড়লেন… যে ব্যাপারটা যদি অমন বিয়োগান্তক না হত তবে তাকে মজাদারই বলা যেত।’ ঘটনাটা বিয়োগান্তক হবার কারণ হল এই যে কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কোনো দলই ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উপর-উপর ভাবে ছাড়া চিন্তা করেনি। তাদের কাছে স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং দেশ বিভাজনই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ লক্ষ্য ছিল। এবারে তাঁরা বুঝলেন যে এ কেবল সূত্রপাত।”(৩২) তেসরা জুন সন্ধ্যায় দিল্লি বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বড়লাট ও নেহরুর পর জিন্না বিশ্বকে তাঁর দীর্ঘদিনের প্রয়াসের সাফল্য – পাকিস্তান অর্জনের সংবাদ ঘোষণা করলেন। অতঃপর পাকিস্তানের জন্ম কেবল সময়ের ব্যাপার।
জুনের ৯ই দিল্লির ইম্পিরিয়াল হোটেলের বলরুমে লীগ কাউন্সিলের সভা হল। কিন্তু পাঞ্জাব ও বঙ্গের বিভাজন-বিরোধী লীগ প্রতিনিধিদেরই একাংশের তীব্র বিরোধের ফলে সভা শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত হতে পারেনি। কোনো কোনো বক্তা একে “বিশ্বাসঘাতকতা” এবং “পাকিস্তানের দূরদৃষ্ট” আখ্যা দেন। তাঁদের সব সময়ের হাতিয়ার বেলচা কাঁধে খাকসারা জিন্নার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য জোর করে হোটেলের মধ্যে প্রবেশ করে। তাঁদের সভা থেকে বহিষ্কৃত করতে লীগের ন্যাশনাল গার্ডদের বিশেষ বেগ পেতে হয়। আলোচনা-শেষে লীগ কাউন্সিল “চূড়ান্ত ফয়সালা’ নয়, “আপোস” হিসাবে বিপুল সংখ্যাধিক্যে (বিপক্ষে মাত্র ১১টি ভোট পড়ে) পরিকল্পনা গ্রহণ করার স্বীকৃতি দেয়। ১৫ই জুন অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিও বিপুল সংখ্যধিক্যে ওয়ার্কিং কমিটির দেশ বিভাগের প্রস্তাব অনুমোদন করে। তবে এর জন্য গান্ধীকে সদস্যদের কাছে আবেদন করতে হয়েছিল এবং তারপরও ট্যান্ডন ছাড়াও সমাজবাদীগোষ্ঠী এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। বঙ্গ ও পাঞ্জাবের বিধানসভা যথাক্রমে ২০শে ও ২৩শে জুন প্রদেশ বিভাজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২৬শে জুন সিন্ধু বিধানসভা সংখ্যাধিক্যে এক নূতন গণপরিষদে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। ইতিমধ্যে প্রবল সাম্প্রদায়িক প্রচারের মধ্যে শ্রীহট্ট ও সীমান্ত প্রদেশে গণভোট-পর্ব সমাপ্ত হয়। ৭ই জুলাই শ্রীহট্ট ৫৫,৫৭৮ ভোটের সংখ্যাধিক্যে বঙ্গ ও সেই কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়। সীমান্ত প্রদেশে “পাখতুনিস্তানের” দাবিতে গণভোট গৃহীত না হবার প্রতিবাদে তত্রস্থ কংগ্রেস সরকারিভাবে তাতে অংশগ্রহণ না করলেও ১৭ই জুলাই যখন তার পরিণাম ঘোষিত হয় তখন দেখা যায় যে “পাকিস্তানের পক্ষে ২৮৯, ২৪৪ এবং “হিন্দুস্থানে”র পক্ষে মাত্র ২,৮৭৪টি ভোট পড়েছে। এইভাবে জিন্না যাকে “বিকলাঙ্গ ও কীটদষ্ট” পাকিস্তান বলে ক্ষোভ করেছিলেন তা বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করে।
জিন্না ইতিমধ্যে দিল্লি থেকেই তাঁর নূতন রাষ্ট্রে স্বার্থরক্ষার জন্য সাংবিধানিক লড়াই চালিয়ে গেলেন। কংগ্রেসের দাবি ছিল যে ভারত বিভাগ ও পাকিস্তানের গণপরিষদ গঠন আনুষ্ঠানিকভাবে স্থির হয়ে যাবার পর লীগ প্রতিনিধিদের অন্তর্বর্তী সরকার থেকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু জিন্নার যুক্তি অনুসারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রস্তাবিত ভারতের স্বাধীনতার বিল গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত বড়লাট কংগ্রেসের দাবি স্বীকার করতে সম্মত হলেন না। জিন্না এর পর প্রস্তাব করলেন যে দিল্লিতেই যুগপৎ ভারত ও পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশন
পৃষ্ঠা: ২৭০

হোক। মাউন্টব্যাটেন এর অনুকূল হলেও কংগ্রেসের নেতৃবর্গ কোনোমতেই ভারতের মাটিতে পাকিস্তানের গণপরিষদের সভার অনুষ্ঠানে সম্মতি দিলেন না। জিন্না প্রথমে চেয়েছিলেন যে মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবিত উভয় ডোমিনিয়নের সম্মিলিত বড়লাট (Super Governor General) হিসাবে ভারত বিভাগের প্রক্রিয়ার তদারকী ও প্রয়োজনে মধ্যস্থতা করুন। ব্রিটিশ সরকার তাঁদের প্রতিনিধি কর্তৃক মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব স্বীকার করেনি, তবে ভারত বিভাগের খুঁটিনাটি সহজ করার উদ্দেশ্যে উভয় রাষ্ট্রের একটি বড়লাটের প্রস্তাবে রাজী হয়েছিলেন। কংগ্রেস ইতিপূর্বে মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের নিয়মতান্ত্রিক বড়লাট হবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। জিন্নাও এরকম প্রস্তাবের আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু ১লা জুলাই জিন্না মাউন্টব্যাটেনকে জানিয়ে দিলেন যে তিনিই পাকিস্তানের প্রথম বড়লাট হতে চান।
হতবুদ্ধি রাজপ্রতিনিধিকে জিন্না বললেন, “আমার পদমর্যাদার দিক থেকে দেখতে গেলে আমারই পরামর্শ দেওয়া উচিত এবং আর সকলে তদনুসারে কার্য করবেন।”(৩৩) মাউন্টব্যাটেন জিন্নার এ প্রস্তাব শুনে সিদ্ধান্ত করলেন যে তিনি হয় উন্মাদ হয়ে গেছেন আর নচেৎ উৎকট ধরনের “আত্মগরিমা”র ব্যাধিতে ভুগছেন। মাউন্টব্যাটেনের যুক্তি, তর্ক, অনুরোধ এবং এমনকি শাসানী উপেক্ষা করেও জিন্না তাঁর দাবিতে অটল রইলেন। শিব রাও-এর মতে গোলটেবিল বৈঠকের সময়ে এক জ্যোতিষী জিন্নাকে বলেন যে কর্মজীবনের শেষে তিনি এক স্বতন্ত্র দেশের প্রধান হবেন। তাঁর অবচেতন মনে শুধু বড়লাট হবার পিছনেই নয়, স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবির পিছনেও ঐ ভবিষ্যদ্বাণী ক্রিয়া করে থাকতে পারে।(৩৪) ডঃ আয়েষা জালালের মতে মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস-ঘেঁষা এবং তাঁর মাধ্যমে কংগ্রেস পাকিস্তান এলাকায় লীগ ও জিন্না বিরোধী কার্যকলাপে উস্কানি দিতে পারে ইত্যাদি বিবেচনা ছাড়াও “জিন্নার মনে হয়েছিল যে সেনাবাহিনীর বিভাজনের ক্ষেত্রে ঐ পদে থাকায় তাঁর অপেক্ষাকৃত সুবিধা হবে এবং পাকিস্তানের প্রদেশগুলির উপর কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেবার জন্য তাঁর কাছে যা সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় ছিল তা হল সৈন্যবাহিনী।”(৩৫) এত ক্ষমতা অপর কাউকে দেওয়া সমীচীন নয়, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর কাছ থেকে আদেশ নিতে হবে এবং তা ছাড়া ঐ পদে অভিষিক্ত হলে তিনি মাউন্টব্যাটেন ও এটলী প্রমুখের সঙ্গে সমানে সমানে কথা বলতে পারবেন ও কায়েদ-এ-আজম হিসাবে তাঁর সৃষ্টি নূতন রাষ্ট্রে একমাত্র ঐ পদই তাঁর পক্ষে শোভন—এসব মানসিকতাও ঐ সিদ্ধন্তের পিছনে কাজ করে থাকবে। প্রথম এশিয়াবাসী হিসাবে ঐ উচ্চপদ অধিকার করার আকাঙ্ক্ষাও জিন্নার মনে হয়তো ছিল। যে কালব্যাধিতে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন তার কথা তিনি ও তাঁর চিকিৎসক ছাড়া আর কেউ (এমনকি ভগ্নী ফতিমাও) না জানলেও তার গুরুত্ব সম্বন্ধে তিনি সম্যক অবহিত ছিলেন। তাঁর ক্ষীয়মান স্বাস্থ্য উদ্বেগের কারণ হচ্ছিল। উলপার্টের মতে ক্ষমতা ভোগ করার সময় আর নাও মিলতে পারে—এই মানসিকতা তাঁর পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তের পিছনে ক্রিয়া করার প্রবল সম্ভাবনা।(৩৬)
৬ই জুলাই জিন্না ভারতবর্ষে যেসব মুসলমানদের থেকে যেতে হচ্ছে তাঁদের এই পরামর্শ দিলেন যে, “সংখ্যালঘুরা যে রাষ্ট্রের অধিবাসী তার প্রতি অনুগত হবেন।”(৩৭) ১৩ই জুলাই জিন্না এক সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের “আশ্বাস” দেন যে তাঁর সদ্যজাত ডোমিনিয়নে তাঁদের ‘ধর্ম, বিশ্বাস, জীবন, সম্পত্তি এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণ’ দেওয়া হবে।” তিনি আরও বলেন যে সংখ্যালঘুরা “ভেদভাবরহিত ভাবে সর্ববিষয়ে পাকিস্তানের সমান অধিকারবিশিষ্ট নাগরিক হবেন।…ভারতবর্ষের সংখ্যালঘুদের প্রতিও একই নীতি প্রযোজ্য হবে।…শ্রীযুক্ত জিন্না এই আন্তরিক বিশ্বাস ব্যক্ত করলেন যে ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হবে।”(৩৮) দেশ বিভাগ একবার স্বীকার করে নেবার পর তার রূপায়ণের বাধক কোনো রকম অশান্তির চিহ্ন দেখা দিলেই তা কঠোর হাতে এমনকি সামরিক বাহিনী নিয়োগ করে দমন করা হবে—মাউন্টব্যাটেনের এই গুরুগম্ভীর প্রতিশ্রুতিকে(৩৯) ব্যঙ্গ করেই যেন ইতিমধ্যে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার আগুন ভারতবর্ষের দিকে দিকে লেলিহান হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেল সংখ্যালঘুদের বাস্তুত্যাগ। আর কয়েকদিন পরে র‍্যাডক্লিফ রোয়েদাদ ঘোষিত হবার পরই এই হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও বাস্তুত্যাগ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে বিশ্বের ইতিহাসে মনুষ্যের দুর্দশার অদ্বিতীয় নিদর্শনরূপে লিপিবদ্ধ হবে।
এই পটভূমিকায় ৭ই আগস্ট অসংখ্য মানুষের “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” ও “কায়েদ- এ-আজম জিন্দাবাদ” ধ্বনির মধ্যে জিন্না বড়লাটের ডাকোটা বিমানে করাচী বিমানবন্দরে প্রস্তাবিত নবরাষ্ট্রের রাজধানীতে পদার্পণ করলেন। বিমানবন্দর থেকে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট সরকারি বাসগৃহ (যা পূর্বে ছোটলাটের নিবাস ছিল) পর্যন্ত সমগ্র পথ জনসাধারণের উচ্ছ্বসিত অভিনন্দনে সাড়া দেবার পর সিঁড়ি দিয়ে ঐ সুরম্য হর্মের ভিতর প্রবেশ করতে করতে তাঁর নবনিযুক্ত সহায়ক নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট এস. এম. আসানকে উদ্দেশ্য করে জিন্না বললেন, “জানো, আমার জীবিতকালে পাকিস্তান দেখে যেতে পারব—এমন আশা আমি কখনো করিনি। আমরা যা অর্জন করেছি তার জন্য ঈশ্বরের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।”(৪০) ঐদিনই স্থায়ীভাবে ভারতবর্ষ ছাড়ার পূর্বে যাঁরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছিলেন তাঁদের ধন্যবাদ দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “অতীতকে কবর দিতে হবে এবং আসুন আমরা হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান নামক এই দুই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের শুভারম্ভ করি। হিন্দুস্থানের সমৃদ্ধি ও শান্তির জন্য আমি কামনা জানাই।”(৪১)
আমাদের জিন্না-জীবনবৃত্ত-পরিক্রমার সমাপ্তিও এইখানে।

২৯
পাদটীকা

১. জালাল; সমগ্রন্থ; ২৩৬ পৃষ্ঠা। হডসন; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৯৪। জাইগলার; Mountatten; উইলিয়াম কলিন্স, লন্ডন (১৯৮৫); পৃষ্ঠা ৩৫৫। T.P.; নবম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৪৫১। জাইগলার অবশ্য একথাও জানিয়েছেন যে বড়লাট হিসাবে মাউন্টব্যাটেনের নাম প্রস্তাবিত হবার পূর্বেই মন্ত্রীসভায় এর প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে কথা হয় এবং প্রত্যক্ষভাবে এটলী এবং প্রকারান্তরে ওয়াভেলেরও এ ব্যাপারে ভূমিকা ছিল।
২. জাইগলার; সমগ্রন্থ; ৩৬৪ পৃষ্ঠা।
৩. মূর; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৪৩-৫০৭ পৃষ্ঠা।
৪. T.P.; নবম খণ্ড; ৯৪৮-৯৪৯ পৃষ্ঠা।
৫. T.P.; নবম খণ্ড; ৯৭২-৯৭৪ পৃষ্ঠা।
৬. প্যারেলাল; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৭৯-৮৪। আরও দ্রষ্টব্য T.P.; দশম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৬৯-৭০। এ সম্বন্ধে মৌলানার বক্তব্য: “দুর্ভাগ্যক্রমে জওহরলাল ও সর্দার প্যাটেলের তীব্র বিরোধিতার জন্য এই পদক্ষেপ তেমন অগ্রগতি করতে পারেনি। বস্তুতঃ তাঁরা গান্ধীজীকে এ প্রস্তাব প্রত্যাহারে বাধ্য করেন।”(সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৮৭)।
৭. অ্যালান-ক্যাম্পবেল জনসন; Mission With Mountbatten; ৫৬ পৃষ্ঠা।
৮. জাইগলার; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩৬৮। উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে মাউন্টব্যাটেনের উক্তি বড়লাটের ১১ই এপ্রিল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের কর্মীসভার বিবরণী থেকে (দ্রঃ T.P.; দশম খণ্ড; পৃষ্ঠা ১৯০)। এ সম্বন্ধে পরবর্তীকালে মাউন্টব্যাটেনের মন্তব্য: “আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনি যে একজন বুদ্ধিমান, উচ্চশিক্ষিত এবং ইংলন্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিজের মনের দুয়ারকে এমনভাবে বন্ধ করে রাখতে পারেন। তিনি যে এটা বুঝতে পারতেন না তা নয়—তিনি স্রেফ মনের দরজাকে বন্ধ করে দিতেন। যেন দরজার পাল্লা বন্ধ হয়ে যেত। তখন আমি উপলব্ধি করলাম যে তিনি যতদিন জীবিত থাকবেন কিছুই করা যাবে না। আর সবাইকে বোঝানো সম্ভব হত, কিন্তু জিন্নাকে নয়।”(ল্যারি কলিন্স ও ডোমিনিক ল্যাপিয়ার; Mountbatten and the Partition of India; পৃষ্ঠা ৪৪।)
৯. T.P; দশম খণ্ড; ১৯০ পৃষ্ঠা।
১০. জাইগলার; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩৭৩-৩৭৪। T.P.; দশম খণ্ড; ১৯২ পৃষ্ঠাও দ্রষ্টব্য।
১১. তুলনীয় মাউন্টব্যাটেনের জবানবন্দীতে জিন্নার উক্তি: “…পাঞ্জাব এক জাতি (nation )। বঙ্গ এক জাতি। হিন্দু বা মুসলমান হবার পূর্বে মানুষ পাঞ্জাবি বা বাঙ্গালি।”(ল্যারি কলিন্স ও ডোমিনিক লাপিয়ার; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৪৩)।
১২. উভয়ের আলোচনার বিবরণের জন্য T.P.; দশম খণ্ড; পৃষ্ঠা ১৩৮-১৮৮ দ্রষ্টব্য। পরবর্তীকালে ঐসব আলোচনা প্রসঙ্গে মাউন্টব্যাটেন ল্যারি কলিন্স ও ডোমিনিক ল্যাপিয়ারের কাছে যেসব মন্তব্য করেন তা তাঁদের Mountbatten and Partition of India গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর কয়েকটি হল: “শ্রীযুক্ত জিন্না চিরকাল ব্রিটিশের অধীনে চালিয়ে যেতে খুবই সুখী বোধ করতেন।”(পৃষ্ঠা ১৫) “একটানা ‘না’ বলার কারণ তিনি (জিন্না) যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তা তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।”(পৃষ্ঠা ৩৯)। “জিন্না ছিলেন একক ঐক্যতান বাদন।”(পৃষ্ঠা ৩৯)। “জিন্না বিকৃত-মস্তিষ্ক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ কারবার করা একেবারেই—সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব।”(পৃষ্ঠা ৪০)। “…তিনি (জিন্না) ছিলেন একমাত্র—আবার বলছি একমাত্র বাধা।”(পৃষ্ঠা ৪০)। “তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এ (অবিভক্ত ভারত) সম্ভব হতে দেননি। জিন্নার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হবার পূর্বে আমি বুঝতে পারিনি যে ব্যাপারটা কী পরিমাণ অসম্ভব হতে চলেছে…আমি বুঝতে পারিনি যে জিন্নার ব্যাপারে কিছুই করা সম্ভব নয়। তিনি তাঁর মন একেবারে তৈরি করে নিয়েছিলেন। কোনো কিছুতেই তাঁকে নড়ানো সম্ভব ছিল না (পৃষ্ঠা ৪২)।” “…কোনো ব্যাপারে মনের অর্গল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেবার ক্ষমতা তাঁর (জিন্নার) ছিল। অপরের যুক্তি তিনি ঠিকই বুঝতেন, তিনি দক্ষ বিতর্ককারীও ছিলেন, তাঁর মানসিক গঠন অত্যন্ত পরিশীলিত ছিল, তিনি ছিলেন আইনজীবী। তবে তাঁর সম্বন্ধে আমার এ ধারণা হয়েছিল যে তিনি তাঁর মনের দরজা বন্ধ করে দিতেন, কান বন্ধ রাখতেন, তিনি বুঝতে চাইতেন না, শুনতে চাইতেন না। আমার বলার উদ্দেশ্য হল—যা কিছুই অপর পক্ষ বলুক না কেন, তা তাঁকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করত না।…তাঁর শক্তির মূল…এসব তিনি পেতেন তাঁর মনের অর্গল বন্ধ করে ও ‘না’ বলে।”(পৃষ্ঠা ৪৫)
১৩. জেনকিন্সের ১৬ই এপ্রিলের নোট। T.P.; দশম খণ্ড; ২৮২-২৮৩ পৃষ্ঠা।
১৪. ভি. বি. কুলকার্নী; The Indian Triumvirate; ভারতীয় বিদ্যাভবন, বোম্বাই; ২০২ পৃষ্ঠা।
১৫. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; সপ্তম খণ্ড; ৪৪৪-৪৪৫ পৃষ্ঠা।
১৬. ২৩শে এপ্রিলে অনুষ্ঠিত বড়লাটের সপ্তম বিবিধ সভার আলোচনা বিবরণী। T.P.; দশম খণ্ড; ৩৮১ পৃষ্ঠা।
১৭. জালাল; সমগ্রন্থ; ২৬১-২৬২ পৃষ্ঠা।
১৮. অ্যালান-ক্যাম্পবেল জনসন; সমগ্রন্থ; ৮৪ পৃষ্ঠা।
১৯. সমগ্রন্থ; ৮৫ পৃষ্ঠা।
২০. প্যারেলাল; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ১৬৯ পৃষ্ঠা।
২১. সমগ্রন্থ; ১৭৬-১৯০ পৃষ্ঠা।
২২. ঐ সময়ে জিন্না বলেছিলেন যে পাকিস্তানে যোগ না দিয়েও বাংলা যদি অবিভক্ত কী থাকে তবে তিনি “খুশি” হবেন। কারণ “কলকাতা ছাড়া বঙ্গের সার্থকতা কি? বরং তাঁরা ঐকবদ্ধ ও স্বাধীন হয়েই থাকুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাঁরা আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বভাবাপন্ন থাকবেন।” T.P.; দশম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৪৫২। সংবাদপত্রের বিবরণ থেকেও জানা যায় যে, এমনকি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাসেও পুরো পাঞ্জাবসহ সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান পেলে জিন্না বঙ্গের উপর থেকে তাঁর দাবি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। (দ্রঃ প্যারেলাল; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ১৭৮)।
২৩. বঙ্গীয় লীগের “সার্বভৌম বঙ্গ” আন্দোলনের বিস্তারিত কাহিনীর জন্য ডঃ শীলা সেনের সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২২৩-২৪৫ দ্রষ্টব্য। এ প্রসঙ্গে আবুল হাশিমের “আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি”; চিরায়ত প্রকাশন (কলিকাতা), ১৯৮৮ এবং নিতে অন্য দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য বদরুদ্দীন উমর-এর “বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি”; চিরায়ত প্রকাশন, কলিকাতা (১৯৮৭) উল্লখযোগ্য গ্রন্থ।
২৪. জিন্নার ১৭ই মে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের নোট; T.P.; দশম খণ্ড; ৮৫২-৮৫৩ পৃষ্ঠা।
২৫. জালাল; সমগ্রন্থ; ২৩৫ পৃষ্ঠা।
২৬. T.P.; দশম খণ্ড; ৮৯৬ পৃষ্ঠা।
২৭. ভি. বি. কুলকার্নী; সমগ্রন্থ; ২০২-২০৩ পৃষ্ঠা।
২৮. T.P.; দশম খণ্ড; ৯২৯-৯৩০।
২৯. জাইগলার; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩৮৫। এ প্রসঙ্গে T.P.; দশম খণ্ড; ৯৪৪-৯৪৬ পৃষ্ঠাও দ্রষ্টব্য।
৩০. জাইগলার; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩৮৬ পৃষ্ঠা।
৩১. অ্যালন-ক্যাম্পবেল জনসন; সমগ্রন্থ; ১০২-১০৩ পৃষ্ঠা।
৩২. জাইগলার; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩৯২। মাউন্টব্যাটেনের উক্তির উদ্ধৃতির জন্য T.P.; একাদশ খণ্ড; পৃষ্ঠা ১৬৩ দ্রষ্টব্য।
৩৩. T.P.; দশম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৮৯৯। খলিকুজ্জমাঁ জানিয়েছেন (সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩৯০-৩৯১) যে পূর্বোক্ত সিদ্ধান্ত অথবা ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের সৃষ্টি হবে—এ সিদ্ধান্ত এককভাবে জিন্নারই। কারণ ৯ই জুন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর লীগ ওয়ার্কিং কমিটি অথবা কাউন্সিলের কোনো সভা হয়নি। খলিকুজ্জমাঁ এও বলেছেন যে সাধারণ ধারণা এইরকমের ছিল যে অন্তর্বর্তীকালের জন্য মাউন্টব্যাটেন উভয় ডোমিনিয়নের বড়লাট হবেন।
৩৪. সমগ্রন্থ; ১২৭ পৃষ্ঠা।
৩৫. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২৯২। ২৩শে অক্টোবর থেকে উপজাতীয়দের অভিযানের নামে পাকিস্তান কর্তৃক কাশ্মীর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বড়লাট হিসাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক না হবার সমস্যা জিন্না উপলব্ধি করেছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের সুপ্রীম কমান্ডার ফিল্ড মার্শাল অচিনলেকের নির্দেশ ছাড়া কেবল বড়লাট জিন্নার ২৭শে অক্টোবরের আদেশে পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর অস্থায়ী প্রধান সেনাপতি জেনারেল স্যার ডগলাস গ্রেসি কাশ্মীরে সৈন্য পাঠাতে অস্বীকার করে পাকিস্তানের পক্ষে কাশ্মীর দখলের সম্ভাবনা তিরোহিত করেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বীজও জিন্নার এই মানসিকতা ও কার্যপদ্ধতিতে নিহিত।
৩৬. সমগ্রন্থ; ৩৩৩ পৃষ্ঠা।
৩৭. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ৩৯৩ পৃষ্ঠা।
৩৮. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ৩৩৪ পৃষ্ঠা।
৩৯. “অন্ততঃ এ ব্যাপারে আমি আপনাদের পরিপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেব, যাতে কোনো রক্তপাত বা দাঙ্গা না হয় তা আমি দেখব। আমি সৈনিক, কোনো বেসামরিক নাগরিক নই। একবার দেশ বিভাগ নীতিগতভাবে স্বীকৃত হয়ে গেলে দেশের কুত্রাপি যাতে সাম্প্রদায়িক অশান্তি না হয় তার ব্যবস্থা করার জন্য আদেশ জারি করব। বিন্দুমাত্র গোলযোগের আশঙ্কা দেখলেই আমি তা অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্য কঠোরতম ব্যবস্থা অবলম্বন করব। আমি এমনকি সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকেও নিয়োগ করব না। আমি স্থল ও বিমান বাহিনীকে কাজে নেমে পড়ার হুকুম দেব। যে কেউ গোলযোগ সৃষ্টি করতে চায় তাকে দমন করার জন্য আমি সাঁজোয়া গাড়ি ও বিমানবহর নিয়োগ করব।” মাউন্টব্যাটেনের পূর্বোক্ত উক্তি আজাদ কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১৯০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। মাউন্টব্যাটেনের প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গে মন্ত্রীমণ্ডলীর কাছে এটলীর প্রতিবেদনও স্মরণীয় “ব্যাপক সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ রোধের একমাত্র সম্ভাবনা হল এর প্রথম নিদর্শনকে সাঁজোয়া গাড়ি ও বিমানবহরসহ যা কিছু শক্তির প্রয়োজন তার প্রয়োগ করে অবিলম্বে ও কঠোর হস্তে দমন করা।” T.P.; দশম খণ্ড; ৯৬৭ পৃষ্ঠা।
৪০. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ৩৩৬ পৃষ্ঠা।
৪১. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৬৪১ পৃষ্ঠা।
পৃষ্ঠা: ২৭৫

এক মূল্যায়ন
৩০

জিন্নার জীবন ও কৃতির মূল্যায়নের দ্বারা এ আলোচনার উপসংহার করা হবে।
সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের সৃষ্টি নিঃসন্দেহে জিন্নার সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতি। “পাকিস্তান মহম্মদ আলী জিন্নার একক অবদান, ”(১)—এ কোনো অত্যুক্তি নয়। মাত্র সাত বৎসরের কুশলী রাজনৈতিক পদক্ষেপের দ্বারা তিনি একেবারে শব্দার্থে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। এর পিছনে ছিল তাঁর দুই জাতি তত্ত্ব। অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরের সঙ্গে কেবল সম্পর্কশূন্যই নয়, পরস্পরবিরোধী দুই স্বতন্ত্র জাতি (nation) এবং তাই তারা এক রাষ্ট্রে থাকতে পারবে না। সুতরাং মুসলমানদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও শিক্ষা ইত্যাদির ন্যায়সঙ্গত বিকাশের জন্য তাঁদের এক পৃথক সার্বভৌম বাসভূমি চাই। এর নাম পাকিস্তান।
পরিক্রমা প্রসঙ্গে আমরা দেখেছি যে কিভাবে এককালের “হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের রাজদূত” জিন্না মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের (অপর মতে অস্মিতা বা আত্মাভিব্যক্তির) কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পাকিস্তানের জনকে পরিণত হলেন। কিন্তু আমরা এ-ও লক্ষ করেছি যে পাকিস্তানের সম্ভাবনা দিক্‌চক্রবালে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কখনও মৌনভাবে ইশারায়-ইঙ্গিতে, আবার কখনো বা বড়লাটের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে মুখরভাবে পাঞ্জাব ও বঙ্গ বিভাজনের বিরুদ্ধে অভিমত ব্যক্ত করে জিন্না তাঁর দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তান দাবিরই বিরোধিতা করেছিলেন। প্রাপ্তির দ্বারদেশে উপনীত হয়ে কাম্যবস্তুর বিরোধিতা করার মধ্যে যুগপৎ ট্র্যাজিডি ও চরিত্রের অসামঞ্জস্য বিদ্যমান। জিন্নার জীবনের এই আদ্যন্ত বিয়োগান্তক দিকের কথা আমরা ক্রমশ পর্যালোচনা করব।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা তাঁর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই জুলাই-এর এক সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্যের উল্লেখ করেছি যাতে প্রস্তাবিত পাকিস্তান এলাকার সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো ভেদ-ভাব করা হবে না এবং তাঁরা মুসলমানদের সঙ্গে সমান অধিকারসম্পন্ন নাগরিক হবেন—এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে এই আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে ভারতবর্ষেও সংখ্যালঘুদের (ভারত বিভাজনের সময়ে ৪ কোটিরও বেশি মুসলমান ভারতে থেকে যান) প্রতি অনুরূপ আচরণ করা হবে। ১৮ই আগস্টের জিন্নার ঈদ-উল-ফিতরের বাণী উল্লেখযোগ্য: “হিন্দুস্তানের সংখ্যালঘু আমাদের ভাই-বন্ধুরা নিশ্চিত থাকতে পারেন যে আমরা কখনই তাঁদের উপেক্ষা করব না বা বিস্মৃত হব না। আমাদের হৃদয় তাঁদের সঙ্গে রয়েছে এবং তাঁদের সাহায্য করার জন্য কোনো প্রয়াসকেই আমরা কঠিন মনে করব না। আর তাঁদের মঙ্গলবিধানের জন্য চেষ্টা করব। কারণ আমি স্বীকার করি যে এই উপমহাদেশের মুসলমান সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহই আমাদের বাঞ্ছিত লক্ষ্য পাকিস্তান অর্জনের অন্দোলনে অগ্রণী ছিল এবং তার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল।”(২) ভারতের সংখ্যালঘুদের নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকার পরামর্শ দেবার পর ভিন্ন রাষ্ট্র থেকে তাঁদের জন্য চিন্তা ব্যক্ত করার স্ববিরোধ জিন্নার মতো কুশাগ্রবুদ্ধি আইনজীবী যে বোঝেননি তা মনে হয় না। তবে আবেগের প্রভাবমুক্ত হওয়া মানুষের পক্ষে সহজ নয়, তা সে মানুষ জিন্নার মতো লোকদৃষ্টিতে আবেগবিহীন ব্যক্তি মনে হলেও। প্যাটেলের মতো আবেগ-বিরল কড়া ধাতের বাস্তববাদী রাজনৈতিক নেতাও পাকিস্তানের হিন্দুদের জন্য একাধিকবার প্রকাশ্যে এজাতীয় মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। যাই হোক, প্রশ্ন হল—উভয় রাষ্ট্রেই সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠদেরই সমান রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া যদি তাঁর কাম্য ছিল তাহলে দেশ বিভাগের দাবি তিনি ওঠালেন কেন? জিন্নার সমালোচকরা বলতে পারেন যে, ১৩ই জুলাই- এর তাঁর প্রতিশ্রুতি দেশ বিভাজনের প্রাক্কালে প্রস্তাবিত পাকিস্তান এলাকার সংখ্যালঘুদের প্রতি ছলনা যাতে তিনি তাঁর বাঞ্ছিত পাকিস্তান তাঁদের অনাবশ্যক বিরোধ ছাড়াই পেয়ে যান। কিন্তু পরবর্তীকালেও (২৬শে অক্টোবর) রয়টারের প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তিনি “পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের সমান অধিকারসম্পন্ন নাগরিকরূপে অভিহিত করেন।”(৩)
পাকিস্তান নিছক মুসলমান দেশ হোক এ যে তিনি চাননি তার আরও কয়েকটি প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে। বেশ কয়েকটি হিন্দু ও শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশীয় রাজ্যের নৃপতিদের পাকিস্তানে যোগ দেবার জন্য তিনি ব্যর্থ প্রয়াস করেন। একাধিক দায়িত্বশীল শিখ নেতাদের কাছে প্রতিশ্রুতি দেন যে পাকিস্তানে তাঁদের ন্যায়সংগত অধিকার রক্ষিত হবে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তার দরজা অমুসলমানদের জন্যও খুলে দেবার প্রস্তাব তিনি করেন এবং লিয়াকত আলী খাঁও এর সমর্থন করেন। কিন্তু লীগের অন্যান্য নেতাদের বিরোধিতার ফলে তাঁর এ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। দেশ বিভাজনের পর পাকিস্তানে অবস্থানকারী সাংবাদিক এম. এস. এম. শর্মার কাছে জিন্না নিজেকে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষক বলে পরিচয় দেন। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত ও পাকিস্তান ত্যাগে প্রস্তুত হিন্দু উদ্বাস্তুদের দুঃখ-দুর্দশায় জিন্নার চোখে জল আসার ঘটনা শ্রীযুক্ত শর্মাও লিপিবদ্ধ করেছেন। গান্ধীর সম্বন্ধেও তাঁর অভিমত কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছিল। শ্রীযুক্ত শর্মার মতে লীগ কাউন্সিলের এক সভায় তিনি বলেন যে, “মিস্টার গান্ধী মুসলমানদের প্রকৃত বন্ধু এবং…ভারতবর্ষের মুসলমানদের সম্মিলিতভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ানো উচিত।” পাকিস্তানের অমুসলমান সরকারি কর্মচারীরা যাতে ওদেশে থেকে যান তার জন্য তিনি ও লিয়াকৎ আগ্রহশীল ছিলেন।(৪) পূর্বোক্ত ঘটনাবলীর অনেকগুলিরই হয়তো প্রতিকূল ভাষ্য করা যায়। কিন্তু তার জন্য জিন্নার সংখ্যালঘুদের প্রতি দরদ মিথ্যা হয়ে যায় না।
অনুরূপ এক মন্তব্য তিনি করেন মৃত্যুর সাত মাস পূর্বে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের কাছে এক বেতারবার্তা সম্প্রচার প্রসঙ্গে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধান কি ধরনের হবে এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, “আমি নিঃসন্দেহ যে এ হবে গণতান্ত্রিক ধাঁচের…। ইসলাম ও তার আদর্শবাদ আমাদের গণতন্ত্রের শিক্ষা দিয়েছে। এর শিক্ষা হল মানুষে মানুষে সাম্য, ন্যায়বিচার ও সবার প্রতি উচিত আচরণ…। আর যাই হোক, পাকিস্তান শাস্ত্রচালিত যাজক সম্প্রদায় পরিচালিত ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হবে না। আমাদের দেশে হিন্দু, খ্রিস্টান, পার্শী প্রমুখ বহু অমুসলমান রয়েছেন, কিন্তু তাঁরা সবাই পাকিস্তানি। অপর যে কোনো নাগরিকের মতোই তাঁরা সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন এবং পাকিস্তানের কাজ-কর্মে তাঁদের ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা পালন করবেন।”(৫)
তাছাড়া প্রথম অধ্যায়ে উদ্ধৃত পাকিস্তান গণপরিষদের সভাপতি হিসাবে ১১ই আগস্টের তাঁর প্রথম বক্তৃতা (ঐ বক্তৃতা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল কোনো লিখিত নোটের ভিত্তিতে নয়। তাঁর জীবনীকারদের মতে অতঃপর আর যে-কটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন তার কুত্রাপি তিনি স্বতঃস্ফূর্ত বক্তৃতা দেবার সুযোগ পাননি) সম্বন্ধে কি বলা হবে? ঐ গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাটির আরও একটু পর্যালোচনা প্রয়োজন। তবে তার পূর্বে ভারতীয় গণপরিষদের মুসলিম লীগ সদস্যদের সঙ্গে তাঁর যে সর্বশেষ আলোচনা হয় সে সম্বন্ধে লীগ দলের নেতা খলিকুজ্জমাঁর জবানীতে শোনা যাক:
“দেশবিভাগের পর যেসব মুসলমান ভারতবর্ষে রয়ে যাবেন তাঁদের গভীর সঙ্কট স্বয়ং শ্রীযুক্ত জিন্না উপলব্ধি করেন। মনে আছে যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পহেলা আগস্ট স্থায়ীভাবে করাচীতে চলে যাবার কয়েক দিন পূর্বে ভারতবর্ষের গণপরিষদের মুসলমান সদস্যদের বিদায় জানাবার জন্য শ্রীযুক্ত জিন্না তাঁদের তাঁর ১০নং ঔরঙ্গজেব রোডের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। যেসব মুসলমান ভারতবর্ষে থেকে যাবেন তাঁদের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত রিজওয়ানউল্লা বেশ কয়েকটি বিব্রতকারী প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। সেইদিনের মতো আর কখনও আমি শ্রীযুক্ত জিন্নাকে অমন অপ্রতিভ অবস্থায় দেখিনি। এর কারণ সম্ভবত এই যে, অদূর ভবিষ্যতে মুসলমানদের ভাগ্যে কি আছে ততদিনে তিনি স্পষ্টত উপলব্ধি করতে পারছিলেন। পরিস্থিতি জটিল ও হতবুদ্ধিকর দেখে আমি আমার বন্ধু ও সহকর্মীদের আলোচনা বন্ধ করতে বললাম। আমার বিশ্বাস আমাদের ঐ বিদায়-সভার পরিণামস্বরূপ শ্রীযুক্ত জিন্না প্রথম অবকাশেই তাঁর ১১ই সেপ্টেম্বরের বক্তৃতায় দ্বিজাতি তত্ত্বকে বিসর্জন দিয়েছিলেন।”(৬)
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে লাহোরের দ্বিজাতি তত্ত্বরূপী যে বিষবৃক্ষের বীজ জিন্না বপন করেছিলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদের অনুকূল ক্ষেত্র,(৭) সাম্রাজ্যবাদী ভেদনীতির সার এবং সাম্প্রদায়িক প্রচার, ঈর্ষা, অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্বের জলসিঞ্চনে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে তা বিশাল মহীরূহের আকার ধারণ করে হিন্দু ও মুসলমানকে দুই যুযুধান শিবিরে বিভক্ত করতে সমর্থ হয়। তারপর জিন্নার কুশলী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তদনুরূপ চালে সেই বিষবৃক্ষে যখন আর দেড় বৎসরের মধ্যে পাকিস্তান ও অবশিষ্ট ভারত—পরস্পরের প্রতি গভীর অবিশ্বাসে ওতপ্রোত দুই স্বতন্ত্র রাষ্ট্ররূপী ফল ধরে, তখনও একদা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ও পরবর্তীকালে পৃথক জাতি (nation) মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির প্রবক্তা জিন্নার ট্র্যাজেডির গভীরতার পরিমাপ করা সহজসাধ্য নয়। কিন্তু তাঁর ট্র্যাজেডির পরিমাপ করার প্রয়াসের পূর্বে জিন্নার সেই ১১ই আগস্টের স্বতঃস্ফূর্ত বক্তৃতা—যার ব্যাপক প্রচার পরবর্তীকালের পাকিস্তানের নেতৃত্বের বিশেষ কাম্য ছিল না—তার আরও কিছু অংশ উদ্ধৃত করা প্রয়োজন। প্রথম অধ্যায়ে উদ্ধৃত অংশের পূর্বে বক্তৃতার গোড়ার দিকে তিনি বলেন:
“কিন্তু প্রশ্ন হল, যা করা হয়েছে তার থেকে ভিন্ন কিছু করা সম্ভব বা বাস্তবে সাধ্য ছিল কি?…বিভাজন হতই। হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান উভয় পক্ষেই এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যাঁরা এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত নন, এ পদক্ষেপ যাঁদের মনোমতো নয়। কিন্তু আমার বিবেচনায় সমাধানের অপর কোন উপায় ছিল না এবং আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে ভবিষ্যৎ ইতিহাস এই পদক্ষেপের সমর্থনে তার রায় দেবে। আর তার চেয়েও বড় কথা হল এই যে, যতই দিন যাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একথা প্রমাণ হবে যে ওই ছিল একমেব সমাধান।…সম্মিলিত ভারতবর্ষের কোনো পরিকল্পনা বাস্তবে কদাপি কাজ করত না এবং আমার মতে তা আমাদের প্রচণ্ড সর্বনাশের স্থিতিতে নিক্ষেপ করত। হয়তো এই অভিমত যথার্থ; হয়তো যথার্থ নয়; তবে তা ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত।”
ভারত বিভাজনের যৌক্তিকতা ভবিষ্যৎ ইতিহাস সপ্রমাণ করবে—এই আশা জিন্না ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু বিগত বিয়াল্লিশ বছরের মধ্যে জিন্নার সে আশা পূর্ণ হয়নি। অবশ্য ইতিহাসের বিস্তীর্ণ পটভূমিকায় বিয়াল্লিশ বছর কিছুই নয়। পাকিস্তানের সৃষ্টির সাত মাসের মধ্যে (২১শে মার্চ, ১৯৪৮) ঢাকায় তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতার একাংশের (পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু) বিরোধিতা করে বাংলাদেশের যে আন্দোলন দানা বাঁধতে আরম্ভ করে, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের রক্ত ও অশ্রুঝরা আবির্ভাবে তার পূর্ণাহুতি হবার সঙ্গে সঙ্গে জিন্নার আশাকে চিরতরে অলীক প্রমাণিত করে ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বিজাতি তত্ত্বের স্থায়ী কবর রচিত হয়। যাই হোক, এখানে উল্লেখযোগ্য যা তা হল দেশ বিভাজনের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে অত শীঘ্র জিন্নার নিজের মনেই সন্দেহ যা পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্যদের সম্মুখে তিনি এতদিনের সাধনালব্ধ ফল করায়ত্ত হবার পূর্বমুহূর্তে স্বগতোক্তির মতো ব্যক্ত করেছিলেন।
ঐ বক্তৃতার শেষাংশে জাতি তথা বিশ্বের সামনে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে তিনি নিজের জন্য যে ভূমিকা নির্ধারণ করেছিলেন তা কোনোক্রমেই সাম্প্রদায়িকতাবাদী নয়: “রাজনৈতিক ভাষায় যাকে পূর্ব সংস্কার এবং দুর্ভাবনা আখ্যা দেওয়া হয়, অর্থাৎ পক্ষপাত ও স্বজনপোষণের প্রশ্রয় না দিয়ে আমি সর্বদা ন্যায়বিচার ও উপযুক্ত আচরণের নীতির দ্বারা চালিত হব। আমার দিগ্‌দর্শক নীতি হবে ন্যায়বিচার ও পূর্ণ নিরপেক্ষতা এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে আপনাদের সমর্থন ও সহযোগিতার দ্বারা পাকিস্তান বিশ্বের অন্যতম মহান রাষ্ট্রে পরিণত হবে—এ আশা আমি করতে পারি।”
একথা সত্য যে পাকিস্তান তার জনকের প্রতিশ্রুতি—সকল নাগরিকদের প্রতি ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষতা—পরবর্তীকালে রক্ষা করতে পারেনি। তবে এর জন্য জিন্নার ওপর দোষারোপ করা চলে না। কারণ পাকিস্তানের জন্মের কিছুদিন পরই অসুস্থতার কারণে দেশের আসল প্রশাসন ক্ষমতা দ্রুত অন্যের হাতে চলে যায়। আর তাছাড়া আমাদের ভারত রাষ্ট্রও যে তার জনক গান্ধী ও প্রধান রূপকার জওহরলালের বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের জন্য প্রদত্ত বহু আন্তরিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি তার জন্য তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। উপকথার নায়কদের মতোই রাজনৈতিক নেতারা যেসব শক্তির জন্ম দেন পরবর্তীকালে ইচ্ছা করলেও তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না।
ভারত বিভাজনের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সন্দেহের যে বীজ জিন্নার মনে উপ্ত হয়েছিল, র‍্যাডক্লিফ রোয়েদাদ ঘোষণার পরবর্তীকালের গৃহযুদ্ধ ও তজ্জনিত মানবীয় দুঃখের গভীরতা- দৃষ্টে তা তাঁর মনে মহীরূহের আকার ধারণ করে তাঁকে অত্যন্ত পীড়িত করত। এ বিষয়ের সাক্ষ্য পাওয়া যায় তাঁর সর্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ ব্যক্তি ভগ্নী কুমারী ফতিমা জিন্নার স্মৃতিকথায়: “…তাঁর সম্মানে বিজয়োল্লাসের লগ্নেও কায়েদ-এ-আজম গভীর অসুস্থ ছিলেন। …দুঃখ ও বেদনার্ত চিত্তে এ আমি লক্ষ করতাম। আহারে তাঁর রুচি ছিল না বললেই চলে এবং ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছাও তিনি যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন। সীমান্তের উভয় পার্শ্ব থেকে যে সময়ে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটের চরম দুর্দশাপূর্ণ ঘটনাবলীর বিবরণ আসছে, তখন তাঁর ঐ রকম অবস্থা। জলযোগের সময়ে ঐসব গণহত্যার বিবরণ আমার সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর দিনের সূত্রপাত হত এবং মাঝে মাঝেই অলক্ষিত ভাবে তাঁর রুমাল নিজের আর্দ্র চক্ষুকে আবরিত করত…।”(৮)
দেশ বিভাজনের জন্য জিন্নার এই ক্ষোভ ও অশ্রুমোচন কেবল মুসলমানদের জন্য, একথা মনে করা ভুল হবে। জিন্নার অন্যতম জীবনীকার হেক্টর বলিথোর কাছে তাঁর গুণগ্রাহী বন্ধু এবং দেশবিভাগের সময়ে করাচীর মেয়র পার্শী জামসেদ নসরওয়ানজী জিন্নার সম্বন্ধে বলেন: “আমার সানুনয় মিনতি—বিশ্বাস করুন শ্রীযুক্ত জিন্না মানব দরদী ছিলেন। কোনোদিনই তাঁর মধ্যে চোখের জল ফেলার প্রবণতা ছিল না—না, আদৌ না। কিন্তু দুবার আমি তাঁকে অশ্রুমোচন করতে দেখেছি। একবার দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। সে সময়ে আমি তাঁর সঙ্গে হিন্দুদের এক শিবিরে গিয়েছিলাম। এঁরা পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলেন। শিবিরের বাসিন্দা সেই সব হিন্দুদের দুর্দশা দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। তাঁর গালের উপর দিয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে দেখেছি।”(৯)
পাকিস্তানের স্বরূপ দেখে জিন্নার হতাশা সম্বন্ধে আরও দুটি সাক্ষীর জবানবন্দী উদ্ধৃত করে এ প্রসঙ্গের ইতি করা হবে। প্রথমটি হল নিজামের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী এবং জিন্নার অনুগামী মীর লায়েক আলী, যাঁর মতে, “সেদিন ছাড়া জীবনে আর কখনো শ্রীযুক্ত জিন্নাকে আমি অমন আবেগাভিভূত দেখিনি। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন যে বিমানবন্দর থেকে আসার সময়ে আমি উদ্বাস্তুদের বসতি… দেখেছি কিনা?… তা অবশ্যই চোখে পড়েছিল। জনসাধারণের ব্যাপক দুর্গতির কথা বলার সময় কয়েক বার তাঁর গণ্ডদেশ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।”(১০)
দ্বিতীয়জন হলেন আমেরিকার “লাইফ” পত্রিকার সাংবাদিক ও ফোটোগ্রাফার মার্গারেট বৌরক-হোয়াইট, ভারত বিভাজনের আনুষঙ্গিক মানবীয় দুঃখদুর্দশার চিত্র ও বিবরণ লিপিবদ্ধ করার জন্য যিনি বিখ্যাত। ফতিমার সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে তিনি দেশবিভাগের তিন মাস পর জিন্নার অন্তরঙ্গ পোর্ট্রেট তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং এই গ্রন্থে সেটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর বিবরণ হল:
“বাঞ্ছিত দেশ প্রাপ্তির কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর প্রায় দেবতুল্য উত্তুঙ্গ আশা-ভরসা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এমনকি তুচ্ছতম সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারেও তাঁর মধ্যে একটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত অক্ষমতার সৃষ্টি হয়েছিল। নিজেকে বিস্ময়করভাবে একটা কোটরের মধ্যে আবদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে জিন্না এমনকি তাঁর মন্ত্রীদের সঙ্গেও দেখা করতেন না।(১১)
“(ফতিমা আমাকে বললেন যে) ক্লোজ-আপ ছবি নেবার জন্য আমি যেন তাঁর কাছে না যাই। যখন তাঁর মুখমণ্ডল দেখলাম তখন ঐ পরামর্শের কারণ বুঝতে পারলাম। সে মুখমণ্ডলে ভীতিজনক পরিবর্তন ঘটে গেছে। মনে হল, চৈতন্যের এক ধরনের অসাড়তার আবরণের তলে আতঙ্কের কাছাকাছি একটা ভাব সংগুপ্ত রয়েছে। আমি ফোটো নেওয়া শুরু করলাম এবং প্রতিটি ফোটো নেবার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর ভগ্নী জিন্নার সামনে এসে তাঁর মরীয়া হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত ধীরে ধীরে খুলে দেবার চেষ্টা করলেন।”
জিন্নার মাথার টুপিটি বদলে দেবার জন্য লেখিকা তাঁর ভগ্নীকে অনুরোধ করেছিলেন। একগাদা টুপির মধ্যে থেকে একটি বেছে নিয়ে তার জন্য উদ্যোগ করতেই:
“বিখ্যাত নেতা বিরক্তি সহকারে হাত নেড়ে পশমের সব ফেজগুলিসহ্ তাঁর ভগ্নীকে দূরে থাকতে ইঙ্গিত করলেন। অবাধ্য নিষ্ঠুর শিশুর মতো তিনি বলতে লাগলেন, ‘না, না, না।’ এইটাই বোধহয় তাঁর শেষ পোর্ট্রেট ছিল…।
পৃষ্ঠা: ২৮০

“জিন্নার মুখমণ্ডলে যে উৎপীড়িতের ছবি দেখেছি তা নিয়ে আমি অনেক চিত্তা করেছি। আমার বিশ্বাস জীবন সায়াহ্নে জিন্না নিজের কার্যকলাপের যে হিসাব-নিকাশ করছিলেন এ তারই আভাস। উচ্চস্তরের বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও মেধার অধিকারী হবার জন্য তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি কী করেছেন। ডাঃ ফাউস্টের মতো তিনি একটা চুক্তি করেছিলেন, যার শর্ত থেকে কখনও তিনি মুক্ত হতে পারেননি। সংগ্রামের চূড়ান্ত উত্তেজনার মুহূর্তে কুসংস্কারের যাবতীয় নাটকীয় শক্তিসমূহের সহায়তা নিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন এবং এখন এই রক্তাক্ত বিজয় তাঁর মুখে বিস্বাদ ঠেকছিল।”(১২)
লেখিকার বক্তব্যে কিছুটা আত্মবাদী (সাবজেকটিভ) প্রবণতা আছে ঠিকই, তাছাড়া তাঁর পক্ষে তখন জানা সম্ভব ছিল না যে মৃত্যুদূত ইতিমধ্যে জিন্নার উপর নিজ পরোয়ানা জারি করে গেছে। দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁর যক্ষ্মার প্রকোপ তো ছিলই, ইদানীং ক্যান্সারও তাঁর ফুসফুসে শিকড় ছড়াতে আরম্ভ করেছে। মনের উপর আসন্ন মৃত্যুর প্রচণ্ড চাপের অংশ গ্রহণ করার কেউ নেই তাঁর আশেপাশে—এমনকি ভগ্নীও নন। রাজনীতির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারীদের দুরদৃষ্ট—পাছে উত্তরাধিকারের লড়াই-এ জীবিত অবস্থাতেই তাঁদের রঙ্গমঞ্চের পার্শ্বদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। তাই চরমতম অসুস্থতার সামনে আত্মজনের সেবা-শুশ্রূষা ও সহানুভূতি পাবার বদলে সে সংবাদ গোপন রেখে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের অভিনয় করে যেতে হয়। যাই হোক, তবু মনের সঙ্গে যুদ্ধে জর্জর, ক্ষতবিক্ষত একজন মহাকাব্যের নায়কসদৃশ ব্যক্তির চরিত্রের অন্তরঙ্গ চিত্রের ঝলক পূর্বোক্ত উদ্ধৃতি থেকে মেলে। বলা বাহুল্য জিন্নার মনের ভিতর এই উত্তাল তরঙ্গ-বিক্ষোভের একটা বড় কারণ দেশবিভাগ ও তার থেকে উদ্ভুত সমস্যা।
মৃত্যুর (১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮) মাত্র এক পক্ষকাল পূর্বে ২৭শে আগস্ট ঈদ-উল- ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে জিন্না যে বাণী দেন তাতেও এক রণক্লান্ত সেনাপতির আশাভঙ্গের প্রবল অভিব্যক্তি: “বিগত বৎসরের রক্তস্নান ও তার পরিণাম—লক্ষ লক্ষ নরনারীর ব্যাপক বাস্তুত্যাগ—এক অভূতপূর্ব গুরুতর সমস্যার উদ্রেক করেছিল। এই বিপুল উদ্বাস্তু জনস্রোতকে নূতন আশ্রয় দিতে গিয়ে আমাদের কর্মশক্তি ও সম্পদের উপর যে অভাবনীয় চাপ পড়ে তাতে উভয় দিক থেকেই আমাদের ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়। ঐ কাজের ব্যাপকতা ও বিপুলতা আমাদের প্রায় নিমজ্জিত করার উপক্রম করেছিল— কোনোমতে আমরা আমাদের মাথাটুকুকে শুধু জলের উপর ভাসিয়ে রাখতে পেরেছি।”(১৩)
অতঃপর আমরা জিন্নার কৃতির মূল্যায়ন করব। জিন্না দাবি করেছিলেন যে, ভারতের বিভাজন করে মুসলমানদের স্বতন্ত্র বাসভূমি পাকিস্তানের সৃষ্টি করলেই হিন্দু ও মুসলমান সদ্ভাব সহকারে থাকতে পারবে। কলকাতার শোচনীয় গণহত্যার পর থেকে ভারতবর্ষের কোণে কোণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে আগুন জ্বলে ওঠে এবং বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারে লীগ প্রতিনিধিদের অসহযোগের ফলে যে অচলাবস্থা দেখা দেয় তার পরিপ্রেক্ষিতে জওহরলাল যাকে উত্যক্ত হয়ে ‘মাথা কেটে ফেলে মাথাব্যথার চিকিৎসা” আখ্যা দিয়েছিলেন, সেই মানসিকতা চালিত হয়ে হিন্দু জনতার বড় একটা অংশ ও হিন্দু মহাসভার নেতৃবর্গই নয়, এমনকি কংগ্রেসেরও অধিকাংশ নেতা শেষ অবধি দেশবিভাগের অনুকূল হয়েছিলেন। কিন্তু দুই রাষ্ট্রের সৃষ্টির ফলে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের অবসান ঘটেছে কি?
স্পষ্টত পূর্বোক্ত প্রশ্নের উত্তর একটি দ্ব্যর্থহীন — “না”। যে সমস্যা একটি রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করেছে মাত্র। কাশ্মীরের পরোক্ষ যুদ্ধের কথা ছেড়ে দিলেও এযাবৎ ভারত ও পাকিস্তানবাসী তিন-তিনবার যুদ্ধক্ষেত্রে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে পরস্পরকে হত্যা করেছে। এটা জিন্নার কাম্য ছিল না।(১৪) যে ভারতবাসীরা ইংরেজ আমলে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য বার বার প্রতিরক্ষা খাতে খরচ কম করার জন্য দাবি জানাত, বিভক্ত হবার পর পূর্বতন ভারতের উভয় অংশ সোৎসাহে প্রতিরক্ষার ব্যয় গগনচুম্বী করে তোলার প্রক্রিয়ায় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব সানন্দে মেনে নিয়েছে। ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানের নিত্য বর্ধমান অবিশ্বাস্য অঙ্কের সামরিক ব্যয়ের মূল কারণ পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস। এ ছাড়া পরস্পরকে উত্ত্যক্ত করার যেসব অসংখ্য ঘটনা অতীতে ঘটেছে এবং প্রায় প্রত্যহই ঘটছে তার বিবরণ দিতে গেলে এক স্বতন্ত্র মহাভারত হয়ে যাবে। দ্বিজাতি তত্ত্বের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানে সংখ্যালঘুরা জিন্নার আশার অনুসরণে নিরপেক্ষ ব্যবহার ও সমান অধিকার পায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে স্বাধীনতা প্রাপ্তির লগ্নে মোটামুটি হিন্দু সংখ্যালঘুশূন্য হলেও সংখ্যালঘু পীড়নের মানসিকতা সেখানে শিয়া, আহমদিয়া এবং এমনকি মুহাজিরদের (উদ্বাস্তু) মধ্যে নতুন সংখ্যালঘু সৃষ্টি করে নিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে দেশবিভাগের সময় যে প্রায় এক কোটি হিন্দু সখ্যালঘু ছিল, স্বাভাবিক কারণে তার সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটার বদলে দফায় দফায় উদ্বাস্তু হবার ফলে সংখ্যা হ্রাসই · পেয়েছে। বাংলাদেশের জন্মের ফলে ঐ দেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা কিছুটা অনুকূল হলেও, মুজীব-পরবর্তীকালে ওদেশের রাজনীতিতে পুনরায় ঐস্লামিক গোঁড়ামির প্রভাব বৃদ্ধি পাবার ফলে তাঁদের অবস্থা আজও অনিশ্চিত। তাছাড়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের পক্ষে যে নূতন হাওয়ার রেশ দেখা যায় তার কৃতিত্ব আর যারই হোক, জিন্নার নয়। ভারতবর্ষের অবস্থাও খুব গৌরবজনক নয়। দেশবিভাগের সময়ের ৪ কোটি মুসলমান প্রায় ১০ কোটিতে দাঁড়ালেও এবং ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় নীতির ফলে মুসলমানরা সংবিধান, আইন ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে এদেশে সমান অধিকার পেলেও তাঁদের বড় একটা অংশ আজও দেশবিভাগজনিত ঐতিহাসিক ভূকম্পনের প্রভাব জয় করে দেশের জন জীবনের মূল ধারার সঙ্গে সম্মিলিত হতে পারেননি। গোঁড়া ও পশ্চাৎগামী মনোভাবকে আশ্রয় করে তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের ভারত বিভাজনের দাবির ঐতিহ্যের বোঝা বহন করছেন। একথা দুঃখজনক হলেও সত্য যে ভারতবর্ষ এখনও হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কলঙ্কমুক্ত নয়। হিন্দু মৌলবাদ যেন পাল্লা দিয়ে সংগঠিত হচ্ছে।
দেশবিভাগের ফলে মুসলমানদের নিজস্ব দেশের (home-land) আকাঙ্ক্ষারও কি পূর্তি হয়েছে? আদৌ না। পাকিস্তানের নেতা ওয়ালি খাঁর হৃদয়স্পর্শী উক্তি “ভারত বিভাজন মুসলিমদের বিভাজন”(১৫) এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা তিনটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার তাঁদের অস্মিতা বিপন্ন।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে লীগের দিল্লি অধিবেশনে জিন্না সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রসঙ্গে বলেছিলেন: “আমার জীবিতকালে এটা ঘটবে কিনা জানি না। তবে আমার এই কথা আপনারা তখন মনে করবেন; আর একথা আমি কারও প্রতি কোনো বিদ্বেষ বা দুর্ভাবনা চালিত হয়ে বলছি না। কোনো কোনো জাতি পরস্পরকে হয়তো লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় নিহত করেছে এবং তবুও আজকের শত্রু আগামী কালের মিত্র। এর নাম ইতিহাস।”(১৬) প্রচ্ছন্নভাবে হলেও দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষ—সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস এবং বিদ্বেষ এই পরিমাণে ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে গেছে যে জিন্নার পূর্বোক্ত আশা সাকার হবার স্পষ্ট সম্ভাবনা এখনও দিক্‌চক্রবালে দৃষ্টিগোচর নয়। এর সম্ভাবনা রয়েছে ভারতবর্ষের সংস্কৃতি-সমন্বয়ের ঐতিহ্যে যার অনুশীলন গান্ধীর মতো জিন্নাও একদা করেছিলেন। ভারত বিভাজনের সিদ্ধান্তের পর আরও অনেকের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগের দুই নেতা খলিকুজ্জমাঁ ও সুরাবর্দীও এর যৌক্তিকতা উপলব্ধি করেছিলেন। এতদুদ্দেশ্যে কাজ করার জন্য ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে গান্ধীর প্রস্তাব নিয়ে তাঁরা উভয়ে পাকিস্তানে জিন্নার কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু জিন্নার উৎসাহের অভাবে তাঁদের সে প্রয়াস অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল।(১৭) ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধানের পথ বিভেদ নয়- ঐক্য, দ্বন্দ্ব নয়—সমন্বয়, এই চ্যালেঞ্জ স্বাধীনতা-পূর্ব যুগের মতো আজও বিদ্যমান।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে জিন্নার কংগ্রেস ছাড়ার কারণ, গান্ধীর সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাত ছাড়াও গান্ধী-নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ গণআন্দোলনে জিন্নার অনীহা—এ আমরা সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে দেখেছি। মূলত অভিজাত এবং নিয়মতান্ত্রিক জিন্নার ব্রিটিশ-শাসনের বিরোধের ক্ষেত্র সে যুগের আরও অনেকের মতো ছিল আইনসভা, সংবাদপত্র এবং ইংরাজি-নবীশ শিক্ষিত সমাজের সভা। গান্ধী এর পরিবর্তে শিক্ষিত নিরক্ষর নির্বিশেষে দেশের সাধারণ মানুষদের ব্রিটিশবিরোধী প্রত্যক্ষ অহিংস গণসংগ্রামে—অসহযোগ আইনঅমান্য ও নানাবিধ সত্যাগ্রহে ব্রতী করেন। আমরা দেখেছি যে সুযোগ পেলেই জিন্না এজাতীয় আন্দোলনের নিন্দা করেছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি নিজের অগোচরে অভিজাত ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন পদ্ধতি নিজের জন্য সংরক্ষিত রেখে লীগের ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনের সময় থেকে তিনি ক্রমশ গণনেতাতেও পরিবর্তিত হয়েছেন। গণনেতার এক বিশিষ্ট উপাদান লোকমনোরঞ্জনকারী বাগ্‌বৈদগ্ধ্য ও জনসাধারণের হাততালি পাবার মানসিকতা—লীগের পরবর্তী বৎসরের অর্থাৎ লাহোর অধিবেশনের পরিবেশ সৃষ্টি ও তাঁর নিজের বক্তৃতায় পূর্ণমাত্রায় ছিল। যে দ্বিজাতি তত্ত্বকে তিনি মাত্র সাত বৎসর পর প্রকাশ্যভাবে বাতিল করবেন তাকে তাঁর বাক্‌চাতুর্যের সাহায্যে বেদবাক্যের রূপ দেওয়া তাঁর গণনেতায় রূপান্তরিত হবার অন্য প্রক্রিয়া। পাকিস্তান দাবির সপক্ষে পরবর্তীকালে তাঁর এক-একটি চটকদার বিবৃতি ও বক্তৃতা—যার সর্বশেষ হল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী এক ভূখণ্ড দাবি—জিন্নার করতালি-অভিলাষী গণআন্দোলনের নায়কের ভূমিকায় উত্তরণের অপর একটি ধাপ। আর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের প্রত্যক্ষ কার্যসূচির প্রস্তাবের পর থেকে তো তিনি পূর্ণমাত্রায় লোকমনোরঞ্জনকারী গণনেতা। এছাড়া বড় বড় সভা ফেস্টুন ব্যানার ও ইসলামী প্রতীকসহ শোভাযাত্রা বিক্ষোভ কালো পতাকা প্রদর্শন আইনঅমান্য ইত্যাদি বহুবিধ গণমুখী রাজনৈতিক কর্মসূচী এই পর্যায়ে তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত লীগ নিয়েছিল।
গান্ধীও গণআন্দোলনের নায়ক ছিলেন। কিন্তু এর অপরিহার্য পরিণতি লোকমনেরঞ্জনকারী নেতা হবার হাত থেকে তিনি নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন তাঁর চরিত্রের আধ্যাত্মিক অন্বেষণা বৃত্তি ও অহিংসা-নিষ্ঠার জন্য। এর প্রভাবে আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী ভারতবর্ষে তাঁর সৃষ্ট অসহযোগরূপী গণআন্দোলনের উত্তাল ব্যাপ্তির মধ্যে ছোট একটি জনপদ চৌরীচেরার হিংসার দৃষ্টান্ত দেখে তিনি তাঁর “হিমালয় সদৃশ ভ্রান্তি” হয়েছে একথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে অপর কোনো সহকর্মীর সঙ্গে পরামর্শ বিনাই আন্দোলন প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিতে পেরেছিলেন। এবং এর চেয়েও বিস্মকর সত্য এই যে তাঁর সে নির্দেশ পালিতও হয়েছিল। কিন্তু কলকাতা নোয়াখালি এবং তারপর পাঞ্জাব সীমান্তপ্রদেশ লীগের প্রত্যক্ষ কার্যসূচি বীভৎস হিংসা ও বিশৃঙ্খলার জন্ম দিলেও, নিয়মতান্ত্রিক জিন্না তার অসহায় দর্শক, এমনকি ঐ আন্দোলন প্রত্যাহার করার কথা চিন্তাও করতে পারেননি। অবশ্য তাঁর ওরকম আহ্বানে যে কোনো সাড়া মিলত একথা বলা যায় না। পাঞ্জাব সীমান্তপ্রদেশ এবং আসামেও লীগের প্রত্যক্ষ কার্যসূচির প্রস্তাবের নামে যাঁরা হিংসা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে অগ্রণী হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই জিন্নার লীগের কেউ নন, প্রতিষ্ঠানের সদস্য বা অনুশাসনের অধীন নন—একথা জিন্না ও তদানীন্তন লীগ নেতৃত্ব একাধিকবার প্রকাশ্যে বললেও সেইসব ব্যক্তি বা তাঁদের ক্রিয়াকলাপকে জিন্না প্রকাশ্যে নিন্দা করতে পারেননি, নিয়ন্ত্রণ করা তো সুদূরপরাহত। বরং ঐসব দুষ্কৃতির পিছনে হিন্দু সমাজ, কংগ্রেস বা গান্ধীর ষড়যন্ত্র “আবিষ্কার” করে জিন্না নিজের সাফাই গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐসব ক্রিয়াকলাপকে নির্বিবাদে চলতে দিয়েছেন। জিন্নার নেতৃত্বের ভঙ্গী জনতার রাজনৈতিক চেতনা ও সংস্কৃতির মানকে নেতৃত্বের পরশপাথরের ছোঁয়ার ধীরে ধীরে উন্নত করার পরিবর্তে জনতার প্রচলিত মানের কাছে আত্মসমর্পণের এক অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত। বলা বাহুল্য জিন্নার জীবন ও কর্মের অপর এক বিয়োগান্তক অধ্যায় এ।
তবে ন্যায়বিচারের খাতিরে স্বীকার করতে হবে যে অন্তত এই ক্ষেত্রে অসম বিধায়ে জিন্না ও গান্ধীর তুলনা অচল। কারণ ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে ঘটনাচক্রে রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে পড়লেও গান্ধী মূলত রাজনৈতিক পুরুষ ছিলেন না। গান্ধীর এক বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে—তাঁর উদ্দেশ্য “রাজনীতির অধ্যাত্মীকরণ”। তাই এ ব্যাপারে জিন্নার সঙ্গে তুলনা চলতে পারে দেশ-বিদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবর্গের সঙ্গে যাঁরা জনসাধারণের নেতৃত্ব করতে এসেও ক্ষমতাপ্রাপ্তির প্রারম্ভিক সোপান—জনপ্রিয়তার অনুশীলন করতে করতে শেষ পর্যন্ত জনমনোরঞ্জনকারীতে পর্যবসিত হন, অর্থাৎ জনগণের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, তাঁরাই জনসাধারণের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন। ডাঃ ফাউস্টের শয়তানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবার এই আধুনিক নিদর্শন—রাজনীতি-ব্যবসায়ীর বিয়োগান্তক পরিণাম —যত প্রবল ও প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্নই হোন না কেন, জিন্না এড়াতে পারবেন এ একান্তভাবেই অসম্ভাব্য।
পাকিস্তান আন্দোলন চলাকালীন আগাগোড়া তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলা সত্ত্বেও জিন্নার অপর এক ট্র্যাজিডি হল পাকিস্তানে সামরিক শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে যাওয়া। জিন্নার স্বভাবের উগ্রতা যা প্রায় স্বেচ্ছাচারের পর্যায়ে পড়ে তা আমরা লক্ষ করেছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁর কর্মপদ্ধতি, মুসলমান স্বার্থের একমাত্র প্রবক্তা হবার সাধনায় যা ভিন্নমত বরদাস্ত করতে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। নেতা এবং অনুগামী জনতা এইভাবে দীর্ঘকাল রাজনীতির ক্ষেত্রে একটিমাত্র রাগিণীর আলাপনে অভ্যস্ত হলেন। যখন ক্ষমতা পাবার সময় এল জিন্না জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হবার বদলে গভর্নর জেনারেল হওয়া পছন্দ করলেন, কারণ গভর্নর জেনারেল প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে সক্ষম সামরিক বাহিনীরও তিনিই প্রধান। নবসৃষ্ট পাকিস্তানের কেবল প্রধানমন্ত্রীকেই জিন্না মনোনীত করেননি, মন্ত্রীসভার তাবৎ সদস্য তাঁর দ্বারা মনোনীত হয়। দীর্ঘকাল ধরে তিনি লীগের সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হবার পরও সে-পদে রয়ে গেলেন। এইভাবে একই ব্যক্তির হাতে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, সৈন্যবাহিনী এবং ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনা সংক্রান্ত তাবৎ ক্ষমতা কেন্দ্রীত হল। কার্যত এবং স্বভাবে জিন্না নিছক সাংবিধানিক গভর্নর জেনারেল ছিলেন না। ঐ পদ গ্রহণ করার পরও তাঁর হাতে কাশ্মীর এবং সীমান্ত অঞ্চল বিভাগের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব ছিল। গণপরিষদে প্রস্তাব করে তিনি গভর্নর জেনারেল হিসাবে নিজের কর্তৃত্ব বাড়িয়ে নেন। এছাড়া কায়েদ-এ-আজম হিসাবে জনমানসে তাঁর নিজস্ব প্রভাব তো ছিলই। প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতে অন্যান্য মন্ত্রীদের তো বটেই, এমনকি প্রাদেশিক গভর্নর, মন্ত্রী ও বিভাগীয় সচিবদের তিনি সরাসরি নির্দেশ দিতেন। পাকিস্তান প্রাপ্তিতে তাঁর ভূমিকা ও সে-দেশে তাঁর অদ্বিতীয় জনপ্রিয়তার জন্য এজাতীয় ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার কথা কেউ চিন্তা করতে পারতেন না। সংসদীয় সরকারের বিধিবিধান গভর্নর জেনারেল জিন্নার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। “উদ্দেশ্যের দিক থেকে শাসক হিসাবে জিন্নার রাজনৈতিক আচরণে হয়ত প্রশ্ন তোলা যায় না। তবে পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অদৃষ্টে যা ঘটে তার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আচরণের পুনর্মূল্যায়ন করার অবকাশ আছে। নিজের হাতে অধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীত করে এবং একসঙ্গে এতগুলো পদ অধিকার করে তিনি এমন এক নজির সৃষ্টি করলেন যা অপেক্ষাকৃত নিচুদরের মানুষরা অনুকরণ করতে অত্যন্ত প্রলুব্ধ হবে। আর সত্যসত্যই যে প্রলোভন তাঁদের মধ্যে এসেছিল।”(১৮)
“মুসলিম লীগের উপর জিন্নার হয়তো প্রায় একনায়কের মত কর্তৃত্ব ছিল। তবে নিজের চতুষ্পার্শ্বে তিনি যে পাকিস্তানের বাগ্‌জাল রচনা করেছিলেন, তিনি স্বয়ং তার এক বন্দীতে পর্যবসিত হন। ১৯৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জিন্না সে সম্বন্ধ কি ভাবেন না ভাবেন তার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণায় এক নিজস্ব প্রাণ সঞ্চার হয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের উদ্দীপন, ইংরেজদের এদেশে নিজ শাসনের সমাপ্তি-পর্ব ত্বরান্বিত করার আকাঙ্ক্ষা, শিখদের নিজ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কার্যকরী করার সিদ্ধান্ত, কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে, তার আয়তন যাই হোক না কেন, এক শক্তিশালী এককেন্দ্রিক ভারতবর্ষ পাবার উত্তরোত্তর বর্ধিত ইচ্ছা—এসবের উপর জিন্নার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ভারতবর্ষে ইসলামের ভবিতব্য বলে পাকিস্তান অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি, এ সম্ভব হয় বিশেষ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে একাধিক পরস্পরবিরোধী শক্তির সংহতির ফলে। জিন্নার হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ সত্ত্বেও এমনকি তিনি যদি দীর্ঘজীবীও হতেন, তবু একই কারণে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর তাঁর পক্ষে পাকিস্তানের ভিতর অনতিবিলম্বে যেসব সংঘাত ও সংঘর্ষ দেখা দিয়েছিল তার উপর বিজয়ী হওয়া সম্ভব হত না। কারণ পাকিস্তান যদি অপরিহার্য হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশও অপরিহার্য। কেউ যদি তাঁর লক্ষ্যসিদ্ধির পন্থা নির্বাচনে সতর্ক না হন তাহলে দেখা যাবে যে পন্থাই তাঁর জন্য লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছে।”(১৯) জিন্নার জীবন ও কর্মের ট্র্যাজিডির গভীরতা পরিমাপ প্রসঙ্গে উদ্ধৃতির শেষ বাক্যটি বিশেষরূপে লক্ষণীয়।
জিন্নার ব্যক্তিগত জীবনও সমান বিয়োগান্তক। তাঁর প্রথমা পত্নী অল্প বয়সে—জিন্না বিলাতে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই মারা যান। বেশি বয়সে ধর্ম, আচারব্যবহার, মানসিকতা এবং সর্বোপরি বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও প্রণয়সূত্রে জিন্না যাঁকে বিবাহ করলেন তাঁর সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য-জীবন সুখের হয়নি। মোকর্দমা ও রাজনীতি নিয়ে জিন্না এত ব্যস্ত থাকতেন যে তাঁর স্ত্রী রত্তি উপেক্ষিতা ও নিঃসঙ্গ বোধ করতে করতে অবশেষে মানসিক হতাশার শিকার হন এবং তাঁকে একরকম পরিত্যাগ করেই চলে যান। এক ভারতবিখ্যাত রাজনৈতিক
পৃষ্ঠা: ২৮৫

নেতা হিসাবে এ ঘটনা জিন্নার পক্ষে কম অসম্মানজনক ও মনোবেদনামূলক হয়নি। রত্তির মৃত্যুও হয় অল্পবয়সে শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্যে। একমাত্র সন্তান কন্যা দীনাকে জিন্না স্বভাবতই খুবই স্নেহ করতেন। তবে ইংলন্ড থেকে বোম্বাই-এ প্রত্যাবর্তনের পর আবার আদালত ও রাজনীতির চাপে তার প্রতিও জিন্না প্রয়োজনীয় দৃষ্টি দিতে পারেননি। পিতার কর্ম ও মনোজগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন দীনা নিজের জন্য পতি নির্বাচন করে মায়ের অর্থাৎ পার্শী সম্প্রদায় থেকে। স্বভাবতই ততদিনে মুসলমান সমাজের অদ্বিতীয় নেতা হিসাবে জনসমাজে স্বীকৃত জিন্নার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার প্রতিও এ এক প্রবল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। পিতার অহমিকার কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। সুতরাং “জিন্না তাঁর স্বাভাবিক কর্তৃত্বপূর্ণ ভঙ্গীতে মেয়েকে বলেছিলেন যে, ভারতবর্ষে, লক্ষ লক্ষ মুসলমান যুবক রয়েছে এবং তাদের মধ্যে দীনা কাউকে বাছতে পারতেন।” জিন্নার এ মনোভাব ইসলাম-নিষ্ঠার বদলে বরং ইসলামের রক্ষাকর্তারূপে জনমানসে তাঁর যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল এবং যা তাঁর পাকিস্তান দাবির প্রবল সহায়ক তা বজায় রাখার জন্য, এ সত্য উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয় না। অতঃপর সেই তরুণী যে বাবার সঙ্গে পাল্লা দিতে আদৌ পিছপা নয় জবাব দিল: “বাবা, ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ মুসলমান মেয়ে ছিল। তাহলে তুমি কেন তাদের একজনকে বিবাহ করোনি?”(২০) এই “ঔদ্ধত্য” ও “বিদ্রোহ” সচরাচর আনুগত্য পেতে অভ্যস্ত জিন্না বরদাস্ত করতে পারেন নি। দীনার সঙ্গে বাকি জীবন তাঁর আর হৃদ্যসম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়নি। কন্যাকে কদাচিৎ পত্র লিখতে হলে তিনি তাঁর নাম ধরে নয়— “শ্রীমতী ওয়াডিয়া” রূপে সম্বোধন করতেন। পরিচিত মহলে কন্যার কোনো উল্লেখ পর্যন্ত করতেন না। এমনকি তাঁর কোনো কন্যা আছে তাও স্বীকার করতেন না। অর্থাৎ এখানেও রাজনীতির যূপকাষ্ঠে সন্তান-প্রেমের বলিদান। জিন্নার একমাত্র সন্তান দীনা কেবল তাঁর শেষকৃত্যের সময়ে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। কন্যা জামাতা অথবা দৌহিত্র-দৌহিত্রী জিন্নার সাধের পাকিস্তানকে স্বদেশরূপে গ্রহণ করেননি।
“মুসলমানদের রাজনৈতিক অস্মিতা স্বীকার না করার জন্য ‘জিন্নার ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতা’ তাঁকে কংগ্রেসের প্রতি তীব্র বিরূপ ভাবাপন্ন করেছিল। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে কোনো রাজনৈতিক মর্যাদা লাভ করেননি বলে অল্প বয়স থেকেই নিছক নিজের প্রচেষ্টার বলে তাঁকে এ জগতে নিজের স্থান করে নিতে হয়েছিল। অনুশাসন ও আত্মত্যাগের আচার- সংহিতা পালন করে ভারতের রাজনীতিতে তিনি একটা মর্যাদাসম্পন্ন স্থান করে নিয়েছিলেন।(২১) পেশা ও রাজনৈতিক সাফল্যের ব্যাপারে তাঁর একাগ্র সাধনার জন্য তিনি ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি বিশেষ সময় দিতে পারতেন না। দিতে পারলে হয়তো জনজীবনে প্রত্যাখ্যাত হবার পীড়াবোধের কিছুটা উপশমের সম্ভাবনা থাকত। তাঁর চোস্ত সাহেবি পোশাক এবং যে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যে তিনি নিজেকে বিভূষিত করেছিলেন তাকে নিজের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার প্রবণতার চেয়ে বরং তাঁর নির্মোক আখ্যা দেওয়াই অধিকতর সঙ্গত। মধ্যবয়সের রাজনৈতিক বিপর্যয়সমূহের আঘাত কমাবার জন্য তাঁর পক্ষে ব্যক্তিগত বা গৃহস্থ জীবনের স্বাভাবিক আনন্দের স্বাদ পাবার উপায় ছিল না।”(২২)
“যাঁরা জিন্নার কাছে গেছেন তাঁদের প্রায় সবাই তাঁকে রাশভারি, দুরস্থ, একান্তবাসী এবং বিশেষ করে নিঃসঙ্গ রূপে বর্ণনা করেছেন। পরবর্তী জীবনে তাঁর একান্তবাসী স্বভাবের আংশিক কারণ শ্বাসনালীর পুরাতন সংক্রামক ব্যাধি (যার সূচনা হয় সম্ভবত ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে) এবং জুলাই ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে জনৈক আততায়ীর আক্রমণের পর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসাবে তিনজন পর্যন্ত দেহরক্ষীর প্রহরায় থাকার সরকারি ব্যবস্থা। তবে স্পষ্টত তিনি কারো দৈহিক সান্নিধ্য খুব একটা পছন্দ করতেন না এবং বাদবাকি জগৎকে কিছুটা তফাতে রাখতেন। তাঁর সেই বিখ্যাত এক চোখের চশমা ও ঘনঘন পোশাক পরিবর্তনের স্বভাব, তাঁর করমর্দনে অনিচ্ছা ও প্রথম শ্রেণীর কুপে না হলে রেলগাড়িতে ভ্রমণে আপত্তির মতো মনে হয় তাঁর নিষ্কলঙ্ক ফিটফাট থাকার স্বভাবের অভিব্যক্তি। স্যার স্ট্রাফোর্ড ক্রিপস যখন ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন তখন লক্ষ করেন ‘তাঁকে নিজের সঙ্গে নিরন্তর সংঘর্ষরত একান্তভাবে নিঃসঙ্গ এবং এমন এক ব্যক্তি যিনি কারও উপর বিশ্বাস করতে অসমর্থ অথবা তাঁকে সৎপরামর্শ দেবার মতো কেউ নেই মনে হয়েছিল। এ সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা ও সহজবোধ্যতা সহকারে নিজ বক্তব্য উপস্থাপিত করেছিলেন।’ জানুয়ারিতে স্যার রেজিন্যাল্ড কুপল্যান্ড মালাবার হিলের নূতন বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ‘সুযোগ্য আইনজীবীর’ ‘আদালতকে প্রভাবিতকারী উত্তুঙ্গ যোগ্যতা… প্রশংসনীয় প্রাঞ্জলতা…সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ বৃত্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর বিবরণী থেকে জিন্নার ব্যবহারিক অসম্পৃক্ততা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরিচয় মেলে। তাঁর আবাস ও কর্মস্থলের অট্টালিকাটিতে ছিল ‘জমকালো আসবাবপত্রে সুসজ্জিত নয়নমনোহর প্রকোষ্ঠাবলী এবং একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় মর্মরমণ্ডিত বঙ্কিম চত্বর। তার নীচে ছিল একটি তৃণভূমি যা ক্রমশঃ ঢালু হতে হতে এক বৃক্ষবাটিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এবং ফাঁকে ফাঁকে সমুদ্র পরিদৃশ্যমান।’ জিন্না তাঁকে লীগের একগাদা প্রচার পুস্তিকা দিয়েছিলেন, ‘যার অধিকাংশই ছিল তাঁর নিজস্ব বক্তৃতার পুনমুদ্রণ।”(২৩)
জিন্নার বাহ্যজীবন যেমন তাঁর পারিবারিক সম্বন্ধকে প্রভাবিত করেছিল, তেমনি অন্তর্জীবন—বিশেষ করে তাঁর আনন্দ ও বেদনা, সাফল্য ও হতাশা—তাঁর বহির্জীবন- অর্থাৎ রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও পদক্ষেপকে অবশ্যই প্রভাবিত করে থাকবে। যদিচ তার প্রতি আলোকপাত করা আরও গবেষণাসাপেক্ষ ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির সাক্ষ্য বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমে চাগলার একটি উক্তি। তাঁর মতে নিঃসঙ্গ জিন্নার একমাত্র সঙ্গী ভগ্নী ফতেমা জিন্নার হিন্দুবিরোধী ভঙ্গীতে “বিষের একটা অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করে দিতেন।”(২৪) জিন্নার পারিবারিক বন্ধু কানজী দ্বারকাদাসের “সন্দেহ যে তিনি (ফতিমা) গান্ধী-জিন্না (১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ) আলোচনার ব্যর্থতার জন্য কোনো না কোনো প্রকারে দায়ী।”(২৫) দুর্গাদাসের মতে: “বোম্বেতে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠনের আলাপ- আলোচনার ব্যর্থতা (১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ) জিন্নাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত করেছিল। কানজি দ্বারকাদাস আমাকে বলেছিলেন—এবং পরে কে. এম. মুন্সীও এর সমর্থন করেন—যে ফিরোজ শা-এর মৃত্যুর পর বোম্বাই-এ রাজনৈতিক শলা-পরামর্শের দুটি কেন্দ্রস্থল ছিল। এর একটি ছিল সর্দারের “গৃহ” তিলক যেখানে থাকতেন। দ্বিতীয়টি ছিল জিন্নার চেম্বার বা দপ্তর। বোম্বাই-এর খের ও মুন্সীর মতো মন্ত্রীরা (জিন্নার) সেই চেম্বারে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের আন্দোলনের পর তাঁরা বিভিন্ন সময়ে জিন্নার সাহচর্য বর্জন করেছিলেন। বোম্বাই-এ যখন ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হয়, জিন্না দেখলেন যে যে- শহরে তিনি একদা এক বিশেষ শক্তি হিসাবে পরিগণিত হতেন সেখানে যেন প্রায় বহিরাগত হয়ে পড়েছেন। পত্নীর মৃত্যুর পর তাঁর ব্যক্তিগত জীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল। এবারে এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের—তাঁর যে কোনো সমসাময়িকের মতোই যা ছিল গৌরবোজ্জ্বল—শেষে তাঁর সামনে দুটিমাত্র বিকল্প উপস্থিত। হয় রাজনীতি থেকে অগৌরবজনক ভাবে অবসর গ্রহণ অথবা তাঁর বিরোধী পক্ষকে প্রত্যাঘাত করা।”(২৬) নিজ স্বভাবের দারে জন্য জিন্না দ্বিতীয়োক্ত চ্যালেঞ্জই গ্রহণীয় মনে করেছিলেন—এ আমরা দেখেছি। অষ্টাদশ অধ্যায়ে গান্ধীর প্রতি কঠোর বাক্যবাণ নিক্ষেপ করার যে ঘটনা আমরা লক্ষ করেছি তার কারণ অনুধাবন করা অতঃপর সহজ হবে।
এমন একজন বিচ্ছিন্নতা বোধের শিকার ব্যক্তি কি ভাবে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় মুসলমানকে এত দীর্ঘদিন ধরে প্রায় মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন এবং তাবৎ বিরোধিতা সত্ত্বেও এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রাপ্তির মতো মহান লক্ষ্যের অভিমুখে তাঁদের চালিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। বিংশতিতম অধ্যায়ের শেষাংশে এর কিছুটা চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান প্রয়াস তারই সংযোজন। ঐতিহাসিক মূরের মতে: “জিন্নার নেতৃত্ব ও এক মুসলিম জাতীয় চেতনার মধ্যে অপরিহার্য সংযোগ-সূত্র হল, কংগ্রেসের হাতে মর্যাদা লাভে বঞ্চিত মুসলমানদের—আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে উর্দুভাষী মুসলমানদের—নির্যাতিত হবার মানসিকতার জীবন্ত প্রতিরূপ ছিলেন জিন্না।”(২৭) “পটভূমিকার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক খলিদ-বীন-সঈদ জিন্নার ব্যক্তিত্ব ও পাকিস্তান আন্দোলনের সম্বন্ধের চাবিকাঠির অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন। জিন্না ছিলেন এক দাম্ভিক ব্যক্তি, জীবনের বিপর্যয়সমূহ যাঁকে বেপরোয়া করে তুলেছিল। তাঁর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ‘সাযুজ্যতা’ সৃষ্টি হল তাঁর স্বধর্মাচারী জনসাধারণের প্রয়োজনীয়তা ও চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের। এই জনসাধারণ এমন ‘একটি সম্প্রদায়… যা বিরাট ত্রাণকর্তার খোঁজে ছিল…যিনি সমগ্র সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলামের জন্যে ইহজাগতিক গৌরব অর্জনে প্রস্তুত।’ তবুও সঈদের কাছে ‘প্রহেলিকা প্রহেলিকাই থেকে যায়—ঐসব মানুষ কি করে এমন এক নেতার অনুগামী হলেন যিনি এমন কঠোর ও আত্মসংযমী এবং তাদের থেকে এত দূরাবস্থিত।’ তাঁর অনুমান এই যোগসূত্র হল ‘এই ক্ষমতাসচেতন মানুষটি তাঁদের জন্য কোরানে উক্ত সেই রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাঁদের পূর্বপুরুষরা ভারতবর্ষে যার প্রয়োগ করেছেন।”(২৮) গণ-মনোবিজ্ঞান, সমাজ-বিজ্ঞান, অর্থব্যবস্থা ও ইতিহাসের জট ছাড়িয়ে খুব স্পষ্ট একটা চিত্র হয়ত পেশ করা সম্ভব হল না। কারণ আমাদের আলোচ্য বিষয় জিন্না- মানস, যা আর যাই হোক, আদৌ ঋজু নয়।
কাশ্মীরের প্রতি জওহরলালের মতোই জিন্নারও একটা অন্ধ আবেগজনিত আকর্ষণ ছিল। ভারত সরকারের সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে তথাকথিত উপজাতীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ঐ রাজ্যের পাকিস্তান-ভুক্তির প্রয়াস বিফল হওয়ায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এর পরিণামে তাঁর ভিতর ভারত এবং তার সব কিছুর প্রতি বিরোধিতা করার একটা মানসিকতা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর থেকে গড়ে উঠেছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দেশ-বিভাগোত্তর ভারতে মুসলমানদের অসহায় মানসিকতা ছাড়াও ভয় ও উৎপীড়নের কারণে দলে দলে উদ্বাস্তু হয়ে(২৯) পাকিস্তানে গিয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে সংগ্রাম করে জীবনযাপন করতে বাধ্য হবার জন্য গভীর মনোবেদনা। সম্ভবত এই মানসিকতার চূড়ান্ত নিদর্শনস্বরূপ ২৪শে অক্টোবর ঈদুজ্জোহার বাণীতে তিনি বলেন: “শত্রুদের আঘাতের জন্য আমাদের নবজাত রাষ্ট্র রক্তমোক্ষণ করছে। ভারতবর্ষে আমাদের মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দের বলির পশুর মতো অবস্থা। মুসলমান এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় তাঁদের সাহায্য ও সহানুভূতি ছিল বলে তাঁদের উপর অত্যাচার হচ্ছে।”(৩০) এর ছয় দিন পর লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম থেকে এক জনসমাবেশকে সম্বোধন প্রসঙ্গেও তাঁর অনুরূপ তিক্ত মনোভাব ফুটে ওঠে: “আত্মরক্ষার উপায়বিহীন নির্দোষ ব্যক্তিদের যেমন সুপরিকল্পিত ভাবে জবাই করা হচ্ছে, তা ইতিহাসে উল্লিখিত চূড়ান্ত অত্যাচারীর জঘন্য কুকীর্তি সমূহকেও ম্লান করে দেবে। সততা, সৌজন্য ও মর্যাদার প্রাথমিক নীতিকে উপেক্ষাকারী এক গভীর ও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার আমরা। এইসব পাপের শক্তির সঙ্গে লড়াই করার সহস ও বিশ্বাস আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করার জন্য আমরা ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ।”(৩১)
এক সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দুগোষ্ঠীর প্রতিনিধির হাতে “অযৌক্তিকভাবে মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতকারী” ও “পাকিস্তানের দালাল” রূপে চিহ্নিত হবার অভিযোগে নিহত গান্ধীর স্মৃতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান এক সংক্ষিপ্ত প্রকাশ্য শোকবার্তায় বলেন, “তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান ছিলেন” এবং ঐ ঘটনা হল “হিন্দু জাতির (Nation) এক ক্ষতি”। প্রায় তিন দশকের মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যুর পর অন্তত তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার করেননি—একথা “ইংরেজ ভদ্রলোক” জিন্না সম্ভবত অনতিবিলম্বেই উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে নিজের ভুল স্বীকার করা জিন্নার স্বভাববিরুদ্ধ। তাই নিউইয়র্কের একটি ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতির সঙ্গে গান্ধী-তিরোধানের কয়েক দিন পর আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি তাঁর মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্পর্কে সংশোধিত অভিমত ব্যক্ত করেন “জিন্না…প্রকাশ্য বিবৃতিতে যা বলেছিলেন তার তুলনায় অনেক উদারভাবে গান্ধী সম্বন্ধে বলেন এবং একথাও স্বীকার করেন…যে মুসলমানদের পক্ষে এ কী পরিমাণ ক্ষতিকারক হয়েছে।”(৩২) বর্তমান অধ্যায়ের প্রথম দিকে পাকিস্তানের হিন্দু সাংবাদিক শ্রীশর্মার জবানীতে গান্ধী সম্বন্ধে তাঁর পরিবর্তিত মনোভাব সম্বন্ধে আমরা অবগত হয়েছি।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একাধিকবার নিজের ভূমিকা পরিবর্তন করার জন্য জিন্নার প্রতি অব্যবস্থিত চিত্ততার অভিযোগ উঠতে পারে। একদা গান্ধীর সম্বন্ধ জিন্না বলেছিলেন যে, তিনি এক “প্রহেলিকা” এবং এ অপবাদ—যদি একে অপবাদ আখ্যা দেওয়া যায়—তাঁর সম্বন্ধে অধিকতর প্রযোজ্য। প্রত্যুত জিন্নার চরিত্রের এই দিকটির বর্ণনা প্রসঙ্গে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত চার্চিলের এক চিরায়ত উক্তির উদ্ধৃতি দেবার লোভ সংবরণ করা কঠিন—“একটি ধাঁধার মধ্যে রহস্যে আবরিত প্রহেলিকা।”(৩৩) কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা জানেন যে মানুষ একই সঙ্গে একাধিক জটিল উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত হয়। আর জিন্না তো মূলত রাজনৈতিক পুরুষ ছিলেন যাঁদের আদর্শ সর্বদা ম্যাকিয়াভেলীর The Prince না হলেও নিঃসন্দেহে চাণক্যের “মনসা চিত্তয়েৎ কর্ম বচসা ন প্রকাশয়েৎ”।
দেশ বিভাজনের কিছুদিন পরই যে প্রশ্ন উঠেছিল এবং বর্তমানে নূতন করে যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে তা হল—জিন্না কি সত্যসত্যই ভারত বিভাগ করে মুসলমানদের এক স্বতন্ত্র বাসভূমি সার্বভৌম পাকিস্তান চেয়েছিলেন? সমসাময়িক হবার ফলে মৌলানা আজাদের পক্ষে ভিতরের কথা জানার সম্ভাবনা বেশি ছিল এবং জিন্নার প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠার আশঙ্কা নেই। কারণ উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক আদৌ হৃদ্যতামূলক ছিল না। তাঁর অভিমত হল: “সম্ভবত শেষ অবধি পাকিস্তান জিন্নার একটা দরাদরির বিষয় ছিল।”(৩৪) ভিতরের খবর আরও যাঁদের জানার সম্ভাবনা, ভারতের সেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের মতেও(৩৫) – অন্তত প্রথম দিকে জিন্না এই মানসিকতা দ্বারা চালিত ছিলেন। পেনড্রেল মুন ও শ্রীযুক্ত মজুমদার থেকে আরম্ভ করে সাম্প্রতিক কালের ডঃ আয়েষা জালালের মতো আরও অনেক জিন্না-গবেষকেরও এই মত। তাঁদের বক্তব্য—কংগ্রেস ভারত-বিভাজনে রাজী হয়ে যাবে, একথা জিন্না স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। পাকিস্তানের দাবি—তাঁর নিজের দলের জন্য অধিকতর সুযোগ-সুবিধা আদায়ের কৌশল ছিল। যদিচ অন্যদিকে পীরজাদা থেকে আরম্ভ করে শরীফ অল মুজাহিদ এবং মুহম্মদ সালীম আহমদের(৩৬) মতো আধুনিক পাকিস্তানি ও অনীতা ইন্দর সিং-এর মতো ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মতে গোড়া থেকেই জিন্না কেবল মুসলিম স্বার্থের সংরক্ষক ছিলেন এবং পাকিস্তানে তার পূর্ণাহুতি। মনের আসল কথা জিন্না কোনো আত্মজীবনী বা ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে যাননি বলে এ ব্যাপারে আমাদের পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পরীক্ষা করে দেখা ছাড়া উপায়ান্তর নেই। এর সর্বাপেক্ষা জোরালো সাক্ষ্য হল ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে আলোচনার সময়ে লীগের বিকল্প প্রস্তাব—যাতে সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নেওয়া হয়েছিল (অধ্যায় সংখ্যা ২৫) এবং মিশনের ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মে তারিখের প্রস্তাব লীগ কর্তৃক গ্রহণ। ঐ প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বাতিল করা হলেও জিন্না যে তা গ্রহণ করেছিলেন—এটা পাকিস্তান দাবির প্রতি তিনি যে কতটা গুরুত্ব দিতেন তার এক নিদর্শন। একথা সত্য যে ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করার সময়ে লীগ ওতে “পাকিস্তানের সারমর্ম” আছে বলে ঘোষণা করে। কিন্তু এটা যে এতদিন যাঁদের পৃথক পাকিস্তানের জন্য উত্তেজিত করা হয়েছে তাঁদের ভোলাবার জন্যে রাজনৈতিক বাক্‌চাতুরী একথা বুঝতে বিলম্ব হয় না। সুতরাং জিন্না সত্যসত্যই পাকিস্তানের জন্য উদ্‌গ্রীব ছিলেন কিনা—এই সংশয়ের জোরালো ভিত্তি আছে।
তাহলে কেন তিনি পাকিস্তানের জন্য এমন মরীয়া হয়ে আন্দোলন করেছিলেন? আর কেনই বা তাঁর চরিত্রে কিঞ্চিৎ পূর্বে আলোচিত এমন স্ববিরোধ ছিল? এর বড় একটা কারণ সম্ভবত রাজনীতি অর্থাৎ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অধিগত করার অভীপ্সা। প্রত্যক্ষভাবে না হোক, পরোক্ষভাবে—অনুগামীদের মাধ্যমে। কদাচিৎ কোনো রাজনৈতিক পুরুষ লক্ষ্য ও উপায়ের বিচার করেন। জিন্নাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
সর্বশেষে আর একটি প্রশ্ন, ভারতীয় উপমহাদেশের বিগত কয়েক শতাব্দীর তো বটেই, সম্ভবত আগামী কয়েক শতাব্দীরও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা, যার পরিণামে ভারতবর্ষ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো তিনটি রাষ্ট্রের প্রায় ১০০ কোটি নর-নারীর রক্তমোক্ষণ হচ্ছে এবং আরও কতদিন হবে তা ভবিষ্যৎই জানে, সেই দেশ-বিভাগের জন্য দায়ী কে? বিশেষ করে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য জিন্নাকে যদি সন্দেহাবসরে মুক্তি দিতে হয়, তাহলে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াবার জন্য বাকি থাকেন কারা?
ব্রিটিশ সরকার সাম্রাজ্যবাদী শাসন বজায় রাখতে আগা-গোড়া ভেদনীতির সাহায্য নিয়ে ভারত বিভাজনে একটি বড় ভূমিকা নিয়েছিল।(৩৭) ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে বিশেষ করে ভারতে কর্মরত উচ্চপদস্থ ইংরেজ রাজকর্মচারীদের একটা বড় অংশ তাঁদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জকারী কংগ্রেসের বিরোধিতার জন্য লীগের ভারত বিভাগের দাবিতে পরোক্ষভাবে তো বটেই, বহু সময়ে প্রত্যক্ষভাবেও সাহায্য করেন। এটা সাম্রাজ্যবাদের চিরকালের নীতি বলে ভারতের বেলায় বিশেষ করে ইংরেজেদের দোষ দেওয়া যায় না। তবে ক্ষমতা
পৃষ্ঠা: ২৯০

হস্তান্তরের নীতি-নির্ধারক এটলীর সরকার এবং প্রথম দিকে বড়লাট মাউন্টব্যাটেনও ভারত বিভাগের পক্ষে ছিলেন না।
লীগ ছাড়া অপর যে দল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের দবির সমর্থন করেছিল তা হল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। বিশেষভাবে ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করার নীতি গ্রহণ করার পর থেকে ঐ দল পাকিস্তান-প্রস্তাব ও মুসলিম লীগের সমর্থন করা আরম্ভ করে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের গান্ধী-জিন্না আলোচনার সময় থেকেই এই দলের ধুয়া ছিল: কংগ্রেস লীগ মিলনের পথে স্বাধীন হও। এ দলের তদানীন্তন সর্বভারতীয় সম্পাদক শ্রী পূরণচন্দ্র জোশীর স্বীকৃতি হচ্ছে: “আমরাই মুসলমানদের পাকিস্তানের দাবি কংগ্রেসসেবীদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছি।” লাহোরের (পাকিস্তান) প্রস্তাব কংগ্রেসের ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবেরই অনুরূপ “একটি স্বাধীনতা প্রস্তাব” এবং স্বরাজের মতো “পাকিস্তানও মুসলিমদের জন্মগত অধিকার”(৩৮) ইত্যাদি। ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী(৩৯) সহ আরও অনেক বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতাও মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণ দাবির নামে পাকিস্তানের জন্য ওকালতি করেন। এক সাম্প্রতিক গ্রন্থের(৪০) তথ্য অনুসারে অধিকারী গোপনে পাঞ্জাব লীগের ১৯৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনী ইস্তাহার (যার মূল কথা পাকিস্তান) রচনা করেন এবং এর অন্তিম রূপ দেন জিন্না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টিকে পাকিস্তানের জন্য দায়ী করা যায় না। ঐ দলের ঐ ভূমিকার পিছনে বড় বেশি হলে “জনযুদ্ধর” থিসিস চালিত হয়ে সোভিয়েট রাশিয়াকে সাহায্যের উদ্দেশ্য ও এই সুযোগে মুসলমান সমাজে প্রভাব বিস্তারের মানসিকতা ক্রিয়াশীল ছিল। কিন্তু তদানীন্তন ভারতবর্ষে ঐ দলের রাজনৈতিক প্রভাব তখন এমন ছিল না যার জন্য তার পাকিস্তানের দাবির সমর্থনে ঘটনার গতিপথ খুব একটা প্রভাবিত হবে।
কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে ইসলামি মৌলবাদের উদ্দীপনকারী খিলাফৎ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া, আসামের জন্য ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের বাধ্যতামূলক গোষ্ঠীবদ্ধ হবার প্রস্তাবের বিরোধিতা করা এবং সর্বশেষে গৃহযুদ্ধের হাত এড়াবার জন্য অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্যদের কাছে ওয়ার্কিং কমিটির দেশবিভাগের প্রস্তাবকে মেনে নেবার জন্য ওকালতি করার জন্য গান্ধীর নাম এ প্রসঙ্গে উচ্চারণ করা হয়। তবে গান্ধী যে ভারত বিভাজনের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন—তার সপক্ষে শতবিধ সাক্ষ্য উপস্থাপিত করা যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন। তাই সাফল্যের পূর্বক্ষণে তাঁর ব্যর্থতার ট্র্যাজিডির গভীরতা ব্যক্তকারী কংগ্রেস কর্তৃক ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের দোসরা জুন সরকারি ভাবে ভারত বিভাগ মেনে নেবার পূর্বদিন অতি ভোরে তাঁর হৃদবিদারী অর্ধস্বগতোক্তির উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হতে হবে।(৪১) গান্ধীর পরামর্শ অগ্রাহ্য করে এবং তাঁর অজ্ঞাতে নেহরু ও প্যাটেল ৮ই মার্চ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবের মাধ্যমে পাঞ্জাব বিভাজনের যে দাবি করেন তারই পূর্ণাহুতি হয় দোসরা জুনের মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবের স্বীকৃতিতে। কিন্তু জওহরলালও স্বেচ্ছায় নয়, নিরুপায় হয়ে ঐ অবস্থায় উপনীত হন।(৪২) ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে লীগ প্রতিনিধিদের উত্তরপ্রদেশ মন্ত্রীমণ্ডলীতে গ্রহণ না করা এবং ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জুলাই ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়ে জিন্নাকে ঐ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করার জন্য প্ররোচিত করে ভারত বিভাজনের পথ প্রশস্ত করার ব্যাপারে অবশ্যই নেহরুর দায়িত্ব আছে। তবে নিছক ঐ দুটি ঘটনার পরিণামে ভারত বিভাগ হয়েছে মনে করা ইতিহাসনিষ্ঠার পরিচায়ক হবে না। মৌলানার গ্রন্থ সম্বন্ধে লোকসভায় আলোচনা প্রসঙ্গে (২৩শে মার্চ, ১৯৫৯) জওহরলাল ঠিকই বলেছিলেন যে এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক শক্তিসমূহের ভূমিকা বিবেচনা না করা ভুল হবে। ভবিষ্যতে ভারতবর্ষকে একসূত্রে বন্ধন (দেশীয় রাজ্যসমূহের ভারতভুক্তির) করার নায়ক বল্লভভাই প্যাটেল সম্বন্ধেও ঐ একই কথা প্রযোজ্য।(৪৩) কংগ্রেসের প্রথম সারির আরও অনেক নেতাই এর(৪৪) ব্যতিক্রম নন।
সাভারকর “হিন্দু-রাষ্ট্রের জন্য ১৯৩৭ খ্রি. ডিসেম্বরে ভারত বিভাগের প্রকাশ্য দাবি সর্বপ্রথম করলেও এবং হিন্দু মহাসভার নেতারা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে—ভারত বিভাজন যখন মোটামুটি সম্ভাবনার পর্যায়ে পর্যবসিত এবং মুসলমানদের মতই দেশের হিন্দু জনমতও যখন ভারত বিভাগের সপক্ষে মুখর—পাঞ্জাব ও বঙ্গের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভাজন দাবি করে যতটা সম্ভব বেশি এলাকা ভারতবর্ষে রাখার জন্য সাধ্যমতো প্রয়াস করেন বলে শেষ অবধি এই শোচনীয় ঘটনার জন্য একান্ত ভাবে ঐ দলের উপরও দোষারোপ করা যায় না। তাহলে?
গ্রীক নাটকের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা সফোক্লিসের সৃষ্ট নায়ক-নায়িকা এবং বিশেষ করে রাজা ঈডিপাসের কথা এ প্রসঙ্গে স্বভাবতই মনে পড়ে। এক অদৃশ্য শক্তির অঙ্গুলিহেলনে দীপশিখাভিমুখী পতঙ্গের মতো তারা ট্র্যাজিডির অভিমুখে ছুটে চলে। শত প্রয়াস সত্ত্বেও শোচনীয় পরিণতি এড়াতে পারে না। নিষ্কলুষকেও দোষীর সঙ্গে শাস্তি ভোগ করতে হয়। ভারতবর্ষের বিভাজনও সম্ভবত সেই শক্তির খেলা। নচেৎ ভারত বিভাজনের বিরোধী হয়েও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কুশীলবরা ক্ষমতা হস্তান্তররূপী নাটকের শেষ অঙ্কে কোনোরকম ব্যতিক্রম ছাড়াই বার বার এমন ভূমিকা কেন গ্রহণ করলেন, যার জন্য দেশবিভাগ অপরিহার্য হল? কিন্তু আচার্য যদুনাথ সরকারের মতো অদ্বিতীয় ইতিহাসবেত্তার উদাহরণ সামনে থাকলেও সাধারণ ইতিহাসকারের পক্ষে তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্র ছেড়ে এমনকি ইতিহাসের দর্শনের খোঁজেও অপরের এলাকায় প্রবেশ করা বিপজ্জনক। তাই এ প্রসঙ্গে এখানেই ইতি করা বাঞ্ছনীয়।

৩০
পাদটীকা

১. লিওনার্ড মসলে; The Last Days of the British Raj; ওয়াই ডেনফিল্ড অ্যান্ড ছোট নিকলসন, লন্ডন (১৯৬১); ২৪৭ পৃষ্ঠা।
২. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৬৪২ পৃষ্ঠা।
৩. সমগ্রন্থ; ৬৪৪ পৃষ্ঠা।
৪. রাজমোহন গান্ধী; Eight Live; রোলি বুকস, দিল্লি (১৯৮৬); পৃষ্ঠা ১৭৭-১৭৯ ও ২৬৯।
৫. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৬৫০-৬৫১ পৃষ্ঠা।
৬. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩২০-৩২১। খলিকুজ্জমাঁর গ্রন্থে বক্তৃতাটির মাস ভুল উল্লেখ করা হয়েছে। এটি আগস্ট হবে।
৭. “ব্রিটিশের ভূমিকা এমন কিছুর সৃষ্টি করেনি, যার অস্তিত্ব পূর্বে ছিল না। এমন কিছু করা একান্তভাবেই এর ক্ষমতাবহির্ভূত ছিল। যা সুপ্ত অবস্থায় ছিল তাকে হয়তো ইংরেজ সময় সময় জাগিয়েছে এবং যা পাপ তাকেও প্রায়ই কাজে লাগিয়েছে। চা বর্তমানেরই মতো হিন্দু ও মুসলমানের সম্মিলিত ইতিহাস সম্বন্ধে অতীতেও তাদের নারীর মধ্যে মতভেদ ছিল এবং তাদের অস্মিতা ( identity) ও কার্যকলাপের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পার্থক্যের এইটাই হল প্রধান কারণ।”(লোহিয়া; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৬-৭)। ৮. ফতিমা জিন্নার My Brother গ্রন্থ থেকে উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৩৪৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৯. সমগ্রন্থ; ৯৫ পৃষ্ঠা।
১০. “Reminiscences of the Quaid”; জিয়াউদ্দীন আহমদের Mohammad Ali Jinnah (করাচী, ১৯৭৬) গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৬১-৭০। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৩৪৬ ২ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১১. এই তথ্যের সমর্থন অন্যান্য সূত্র থেকেও মেলে। পাকিস্তানের সৃষ্টির কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তাঁর এককালের অন্তরঙ্গ সহকর্মীদের প্রতি একান্ত বিরূপ হয়ে ওঠেন এবং না একাধিক ব্যক্তির কাছে তাঁদের সম্বন্ধে কঠোর মন্তব্য করেন। দ্রঃ উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ম- ৩৬০-৩৬১ পৃষ্ঠা।
১২. Portraits of Myself; সাইমন অ্যান্ড সুস্টার; নিউইয়র্ক (১৯৬০); ১৯০-৯১ পৃষ্ঠা।
১৩. জমিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ৫৬৮ পৃষ্ঠা।
১৪. ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে বোম্বাই-এ আলোচনা প্রসঙ্গে ভ্রাতৃভাব নিয়ে পৃথক ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকুক—গান্ধীর এই প্রস্তাব জিন্না প্রত্যাখ্যান করলেও (জিন্নার ২১শে সেপ্টেম্বরের চিঠি, ত্রয়োবিংশতি অধ্যায়), সম্ভবত কালপ্রভাবে জিন্না এর যৌক্তিকতা উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মার্চ এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন: “ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের নিজস্ব সর্বোচ্চ স্বার্থের খাতিরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও ভারতীয় ডোমিনিয়নের পক্ষে নিজ নিজ ভূমিকার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। এছাড়া এই একই কারণে পাকিস্তান ও ভারতবর্ষ স্বাধীন ও সার্বভৌম জভী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ভূভাগ এবং সমুদ্রের দিক থেকে যে কোনো বহিরাক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার জন্য বন্ধুত্বমূলকভাবে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করুক এটাও উভয় রাষ্ট্রের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।”(Selected Speeches and Statements of Quaid-i-Azam Mohammad Ali Jinnah; এম. রফিক আফজল, লাহোর (১৯৭৬); পৃষ্ঠা ৪৫৮-৪৫৯। রিয়াজ আহমদ কর্তৃক Indo- Pakistan Relations as Visualiased by Quaid-i-Azam M. A. Jinnah কী প্রবন্ধের ৫৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। South Asian Studies; লাহোরের পাঞ্জাব না বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়ন কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত; জুলাই ১৯৮৪ সংখ্যা)। উভয় দেশই নিজ নিজ জাতির জনকের ইচ্ছার প্রতিকূল আচরণ করে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুঠারাঘাত করছে—এও আধুনিক ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর পরিহাস।
১৫. Facts are Facts: The Untold Story of India’s Partition; বিকাশ, দিল্লি (১৯৮৭); পৃষ্ঠা ১২৪, ১৪৩, ১৫২-১৫৪।
১৬. হেক্টর বলিথো; সমগ্রন্থ; ১৯০ পৃষ্ঠা।
১৭. খলিকুজ্জমা; সমগ্রন্থ, ৩৯৭-৩৯৯, ৪০৩-৪০৫ এবং ৪১০-৪১৩ পৃষ্ঠা। সুরাবর্দী ও এ অভিমত সমর্থন করেছেন। দ্রঃ Memoirs of H. S. Suhrawardy; এম. এইচ. . আর. তালুকদার সম্পাদিত; ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা (১৯৮৭); পৃষ্ঠা ১০৯।
১৮. সলীম এম. এম. কুরেশী; Iqubal and Jinnah: Personalities, Perceptions and Politics; সি. এম. নঈম (সম্পাদিত) Iqubal Jinnah and Pakistan; জিন্না পাবলিশিং হাউস, দিল্লি (১৯৮২); পৃষ্ঠা ৩৪-৩৬। এ প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে আলাপ-আলোচনার সুযোগপ্রাপ্ত কয়েকজন বিশিষ্ট বিদেশির অভিমতও প্রণিধানযোগ্য। “কুপল্যান্ড জিন্নাকে লীগের ‘এক রকম ডিক্টেটার’ বলে অভিহিত করেছেন। ক্যাবিনেট মিশনের আলাপ-আলোচনার সময়ে এ. ভি. আলেকজেন্ডারের অভিজ্ঞতাতেও একই অভিমতের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়: ‘মুসলিম লীগের তথাকথিত ভাগ্যবিধাতা শ্রীযুক্ত জিন্না একজন চতুর আইনজীবী …এবং আমার মনে হয় নিজের পদ্ধতিতে তিনি একজন পুরোদস্তুর ডিক্টেটারের সমতুল্য।’ মাউন্টব্যাটেন বিশ্বাস করতেন যে ‘একজন মাত্র যে উপদেষ্টার কথায় জিন্না কর্ণপাত করেন তিনি হলেন জিন্না স্বয়ং’ (মূর; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১১১-১১২। কুপল্যান্ডের উদ্ধৃতি তাঁর “ইন্ডিয়ান ডায়েরির” ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই এপ্রিলের দিনলিপি থেকে। আলেকজেন্ডারের উদ্ধৃতি তাঁর ডায়েরির ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা এপ্রিলের দিনলিপি থেকে। মাউন্টব্যাটেনের উদ্ধৃতি; হডসন; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২১৭ থেকে।
১৯. সি. এম. নঈম; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৮৭।
২০. চাগলা; সমগ্রন্থ; ১২০ পৃষ্ঠা।
২১. জিন্না প্রসঙ্গে তাঁর এক কালের প্রবল সমালোচক জওহরলালের ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে লিখিত অভিমত বিবেচ্য। “তিনি ছিলেন যোগ্য ও দুর্ধর্ষ। পদের প্রলোভন দ্বারা তাঁকে বশীভূত করা সম্ভব নয় যা কিনা এত জনের এত বড় দুর্বলতা।”(Discovery of India; মেরিডিয়ান বুকস লিঃ, লন্ডন, ১৯৫১; পৃষ্ঠা ৩৮৬)। জিন্নার ভারত বিভাগের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে লিখিত গ্রন্থে আম্বেদকরও তাঁকে “দুর্নীতির ঊর্ধ্বে” আখ্যা দিয়েছিলেন। (এন.জি.নূরানী; Indian Express (দিল্লি সংস্করণ); ২৭শে নভেম্বর ১৯৮৮; পত্রিকা অংশ, পৃষ্ঠা ৫)।
২২. মূর; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১০৯।
২৩. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১১১।
২৪. চাগলা; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১১৯।
২৫. এ. কে. মজুমদার; Writtings on the Transer fo Power, 1945-1947; বি. আর. নন্দা (সম্পাদিত) Essay in Modern Indian History; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি (১৯৮০); পাদটীকা সংখ্যক ২৬; পৃষ্ঠা ২১৮।
২৬. দুর্গাদাস; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২১৫।
২৭. মূর; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১১১।
২৮. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১০৭। সঈদের উদ্ধৃতির জন্য সি.এইচ.ফিলিপস ও এস.ডি. ওয়েনরাইট (সম্পাদিত) The Partition of India: Policies and Perspectives 1935-1947 লন্ডন (১৯৭০) গ্রন্থে The Personality of Jinnah and his political strategy প্রবন্ধ (পৃষ্ঠা ২৮২ ও ২৯৩ দ্রষ্টব্য)।
২৯. লিওনার্ড মসলের মতে (সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২৪৩) পাকিস্তানের অমুসলমানদের শতকরা ৪০ ভাগ — আনুমানিক দেড় কোটি নরনারীকে বাস্তুত্যাগ করতে হয়। ভারতবর্ষ – থেকে মুসলিম বাস্তুত্যাগীদের সংখ্যাও কম ছিল না। দেশবিভাজনপূর্ব দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু-প্রবাহের বিবরণের জন্য মার্গারেট-বৌরক হোয়াইটের Half Way to Freedom (সাইমন অ্যান্ড স্টার, নিউ ইয়র্ক, ১৯৪৯) দ্রষ্টব্য। তাঁর শরণার্থীদের দুই imilien তরফা অভিযানের আলোকচিত্রগুলিও ঐতিহাসিক দলিল। এ ছাড়া ফ্রান্সিস টুকারের rose While Memory Serves (ক্যাসেল; লন্ডন, ১৯৫০); হডসনের The Great Divide (অক্সফোর্ড, করাচী ১৯৬৯); পেনড্রেল মুনের Divide and Quit (চ্যাটো অ্যান্ড উইন্ডাস, লন্ডন ১৯৬৪); খুঁটিনাটি তথ্যে কোথাও কোথাও ভুল থাকলেও নাটকীয়ভাবে বর্ণনার জন্য ল্যারী কলিন্স ও ডোমিনিক ল্যাপিয়ারের Freedom at Midnight প্রমুখ গ্রন্থও উল্লেখনীয়। ভারত বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত দাঙ্গায় মৃতের সংখ্যা দুই থেকে দশ লক্ষ (পেনড্রেল মুন; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২৮৩) বলে অনুমিত হয়।
৩০. Speeches by Quaid-i-Azam Mohammed Ali Jinnah, Governor General of Pakistan (করাচী); পৃষ্ঠা ১৮। অ্যালেন-হেইস মেরিয়াম কর্তৃক তাঁর কী গ্রন্থের ১৩৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৩১. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ৩৫৩ পৃষ্ঠা।
৩২. অ্যালান-ক্যাম্পবেল জনসন; Mission with Mountbatten; ২৮৩ পৃষ্ঠা। ৩৩. এই প্রহেলিকার নিদর্শন হিসাবে অসাম্প্রদায়িক ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনে সম্ভবত স্বাধীন উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীর চাহিদা মেটাতে তিনি যে সাম্প্রদায়িক ভূমিকা নিতেন সত্যের খাতিরে তার কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। এর তিনটি উদাহরণ পেশ করা হবে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ই অক্টোবর করাচীতে অসামরিক এবং সৈন্যবাহিনীর তিনটি মিনি শাখার অফিসারদের সামনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “পরিকল্পনা ছিল এই যে আমরা এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব যেখানে আমরা স্বাধীন মানুষ হিসাবে বাঁচতে ও নিঃশ্বাস নিতে পারি, যার বিকাশ আমরা আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি অনুসারে করতে পারি এবং সেখানে ঐস্লামিক সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শ চূড়ান্তভাবে অবাধে ক্রিয়াশীল থাকতে পারে।” ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে মার্চ চট্টগ্রামে এক নাগরিক সংবর্ধনার প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, “পাকিস্তানের ভিত্তি হবে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ঐস্লামিক সমাজবাদের মজবুত বুনিয়াদ…।” ২৮শে মার্চ ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে ঘোষণা করেন, “পাকিস্তান মুসলিম জাতির (nation) ঐক্যের মূর্ত প্রতীক এবং তা-ই থাকবে। সাচ্চা মুসলমান হিসাবে আমাদের সেই ঐক্যকে সতর্কভাবে প্রহরা দিতে হবে ও রক্ষা করতে 1) হবে।”(শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৬৪৩, ৬৫৩ ও ৬৫৪ পৃষ্ঠা।
৩৪. সমগ্রন্থ; ১৯৮৮ সংস্করণ; ১৯৭ পৃষ্ঠা।
৩৫. ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই এপ্রিল বড়লাট লিনলিথগো ভারতসচিবকে এক তারবার্তায় জানান: “জিন্না এইজন্য এ (পাকিস্তান) প্রস্তব উত্থাপন করেছেন যাতে তিনি দেখাতে ai পারেন যে মুসলমানদের নিজেদেরও কোন গঠনমূলক পরিকল্পনা আছে, যাতে কংগ্রেসের উগ্রবাদী গোষ্ঠীর স্বাধীনতার দাবির বিরোধিতা করা যায় এবং কংগ্রেসের এই দাবিরও খণ্ডন হতে পারে যে ঐ প্রতিষ্ঠানই ভারতবর্ষের একমাত্র প্রতিনিধি ও ভবিষ্যৎ প্রগতির একমেব উপায় হল প্রাপ্তবয়স্কদের মতধিকারের ভিত্তিতে গঠিত এক গণপরিষদ।” সন্ধ্যা চৌধুরী কর্তৃক Gandi and the Partion of India গ্রন্থের ৬২- of ৬৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। পাকিস্তান দাবি সম্বন্ধে অন্যান্য পদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারীদের অনুরূপ অভিমতের জন্যও ঐ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৬৩ দ্রষ্টব্য।
৩৬. “The First Phase of Quaid-i- Azam Jinnah’s Leadership in Muslim 1601 League: A Political Study” (Grassroots: Biannual Research Pabna Journal, Pakistan Study Centre; সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়/ জামশারো, সিন্ধুপ্রদেশ; ষষ্ঠ ও সপ্তম খণ্ড—১৯৮২-৮৩; ৯-৩১ পৃষ্ঠা।)
৩৭. আলোচনা প্রসঙ্গে এর বহুবিধ উদাহরণ দেওয়া হলেও অপর একটি সাক্ষ্য উপস্থাপিত করা হবে এক সুষম বুদ্ধির দক্ষ প্রশাসক ও তদানীন্তন ভারতীয় রাজনীতির গোপন খবর সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ব্যক্তি স্যার মীর্জা ইসমাইলের আত্মকথা থেকে: “অকস্মাৎ sore জিন্নার এরকম গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বয়ং জিন্নার চেয়ে বোধহয় আর কেউ অধিক চা বিস্মিত হননি। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তিনি বলেন, যুদ্ধ ঘোষণার পর বড়লাট স্বভাবতই লীগের সাহায্য চেয়েছিলেন। অকস্মাৎ আমার প্রতি বড়লাটের আচরণে একটা পরিবর্তন লক্ষিত হল। আমার সঙ্গে শ্রীযুক্ত গান্ধীর মতো একই রকম আচরণ করা হতে লাগল। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের প্রতি তা হল প্রচণ্ডতম আঘাত। আমি বিস্ময়াভিভূত হলাম। অকস্মাৎ কেন আমার এই পদোন্নতি এবং শ্রীযুক্ত গান্ধীর পাশাপাশি আসন দেওয়া? এর উত্তর হল অখিল ভারত মুসলিম লীগ। অধ্যাপক এডওয়ার্ড টমসনও এই বলে এ কথার পুষ্টি করেন যে, “জিন্নাকে বীজী একরকম মুসলমানদের মহাত্মারূপে বিবেচনা করা সরকারি প্রথায়’ পরিণত হল। নিতী লন্ডনে ভারতীয় গোলটেবিল বৈঠকের পর যে মানুষটি প্রায় বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর কাছে নিঃসন্দেহে এটা কোনো ছোটখাটো লাভ নয়।”(সমগ্রন্থ; ১১০-১১১ পৃষ্ঠা।
পূর্বোক্ত ভূমিকার পুষ্টি করবে বড়লাট লিনলিথগো বিভিন্ন সময়ে ভারতসচিবের কাছে এ ব্যাপারে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তার থেকে নিম্নোক্ত তিনটি উদ্ধৃতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড়লাটের ভূমিকার পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উদ্ধৃতিগুলি হল (৬ই এপ্রিল ১৯৪০) “আমি স্বীকার করছি যে আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হল মুসলমানদের (ভারত) বিভাজনের পরিকল্পনা নির্বুদ্ধিতার প্রতীক হলেও এই সময়ে ঐ পরিকল্পনাকে একেবারে ছি-ছি করা দুঃখদায়ক হবে। অবশ্য এটা স্পষ্ট যে ও পরিকল্পনাকে কেউ গ্রহণ করতে পারে না এবং আমরা নিজেদের ওর সঙ্গে যুক্তও করতে পারি না।”(১০ই জুন ১৯৪০) “এ ব্যাপারে পূর্বেরই মতো গুরুত্বপূর্ণ যে মুসলমানদের ভূমিকাকে পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ সামরিক (বর্তমানে সৈন্যবাহিনীর শতকরা ৬০ ভাগ মুসলমান) দিক থেকে তাদের সাহায্য ও সমর্থন তো প্রয়োজনই, অন্য মুসলিম রাষ্ট্রে সম্ভাব্য প্রক্রিয়ার প্রতি দৃষ্টি রেখেও এটা করা স্বামী দরকার।”(১২ই অক্টোবর ১৯৪২) “মুসলিম লীগ যে সময়ে প্রত্যুত বেসরকারি কার ভাবে যুদ্ধপ্রচেষ্টার সাহায্য করছে সে সময়ে শ্রীযুক্ত জিন্নাকে শত্রুতাভাবাপন্ন না করা বিশেষ প্রয়োজন।”(সন্ধ্যা চৌধুরী কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৬২ এবং ৯৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।) রাজ ওয়ালি খাঁ ও তাঁর গ্রন্থে সীমান্ত প্রদেশের গভর্নর কানিংহামের ডায়েরি উদ্ধৃত করে বোর সরকারি স্তরে ভেদনীতি প্রয়োগের বহু ঘটনার উল্লেখ করেছেন (পৃষ্ঠা ৬১-৭০ )। এছাড়া লীগের পাকিস্তান পরিকল্পনার আসল রচয়িতা যে বড়লাটের শাসন-পরিষদের সদস্য জাফরুল্লা খাঁ এবং লিনলিথগো-এর নির্দেশে তিনি নিজের ভূমিকা গোপন রেখে এই কাজ করেন—এই তথ্যও সীমান্ত গান্ধীর পুত্র দিয়েছেন (সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২০-৩০)।
৩৮. জোশী; কংগ্রেস লীগ মিলনের পথে স্বাধীন হও; বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, কলকাতা। প্রকাশকালের উল্লেখ নেই। তবে গান্ধী-জিন্না আলোচনার ব্যর্থতার পর লিখিত। বঙ্গে লীগ-কমিউনিস্ট আঁতাতের কিছু তথ্যের জন্য আবুল হাশিমের “আমার জীবন ও বিভাগ পূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি”; (চিরায়ত জানা প্রকাশন, কলিকাতা, ১৯৮৮) পৃষ্ঠা ৩৯, ৪৮, ৬৩, ৭৮, ৮২, ৯৪, ১০১ ও ১১৯ দ্রষ্টব্য।
৩৯. অধিকারী; Pakistan and National Unity। কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় কমিটি জ্ঞানী কর্তৃক পুস্তকটির বঙ্গানুবাদও প্রকাশিত হয়।
৪০. অনীতা ইন্দর সিং; The Origins of the Partition of India 1936-1947; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি (১৯৮৭); পৃষ্ঠা ১২৮।
৪১. “আজ দেখছি আমি একান্ত নিঃসঙ্গ। এমন কি সর্দার ও জওহরলালও মনে করেন জো যে আমি যেভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছি তা ভুল এবং ভারত বিভাগ মেনে ( নিলে শান্তি ফিরে আসতে বাধ্য।…আমি যে বড়লাটকে বলেছি যে দেশ-বিভাগ যদি না হয়ই তা যেন ব্রিটিশের হস্তক্ষেপে অথবা ব্রিটিশ শাসনাধীনে না হয়—তা তাঁদের পছন্দ হয়নি।…তাঁদের ধারণা আমার বুদ্ধি হয়তো বয়সের জন্য কাজ করছে না।…আমি হয়তো দেখার জন্য বেঁচে থাকব না—তবে আমি যে সর্বনাশের আশঙ্কা চা করছি তা যদি ভারতবর্ষকে গ্রাস করে এবং তার স্বাধীনতা যদি বিপন্ন হয়, তাহলে ভবিষ্যদ্বংশীয়রা যেন জানতে পারেন যে তার কথা চিন্তা করেই এই বৃদ্ধের হৃদয় কী পরিমাণ ব্যথা-বেদনা ভোগ করেছে। একথা যেন বলা না হয় যে গান্ধী ভারতবর্ষের জীবন্ত ব্যবচ্ছেদের জন্য দায়ী ছিল।”(প্যারেলাল; Last Phase; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ২১০-২১১। নিম্নরেখ প্যারেলালের)। দেশ বিভাজনের ব্যাপারে গান্ধীর ভূমিকা সম্বন্ধে সন্ধ্যা চৌধুরীর পূর্বোক্ত গ্রন্থও দ্রষ্টব্য।
৪২. অসহায় অবস্থায় ভারত বিভাগে সম্মত হওয়া সম্বন্ধে নেহরুর একটি উক্তি— “মাথাব্যথার উপশমের জন্য মাথাটাই কেটে ফেলা” (প্যারেলাল; Last Phase; জাভা দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ১৫৬) পূর্বেই উদ্ধৃত করা হয়েছে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই কারক অক্টোবর নেহরু নিউ ইয়র্ক শহরে স্বীকার করেন যে দেশবিভাগজনিত দুর্দশার কথা যদি তাঁরা অনুমান করতে পারতেন তাহলে এতে সম্মত হতেন না (সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২৫৬)। নেহরুর দিক থেকে তাঁর অন্যতম জীবনীকার মাইকেল ব্রেচার (Nehru – A Political Biography; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৯) এই বিষয়টির বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে নেহরুর ভারত বিভাগে রাজী হবার কারণ: ( (১) শোচনীয় গৃহযুদ্ধের আতঙ্ক; (২) নিরীহ নাগরিকদের হত্যার তুলনায় দেশ- বিভাগ বাঞ্ছনীয়; (৩) ভারতের সম্মুখস্থ সমস্যাবলী এমন গুরুতর ধরনের যে তার। সমাধানে দেশবাসীর হাতে আসল ক্ষমতা আসার প্রক্রিয়াকে আর বিলম্বিত করা চলে না; (৪) এই উৎকণ্ঠা যে “তাদের (লীগ প্রতিনিধিদের) যদি কেন্দ্রীয় সরকারে বাধ্য হয়ে রাখতে হয়, তাহলে কোনো প্রগতি বা (জাতীয় উন্নয়নের) পরিকল্পনা করা সম্ভব হবে না।”(৫) পাঞ্জাব ও বঙ্গের বিভাজনের জন্য প্রদেশদ্বয়ের সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে জরুরি ও অবিরত আবেদন যে তাঁদের প্রস্তাবিত পাকিস্তানে চিরতরে পক্ষপাতের শিকার এবং এমনকি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করা হোক; (৬) ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সম্ভাবনাই তখনকার ঐ পরিবেশে ভণ্ডুল হয়ে জিগোজ যেতে পারে—অন্তত বিলম্বিত তো হবেই; (৭) জোর করে ঐক্য স্থাপনা করা যায় আমার না ইত্যাদি। (পৃষ্ঠা ৩৭৬-৩৭৭)। ব্রেচারের মতে ঐ সাতটি কারণ ছাড়া নিম্নোক্ত পরিস্থিতিও নেহরুকে প্রভাবিত করে: (ক) সে সময়ে ভারতবর্ষে প্রচলিত ব্যাপক বিশ্বাস যে দেশ-বিভাগ স্বল্পকালস্থায়ী ব্যাপার হবে এবং পাকিস্তান নিজের শক্তিতে জীম টিকে থাকতে অক্ষম; (খ) কংগ্রেস মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবকে বাতিল করলে ব্রিটিশ সরকার তার থেকেও খারাপ অপর কোনো পরিকল্পনা ভারতের উপর চাপিয়ে দিতে পারে এবং (গ) কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে দীর্ঘকাল সংগ্রামের পর ক্ষমতা পাবার আকাঙ্ক্ষা (পৃষ্ঠা ৩৭৮-৩৭৯)। ব্রেচার এও মন্তব্য করেছেন যে, “ক্ষমতালাভরূপী পুরস্কার প্রাপ্তির” জন্য নেহরু ও প্যাটেল দেশ-বিভাগে সম্মত হন (পৃষ্ঠা ৩৭৯)।
৪৩. ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে নাগপুরে এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনকালীন বস্তার নামক দেশীয় রাজ্যকে (বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের একটি জেলা) কী ব্রিটিশ রাজকর্মচারীরা (পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের) নিজামকে ইজারা দেবার গোপন ষড়যন্ত্র পাকা করে ফেলেছিলেন এবং ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবে তিনি ফাইল তলব করা সত্ত্বেও বার বার তাঁর আদেশ উপেক্ষা করার কাহিনী বর্ণনা করার পর সর্দার বলেন: “পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ষড়যন্ত্রের ফলে আমাদের স্বার্থ কেমন ভাবে সর্বপ্রকারে ব্যাহত হচ্ছে তার সম্বন্ধে একমাত্র তখনই আমি পূর্ণমাত্রায় সচেতন হলাম এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে যত তাড়াতাড়ি আমরা এসবের হাত থেকে মুক্তি পাই, আমাদের পক্ষে তত মঙ্গল। আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, এমনকি দেশ কোরিয়া বিভাজনের মূল্যেও ঐসব বিদেশিদের ভারত ত্যাগকে ত্বরান্বিত করা শ্রেয়।” ২৫শে নভেম্বর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের এক সভায় বল্লভভাই — বলেন, “আমার মনে হয়েছিল যে আমরা যদি ভারত বিভাগ স্বীকার না করি, তাহলে দেশ টুকরো টুকরো হবে এবং সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বৎসরের অভিজ্ঞতা আমাকে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত করেছিল যে আমরা যেভাবে চলছিলাম তার পরিণাম অবধারিত সর্বনাশ। সে অবস্থায় একটি নয়, একাধিক পাকিস্তানের সৃষ্টি হত। প্রতিটি দপ্তরে পাকিস্তান সেল-এর সৃষ্টি হত।” আরও এক
বছর পর (নভেম্বর, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ) গণপরিষদে এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হিসাবে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি জানান যে পাঞ্জাবের জনৈকে পক্ষপাতগ্রস্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকেও বদলি করানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ছোটলাটের বিশেষ অধিকারের জন্য। দ্বিতীয় সমস্যা ছিল দেশীয় রাজ্যসমূহের উপর ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের (paramouncy)। অতঃপর তিনি বলেন, “যখন আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হই যে সবকিছু হারাতে হবে—তখন শেষ উপায় হিসাবে আমি দেশ-বিভাগে সম্মত হই।”(প্যারেলাল; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৪)।
৪৪. কংগ্রেস সভাপতি কৃপালনীর বক্তব্য: “আজও আমি মনে করি যে একান্ত নির্ভীকতার জন্য তাঁর (গান্ধীর) কথাই যথার্থ এবং আমার ভূমিকা ত্রুটিযুক্ত। তবু কেন আমি তাঁর সহযাত্রী নই? এর কারণ হল এই যে আমার মতে এখনও তিনি ব্যাপক ভিত্তিতে এই সমস্যার (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার) সমাধানের উপায় উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন নি।”(কংগ্রেস বুলেটিন সংখ্যা ৪, ১০ই জুলাই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ; পৃষ্ঠা ৯। শঙ্খধর কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৩১ পৃষ্ঠায় এবং ব্রেচার কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৩৭৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত)। “মৌলানা আজাদ স্বীকার করেছিলেন, ‘সেসময়ে বাপুর কথায় কর্ণপাত না করা আমাদের পক্ষে এক বিরাট ভ্রান্তি হয়েছিল।’ ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেছিলেন, ‘আমরা যদি বুঝতে পারতাম! ” (প্যারেলাল; Last Phase; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ২৫৬।

সংযোজন

১৯৪৭ খ্রি. ভারত-বিভাজনের নায়ক জিন্না সম্পর্কে লেখকের আঠার বৎসরব্যাপী অধ্যয়ন ও গবেষণার পরিণাম ‘জিন্না: পাকিস্তান নতুন ভাবনা’ নামে ১৯৮৮ খ্রি. প্রকাশিত হওয়ামাত্র জনসংবর্ধিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কর্মী মহলে প্রশংসিত হয়। ১৩৯৫ সনের আনন্দ পুরস্কার দ্বারাও গ্রন্থটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দিল্লি ও লন্ডন থেকে এর ইংরাজি সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে এবং দেশ-বিদেশে এ প্রসঙ্গে একালে যাঁরা লিখছেন তাঁদের অনেকেই এই গ্রন্থটি থেকে বারবার উদ্ধৃতি দিয়ে এর মূল্য স্বীকার করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমানে তিনটি রাষ্ট্রের বর্তমানে প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের জীবন ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মূল নায়ক জিন্নার জীবন ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে লেখকের অনুসন্ধান নিরন্তর চলছে। তার পরিণাম জিন্নার মানস ও ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে অতিরিক্ত তথ্যের এই সব পর্ব, যা তাঁর ‘জিন্না: পাকিস্তান/নতুন ভাবনা’র বক্তব্যকে আরও পুষ্ট করে এখনও তার প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করে।
জিন্নার সমসাময়িক ও তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে একজনের স্মৃতিচারণ দিয়ে এ প্রসঙ্গের সূত্রপাত করা হবে।
স্মৃতিচারণের নায়ক ড. সচ্চিদানন্দ সিনহা। তিনি ছিলেন গান্ধীপূর্ব যুগের কংগ্রেস নেতা, প্রখ্যাত ব্যারিস্টার, শিক্ষাব্রতী ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অনুসারী সাংসদ। কেন্দ্রীয় পরিষদ ও বিহারের বিধানসভা—উভয় সদনেই তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ভারতের গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবীণতম হিসাবে গণপরিষদের উদবোধনী অধিবেশনের পৌরোহিত্য করার জন্য তাঁকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। জিন্নার সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ ও পরিচয় ১৮৯২ খ্রি. লন্ডনে লিংকনস ইন-এ আইনের সহপাঠী হিসাবে। একই পেশা ও জনসেবায় সমান আগ্রহের জন্য কালক্রমে তাঁরা খুবই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন। ড. সচ্চিদানন্দ সিনহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বয়সকালেও স্বচ্ছ স্মৃতিশক্তির জন্য তাঁর স্মৃতিচারণের(১) সংক্ষিপ্ততা সত্ত্বেও তা বহু তথ্যের আকর।
ড. সিনহার স্মৃতিচারণের সূচনায় তাঁদের লিংকনস ইন-এর ছাত্রজীবনের কথা। লন্ডনের ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে তখন জাতীয়তাবাদের প্রবল উন্মাদনা। তাঁর নিজের ও সহপাঠী জিন্নার মধ্যেও তার জোয়ার। সুতরাং সেই সময়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের যে নির্বাচন হয়েছিল তার একটি আসনের প্রার্থী ভারতের ‘গ্রান্ড ওল্ড ম্যান’ বা প্রবীণ জননায়ক দাদাভাই নওরোজিকে বিজয়ী করার জন্য অন্যান্য ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা উভয়েই কোমর বেঁধে লেগে পড়েছিলেন। নির্বাচন কেন্দ্রের একটি বিশেষ এলাকার ভার জিন্নার উপর ছিল। ড. সিনহার সাক্ষ্যমতে ওই এলাকায় “জিন্না যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন তা অতীব সন্তোষপ্রদ এবং খুব ন্যায়সংগত কারণেই তিনি যশোলাভ করেছিলেন।” দাদাভাই-এর চমকপ্রদ বিজয়ের পর ভারতীয় ছাত্রেরা যে ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন, “তার অসামান্য সাফল্যের গৌরব প্রধানত জিন্নার। কারণ তিনিই অনুষ্ঠানের আয়োজন কমিটির নির্বাচিত সম্পাদক ছিলেন।”
পৃষ্ঠা: ৩০০

স্যার ফিরোজশাহ মেহতার চেম্বারে ব্যারিস্টার হিসাবে জিন্নার শিক্ষানবিশী প্রসঙ্গেও ড. সচ্চিদানন্দ সিনহা বলেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বোম্বাই-এ স্যার ফিরোজশাহের অপর নাম ছিল মুকুটবিহীন সম্রাট। প্লেটো-র আকাদেমির মতো “চিমনলাল শীতলবাদ, দিনশা ওয়াচা ও অন্যান্য প্রবীণ রাজনৈতিক নেতৃবর্গদের নিয়ে তাঁকে কেন্দ্র করে (জিন্না ও আমার মতো) আরও যেসব নবীন আইনজীবীরা একত্রিত হয়েছিলেন তাঁরা স্যার ফিরোজশাহ ও তাঁর সমগোত্রীয় বন্ধুবর্গের সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতে রাজনৈতিক দর্শন বলতে যা বোঝাত সে সম্বন্ধে আলোচনার অবাধ সুযোগ পেতেন।” ড. সিনহার মনে ছিল যে তিনি তখন প্রায়ই বোম্বাই-এর আইনজীবীদের সেই আসরে উপস্থিত হতেন। আর জিন্নার সঙ্গেও নিয়মিত দেখা হত বলে তাঁদের বন্ধুত্ব আরও নিবিড় হয়ে উঠেছিল।
১৯০৬ খ্রি. অক্টোবরে বড়লাট মিন্টোর কাছে আগা খাঁ-এর নেতৃত্বে কেবল মুসলমানদের এক প্রতিনিধিমণ্ডল মুসলিম দাবি নিয়ে যে দরবার করতে গিয়েছিল, তার পরবর্তী পদক্ষেপ নিছক মুসলমানদের জন্য এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনার উদ্দেশ্যে ওই বৎসরের শেষে ডিসেম্বরে ঢাকায় মুসলমানদের এক সভা আহুত হয়। জিন্না সেই সভা যোগদানের প্রলোভন ত্যাগ করেন। তার পূর্বেই অক্টোবরে কলকাতায় দাদাভাই নওরোজির সভাপতিত্বে কংগ্রেসের যে বাৎসরিক অধিবেশন নির্ধারিত ছিল, তিনি তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন দাদাভাই-এর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে। জিন্না ও ড. সিনহা উভয়েই ১৯১০ খ্রি. মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারের পর ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউনসিলে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই বৎসরই এলাহাবাদে ড. সিনহার বাড়িতে অতিথি হিসাবে থাকাকালীন “কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে জিন্না এক প্রস্তাব উত্থাপন করে জোরালো ভাষায় ওই মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের তীব্র নিন্দা করেন।” ড. সিনহা আরও বলেছেন, “১৯১০ খ্রি. সেই ভূমিকা থেকে জিন্না সরতে সরতে ১৯৪০ খ্রি. পাকিস্তান প্রস্তাবে যেন নিজের পায়ের নীচে জমি পেলেন এবং ১৯৪৭ খ্রি. তার গভর্নর জেনারেল হয়ে সেই বৃত্ত পূর্ণ হল।”
ড. সিনহার মতে কংগ্রেস নেতার ভূমিকা থেকে জিন্নার দূরে সরে যাবার এই প্রক্রিয়ার সূচনা হয় ১৯২০ খ্রি. নাগপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশন থেকে। সেখানে মৌলানা শওকত আলি কর্তৃক দৈহিক পীড়নের আশঙ্কা এবং উপস্থিত প্রতিনিধিদের একাংশের সরব বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে গান্ধীকে তিনি ‘মহাত্মা’ অভিধায় উল্লেখ করতে অস্বীকার করেন। জিন্নার সে সময়কার মনোভাব তাঁর বহুদিনের সুহৃদ ড. সিনহা নিম্নোদ্ধৃত ভাষায় ব্যক্ত করেছেন: “জিন্নার হৃদয়ের প্রবলতম বাসনা ছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রথম ও প্রমুখ হওয়া। এ হল পূর্ণ গ্রাসের মানসিকতা—আমি প্রথম, অপর কারও স্থান নেই। যতদিন কংগ্রেস কর্মীরা তাঁকে সেই মর্যাদা দিয়েছে, তিনি তাঁদের সঙ্গে থেকেছেন। কিন্তু ১৯২০ খ্রি. মহাত্মা গান্ধীর মতো এক কংগ্রেস নেতার আবির্ভাবে কূটবুদ্ধিসম্পন্ন জিন্না অবিলম্বে আবিষ্কার করলেন যে একাধিক কারণে তিনি আর কংগ্রেস সংগঠনে ইতিমধ্যে যে গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন এবং কালে যাকে পূর্ণাঙ্গ করার ইচ্ছা তিনি পোষণ করতেন, তা আর সম্ভব হবে না।” বন্ধুর এই ধারণার কারণের আরও গভীরে প্রবেশ করে ড. সিনহা বুঝেছেন সে কংগ্রেসের উপর গান্ধীজির ঐ প্রভাবে অবিসংবাদী রূপে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে জিন্নার মতো পাশ্চাত্য চাল-চলনযুক্ত কেউ তো নয়ই, নূতন নেতার সঙ্গে কেউই সার্থক ভাবে পাল্লা দিতে পারবেন না। কারণ তাঁর মধ্যে সন্ন্যাসী স্বভাব, অতীন্দ্রিয়ভাব, শান্তিবাদ, নিরামিষ আহার, মাদক-বর্জন, অসহযোগ, অহিংসা, চরকায় সুতা কাটা, ঐহিক বিষয়বস্তুর ত্যাগ ও ভারতের স্বাধীনতার জন্য উদগ্র আকাঙ্ক্ষা—সব কিছু মিলেমিশে এক অনবদ্য ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি করেছিল। জিন্না অবিলম্বে উপলব্ধি করেছিলেন যে কংগ্রেসের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওই পিচ্ছিল নিরামিষ ভোজী ও আদ্যন্ত সব রকমের মাদক বর্জিত প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে শীঘ্রই তিনি কোণঠাসা হয়ে যাবেন। সুতরাং সে খেলায় নেমে কাজ নেই।
ড. সিনহার অভিমত “জাতীয়তাবাদ থেকে জিন্নার সাম্প্রদায়িকতাবাদে উপনীত হবার সমস্যা ‘সুপার ইগো’ (Super Ego)-এর রোগবিদ্যা (Pathology) বোঝার মতো, মনোবিজ্ঞানীদের মতে যা চিকিৎসার অসাধ্য ব্যাধি। এর সূচনা নিঃসন্দেহে তাঁর জীবনে যথেষ্ট গোড়ার দিকে ঘটেছিল এবং যতই দিন গেছে এর প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। আদালতে আইনজীবীর পেশা আরম্ভ করার প্রথম দিকেই এটা দেখা দেয়। কারণ বোম্বাই উচ্চ আদালতের বিচারক যখন সওয়াল প্রসঙ্গে তাঁকে বলেন, ‘মনে রাখবেন মি. জিন্না, আপনি কোনো তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটকে মামলা বোঝাচ্ছেন না,’ তখন চটজলদি তিনি জবাব দেন, ‘ধর্মাবতার, আমাকে আপনি একথা বলার অনুমতি দিন যে আপনি কোনো তৃতীয় শ্রেণীর উকিলের সঙ্গে কথা বলছেন না।’ না, জিন্নার ক্ষেত্রে কোনো রূপে বা ব্যাপারে তৃতীয়, এমনকি দ্বিতীয় শ্রেণীরও কিছু ছিল না। তাঁর গগনচুম্বী আশা হয় তিনি সর্বত্র প্রথম ও প্রধান, নচেৎ কিছুই না।”
১৯২০ খ্রি. পর থেকে জিন্নার “জাতীয়তাবাদ থেকে এই ক্রমবিচ্যুতি” ড. সচ্চিদানন্দ সিনহার মতে তাঁকে শেষ অবধি রূপান্তরিত করে “এক মুসলিম লিগপন্থী ও কট্টর সাম্প্রদায়িকতাবাদীতে।” এই কারণে ড. সিনহা জিন্নার জীবন প্রবাহকে “বৈপরীত্যের সমাহার” আখ্যা দিয়ে এ প্রসঙ্গের উপসংহার হিসাবে মন্তব্য করেছেন, “রাজনীতির ক্ষেত্রে ইতিহাসে এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিবর্তন অথবা এমন রূপান্তরে অনীহার নিদর্শন কদাচিৎ মেলে।”
১৯১০ খ্রি. ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের (দুজনেই যার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন) একটি কামরায় জিন্নার সঙ্গে তাঁর যে আলোচনা হয়েছিল তার হুবহু বর্ণনা করেছেন ড. সিনহা নিজের দিনলিপির ভিত্তিতে। কলকাতায় জিন্নার স্যার রফিউদ্দিন আহমদের (ওই নির্বাচনে একই আসনে জিন্নার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত এবং পরবর্তী কালে বোম্বাই প্রেসিডেন্সির মন্ত্রী) সঙ্গে আলোচনা এবং তাঁর অন্যান্য তথ্য সূত্রের (বিশেষত ১৯৩৬ খ্রি. লাহোরের দয়াল সিং কলেজ ইউনিয়নের আলাপচারিতা) উপর ভিত্তি করে ড. সিনহা বলেছেন যে তাঁর বন্ধু কট্টর ইসলামি জীবনচর্যার অনুসারী ছিলেন না। ইসলামি আচার- আচরণ অথবা বিধি-নিষেধ, খাদ্যাখাদ্য বিচার মানার ব্যাপারে তাঁর কোনো গোঁড়ামি ছিল না। তিনি ছিলেন নিজ যুগের এক আদর্শ আধুনিক যুক্তিবাদী পাশ্চাত্যশিক্ষিত ব্যক্তি। কিন্তু রাজনীতিতে মুসলিম স্বার্থের প্রবক্তা হয়ে মুসলিম লিগের কর্ণধার হবার পর মুসলিম স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্রতী হয়ে জিন্নার পূর্বোক্ত আধুনিক জীবনযাত্রা পদ্ধতি সম্পূর্ণ পালটে গিয়েছিল। জিন্নার স্বভাবের আমূল পরিবর্তনের কথাও উল্লেখ করেছেন ড. সিনহা। জীবনশক্তিতে উচ্ছল উদ্দাম ও সুরসিক একজন মানুষ তাঁর অত্যন্ত প্রিয় সুন্দরী স্ত্রী রতনপ্রিয়া বা রুট্টির সঙ্গে দুর্ভাগ্যজনক বিচ্ছেদ ও শেষ অবধি তাঁর অকালমৃত্যুর পর কেমন ভাবে নিজের মধ্যেই যেন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন জিন্না এবং “আত্মমগ্ন ও এমনকী জনসাধারণের ভালোমন্দের প্রশ্নের বিবেচনার সময়ে রূঢ়” হয়ে উঠলেন—সেই কাহিনী।
ভারত বিভাজনের দায়িত্ব ড. সিনহার মতে জিন্না ছাড়াও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও কংগ্রেসেরও। ব্রিটিশ শাসক সম্প্রদায় “কংগ্রেসের প্রভাব খর্ব করার জন্য একদিকে জিন্না ও পাল্লার অপর দিকে কংগ্রেস দলকে স্থাপনা করেছিলেন।” আর “কংগ্রেস নেতারাও জিন্না ও তাঁর লিগের সম্যক গুরুত্ব বুঝতে পারেননি।” “মুশকিল হয়েছিল এই যে গোঁড়া সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে মুসলিম জনগণের মধ্যে জিন্নার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সম্বন্ধে কংগ্রেস দলের নেতৃবর্গ না যথোচিত ধারণা করতে পেরেছিলেন আর না ব্যাপারটার প্রতি গুরুত্বও দিতে সমর্থ হয়েছিলেন।” ড. সিনহার মতে এরই কারণ জওহরলাল, ‘ভারতে কেবল দুটি মাত্র দল বিদ্যমান’—এ জাতীয় কূটনীতি-বহির্ভূত উক্তি করেছিলেন।
১৯৩৭ খ্রি. কংগ্রেস প্রাদেশিক সরকার সমূহের দায়িত্ব গ্রহণ করে যখন ঘোষণা করে যে তা করা হল “সংবিধানকে বানচাল করার জন্য” তখনও ওই একই ভুল হয়। ড. সিনহার অভিমত আবার উদ্ধৃত করা যাক। কংগ্রেস নেতৃবর্গ কর্তৃক, “পূর্বোক্ত এবং অনুরূপ ঘোষণা ও পদক্ষেপ জিন্নাকে প্রভূত সাহায্য করছিল। এইসবের পরিণামে তিনি কেন্দ্রীয় পরিষদে কংগ্রেস দলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বুদ্ধি ও কূটকৌশলের যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। ফলে কংগ্রেস দল অবিজ্ঞের মতো (১৯৩৫ খ্রি.) সংবিধানের ফেডারেশনের অংশ বাতিল করে এবং বাক্যবন্ধের অর্থ কী কে জানে—ম্যাকডোনাল্ড রেয়াদাদ না বাতিল করছে, আর না গ্রহণ করছে ঘোষণা করে।” এর সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের অপর একটি অসুবিধা ছিল এই যে তার প্রথম সারির নেতৃবর্গ ১৯৩৭ খ্রি. বিধানসভা ও মন্ত্রীসভা থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়িত্ব যাঁদের উপর পড়ে তাঁদের সংসদীয় বিধিব্যবস্থা পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল না। এর পরিণাম সম্বন্ধে এ প্রসঙ্গে ড. সিনহা যে মন্তব্য করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য: “কংগ্রেস দল ভুলে গিয়েছিল— অথবা এই সত্য শিখতে পারেনি বলাই ভাল—যে রাজনৈতিক ও সংসদীয় গণতন্ত্রের সার হচ্ছে এক শক্তিশালী ও সুসংগঠিত বিরোধী পক্ষ। এই বিরোধী দলকে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এবং প্রতিটি গুরুতর সমস্যার ক্ষেত্রে শাসকদলকে যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। তা সে ক্ষমতার কেন্দ্রে তখনকার মতো বিদেশি ব্রিটিশরাই থাক, অথবা বর্তমানের মতো জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রাই থাকুন। জিন্না ১৯১০ খ্রি. থেকে সংসদীয় রাজনীতির কলাকৌশলে অভিজ্ঞ ছিলেন বলে স্বভাবতই ১৯৩৭ খ্রি. কংগ্রেস দলের সংসদীয় রাজনীতির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থান ছিল তাঁর।”
ড. সচ্চিদানন্দ সিনহা ছিলেন নিজ কালের তীক্ষ্ণধী বুদ্ধিজীবী এবং আইন ও সংসদীয় রাজনীতির রীতি-নীতিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ভারতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধেও দৃঢ় নিষ্ঠা ছিল তাঁর। এমন একজন মানুষের জিন্নার জীবন ও যুগের মননশীল মূল্যায়নের মূল্য তাই একালেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতের মতো বহু জাতিসত্তা, বহু ধর্ম ও বহু সম্প্রদায়ের দেশে বর্জন বা পৃথক থাকার মানসিকতা নয়, সবাইকে গ্রহণ করেই পথ চলতে হবে। ড. সিনহার চূড়ান্ত অভিমত হল: “জিন্নার জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা খোজা সম্প্রদায়ে, যার সৃষ্টি গুজরাতের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত এককালের হিন্দুদের মধ্যে থেকে। সেই সমাজের তাঁর মতো এমন একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি যাঁর বৌদ্ধিক স্তর সুউচ্চ এবং যিনি দেশের আইনজীবী ও জনসেবকদের মধ্যে এত উচ্চ স্থানে ছিলেন, তাঁর প্রতি ১৯২০ খ্রি. নাগপুর কংগ্রেসে এবং পরবর্তী কালে মতবৈষম্যের সময়ে যেরকম ব্যবহার করা হয়েছিল, তার থেকে একেবারে ভিন্ন ধরনের ব্যবহার অপেক্ষিত ছিল।” নিজ বক্তব্যের উপসংহার করেছেন ড. সিনহা হরিজন পত্রিকায় প্রকাশিত গান্ধীজির একটি রচনার উদ্ধৃতি দিয়ে যাতে তাঁর মর্মবেদনার ছাপ স্পষ্ট: “প্রায় সমগ্র ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায় কেন বিদেশের মুসলিম রাষ্ট্রগুলির কাজে-কর্মে এত গভীরভাবে আগ্রহী, অথচ দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জীবন ও তার অগ্রগতির ব্যাপারে তেমন আগ্রহ প্রদর্শন করেন না? দেশের ব্যাপারে মুসলমানদের অপেক্ষাকৃত কম আগ্রহের কারণ এই যে ভারতকে তাঁরা এখনও স্বদেশ মনে করেন না, আর তার জন্য তাঁরা গর্বিত। একান্ত ভ্রমাত্মক ভাবে তাঁদের অনেকে নিজেদের এ দেশ জয়কারী জাতির সদস্য ভাবেন। মুসলমানদের এই দূরত্বের মানসিকতার জন্য আমরা হিন্দুরাও কিছুটা দায়ী। আমরা তাঁদের জাতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বিবেচনা করি না। তাঁদের হৃদয় জয় করার জন্য আমরা তৎপর হইনি।”
অতীতের ভুল থেকে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা নেবার প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী ও সুসংহত জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের গড়ে ওঠা যাঁদের কাম্য, জিন্না-মানস ও তাঁর কার্যকলাপ সম্বন্ধে তাঁদের না জানলে চলবে না। কেবল তা-ই নয়। ভারতীয় উপ মহাদেশের জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে প্রায় ১৫০ কোটি অনুন্নত নর-নারীদের উন্নয়ন ও মানববিকাশের জন্য যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও হার্দ্য সম্পর্কের প্রয়োজন, তার জন্যও অতীতের বিবাদের কারণ জানা অত্যাবশ্যক। ১৯৪৭ খ্রি. পূর্বে যা ছিল হিন্দু ও মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিবাদ, এখন তা প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের বিবাদে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়ে তিনটি রাষ্ট্রেরই সীমিত সম্পদকে স্ব স্ব দেশের নাগরিকদের উন্নয়নের কাজে না লাগিয়ে ধনী দেশের ধনী অস্ত্র উৎপাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র কিনে তাদের আরও ধনী করার কাজে লাগানো হচ্ছে। বিংশ শতাব্দীতে এই দুর্ভাগ্যজনক বিবাদের বিবরণ ও তার এক কেন্দ্রীয় পুরুষ জিন্নার কাহিনী তাই এখনও সমান প্রাসঙ্গিক।


অতঃপর তাঁর অপর তিনজন ঘনিষ্ঠ সমসাময়িক নেতার দ্বারা জিন্নার মূল্যায়ন দেখব ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই নেতৃবৃন্দ কোনো না কোনো সময়ে জিন্নার সঙ্গে রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন।
এঁদের প্রথমজন হলেন মোতিলাল নেহরু (১৮৬১-১৯৩১) যিনি তদানীন্তন কেন্দ্রীয় পরিষদে জিন্নার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন ইংরেজ প্রশাসনকে নাস্তানাবুদ করার ব্যাপারে। ১৯২৮ খ্রি. দোসরা অক্টোবর মোতিলাল এক পত্র প্রসঙ্গে গান্ধীজীকে লেখেন: “একটি মাত্র ব্যাপার ছাড়া মানুষটি (জিন্না) খাঁটি। নেতৃত্ব হারাবার ভয়ে তিনি সদা শশঙ্ক এবং এ ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নিতে তিনি রাজি নন। এই দুর্বলতার কারণে মাঝে মাঝে তিনি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল প্রস্তাবের সমর্থন করতে প্রস্তুত হয়ে যান। বাস্তবে তাঁর কোনো অনুগামীই নেই। তাঁর তথাকথিত অনুগামীরা জিন্নার পূর্বোক্ত দুর্বলতা ভালভাবেই বোঝেন এবং তাই তাঁকে নিজেদের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য করেন। হাতের খেলার পুতুলে পরিণত করার পর জিন্নাকে মুসলমানদের বড় নেতার মর্যাদা দেওয়ার আর অসুবিধা কি? আমার বা তাঁর অপরাপর বন্ধুদের সঙ্গে মন খুলে আলাপ-আলোচনার সময়ে অবশ্য সর্বদা তিনি তাঁর এজাতীয় পদক্ষেপের সমর্থনে উপযুক্ত যুক্তি দিতে পারেন না। সময়ে সময়ে তাঁর একমাত্র যুক্তি হল: ‘আরে মশাই! আমাকে এইসব মুর্খদের সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। ”(২)
ডাঃ এম.এ. আন্সারী (১৮৮০-১৯৩৬) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একনিষ্ঠ প্রবক্তা ও কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতা। কংগ্রেস সভাপতির পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। জিন্নার অন্যতম গুণগ্রাহী পৃষ্ঠপোষক শ্রীমতী সরোজিনী নাইডুকে ১৯২৭ খ্রি. ২৬শে জুন নিম্নোদ্ধৃত ভাষায় জিন্না সম্বন্ধ নিজ ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন তিনি: “আমার ধারণা মনে মনে তিনি জাতীয়তাবাদী হলেও (জয়াকরের মতো) কালের দাবিতে সাম্প্রদায়িকতাবাদীতে পরিণত হয়েছেন। তবে এভাবে যিনি পরিস্থিতি বুঝে চটপট নিজের মৌলিক বিশ্বাস বদলে ফেলতে পারেন, তাঁর উপর আমার বিশেষ আস্থা নেই।”(৩)
তৃতীয় জন হলেন মোতিলালের পুত্র জওহরলাল নেহরু (১৮৮৯-১৯৬৪), ক্ষমতা হস্তান্তরণের প্রক্রিয়ায় মুসলিম লীগের সর্বেসবা জিন্নার সঙ্গে কংগ্রেসের অগ্রগণ্য নেতা হিসাবে যাঁকে পাঞ্জা লড়তে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। জওহরলাল ও জিন্নার প্রকাশ্য রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসংঘর্ষের কটু রূপ সর্বজনবিদিত। ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও দৃষ্টিভঙ্গীর আসমান- জমিন তফাত ঐসব প্রকাশ্য তিক্ত সংঘর্ষে স্পষ্ট হয়ে উঠলেও সেইটাই সব নয়। জিন্না সম্বন্ধে জওহরলালের তীব্র বিরূপতার মূল দ্বিতীয় নেহরুমানসের গভীরে প্রোথিত ছিল। এই বিরূপতার উৎস সন্ধানে জওহরলালের ব্যক্তিগত ডায়েরি এবং বিশেষ করে দীর্ঘ কারাবাসের সহজলব্ধ অবসরে মানুষ যখন আত্মসমীক্ষার, নিজের মুখোমুখি হবার অখণ্ড অবসর পায় তখনকার রোজনামচার সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার মধ্যে মানুষ যেকথা ভাবার সুযোগ পায় না এবং সভ্য সমাজের ভদ্র নাগরিক হিসাবে যেসব যথার্থ মনোভাব ব্যক্ত করা জওহরলালের মতো মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না, তা তিনি অকপটে লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁর “কারাগারের ডায়েরি”-তে।
কালটা হচ্ছে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ খ্রি.। মহাত্মা গান্ধী বোম্বাই-এর কংগ্রেস অধিবেশনে অবিলম্বে স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন্য ইংরেজ শাসক শক্তিকে “ভারত ছাড়ো” বলার পর পরবর্তী গণ আন্দোলনের ব্যুহ রচনার কথা ঘোষণা করলেন। ইংরেজ শাসকেরা মহাত্মার প্রস্তাবিত অহিংস গণআন্দোলনের সূত্রপাতের সুযোগ না দিয়ে সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার রাতেই মহাত্মাসহ কংগ্রেসের প্রথম সারির সব নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করলেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বন্দী সদস্যদের মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর দুর্গে নিয়ে যাওয়া হল ৮-৯ই আগস্ট ভোর রাতেই। ১৯৪৪ খ্রি. ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রথম প্রয়াস “সিমলা সম্মেলন”-এর জন্য সরকার কারামুক্ত না করা পর্যন্ত জওহরলাল আহমেদনগর দুর্গেই বন্দী ছিলেন। রাজনৈতিক কার্যকলাপের ব্যস্ততা থেকে বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত নেহরু এই সময়ের সদ্ব্যবহার করেন তাঁর দ্বিতীয় শখ—লেখাপড়ার চর্চা করে। একটানা মনোযোগ
পৃষ্ঠা: ৩০৫

দিতে পারার জন্য তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া”-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার সঙ্গে সঙ্গে রচনা করেন সমসাময়িক ব্যক্তি ও ঘটনা সম্বন্ধে তাঁর অবারিত দৃষ্টিভঙ্গীর বিবরণ তাঁর “জেল ডায়েরি”।
এই সংক্ষিপ্ত সমীক্ষায় “জেল ডায়েরি”-তে জিন্না সম্বন্ধে বহুবার জওহরলাল যে বিরূপ মন্তব্য ও বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছিলেন তার সম্পূর্ণ বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে মূল গ্রন্থে যেমন বলা হয়েছে, বিশেষ করে এর ৩৯, ৬৮, ৯২, ১২২, ১৫৪-৫৫ ও ৩২৩- ২৪ পৃষ্ঠায় তদানীন্তন মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সর্বেসবা নেতা জিন্না সম্বন্ধে নিজের মনের তিক্ততা যেভাবে নেহরু খোলাখুলি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাতে ক্ষমতা হস্তান্তরণের বিভিন্ন পর্বে কংগ্রেসের এই মুখ্য প্রতিনিধি যে কোনোমতেই মুসলিম লীগের প্রধানের সঙ্গে কোনোরকম রফা করবেন বা তাঁকে সূচ্যগ্র ভূমি ছেড়ে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত মোর্চা তৈরি করবেন তার মানসিকতা দেখা যায়নি। ১৯৪৩ খ্রি. ২৮শে ডিসেম্বর দিনলিপিতে নেহরু যা লেখেন এই দিক থেকে তা গুরুত্বপূর্ণ: “আমার মনে হয় ভারতের প্রগতির ব্যাপারে জিন্নার মিথ্যা ঔদ্ধত্যপূর্ণ মাথাকে বারবার গলাবার সুযোগ দেবার বদলে পাকিস্তান বা আর যা কিছু তিনি চান, তা মেনে নেওয়া ভাল।” ঐ একটিমাত্র বাক্য থেকে জওহরলালের যে কোনো সমালোচক ত্বরিৎ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে ১৯৪৭ খ্রি. মে মাসে মাউন্টব্যাটেন যখন সর্বপ্রথম ভারত বিভাজনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন তখন কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের মধ্যে তিনিই কেন তা চটপট স্বীকার করে নেন।


এম. আর. এ. বেগ ১৯৩৪ খ্রি. থেকে ১৯৪০ খ্রি. পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বৎসর জিন্নার একান্ত সচিব ছিলেন। ভারতের ইতিহাস এবং জিন্নার রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ কালপর্ব ঐ ছয় বৎসর। জিন্না যেন ঐ কয় বৎসরে প্রবাদোক্ত ফিনিকস্ পাখির মতো নিজের পুরাতন দেহাবরণ ভস্ম করে দিয়ে নবকলেবর ধারণ করেন। বেগ সেকালের এক বিশিষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তি এবং সরোজিনী নাইডু, মোতিলাল ও জওহরলালের স্নেহধন্য ছিলেন। স্বাধীনতার পর ইরানে ভারতের রাষ্ট্রদূতসহ তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেন। তাঁর স্ত্রী তারা আলী বেগ দেশের শিক্ষাসংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এম. আর. এ. বেগ বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে তাঁর আত্মস্মৃতি(৫) রচনা করেন যাতে জিন্নার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিরল সুযোগের কারণ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনীতি সম্পর্কে অন্তরঙ্গ সংবাদ পরিবেশন করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা সম্বন্ধে বেগ-এর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য দিয়ে তাঁর জিন্না প্রসঙ্গের সূত্রপাত করা হবে।
বেগ যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক মুক্তমনা তরুণ এবং জাতীয়তাবাদী ধ্যান- ধারণায় ওতঃপ্রোত এসব জেনে-শুনেই জিন্না তাঁকে নিজের একান্ত সচিব হিসাবে নিয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তদানীন্তন রাজনীতিতে জিন্নাকে ক্রমশ কেবল মুসলমান ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখে বেগ-এর মনে জিন্নার আহ্বানে সাড়া দেবার ব্যাপারে দ্বিধা ছিল। কিন্তু প্রতিভাসম্পন্ন যুবকটিকে স্বমতে আনার জন্য তুখোড় ব্যরিস্টার জিন্না নিম্নোক্তভাবে তাঁর সামনে যুক্তিজাল বিস্তার করলেন: “তোমার ধারণা হিন্দু ও মুসলমানেরা একসঙ্গে চলতে পারবে। আমিও মনে-প্রাণে চাই যে তা-ই হোক। তবে তোমাকে বলে রাখছি যে যতদিন কেবল হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ হবার কারণে শক্তিশালী এবং অনৈক্যের কারণ মুসলমানরা দুর্বল, ততদিন তা হবার নয়। হিন্দু ও মুসলমানেরা ভারতীয় দেহের দুই বাহু। কিন্তু যে দেহের একটি বাহু পক্ষাঘাতগ্রস্ত তার ভবিষ্যৎ কি? দুর্বল বাহুকে শক্তিশালী করার চেষ্টা তো সমগ্র দেহে শক্তিসঞ্চারের জন্য।…তুমি যদি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য চাও তো প্রথমে মুসলমানদের জন্য কাজ করতে হবে।” সে সময়ে ঐটাই ছিল জিন্নার ভূমিকা। বেগ-এর মনে তবুও সংশয়ের রেশ ছিল। তিনি তাই বলেছিলেন, “হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে আমি পূর্ণ মাত্রায় আপনার সঙ্গে আছি…তবে ঐক্য ও সাম্প্রদায়িকতা পরস্পর বিরোধী ভূমিকা। আর মুসলিম লীগ তো আদ্যন্ত সম্প্রদায় বিশেষের প্রতিষ্ঠান। বিশেষ এক সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে কি ভাবে আপনি সাম্প্রদায়িক ঐক্য অর্জন করবেন?” জিন্না জবাব দিলেন, “তরুণ বন্ধু! মুসলমান বা রাজনীতি সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান অতীব অল্প। মুসলমানদের তোমার পথে পুরোপুরি আনতে হলে তোমাকে প্রথমে তাদের দিকে অধের্ক পথ এগিয়ে যেতে হবে।”
নিঃসন্দেহে এ এক প্রায়োগিক পদ্ধতি। তবে সময়ে হতাশ চিত্তে বেগ উপলব্ধি করেছিলেন যে জিন্না “মুসলমানদের সম্বন্ধে নয়, আগ্রহী ছিলেন মুসলিম লীগের ব্যাপারে।” আর ইতিমধ্যে বেগ মুসলিম লীগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করলেও তাঁর মূল বিবেচ্য ছিল মুসলিম সম্প্রদায়। বেগ-এর মনে হল: “তিনি (জিন্না) গণনেতা হলেও জনগণের জন্য সময় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। জনগণের প্রতি তাঁর মনোভাবের প্রতিধ্বনি শোনা যেত টেনিসনের সেই বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তিতে: “তারা কোনো জবাব দেবে না/ তারা কোনো যুক্তিতর্ক দেখাবে না,/তারা কেবল আদেশ পালন করবে আর মরবে (Theirs not to make reply / Theirs not to reason why / Theirs but to do and die:)। বড় বেশি হলে টেনিসনের উক্তিকে সামান্য পরিবর্তন করে বলা যেতে পারত—Theirs but to vote and die। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সংবাদপত্রে লীগের লাহোর প্রস্তাবের বয়ান এবং তার সমর্থনে জিন্নার জোরালো দ্বিজাতি তত্ত্বের বক্তৃতার বিবরণ পাঠ করে বেগ জিন্নার দেওয়া দায়িত্বভার ত্যাগ করেন।
তবে ইতিমধ্যে বেগ জিন্নার চিন্তাভাবনা ও কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন এবং আমাদের এই নতুনভাবনার দৃষ্টিতে তা গুরুত্বপূর্ণ। বেগ-এর অভিজ্ঞতার প্রথম অংশ হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি এবং এক ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক মনস্ক ভারতীয় হিসাবে জিন্নার ভূমিকা সংক্রান্ত। তবে যেহেতু মূল গ্রন্থে (জিন্না: পাকিস্তান/নতুন ভাবনা) তা পূর্বেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তাই তার আর পুনরুক্তি করা হচ্ছে না। বেগ অবশ্য তাঁর স্মৃতিচারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের বর্ণনা করেছেন যখন থেকে জিন্না সম্প্রদায় দুটিকে “জাতি” (nation) হিসাবে উল্লেখ করা শুরু করেন। জিন্নার প্রায় সমস্ত প্রেস বিজ্ঞপ্তি ও তাঁর নামে প্রকাশিত রচনার খসড়াকার হিসাবে ১৯৩৯ খ্রি. অক্টোবর মাসের একসময়ে বেগ ব্রিটিশ পত্রিকা Time and Tide-এর সম্পাদকের দ্বারা জিন্নাকে কৃত অনুরোধের প্রত্যুত্তরে তাঁর তরফে একটি লেখার খসড়া রচনা করেন। সম্পাদক মহাশয় জিন্নার কাছ থেকে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সম্বন্ধে একটি রচনা প্রার্থনা করেছিলেন। লেখাটি অবশ্য পত্রিকার ১৯৪০ খ্রি. ১৯শে জানুয়ারির সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল (মূল গ্রন্থের ১৯তম অধ্যায় ও ১৮তম পাদটীকা দ্র:)। বেগ জিন্নার তরফে লিখিত রচনার খসড়াটি তাঁর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পেশ করেছিলেন। বেগ-এর বয়ান অনুসারে জিন্না “লেখাটি অনুমোদন করেন, তবে এক স্থলে পরিবর্তনের পর।” বেগ-এর খসড়ায় এই মর্মে একটি বাক্য ছিল, “এমন এক সংবিধান রচনা করতে হবে যাতে এই কথা স্বীকৃত যে ভারতের দুটি সম্প্রদায়ই (Community) যেন উভয়ের মাতৃভূমির শাসনকার্যে অবশ্যই সহভাগী হতে পারে।” জিন্নার নামে বেগ যে খসড়া প্রবন্ধটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য দাখিল করেছিলেন তাতে তিনি কেবল ঐ বাক্যের সম্প্রদায় (communities) শব্দটি কেটে দিয়ে নিজ হাতে সেখানে জাতিদ্বয় (nations) শব্দটি বসিয়ে দিলেন। ঘটনাটি থেকে জিন্নার মানসিকতায় দ্বিজাতি তত্ত্বের অস্তিত্বের বীজের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। আর এই দ্বিজাতি তত্ত্বকেই তিনি প্রথম প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেন লাহোরে ১৯৪০ খ্রি. ২২শে মার্চ মুসলিম লীগের বাৎসরিক সম্মেলনে নানা যুক্তি-তর্কের সাহায্যে।
দীর্ঘকাল যাবৎ জিন্নাকে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখার কারণ বেগ-এর ধারণা যে লাহোর প্রস্তাব কার্যকরী করা অর্থাৎ ভারত বিভাজনের ব্যাপারে লীগ নেতা আদৌ গুরুত্ব দিতেন না। ঐ দাবি আসলে তাঁর দরাদরির কৌশল ছিল। নিজের ধারণার সমর্থনে বেগ পেনড্রেল মুন-এর বিখ্যাত “Divide and Quit” গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন, যার মতে “ব্যক্তিগত আলাপচারিতে জিন্না লাহোরে দুই একজনের কাছে স্বীকার করেন যে ঐ প্রস্তাব একটা ‘কৌশলী পদক্ষেপ।” এছাড়া “ছয় বৎসর পর একেবারে আলাদা হবার থেকে বেশ কম পেয়েও তিনি বাস্তবে সন্তুষ্ট থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন” তার থেকেও মুন-এর পূর্বোক্ত ধারণা স্পষ্ট হয়েছিল (মুন-এর গ্রন্থের পৃষ্ঠা ২১; অক্সফোর্ড পেপার ব্যাক, দিল্লি, ১৯৮৮)। বেগ এছাড়াও আরও কয়েকটি সাক্ষ্যের উল্লেখ করেছেন নিজের ধারণার সমর্থনে। লাহোর প্রস্তাবের বয়ান সংবাদপত্রে পড়ার পর বেগ-এর জিন্নার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তাঁর লীগের যেসব বন্ধু লাহোরে গিয়েছিলেন সেখান থেকে ফিরে তাঁরা এই কথা বলে বেগকে তিরষ্কার করেছিলেন যে, “কিসের জন্য তুমি ঐ প্রস্তাবকে এতটা গুরুত্ব দিতে গেলে?… জানো না, ঐ হিন্দুরা হল বেনের জাত, আর এই একটা ভাষাই বেনেরা বোঝে।”
মুসলিম লীগের অদ্বিতীয় নেতা জিন্নার ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতার আরও কিছু ঘনিষ্ঠ ঝলক আমরা জিন্নার সঙ্গে বেগ-এর দীর্ঘদিনের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যের জন্য পাই তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে। “সাধারণ পরিবারে জন্ম নিলেও জিন্না বোম্বাই-এর আইনজীবীদের মধ্যে উপরের সারিতে উঠেছিলেন কেবল নিজের চরিত্রের দৃঢ়তা, কঠিন পরিশ্রম ও যোগ্যতার বলে। পেশাগত সাফল্য তাঁর আর্থিক স্বচ্ছলতার পথ প্রস্তুত করেছিল এবং এর ফলে তিনি অনায়াসেই এমন এক উচ্চস্তরের জীবনমান ও জীবন-যাপন পদ্ধতি গ্রহণ করেন যেন তা তাঁর জন্মসিদ্ধ অধিকার। উন্নতির শিখরে উপনীত হবার পর তিনি তাঁর অপেক্ষাকৃত দুর্ভাগা অনুগামীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এবং এটা তাঁর পক্ষে আদৌ প্রশংসনীয় ছিল না। তিনি অতঃপর যা হয়ে উঠলেন তাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ‘স্নব’ বা উন্নাসিক বড়লোক-ঘেঁষা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সামাজিক ক্ষেত্রে অতঃপর তিনি হয়ে উঠলেন কারও সঙ্গে খাপখাওয়ানোয় অক্ষম অমিশুক প্রকৃতির এবং সামাজিক মর্যাদায় যাঁরা একমাত্র তাঁর পর্যায়ের এবং ড্রইংরুম ও ক্লাবে যাঁরা তাঁর সমরুচিসম্পন্ন তাঁদের সঙ্গে ছাড়া অপর কারও সঙ্গে তাঁর মেলামেশার ক্ষমতা রইল না। আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি হয়ে উঠলেন এক ‘কমিটি ম্যান’ এবং তাঁর সমান বুদ্ধিস্তরের মানুষ ও কনফারেন্স টেবিলের চারপাশের দক্ষিণপন্থী মানুষ ছাড়া আর কারও সঙ্গে মেশার বাসনা তাঁর মন থেকে লোপ পেয়ে গেল। ….গান্ধীজি ও জওহরলালজির তুলনায় ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা তাঁর মতো আর কেউ হতে পারেন না।…মিস্টার জিন্না পক্ষান্তরে নিজস্ব ড্রইংরুমে বেশ জাঁকিয়ে বসে থাকতেন যেখানে মুসলমান জননায়কেরা এসে চেষ্টা করতেন যদি তাঁকে বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। তবে ঊর্দু না জানার কারণ তিনি এমনকি জনসভায় বক্তৃতা দেওয়া এড়িয়ে চলতেন। সামাজিক ভাবে সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর কোনো সময় ছিল না এবং রাজনৈতিকভাবে কোনো সাধারণ বা ছোট-খাটো রাজনৈতিক কর্মীকে সময় দিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তবুও তাঁর অনুগামীরা তাঁর পিছনে সার বেঁধে দাঁড়াত।”… “অধিকন্তু নিজের সম্বন্ধে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী মিস্টার জিন্না নেতার চেয়ে বরং ডিক্টেটর ছিলেন। মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি নামে কমিটি হলেও তার একমাত্র কাজ ছিল জিন্নার কথায় হ্যাঁ বলা। লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতিত্ব করতেন তিনি কোনো সেনা-ছাউনির সেনাপতির ধরনে।”
“কারও পক্ষে কদাচ তাঁর খুব অন্তরঙ্গ হওয়া সম্ভব হত না এবং মনে হত তিনি যে কোনো রকমের নৈকট্য এড়িয়ে চলতেন। তিনি ও তাঁর ভগ্নী প্রকাশ্যতই এতটা স্নেহ ভালবাসা বঞ্চিত ছিলেন যে কখনো আমি তাঁর এই মানসিকতার কারণ বুঝে উঠতে পারিনি। বিকেলের পর বিকেল তাঁরা দুজনে কেবল নিঃশব্দে বসে থাকতেন যেন দুটি কঠোর আত্মসংযমী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীর পাষাণমূর্তির মতো,—দুটি বিশুষ্ক দেহ, শুভ্রকেশ, মলিন- বিষণ্ণ মৌন ব্যক্তি এবং একের পর এক বৎসর অতিবাহিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আরও শুষ্ক-রুক্ষ হতে থাকলেন। বহু সময়ই আমি ভেবেছি যে যদি ঐ নীরস ও নিরানন্দ পুরীতে একটু ভালবাসা, প্রাণস্পন্দন ও হাসির অস্তিত্ব থাকত তাহলে ভারতের ইতিহাসের গতিপথ কতটা পরিবর্তিত হতে পারত! আমার ধারণা যে তাঁর অমুসলিম স্ত্রী রত্তির (রতনবাই)— যাঁর সঙ্গে তাঁর বিবাহ সে যুগের জিন্নার স্বভাবেরই অনুকূল ছিল—মৃত্যুর পরই তাঁর ভিতর অমন প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রবল নেতিবাচক সাম্প্রদায়িকতা জন্ম নেয়। রুট্টি বয়সে জিন্না থেকে খুবই ছোট ছিলেন এবং ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবের জীবনরসে ওতপ্রোত মহিলা এবং তিনিই জিন্নাকে স্বাভাবিক বিশ্বজনীন ও সর্বতো অসাম্প্রদায়িক রেখেছিলেন।
বেগ জিন্নার জীবনে যেসব ঘুলঘুলি খুলে ধরেছিলেন তার সহায়তায় আমরা তাঁর মনোজগতের আর কয়েকটি ঝাঁকি-দর্শন উপহার দিয়ে এ প্রসঙ্গে দাঁড়ি টানব।
“আমার ধারণা তাঁর বিবেকের কোনো গভীর গহনে নিজের সাম্প্রদায়িকতাবাদী ভূমিকার কারণ জিন্না দংশন-জ্বালা ভোগ করতেন। কারণ বরাবরই তাঁকে আত্মপক্ষসমর্থন প্রয়াসী মনে হত।” অপিচ, “একাধিক বার তিনি যৌথনির্বাচন প্রথা মেনে নেবার প্রস্তুতি দেখিয়েছিলেন। তবে অপেক্ষাকৃত গোঁড়া মুসলমানদের দ্বারা তা স্বীকার করিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে তিনি মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণের কথাও এর সঙ্গে বলতেন। যদিও দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলা হত না, যে বিশেষ সুবিধাকে তাবৎ বিধিনিষেধবিহীন অবাধ নির্বাচনের পথে অর্ধেক সফরও বিবেচনা করা চলে। কিন্তু এখানে ওখানে গুটিকয়েক আসনের লোভে তাঁর বিরোধিতা করা হত। ফলে তিনি গভীর আঘাত পেতেন এবং হতাশ হয়ে মনে করতেন যে তাঁকে পথে বসানো হল। এইভাবে ধীরে ধীরে তাঁর মনে এই ধারণা গড়ে উঠল যে মুসলমানরা কংগ্রেসের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পেতে পারে না।”
“মিস্টার জিন্নার একমেব আগ্রহ ছিল নিছক সংসদীয় রাজনীতি। তাঁর মতে মুসলিম লীগের একমাত্র ভূমিকা হল সংসদীয় ক্ষমতা দখল। এই কারণে তিনি একরকম মুসলিম লীগের স্রষ্টা ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা হতে পারেন, তবে এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি পূর্ববৎ অজ্ঞাবাদী রূপেই রয়ে যেতে পারেন। তাঁর কর্মপদ্ধতি ও মানসিক কাঠামো ই-ই ছিল নিছক অসূয়ক ও রাজনীতিনির্ভর এবং রাজনীতিতে যাঁরা ধর্মের আমদানি করতেন তিনি তাঁদের উপহাস করতেন—তবে ইসলামকে নয়।… মিস্টার জিন্না ছিলন আদ্যন্ত রাজনৈতিক মুসলমান। যখন তিনি অবিভক্ত ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করতেন নিজেকে মনে করতেন মুসলমান সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতা। আবার যখন পাকিস্তানের পটভূমিতে ভাবতেন তখন তাঁর চিন্তা-ভাবনা আবর্তিত হত মুসলিম জাতিকে (nation) কেন্দ্র করে। নিছক ইসলাম তাঁর চিন্তায় খুব কমই ঠাঁই পেত। যখন তাঁকে এ জাতীয় প্রশ্নের সম্মীন হতে হত যে কেবল ধর্মবিশ্বাসের একত্ব কিভাবে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকে এক জাতিতে পরিণত করতে পারে—তাঁর উত্তর হত যে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করে দিয়েছে যে জাতীয়তা হল নেহাতই এক আত্মবাদী (subjective) ধারণা। মুসলমানেরা যদি নিজেদের এক জাতির মনে করে তবে তারা একই জাতির ব্যাপারটা মাত্র এই। হিন্দুত্ব বা হিন্দুদের প্রতি তাঁর তেমন বিরূপতা ছিল না, রাগ ছিল কংগ্রেসের প্রতি যাকে তিনি মুসলিম লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনা করতেন এবং মুসলিম লীগকে তিনি মনে করতেন তাঁর আপন সম্প্রসারিত সত্তা। নিঃসন্দেহে তিনি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ঘটনা নিয়ে বেশ মাথা ঘামাতেন, তবে তা এই কথা প্রমাণের চেষ্টায় যে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সরকারসমূহ মুসলমানদের ধন প্রাণ রক্ষায় ব্যর্থ। তিনি মুসলমানদের ভীত করে মুসলিম লীগে যোগ দিতে প্ররোচিত করার জন্য দেশে হিন্দু-রাজ এর কথাও বলতেন। তবে তাঁর সঙ্গে আমার যে অসংখ্যবার আলাপ- আলোচনার সুযোগ মিলেছে সেসময়ে কদাপি হিন্দু সম্প্রদায় বা ধর্মকে কোনোরকম আক্রমণ করতে দেখিনি। তাঁর বিরূপতা ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি যা কালক্রমে বিদ্বেষের রূপ ধারণ করে। আর তিনি যদি গান্ধীজি, জওহরলালজি প্রমুখদের নির্মম ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ও নিন্দায় প্রবৃত্ত হয়ে থাকেন তো তা হিন্দু হবার জন্য নয়, মূলতঃ কংগ্রেসের কর্ণধার হবার কারণে। তাঁর অসংখ্য হিন্দু বন্ধু ছিল।”
সর্বশেষে, “…শেষ অবধি তিনি যা হয়ে দাঁড়ালেন তাহল বেদরদী নির্মম ও সর্বতো দোষদর্শী এক ব্যক্তিত্ব। যদি তিনি ঐকান্তিক ভাবে চেয়েও থাকেন যে পাকিস্তানের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিতে হিন্দুরা থেকে যান, তাঁর ভিতর যে রাজনৈতিক সত্তা তা কেবল ঐ হিন্দুদের ক্ষেত্রে সুপরিচিত জিম্মি তত্ত্ব উত্থাপন করার থেকে তাঁকে প্রতিনিবৃত্ত রেখেছিল। তিনি স্বয়ং এবং নিছক মুষ্টিমেয় উৎকট লীগপন্থী ছাড়া সামগ্রিক ভাবে মুসলমানেরা কখনো পাকিস্তান দাবিকে দরকষাকষির বিষয় ছাড়া আর কিছু ভাবতেন না। তাই তাঁরা যখন বুঝতে পারলেন যে সত্য সত্যই পাকিস্তান হতে চলেছে তখন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের মুসলমানেরা আতঙ্ক বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। তাঁদের শান্ত করতে ও তাঁদের রাজনৈতিক সমর্থন এরপরও পাবার ব্যাপারে নিঃসংশয় হবার উদ্দেশ্যে মিস্টার জিন্না তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বলা শুরু করলেন যে পাকিস্তানের হিন্দুদের শান্তি ও সন্তুষ্টি বিধান করে স্বাধীন ভারতে রয়ে যাওয়া মুসলমানদের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার পাওয়া সুনিশ্চিত করা হবে।
পৃষ্ঠা: ৩১০

এই যুক্তির উপস্থাপনার দ্বারা মিস্টার জিন্না যে ধরনের নেতিবাদের পরিচয় দিলেন তাকে খুব একটা নিন্দা করা চলে না। তাঁর ভিতর এমন যথেষ্ট বুদ্ধি ছিল যাতে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে তাঁর পাকিস্তানের যেসব অনুগামীদের স্বয়ং তিনি এমনভাবে তাতিয়েছিলেন যে তাঁরা ভারতে হিন্দুদের সঙ্গে একত্র থাকতে অস্বীকার করেন, পাকিস্তানে যাওয়ার পর তাঁরাই আবার হিন্দুদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা বরদাস্ত করবেন। আর কংগ্রেসি ও হিন্দুদের মুসলিম-বিদ্বেষী হবার ব্যাপারে তিনি যত প্রচার করেছিলেন তার একাংশও যদি সত্য হত, তাহলে নিজেদের দেশকে দ্বিখণ্ডিত হতে দেখার পর, কোনোমতেই তাদের মুসলিম-বিদ্বেষের মাত্রা কম হতে পারে না। এসবের পরিণামে পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘুরা হয় বিতাড়িত আর নচেৎ ধর্মান্তরিত হচ্ছেন। আর ভারতে আরও কত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছে এবং প্রকাশিত সংখ্যার অনেক বেশি মুসলমানের এইসব বিবাদে প্রাণ গেছে। কতজন হিন্দু বা মুসলমানকে জিম্মি তত্ত্বের আওতায় আনা হয়েছে সে সংখ্যা জানার উপায় নেই। কিন্তু ফাঁদে পড়া এইসব অসহায় মানুষদের অবস্থা নিয়ে কে আর অনুশোচনা করছে।”(৬)


পরবর্তী সাক্ষ্য সমূহের বৈশিষ্ট্য হল—মানুষগুলি পাকিস্তান ভারত নির্বিশেষে সমকালীন। আর তাঁরা জিন্নার সহকর্মী হলেও যে অর্থে ড. সচ্চিদানন্দ সিনহা বা মোতিলাল নেহরু ছিলেন বা যেমন ভাবে এম. আর. এ. বেগ অতি কাছের থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, তেমন ভাবে নয়। তবে জিন্নার সেইসব সমকালীন সহকর্মীর তাঁর সঙ্গে প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হত এবং সেসময়ে কাছের থেকে তাঁকে লক্ষ করার সুযোগও জুটত। তবে পদমর্যাদায় তাঁরা আদৌ সমগোত্রীয় ছিলেন না। তাঁদের দেখা অনেকটা সম্ভ্রম মিশ্রিত শ্রদ্ধালুর চোখে।
সৈয়দ শামসুল হাসানের জবানবন্দী(৭) দিয়ে আমরা শুরু করব। তাঁর গ্রন্থ তিন ভাগে বিভক্ত। ১৯৩৬ খ্রি. পর্যন্ত মুসলিম লীগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিয়ে এর সূত্রপাত এবং তার পরে তাঁর নেতার স্মৃতিচারণ ও তাঁর ভূমিকা বিশ্লেষণ অবশ্যই ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদের’ পুনরভ্যুদয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে। পরবর্তী অংশে সঙ্কলিত জিন্নার নির্বাচিত পত্রাচারগুচ্ছ, যার অধিকাংশই অবশ্য ব্যক্তিগত ধরনের এবং এর কাল-পরিধি হল ১৯০৯ খ্রি. থেকে ১৯৪৬ খ্রি. পর্যন্ত। তৃতীয় ও শেষ অংশে উদ্ধৃত হয়েছে মুসলিম লীগের কিছু নির্বাচিত দস্তাবেজ যার বিষয়বস্তু সর্বজনজ্ঞাত। লেখক সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের পূরাতন কর্মীদের অন্যতম এবং ১৯১৪ খ্রি. থেকে তিনি প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদক রূপে এর সঙ্গে যুক্ত হন ও দেশবিভাগের পর পাকিস্তানে গিয়ে একেবারে শুরু থেকে পাকিস্তান মুসলিম লীগের দপ্তরের কাজ আরম্ভ করেন। ১৯৫৮ খ্রি. অক্টোবর পর্যন্ত তিনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন। সেই সময়ে সামরিক আইনের প্রশাসনের নির্দেশে পাকিস্তানের স্রষ্টা মুসলিম লীগ সহ যাবতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। সৈয়দ সামসুল হাসান নেতা জিন্নার দ্বারা ন্যস্ত দুটি অত্যন্ত গুরুতর কর্তব্য সম্পাদন করেছিলেন। ১৯৪৭ খ্রি. ভারত-বিভাজনের সেই মারামারি হানাহানির দিনগুলিতে জিন্নার ব্যক্তিগত পত্রাচার ও মুসলিম লীগের দপ্তরের দস্তাবেজপূর্ণ কয়েকটি বস্তা নিয়ে নিরাপদে করাচীতে উপস্থিত হওয়া ও সেখানে পাকিস্তান মুসলিম লীগের দপ্তরের গোড়াপত্তন। দ্বিতীয়বার সেই সামরিক শাসনের কালে সেইসব কাগজপত্রকে আবার তেমনিভাবে বস্তাবন্দী করে পবিত্র গচ্ছিত ন্যাসের মত লুকিয়ে রেখে নেতার কাছ থেকে ১৯৪৮ খ্রি. শেষ বিদায় নেবার দুই দশক পর তাঁর সেই গচ্ছিত সম্পদের কথা জাতির কাছে প্রচার করা।
আমাদের মূলগ্রন্থে যেহেতু সৈয়দ শামসুল হাসান দ্বারা পুনঃপ্রচারিত রাজনৈতিক দস্তাবেজগুলি থেকে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি যথাস্থানে করা হয়েছে এবং যেহেতু জিন্নার পত্রাচার গুচ্ছে নূতন কোনো বিশেষ গুরত্বপূর্ণ তথ্যের সংখ্যা সীমিত, তাই বর্তমানে আমরা আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করব কিছু পত্রে এবং ১৯৩৯ খ্রি. ৩০শে মে তিনি যে উইল বা অন্তিম ইচ্ছাপত্র রচনা করেন। তার প্রতি এতে পাকিস্তানের স্রষ্টার মনোজগতের গতিবিধির কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে। ব্যক্তিগত পত্রাচার থেকে প্রতীয়মান হয় যে তিনি ছিলেন ঠেট বাস্তব ও কোনো রকম ধানাই-পানাই-এর প্রবণতার বিরুদ্ধে। তাঁর ভিতর আবেগের বালাই খুব একটা ছিল না। অতীব আবেগপূর্ণ চিঠিপত্র এবং এমনকি এক পুরাতন সেবকের চিঠির জবাবও (ইংরাজিতে) একেবারে নিরুত্তাপ বাঁধাধরা ভাষায়। আবার পাশাপাশি যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর আর্থিক বিলি-ব্যবস্থার সম্বন্ধ ছিল তাদের চিঠির জবাব দেবার জন্য তিনি যথেষ্ট সময় দেবার সঙ্গে সঙ্গে ধৈর্যের পরিচয় দিতেন, আর্থিক ব্যাপারের খুঁটি- নাটির প্রতি তাঁর দৃষ্টি থাকত। শেষোক্ত ধরনের পত্র রচনার সময়ে তাঁর ইস্পাতকঠিন মনোভাব এবং একেবারে কাঠখোট্টা স্পষ্টবাদী ভূমিকার পরিচয় মেলে। সে এমন এক রূঢ় ব্যক্তিত্ব যে কোনোরকম তোষামোদে ভোলার নয় এবং যা নিজের কাছে অসহনীয় মনে হয় তার সঙ্গে কোনোমতেই আপোষে প্রস্তুত নয়। বেদনাদায়ক সত্য হল এই যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানাটকে অংশগ্রহণকারী জিন্নার বহু সহচরিত্র তাঁর স্বভাবের এই দিকটি বুঝে উঠতে না পারায় তাঁরা তাঁর সঙ্গে তদনুরূপ আচরণ করতে পারেননি।
তাঁর উইল বা শেষ ইচ্ছাপত্রের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়। নিজ বিষয়- সম্পত্তির ব্যাপারে জিন্না যে কেমন সচেতন ছিলেন তার নিদর্শন হল ১৯৩৯ খ্রি. ৩০শে মে সম্পাদিত সেই ইচ্ছাপত্র। আরও সর্তকতার জন্য পরবর্তী বৎসরের ২৫শে অক্টোবর এর একটি ক্রোড়পত্র (codicil) সম্পাদন করেন যা আবার তাঁর সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচায়কও বটে। শেষ ইচ্ছাপত্রের সর্বাপেক্ষা বিয়োগান্তক দিক হল—যেখানে ফতিমা সহ অন্যান্য ভাই-বোনদের নামোল্লেখ করে তাঁদের জন্য তাঁর সম্পত্তির ভাগ বরাদ্দ করেছেন, সেখানে একমাত্র সন্তান কন্যা দীনার নামোল্লেখই করতে পারেননি। অবাধ্য কন্যার প্রতি অতিমানে বিরূপ হলেও অন্তরের স্নেহ ফল্গুধারার মতোই যে প্রবাহিত ছিল তার প্রমাণ সর্বক্ষণের সঙ্গী ফতিমার পরই নামোল্লেখ না করে যাঁর জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন (২ লাখ টাকা, প্রাক-মহাযুদ্ধের মূল্যমানে প্রভূত অর্থ) তিনি দীনা ওয়াডিয়া। গ্রীক ট্রাজিডির চরিত্রের মতো জিন্নার জীবনের সুখ-দুঃখও যেন অদৃশ্য ভাগ্যদেবতার অঙ্গুলিহেলনে নিয়ন্ত্রিত। সাফল্যের সূর্যকরের মধ্যেই ব্যর্থতার কৃষ্ণচ্ছায়া।

জম্মু-কাশ্মীর দেশীয় রাজ্যের বাসিন্দা কে. এইচ. খুরশিদের বয়স ১৯৪৪ খ্রি. ছিল বিশের কোঠায়। আরও কারও কারও সঙ্গে তিনিও ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ-ভিত্তিক’ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় সেই বয়সেই জিন্না ছিলেন তাঁর ‘হিরো’ এবং তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের এক সুযোগ খুরশিদ পেয়ে তাই কৃতার্থ হলেন। তবে তাঁদের মতো ব্যক্তিদের কাছে যা ছিল মুসলিম জাগরণ বা জাতীয়তাবাদ ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখলে তা-ই ছিল মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ, অর্থাৎ বিদেশি শাসনের বন্ধনমুক্ত হওয়ার জন্য হিন্দু-মুসলমান-শিখ- খ্রিস্টান-পার্শী-বৌদ্ধ প্রমুখ সকল মত ও পথের ভারতবাসীর সম্মিলিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল ধারা তার থেকে পৃথক হওয়া। সেই সময়ে যখন তাঁর মতাবলম্বীদের নৌকার পাল জোয়ারের হাওয়ায় ফেঁপে ফুলে উঠেছে তখন তাঁর নেতা যে-ই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর দপ্তরে যোগদান করার আমন্ত্রণ জানালেন তখন তিনি আনন্দে যেন আত্মহারা হয়ে উঠলেন। তিনি আহ্লাদিত মনে সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর কায়েদ-এ আজমের ব্যক্তিগত দপ্তরে নিষ্ঠাসহকারে আপ্ত-সচিবের (Private Secretary) দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। এই পর্যায়ে নেতার জীবনের পরবর্তী সাড়ে তিন বৎসরকাল পর্যন্ত তাঁকে বহু গোপন ও রীতিমতো কষ্টসাধ্য কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়। তবে নেতার শেষ- শয্যার পাশে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। কারণ সেসময়ে তিনি জম্মু-কাশ্মীর সরকারের কারাগারে বন্দী। সেখানে তিনি প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত হয়েছিলেন আত্মপরিচয় গোপন রেখে। তবে অবশ্যই তা নিজ নেতার সম্মতিক্রমে এবং নিঃসন্দেহে তাঁরই আদেশিত অজ্ঞাত কোনো কর্তব্যপালনের উদ্দেশ্যে। কারামুক্তির পর পাকিস্তানে ফিরে খুরশিদ বুঝতে পারলেন যে তাঁর নেতার উত্তরাধিকারীবর্গের কাছে তাঁর আর সমাদর নেই। অতঃপর ফতিমা জিন্নার পরামর্শ ও সহায়তায় তিনি ইংলন্ডে গিয়ে আইনের পাঠ শুরু করে সনদপ্রাপ্ত আইনজীবি হবার পর করাচীতে আইন ব্যবসায় শুরু করলেন। জেনারেল আইয়ুব খাঁ সামরিক শাসন জারি করার পর ১৯৫৯ খ্রি. তাঁকে আজাদ বা পাকিস্তানের দখলীকৃত কাশ্মীরের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিলেন। সেই ‘গৌরবজনক’ পদের অধিকারী হবার পরও পাকিস্তানের শাসনে ‘আজাদি’-এর যথার্থ তাৎপর্য তিক্তভাবে বুঝে নিতে তাঁর খুব বেশি বিলম্ব হয়নি এবং ১৯৬৪ খ্রি. অতীব অমর্যাদাকর ভাবে সেই দায়িত্বও ছেড়ে দিতে তাঁকে বাধ্য করা হয়। কাটা ঘা-এ নুনের ছিটের মতো উপরন্তু হিসাবে আরও জনাকয়েক আজাদ- কাশ্মীর নেতার সঙ্গে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৬৫ খ্রি. তাঁকে জনাই বন্দীশিবিরে একবৎসর বন্দীদশায়ও কাটাতে হয়। তাঁদের অপরাধ—পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর থেকে আইয়ুব খাঁ-র ব্যর্থ কাশ্মীর অভিযানের তাঁরা বিরোধিতা করেছেন। এছাড়া ফতিমা জিন্না যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে আইয়ুব খাঁর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তিনি তখন ফতিমার নির্বাচন যুদ্ধের পরিচালকও ছিলেন। ১৯৮৮ খ্রি. মৃত্যুমুখে পতিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি আজাদ কাশ্মীরের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
কাছের থেকে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়মিত দেখা, বিশেষ করে তিনি যদি দর্শনকারীর নয়নের মণি বা ‘হিরো’ হন অনেক সময়েই দ্রষ্টার সত্য বা যথার্থ দর্শনের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে থাকে। তবুও খুরশিদের এই সাক্ষ্য বিবেচ্য যে আপাতদৃষ্টিতে নিছক বস্তুবাদী আত্মসর্বস্ব মানুষটির জীবনেও ক্ষণস্থায়ী হলেও স্নেহ ও অন্তরঙ্গতার সাময়িক ঢল নামত। ইংরাজি চিরায়ত কাব্য এবং বিশেষ করে শেক্সপীয়রের রচনার প্রতি জিন্নার আকর্ষণের কথা খুরশিদও জানিয়েছেন। একবার সাময়িক রোগভোগের পর জিন্না যখন ১৯৪৫ খ্রি. গ্রীষ্মকালে মহারাষ্ট্রের মাথেরনে স্বাস্থ্যোদ্ধার করছিলেন তখন শেক্সপীয়র চর্চার কথা খুরশিদ বলেছেন। তাঁর মতে জিন্না বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের জীবনীও নিবিষ্ট মনে পাঠ করতেন।
জিন্নাকে অকপট খোলামেলা স্বভাবের স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর রাজনীতি সম্পর্কে খুরশিদের মন্তব্য হল: “মিস্টার জিন্নার কাছে রাজনীতি ছিল এক বৈজ্ঞানিক সন্নীতিনির্ভর কার্যকলাপ যার সঙ্গে চালাকির কোনো সম্পর্ক নেই। এতে ঝুঁকি বেশি কিন্তু চাল হবে ধীরগতির” (পৃ. ৩৩)। খুরশিদ তাঁর গ্রন্থের পরবর্তী কয়েক পৃষ্ঠায় পূর্বোক্ত বক্তব্যের বিস্তার করলেও তা গ্রহণীয় নয় এবং খুরশিদের নিজেরই দেওয়া উদাহরণ অনুসারে জিন্নার অধিকাংশ সহকর্মীদের ক্ষেত্রে তো নয়-ই। তবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী থেকে যে জিন্না ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদের’ অগ্রনায়ক কায়েদ-এ-আজমে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, এ বিষয়ে খুরশিদের নিজের মনে অন্তত সংশয় নেই। তাঁর ভাষায়: “পরবর্তী কাল অর্থাৎ ১৯৪০ খ্রি. পরবর্তী সময়ের মুসলিম লীগ আন্দোলনের জিন্না ১৯১৩-১৬ খ্রি. জিন্না থেকে মূলগতভাবে ভিন্ন ছিলেন এবং এমনকি গোলটেবিল বৈঠকের জিন্নার সঙ্গেও একালের জিন্নার গভীর পার্থক্য। বাহ্যত এ পরিবর্তন ছিল—জাতীয়তাবাদী ও হোমরুলপন্থী থেকে তিনি ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদী’ হয়েছিলেন।…ইংলন্ড থেকে স্থায়ীভাবে প্রত্যাবর্তনের কালে বয়সে নবীন ও উৎসাহী জিন্না বিশ্বাস করতেন যে ভারত গ্রেট ব্রিটেনের মতোই এক জাতি এবং সেই কারণে পৃথক (সাম্প্রদায়িক) নির্বাচন-ব্যবস্থার অবসানের ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য কাজ করতেন। …..কিন্তু অনতিবিলম্বেই তিনি বুঝতে পারলেন যে বাস্তবে পরিস্থিতি সেরকম নয়।… তাঁর মনে হল যে তাঁর জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে, যদিও অপর যে কোনো ব্যক্তির তুলনায় তিনি উভয় সম্প্রদায়কে কাছাকাছি আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর উপলব্ধি হল যে তিনি আরম্ভই করেছিলেন ভুল বিশ্বাস থেকে। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ছিল তাঁর প্রথম প্রথম প্রণয় আর এক্ষেত্রে যেমন হয় এই প্রথম প্রণয় পরবর্তী জীবনেও থেকে থেকে তাঁর অন্তরে বেদনা সৃষ্টি করেছে।”(পৃ. ৫১-৫৩)।
পাকিস্তানের আর কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যাঁরা বিভিন্ন সময়ে পরিধিতে সে রাষ্ট্রের স্রষ্টার কাছাকাছি এসেছিলেন তাঁদের সম্বন্ধে খুরশিদের সংক্ষিপ্ত অভিমত উদ্ধৃত করে আমরা তাঁর স্মৃতিচারণ গ্রন্থের(৮) প্রসঙ্গ সমাপ্ত করব। এক নূতন রাষ্ট্রের সৃষ্টির ক্ষেত্রে কায়েদ-এ- আজমের ভূমিকা ও চরিত্র সম্বন্ধে বর্তমান গ্রন্থের বক্তব্যের সঙ্গে তাঁদের বিশ্লেষণের মোটামুটি সাযুজ্য থাকলেও তাঁদের প্রত্যেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উপর কোনো না কোনো ধরনের নবীন রশ্মিপাত করেছেন। মালিক খিজির হায়াৎ খাঁ তিওয়ানা ছিলেন পাঞ্জাবের হিন্দু-মুসলমান-শিখদের (ভূস্বামী) সম্মিলিত রাজনৈতিক দল ইউনিয়নিস্ট পার্টি’-র নেতা ও প্রদেশের তদানীন্তন (স্বাধীনতা পূর্বকালের ব্যবস্থা অনুযায়ী) প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতা হস্তান্তরণের মাস কয়েক পূর্বে মুসলিম লীগ কর্তৃক পাঞ্জাবে যে প্রবল হিংসাত্মক আন্দোলন আরম্ভ করা হয় তার কারণ খিজির হায়াৎ খাঁ পদত্যাগে বাধ্য হন। পাঞ্জাব মুসলিম লীগের ওরকম হঠাৎ উগ্র আন্দোলনের অন্যতম কারণ হল খিজির হায়াৎ খাঁর সঙ্গে জিন্নার একধারে অনুরাগ ও বিরাগের সম্পর্ক। খিজির হায়াৎ খাঁর মতে পাকিস্তানের জন্মগ্রহণের প্রক্রিয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানে যে ব্যাপকভাবে শিখ নিধনযজ্ঞ চলেছিল, “তা পূর্ব পরিকল্পিত এবং কায়েদ এর কথা জানার পর ‘তিনি খুবই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন’। তাঁর মতে ‘এটা জিন্নার মহত্ত্বের পরিচায়ক।” পাকিস্তান আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে কাজি মহম্মদ ঈশা একরকম শূন্য থেকে বেলুচিস্তানে লীগ সংগঠনের সূত্রপাত করেছিলেন। আর সম্ভবত: “তরুণ মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে…তিনিই ছিলেন জিন্নার সর্বাপেক্ষা কাছের মানুষ এবং তাঁর বিশ্বাসভাজনও ছিলেন।” তবে কোনো অজ্ঞাত কারণে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তাঁর নেতা স্বয়ং তাঁর কর্মশক্তির যথোচিত উপযোগ করেননি। তিনি জিন্নার একাধিক স্মরণ প্রসঙ্গ বর্ণনা করেছেন এবং তারমধ্যে বেশ কয়েকটি জিন্নার রসিকতার কাহিনীও আছে। এদের মধ্যে আবার কয়েকটি রসিকতা নিজেকে নিয়ে। তাঁর অভিজ্ঞতা হল নবাবজাদা লিয়াকৎ আলী খাঁ সহ কেউ-ই নেতার আস্থার পাত্র ছিলেন না। পূর্বোক্ত বক্তব্যের সমর্থন মেলে চৌধুরী মহম্মদ আলীর সঙ্গে খুরশিদের সাক্ষাৎকারের বিবরণ থেকেও। চৌধুরী মহম্মদ আলী ছিলেন অবিভক্ত ভারতের অর্থমন্ত্রকের এক উচ্চপদস্থ আমলা যাঁর পরামর্শেই ১৯৪৬ খ্রি. অন্তর্বর্তী সরকারে লীগ চলত এবং যাঁর কূটবুদ্ধির কারণে সেই মন্ত্রীমণ্ডলীর যৌথ দায়িত্ব প্রথা বার বার বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিক্তবিরক্ত হতবুদ্ধি কংগ্রেসি মন্ত্রীরা দেশবিভাজনে সম্মতি জানিয়েছিলেন।
নূতন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর চৌধুরী মহম্মদ আলীকে সে দেশের প্রশাসনে সর্বোচ্চ আমলার পদ দ্বারা পুরস্কৃত করা হয়েছিল। শেষ অবধি তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। খুরশিদের মূল পাণ্ডুলিপি অনেকটা এলোমেলো খসড়ার মতো ছিল। পাকিস্তানের বিশিষ্ট সাহিত্যিক খালিদ হাসান পাণ্ডুলিপির যথোপযুক্ত সম্পাদনা করে তাকে পাঠক দরবারে হাজির করার মতো বর্তমান রূপ দেন। খালিদ হাসান মহম্মদ আলীর ভূমিকার যে পরিচয় বৃত্তান্ত এই অবসরে রচনা করেন তাও সমান চিত্তাকর্ষক: “চৌধুরী মহম্মদ আলী সেইসব মুসলিম আমলাদের অন্যতম যাঁরা স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে চলে এসে এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরের কর্ণধার হয়ে বসেন এবং এইভাবে দেশে ‘অরাজনৈতিকরণের’ বীজ বপন করেন এবং তার পরিণামে শেষ অবধি ১৯৫৮ খ্রি. শাসনব্যবস্থার উপর নাগরিক কর্তৃত্ত্বের অবসান ও সামরিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে। মাঝখানে স্বর্গীয় জুলফিকার আলী ভুট্টোর আমলের সাড়ে পাঁচ বছরের নাগরিক শাসনের কথা বাদ দিলে পরবর্তী ত্রিশ বৎসর (খুরশিদের গ্রন্থ-প্রকাশের কাল ধরে) এই সামরিক শাসন পাকিস্তানে চলেই আসছে।” খলিদ হাসানের বিশ্লেষণের জের টেনে যোগ করা যায় যে পাকিস্তানে অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসনের সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।’ ২০০৭ খ্রি. ওদেশে গণতন্ত্রের সাময়িক রাহুমুক্তি ঘটলেও রাজনৈতিক গগনে তার সঙ্গে সামরিক বাহিনী ও তার আশ্রিত সন্ত্রাসবাদের (বেনজির ভুট্টোর হত্যার ঘটনার সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানের প্যানেলের তদন্ত প্রতিবেদন; ১৬ই এপ্রিল, ২০১০ খ্রি.) কৃষ্ণমেঘের যে লুকোচুরি খেলা চলছে তাতে গণতন্ত্রের সূর্য ওদেশে কতদিন প্রকট থাকবে বলা কঠিন।

পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি মহম্মদ মুনীরের নিজের জবানবন্দী হল, “কায়েদ-এ আজমের সঙ্গে আমার দেশবিভাগের পূর্ব থেকেই অতীব ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল এবং তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধাও ছিল।” স্বাধীনতাপূর্ব কালের খ্যাতনামা আইনজীবি মহম্মদ মুনীরের সঙ্গে জিন্না ও মুসলিম লীগের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। বিচারপতি দীন মহম্মদের সঙ্গে মহম্মদ মুনীরকেও স্বয়ং জিন্না বেছে নিয়েছিলেন সীমানা কমিশনে পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষার জন্য। মাউন্টব্যাটেনের ১৯৪৭ খ্রি. দোসরা জুনের প্রস্তাব অনুসারে সেই বৎসরের ৯ই জুলাই সিরিল র‍্যাডক্লিফের সভাপতিত্বে ঐ সীমানা কমিশন কার্যারম্ভ করেছিল পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশের সাম্প্রদায়িক (মুসলমান-অমুসলমান) ভিত্তিতে সীমানা চিহ্নিত করার জন্য। মহম্মদ মুনীর
পৃষ্ঠা: ৩১৫

বার বার তাঁর গ্রন্থে(৯) বলেছেন যে “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল যেসব এলাকা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানকার স্বশাসন-ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাতে সংখ্যালঘুদেরও দেখিয়ে দেওয়া যায় যে মুসলমানদের স্বশাসন কতটা ন্যায়পরায়ণ হতে পারে। তবে যে কোনো ধরনের ধর্মীয় শাসনকে তিনি (জিন্না) স্পষ্টতঃ বাতিল করেছিলেন (পৃ. ৩৫)।” একজন আধুনিক মানসিকতাবিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসেবে জিন্না বহুদেশের সুশীল সমাজের (civil society) ধরন-ধারণ সম্বন্ধে খবর রাখতেন। বর্তমান বিশ্বের চিন্তা-ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজাম-ই-মুস্তাফা ও ইসলাম সম্বন্ধে জিন্নার ব্যাখ্যা কেবল পাকিস্তান নয় বহু মুসলিম দেশের পরিবর্তনে অনিচ্ছুক মনোভাবসম্পন্ন কট্টরপন্থীদের মধ্যেও প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জিন্না থেকে জিয়া পর্যন্ত মহম্মদ মুনীর বর্ণিত ইতিকথা এক চিত্তাকর্ষক দস্তাবেজ যাতে বিবৃত হয়েছে “কিভাবে কায়েদ-এ-আজমের ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে পৃথক করে মহম্মদ আলী জিন্নাকে পাকিস্তান গোঁড়া গোষ্ঠীর হাতে চালান করে যাঁদের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল দেশকে আদ্যপান্ত ইসলামি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা…” (মুখবন্ধ)। এই উপমহাদেশকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করার জন্য কাজ করার পরও মুনীর কর্তৃক জিন্নার ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকাকে চিহ্নিত করার প্রয়াস বলা বাহুল্য (দিল্লিতে ১৯৪৬ খ্রি. রয়টারের প্রতিনিধি ডুন ক্যাম্পবেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকার এবং অনুরূপ প্রসঙ্গ স্মর্তব্য) নবসৃষ্ট রাষ্ট্রের গণপরিষদে ১৯৪৭ খ্রি. ১১ই আগস্টের বক্তৃতার অনুসারী, যার সংশ্লিষ্ট অংশ মূল গ্রন্থের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করা হয়েছে।
মুনীর তাঁর গ্রন্থে (৩১-৩২ পৃষ্ঠা) পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসাবে জিন্নার ঢাকায় প্রথম ও শেষ বক্তৃতা সম্পূর্ণভাবে উদ্ধৃত করেছেন। ১৯৪৮ খ্রি. ২১শে মার্চ সেই বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তিনি বলেন, “পাকিস্তান কোনো ধর্মীয় তন্ত্র বা অনুরূপ কিছু নয়। আমরা অপরাপর ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সহনশীল হই—এইটা আমাদের কাছে ইসলামের কাম্য। যিনি যে মতাবলম্বীই হোন না কেন তাঁদের সবার কাছ থেকে আমরা পাকিস্তানের আদর্শ ও তার প্রতি অনুগত নাগরিক হিসাবে স্বেচ্ছায় তাঁরা তাঁদের উপযুক্ত ভূমিকা পালন করুন— এই আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করি।” জিন্নার বক্তৃতার উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি মহম্মদ মুনীর জাভেদ ইকবালের “ইডিওলজি অফ পাকিস্তান” গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করেছেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিচারপতি জাভেদ ইকবাল ছিলেন কবি-দার্শনিক মহম্মদ ইকবালের পুত্র। বিচারপতি জাভেদ ইকবাল অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাবে জিন্নার পূর্বোদ্ধৃত অভিমতের সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে জিন্নার ঐ অভিমত চরিত্র-বৈশিষ্ট্যে ধর্মনিরপেক্ষ। ইকবাল-পুত্রের বক্তব্য হল, “ইসলাম ‘আত্মিক’ ও ‘অনাত্মিক’-এর পার্থক্য স্বীকার করেনা। ইসলামের মতে আত্মিক ও আধিভৌতিক দায়-দায়িত্ব কেবল পরস্পর সম্পৃক্তই নয়, ইহজাগতিক কর্তব্যসমূহ সম্পাদনকালে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের অভিব্যক্তি বাধ্যতামূলক। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর এই কারণে ইসলামি রাষ্ট্র এক আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের গুণাবলীর আত্তীকরণ করে থাকে।”(জাভেদ ইকবালের পূর্বোক্ত গ্রন্থের চতুর্থ পৃষ্ঠা থেকে মহম্মদ মুনীর কর্তৃক স্বীয় গ্রন্থের ১২ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।) পাকিস্তানের লিয়াকত আলী প্রবর্তিত ‘অবজেকটিভ রেজলিউশান’ বা সংবিধানের দিশানির্দেশক প্রস্তাব কায়েদ-এ-আজমের রাষ্ট্রীয় আদর্শের ধ্যান-ধারণা থেকে একেবারে বিপরীতধর্মী ছিল। অমুসলমানেরা ঐ দিশানির্দেশক প্রস্তাবের এই বলে বিরোধিতা করতেন যে ঐ প্রস্তাব অনুসারে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার কথা তাতে তাঁদের স্থান হবে জিম্মির এবং এটা কায়েদ- এ-আজমের ঘোষণার বিপরীত ছিল। কিন্তু তাঁরা ছিলেন স্বল্পসংখ্যক এবং লিয়াক‍ আলী খাঁ নিজের ভূমিকার পরিবর্তনে প্রস্তুত হলেন না বলে তাঁরা গণপরিষদের ঐ সভা থেকে প্রতিবাদে বেরিয়ে যান (‘ওয়াকআউট’) এবং এইভাবে ঐ প্রস্তাব স্বীকৃত হয়। মুনীরের মন্তব্য দ্ব্যর্থহীন: “কায়েদ-এ-আজমের জীবনকালে প্রধানমন্ত্রী খাঁ লিয়াকত আলী খাঁ যদি ১৯৪৯ খ্রি. ২৫শে মার্চের মতো কোনো দিশানির্দেশক প্রস্তাব পাকিস্তান গণপরিষদে প্রবর্তন করার চেষ্টা করলেও কায়েদ-এ-আজম কিছুতেই তাতে সম্মতি দিতেন না (পৃ.৩৪-৩৫)। একাধিক পাকিস্তান-বিশেষজ্ঞেরই ধারণা অনুরূপ। তবে মুসলিম লীগ ছাড়া তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রায় সব কয়টি রাজনৈতিক দলই পাকিস্তানের বিরোধী ছিল। তারা পরবর্তী কালে এই কারণে বার বার প্রকাশ্য অনুশোচনা করে গেছে যে ৪ কোটি মুসলমানকে ভারতে তাঁদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে আসা হয়েছে। দলগুলির নাম হল অহর, জামাত-ই-ইসলামি, দেওবন্দী, বেরিলভি ও অহল-ই-হাদিস। দিশানির্দেশক প্রস্তাবের ভিত্তিতে আহমদিয়াদের তাঁরা তাঁদের প্রথম লক্ষ্য বানালেন।…” এর ফলে আহমদিয়াদের উপর প্রচণ্ড দমননীতি আরম্ভ হয়ে গেল এবং পরিণামে, “দীর্ঘকাল অর্থাৎ ১৯৬২ খ্রি. পর্যন্ত যাবত পাকিস্তানের আদর্শ ও ইসলামি রাষ্ট্র সম্বন্ধে আর উচ্চবাচ্য করা গেল না। ঐ বৎসরে জমায়েত-ই-ইসলামির জনৈক সদস্য ইসলামকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ রূপে বর্ণনা করেন।” ইতিমধ্যে এক নূতন গণপরিষদ আহুত হয় যার নেতা ছিলেন মহম্মদ আলী এবং সেই গণপরিষদ “পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচনা করে।” আর তদনুসারে মহম্মদ আলীই পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। “নূতন সংবিধানে দেশের নামকরণ হয় পাকিস্তানের ইসলামিক সাধারণতন্ত্র। কুর’আন ও সুন্নার নির্দেশানুসারে পাকিস্তানের সব আইন-কানুনের সংশোধিত রূপ পেশ করার জন্য মহম্মদ আলী এক সদস্যবিশিষ্ট এক কমিশনও নিয়োগ করেন। প্রস্তাবিত কুর’আন ও সুন্না অনুসারী আইন-কানুন সমূহকে জাতীয় পরিষদের অনুমোদন নিয়ে বিধিবদ্ধ রূপ দেবার সিদ্ধান্ত হয়…।” শেষ পর্যন্ত কুর’আনের কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করে বিচারপতি সুনীর সখেদে মন্তব্য করেছেন যে সামরিক ডিক্টেটার জিয়া-উল-হকের পাকিস্তানি সমাজের ইসলামীকরণের তথাকথিত নির্দেশের অধিকাংশই বাস্তবে ছিল ইসলাম-বিরোধী। তাঁর সিদ্ধান্ত হল—ইতিহাসের এক বিচিত্র গতির পরিণামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি তাকে এমন পরিস্থিতির ঘূর্ণিপাকে ফেলে দেয় যে নবসৃষ্ট দেশের নেতৃবর্গ পাকিস্তান রাষ্ট্র সম্বন্ধে কায়েদ- এ-আজমের ধ্যান-ধারণার বিরোধী এমন সব আইন-কানুন প্রবর্তন করেন যেগুলি কিনা কুর’আনের সরাসরি বিরোধী” (প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ)


১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ও পরবর্তী দশকের গোড়ার দিকে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুল প্রশংসিত ছাত্রজীবন সমাপনান্তে জিন্নারও নিবাস ঐ শহরেরই অধিবাসী ড. রফিক জ্যাকেরিয়া ছাত্র- নেতা ও সাংবাদিক হিসাবেও খ্যাতিলাভ করার পর ওখানকার উচ্চআদালতে আইনজীবীর তালিকাভুক্ত হলেন। জিন্নারই মতো তিনি লিংকনস-ইন থেকে ব্যারিস্টার হন। তবে একই সঙ্গে লন্ডন থেকে ডক্টরেটের ডিগ্রিও অর্জন করেন। চল্লিশের দশকের শেষার্ধে লন্ডনে ছাত্র থাকাকালীন রফিক জ্যাকেরিয়া ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নবীন যোদ্ধা ও বিশিষ্ট সংবাদপত্রের সাংবাদিক হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বোম্বাই-এ আইনের পেশায় নিযুক্ত থাকার সময় থেকেই তিনি কংগ্রেস কর্মী হিসাবে রাজনীতির ক্ষেত্রেও সক্রিয় হন এবং দীর্ঘ পনের বৎসর কাল রাজ্য মন্ত্রীমণ্ডলের সদস্য হবার সম্মান অর্জন করেন। ১৯৭৮ খ্রি. তিনি লোকসভায় কংগ্রেসদলের ডেপুটি লিডার নির্বাচিত হন ও একাধিকবার সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানের অধিবেশনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। ঐরকমই এক অধিবেশনে তাঁকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি জুলফিকর আলী ভুট্টোর সঙ্গে বিতর্কে জোর পাল্লা দিতে হয়। তাঁর সংবাদিকতা ও লেখার চর্চাও এর পাশাপাশি চলেছে এবং রাজনীতি, ইসলাম ও কুরআন সম্বন্ধিত একাধিক পাঠক-প্রশংসিত গ্রন্থেরও তিনি রচয়িতা।
জাতীয়তাবাদী শিবিরভুক্ত হলেও বোম্বাই-এর এক সক্রিয় ছাত্র-নেতা হবার জন্য জ্যাকেরিয়া কেবল বেশ কাছ থেকেই জাতীয়তাবাদী জিন্নার কেবল মুসলমানদের প্রবক্তায় রূপান্তরিত হওয়া প্রত্যক্ষ করেননি, বেশ কয়েকবার জিন্নার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কেরও সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। তবে ঐ নেতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা থেকে সজ্ঞানেই তিনি কেন বিরত থেকেছেন তার কারণ স্পষ্ট। তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মস্মৃতি(১০) থেকে তিনটি উদ্ধৃতি দেওয়া হবে পাকিস্তানের স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টি সম্বন্ধে জ্যাকেরিয়ার ব্যক্তিগত মূল্যায়নের ধারণা পাবার জন্য। সর্বাগ্রে পাকিস্তানের স্রষ্টার সম্বন্ধে দুটি ঘটনা যার সাক্ষী ছিলেন তিনি। প্রথমটির ঘটনাস্থল বোম্বাই-এর মুসলিম বহুল এলাকায় লীগের আহ্বানে “মুক্তিদিবস” (দেশবাসীর মতামত না নিয়ে ভারতের বড়লাট কর্তৃক ইংলন্ডের দ্বারা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ঘোষণা করার পরই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা এবং ভারতের ধনজনের দ্বারা সে যুদ্ধে নিঃশর্ত সহায়তার প্রতিবাদে প্রদেশসমূহের কংগ্রেসি সরকারের পদত্যাগে উল্লাস প্রকাশের উদ্দেশ্যে। মূল গ্রন্থে এর বিস্তারিত বিবরণ দ্রষ্টব্য)। জিন্না এবং আম্বেদকর (তিনিও লীগনেতার মতো কট্টর কংগ্রেস বিরোধী ছিলেন) উভয়েই সেই সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। জিন্না যথারীতি একেবারে নির্ধারিত সময়ে সভায় উপনীত হয়েছিলেন। তবে “তিনি যখন দেখলেন যে সামনের সারিতে সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের জন্য যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়নি, তখন তাঁর ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটল। সভার আয়োজকদের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘সংবাদপত্রের লোকেরা কই’? এবং তারপর উপস্থিত সবার শ্রুতিগোচর ভাবেই (সভামঞ্চে মাইক্রোফন সক্রিয় ছিল) তাঁর বজ্রনির্ঘোষ নাদিত হল: ‘আপনারা কি মনে করেন যে আমি এইসব গদর্ভদের কাছে আমার কথা বলতে এসেছি?’ উপস্থিত জনতার কাছে ততটা নয়, তাঁর আগ্রহ বিশ্ববাসীর কাছে নিজের কথা পৌঁছে দেওয়া। সভার আয়োজকদের মধ্যে হুটোপুটি পড়ে গেল। কোনোমতে তাঁরা সভামঞ্চের সামনে সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের জন্য কিছু চেয়ার-টেবিল এনে জড়ো করলেন এবং এক ঘণ্টার উপর জিন্না ইংরাজিতে তাঁর বক্তব্য বললেন। সাধারণ শ্রোতারা জিন্নার সেই বক্তৃার একটি শব্দও না বুঝলেও মাঝে মাঝেই ‘আল্লা হো আকবর’, ‘মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’ ও ‘কায়েদ-এ-আজম জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উচ্চারণে তাঁদের কোনো বিরতি ছিল না।”(পৃ. ২৯)
আর একবার ঘটনাচক্রে জিন্নার সঙ্গে একই রেলগাড়িতে যাত্রার সময়ে: “অনেক রাতে পথিপার্শ্বস্থ কোনো রেলস্টেশনে গভীর কোলাহলে আমার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে বেরিয়ে দেখি একটি কামরার সামনে একদল মানুষ প্রায় মৃগীরোগীর মতো একটানা চেঁচিয়ে চলেছে ‘কায়েদ-এ-আজম জিন্দাবাদ’। প্রথম শ্রেণীর কামরাটির ভিতরে জিন্না গভীর ঘুমে নিদ্রিত ছিলেন। কোনো কোনো উৎসাহী কামরার দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন। কিন্তু তবুও ভিতর থেকে কোনো সাড়া মিলল না। তবে উৎসাহীদের উদ্যমে বিরাম নেই। তাঁদের উপর্যুপরি করাঘাত চলতেই থাকল। অতঃপর রেশমি নৈশ-গাউন পরা জিন্নাকে তাঁদের সমক্ষে হাজির হতেই হল। তবে দেখা দিয়েই তিনি হুংকার ছাড়লেন, ‘মুর্খের দল, বোঝেননি যে আমি ঘুমাচ্ছিলাম? এবার যান সবাই।’ বলেই তিনি আবার কামরার দ্বার রুদ্ধ করলেন। গাড়ি চলা আরম্ভ করল। জনতা কিন্তু চিৎকার করেই চলল, ‘কায়েদ-এ-আজম জিন্দাবাদ।’ জিন্নার অসহিষ্ণু এবং সাধারণ মুসলিম জনসাধারণের মনোভাবের প্রতি উপেক্ষার ভাব দেখে আমি বিভ্রান্ত বোধ করতাম। মনে মনে প্রশ্ন জাগত—এ আবার কোন্ ধরনের নেতা? যে সম্প্রদায় সহজেই এমন আবেগতাড়িত হয়, তারা কিভাবে এমন অসংবেদী নেতাকে বরদাস্ত করেন? তিনি কেবল রাশভারি ছিলেন না, তিনি বদমেজাজী ও উদ্ধত প্রকৃতিরও ছিলেন। শিক্ষিত যুবকেরা কিভাবে তাঁর এত অন্ধ অনুগামী হত? অতীব সৌম্য ও স্নেহশীল গান্ধী অথবা হঠাৎ রেগে উঠলেও চিত্তাকর্ষক ব্যক্তিত্বের নেহরু—যিনি অভিজাত হলেও জনগণকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন তাঁদের সঙ্গে ঐ বদমেজাজি মানুষটির কী দুস্তর পার্থক্য! অথবা আজাদ যাঁর সত্তার প্রতিটি কণা ছিল মুসলমান এবং যিনি ছিলেন এক বিশ্ববন্দিত ধর্মীয় পুরুষ এবং যাঁকে মাত্র এক দশক পূর্বে মুসলমানেরা ‘তমাসউল হিন্দ’–বা সর্বোচ্চ যাজক আখ্যা দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গেও জিন্নার কী ব্যবধান।’ (পৃ. ৪৮)।
জ্যাকেরিয়া এমন এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেছেন যার সম্পূর্ণ উত্তর এ যাবৎ পাওয়া যায়নি। এর পূর্ণাঙ্গ উত্তর পেতে সম্ভবত একাধিক ক্ষেত্রের সমীক্ষা এবং বহু শক্তির ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার অধ্যয়ন প্রয়োজন যার মধ্যে মুসলিম গণ-মানসের বৈশিষ্ট্যও পড়ে। ইংরেজ শাসনের সার্বভৌমত্বের কালে এর স্বাভাবিক বিকাশের পথ ছিল অবরুদ্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অন্তিমপর্বে সীমিত সংখ্যক মুসলিম নব অভিজাতরা রাজ-এর পৃষ্ঠপোষণায় যে চোখ ধাঁধানো সাফল্য অর্জন করেছিলেন, সাধারণ মুসলমানের কাছে তার চমক-বিহ্বলতাতেও এর উৎসের সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। একদা মুসলমানেরা ভারতের শাসক ছিলেন এবং ইংরেজরা যেহেতু মুসলমান সম্রাটদের কাছ থেকে ভারতের শাসন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তাই ন্যায়বিচারের জন্য তাঁদের নেতৃবৃন্দের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশ ত্যাগ করা উচিত—এইসব অর্ধ সত্য ও অতিকথাও সাধারণ মুসলমানের মানসে বিগত শতাব্দীর চারের দশকে প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। সামাজিক-মনোবিজ্ঞান ও মানুষের আচরণ-পদ্ধতির সব সত্য এখনও অজ্ঞাত।
জিন্নার সৃষ্টি সম্বন্ধে জ্যাকেরিয়ার মন্তব্য হল: “বিভাজনপূর্ব ভারতের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির মুসলমানেরা বিস্ময়জনক ভাবে পাকিস্তান-আন্দোলনের পুরোভাগে থাকলেও তাঁরা এমন এক অলীক স্বর্গসুখে মোহিত ছিলেন যে বুঝতেই পারেননি যে তাঁরা নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ছেন। তাঁরা আদৌ উপলব্ধি করতে পারেননি যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির মুসলমানেরা পাকিস্তানের ব্যাপারে উৎসাহ না দেখিয়ে অবিভক্ত ভারতের অধিবাসী রূপে সন্তুষ্ট থাকলেও আসলে এর দ্বারা একমাত্র তাঁদেরই উপকার হবে। এই হল অদৃষ্টের পরিহাস”। (পৃ. ৫৪)।
জ্যাকেরিয়ার অনুসরণে আমরা তাঁর অভিমতের উপসংহার করব তিনি যে আম্বেদকরের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন তারই একাংশের উদ্ধরণ করে। বোম্বাই-এর আইনজীবীদের অগ্রগণ্য ভীমরাও আম্বেদকরও ছিলেন ভারত-বিভাজনরূপী সেই অতীব বিয়োগান্তক নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব স্বীকৃত হবার পরই এই অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে ঐ প্রস্তাব নিছক এক চমক সৃষ্টির প্রয়াস মাত্র, “কারণ প্রস্তাবের পদে পদে স্ববিরোধ। জিন্নার মতো এমন যোগ্য আইনজীবীর চোখে এসব ধরা পড়বে না—এমন হতেই পারে না। আমার মনে হয় তিনি জেনেশুনেই এসব করেছেন। এতে উল্লিখিত হয়েছে যে এর স্বাধীন অঙ্গরাজ্যগুলি গোষ্ঠীবদ্ধ হবে, অথচ সঙ্গে সঙ্গে তারা সার্বভৌমও থাকবে। এর অর্থ কি? একি ফেডারেশনের প্রতি ইঙ্গিত? তা যদি হয় তাহলে তার অঙ্গগুলি সার্বভৌম হয় কিভাবে? আর তাছাড়া এর দুটি অংশ যাদের মধ্যে হাজার মাইলের দূরত্ব, তাদের মধ্যে যোগসূত্র থাকবে কিভাবে তারও কোনো উল্লেখ নেই লাহোর প্রস্তাবে। আমার মনে হয়না এ প্রস্তাব জিন্না গুরুত্বসহকারে ভেবেচিন্তে গ্রহণ করেছেন।”(পৃ. ৬২-৬৩) পাঠকদের মনে পড়বে পরবর্তী কালে জিন্না কিভাবে “রাজ্যগুলি” শব্দবন্ধের বৈপরীত্যকে টাইপের ভুল বলে চালাবার চেষ্টা করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে ওটা আসলে হবে ‘রাজ্য’ (মূলগ্রন্থের সংশ্লিষ্ট অংশ দ্রষ্টব্য)। ব্রিটিশ সরকারের তরফে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরণের আলোচনা করতে মন্ত্রীমণ্ডলীর সদস্যদের যে ত্রিমূর্তি এদেশে এসেছিলেন তাঁদের অন্যতম এ. ভি. আলেকজেন্ডারের মনে হয়েছিল, “জিন্না…ছিলেন আলোচনাকারীদের মধ্যে চতুর চূড়ামণি। তাঁর খেলার ধরন দেখে মনে হত যে তিনি জিততে বদ্ধপরিকর। প্রথমেই তিনি নিজের অনুকূল সুউচ্চ দাবি পেশ করতেন এবং ঘোষণা করে দিতেন যে দাবিগুলি নিয়ে কোনোরকম দরাদরিতে তিনি প্রস্তুত নন। আর তারপর অপরপক্ষ কি চাল দেয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতেন। এই পদ্ধতিতে প্রায়ই তিনি অনেকটা আদায় করে নিতেন। তাঁর এই ধাপ্পা দেওয়া কাজে দিত” (পৃ. ৩৮)। খ্যাতনামা ইংরেজ সাংবাদিক পিটার স্ট্রাসবার্গ স্বয়ং যদিও ১৯৪৬ খ্রি. ক্ষমতা হস্তান্তরের ঐ নাটকের কুশীলব ছিলেন না, তবুও ঐ দীর্ঘমেয়াদী আলোচনার অন্তরঙ্গ পর্যবেক্ষক ছিলেন। ঐ দীর্ঘ একটানা আলোচনার অভিজ্ঞতা আলোচনা প্রসঙ্গে জ্যাকেরিয়াকে তিনি বলেছিলেন: “জিন্না…ধর্মোন্মাদ ব্যক্তি ছিলেন না…” তবে “ধর্মীয় কট্টরপন্থাকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন….।” নিজের অনুগামীদের মধ্যে জিন্না যে ধরনের ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলেন তা প্রত্যক্ষ করে স্ট্রাসবার্গ আশ্চর্য বোধ করতেন। “জিন্নাকে তিনি এক গণতান্ত্রিক নেতার চেয়ে বরং ডিক্টেটার স্বরূপ বিবেচনা করতেন…। নিজের কট্টর অনুগামীরা যখন তাঁকে কায়েদ-এ-আজম রূপে সম্মান জানাতেন সে সময়ে জিন্না আত্মগৌরবের যে সপ্তম স্বর্গে বিচরণ করতেন তার অভিজ্ঞতা পিটার স্ট্রাসবার্গ আমার কাছে বর্ণনা করেছিলেন। স্ট্রাসবার্গ জিন্নার ঐ মনোভাবে নাৎসীদের ‘হেইল হিটলার’ সম্বোধনের প্রতিধ্বনি শুনতে পেতেন”। পিটার স্ট্রাসবার্গ জ্যাকেরিয়াকে বলেছিলেন: “জিন্নার সবুজ উর্দি পরা এক সশস্ত্র দেহরক্ষী ছিল…।” তিনি জিন্নাকে পছন্দ করতেন না। তবে ভাবতেন যে তিনি একজন স্থিরসঙ্কল্প নেতা, যিনি, “নিজের ট্রাউজারের ভাঁজ একটুও কোঁচকাতে না দিয়ে এবং চোখের রিমলেস চশমা একবারও না সরিয়ে” তাঁর অনুগামীদের “প্রতিশ্রুত পবিত্র-ভূমিতে” পথ দেখিয়ে উপনীত করে দেবেন” (পৃ. ১৩৯-১৪০)। শরীফুদ্দীন পীরজাদা ছিলেন জ্যাকেরিয়ার বোম্বাই কলেজজীবনের বন্ধু। পীরজাদা কেবল মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন না, আংশিক সময়ের জন্য জিন্নার সচিবের কাজও করতেন।
পৃষ্ঠা: ৩২০

তবু জ্যাকেরিয়ার সঙ্গে কলেজজীবনে যে সখ্য গড়ে ওঠে তা বজায় ছিল এবং তিনি মনে মনে আশা পোষণ করতেন যে কোনো না কোনোদিন তাঁর পথভ্রান্ত বন্ধু জ্যাকেরিয়া লীগের প্রভাব-বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পীরজাদা নিজের শহর বোম্বাই চিরকালের জন্য ছেড়ে সে দেশের বাসিন্দাই কেবল হননি সেখানকার সফল আইনজীবীর সঙ্গে সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। নূতন রাষ্ট্রের একাধিক দায়িত্বও তিনি পালন করেন। জীবনসায়াহ্নে তিনি এক খ্যাতিমান পণ্ডিত রূপেও স্বীকৃতি লাভ করেন এবং মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলন সম্বন্ধে একাধিক গ্রন্থ রচনার সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে সম্পর্কিত বহু দলিল-দস্তাবেজের সম্পাদনা ও সংকলন করেন। পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হবার পর “ক্রোধের বদলে বিষণ্ণ কণ্ঠে” পীরজাদা জ্যাকেরিয়াকে বলেন যে ১৯৪০ পর্যন্ত প্রায় তিন দশক “জিন্না জোড় হস্তে বার বার মুসলমানদের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেবার অনুরোধ জানাতে গেছেন; কিন্তু “প্রতিবারই তাঁরা জিন্নাকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন…জিন্না বার বার অপমানিত হয়েছেন। ১৯২৮ খ্রি. নেহরু রিপোর্টকে স্বীকৃতি দেবার সময়ে এমন ঘটেছে (মূল গ্রন্থের সংশ্লিষ্ট অংশ দ্রষ্টব্য)। তারপর তিনি যখন তাঁর ‘চোদ্দ দফা’ উপস্থাপিত করলেন তখনও এমনি ঘটেছে। আর শেষ অবধি ১৯৩৭ খ্রি. কংগ্রেস যখন মুসলিম লীগের সঙ্গে বিভিন্ন প্রদেশে কোয়ালিশন সরকার গড়তে গররাজী হল তখনও ঐ একই ব্যাপার হল। বারবার একই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা হবার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে হিন্দুরা মুসলমানদের সঙ্গে মিলিত ভাবে ক্ষমতা ভোগ করতে প্রস্তুত নয়” (পৃ. ৮৫)।


দিল্লির প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং পরবর্তীকালে ইংলন্ডে ভারতের রাজদূত ও রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতির মনোনীত সদস্য কুলদীপ নায়ারের পরিবার লাহোরের মূল বাসিন্দা ছিল। দেশবিভাগের পর আরও অনেকের মতো তাঁকে বহু কষ্টে দিল্লিতে থেকে কঠিন জীবন- সংগ্রামের দ্বারা দাঁড়াবার স্থান করে নিতে হয়। ১৯৪৫ খ্রি. লাহোরের আইন কলেজের দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র হিসাবে আকস্মিক ভাবেই তিনি জিন্নার সঙ্গে সরাসরি বার্তালাপের সুযোগ পেয়ে যান।(১১) মনে রাখতে হবে যে পৃথক পাকিস্তানের জন্য জিন্না ও লীগের প্রচারাভিযান তখন তুঙ্গে। তবু আইন কলেজের ছাত্রদের সেই সভায় যথেষ্ট উপস্থিতি ছিল না। “উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে-প্রদেশগুলির পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবার কথা সেখানে মুসলমানদের জন্য এক পৃথক রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন ধর্মের ভিত্তিতে দেশবিভাগের দুই বৎসর পূর্বে পরিলক্ষিত হয়নি”।
জিন্না সেই সভায় তাঁর স্বপ্নের পাকিস্তানের কথা প্রায় “ভগবদ্বাক্য প্রচারকের” মত বলেছিলেন। মুসলমানেরা হিন্দুদের থেকে এমন সর্বতোভাবে পৃথক যে কেবল মুসলমানদের জন্য এক পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি ছাড়া দ্বিতীয় পন্থা নাস্তি বার বার এই কথা প্রচার করা সত্ত্বেও এক বিচিত্র ধারণা চালিত হয়ে তিনি সেই সভায় বলেছিলেন যে উভয় রাষ্ট্র নিজেদের প্রতিভা অনুযায়ী গড়ে উঠবে এবং “উভয়ে পরস্পরের উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা করবে।”
সভাশেষে শ্রোতাদের প্রশ্ন আহুত হলে কুলদীপ নায়ার দুটি প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁর প্রথম প্রশ্নের সারমর্ম ছিল—বিগত কয়েক বৎসরে যেভাবে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও শত্রুতা প্রচার করা হয়েছে তাতে তো আশঙ্কা যে ইংরেজ চলে গেলেই তারা একে অপরের টুটি লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
“আমার আশঙ্কার সঙ্গে জিন্না সহমত হলেন না। আর পাকিস্তান পৃথক হবার সময়ে কোনোরকম দাঙ্গা-হাঙ্গামা হবে বলে তিনি মনে করেন না, এই ধারণা ব্যক্ত করলেন। তর্জনীর ফাঁকে নিজের রিমলেস চশমা বাগিয়ে ধরে তিনি জবাব দিলেন যে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো যোগসূত্রই নেই। তাই তারা পৃথক হয়ে গেলে সুখেই থাকবে। কোনো রকম সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকবে না। তাঁর উত্তর হল, ‘রক্তের সম্বন্ধ অনেক গভীর (Blood is thicker than water)। তিনি বললেন যে হিন্দু মুসলমানের দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে আমি যে সংঘর্ষের মানসিকতা দেখতে পাচ্ছি তা পরস্পর থেকে পৃথক ও স্বাধীন হবার দিনই অদৃশ্য হয়ে যাবে। পাকিস্তান ও ভারত সৎ প্রতিবেশীদের মতো থাকবে।’ কোনো কোনো রাষ্ট্র পরস্পরের লক্ষ লক্ষ অধিবাসীকে এক সময়ে হত্যা করে থাকবে; কিন্তু তবুও আজকের শত্রু কালকের বন্ধু হয়ে যায়’ বলে তিনি উত্তরের উপসংহার টানলেন।”
১৯৪৫ খ্রি. জিন্নার ঐ উত্তরে বাস্তববুদ্ধির অভাবের সুস্পষ্ট নিদর্শন থাকলেও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে তাঁর বক্তব্য পাকিস্তান প্রস্তাবের সম্পর্কে ১৯৪০ খ্রি. মার্চে লীগের সাধারণ সভায় উপস্থাপিত বক্তব্যের সুরেই বাঁধা ছিল। আর জিন্না প্রসঙ্গে একদা আইনের পেশায় তাঁর সহকারী চাগলার মূল্যায়ন—তিনি জোরালো আইনজ্ঞ (lawyer) না হলেও ছিলেন জবরদস্ত অধিবক্তা বা উকিল (advocate)। তবে আর মাত্র দুই বৎসরের মধ্যেই যে জিন্না তাঁর কল্পলোক থেকে বাস্তব জগতে নেমে আসতে বাধ্য হন তার প্রমাণ ও কুলদীপ নায়ার সংগ্রহ করেছিলেন ১৯৭১ খ্রি. পাকিস্তানে যখন ইতিপূর্বে উল্লিখিত জিন্নার এককালের আপ্ত সচিব কে. এইচ. খুরশিদের কাছে তিনি এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। ইতিমধ্যেই অবশ্য মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয়েই দেশবিভাজনকালের দাঙ্গাহাঙ্গামাকে ‘অসম্ভাব্য বা অবিশ্বাস্য’ আখ্যা দিয়েছে।
খুরশিদের জবানিতে ঐসব শোচনীয় হিংসাত্মক ঘটনা সম্বন্ধে জিন্নার প্রতিক্রিয়ার যে বিবরণ পাওয়া যায় তা তাঁর দীর্ঘকালীন নিঃসঙ্গ মানসিকতারই অনুরূপ। “প্রথম দিকে কায়েদ-এ-আজম বিশ্বাস করতেই চাইতেন না, যে অমন ব্যাপক হিংসার এতসব ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তীকালে তিনি বলতেন যে ‘ওরা পাকিস্তানকে শেষ করে দিতে চায়।’ তাঁর ইঙ্গিত ছিল কংগ্রেস ও আকালীদের প্রতি, ব্রিটিশদের প্রতি নয়। খুরশিদ আমাকে জানিয়েছিলেন যে পরবর্তীকালে এ প্রসঙ্গ উঠলে কায়েদ-এ-আজম মুখ কাল করে একেবারে মৌন হয়ে যেতেন। ”
কুলদীপ নায়ার কর্তৃক উল্লিখিত অপর প্রসঙ্গটির ঘটনাস্থল স্বাধীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নার করাচিস্থ সরকারি আবাস। কাল — স্বাধীনতার ঠিক পরই যখন একদিক থেকে নিঃস্ব হিন্দু শিখের উদ্বাস্তুস্রোত ভারতের অভিমুখে ধেয়ে চলেছে এবং একই ভাবে ভারত থেকে আহত-পীড়িত-লাঞ্ছিত মুসলমান নর-নারী-শিশুর স্রোত পাকিস্তানে চলেছে। দুই দেশের সাধারণ মানুষই সেই অমানবিক নর সংহারের নিন্দা করছে। একে অপরের দেশকে দায়ী করছে। কিন্তু মনুষ্যত্ব বিরোধী কাজ কেউ থামাতে পারছে না। নৌবাহিনীর তরুণ অ্যাটাচেও বড়লাট ভবনের সেই ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন যেখানে কায়েদ-এ- আজম তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তরুণ অফিসারটির মন তখন অত্যন্ত চঞ্চল। উভয় দেশের উদ্বাস্তুদের দুর্দশার জন্য তো বটেই। উপরন্তু ভারতে তাঁর আত্মীয়বর্গ কিভাবে আছেন এবং কেমনভাবে ও কি অবস্থায় তাঁরা পাকিস্তানে পৌঁছাবেন, সেই দুশ্চিন্তায়ও।
অতঃপর লেখকের জবানীতে: “খেতে খেতে কায়েদ-এ-আজমকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্যার, পাকিস্তানের কি প্রয়োজন ছিল? জনসাধারণের দুঃখকষ্টের ধারণা করা যায় না। ভবিষ্যতে কি হবে? খাবার টেবিল ঘিরে ফতেমা জিন্না সহ আর সবাই যাঁরা ছিলেন সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে তিনি বিড় বিড় করে কথাগুলি উচ্চারণ করলেন। ঘরের মধ্যে হঠাৎ সম্পূর্ণ নীরবতা ছেয়ে গেল। এমনিতেই ভারত-বিভাজন উত্তর অশান্তি ও ব্যাপক দেশান্তরী হবার ঘটনায় সবার চিত্ত ভারাক্রান্ত ছিল। সবাই এক দৃষ্টিতে জিন্নার দিকে চেয়ে রইলেন। বেশ কিছুটা সময় লাগল তাঁর নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে।
শেষ অবধি জিন্না বললেন যে ও প্রশ্নের তিনি উত্তর দিতে পারবেন না। একমাত্র ভবিষ্যৎই এসম্বন্ধে চূড়ান্ত রায় দিতে পারবে। ‘ঘটনার এত কাছে আমরা রয়েছি বলে সমুচিত রায় দেওয়া সম্ভব নয়।’ এইটুকু উচ্চারণ করেই আবার তিনি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। আর তার একটু পরেই তিনি খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্থানত্যাগ করলেন।”

দিল্লির মানবাধিকার ও সাম্প্রদায়িক সদ্ভাবনার ক্ষেত্রে সক্রিয় জনসেবকদের মধ্যে ধীরুভাই শেঠ বিগত শতাব্দীর শেষভাগে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। এঁদের অন্যান্য কার্যকলাপের মধ্যে সুশীল সমাজের সদস্যদের কর্তব্য হিসাবে নানা প্রসঙ্গে জনচেতনা সৃষ্টির জন্য উচ্চ স্তরের আলোচনাচক্র আয়োজিত হয়ে থাকে। সেই সব আলোচনাচক্রে উপস্থাপিত নানা বিদ্বজনের বক্তব্য লিখিত রূপেও প্রকাশিত হয়। এইরকম একটি গ্রন্থে প্রকাশিত দিল্লির সুপ্রিম কোর্টের তরুণ আইনজীবি ও উৎসাহী সমাজ-সেবক অনিল নেউরিয়ার একটি বিশ্লেষণাত্বক রচনার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে। পাকিস্তান-মূল ঐতিহাসিক ড. আয়েষা জালাল, ভারতের আইনজীবি সিরভাই (মূলগ্রন্থে এঁদের উল্লেখ বিদ্যমান) প্রমুখ এক শ্রেণীর জিন্না-গবেষকদের ধারণা এই যে জিন্না আসলে যা চেয়েছিলেন তা হল রাজনৈতিক অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর মুসলিম সমাজের জন্য নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে সংখ্যাসাম্য (parity), ভারত-বিভাজন নয়। অবশ্য সংখ্যাসাম্যের কথা একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কখনও মুসলমান-অমুসলমানের, কখনও বা মুসলমান-বর্ণহিন্দুর, কখনও আবার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসি প্রতিনিধিদের মধ্যে। এই বক্তব্য খণ্ডন করে নেউরিয়া প্রশ্ন তুলেছিলেন তবে তিনি কেন্দ্রীয় পরিষদে ১৯৪৫ খ্রি. ১১ই জানুয়ারি রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসানের জন্য কংগ্রেস নেতা ভুলাভাই দেশাই ও লীগ দলের নেতা লিয়াকৎ আলী যে চুক্তি করেছিলেন (মূল গ্রন্থে এর বর্ণনা ও অগৌরবজনক সমাপ্তির বিবরণ আছে), তার প্রতি বিমুখ হলেন কেন?
ঐ বৎসরের জুন মাসে ওয়াভেল কর্তৃক আহুত প্রথম সিমলা সম্মেলনে কংগ্রেস প্রস্তাবিত বড়লাটের অন্তর্বর্তী শাসন পরিষদে কংগ্রেস ও লীগ প্রতিনিধিদের সংখ্যাসাম্য মেনে নিলেও কেবল জিন্নার আপত্তিতে তা পরিত্যক্ত হয়। কংগ্রেসের ‘কোটা’ থেকে কোনো মুসলমান সদস্য নেওয়া চলবে না—জিন্নার এই দাবি সর্ব সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসের পক্ষে স্বীকার করা সম্ভব ছিল না। জিন্নার দাবি ছিল যে তাঁর লীগকে মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্ব মূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে আগাম স্বীকৃতি দিতে হবে। উল্লেখ্য, ঐ প্রথম সিমলা সম্মেলনের এক বক্তৃতায় জিন্না স্বয়ং ঘোষণা করেন যে, “পাকিস্তানের ভিত্তিতে ছাড়া আর কোনো শর্তেই তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরনের কোনো সাংবিধানিক বোঝাপড়া মেনে নেবেন না” (ভি.পি. মেনন; Trausfer of Power; ১৯৫৭; পৃ. ১৯৭-৯৮)। তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে ঐ বৎসরেই সপ্রু কমিটির বেসরকারী বোঝাপড়ার প্রসঙ্গে। তার মুসলমান ও বর্ণ হিন্দু প্রতিনিধিদের সংখ্যাসাখ্যের প্রস্তাব গান্ধী স্বীকার করে নিলেও জিন্না তা মানতে অস্বীকার করেন।
অন্তবর্তী সরকারে কংগ্রেস ও লীগ প্রতিনিধিদের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও তার কারণে তার কাজ-কর্মে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে বড়লাট ওয়াভেলের উদ্যোগে নেহরু, জিন্না ও বলদেও সিংকে লন্ডনে আমন্ত্রণ জানান হয় ব্রিটিশ মন্ত্রী মণ্ডলীর সঙ্গে আলোচনা ও তার মধ্যস্থতায় কোনো সমাধানসূত্র খোঁজার জন্য। সে প্রয়াসও ব্যর্থ হবার পর প্রধানমন্ত্রী এটলি ১৯৪৭ খ্রি. ফেব্রুয়ারিতে ভারত বিভাজন নীতিগত ভাবে মেনে নিয়ে এক ঘোষণা করেন। যাই হোক, দেশে ফেরার পথে জিন্না মিশরের রাজধানী কায়রোতে যাত্রা বিরতি করেন। ১৯৪৬ খ্রি. ১৯শে ডিসেম্বর সেখানে তিনি ঘোষণা করেন, ভারতে যদি “কোনো হিন্দু সাম্রাজ্যের পত্তন হয়, তাহলে কেবল সেদেশেই ইসলামের সর্বনাশা হবে না, অপরাপর মুসলিম দেশেও তার সর্বনাশ প্রতিক্রিয়া ঘটবে” (The Eastern Times; ২২শে ডিসেম্বর ১৯৪৬)। মুসলিম (?) দেশ মিশরে বসে ইসলামের ভবিষ্যৎ বিপন্ন—এ ধূয়ো তোলা গোঁড়া সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও প্যান-ইসলামী মানসিকতার প্রচার, একথা অস্বীকার করা যায় না। অথচ এই জিন্নাই একদা প্যান-ইসলামী আন্দোলন খিলাফৎ-এর সঙ্গে গান্ধী কর্তৃক কংগ্রেসকে যুক্ত করায় আপত্তি জানিয়েছিলেন এবং এর দুই অগ্রনায়ক আলী ভ্রাতৃদ্বয়কে তাঁর মত আধুনিকতাপন্থী নেতার তুলনায় গান্ধীর অধিক স্বীকৃতি দেন— এই অনুযোগ করে তিনি মনে মনে ক্ষোভ পোষণ করতেন।


ভারতীয় জনতা পার্টির প্রথম সারির নেতা ও বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের স্বরাষ্ট্র ও উপপ্রধান মন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদওয়ানি দীর্ঘ দিনের রাজনীতিবিদ ও জাতীয় স্তরের প্রমুখ ব্যক্তিত্ব বলে জিন্নার ভূমিকা সম্বন্ধে কিছুদিন পূর্বে একাধিকবার যেসব মন্তব্য তিনি করেছেন, তার সম্বন্ধেও বিবেচনা করা যেতে পারে। বলা বাহুল্য, তাঁর উক্তিসমূহের মূল উৎস সমসাময়িক সংবাদপত্রের প্রতিবেদন।
মন্ত্রীত্বের দায়মুক্ত হয়ে ২০০০ খ্রি. নিজ জন্মভূমিতে জিন্নার সমাধিস্থলে এক বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে পরলোকগত পাকিস্তানের স্রষ্টা ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি। তদানীন্তন (সর্দার প্যাটেল নন—কারণ নিজেকে তিনি তাঁর প্রতিরূপ একালের ‘লৌহপুরুষ’ রূপে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে রত হয়েছিলেন) কংগ্রেস নেতৃত্ব, বিশেষ করে গান্ধী ও জওহরলালের অসহযোগীতামূলক আচরণের কারণে বাধ্য হয়ে নাকি জিন্না পাকিস্তান বা ভারত বিভাজনের নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তানে থাকাকালীন তিনি একাধিকবার এজাতীয় প্রকাশ্য মন্তব্য করে ওদেশের গণমাধ্যমে ও জনমানসে অনুকূল ভাবমূর্তি সৃষ্টি করতে সমর্থ হলেও স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর নিজ দলের আদর্শগত নিয়ামক, অহিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব দেওয়ার রাজনৈতিক দর্শনের প্রবক্তা ও বিশেষ করে মুসলমানদের পঞ্চম বাহিনীর সদস্য বিবেচনাকারী রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের (গুরু গোলওয়ালকর-এর We or Dur Natiohood Defined; নাগপুর, ১৯৪৭ ও Bunch of Thoughts; বাঙ্গালোর ১৯৮০ দ্রষ্টব্য) চাপে কেবল তিনি তাঁর পাকিস্তানের ঐসব বক্তব্যের অনেকাংশ থেকে পশ্চাদাপসরণই করেননি, বেশ কিছু দিন দলে কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন। ঐজাতীয় বক্তব্যের ব্যাপারে তাঁর উপদেষ্টা রূপে চিহ্নিত এবং একদা বিজেপি-এর অন্যতম চিন্তানায়ক (Think-tank) রূপে বিবেচিত সুধেন্দ্র কুলকার্ণীকেও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের বিরোধিতার ফলে পিছনের সারিতে স্থান গ্রহণ করতে হয়।
আদওয়ানিজী প্রথম সারির একজন সক্রিয় রাজনৈতিক নেতা। আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যে “মনসা চিন্তত কর্মং বচসা ন প্রকাশয়েৎ” নীতি নিষ্ঠা সহকারে মেনে চলেন—এ সর্বজনবিদিত তথ্য। সুতরাং পাকিস্তান সফরের সময় হঠাৎ ঠিক কেন তিনি জিন্নার ঐরকম প্রশস্তি গাইলেন তা তিনি স্বয়ং খুলে বলেননি। আর সেই সব উক্তির কারণে তাঁর যে রাজনৈতিক হেনস্থা হয়েছিল, তার জন্য ভবিষ্যতেও এ বিষয়ে মন খুলে কথা বলবেন এমন আশা করা যায় না। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের এ বিষয়ে অনুমানের আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
আদওয়ানিজীর জিন্না সম্পর্কিত উক্তির মোটামুটি দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমটি তাঁর রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির স্বার্থে। আর দ্বিতীয়টি নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে।
ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনৈতিক হিন্দুত্বের দর্শন ও অহিন্দুদের প্রতি অবিশ্বাস এবং তাঁদের হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহণে বাধ্য করার কর্মসূচীর প্রতি পূর্বেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ নির্দেশিত এই রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ধ্যান-ধারণা দ্বারা দেশের শতকরা ২০ ভাগেরও বেশি (সংখ্যায় ২১-২২ কোটি) সংখ্যালঘুরা তো দূরস্থ, আধুনিক মানসিকতার হিন্দুদেরও বৃহত্তম অংশ যে চালিত হবেন না—এ সত্য দিবালোকের মত স্পষ্ট। যে একবার মাত্র এন.ডি.এ.-এর মাধ্যমে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসতে সমর্থ হয়েছিল, তখনই ঐ দলকে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের দর্শনকে ঠাণ্ডা ঘরে রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরই তা সম্ভবপর হয়েছিল। এন.ডি.এ-এর তামিল ও তেলেগু অস্মিতার বহুল সংখ্যক সদস্যবিশিষ্ট দলগুলি ছাড়াও জনতা দলের সহযোগী দলগুলি এবং তৃণমূল কংগ্রেস— সব দলই একবাক্যে একাধিক বার প্রকাশ্য ঘোষণা করে যে তারা বিজেপি-এর ঐ রাজনৈতিক হিন্দুত্বের কর্মসূচী মানেন না। ২০০২ খ্রি. গোধরা-উত্তর গুজরাতের এক তরফা মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে দলগুলি প্রকাশ্যে সরব হয় এবং তাঁর অপসারণে সফল না হলেও মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে। এইসব সহযোগী দলগুলির উৎসাহের অভাবেই নানা ধরণের তোড়জোড় এবং একাধিকবার ঘোষণা করা সত্ত্বেও এন.ডি.এ সরকারের প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন সমর্থনে বিধ্বস্ত বাবরি মসজিদের স্থানে রাম মন্দিরের জন্য একটি পাথরও গাঁথার চেষ্টা করা হয়নি। ক্ষমতা দখলের যে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্য বিজেপিকে সব সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে ভারতের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে চলার রণনীতি গ্রহণ করতে হয়েছিল, তারই
পৃষ্ঠা: ৩২৫

পূরক ছিল জিন্নার প্রশংসা এবং তার মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারতীয় মুসলমানদের কাছে নিজ দলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির চেষ্টা।
যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে এন.ডি.এ গড়ে উঠেছিল তিনি হলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কবি, মধুরভাষী, সুবক্তা, নম্র ও সংবেদনশীল নেতা। সংসদীয় রাজনীতিতে সাফল্যের চাবিকাঠি কেবল নিজ জোট-সঙ্গীদের মধ্যে যেসব বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থাকে তার সঙ্গে মানিয়ে চলাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে বিপক্ষের বক্তব্যও ধৈর্য ধরে শোনা এবং তাতে কোনো সত্য থাকলে তাকে যথাসম্ভব স্বীকার ও গ্রহণ করা——দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বাজপেয়ীজী এসব আয়ত্ত্ব করেছিলেন। আদওয়ানিজীর ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তাঁর একদেশদর্শী ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ১৯৯০ খ্রি. ‘রামরথযাত্রা’ থেকে শুরু করে সুপরিকল্পিত ভাবে বাবরি মসজিদ ভাঙা, গুজরাতের মুসলিম উৎসাদনের অনুঘটক নরেন্দ্র মোদীকে সংরক্ষণ দান থেকে শুরু করে আরও অসংখ্য সংখ্যালঘু বিরোধী ঘটনার নায়ক রূপে। বাজপেয়ীজী ক্রমশঃ অসুস্থতার কারণে অশক্ত হয়ে পড়ায় বিজেপি- এর সর্ব্বোচ্চ স্তরে নেতৃত্ব গ্রহণ করার প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব স্বতঃই দানা বাঁধছিল। আদওয়ানিজীর বুঝতে দেরি হয়নি যে নিজের কট্টর সংখ্যালঘু বিরোধী ভাবমূর্তির পরিবর্তন করতে না পারলে কোয়ালিশনের নেতা হিসাবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবেনা। সেকারণেও জিন্নার প্রশংসার মাধ্যমে তিনি মুসলমান এবং তৎসহ অপরাপর সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস অর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে এন.ডি.এ.-এর নেতা হিসাবেও স্বীকৃত হবার চেষ্টা করেছিলেন- এমন অনুমান করলে তা নিতান্ত স্বকপোলকল্পিত হবে না।
অতঃপর দেশের প্রধান বিরোধী দলের উপরতলায় বিভাজন সৃষ্টির উপলক্ষ্য হবার কারণে বহু আলোচিত জিন্নার সাম্প্রতিক এক নূতন রাজনৈতিক জীবনীর(১৩) প্রসঙ্গ। গ্রন্থটির লেখক হবার কারণ স্বীয় দল থেকে একেবারেই অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বহিষ্কৃত ও একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের দ্বারা কঠোর ভাবে তিরষ্কৃত ভারতীয় জনতা পার্টির প্রথম সারির ধীসম্পন্ন নেতা এবং সফল প্রশাসক ও সাংসদ ধীরবুদ্ধির যশবন্ত সিং-এর গ্রন্থের কথা।
১৯৪৭ খ্রি. ভারত-বিভাজনের ঘটনা যা ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের সমস্যার কোনো সমাধান করার বদলে প্রশ্নটিকে এক জটিল আন্তর্জাতিক সমস্যার রূপ দিয়েছে এবং যার অভিঘাতে ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রের প্রায় দেড়শত কোটি নর-নারী এখনও এক কুটিল ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হচ্ছে, তার সম্বন্ধে ভাবনা-চিন্তা ও বিতর্কমূলক কোনো গ্রন্থ রচনা করলে কেবল পার্টি-লাইন বিরোধী এই কারণে লেখকের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার নিদর্শন। এর সঙ্গে তুলনা চলে মধ্যযুগের ইউরোপের ইনকিউজিশন’ বা গোঁড়া হিন্দুসমাজের ধোপা-নাপিত বন্ধ করে জাতিচ্যুত করার প্রথার। আধুনিক গণতান্ত্রিক সভ্যতা-সংস্কৃতির বিরোধী এ। তবে প্রসঙ্গটি বিশেষ এক রাজনৈতিক দলের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে আমরা ঐ ঘরোয়া বিবাদের টানা-পোড়েনের মধ্যে প্রবেশ না করে কেবল তাঁর গ্রন্থ প্রসঙ্গে আলোচনা সীমিত করব।
প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভাল যে জিন্না সম্বন্ধে কোনো নূতন, চমকপ্রদ বা বিতর্কিত তথ্য লেখক দেননি। ইতিপূর্বে জ্ঞাত তথ্যাবলী তিনি ব্যবহার করেছেন উৎসসমূহের যথাযথ উল্লেখ করে। যশবন্ত সিং-এর বৈশিষ্ট্য তাঁর বিশ্লেষণে। লিবারল পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জিন্নার ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলমানদের একমাত্র প্রবক্তা হয়ে অবশেষে কায়েদ-এ-আজম রূপে বিবর্তন ও ভারত বিভাজনের মূল কারণ হবার পিছনে বারতের ইসলাম ও মুসলিম সমাজের ইতিহাস অনুধাবন ও বিশ্লেষণ যশবন্ত সিং-এর গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য। এ দায়িত্ব তিনি তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি ও সাধ্যমত সততার সঙ্গে পালন করেছেন। যদি ইন্টারনেটের যুগ বলে তুলনামূলক ভাবে অন্যান্য বহু গবেষকের তুলনায় তিনি এ সম্বন্ধে পাকিস্তানী সূত্রের অধ্যয়ন ও উল্লেখ করার সুযোগ পেয়েছেন বেশি। আর সেই জন্যই তাঁর অভিমত একাঙ্গী হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। সেই কারণে তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের বহু অবকাশও আছে।
তাঁর মতে পাশ্চাত্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তিনি স্বয়ং বিশ্বাসী হলেও জিন্নার সমর্থনের ভিত্তি—সাধারণ মুসলমান—ইসলামের শিক্ষার প্রভাবে এমন এক মানসিকতার যে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও সংখ্যাগুরু অমুসলমানদের সঙ্গে একই রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ভাবে মিলে-মিশে থাকার শিক্ষা তাঁরা পাননি। জীবনের সর্বদিগন্তকে প্রভাবিতকারী সর্বাঙ্গীণ ধর্মীয় বিশ্বাসে ইসলামী ‘উম্মা’ ও ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভিত্তিক। গ্রন্থের ৪৮৯ পৃ. যশবন্ত সিং একে ‘মাইনরিটি সিনড্রম’ রূপে চিহ্নিত করেছেন। আধুনিক গণতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও নিজ সমর্থকদের আশা-আকাঙ্খার পূর্তির জন্য তাই জিন্নাকে ধীরে ধীরে পূর্বসুরী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব স্যার সৈয়দ, সৈয়দ আমীর আলি, নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখদের মত মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা, আসন সংরক্ষণ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারে সংখ্যা সাম্য (parity) এবং অবশেষে অযৌক্তিক দ্বিজাতি তত্ত্বের মায়াজাল সৃষ্টি করে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাজনের অগ্রনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছিল। স্মর্তব্য, প্রথমাবধি জিন্নাকে মুসলিম সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচন লড়তে হয়েছিল।
যশবন্ত সিং-এর মতে জিন্নার রাজনৈতিক বিবর্তনের এই বিয়োগান্তক পরিণতিতে গান্ধী তো বটেই, জওহরলাল ও প্যাটেলেরও ভূমিকা ছিল। মূল গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে আমরা ভারত-বিভাজনে কংগ্রেস নেতৃত্বের ত্রয়ীর ভূমিকাসম্বন্ধে আলোচনা করেছি বলে তার পুনরুক্তি করব না। ঘটনাচক্রে নিজ গ্রন্থের ৪১৮ পৃ. লেখক স্বীকার করেছেন যে গান্ধী- আজাদের (এবং বাদশাহ খাঁরও যিনি তখন গান্ধীর সঙ্গে তাঁর শান্তি-মিশন বিহারের সুদূর গ্রামাঞ্চলে) অজ্ঞাতসারে ও অনুপস্থিতিতে ১৯৪৭ খ্রি. ৮ই মার্চ নেহরু-প্যাটেলের উদ্যোগে কংগ্রেস ভারত-ভাগের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়ে ভারত-ভাগ সম্ভব— এমন প্রকাশ্য ঘোষণার পরও গান্ধীজী কেন নেহরু-প্যাটেলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য দেশবাসীকে ডাক দেননি—এ অভিযোগ যশবন্ত সিং-এর আছেই। কিন্তু তিনি একথার উল্লেখ করেননি যে গান্ধী ১৯৪৭ খ্রি. ঐ বিভাজনকে অস্বীকার করে বকি জীবন পাকিস্তান নামে অভিহিত ভারতের একদা অবিভক্ত অঙ্গে থেকে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য জিন্নার সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্বিতীয় স্তরের রাজনীতির সূত্রপাত করে দিয়েছিলেন।
যাই হোক, তাঁর ও সমভাবে ভাবিত ভারতবিভাজনের প্রশ্নের গবেষকদের বিবেচনার জন্য একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা অবশ্যই জরুরী। ১৯৯৯ খ্রি. অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধান মন্ত্রীত্বকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসাবে তিনি স্বয়ং ভারতের কারাগার থেকে পাকিস্তানী সন্ত্রাসবাদীদের কান্দাহারে নিয়ে গিয়ে মুক্ত করেন বিমান ছিনতাই-এ পণবন্দী শতাধিক ভারতীয় বিমানযাত্রীর প্রাণরক্ষা করার জন্য। ২০০৮ খ্রি. ঐ বিতর্কিত কার্যের সমর্থনে তিনি বলেন যে, “ভবিষ্যতে অনুরূপ পরিস্থিতিতে পড়লে আমি আবার একই কাজ করব।” তাহলে ১৯৪৬ খ্রি. শেষে (দিল্লীবাসী নীরদচন্দ্র চৌধুরীর প্রত্যক্ষ করা ঘটনা) অন্তর্বর্তী সরকারের ভারতীয় প্রধানকে যদি রাজধানীর কনট প্লেসে স্বদেশী পুলিশের মানসিকতা ও কর্মে সাম্প্রদায়িকতাজনিত নিষ্ক্রিয়তা ও বিদেশী সামরিক বাহিনীর কর্তাদের ঔদাসীন্যে কেবল একটি ব্যাটন হাতে দোকানপত্র লুণ্ঠনকারী ও অগ্নিসংযোগকারীদের সঙ্গে নিজ প্রাণ বিপন্ন করে একা ধস্তাধস্তি করতে হয়, তাহলে তিনি কি করেন? অথবা ঐ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর আদেশ উপেক্ষা করে শ্বেতাঙ্গ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাজধানীর সন্নিহিত গুরগাঁও-এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে তাঁর সামনে উপায় কি? ভুলে গেলে চলবে না যে ক্ষমতা হস্তান্তরের সেই ক্রান্তিলগ্নে সমগ্র ভারত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিধ্বংসী আগুনে জ্বলছে। বহু কোটি নর-নারী-শিশুর জীবন- মরণ সমস্যা। নেহরুর ভাষায় তাঁরা তাই “মাথা কেটে মাথাব্যথার চিকিৎসা করেছিলেন।” ঘটনা ঘটে যাবার পর বিজ্ঞ হওয়া সহজ। কিন্তু যশবন্ত সিং-এর মত ধীর বুদ্ধির রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি সংবেদনশীলতা আকাঙ্খিতও ছিল।

ভারতীয় জনতা পার্টি এবং বাজপেয়ী সরকারে যশবন্ত সিংহের তরুণতর সহকর্মী হলেও এবং প্রবীণ নেতাকে একান্ত অগণতান্ত্রিক ভাবে বহিষ্কৃত করার বিরুদ্ধে সাহসী প্রকাশ্য প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও যশবন্ত সিংহের জিন্না ও দেশবিভাগ সংক্রান্ত অভিমতের প্রবল বিরোধিতা করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বহু গ্রন্থের রচয়িতা অরুণ শৌরী। যশবন্ত সিংহের বহু বিজ্ঞাপিত গ্রন্থের প্রকাশনার কয়েক মাস পরই তাঁর আধুনিকতম গ্রন্থের(১৪) এক অধ্যায়ে শৌরী স্পষ্ট বলেছেন, “এক কথায় বলতে গেলে দলে আমার প্রধান নেতা যশবন্ত সিংহের মত জিন্নার প্রতি আকৃষ্ট হবার পরিবর্তে আমি বরং তাঁর প্রতি একান্ত বিরূপ।” কারণ: “সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের মুসলিম লীগের ‘প্রত্যক্ষ কার্যক্রম’-এর নামে তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছিলেন। লিয়াকত আলীর মাধ্যমে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দিয়েছিলেন। ১৯৩৫ খ্রি. থেকে তিনি নিরন্তর গোপনে ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে যোগসাজস করে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখার যাবতীয় পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছিলেন।” পুনরপি, “যখন থেকে আমি পাকিস্তান সরকারের মহাফেজখানা কর্তৃক প্রকাশিত ‘জিন্না পেপার্স’-এর সব কয়টি খণ্ড, ‘ফাউন্ডেশনস অফ পাকিস্তান’-এর দুটি খণ্ড, চার খণ্ডের ‘হিস্ট্রি অফ পার্টিশান অফ ইন্ডিয়া’ পড়া শেষ করেছি তাঁকে (জিন্নাকে) আমার অপরকে চিমটি কাটা স্বভাবের, সঙ্কীর্ণচিত্ত, শয়তানী স্বভাবের ফন্দিবাজ এক ব্যক্তি মনে হয়েছে, ভারত-বিভাজনে যিনি ব্রিটিশ শাসকদের ব্যবহার করেছেন এবং ঐ একই উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকারও যাঁকে কাজে লাগিয়েছে।”
অরুণ শৌরীর উপসংহার হল: “দেশবিভাগ আমাদের পক্ষে অতীব মঙ্গলজনক হয়েছে এর ফলে আমরা শ্বাস নেবার অবকাশ পেয়েছি, আত্মস্থ হয়ে আমাদের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও ধর্মমতসমূহকে বাঁচাবার কিছুটা সময় মিলেছে। দেশবিভাগ না হলে আমাদের সর্বদা ইসলামি মৌলবাদীদের শাসানী-ধমকানী, দৈহিক নিপীড়ন সহ্য করতে করতে তাদের দ্বারা গ্রসিত হয়ে যেতে হত।”

যশবন্ত সিংহের গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর জিন্না এবং ভারত-বিভাজন সম্বন্ধে নূতন করে যে প্রবল বিতর্ক আরম্ভ হয়েছে তার মধ্যে থেকে আরও কয়েকটির কথা উল্লেখ করা হবে।
এরমধ্যে প্রথমটি হল তাঁর ব্যক্তিগত মিত্র ও ভারতের শেষ বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের একদা এ.ডি.সি. নরেন্দ্র সিংহ সরিলা, দেশ-বিভাগ সম্বন্ধে ব্যাপক গবেষণা ঋদ্ধ খাঁর একটি গ্রন্থ(১৫) প্রায় পাঁচ বৎসর পূর্বে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের ছাত্রদের প্রশংসা অর্জন করে। এছাড়া যশবন্ত সিংহের গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর নূতন দিল্লীর The Indian Express পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে(১৬) তিনি যেকথা বলেন, তা-ও প্রাসঙ্গিক।
নরেন্দ্র সিংহের অভিমত এই যে তাঁর বন্ধু যশবন্ত সিংহের গ্রন্থ অপূর্ণ এবং বর্তমান প্রজন্মের ভারতবাসীর কাছে দেশ-বিভাজন সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে সমর্থ হবেনা।
“তিনি (যশবন্ত) মহম্মদ আলী জিন্নার প্রশংসা করেছেন, কিন্তু নেহরু ও সর্দার প্যাটেলের প্রতি ন্যূনতম সুবিচার করেননি। তাছাড়া ভারত-বিভাজনের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা তাদের রণকৌশলগত স্বার্থের কারণ পাকিস্তান সৃষ্টির বাস্তবতার প্রতি কেন ইঙ্গিত করেননি?” “জিন্নাকে যতটা মহৎ রূপে চিত্রিত করা হয়েছে, বাস্তবে তিনি তেমন ছিলেন না। গোড়ার দিকে তিনি সৎ রাজনীতিবিদ হলেও, আনুমানিক ষাট বছর বয়স থেকে নিজ ভূমিকা পরিবর্তন করেন। তাঁর ‘প্রত্যক্ষ কার্যক্রম’-এর পরিকল্পনা, বর্তমানে আমরা সন্ত্রাসবাদ বলতে যা বুঝি, তার সূচনা। নিজের উদ্দেশ্যসিদ্ধি হবে মনে হলে মুসলমানদেরকে তিনি হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতেন। ভুলে যাবেন না যে দেশ-বিভাগের সাত বৎসর পূর্বে ইংরেজদের ইশারাতে তিনিই ১৯৪০ খ্রি. সর্বপ্রথম মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তোলেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন একবার আমাকে বলেছিলেন যে তিনি (জিন্না) মহনীয়তার দিবাস্বপ্নে ভুগতেন।” শ্রীযুক্ত সরিলা-এর মতে জিন্না “১৯৩৯ খ্রি. জানতে পেরেছিলেন যে তাঁর আয়ু আর বেশিদিন নেই। প্রাণঘাতী মারাত্মক যক্ষা রোগে তিনি যে আক্রান্ত তা জিন্না জেনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভিতর ক্ষমতা ও গৌরবের আকাঙ্খা ছিল যার কারণ তিনি ব্রিটিশ চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন। কংগ্রেসের ভুল-ভ্রান্তিও ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতার দ্বারা তিনি লাভান্বিত হতে থাকলেন। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জিন্নাকে যদি মহান ব্যক্তি বলা হয় তাহলে তো হিটলারও শক্তিশালী মিত্র পক্ষের সঙ্গে লড়াই করার জন্য মহান।”
অপরটি হল কলকাতার The Statesman-এ প্রকাশিত জাপানের নাগাসাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপক দীপক বাসু-এর মন্তব্য।(১৭)
যশবন্ত সিংহ এবং তাঁর এককালের নেতা আডওয়ানিজী কর্তৃক জিন্নার গুণকীর্তনের বিরোধিতা করে তিনি জিন্নাকে ধর্মনিরপেক্ষ রূপে তুলে ধরার চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। বলেছেন যে, যে লখনউ চুক্তির রূপকার হিসাবে তিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের রাজদূত রূপে প্রশংসিত হয়েছিলেন, তা তো আসলে হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে আসন রফা করার ব্যবস্থার বিরোধিতাকে শান্ত করার প্রয়াস। এর পূর্বেই তিনি কেন্দ্রীয় পরিষদে প্রথম নির্বাচিত হয়েছিলেন মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত এক আসন থেকে, ভারতে সাম্প্রদায়িক বিরোধ চিরস্থায়ী করার ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ— যৎকিঞ্চিৎ ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারতবাসীকে বিভক্ত করার উপাদান মর্লি-মিন্টো শাসন-সংস্কারের বাস্তব রূপ নূতন সংবিধানের বকলমে।
পাকিস্তান গণ-পরিষদের সদস্যদের কাছে তাঁর ১৯৪৭ খ্রি. ১১ই আগস্টের বক্তৃতার ভিত্তিতে জিন্নাকে ধর্মনিরপেক্ষ সাব্যস্ত করার প্রবল বিরোধিতা প্রসঙ্গে লেখকের দেওয়া এই ধরণের তথ্যও এ প্রসঙ্গে বিবেচ্য: “১৯৪৪ খ্রি. সেপ্টেম্বরে গান্ধীর সঙ্গে দীর্ঘ কয়েক দিনের আলোচনা প্রসঙ্গে জিন্নার দাবি ছিল যে পাকিস্তানের দাবির ঔচিত্য নির্ধারণে গণভোট নেওয়া হলে এলাকার সমগ্র জনসাধারণের নয়, কেবল মুসলমানদের মতামত বিবেচিত হবে।” দ্বিতীয়তঃ “স্বাধীনতার পর জিন্না স্ব সৃষ্ট যে রাষ্ট্রের প্রধান হন, সেখানেও ঐ একই সুরে কথাবার্তা বলতেন। তিনি ইসলাম নির্দেশিত স্বাধীনতা, মৈত্রী ও সাম্য’ অর্জনের ডাক দেন (২৫শে আগস্ট, ১৯৪৭খ্রি.); ‘ইসলামী গণতন্ত্র, ইসলামী সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবত্বের সমভাবের’ কথা বলেন (২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ খ্রি.); ‘সামাজিক ন্যায়- বিচারের নিশ্চিত ভিত্তি ও সেই ইসলামী সমাজবাদ যা মানুষে-মানুষে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববন্ধন প্রতিষ্ঠার’ কথা বলেন (২৬শে মার্চ ১৯৪৮ ক্রি.); ‘আমাদের গণতন্ত্রের মূলে বিরাজিত যথার্থ ইসলামী আদর্শ ও নীতির’ প্রতি জোর দেন (১৪ই আগস্ট ১৯৪৮ খ্রি.); ‘ইসলামী নবজাগরণ, সংস্কৃতি ও আদর্শের অগ্রগতির’ স্মৃতিচারণ করেন (১৮ই আগস্ট, ১৯৪৮ খ্রি.)।” এরপর লেখকের প্রশ্ন, “ওসব কি ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীর কথাবার্তা?”
১৯৪০ খ্রি. লাহোর বক্তৃতায় জিন্না হিন্দু ও মুসলমান সর্বতোভাবে পৃথক দুই জাতি (nation) এবং তাই তাদের একত্র থাকা সম্ভব নয় বলে ঘোষণা করে মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য এক পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তোলেন। সেই দাবি ক্রমশঃ ভারতীয় মুসলমানদের একটা বড় অংশকে প্রভাবিত করে তার প্রবল সমর্থক করে তোলে। এর চূড়ান্ত পরিণতি দেখা দেয় ‘প্রত্যক্ষ কর্মসূচী’তে ১৯৪৬ খ্রি. কলকাতা ও নোয়াখালি-কুমিল্লায়। সেই হত্যালীলা ও নারী-নিগ্রহের নিন্দা করে জিন্না বা লীগের কোনো নেতা একটি কথাও বলেননি। “১৯৪৮ খ্রি. হিন্দুদের নোয়াখালি থেকে উৎখাতপর্ব শুরু হবার পর তিনি বরং মন্তব্য করেন যে জন-বিনিময় আরম্ভ হয়ে গেছে এবং একে ব্যাপক রূপ দেবার জন্য একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। ১৯৪৭ খ্রি. ১৫ই আগস্টের আগে-পরে জিন্না যখন তাঁর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ অভিমত ব্যক্ত করছিলেন তখন নোয়াখালি ও অন্যত্র থেকে হিন্দুদের বাস্তুত্যাগ ব্যাপক আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছিল। পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসাবে জিন্নার এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল। কিন্তু তিনি তার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে কাশ্মীর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যার সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ খ্রি. ২০শে অক্টোবর।” পাকিস্তান থেকে হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ সব ধরণের সংখ্যালঘুদের উৎসাদনের ব্যাপারেই জিন্নার নেতৃত্বাধীন সরকার চোখ বুজে থেকেছে, এই অভিযোগ তুলে ধরার পর লেখক জিন্নার সেই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বক্তৃতার ব্যাখ্যা করেছেন নিম্নোদ্ধৃত ভাষায়: “জিন্নার জীবন ও কার্যকলাপ এই কথাই প্রমাণ করে যে লক্ষ লক্ষ মানুষের বিনাশ ও উৎসাদন অবধারিত হলেও তাঁর লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের জন্য এক ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।
পৃষ্ঠা: ৩৩०

১৯৪৭ খ্রি. ১১ই আগস্টের তাঁর ঐ বক্তৃতা ছিল প্রায় এক প্রতারণাপূর্ণ রাজনৈতিক উপস্থাপনা যার উদ্দেশ্য ইংরেজ উচ্চবর্গীয়দের প্রীতিসাধন। এক সফল আইনজীবি জিন্না ভাল অভিনেতাও ছিলেন এবং তাঁর অভীষ্ট শ্রোতৃমণ্ডলীকে সন্তুষ্ট করার কৌশলও তাঁর আয়ত্ত্বাধীন ছিল।”


পূর্ব ধারণা পরিচালিত হয়ে জিন্না ও ভারত-বিভাজন সম্বন্ধে কয়েকটি অভিমতের সমীক্ষা করার পর আমরা এ প্রসঙ্গের আপাত ইতি করব এ সম্বন্ধে ভারতে প্রকাশিত সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থের বক্তব্যের পরিচিতিদান দ্বারা। গ্রন্থদ্বয়ের উভয়েরই রচয়িতা দুই প্রবীণ পেশাদার ঐতিহাসিক।
এঁদের মধ্যে প্রবীণতম এবং বর্তমান লেখকের জ্ঞান অনুসারে ভারতীয়দের মধ্যে ১৯৪৭ খ্রি. বিভাজনের সর্বাঙ্গীণ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষক ও রচয়িতা হলেন দিল্লীর জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত অধ্যয়নের অধ্যাপক ও তত্রস্থ আন্তর্জাতিক অধ্যয়ন কেন্দ্রের ভূতপূর্ব ডীন ও অতীতে নেপালস্থ ভারতের রাষ্ট্রদূত বিমল প্রসাদ। দীর্ঘকালের অধ্যয়ন ও গবেষণার পর ১৯৯৯ খ্রি. থেকে ক্রমশ তিন খণ্ডে বিপুল তথ্য ও দলিল-দস্তাবেজ সহ ২০০৯ খ্রি. তাঁর গ্রন্থের (১৮) তৃতীয় ও শেষ যে খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, সম্মিলিতভাবে তাদের এবিষয়ে শেষ কথা আখ্যা দিলে অনুচিত হবে না।
প্রায় দুই হাজার পৃষ্ঠার সাক্ষ্য-প্রমাণ-অভিমতের সারমর্ম দু-চার পৃষ্ঠায় দেবার দুঃসাহস করা উচিত নয়। তবে তাঁর বক্তব্যের ধারার আভাস দেওয়া যেতে পারে। সমগ্র উত্তর ভারতের পটভূমিকায় মধ্যযুগ থেকে ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের তিনি সমীক্ষা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির স্বাভাবিক সমন্বয়-প্রবণতার জন্য হিন্দু-মুসলমান ও শিখেরা অধিকাংশ এলাকায় মিলে-মিশে থাকলেও অনেক অঞ্চলে শাসকের (মুসলমান হিন্দু জাঠ, মারাঠা বা শিখ) সম্প্রদায়গত অবস্থান হিসাবে মানুষের—বিশেষ করে অভিজাত- বর্গের—মধ্যে দৃষ্টিগোচর ভাবেই উত্তম-অধমের ভেদভাব ছিল। উদাহরণ স্বরূপঃ “আরব ও তুর্কীদের ইসলাম গ্রহণের পর সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রক্রিয়ায় গোড়া থেকেই উলেমাবর্গ তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাকে সমর্থন করে বৈধ রূপ দেওয়ায় প্রবৃত্ত হয়। আর এই প্রক্রিয়ায় উলেমা শাসকদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধাও পেতে থাকে যাতে ‘সত্য ধর্ম’-এর আরও প্রচার ঘটে। আর মুসলিম অভিজাতদের মধ্যে এমন একটা মানসিকতাও ক্রমশঃ গড়ে ওঠে যে তাঁদের জন্ম হয়েছে অমুসলমানদের উপর রাজত্ব করার জন্য। তুর্কী শাসকেরা এই মানসিকতার ব্যতিক্রম ছিলেন—নিজেদের শাসনে তাঁরা ভারতীয়দের পদ ও ক্ষমতা দিতেন শাসন-কার্যের সুবিধার জন্য।”(পৃ. ২০-২১, প্রথম খণ্ড)
জাঠ, রাজপুত, মারাঠা ও শিখ শাসকদের আমলেও এমনি শাসকের মানসিকতা অনুসারে মুসলমান বা অপর ধরণের রাজপুরুষ নিয়োগ করা হত। এমন কি মহারাজ রণজিৎ সিংহের মত মোটামুটি দক্ষ ও প্রজাপালক শাসকের রাজত্বেও স্ব-সম্প্রদায়ের অভিজাতদের মানসিকতার তারতম্যে মসজিদ ধ্বংস অথবা মুসলমান হবার কারণেও পক্ষপাতের শিকার হবার ঘটনা ঘটেছে। স্মরণ রাখতে হবে যে রায় বেরিলিরি সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে বঙ্গদেশ (অপেক্ষাকৃত কম) থেকে শুরু করে বিহার ও উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত একদা ওয়াহাবি আন্দোলনের যে প্রবল ঘূর্ণাবর্ত ওঠে, তা মূলতঃ শিখ বিরোধী (“রাজ করেগা খালসা”) ছিল, ইংরেজ-বিরোধী নয়। এই সত্য সেই সেকালে ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করে স্ব সম্প্রদায়ের উন্নতি করার নেতা স্যার সৈয়দ আহমদের চোখেও ধরা পড়ে।
অতঃপর রঙ্গমঞ্চে তৃতীয় পক্ষ, অর্থাৎ ইংলন্ডের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়াও শুরু হয়। তারা মুসলমানদের ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে রাজনৈতিক সম্প্রদায়ে পরিণত করার প্রক্রিয়া আরম্ভ করে তাঁদের পন্থ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আর্থ সামাজিক ভেদাভেদকে উপেক্ষা করে বাস্তব পরিস্থিতি থেকে ভিন্ন হিন্দুদের প্রতিপক্ষ এক পাথরে কোঁদা মূর্তির মত সমরূপ বলে মুসলমানদের বিবেচনা করে। (পৃ. ৪৩-৪৫, প্রথম খণ্ড) জেমস মিল ও স্যার হেনরি এম.ইলিয়ট (১৮৪৭ খ্রি.) প্রমুখ সাম্রাজ্যবাদের পোষক প্রথম যুগের ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা শাসকদের সেই উদ্দেশ্যের সহায়ক হন। এরই সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু মুসলমান শিখ তিনটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই ধর্মীয় বিশ্বাসভিত্তিক আত্মপরিচয়ের বৃদ্ধির যেসব আন্দোলন অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থেকে সামাজিক ও মানসিক বিভাজনের প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক বিভাজনের অনুকূল করে তোলে তার তথ্যও বিমল প্রসাদ উৎস উল্লেখ করে সবিস্তারে দিয়েছেন।
গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে এইভাবে প্রবীণ ঐতিহাসিক ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের ভারতে পাশাপাশি তিনটি সুস্পষ্ট পৃথক ধারার অস্তিত্বের কথা বর্ণনা করেছেন। একদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ যার দুর্গ তদানীন্তন উত্তর পশ্চিম প্রদেশ ও আউধ (বর্তমানের উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড) যেখানে ঊর্দু ও তার ফার্সি লিপির বদলে দেবনাগরী লিপিতে হিন্দি প্রবর্তনের দাবিতে এর বিকাশ। হিন্দু জাতীয়তাবাদের অপর অঙ্গ গোরক্ষা আন্দোলন ও মুসলিম বিরোধী দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে আর্যসমাজের নেতৃত্বে পাঞ্জাব ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে উদ্‌গত হয়ে সমগ্র উত্তর ভারতে তার বাহু বিস্তার করছে। (এই প্রসঙ্গে বঙ্গদেশে হিন্দু মেলা, নবগোপাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসু প্রমুখের ভূমিকার কথাও এসে পড়ে। অপরদিকে মুসলিম জাতীয়তাবাদ যার জন্ম আলীগড়ে, মহমেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজের প্রতিষ্ঠা (১৮৭৭ খ্রি.) ও ন্যাশনাল মহমেডান আ্যসোসিয়েশানের স্থাপনায়। তৃতীয় ধারা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের (১৮৮৫ খ্রি.) প্রতিষ্ঠায়, যা সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভারতীয়দের নিয়ে তার স্ব শাসনের লক্ষ্যে চলতে আগ্রহী।
গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে প্রবীণ ঐতিহাসিক পাকিস্তান বা মুসলমানদের জন্য পৃথক বাসভূমির উৎস অনুসন্ধানে লীগের লাহোর প্রস্তাবের দিন থেকে অন্তত দুই দশক কাল পূর্বে পাঞ্জাবে এর জন্মকে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৩৩ খ্রি. কেম্ব্রিজের রহমৎ আলী হঠাৎ এরকম দাবি করার অনেক পূর্বেই ১৯২০-এর দশক থেকেই মুসলমান বুদ্ধিজীবি ও বিশেষ করে যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির অঙ্গ পৃথক বাসভূমির কল্পনা দানা বাঁধছিল। প্রথম সারির নেতারা এর কথা লেখায় বা বক্তৃতায় উল্লেখ না করলেও হিন্দু লালা লাজপৎ রায় ও মুসলমান মৌলানা মহম্মদ আলী এর সপক্ষে প্রচার না করলেও এবং ১৯২৪ খ্রি. কাছাকাছি উভয়েই এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ আপোষ না মিটিয়ে ফেললে দেশবিভাগের সম্ভাবনা বিদ্যমান। বিমল প্রসাদের মতে জিন্না স্বয়ং ১৯৩৭ খ্রি. জুন মাসে ইকবালেরই মতই ভারত বিভাগ অপরিহার্য বিশ্বাস করা শুরু করেছিলেন যদিও প্রকাশ্যে তখনও তা প্রচার করা শুরু করেননি। ইকবালের জিন্নাকে লেখা পত্রগুচ্ছের প্রকাশনার জন্য জিন্নার ভূমিকা থেকে এটা স্পষ্ট (মূল গ্রন্থেও এর উল্লেখ আছে)। যেহেতু উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেসী মন্ত্রীমণ্ডলে লীগের প্রতিনিধির স্থান না হওয়া এর অনেক পরের কথা, তাই সেই ঘটনার কারণ জিন্নার মন ভারত-বিভাজনে প্রস্তুত হয়—এমন কথা বলা চলে না। সব দিক দিয়ে বিবেচনা করে বিমল প্রসাদের তাই বক্তব্য (দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৪০৬) ১৯৩৭ খ্রি. জুনের ভিতর জিন্নার মন ভারত-বিভাজনের জন্য তৈরী হয়ে গেলেও সেকথা তখনই তিনি ব্যক্ত করেননি।
বিমল প্রসাদের গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে লীগ কর্তৃক লাহোর (পাকিস্তান) প্রস্তাব গ্রহণের পটভূমি থেকে শুরু করে পাকিস্তানের জন্ম পর্যন্ত দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা করা হয়েছে। পূর্ববর্তী ঘটনাসমূহ যেহেতু, প্রধানত প্রকাশ্য ঘটনা সমূহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিণাম, তাই আমরা সরকারীভাবে পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণের দৃশ্যত যবনিকার অন্তরালে অনুষ্ঠিত মোটামুটি এক বৎসরকালের কার্যকলাপের কথা এখানে সংক্ষেপে বিবৃত করব গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ের (১৬৮-২৩৪ পৃ.) অনুসরণে।
আর যখন হিটলার-মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপকে তোষামোদ নীতির চূড়ান্ত পরিচয় দিয়েও ইংলন্ড নিরস্ত করতে পারল না তখন নিজ জগৎ-জোড়া বাণিজ্যিক শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনের স্বার্থে নিজ মিত্র শক্তিকে নিয়ে ব্রিটেন অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করল। সঙ্গে সঙ্গে ভারতসহ সব কয়টি সাম্রাজ্য ও উপনিবেশকেও ১৯৩৯ খ্রি. তেসরা সেপ্টেম্বরের পর যথাসম্ভব শীঘ্র তার পদাঙ্ক অনুসরণে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করতে বাধ্য করে যুদ্ধে ইংলন্ডের স্বার্থে সেসব দেশের সম্পদ ও জনশক্তির অবাধ ব্যবহার করতে দেওয়া হতে লাগল। সঙ্গত কারণেই ভারতে কংগ্রেস এই প্রশ্ন তুলল যে একদিকে মিত্রশক্তির তরফ থেকে ইংলন্ড দাবি করছে যে এ হল ফ্যাসিস্ট স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আদর্শগত যুদ্ধ; কিন্তু অপরদিকে ভারত স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে সহযোগী হতে চাইলেও ভারতে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের নামে যেটুকু গণতন্ত্র ছিল সাম্রাজ্যবাদী সরকার তা-ও হরণ করেছে। যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বে প্রদোশিক সরকারগুলির (এর অধিকাংশ কংগ্রেস পরিচালিত) সঙ্গে কোনো পরামর্শ তো করাই হয়নি, উপরন্তু হিসাবে তথাকথিত “ভারতরক্ষা আইন”-এর নানা বিধি-নিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দেশবাসীর উপর। বার বার আপত্তি করেও কোনো ফল না হওয়ায় অবশেষে কংগ্রেসের নির্দেশে প্রতিবাদ স্বরূপ কংগ্রেসী মন্ত্রীমণ্ডলগুলি পদত্যাগ করে।
মুসলিম লীগ এতে খুশি হয়ে “মুক্তি দিবস” পালন করলেও (বড়লাট এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রয়টারের মারফত জিন্নার বক্তব্যকে সমগ্র বিশ্বে প্রচার করে কংগ্রেসের ভূমিকাকে গৌণ করার ব্যবস্থা করেন।) এবং নিজেদের যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে বড়লাট লিনলিথগো লীগ ও তার নেতা জিন্নাকে হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া শুরু করলেও ব্রিটিশ জনমতের এক প্রভাবশালী অংশ এবং (তখনও ব্রিটেনের সপক্ষে যুদ্ধে যোগ না দিলেও মিত্র শক্তির প্রবল সহায়ক) আমেরিকার জনমতের অনুসরণে রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট বারবার চার্চিলের যুদ্ধকালীন সরকারের উপর চাপ দিতে লাগলেন ভারতের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিতে। চার্চিল ভারতে সাম্রাজ্যবাদের মুষ্ঠি তিলমাত্রে শিথিল করার বিরুদ্ধে ছিলেন। লিনলিথগো গান্ধীর সঙ্গে মাঝে মাঝে আলোচনা করে দরজা খোলা রাখলেও যুদ্ধের মধ্যে কোনো রকম ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই তাঁর সমস্ত উদ্যম কেন্দ্রীত হল জিন্নাকে কাজে লাগাবার জন্য যাতে ইংলন্ড ও আমেরিকার জনমতকে সামাল দেওয়া যায়।
জিন্নার সঙ্গে এই জাতীয় এক আলোচনা প্রসঙ্গে ১৯৪০ খ্রি. ৬ই ফেব্রুয়ারি লিনলিথগো তাকে পরামর্শ দিলেন যে কেবল লীগ অথবা মুসলমানদের মনোভাব বা স্বার্থ উপেক্ষা করে ভারতে কোনো শাসন-সংস্কার প্রবর্তন করা চলবে না—-এজাতীয় নেতিবাচক কথা-বার্তা না বলে তিনি যেন যথাসম্ভব শীঘ্র নিজের কোনো গঠনমূলক প্রস্তাব (Constructive programme) জনসমক্ষে পেশ করেন। বড়লাটের ভাষায়, “নচেৎ বর্তমানের মত কেবল সরকারকে, কোনো আনুষ্ঠানিক জ্ঞাপন (memorandum) দিয়ে অথবা সরকার কর্তৃক কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে তার কোনো কমিটিতে সাক্ষ্য দিয়ে গ্রেট ব্রিটেনের জনমত এবং বিশেষ করে হাউস অফ কমনসের প্রায় ৬০০ জন সদস্যকে প্রভাবিত করা যাবে না। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা যদি চান যে গ্রেট ব্রিটেনে তাঁদের দ্বারা নিজেদের বক্তব্যকে ঠিকভাবে তুলে ধরার অপারগ কারণে মুসলমানদের দাবির প্রতি যদি যথোচিত দৃষ্টি দেওয়া সম্ভব না হয়ে থাকে তাহলে তাঁদের নিজস্ব সদর্থক প্রস্তাব যথাসম্ভব শীঘ্র রচিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।”(ভারতসচিব জেটল্যান্ডকে প্রেরিত জিন্নার সঙ্গে বড়লাটের আলোচনার বিবরণ)। বড়লাটের বিবরণ অনুসারে জিন্না তাঁর পরামর্শে সম্মতি . জ্ঞাপন করেন। লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক সে সময়ে দিল্লীতে চলছিলই। সেই দিনই অর্থাৎ ৬ই ফেব্রুয়ারী তার শেষ যে প্রস্তাবের খসড়া লিপিবদ্ধ করা হয়, তা ভারত- বিভাজনের। লাহোরে পরের মাসে লীগের বাৎসরিক অধিবেশনের সময়ে প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ রূপ পায়। (মূল গ্রন্থে এপ্রসঙ্গের উল্লেখ আছে।)
ইতিপূর্বেও বড়লাট পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী এবং আগা খাঁর মাধ্যমে ছাড়াও তাঁর শাসন-পরিষদের তদানীন্তন আইন বিষয়ক সদস্য ও তাঁর একান্ত বিশ্বাসভাজন স্যার জাফরউল্লা খাঁ মারফত জিন্নাকে তাঁর ‘গঠনমূলক প্রস্তাব’ জনসমক্ষে পেশ করার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ বোম্বে প্রেসিডেন্সীর ছোটলাটের মাধ্যমে স্বয়ং জিন্নার এবং আগ্রা-অযোধ্যা সংযুক্ত প্রদেশের ছোটলাটের মাধ্যমে লীগের প্রভাবশালী নেতা খলিকুজ্জমাঁ-এর চিন্তা-ভাবনা ও গোয়েন্দা বিভাগের মাধ্যমে যেসব নিয়মিত খবর তিনি পাচ্ছিলেন, তাতে তাঁর ধারণা জন্মেছিল যে লীগ কংগ্রেসের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক কোনো পন্থা নেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। জাফরউল্লা খাঁ-এর প্রয়াসের ব্যাপারে এ প্রসঙ্গে আর একটু বলা প্রয়োজন। মুসলিম-মানসের হাল-হকিকৎ সম্বন্ধে বড়লাটকে ওয়াকিবহাল রাখার জন্য জাফরউল্লা খাঁ একটি নোট তৈরী করেন যার নীট বক্তব্য ছিল এই যে শিক্ষিত মুসলমানদের বড় একটা অংশ এখন বিশ্বাস করা আরম্ভ করেছে যে ভারত ‘এক দেশ নয়’, “বহু দেশের সমাহার হয়েছে এখানে’ এবং এখানকার অধিবাসীরা ‘একটি নয়, অন্তত দুটি জাতির (nation) প্রতিনিধিত্ব করে’। তাঁর মতে যে পৃথক হয়ে যাবার পরিকল্পনা মুসলমানদের অধিকাংশের বাঞ্ছিত, তাতে তিন বা ততোধিক ফেডারেশান থাকবে যার দুটি অন্তত হবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। উত্তর-পূর্বে আসাম-বঙ্গদেশ নিয়ে একটি এবং অপরটি হবে উত্তর-পশ্চিমে সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব সিন্ধু ও বেলুচিস্তানকে নিয়ে যাদের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ হবে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে। ভারতের বাকি অংশে এক বা একাধিক ফেডারেশন হতে পারে যাদের সঙ্গেও ব্রিটিশ সরকারের সরাসরি সম্পর্ক থাকবে। জাফরউল্লা খাঁ-এর নোটে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ সমর্থিত হয়নি, কারণ তাতে নাকি ‘নাগরিক বিনিময়’ অপরিহার্য ছিল। খুব সম্ভব বড়লাটের সম্মতিতেই জাফরউল্লা খাঁ তাঁর নোটের একটি নকল জিন্নার অবগতির জন্য তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। কারণ শাসন-পরিষদের সদস্য বড়লাটকে যে নোট দিচ্ছেন, তার নকল অপর কাউকে দেবার কথা নয়।
একদল ঐতিহাসিক এই কারণে বলে থাকেন যে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’-এর খসড়া বড়লাটের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে স্যার জাফরউল্লাকৃত। প্রধানত তিনটি কারণে বিমল প্রসাদ এই অভিমত থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। প্রথমত জিন্না তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি মত রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে ব্যাপারটি গোপন রাখলেও চৌঠা ফেব্রুয়ারী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি হাজি আবদুল্লা হারুণ কমিটির দোসরা ফেব্রুয়ারীর সুপারিশক্রমে মুসলমানদের স্বতন্ত্র বাসভূমি দেবার উদ্দেশ্যে ভারত-বিভাজনের এক পঞ্চসূত্রী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয়তঃ স্যার জাফরউল্লার প্রস্তাবের সঙ্গে ২২শে মার্চ লীগ কর্তৃক স্বীকৃত দেশভাগের “লাহোর প্রস্তাবের” একাধিক ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্য ছিল। তাঁর মতে তৃতীয় ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল: “বিশ্বের দরবারে (প্রধানত ব্রিটিশ ও আমেরিকান জনমতের কাছে) ব্রিটিশ সরকারের ভারত সম্পর্কিত নীতির সম্পর্কে অনুকূল ভাবনার সৃষ্টির সহায়ক হবে ও সরকারের আসল উদ্দেশ্য গোপনের পক্ষে ঢালের কাজ করবে বলে বড়লাটের অবশ্যই আগ্রহ ছিল যে লীগের লক্ষ্য যথাসম্ভব শীঘ্র প্রকাশ্যে প্রচারিত হোক। তবে এর থেকে যেন এই ভিত্তিহীন সিদ্ধান্ত না করা হয় যে বড়লাটের চাপে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। জিন্নার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে যাঁর কিছুমাত্র পরিচয় আছে তিনি এজাতীয় চিন্তা গোড়াতেই বাতিল করে দেবেন। তবে এছাড়াও এমন বহু সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে…যা ঐ একই সিদ্ধান্তের প্রতি ইঙ্গিত করে। প্রত্যুত ঐসব সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিকেই একথা বললে অতিশয়োক্তি হবেনা যে জিন্নার দ্বারা নির্ধারিত সময়ে লীগ কর্তৃক উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত বিজয়ের মুহূর্ত। কারণ অতীব নিষ্ঠা এবং তৎসহ সতর্কতা সহকারে ও হিসাব করে তিনি পূর্ববর্তী কয়েক বৎসর যাবৎ এতদুদ্দেশ্যে কাজ করে আসছিলেন” (সমগ্রন্থ; তৃতীয় খণ্ড; পৃ. ২২৩-২৪)।
দ্বিতীয় ঐতিহাসিক হলেন বি.আর.নন্দ, গান্ধী-নেহরু-মালব্য-লাজপৎ রায় সহ ভারতের জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত বহু নায়কের জীবন ও কর্মের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কৃতি যিনি ইতিপূর্বে আমাদের উপহার দিয়েছেন।
বিমল প্রসাদের মত মোটামুটি একই শ্রেণীর সাক্ষ্য-প্রমাণের উপর শ্রীযুক্ত নন্দ নির্ভর করেছেন। তবে তাঁর অধ্যয়ন, মূলত জিন্না-কেন্দ্রিক বলে স্বভাবতই তার সীমা সীমিত এবং সেই কারণে সংক্ষিপ্তও (৩২৪ পৃষ্ঠা) বটে। তবে গ্রন্থের ২৭তম অধ্যায়ে তিনি ১৮৭৭ খ্রি. থেকে আলীগড়ে স্যার সৈয়দ আহমেদের উদ্যোগে যে মুসলিম অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজের স্থাপনা হয় তাকেই মুসলিম পৃথকতাবাদের সূচনা রূপে চিহ্নিত করে সেখান থেকে ১৯৪৭ খ্রি. আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তান রূপী কেবল মুসলিম রাষ্ট্রের সৃষ্টির যে ইতিহাস সংক্ষেপে দিয়েছেন, তার থেকে সংশ্লিষ্ট উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের সৃষ্টির অপরিহার্যতা সম্বন্ধে তাঁর অভিমতের পরিচয় দেওয়া হবে।
পৃষ্ঠা: ৩৩৫

তবে তার পূর্বে ভারতে সাম্রাজ্যবাদের বন্ধন-মোচনের ও স্বায়ত্ত্ব শাসনের অধিকার লাভের আন্দোলনের প্রথম প্রহরেই পাশাপাশি যে হিন্দু ও মুসলমান পৃথকতাবাদের সৃষ্টি হয় এবং যাকে ভুল করে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ বা ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ আখ্যা দেবার যে প্রবণতা এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে দেখা যায়, তার অযৌক্তিকতা সম্বন্ধে শ্রীযুক্ত নন্দের একটি মূল্যবান মন্তব্য উদ্ধৃত করা হবে। বলা বাহুল্য মন্তব্যটি পাকিস্তান দাবি প্রসঙ্গে বলে নন্দ কেবল ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ সম্বন্ধে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করলেও ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কেও বক্তব্যটি সমান প্রযোজ্য। অতঃপর শ্রীযুক্ত নন্দের বক্তব্য:
“স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁ-এর কাল থেকে মুসলমানদের দ্বারা ভারতের জাতীয়তাবাদের প্রতি বিরোধকে অধিকাংশ পাকিস্তানী ঐতিহাসিক ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’–এর ভাবনাপ্রসূত বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ‘খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদ’ বা ‘বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ’—শব্দবন্ধের মতই অর্থহীন। জাতীয়তাবাদ শব্দটির মূলে আছে কোনো বিশেষ দেশ অথবা ভৌগোলিক অঞ্চল। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে পাকিস্তানের ধারণা জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত না হওয়া অবধি এজাতীয় একটা সম্ভাব্য সম্পর্কের অস্তিত্ব ছিলনা। এরপর থেকেই ভারতের মুসলিম পৃথকতাবাদ বিছিন্নতাবাদী ও জাতীয়তাবাদী চরিত্র গ্রহণ করা আরম্ভ করে। অতঃপর তিনি নিজ বক্তব্যের সমর্থনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসের বিশিষ্ট রচয়িতা ঐতিহাসিক এস.আর. মেহেরোত্রা-এর একটি অভিমত উদ্ধৃত করেছেন যাঁর বক্তব্য হল, “ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, এটা ‘ভূগোলের একটা আকস্মিকতা’। উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের অস্তিত্ব পাকিস্তানের কল্পনাকে বাস্তব রাজনীতির এলাকায় আনতে পেরেছিল। সমগ্র দেশে যদি মুসলমান অধিবাসীরা মোটামুটি সমান ভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতেন, তাহলে সর্বত্রই তাঁরা সংখ্যালঘু হতেন এবং সেই পরিস্থিতিতে তাঁরা সংখ্যালঘু রূপে না এক পৃথক অঞ্চলে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি করতে পারতেন আর না তাঁদের ক্ষমতা হত অঞ্চল বিশেষে প্রাধান্য বিস্তারের” (পৃ. ৩১৮-৩১৯)।
অতঃপর কলকাতায় ১৯৪৬ খ্রি. ১৬ই আগস্টের ভীষণ দাঙ্গার পর কোনো কোনো পক্ষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভারতের পরিস্থিতি কিভাবে দ্রুত দেশবিভাগের দিকে অপরিহার্য রূপে ধাবিত হয়, তার ঘটনাক্রম শ্রী নন্দার গ্রন্থ অনুসারে দেওয়া হবে:
দাঙ্গার কারণে বিচলিত হয়ে লর্ড ওয়াভেল মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের অন্তর্বর্তী সরকারে নিয়ে এলেন। কিন্তু এর পরিণাম হল তিনি যা আশা করেছিলেন তার ঠিক বিপরীত। অন্তর্বর্তী সরকার আরও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও কর্মকুশল হয়ে ওঠার পরিবর্তে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ-সংঘর্ষের কারণ পঙ্গু হয়ে গেল। কিংকর্তব্য বিমূঢ় বড়লাট উপায়ান্তর না দেখে ক্রমান্বয়ে সমগ্র উপমহাদেশের এক একটি প্রদেশ থেকে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীকে সরিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে এক ‘ভেঙে ফেলার’ (breakdown) পরিকল্পনা রচনা করলেন। ইংলন্ডে ১৯৪৬ খ্রি. সাধারণ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলি সুস্পষ্ট সংখ্যাধিক্যে বিজয়ী হয়েছিলেন। ওয়াভেলের পরিকল্পনা তাঁর কাছে হতাশের পরামর্শ মনে হল। তিনি এক নূতন বড়লাট নিয়োগের সিদ্ধান্ত এই উদ্দেশ্যে নিলেন যিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের অপেক্ষাকৃত সুশৃঙ্খল কোনো পরিকল্পনা রচনা ও তার রূপায়ন করবেন।
১৯৪৭ খ্রি. ২০শে ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ সরকার এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতির মাধ্যমে দায়িত্বশীল ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবার পর ১৯৪৮ খ্রি. জুন মাসের ভিতর ভারত ছাড়ার নিশ্চিত অভিপ্রায় ব্যক্ত করল। বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐকমত্য স্থাপনার উদ্দেশ্যে এই ঘোষণা ‘শক থেরাপি’ বা আঘাত দিয়ে চিকিৎসার প্রক্রিয়া হতেই পারত। কিন্তু বাস্তবে হল তার বিপরীত। কারণ ঘোষণায় এর পরই বলা হয়েছিল যে যদি নির্ধারিত দিনে (৩০শে জুন, ১৯৪৮ খ্রি.) সমগ্র দেশের জন্য একটি মাত্র সরকারের অস্তিত্ব না থাকে তাহলে ব্রিটিশ সরকার কোনো কোনো এলাকায় “বর্তমানের প্রাদেশিক সরকারসমূহ কিংবা সম্ভবপর আর যেকোনো উপায়ে হোক” ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। মুসলিম লীগের তখন কেবল বঙ্গদেশ ও সিন্ধু প্রদেশে দলীয় সরকার ছিল। লীগ তাই ধরে নিল যে তাহলে পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আসাম প্রমুখ অপর যেসব প্রদেশের নির্বাচনে দল পরাজিত হয়েছিল এবং যেগুলি তার প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত সেসব প্রদেশে ক্ষমতা দখলের জন্য আর মাত্র পনের মাস সময় হাতে রয়েছে। সুতরাং বাকি এদেশগুলিতে ক্ষমতা করায়ত্ব করার জন্য লীগ “প্রত্যক্ষ কর্মসূচী”-এর নামে বিক্ষোভ-প্রদর্শন শুরু করল এবং এর পরিণামে ১৯৪৭ খ্রি. মার্চ মাসের মধ্যে পাঞ্জাবের পশ্চিমের ব্যাপক অঞ্চলে গুরুতর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরম্ভ হয়ে গেল। পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যে প্রস্তাব গ্রহণ করল তাতে মুসলমান-অমুসলমানের ভিত্তিতে পাঞ্জাবের বিভাজন দাবি করা হল। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে মুসলিম লীগ এই বার্তা পেয়ে গেল যে পূর্ব ও পশ্চিমের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে ভারত থেকে পৃথক করার দাবি আঁকড়ে থাকলে তাকে পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলি নিয়ে পৃথক হবার সুযোগ দেওয়া হবেনা। ভারত বিভাজনের জন্য মুসলিম লীগ যে যুক্তি উপস্থাপিত করেছিল, তা সমভাবে ঐ প্রদেশ দুটির বিভাজনের সমর্থনেও পেশ করা যায়।
১৯৪৭ খ্রি. মার্চ মাস মুসলিম লীগ সন্তুষ্ট চিত্তে নিজের দাবিতে অনড় ছিল। ঐক্যবদ্ধ ভারত বলে অতীতে কখনও কোনো দেশের অস্তিত্ব ছিলনা এবং আপাত দৃষ্টিতে যে ঐক্য দৃশ্যমান তা ব্রিটিশ শাসনের অবদান। আর মুসলমানদের উপর যদি হিন্দুদের শাসন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় তাহলে এমন গৃহযুদ্ধের সূচনা হবে যার ভীষণতার নজির এশিয়ার অতীত ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তাই লীগের ঐকান্তিক দাবি যে গৃহযুদ্ধ এড়াতে দুটি পৃথক কর্তৃত্ত্বের কাছে ক্ষমতা সমভাবে হস্তান্তর করা হোক। আর লীগের দাবি এ ব্যাপারে অগ্রণী হবার দায়িত্ব একমাত্র ব্রিটিশ সরকারের। সরকারকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং এই প্রক্রিয়ায় এটা বুঝে নিতে হবে যে দুটি গণপরিষদ থাকবে যার একটি হিন্দুস্তানের সংবিধান রচনা করবে এবং অন্যটি করবে পাকিস্তানের। জিন্নার অলীক দাবির প্রবল সমর্থকদের অভিমত এই যে দুটি ব্রিটিশ স্বীকৃত এবং তাদের উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রস্তাব দেবার সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত হিন্দুরাজের কাছে নতি স্বীকার করার বদলে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে জিন্না অপর কোনো ধরণের বোঝা-পড়ার সম্ভাবনাকে কার্যত অসম্ভব করে দিয়েছিলেন।
এন. মানসার্গেরও সুচিন্তিত অভিমতও এই। “ট্রান্সফার অফ পাওয়ার ১৯৪২-৪৭” নামে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত সরকারী দলিল দস্তাবেজ খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশনার দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন তিনি। তাঁর মতে “ব্রিটিশ সরকারের উত্তরাধিকারী হিসাবে ভারতে দুটি রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে এমন ভীষণ – গৃহযুদ্ধ এখানে হতে পারত এশিয়ার ইতিহাসে যার উদাহরণ নেই।” অন্তত ১৯৪৭ খ্রি. সেই গ্রীষ্মকালে ব্রিটিশ সরকারের মনে হয়েছিল যে এছাড়া অপর কোনো বিকল্প সমাধানের পদ্ধতি অবাস্তব।’
১৯৪৭ খ্রি. মার্চের শেষে ওয়াভেলের স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য মাউন্টব্যাটেনের ভারতে উপনীত হবার পূর্বেই কংগ্রেস নেতৃবর্গ “অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকারক হিসাবে পাকিস্তানের সম্ভাবনার সঙ্গে মানিয়ে নেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠছিলেন। দেশবিভাগ অথবা গৃহযুদ্ধ— এই দুটি মাত্র বিকল্প থেকে বেছে নেবার পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছিল। নেহরু ও প্যাটেলের অন্তর্বর্তী সরকারে লীগকে নিয়ে চলার তিক্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে দেশের চতুর্দিকে ক্রমবর্ধমান আইন-শৃঙ্খলার অবনতির জ্ঞান তাদের ছিল। লীগের সঙ্গে কোনো রকম বোজাপড়া কেবল সুদূরপরাহতই নয়, অসম্ভব মনে হয়েছিল। ভারত-বিভাজন খারাপ নিশ্চয়ই, কিন্তু দেশের তার থেকেও আশঙ্কাজনক সম্ভাবনা কংগ্রেস-নেতৃবর্গ দেখতে পাচ্ছিলেন। ভূপালের নবাব প্রমুখ পশ্চিম ও ভারতের দেশীয় রাজ্যসমূহের নৃপতিবর্গ “রাজন্যবর্গের লীগ” গড়ার চিন্তা করতে আরম্ভ করে দিয়েছিলন। মধ্য ভারতের এক ক্ষুদ্র দেশীয় রাজ্য বস্তার-এর রাজা হায়দ্রাবাদের নিজামের সঙ্গে যে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং স্বরাষ্ট্র বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বল্লভভাই প্যাটেলের অধীনস্থ রাজনৈতিক বিভাগের ইংরেজ অফিসাররা তাঁর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সেই ষড়যন্ত্রে যেভাবে উস্কানী দিচ্ছিলেন, তা-ই শেষ পর্যন্ত প্যাটেলের মনে এই ধারমার সৃষ্টি করে যে অবিলম্বে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হওয়া প্রয়োজন এবং তারজন্য যদি ভারত ভাগ মেনে নিতেই হয়, তবে তাও বাঞ্ছনীয়। অন্তর্বর্তী সরকার চালাবার কটু অভিজ্ঞতা লাভ প্রসঙ্গে নেহরু যখন দেখলেন যে ব্রিটিশ অফিসার ও লীগ নেতৃবর্গের মধ্যে একটা “মানসিক সাযুজ্য” বিদ্যমান, তখন তিনিও একই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। এইভাবে স্বাধীনতার প্রাক্কালে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ – কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও ব্রিটিশ সরকার সামনে অগ্রসর হবার পথ হিসাবে বারত-বিভাজন স্বীকার করে নিল।
দেশবাসীর চেতনা উদ্বেল হয়েছিল পারশাসন-বন্ধন উন্মোচন করে আত্মোন্নতির আকাঙ্ক্ষায়। প্রশ্ন উঠেছিল, ধর্ম-জাত-সম্প্রদায় নির্বিশেষে উপ-মহাদেশের প্রতিটি অধিবাসীর সম্মিলিত স্ব-ভূমিতে এর সাধনা হবে, না বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় বা জাত-পাত ভিত্তিক গোষ্ঠী অন্যনিরপেক্ষ ভাবে কেবল নিজেদের জন্য সেই প্রয়াসে ব্রতী হবেন? ১৯৪৭ খ্রি. আগস্টের মধ্যভাগে সেই সিদ্ধান্ত রূপায়িত হয়েছিল। অপর সকলের থেকে পৃথক হয়ে কেবল মুসলমানদের জন্য পৃথক এক নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে দৃশ্যতঃ তাঁদের অনেকেই নিজেদের সাধনার সিদ্ধির পথ বেছে নিয়েছিলেন। সুতরাং সঙ্গত ভাবেই বার বার জিজ্ঞাসা যে ৬৩ বৎসর পূর্বে কারা, কেন, কোন্ পরিস্থিতিতে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? আর সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ৪০ কোটি মানবের হিতে উচিত হয়েছিল, কি অনুচিত? তবে প্রশ্নটা আর ৪০ কোটির তরফে নয়। এত দিনে প্রায় ১৫০ কোটির পক্ষ থেকে উঠছে। আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানে একটি নয়, দুটি। তাই অতীত ও বর্তমানের মত ১৯৪৭ খ্রি. ভারত-বিভাজন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং ভবিষ্যতেও উঠবে। বিতর্ক চলেছে এবং আরও চলতে থাকবে।
সাম্প্রতিক কালে পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই মাথা তুলছে। ভারতীয় উপ-মহাদেশের একই পর্বত-মালা, উপত্যকা ও নদী-নালার ভৌগোলিক-প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রাজনৈতিক বাস্তবতা হলেও প্রায় ১৫০ কোটি অধিবাসীদের জীবন-জীবিকা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে সার্বভৌমত্ব বজায় রেখেও আত্মোন্নতির তাগিদে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র কি বৃদ্ধি করা যায় না? বিশেষ করে যখন এই বাস্তবতা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে উপমহাদেশে ইসলামের নাম নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি হলেও তারই বৃহদংশের মুসলমানদেরই নেতৃত্বে ২৪ বছরের মধ্যেই বহু রক্তও অশ্রু ঝরিয়ে সেই রাষ্ট্র দ্বিধা-বিভক্ত হয়েছে। আর সেই দুটি রাষ্ট্রেই অল্পাধিক হলেও অমুসলমান নাগরিকদের বসবাস প্রত্যক্ষ বাস্তব। বাংলাদেশ তো আরও এক ধাপ এগিয়ে বহু ধর্মীয় নাগরিকতার আধুনিক বাস্তবতাকে সগৌরবে বরণ করে নিয়েছে। কেবল তাই নয়। আধুনিক অর্থব্যবস্থা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ-বিজ্ঞানের দৌলতে পৃথিবীর কুত্রাপি আর একটি মাত্র ধর্ম- জাত-সম্প্রদায় ইত্যাদির মধ্যে নাগরিকতা সীমিত নয়। এমনকি স্বঘোষিত ইসলামি বা ইহুদী রাষ্ট্রগুলিতেও। উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রই বর্তমানে ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদের দ্বারা পীড়িত। পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সহযোগিতার অভাবের কারণ প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের অবসানের পরও অস্ত্র উৎপাদক ও সরবরাহকারীদের পিছন পিছন আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীরা তিনটি রাষ্ট্রেই শিকড় ছড়াচ্ছে। নাগরিকদের বৃহৎ এক অংশকে অভুক্ত, শিক্ষার আলোক-বঞ্চিত ও অনুন্নত রাখার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি দেশই নিজ নিজ সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তুলছে। পুরাতন সংস্কারমুক্ত হয়ে পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঈর্ষা, অসূয়া দূর করে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে নূতন করে বাঁচার সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নের কলা ও বিজ্ঞান ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় ১৫০ কোটি নর-নারীকে শিখতে হবে। আর তার চাল-চিত্র হিসাবে ১৯৪৭ খ্রি. ভারত-বিভাজনের ইতিহাসের গভীরে যাবার মানসিকতাও এ অঞ্চলে বৃদ্ধি পাবে। অনাসক্ত চিত্তে অতীতকে জানাই সুষ্ঠু ভবিষ্যৎ গড়ার প্রথম ধাপ। সেই কারণেও এই বিতর্ক চলা জরুরী।

সংযোজন
পাদটীকা

১. Jinnah as I Knew Him; খুদাবক্স ওরিয়েন্টাল পাবলিক লাইব্রেরী; পাটনা (১৯৯৩) Hindusthan Review; জানুয়ারি ১৯৪৮ ও জানুয়ারি ১৯৪৯-এর পৃ. ২-৩, ১১- ১২, ১৪ এবং ৪, ৬, ৯ ও ১২-১৬ থেকে উদ্ধৃত।
২. Selected Works of Motilal Nehru, পঞ্চম খণ্ড, সপ্তম সংখ্যা, পৃ. ৩৬৮-৩৬৯ থেকে বিমল প্রসাদ কর্তৃক তাঁর Pathway to India’s Partition; প্রথম খণ্ড; মনোহর বুকস; দিল্লী; পৃ. ২৯২-৯৩ উদ্ধৃত।
৩. বিমল প্রসাদ কর্তৃক সমগ্রন্থের ২৯৩ পৃষ্ঠায় মুশিরউল হাসান (সঃ) Muslims and the Congress: Select Correspondences of Dr. M. A. Ansari 1912-13 গ্রন্থের পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত।
৪. ড. সর্বপল্লী গোপাল ( স: ); Collected Works of Jwaharlal Nehru; ত্রয়োদশ খণ্ড; দিল্লী (১৯৮১)। ক্রিপসের কাছে লিখিত জওহরলালের ২১শে জানুয়ারী, ১৯৩৯ খ্রি. পত্রও (উক্ত খণ্ডের ৭০৮ পৃ.) এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য।
৫. In Different Saddless; লন্ডন; পৃ ১২৮-৭৯| Khuda Bakhs Library Journal সংখ্যা ৮১-৮৩ (১৯৯৩ খ্রি.)-তে When I Was Secretary to Jinnah নামে পুনরুদ্ধৃত।
৬. পাকিস্তানের সৃষ্টিতে অসন্তুষ্ট ও অনুশোচনাকারী পাকিস্তানীদের মধ্যে মুহাজিরদের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখনীয়। এঁরা হলেন ভারত ছেড়ে ওদেশে মুসলিম স্বর্গভূমি তাঁদের নিজস্ব বাসভূমি পাকিস্তানে গিয়ে নয়া বসতিকারী উর্দুভাষী মোগল-সংস্কৃতির উত্তরাধিকারীবৃন্দ। ওদেশের হাল-চালে প্রবল অসন্তুষ্ট পাকিস্তানের মুক্তিদ কৌমী মুভমেন্ট (MQM)-এর বিক্ষুব্ধ নেতা আলতাফ হোসেন স্বেচ্ছানির্বাসন পর্বে ২০০০ খ্রি. ১৭ই সেপ্টেম্বর লন্ডনে এইভাবে পাঞ্জাবী ছাড়া পাকিস্তানের বিক্ষুব্ধ নাগরিকদের ছাপ্রকাশ্য সমাবেশে বলেন যে, “ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজন মানব-ইতিহাসের তা প্রচণ্ডতম ভ্রান্তি ছিল।”(Times of India; নূতন দিল্লী, ১৯.৯.২০০০ খ্রি.)। পাকিস্তানের শাসকবর্গ ও তাঁদের সমর্থক সংবাদমাধ্যম কর্তৃক কঠোর ভাবে নিন্দিত হলেও এম.কিউ.এম নেতৃবৃন্দ যে স্বীয় অভিমতে অবিচল ছিলেন, তার প্রমাণ হল স্বামী তাঁদের অপর এক নেতা খলিদ মকবুল সিদ্দিকীর প্রকাশ্য বিবৃতি। তিনি অপর কয়েকজন পাকিস্তানের পাখতুন, বালুচ ও সিন্ধী প্রতিনিধিদের নিয়ে লন্ডনের পূর্বোক্ত সম্মেলনের পর দিল্লীতে আসেন। সিদ্দিকী একদা নওয়াজ শরিফের মন্ত্রীসভার শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন এবং মুহাজিরদের প্রতি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও পুলিশদের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদ করে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। দিল্লীর ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানকে “মেকি, সামন্তবাদী গণতন্ত্র” আখ্যা দিয়ে কেবল ভারত সরকারই নয়, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের অধিবাসীদের কাছ থেকে তাঁদের স্বদেশে যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। (Times of India; নূতন দিল্লী; ৫.১০.২০০০খ্রি.)। এই প্রসঙ্গে প্রবীণ সিন্ধী নেতা জি.এম. সঈদের শেষ জীবনে তাঁর দ্বারা প্রবর্তিত “জিয়ে সিন্ধ” আন্দোলনের কথাও উল্লেখনীয়। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে নানা কারণে অভিবাসী সিন্ধীদের একটি গোষ্ঠী যাঁরা ওয়াশিংটনস্থ “ওয়ার্ল্ড সিন্ধী ইনস্টিটিউটের” ছত্রছায়ায় সংগঠিত তাঁদের এক প্রতিনিধিদলের গত ২৩শে মার্চ ২০০১ খ্রি. নূতন দিল্লীতে প্রদত্ত বিবৃতিও প্রণিধানযোগ্য। তাঁদের “সিন্ধী অধিকারের ঘোষণাপত্র” অনুসারে ১৯৪৭ খ্রি. ভারত- বিভাগ “সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার পক্ষে এক গভীর বিয়োগান্তক ঘটনা” এবং সিন্ধীদের পক্ষে এক বিপুল দুর্যোগ। বিগত পাঁচ দশক কাল যাবত যে “জাতিভিত্তিক নর- উৎসাদন” (ethnic cleansing) ঘটেছে তার পরিণামে সিন্ধীদের এক তৃতীয়াংশ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। ওয়াশিংটনের সিন্ধীদের ঐ প্রতিষ্ঠানের নির্দেশক মুনাওয়ার, লাঘারি সাংবাদিকদের জানান যে সিন্ধী হলেও বেনজির ভুট্টোর প্রতি তাঁদের কোনো ভরসা নেই। তাঁরা বরং চান যে চীনের ক্ষেত্রে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র যেমন ভূমিকা নিয়েছে ভারতও তেমনি পাকিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সিন্ধীদের প্রতি পীড়নের বিরুদ্ধে মুখর হোক। (Times of India; নূতন দিল্লী, ২৬শে মার্চ, ২০০১ খ্রি.)। তাঁদের অবশ্য তখন জানার কথা নয় যে শেষ বার মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রক্রিয়ায় ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী বেনজিরকে ২০০৭ খ্রি. ডিসেম্বর মাসে তাঁর স্বদেশবাসীরাই নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করবেন। হত্যার রহস্য উন্মোচনের জন্য পাক সরকারের অনুরোধে নিযুক্ত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের তিন সদস্যের প্যানেলের অভিমত হল এই যে অন্যান্য কারণ সহ ক্ষমতা পেলে (যাঁর সম্ভাবনা তখন প্রবল) ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে এই উপমহাদেশে পাছে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন তাই ভারত-বিদ্বেষী পাকিস্তানের শাসক-সম্প্রদায় ও জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের নায়ক গাজী পাকিস্তান ভিত্তিক আল-কায়েদা ও তালিবানদের সুহৃদ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের যোগসাজশে ৫৪ বছর বয়সেই এক সম্ভাবনাপূর্ণ রাজনীতিবিদ্ বেনজিরকে প্রাণ দিতে হয়। (সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানের প্রধান দপ্তর থেকে প্রচারিত ১৬ই এপ্রিল, ২০১০ খ্রি. প্রতিবেদন)।
“পাখতুন কোয়া” (Pakhton Qwa) বা পাকিস্তানের পুস্তুভাষী নর-নারীদের জন্য এক স্বতন্ত্র বাসভূমি রূপী আবেগপূর্ণ সমস্যাটির কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। ১৯৯৮ খ্রি. শেষভাগে লেখকের সীমান্ত প্রদেশে কিছুদিন এক শুভেচ্ছাসফরের সদস্য হিসাবে পরিভ্রমণ করার সুযোগ ঘটে। সে সময়ে পেশেয়ারে তাঁদের সম্মানে আয়োজিত এক সভায় একাধিক পাঠান নেতা কর্তৃক কঠোর ভাষায় পাঞ্জাবীদের (শাসকগোষ্ঠী) বিরূপ সমালোচনা শোনারও অবকাশ মিলেছিল। বিদেশী, তায় ভারতবাসীদের সামনে এ জাতীয় স্বদেশীয় দূষণের মূল যে গভীরে তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়৷ এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পাঠান গায়কদল কর্তৃক “ওহ জামা ওয়তন” গাইবার সঙ্গে সঙ্গে পাঠান ভ্রাতৃমণ্ডলীর মধ্যে যে মানসিক আবেগের বিস্ফোরণ ঘটে এবং তাঁরা আসন ছেড়ে পরস্পরের হাত ধরে যে ভাবে সোল্লাসে নৃত্যরত হন তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পরে জেনেছিলাম যে গানটি নাকি “পাখতুন কোয়া”-এর জাতীয় সঙ্গীত। নানা উপজাতিতে বিভক্ত হলেও সীমান্ত প্রদেশের প্রায় তিন কোটি পাঠানদের মধ্যে পাখতুন অস্মিতা প্রবল এবং এর সন্তোষজনক সমাধান না হলে অনতিবিলম্বে জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের সামনে সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
সর্বশেষে উল্লেখ করলেও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য হল এক পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবির যিনি একদা ওদেশের শাসকগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য (পদস্থ সরকারী কর্মচারী এবং কিছু কাল লন্ডনে পাকিস্তানের হাই কমিশনার) ছিলেন। তাঁর বক্তব্য: “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ধিক্কারজনক মন্তব্য হল এই যে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে থাকা একটি সম্প্রদায়কে ধরে তাকে জবরদস্তি কয়েকটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথমে তাদের জন্য একটি দেশের সৃষ্টি করে পরে তাদের দ্বিধাবিভক্ত করা হয়েছে এবং অপরাপর অংশগুলিকে মাঝ আকাশে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। যেসব নর-নারী একদা সমগ্র উপমহাদেশের একই সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ও ইতিহাসের উত্তরাধিকারী ছিলেন, তাঁরা অতঃপর না এক জাতির (nation) অঙ্গ আর না একই সম্প্রদায় হিসাবে স্বীয় আত্মচেতনার অঙ্গীভূত হয়ে রইলেন। ভারতের মুসলমানদের পক্ষে পাকিস্তান দু-ধারা তলোয়ারের মত সর্বনাশা হল। প্রথমত সমগ্র সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁদের একাত্মতার চেতনা চলে গেল এবং ভারত-রাষ্ট্রে তাঁদের শক্তি ও তার সঙ্গে সঙ্গে নেতৃত্ব চলে গেল তাঁদের মধ্যবিত্তদের হাজারে হাজারে পাকিস্তানে চলে খাবার কারণে। দ্বিতীয়ত পাকিস্তানের সপক্ষে ভোট দিয়ে ভারতের ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য নিজ স্বদেশে তাঁদের চিরকালের জন্য ধিকৃত জীবন যাপন করতে হবে।” রফিক জ্যাকেরিয়া; The Men Who Divided India; পৃ. X।
৭. Plain Mr. Jinnah; রয়াল বুক কোম্পানী; করাচী (১৯৭৬ খ্রি.)।
৮. খলিদ হাসান (স:); Memories of Jinnah; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস; করাচী (১৯৯০ খ্রি.)।
৯. From Jinnah to Zia; ভ্যানগার্ড বুকস লিঃ; লাহোর (১৯৮০ খ্রি.) পুনর্মুদ্রিত সংস্করণের ভূমিকা থেকে।
১০. The Price of Partition; ভারতীয় বিদ্যাভবন; মুম্বাই (১৯৯৮ খ্রি.)।
১১. কুলদীপ নায়ার; Scoop; হারপার কলিন্স, নূতন দিল্লী, তৃতীয় সংস্করণ (২০০৭)। গ্রন্থের A Chance Encounter with Jinnah, ও The Fall out of Partition প্রবন্ধ দুটি থেকে উদ্ধৃতিগুলি’ নেওয়া হয়েছে।
১২. ডি.এন.শেঠ ও গুরুপ্রীত মহাজন (সঃ) Minority Identifies and the National State; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নূতন দিল্লী (১৯৯৯) গ্রন্থের পৃ. ৭৩-১১২ প্রকাশিত অনিল নেউরিয়ার Some Portrayals of Jinnah: A Critique প্রবন্ধ।
১৩. Jinnah-India, Partition, Independence; রূপা অ্যান্ড কোং; (দিল্লী) ২০০৯।
১৪. অরুণ শৌরী; We Must Have No Price And Everyone Must Know That We Have No Price; দিল্লী; ২০১০ খ্রি.
১৫. নরেন্দ্র সিংহ সরিলা; Shadow of Great Game: The Untold Story of Partition; নূতন দিল্লী; ২০০৫ খ্রি.
১৬. ২০শে আগস্ট; ২০০৯; পৃ. ৯।
১৭. Crime Against Humanity; পহেলা ডিসেম্বর, ২০০৯ খ্রি.।
১৮. Pathway to India’s Partition; মনোহর বুকস, নূতন দিল্লী (প্রথম খণ্ড ১৯৯০ খ্রি. দ্বিতীয় খণ্ড ২০০০ খ্রি. ও তৃতীয় খণ্ড ২০০৯ খ্রি.)
১৯. বি.আর.নন্দ; Road To Pakistan: The Life and Times of Mohammad Ali Jinnah Routledge; নূতন দিল্লী, ২০১০ খ্রি.।

পৃষ্ঠা: ৩৪২

———X———

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!