You dont have javascript enabled! Please enable it! জিন্না: পাকিস্তান নতুন ভাবনা | শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (Part 01) - সংগ্রামের নোটবুক

জিন্না: পাকিস্তান
নতুন ভাবনা
শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

ভূমিকা

গুজরাতী প্রথা অনুসারে পুত্রের নামের সঙ্গে পিতার নাম যুক্ত করে পরিশেষে যোগ করতে হয় বংশের পদবী। যেমন গান্ধী বংশের করমচাঁদের পুত্র মোহনদাস। যেমন তাতা বংশের নাসরবানজীর পুত্র জামশেটজী। তেমনি খোজানী বংশের ঝীণাভাইয়ের পুত্র মহম্মদালী। বড়ো হয়ে মহম্মদালী তাঁর নামটাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। মহম্মদ আলী। তাঁর পিতার নামকেও দুই ভাগে বিভক্ত করে প্রথম ভাগটাকেই করেন তাঁর পদবী। দ্বিতীয় ভাগটা বর্জন করেন। বাদ যায় বংশপদবীও। বিলিতী কায়দায় বানান করতে গিয়ে ঝীণা হয়ে যায় এমন একটি শব্দ যার উচ্চারণ সাহেবদের মুখে জিনা, ভারতীয়দের মুখে জিন্না, আরবদের মুখে জিন্নাহ্। যেমন আল্লাহ্। ইংরেজদের বানানে মহারাজা শব্দটির অন্তেও এইচ জুড়ে দেওয়া হতো। বার্মার অন্তেও। হাওড়ার অন্তে এখনো হয়।
জিন্না সাহেব যে সম্প্রদায়ের মুসলমান তার নাম ইসমাইলিয়া খোজা। একবার এক আইনের কেতাবে দেখেছিলুম, “The term ‘Hindu’ includes Ismailia Khoja.” আইনটা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত। তাই যদি হয় তবে জিন্না সাহেব উত্তরাধিকারসূত্রে হিন্দু। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। ধর্ম যত সহজে বদলানো যায় উত্তরাধিকার তত সহজে নয়।
গুজরাতী হিন্দুদের অনেকের নাম ঝীণা। তার মানে ‘ছোট’। কে জানে ‘ছোট’ থেকে বড়ো হওয়ার আকাঙ্ক্ষা মহম্মদ আলীর অন্তরে কাজ করছিল কিনা। নিজের প্রতিভার জোরে তিনি বড়ো ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। বড়ো রাজনীতিক হওয়াও স্বাভাবিক। হলেন শেষ পর্যন্ত একটি নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর জেনারেল। বেঁচে থাকলে প্রেসিডেন্টও হতে পারতেন। তাঁর মতে পাকিস্তানই নাকি বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কথা—এটা তাঁর একার সৃষ্টি। গান্ধী না থাকলেও ভারত একদিন না একদিন স্বাধীন হতো। কিন্তু জিন্না না থাকলে পাকিস্তান কি আদৌ সম্ভব হতো? ভারতকে স্বাধীন করার দাবীদার আরো একজন কি দু’জনের নাম শোনা যায়, কিন্তু পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র করার দাবীদার আর একজনও নেই। লা শরিক জিন্নাহ্। যেমন লা শরিক আল্লাহ্।
এমন এক ইতিহাস-নির্মাতার ইতিকথা লিখেছেন শ্রীশৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি স্বয়ং একজন গান্ধীপন্থী। গান্ধীপন্থীর পক্ষে জিন্না সাহেবকে বোঝাও সহজ নয়। তবে গান্ধীপন্থীদের আদর্শ হলো খ্রীষ্টপন্থীদের মতো শত্রুকেও ভালোবাসা, অপরাধী হয়ে থাকলে ক্ষমা করা, বিদ্বেষ পুষে না রাখা, মন্দের ভিতর থেকে ভালো আসে এই তত্ত্বে বিশ্বাস বজায় রাখা। চল্লিশ বছর পরে জিন্না সম্বন্ধে সহৃদয়ভাবে বিচার করার সময় এসেছে। সে ভার নিয়েছেন গ্রন্থকার।
ঐতিহাসিক পুরুষরা ইতিহাসের হাতের যন্ত্র হিসাবেই কাজ করে যান। কখনো জ্ঞাতসারে, কখনো অজ্ঞাতসারে। তাঁরা যে কোথা থেকে শুরু করে কোথায় গিয়ে শেষ করবেন তা তাঁরাও আগে থেকে জানেন না। দাবাখেলায় একপক্ষের চাল নির্ভর করে অপরপক্ষের চালের উপরে। ব্রিটিশ শাসকরা একটা চাল দিলে গান্ধীজী দিতেন তার পাল্টা চাল। আর গান্ধীজী একটা চাল দিলে জিন্না সাহেব দিতেন তার পাল্টা চাল। মনে হতো জিন্না সাহেব যেন ব্রিটিশ পক্ষের ডামি। সেটা কিন্তু ঠিক নয়। তিনিও ছিলেন স্বাধীন খেলোয়াড়। ব্রিটিশ শাসকরা তাঁকে পদ দিয়ে বা উপাধি দিয়ে কিনে নিতে পারেননি। তিনি ছিলেন আনপারচেজেবল। ইনকরাপটিবল। অবিকল গান্ধীজীর মতো। তবে শেষের দিকে তাঁর ধারণা জন্মেছিল তাস খেলায় ব্রিটিশ পক্ষই তাঁর ডামি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলী, ক্যাবিনেট মিশনের নেতা পেথিক-লরেন্স, বড়লাট ওয়েভেল বা মাউন্টব্যাটেন তাঁর খেলাই খেলবেন, তাঁদের নিজেদের খেলা নয়। দারুণ, নিদারুণ ভ্রম। ইংরেজ আর কারো খেলা খেলে না। সে ফরাসীর কাঁধে বন্দুক রেখে জার্মানের সঙ্গে লড়ে। মুসলমানের কাঁধে বন্দুক রেখে হিন্দুর সঙ্গে লড়ে, মুসলিম লীগের কাঁধে বন্দুক রেখে কংগ্রেসের সঙ্গে লড়ে। মিটমাটের সময় যখন আসে তখন প্রতিপক্ষের সঙ্গে করমর্দন করে। মিত্রকে তেমন পাত্তা দেয় না। তবে একেবারে পথে বসায় না। জিন্না সাহেব পেলেন ঠিক ততখানি, যতখানি ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধি মাউন্টব্যাটেন মানে মানে সাম্রাজ্য গুটিয়ে নেবার সময় কংগ্রেসের সম্মতি নিয়ে দিতে সক্ষম।
গান্ধীজীকে দিয়ে মানিয়ে নিতে পারতেন না, সেটা তিনি জানতেন। কিন্তু গান্ধীজী যদি তাঁর প্রস্তাবে বাধা দিতেন তা হলে তিনি ১৯৪৮ সালের জুন মাসের পূর্বেই প্রদেশওয়ারি ভাবে ক্ষমতা বণ্টন করে দিয়ে যেতেন। ফলে কংগ্রেস পেত আটটি প্রদেশ, সেই আটটিকে নিয়ে কেন্দ্র গঠন করতে পারত, কিন্তু আসামে সৈন্য পাঠাতে পারত না, মাঝখানে পড়ত মুসলিমশাসিত বঙ্গ, উত্তরপশ্চিম সীমান্তপ্রদেশে সৈন্য পাঠাতে পারত না, মাঝখানে পড়ত মুসলিমশাসিত পাঞ্জাব, তিনটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত পাকিস্তান আরো দুটিকেও কুক্ষিগত করত। গান্ধীজী কি আরো এক দফা সত্যাগ্রহের সাহায্যে ভারতের অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারতেন? না, তার জন্যে আবশ্যক হতো মাউন্টব্যাটেনের মতি পরিবর্তন নয়, মুসলিম লীগের নীতি পরিবর্তন। তার জন্যে জিন্না সাহেবের সঙ্গে একমত হয়ে প্রত্যেকটি প্রদেশে তথা কেন্দ্রে কংগ্রেস লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন। সেটার জন্যে কংগ্রেসকে তথা হিন্দু সম্প্রদায়কে এত বেশী ত্যাগ স্বীকার করতে হতো যে কংগ্রেস তো নারাজ হতোই, হিন্দু জনমতও বিদ্রোহী হতো। গান্ধীজী আপনাকে শূন্যে পরিণত করেন। কিন্তু জাত বেনিয়া তিনি, যাচাই করে দেখেন ভারতের মুক্তি নামক মুক্তাটা সাচ্চা না ঝুটা। সেটা সাচ্চাই বটে। মাউন্টব্যাটেন ঠকাননি। ভারত সত্যিই মুক্ত, যদিও বিভক্ত।
জিন্না সাহেব যেটা পান সেটাও সাচ্চা। যা মোগল আমলে সম্ভব হয়নি, যা ব্রিটিশ আমলে সম্ভব হতো না, তাই সম্ভব হলো জিন্না-নেতৃত্বে। এই উপমহাদেশের এক-চতুর্থাংশ হলো ‘দারুল ইসলাম’। বাকীটা থেকে গেল ‘দারুল হরব’। যেমন বরাবর ছিল। মুসলিম দুনিয়ার দিক থেকে কত বড়ো জয়! কৃতজ্ঞ মুসলিম নেশন জিন্নাকে বাদশাহ বানাতে পারত। কিন্তু ন্যাশনালিস্ট হিসাবে তিনি অস্থিরমতি হলেও ডেমোক্রাট হিসাবে স্থিরমতি ছিলেন।
তার মানে তিনি ব্যালটে বিশ্বাস করতেন, বুলেটে নয়। নিতান্ত মরীয়া না হলে তিনি বলতেন না যে তাঁর হাতেও একটা পিস্তল আছে। সেই পিস্তলের নাম ডাইরেক্ট অ্যাকশন। রাশ টানার সাধ্য তাঁর ছিল না, থাকলে মহামারী ঘটে যেত না। খতিয়ে দেখলে মুসলমানই মারা পড়ল বেশী। ভারতবর্ষকে দু ভাগে বিভক্ত করার ফলে ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজও দু’ভাগে বিভক্ত হলো। চার কোটি মুসলমানকে বিপদে ফেলে তিনি পাকিস্তানে নিষ্ক্রমণ করলেন। কংগ্রস যদি পাকিস্তানের অনুকরণে হিন্দুরাষ্ট্র পত্তন করত মুসলমানদের দশা হতো যাকে বলে ‘না ঘরকা না ঘাটকা’। যেমন দশা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর পাঞ্জাবী মুসলমান ফৌজের দ্বারা পরিত্যক্ত বিহারী মুসলমানদের। বাংলাদেশ তাদের রাখতে চায় না, পাকিস্তান তাদের নিতে চায় না। কংগ্রেস স্বাধীন ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করে তাদের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকের অধিকার দিয়েছে। জিন্না সাহেবের ইচ্ছা থাকলেও পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখদের তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকত্ব দিয়ে যেতে পারেন নি। হয়তো দিতেন, যদি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতেন। কিন্তু যাঁদের মদত নিয়ে তিনি তখতে বসেছিলেন সেই মোল্লারাই তাঁকে শাসিয়ে রেখেছিল। আর তাঁর আসল ক্ষমতা চলে গেছল তাঁর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের হাতে।
পাকিস্তানী পার্লামেন্টের কাছে কার্যত প্রধানমন্ত্রীই দায়ী। গভর্নর জেনারেল জিন্না। বিদ্যমান ভারত শাসন আইন অনুসারে তাঁর পাকিস্তানী পার্লামেন্টের কাছে তিনি দায়ী নন। তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্রিটিশ সরকারের সেক্রেটারি অভ্ স্টেট ফর ইন্ডিয়া। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের পর সেই কর্তৃপক্ষই বা কোথায়? গভর্নর জেনারেল অভ্ পাকিস্তান কারো কাছে দায়ী নন। অথচ নামেই সর্বক্ষমতাবান।
জিন্নাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোয়েটার কাছে এক স্বাস্থ্যকর স্থানে চিকিৎসকের হেফাজতে। সেখানে তিনি তাঁর চিকিৎসককে বলেন পার্টিশন হচ্ছে তাঁর জীবনের বৃহত্তম ভুল। সেখান থেকে যখন তাঁকে করাচীতে ফিরিয়ে আনা হয় তখন তাঁকে অভ্যর্থনা করতে কেউ বিমানবন্দরে আসেন নি। মাটিতে শুইয়ে রাখা হয় তাঁকে। তাঁর দেহের উপর পিঁপড়েরা ঘুরে বেড়ায়। লক্ষ করেন এক বাঙালী মুসলমান বিমানবন্দর কর্মী। মিনিট দশেক পরে তাঁর মন্ত্রীরা আসেন ও তাঁকে সরানো হয়। করাচীতে জন্ম, করাচীতেই মৃত্যু। কিন্তু ভারতীয় হিসেবে নয়, পাকিস্তানী হিসাবে।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্বে তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম সভ্য, দাদাভাই নওরোজীর রাজনৈতিক শিষ্য। ভারতীয় জাতির জাতীয় স্বার্থের প্রহরী। মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা তিনি সমর্থন করতেন না, তাতে জাতীয় সংহতি ক্ষুণ্ণ হয়। মুসলিম লীগের গোড়ার দিকে তিনি তার সভ্য হননি। মুসলিম নির্বাচকমণ্ডলী থেকে নির্বাচিত হয়ে কেন্দ্রীয় আইন সভার সদস্য হওয়ার পর মুসলিম লীগের সভ্য হন। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি কংগ্রেস ও লীগ দুই প্রতিষ্ঠানের সভ্য হন কী মনে করে, তখন তিনি উত্তর দেন, “আমি ভারতের জাতীয় স্বার্থের খাতিরে কংগ্রেসের সভ্য, আর মুসলিম সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক স্বার্থের খাতিরে মুসলিম লীগের সভ্য।” তখনকার দিনে মালবীয়জী প্রমুখ কংগ্রেস নেতারা হিন্দু মহাসভাতেও ছিলেন। বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে ক্ষুদ্রতর স্বার্থের বিরোধ ছিল না। বৃহত্তর স্বার্থ ভারতের স্বরাজ বা হোম রুল। তার প্রথম কিস্তি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। তাতে হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ ক্ষুদ্রতর।
তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্বে তিনি কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে সেতুবন্ধন করেন, লোকমান্য টিলকের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তিনি লখনউতে ১৯১৬ সালে কংগ্রেস লীগ চুক্তি সম্পাদনে অগ্রণী হন। তখন তাঁর উপর আস্থা জাগে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের। সরোজিনী নায়ডু বলেন, তিনি হিন্দু মুসলিম ঐক্যের রাজদূত। কংগ্রেসের চেয়ে আরো এক পা এগিয়ে তিনি হোম রুল লীগের সভাপতি হন, যার জন্যে অ্যানী বেসান্ট অন্তরীণ হন। জিন্নার প্রতিপত্তি তখন তুঙ্গে। মডারেটদের চেয়ে উচ্চে। এই পর্বে ছেদ পড়ে কংগ্রেস যখন গান্ধিজীর নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগ নীতি গ্রহণ করে। জিন্নার নীতি ননকোঅপারেশন নয়, রেসিপ্রোকাল কোঅপারেশন। ননভায়োলেন্ট নয়, কনস্টিটিউশনাল। গান্ধী-নেতৃত্ব তিনি গ্রহণ করতে পারেন না নীতিগত পার্থক্যের দরুন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। গান্ধীজী যখন গণসত্যাগ্রহ আরম্ভ করতে উদ্যত তখন তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বারদোলি গিয়ে রাত্রিবেলা গান্ধীজীর শিবিরে উপস্থিত হন। বলেন গভর্নমেন্ট সৈন্য আনিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করছে, আন্দোলন শুরু হলেই গুলী চলবে। সুতরাং আন্দোলনে ঝাঁপ দেবার আগে বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাই শ্রেয়। তাঁকে নিয়ে জিন্না ও মালবীয় লর্ড রেডিঙের সঙ্গে বসবেন। যদি তিনি রাজী হন। গান্ধীজী রাজী হন না। কিন্তু গণসত্যাগ্রহের প্রোগ্রাম পরিত্যাগ করেন। যেহেতু যুক্তপ্রদেশে চৌরী চৌরা থানা আক্রমণ করে ক্রুদ্ধ জনতা পুলিশকে পুড়িয়ে মেরেছে সেহেতু দেশ গণসত্যাগ্রহের জন্যে প্রস্তুত নয়। সিদ্ধান্তটা জিন্নার পরামর্শে কিনা অনুমান সাপেক্ষ।
তৃতীয় পর্বে জিন্না কংগ্রেসের সভ্য নন, অথচ মুসলিম লীগের সভ্য থেকেও তার মডারেটদের একজন নন। তিনি তাঁর স্বকীয় ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি গঠন করেন কেন্দ্রীয় আইনসভায়। সভ্যদের কেউ বা হিন্দু, কেউ বা পার্শী। সবাই যে মুসলমান তা নয়। ইন্ডিপেন্ডেন্ট বলতে বোঝায় সরকারের থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট তো বটেই, কংগ্রেসের থেকেও ইন্ডিপেন্ডেন্ট। স্বরাজ পার্টির সভ্যরা ছিলেন কংগ্রেসের লোক। কংগ্রেস কেবল বিরোধিতাই করে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি কখনো কংগ্রেসের পক্ষে ও সরকারের বিপক্ষে ভোট দেয়, কখনো সরকারের পক্ষে ও কংগ্রেসের বিপক্ষে। তৃতীয় পর্বে জিন্না একবার লন্ডনের এক ডিনারে পাকিস্তানের প্রবক্তা চৌধুরী রহমত আলীর দ্বারা নিমন্ত্রিত হন। তাঁকে অনুরোধ করা হয় পাকিস্তানের উদ্যোক্তা হতে। জিন্না বলেন ওটা একটা অবাস্তব স্বপ্ন। তিনি তার পক্ষপাতী নন। ঘটনাটা ১৯৩৪ সালের।
চতুর্থ পর্বে তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় আইন সভার মুসলিম লীগ পার্টি গঠন করেন। বাইরেও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন। ভারতের জাতীয় স্বার্থের চেয়ে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থই ক্রমে ক্রমে বৃহত্তর হতে থাকে। মুসলিম স্বার্থের একমাত্র প্রতিনিধি বলে দাবী করে মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ একমাত্র মুসলিম প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠান হলে কংগ্রেসকে হতে হয় অমুসলিম বা হিন্দু প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠান। কংগ্রেস লীগ চুক্তি যদি নতুন করে সম্পাদন করতে হয় তবে কংগ্রেসকে স্বীকার করতে হয় নিছক সাম্প্রদায়িক ভূমিকা। তার কাছে সাম্প্রদায়িক স্বার্থই হয় বৃহত্তর। কংগ্রেস কেমন করে রাজী হয়? তাই কংগ্রেস লীগ চুক্তি সম্পন্ন হয় না। কংগ্রেস একাই অধিকাংশ প্রদেশে সরকার গঠন করে। লীগকে অংশ দেয় না। তাছাড়া লীগের পলিসিও কংগ্রেসের সঙ্গে মেলে না। কংগ্রেস সব সময় ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে অসহযোগী, লীগ সব সময় নয়। কখনো সহযোগী, কখনো অসহযোগী।
জিন্না তখন থেকেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে কংগ্রেসকে কিছুতেই কেন্দ্রীয় স্তরে একক সরকার গঠন করতে দেবেন না। করতে হবে লীগের সহযোগে ও লীগের শর্তে। নতুবা তিনি দাবী করবেন পাকিস্তান ও তার জন্যে লড়বেন কংগ্রেসের সঙ্গে। ইংরেজ যদি কংগ্রেসের পক্ষ নেয় তবে ইংরেজের সঙ্গেও। রক্তপাত হয় হবে। তার ভয়ে তিনি নিরস্ত হবেন না। কাজটা কি সংবিধানসম্মত হবে? না হলেও তিনি পেছোবেন না। তবে তার আগে পাকিস্তানের ইস্যুতেও নির্বাচনে লড়বেন অন্যান্য দলের মুসলমান প্রার্থীদের সঙ্গে। কংগ্রেসপন্থী মুসলমানদের সঙ্গে তো আলবৎ। ওরা হিন্দুর দলে ভিড়েছে। কংগ্রেসের শো বয়।
ভারতের জাতীয় স্বার্থ? সেটার কি কোনো মানে হয়? ভারত একটা ভৌগোলিক অভিধা। সেখানে দুই নেশনের বাস। হিন্দু আর মুসলমান। মুসলিম নেশনের স্বার্থে চাই স্বতন্ত্র বাসভূমি। হিন্দুস্থানের বাইরে পাকিস্তান। দুই স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর মতো দুই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। পাকিস্তানের বৃহত্তর স্বার্থই মুসলিম লীগের ও তাঁর অন্বিষ্ট। তখনো তিনি জাতীয়তাবাদী, কিন্তু ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নন। তখন তিনি মুসলিম জাতীয়তাবাদী। যেসব মুসলমান ভারতীয় জাতীয়তাবাদী তারা মুসলিম স্বার্থবিরোধী। ধর্মে মুসলমান হওয়া যথেষ্ট নয়, হতে হবে মুসলিম লীগের সভ্য। তাও যথেষ্ট নয়, হতে হবে দুই নেশন তত্ত্বে বিশ্বাসী। বিশ্বাস করতে হবে যে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায় নয়, দুই নেশন। যেমন ইংরেজ ও ফরাসী। ফরাসীদের দেশে ইংরেজরা বিদেশী, ইংরেজদের দেশে ফরাসীরা বিদেশী। সেই যুক্তি অনুসারে পাকিস্তানে হিন্দুরা বিদেশী, হিন্দুস্থানে মুসলমানরা বিদেশী। বিদেশীদের পাইকারী হারে বিনিময় করতে হবে। যেমন গ্রীস থেকে তুরস্কে, তুরস্ক থেকে গ্রীসে। হিন্দু মুসলিম সমস্যার সমাধান তা হলে পরস্পরের মূলোচ্ছেদ করা।
জিন্না যে প্রত্যয়ে এসে পৌঁছেছিলেন সেটা প্রত্যক্ষ অসত্য। অসত্যের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল হিংসা। সাত-আটশো বছর একসঙ্গে বসবাসের ইতিহাসে এমনতর মহামারীর নজীর একটাও নেই। যত দোষ নন্দ ঘোষ ইংরেজও এর জন্যে দায়ী নয়। ইতিহাসের কাঠগড়ায় জিন্নাকেই জবাবদিহি করতে হবে।
তবে তাঁর দিক থেকেও বলবার আছে যুক্তিযুক্ত কিছু কথা। সরকার থাকলেই তার বিরোধীপক্ষ থাকে। সেই বিরোধী পক্ষের অভাব পূরণের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছিল কংগ্রেসের। অগ্রণী হয়েছিলেন অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম প্রমুখ কয়েকজন ইউরোপীয় তথা ভারতীয় নেতা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হিন্দু মুসলমান পার্শী খ্রীষ্টান। পার্লামেন্টারি কেতা অনুসারে বিরোধী পক্ষই বিকল্প সরকার গঠনের অধিকারী। বিকল্প সরকার গঠনের সুযোগ পেলে কংগ্রেসই সরকারের মসনদে বসবে। সেই সুযোগটা জোটে ১৯৩৭ সালে ছয়টি প্রদেশে। পরে আরো দুটি প্রদেশে। তখন কংগ্রেস সরকারেরও বিরোধী পক্ষ দেখা দেয়। প্রধানত মুসলিম লীগ। পার্লামেন্টারি রীতি অনুসারে কংগ্রেস সরকারের বিকল্প সরকার গঠনের অধিকারী মুসলিম লীগ। কিন্তু মুসলিম লীগের যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই সেখানে সে বিকল্প সরকার গঠন করলে সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন হবে কী করে? কংগ্রেস যখন মসনদ ছেড়ে জেলে চলে যায় তখন মুসলিম লীগকে সরকার গঠন করতে ডাকা হয় না। সরকারী কর্মচারীরাই মন্ত্রীর পরিবর্তে পরামর্শদাতা হন। সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় মুসলিম লীগ। প্রাদেশিক স্তরেই যদি এ রকম বঞ্চনা ঘটে তবে কেন্দ্রীয় স্তরেও তো সেই রকম ঘটবে। ইংরেজ সরে গেলে দিল্লীর সিংহাসনে বসবে কংগ্রেস, যেহেতু তারই পার্লামেন্টারি মেজরিটি। কংগ্রেস সরে গেলে লীগকে কি দিল্লীর সিংহাসনে বসতে দেওয়া হবে? সেটা সম্ভব নয়, কারণ তার পার্লামেন্টারি মেজরিটি থাকবে না, থাকা অসম্ভব। তা বলে কি সে চিরকাল বিরোধী পক্ষে থেকে যাবে? আর কোনো বিকল্প কি নেই? এর উত্তর, আছে, যদি একটি কেন্দ্র না হয়ে দুটি কেন্দ্র হয়। দুই কেন্দ্রের খাতিরে দুই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান। ইংরেজরাই সেটা সম্পন্ন করে যাক। অন্যথা গৃহযুদ্ধের দ্বারা সেটা রূপায়িত হবে। গৃহযুদ্ধে মুসলিম রেজিমেন্টগুলো যোগ দেবে। মুসলিম জনতাও। হিন্দুরা যেখানে সংখ্যালঘু ও মুসলমানরা সংখ্যাগুরু সেখানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হবে তলোয়ারের জোরে। তার চেয়ে ভালো হচ্ছে ভদ্রভাবে পাকিস্তান সৃষ্টি করতে দেওয়া। ব্রিটিশ মধ্যস্থতায়।
ব্রিটিশ মধ্যস্থতায় পাকিস্তান গান্ধীজীর মূলনীতিবিরুদ্ধ। তলোয়ারের জোরে পাকিস্তান, সেটাও তাই। কংগ্রেস ও লীগ একমত হয়ে যদি ভারত ভাগ করত তবে তিনি বাধা দিতেন না। সেটা কিন্তু ব্রিটিশ অপসরণের পরে। আগে নয়। জিন্নার জেদ কিন্তু পরে নয়, আগে। শেষ পর্যন্ত যেটা ঘটে সেটা আগেও নয়, পরেও নয়, একই কালে। ব্রিটিশ মধ্যস্থতায়। পনেরোই আগস্ট গান্ধীজী অনশন করেন। আর কংগ্রেস করে উৎসব। সম্ভবপর হিন্দু রাজত্বের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে লীগও করে ধুমধাম।
ব্রিটিশ রাজের একমাত্র উত্তরাধিকারী কংগ্রেস নয়, অন্যতর উত্তরাধিকারী মুসলিম লীগ, এটাই স্বীকার করে নিল উভয় পক্ষ। ক্ষমতা ভাগ করে নয়, ভূমি ভাগ করে। যে যার ভূমিতে স্বাধীন। এই মীমাংসাই চূড়ান্ত। গান্ধীজী একে রোধ করতে পারতেন। কিন্তু উভয়পক্ষের গ্রহণযোগ্য অন্য কোনো মীমাংসা নির্দেশ করতে পারতেন না। দুর্বলতর কেন্দ্র আর প্রবলতর প্রদেশ কোনো কাজের নয়। কেন্দ্রেও কংগ্রেস লীগের দ্বৈরাজ্য। দ্বৈরাজ্য পরিণত হতো দুই রাজ্যে। গান্ধীজী তাই নীরবে সায় দেন। মৌন সম্মতি। কিন্তু বিয়োগান্ত নাটকের তো সেইখানেই যবনিকাপতন নয়। ট্র্যাজেডির অন্তিম দৃশ্য মহাগুরুনিপাত। দুই রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু দুই সম্প্রদায়ের দুঃসহ বেদনাই তাঁকে কাতর করেছিল। ভিতরে ভিতরে তিনি মৃত্যুর জন্যে আকুল হয়েছিলেন।
আর জিন্না? আমার তো মনে হয় তিনিও মৃত্যুর জন্যে অধীর হয়েছিলেন! মৃত্যুর শয্যায় কে একজন স্তাবক তাঁকে স্তোক দেন, “কায়দে আজম, আপনি অনেক দিন বাঁচবেন।” তিনি উষ্মার সুরে বলেন, “না।” তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে তাঁকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তিনি ব্যবহারকর্তা নন। অত্যন্ত অহঙ্কারী পুরুষ, অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত হতেন তিনি! তাঁর নেতৃত্বের ভূমিকা নিঃশেষ। আয়ুও নিঃশেষ।
পাকিস্তানে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। খেলায় বাজী ধরে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা কংগ্রেসেরই কৌশলে। কংগ্রেস চেয়েছিল পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গ। নইলে দিল্লী নিরাপদ হতো না, কলকাতা লাভ করা যেত না। কংগ্রেস চেয়েছিল দিল্লীর একাধিপত্য। সংবিধান সভায় স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতি তথা ওয়েজে প্রথা বিলোপ। সরকারী চাকরিতে স্বতন্ত্র কোটা তথা ওয়েটেজ বর্জন। মুসলিম লীগকে দেশের ও প্রদেশের একাংশ ছেড়ে না দিলে তো লীগ এসব ছেড়ে দিত না। ইংরেজ ভাগ করে দিয়ে গেল এটা পূর্ণ সত্য নয়। কংগ্রেস ভাগ করিয়ে নিল এটাও অনেকটা সত্য। কংগ্রেস নেতারাই গান্ধীজীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাধাদানে নিবৃত্ত করেন। রাজাগোপালাচারী, বল্লভভাই, জবাহরলাল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, কৃপালানী। আজাদ বাদে। তিনিই এ কাব্যের উপেক্ষিত। খান্ আবদুল গফফর খান্ তো বিড়ম্বিত। আমরা যেন জিন্নাকেই পুরোপুরি দায়ী না করি। ইংরেজকেও না।
গান্ধীজীর দৃঢ়বিশ্বাস ছিল ইংরেজ থাকতে হিন্দু মুসলিম সমস্যা মিটবে না, ইংরেজ চলে গেলেই মিটবে। এটাও পূর্ণ সত্য নয়। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব মোগল ও মারাঠার মধ্যেও ছিল। বিজাপুর ও গোলকোণ্ডা ছিল শিয়া রাজ্য, মোগল সম্রাটরা সুন্নী। বিজাপুর ও গোলকোণ্ডা সরাসরি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখত, দিল্লীর আধিপত্য মানত না। ওদের পদানত না করে আওরংজেবের স্বস্তি ছিল না। একচ্ছত্র হতে কেউ পারেননি, অশোকও না, আকবরও না, আওরংজেবও না। এমন যে দেশ তাকে এক শাসনাধীন করা ভারতীয়দের সাধ্য নয় বলেই ব্রিটিশ শাসন কায়েম হয়েছিল। ব্রিটিশ অপসারণের পর আবার সাধ্যাতীত হতো। এটাই আমাদের ইতিহাসের লিখন। মোগল ও মারাঠার স্থান নেয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ। ইংরেজ গেলে ওরা লড়তে লড়তে দুর্বল হতো, তখন তৃতীয় কোনো এক শক্তি গজ-কচ্ছপের যুদ্ধ থামিয়ে নিজে গরুড় হতো। মুসলমানরা সবাই স্বেচ্ছায় কংগ্রেসে যোগ দেবে এটা গান্ধীজীর মোহ। তেমনি জিন্না সাহেবের মোহ মুসলমানরা সবাই স্বেচ্ছায় মুসলিম লীগে যোগ দেবে। কংগ্রেসই হচ্ছে ভারতবর্ষ এটা সত্য নয়। তেমনি লীগই হচ্ছে মুসলিম ভারত এটাও নয় সত্য।
হিন্দু হিন্দুই থাকবে, মুসলমান মুসলমানই থাকবে, দুই জুড়ে গিয়ে এক ভারতীয় হবে এ তত্ত্ব কার্যত পরাহত হয়েছে। হিন্দুকে সেকুলার হতে হবে, মুসলমানকে সেকুলার হতে হবে, সেকুলারের সঙ্গে সেকুলার মিলে এক হবে, এর জন্যে যদি দু’তিন শতক সময় লাগে তো সেটাও এমন কিছু বেশী সময় নয় আমাদের পাঁচ হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাসে। ব্যক্তিগত জীবনে যে যা খুশি হোক, কিন্তু সমষ্টিগত জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতাই শ্রেয়। জিন্নাও এটা জানতেন, কিন্তু তাঁর দলবলের হিন্দু ভীতি ও ইংরেজ প্রীতি তাঁকে মুখ্য স্রোত থেকে পৃথক স্রোতে চালিত করে। দেশভাগের পর চেতনা হয়, কিন্তু সেই পৃথক স্রোতের শক্তি তাঁর ব্যক্তিগত শক্তির চেয়ে প্রবল। গান্ধীজীর কাছে যিনি হার মানলেন না, তিনি মোল্লাদের কাছে মানলেন। বেঁচে থাকলে মিলিটারির কাছেও মানতেন। পাকিস্তান পড়ে মোল্লা মিলিটারির যৌথ কবলে। পূর্ব পাকিস্তান মুক্তি পায়। কিন্তু পরে তারও একই পরিণতি। মুক্তিদাতা মুজিব নিহত।
ভারতীয় মুসলমানদের শিকড় যে ভারতে, পাকিস্তানে নয়, আরবে নয়, ইরানে নয়, মধ্য এশিয়ায় নয় এটা উপলব্ধি করতেও আরো সময় লাগবে। আর হিন্দুদেরও হৃদয়ঙ্গম করতে হবে যে ভারত আর হিন্দু একার্থক নয়, ভারত হিন্দুর চেয়ে বড়ো, হিন্দুর চেয়ে পুরাতন, আর্যের চেয়েও প্রাচীন, বেদের চেয়েও আগেকার। অগ্রাধিকার যদি কারো থকে তবে তা আদিবাসীদের। তারাই এদেশের রেড ইন্ডিয়ান। তারাই আদি ভারতীয় হিন্দু নয়। সবাইকে হিন্দু বানাবার উদগ্র বাসনা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নয়। জিন্না প্রমুখ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের আত্মীয় না করে পর করে দেয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের হিন্দু পুনরুজ্জীবনকামী শাখা। প্যান-ইসলামিজমের মতো প্যান-হিন্দুইজম্। জিন্নার কংগ্রেস ত্যাগের পশ্চাতে সেটাও কাজ করছিল। ভারতীয় হতে হলে হিন্দু হতে হবে এমনতর দাবী কেউ করেনি, কিন্তু “বন্দে মাতরম্” গাইতে হবে, অন্তত গানের সময় উঠে দাঁড়াতে হবে, এটাও ভারতীয়তার নামে হিন্দুত্ব চাপানোর দাবী। অধিকাংশ বাঙালীর বাসভূমি আজ যার নাম বাংলাদেশ, সে দেশে ‘বন্দেমাতরম্’ কেউ গায় না। প্রায় দশ কোটি বাঙালী তাকে অস্বীকার করেছে।
শ্রীশৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্না সাহেবের রাজনৈতিক বিবর্তনের একটি ধারাবাহিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। রোম যেমন একদিনে নির্মিত হয়নি পাকিস্তানও তেমনি একদিনে সংস্থাপিত হয়নি। তার শিলান্যাস হয় গৃহপ্রবেশের চল্লিশ বছর পূর্বে। মুসলিম দরবারীরা যখন বড়লাটের সকাশে গিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতির আর্জি পেশ করেন জিন্না তখন তার বিরোধী ছিলেন। অথচ সেদিনকার সেই জিন্নাই বিশ বছর বাদে কট্টর স্বতন্ত্র নির্বাচনবাদী। সার আলী ইমাম ইতিমধ্যেই অনুতপ্ত হয়ে বলেছেন, “এই হতভাগা হাত দিয়ে আমি সেই কাগজে সই করেছিলুম।” জিন্নার মনেও দ্বিধা ছিল। তিনি বার বার প্রস্তাব করেছেন যে তিনি যৌথ নির্বাচনে রাজী হবেন, যদি কেন্দ্রীয় আইনসভায় সংখ্যালঘু মুসলমানদের আরো ওয়েটেজ দেওয়া হয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওয়েটেজ লোপ করা হয়। হিন্দুরা রাজী হবে কেন? হিন্দুদের খরচে কংগ্রেসই বা রাজী হবে কী করে? জিন্না নিজেই ১৯১৬ সালে যে চুক্তি সম্পাদনে সাহায্য করেছিলেন এটা সেই চুক্তির খেলাপ। তবে এর একটা ভালো দিক ছিল। যৌথ নির্বাচন প্রবর্তিত হলে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পর নির্ভর হতো। মুসলিম লীগ হয়তো ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে অবিভক্ত বঙ্গে জয়লাভ করত না। ফলে বঙ্গভঙ্গ হতো না। এটা সম্ভব হলো ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তাঁর রোয়েদাদে স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতি বহাল রেখে বাঙালী হিন্দুদের ওয়েটেজ রদ করায়। শুধু তাই নয়, তার আসনসংখ্যা কমিয়ে দেওয়ায়। বাঙালী হিন্দুরা ওয়েটেজও হারাল, যৌথ নির্বাচনও পেল না।
পার্টিশনের পূর্বাহ্নে বঙ্গকে অবিভক্ত রেখে ভারতের তথা পাকিস্তানের বাইরে রাখার একটা প্রস্তাবও উঠেছিল। হিন্দুরা মুসলিম মেজরিটি মেনে নিত, ওয়েটেজ চাইত না, যদি লীগপন্থী মুসলমানরা যৌথ নির্বাচনে রাজী হতো। তারা নারাজ, তাই কথাবার্তা ভেস্তে যায়। জিন্না স্বতন্ত্র বঙ্গে রাজী ছিলেন, কিন্তু স্বতন্ত্র নির্বাচন ছাড়তে নারাজ। তা হলে কি স্বতন্ত্র নির্বাচন থেকেই স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের উদ্ভব? বঙ্গভঙ্গ থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন, স্বতন্ত্র নির্বাচন থেকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। আবার বঙ্গভঙ্গ। মাঝখানে চল্লিশ বছর।
শৈলেশকুমারের এই বাংলা গবেষণা গ্রন্থ আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যে একটি মূল্যবান সংযোজন। আমার নিজের পরিমিত জ্ঞান এই গ্রন্থ পাঠ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। কোনো কোনো বিষয়ে ভ্রান্তিরও অপনোদন হলো। আশা করি আমার মতো আরো অনেকের চোখ খুলে যাবে। আমরা সকলেই স্বখাত সলিলে মজ্জমান
অন্নদাশঙ্কর রায়

জিন্না: পাকিস্তান / নতুন ভাবনা

অবতরণিকা

গান্ধী আমার জীবনের ধ্রুবতারা। জিন্না রাজনীতির ক্ষেত্রে কেবল তাঁর প্রতিপক্ষই ছিলেন না, জীবনচর্যার দিক থেকেও এক ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। তবুও কেন যে আমি পাকিস্তানের জনক কায়েদ-এ-আজম মহম্মদ আলি জিন্নার সম্বন্ধে আলোচনা করতে মনস্থ করেছি, তার কৈফিয়ত দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
এর কারণ গান্ধীর শিক্ষাতেই নিহিত। তিনি ছিলেন সত্য-সাধক। সত্যের সন্ধানে নিজের জীবনের গোপনতম দুর্বলতাসমূহকেও লোকচক্ষুর সম্মুখে তুলে ধরতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। তাঁর আত্মকথার পাঠক সত্যের মহিমা সম্বন্ধে সচেতন। জননেতা- বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মী নিজের তাবৎ কার্যকলাপকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করেন। নচেৎ তাঁর জনপ্রিয়তা কুণ্ঠিত হবার আশঙ্কা। আর জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থনই তো রাজনৈতিক নেতার সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী আশ্রয়। গান্ধী বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র রাজনৈতিক নেতা—যিনি পরবর্তীকালে নয়, নিজের প্রবর্তিত আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে বলতে পারেন যে তাঁর ঐ কার্য ‘হিমালয় সদৃশ ভ্রান্তি’র দ্যোতক। গান্ধীর জীবন ও উক্তি থেকে এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
বর্তমান লেখকের রাজনৈতিক চেতনার সূত্রপাত হয় ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে। মুসলিম লিগ এবং তার নেতা জিন্না তখন স্বাধীনতাপ্রেমী দেশবাসীর আশাআকাঙ্ক্ষার প্রতীক ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং জাতীয়তাবাদী পত্র-পত্রিকা কর্তৃক তীব্রভাবে সমালোচিত। তার ছাপ অন্যান্য দেশবাসীর সঙ্গে সঙ্গে আমার উপরও পড়েছিল। ধীরে ধীরে মনে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে জিন্না আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক এবং ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত, তাদেরই স্বার্থসিদ্ধির যন্ত্র। প্রত্যুত ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান লেখক যখন যথাসাধ্য আগস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল, মুসলিম লিগের তখনকার ভূমিকার জন্য তার নেতা জিন্নাকে দেশদ্রোহী মনে হত। তারপর ১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে যখন আমি কংগ্রেসের পূর্ণ সময়ের কর্মী এবং দেশে যখন এক মহানাটকের—বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের—অনুষ্ঠান হচ্ছে, তখন তো আরও অনেক দেশবাসীর মতো নেতিবাদী জিন্নাকে এর খলনায়ক ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি।
প্রায় ঐ সময়েই আমি অবশ্য জিন্না সম্বন্ধে জওহরলালজির নিম্নোক্ত মন্তব্য পড়ার সুযোগ পাই:
“যাই হোক, কিছু কিছু পুরাতন নেতা কলকাতা(১) কংগ্রেসের পর কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং তাঁদের মধ্যে জিন্না ছিলেন এক জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ব্যক্তি। সরোজিনী নাইডু তাঁকে ‘হিন্দু মুসলিম ঐক্যের রাজদূত’ আখ্যা দিয়েছিলেন। অতীতে মুসলিম লিগকে কংগ্রেসের কাছাকাছি আনার কৃতিত্ব বহুলাংশে ছিল তাঁরই।”(২)
কিন্তু জওহরলালজির পূর্বোক্ত স্বীকৃতির তাৎপর্য তখন আমি অনুধাবন করতে পারিনি। সম্ভবত সেই চল্লিশের দশকের আবেগমণ্ডিত পরিস্থিতিই ছিল এর কারণ। সুতরাং আমার কাছে জিন্না প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িকতাবাদীই রয়ে গেলেন।
মনের বদ্ধ অর্গলে প্রথম আঘাত পড়ল পঞ্চাশের দশকে। আচার্য কৃপালনী প্রতিষ্ঠিত ইংরাজি “ভিজিল” পত্রিকায় হাসু কেবলরমানীর “পাকিস্তান এক্সরেইড” প্রবন্ধমালায় ১১ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানদের উত্তাল ক্রন্দন-কোলাহলের মধ্যে স্থায়ীভাবে ভারতবর্ষ ত্যাগ করার চতুর্থ দিনে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যদের সামনে জিন্নার প্রথম বক্তৃতার অংশবিশেষ পড়লাম। পরে ঐ বক্তৃতা জিন্নার এক জীবনীতেও উদ্ধৃত হয়। তিনি বলেছিলেন:
“আপনারা স্বাধীন। এই পাকিস্তান রাষ্ট্রে আপনাদের ইচ্ছামত মন্দির মসজিদ অথবা অপর যে কোনো উপাসনাস্থলে যাবার অধিকার আপনাদের আছে। আপনাদের ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায় যাই হোক না কেন, তার সঙ্গে এই মূল নীতির কোনো সম্পর্ক নেই যে আমরা একই রাষ্ট্রের অধিবাসী। আমার মতে এই নীতিকে আমাদের আদর্শ রূপে সদাজাগরূক রাখা কর্তব্য। তাহলে আপনারা দেখবেন যে কালক্রমে হিন্দুরা আর হিন্দু এবং মুসলমানরা আর মুসলমান থাকবে না—ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে নয়, কারণ সেটা হল প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রশ্ন—এ হল রাজনৈতিক অর্থে, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে।”(৩)
আমি যেন জিন্নাকে নূতন করে আবিষ্কার করলাম। জিন্নার বক্তৃতার ঐ অংশ আমি অন্তত যেসব বহুল প্রচারিত জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র পড়তাম তাতে প্রকাশিত হয়নি। আর হলেও আমার নজরে পড়েনি। তাই হাসু কেবলরমানীর রচনায় ঐ উদ্ধৃতি পড়ে চমকিত হলাম। এ তো কোনো সাম্প্রদায়িকতাবাদীর উক্তি হতে পারে না।
ঐ পর্যায়ের অপর একটি প্রবন্ধে হাসু কেবলরমানী জানিয়েছিলেন যে পাকিস্তান সৃষ্টি হবার কিছুদিনের মধ্যেই জিন্না সীমান্ত গান্ধী খাঁ আবদুল গফ্ফর খাঁ’র সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে নেবার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। কারণ নবসৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রধান হবার পর তিনি যাঁদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েছিলেন, তাঁদের সান্নিধ্যে জিন্না স্বস্তিবোধ করছিলেন না। কিন্তু ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি এবং তার পরিণতিতে ১১ই সেপ্টেম্বরে তাঁর মৃত্যু জিন্নার এই ইচ্ছার পরিপূর্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল।
মৌলানা আবুল কালাম আজাদের আত্মস্মৃতি “ইন্ডিয়া উইন্‌স্‌ ফ্রিডম” ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। সেই গ্রন্থটি পড়ার পর ভারত বিভাজনের দায়িত্ব সম্বন্ধে চিন্তা করার খোরাক পেলাম। মৌলানা লিখেছেন যে উত্তর (তখন সংযুক্ত) প্রদেশে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচন কংগ্রেস ও লিগ একরকম সম্মিলিতভাবে লড়ে। দুই দলের মধ্যে মোটামুটি এই বোঝাপড়া ছিল যে সম্মিলিত ভাবে উভয় দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে লিগকেও মন্ত্রিসভায় উপযুক্ত স্থান দেওয়া হবে। কিন্তু সময়কালে জওহরলালজিসহ উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেসি নেতৃবর্গ পূর্বপ্রতিশ্রুতি মানতে চাইলেন না। তাঁরা দাবি করলেন যে মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে হলে বিধান সভার লিগ সদস্যদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বর্জন করতে হবে। তাই স্বভাবতঃই আলোচনা ভেঙে গেল। এ সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে মৌলানা আজাদ বলেছেন:
“উত্তরপ্রদেশের লীগের সহযোগিতার প্রস্তাব যদি গ্রহণ করা হত, তাহলে কার্যত মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে যেত। জওহরলালের কাজের ফলে উত্তরপ্রদেশের লীগ যেন নবজীবন পেল। ভারতবর্ষের রাজনীতির প্রত্যেক ছাত্রই জানেন যে উত্তরপ্রদেশ থেকেই লীগ পুনঃসংগঠিত হয়। শ্রীযুক্ত জিন্না ঐ অবস্থার সুযোগ পূর্ণমাত্রায় নিলেন এবং এমন এক আক্রমণ শুরু করলেন যার পরিণামে পাকিস্তানের জন্ম হল।”(৪)
মৌলানার গ্রন্থ তাঁর “বন্ধু ও সাথী” জওহরলালকে উৎসর্গীকৃত এবং নেহরুর জীবদ্দশায় প্রকাশিত। তিনি কখনও মৌলানার এই গুরুত্বপূর্ণ উক্তির প্রকাশ্য প্রতিবাদ করেছিলেন বলে জানা নেই। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে রাজেন্দ্রপ্রসাদের আত্মকথা পড়ার সময়ও এই ঘটনার উল্লেখ পাই, যদিও ঐ আত্মকথারই এক অংশে সৌম্যভাষী রাজেন্দ্রবাবু জওহরলালজির কাজের সপক্ষে যুক্তি দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দেও জওহরলাল ঐরকম আরেকটি মারাত্মক ভুল করেন যার ফলে জিন্না সীমাবদ্ধ ক্ষমতাযুক্ত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবও আর মানতে অস্বীকার করেন। কিন্তু এইসব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের কথা পরে বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হবে।
যাই হোক, জিন্না সম্বন্ধে নূতন করে মূল্যায়ন করার আগ্রহের সৃষ্টি হল গান্ধী শতবার্ষিকীতে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে। কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রবীণ সাংবাদিক বি. শিবরাও-এর জিন্না সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম, পরে যা তাঁর একটি গ্রন্থের(৫) অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। শিবরাও-এর জাতীয় স্তরের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। জারী বিশের দশকের জিন্নার সঙ্গে আলাপচারির উল্লেখ করে শিবরাও জানাচ্ছেন:
“শ্রীমতী বেসান্ত এবং অন্যান্য লিবারালরা যে কারণে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকে বিপজ্জনক মনে করতেন জিন্নাও সেই কারণে তার বিরোধী ছিলেন। বিশেষ করে ভারতবর্ষের মুসলমানদের উপর খিলাফৎ আন্দোলনের সম্ভাব্য পরিণাম নিয়ে তাঁর মনে দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না। অজ্ঞ এবং ধর্মান্ধ মুসলমানদের আন্দোলনের সহকর্মী করাকে তিনি একান্তভাবে অবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে করতেন।”(৬)
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে মোতিলাল নেহরুর গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাবের সমর্থনে শাসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন: “ভারত এক জাতি নয়, এখন একথা আমাদের বলা হচ্ছে। যখন মহাযুদ্ধ চলছিল এবং ভারতবাসীকে রক্ত ও অর্থ দেবার আবেদন জানানো হয়েছিল, তখন আমরা এক জাতি ছিলাম।…যখন আমরা দায়িত্বশীল সরকার, সংসদীয় প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্তির দিকে যথোচিত পরিমাণে অগ্রসর হবার দাবি জানাচ্ছি তখন শুনতে পাচ্ছি যে আমরা এক জাতি অথবা এক রাষ্ট্র নই।”(৭)
একথা সর্বজনবিদিত যে লিবারাল ও সংবিধানপন্থী জিন্না গান্ধীর অসহযোগ কর্মসূচির সঙ্গে সহমত হতে না পেরে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে নাগপুর কংগ্রেসের পর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন। কিন্তু ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দেও মাহমুদাবাদের রাজা যিনি নিজেকে প্রথমে মুসলমান মনে করতেন, তাঁকে জিন্না কঠোরভাবে বলেছিলেন যে “না, তিনি প্রথমে ভারতবাসী পরে নিজেকে মুসলমান”(৮) বিবেচনা করবেন। অন্তত ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি যে জাতীয়তাবাদী ছিলেন একথা তাঁর সমালোচকের পক্ষেও অস্বীকার করা সম্ভব নয়।(৯) আমার এক পরম শ্রদ্ধাভাজন অতি প্রবীণ গান্ধীপন্থী শিক্ষাব্রতী এবং গঠনকর্মীর কাছে শুনেছি যে তাঁদের যৌবনে অর্থাৎ ১৯১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয়তাবাদের প্রেরণা তাঁরা পেয়েছিলেন আরও অনেকের সঙ্গে সঙ্গে জিন্নার বক্তৃতায়। সেসব সেকালে মাদ্রাজের নটেশন কোম্পানি পুস্তিকার আকারে মুদ্রিত করে প্রচার করত।
দাদাভাই নৌরজী ও ফিরোজ শা মেহতার শিষ্য জিন্না কেবল বিলাতফেরত বিখ্যাত ব্যারিস্টারই ছিলেন না, চলন-বলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার এবং মানসিকতার দিক
পৃষ্ঠা: ৫

থেকেও ছিলেন সেকালের প্রথা অনুযায়ী পাক্কা সাহেব। নিয়মিত নমাজ পড়া অথবা দাড়ি রাখা ইত্যাদি ভারতীয় মুসলমানদের বাহ্য অভিজ্ঞানের তিনি ধার ধারতেন না। পাঞ্জাবি মুসলমানদের সালোয়ার কুর্তা অথবা যাকে জিন্না টুপি বলা হয়, সেসব পরা (তাও কালেভদ্রে, কোর্ট-প্যান্টেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন) শুরু করেন তিনি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে। গোখলে জিন্না সম্বন্ধে বলতেন যে তিনি হলেন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। জিন্নাও গোখলে এবং তিলকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন এবং তিলকের বিরুদ্ধে সরকার যখন রাজদ্রোহের অভিযোগ আনে তখন আদালতে জিন্না অত্যন্ত প্রবলভাবে তাঁর পক্ষ সমর্থন করেছিলেন।(১০) জিন্নার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিকের কার্যকলাপ দেখে সরোজিনী নাইডুও অনুরূপ মন্তব্য করেন। এরকম মানুষ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার করবেন এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র বাসভূমি—ভারত বিভাজন করে স্থাপিত পাকিস্তানরূপী সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্রষ্টা হবেন ভাবতে বিস্ময় বোধ হয়।
জিন্না সেকালের মুসলমান সমাজের গোঁড়ামিকে অগ্রাহ্য করে পর্দাবিহীন নিজ পত্নীকে(১১) সভা-সমিতি এবং এমনকি লাটভবনেও নিয়ে যেতেন। মানসিক বিষাদ রোগে আক্রান্ত বেগম জিন্নার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ না হয়ে গেলে এবং অকালে তিনি জিন্নবাসিনী না হলে হয়তো বা ভারতীয় মুসলমান নারীদের মধ্যে আধুনিকতা প্রবর্তনের নেত্রীও হতে পারতেন। বি. শিবরাও শুনেছেন যে, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে একদিন জিন্না “বোম্বে ক্রনিকাল” দৈনিক পত্রিকার তদানীন্তন সম্পাদক হর্নিম্যানকে বলেছিলেন, “মুসলমানদের যে সম্প্রদায়ে তাঁর জন্ম তাঁরা দশাবতারে বিশ্বাসী এবং উত্তরাধিকার আইন ও সামাজিক প্রথার দিক থেকেও হিন্দুদের সঙ্গে তাঁদের বহুল সামঞ্জস্য আছে।”(১২) আর এটা আদৌ অবিশ্বাস্য নয়। কারণ অধিকাংশ ভারতীয় মুসলমান হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত বলে হিন্দুসমাজের চালচলন ও প্রথার রেশ তাঁদের মধ্যে থেকে যাওয়াই স্বাভাবিক। জিন্না এই পরিমাণ ধর্মীয় গোঁড়ামিবর্জিত ছিলেন যে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে একবার দিল্লিতে স্যার তেজবাহাদুর সপ্রুকে হালকা মেজাজে বলেছিলেন, “আমার মনে হয় আমি হিন্দু-মুসলমান সমস্যার একটা সমাধান বাতলাতে পারি। আপনারা আপনাদের গোঁড়া পুরোহিতশ্রেণীকে উৎসাদন করুন এবং আমরাও আমাদের মোল্লাদের ধ্বংস করি—তাহলে সাম্প্রদায়িক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।”(১৩) সমসাময়িক লেখকরা জিন্নার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে তাঁকে চূড়ান্ত বাস্তবতানিষ্ঠ, অহমিকাপূর্ণ, রগচটা, উন্নাসিক ও গজদন্ত-গোপুরম্-নিবাসী মনে হয়। অনেকে বলেন যে তাঁর ভিতর মানবীয় আবেগের ন্যূনতা ছিল। এমনকি তাঁর এককালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী চাগলারও অভিমত হল: “জিন্নার মতো এমন মানবীয় সংবেদনশীলতা বিবর্জিত আর কোনো মানুষের সম্পর্কে আমাকে আসতে হয়নি। তাঁর আচরণ ছিল হিমশীতল ভাবাবেগহীন। আইন এবং রাজনীতি ছাড়া অপর কোনো বিষয়ের প্রতি তাঁর অভিরুচি ছিল না।”(১৪) কিন্তু সত্যসত্যই কি তাই? এমন ঘটনার কি নজীর নেই যখন তিনি সাধারণ মানুষের মতো আচরণ করছেন, যে মানুষ আবেগতাড়িত এবং ভালবাসতে ও ভালবাসা পেতে চায়? সম্প্রতি কতকগুলি ঘটনার কথা জানা গেছে যার কারণ জিন্নার হিমশীতল এবং মানুষের সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবমূর্তি সম্বন্ধে পুনর্বিচার করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
জিন্নার স্ত্রীর শেষকৃত্যের সাক্ষী হবার বিরল সুযোগ চাগলা পেয়েছিলেন। জিন্নার সেই সময়কার অবস্থা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন: “সেই একবার মাত্র আমি জিন্নার আচরণে মানবীয় দুর্বলতার ছায়া প্রত্যক্ষ করেছিলাম: প্রত্যুত তাঁর চক্ষে জলধারা প্রবাহিত হয়েছিল।”(১৫) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এক প্রবন্ধে(১৬) এই ঘটনা ব্যক্ত হয়েছে যে মাঝে মাঝে গভীর রাত্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান জিন্না তাঁর মোটরগাড়ির বিশ্বস্ত চালক মহম্মদ হানিফ আজাদকে নিজের কামরায় ডেকে একটি বিশেষ আলমারি খুলে তাঁর পরলোকগত পত্নীর ব্যবহৃত কাপড়চোপড় বার করে তাঁর সামনে সাজিয়ে রাখতে আদেশ করতেন। “দীর্ঘকাল নিঃশব্দে সেই বস্ত্রগুলির দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় তাঁর চক্ষু সজল হয়ে উঠত।”
জিন্নার অন্যতম জীবনীকার হেক্টর বলিথো তাঁর তরুণদের সান্নিধ্যপ্রেমের কথা লিখেছেন, যা “এক নিঃসঙ্গ বয়স্ক ব্যক্তির ব্যর্থ পিতৃমানসিকতার পরিচায়ক।” একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলছেন যে কোনো এক নিশীথে জিন্না, “এই কারণে ঘুমোতে পারেননি” যে তাঁর বাড়িতে অতিথি তাঁর এক বন্ধুপুত্র এবং তার সঙ্গী “তার পরদিবস চলে যাবে।” তাঁর জীবনীকার আরও লিখেছেন যে বিখ্যাত হবার বহুদিন পরও জিন্না একবার কোনো এক বন্ধুর শিশুপুত্রের জন্য দোল খাওয়া কাঠের ঘোড়া কেনার উদ্দেশ্যে কেমন ভাবে কোনো দিকে দৃকপাত না করে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে খেলনার দোকানের দিকে ধাওয়া করেছিলেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত অপর একটি প্রবন্ধে(১৭) লেখক জানাচ্ছেন যে তদানীন্তন বিখ্যাত নেতা জিন্না কিভাবে তাঁর ব্যস্ত কার্যক্রমের ভিতর থেকে সময় বার করে আগ্রায় গিয়ে এক নগর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে একটি হিন্দু যুবকের পক্ষ সমর্থন করে তাকে বিপন্মুক্ত করেছিলেন। বোম্বের বিখ্যাত ব্যারিস্টার এই ঘটনার পাঁচ বৎসর পূর্বে আইনের পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করলেও একটি যুবকের ভবিষ্যৎ এবং তার পিতার মনোভাবের কথা উপলব্ধি করে জিন্না আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক ঐ কার্য করেছিলেন। জিন্নার ব্যক্তিত্বের কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য দিক বসন্ত কৃপালনীর আত্মস্মৃতিমূলক ঐ রচনায় ফুটে উঠেছে।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবরের শেষভাগে জিন্না যখন হিন্দুবিদ্বেষীরূপে তীব্রভাবে নিন্দিত তখন তাঁর জন্মস্থান করাচীর এক হিন্দু বন্ধুর পুত্র বসন্ত কৃপালনীর সনির্বন্ধ অনুরোধে আগ্রার জনৈক হিন্দু ব্যবসায়ীর প্রতি করুণাপরবশ হয়ে আদালতে তাঁর পুত্রের পক্ষ সমর্থন করার জন্য তিনি আগ্রা যান। যুবকটির বিরুদ্ধে সেখানকার সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষ এইজন্য সাজানো মামলা দায়ের করেছিল যে সে তাদের উৎকোচ দিতে অস্বীকার করেছে। হিন্দু ভগবান ধোণ্ডে তখন জিন্নার ব্যক্তিগত পরিচারক এবং কৃপালনীর মতে কায়েদ-এ- আজম “তার প্রতি অত্যন্ত নির্ভরশীল ছিলেন এবং সে ছিল তাঁর প্রায় সব সময়ের সহচর।” কৃপালনী আরও জানিয়েছেন যে কেবল তাঁকে আর্থিক দিক থেকে সাহায্য করার জন্য জিন্না তাঁকে নিজের ব্যক্তিগত সহায়কের পদে নিযুক্ত করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে কৃপালনী স্বেচ্ছায় সে কাজ ছেড়ে দেন।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে জিন্নার মানবীয় দিক সম্বন্ধে এরকম আরও বহু ঘটনা খুঁজে বার করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান আলোচনার পক্ষে সে সব বড় একটা প্রাসঙ্গিক নয়, কারণ আমাদের মূল জিজ্ঞাসা ভিন্ন। জিন্নার মতো মানসিকতা ও পৃষ্ঠভূমির একজন কুশাগ্র বুদ্ধির মানুষ ভারতে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পাকিস্তান নামক এক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের জনক হবেন—এ যেন ইতিহাসের এক পরম বিস্ময়জনক রহস্য।
ইতিহাসের এই আপাত-অবিশ্বাস্য অথচ সত্য ঘটনার কারণ আবিষ্কারের প্রয়াস আমার কাছে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছিল। সুতরাং শিবরাও-এর প্রবন্ধটি পড়ার পর থেকেই জিন্না সম্বন্ধে অধ্যয়ন আমার প্রায় একটা বাতিকে পরিণত হয়। পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলি বর্তমান লেখকের সেই জিন্না-জিজ্ঞাসার পরিণাম।


পাদটীকা
১. এই তথ্য ভ্রান্ত। জিন্না তার পরবর্তী নাগপুর কংগ্রেসের পর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জেরী সম্পর্কচ্ছেদ করেন।
২. An Autobiography; দ্য বডলি হেড, লন্ডন (১৯৫৫) ৬৭ পৃষ্ঠা।
৩. হেক্টর বলিথো কর্তৃক Jinnah: Creator of Pakistan (অতঃপর Jinnah রূপে উল্লিখিত হবে), জন মারি, লন্ডন (১৯৫৪), গ্রন্থের ১৯৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৪. ওরিয়েন্ট লংম্যান, দিল্লি, (১৯৮৮ খ্রি. পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ): পৃ. ১৭১।
৫. বি. শিব রাও; India’s Freedom Movement, ওরিয়েন্ট লংম্যান, দিল্লি (১৯৭২)।
৬. সমগ্রন্থ, ১২৫ পৃষ্ঠা। গান্ধীও স্বয়ং ১৯৪৫ খ্রি. ৬ই ডিসেম্বর লর্ড কেসীর কাছে একথা স্বীকার করেন। এন. মানসের্গ ও লুম্বি, ই. ডবলু. আর (সঃ) The Transfer of Power (অতঃপর T.P. রূপে উল্লিখিত); ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৬১৭। এইচ.এম.সীরভাই রচিত Partition of India: Legend and Reality (বোম্বাই, ১৯৮৮,) পৃ. ১৩-১৪-এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য।
৭. সমগ্রন্থ, ১২৬ পৃষ্ঠা।
৮. মাহমুদাবাদের রাজা; Some Memories। স্ট্যানলি উলপার্ট কর্তৃক Jinnah of Paki- 1stan (অতঃপর Jinnah রূপে উল্লেখিত); অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউইয়র্ক ১৯৮৪ গ্রন্থের ৭৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৯. আন্সার হারবানী, Before Freedom and After দিল্লি (১৯৮৯), পৃষ্ঠা ৭০।
১০. এ ব্যাপারে তাঁর এক কালের ঘনিষ্ঠ অনুগামী এবং সহকর্মী মহম্মদ করীম চাগলার বক্তব্য (Roses in December); ভারতীয় বিদ্যাভবন; বোম্বাই (১৯৭৩) নিম্নরূপ: ছাড়া “গান্ধীজী, নেহেরু ও অন্যান্যদের প্রতি তিনি কঠোর এবং রূঢ় উক্তি প্রয়োগ করতেন। কিন্তু গোখলে, তিলক ও তাঁদের অভিমতের প্রতি জিন্নার মনে ছিল গভীর তাকী প্রশংসা ও শ্রদ্ধার ভাব।”(পৃ. ১৪) তিলকের প্রতি জিন্নার শ্রদ্ধার ব্যাপারে চাগলা অপর একটি ঘটনারও উল্লেখ করেছেন। তিলকের প্রতি ছয় বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দানকারী বিচারপতি ডাভরকে সরকার নাইট উপাধি দিলে বোম্বাই হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে সংবর্ধনা জানাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাবৎ ব্যবহারজীবীদের কাছে এ সম্বন্ধে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে তাঁদের ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানায়। জিন্না ঐ বিজ্ঞপ্তির উপর তীব্র ভাষায় এই মন্তব্য লিখে উদ্যোক্তাদের কাছে তা ফেরত পাঠান যে তিলককে দণ্ডাদেশকারী বিচারককে সম্মান করার প্রস্তাব করার জন্য তাঁদের লজ্জিত হওয়া উচিত। বিচারপতি স্বয়ং তাঁর সঙ্গে এ সম্বন্ধে কথা বলার পরও জিন্না নিজের মন্তব্য প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃত হন। এ ঘটনা তাঁর স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং তিলকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার দ্যোতক (পৃ. ১৫)।
১১. ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে এপ্রিল জিন্না তাঁর মক্কেল ধনাঢ্য পারসি স্যার দীনশা। পেটিটের কন্যা রত্তনবাই বা রত্তিকে বিবাহ করেন। স্যার দীনশা এ বিবাহের তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং আদরিণী কন্যাকে সমস্ত জীবন ক্ষমা করেননি। ভিন্ন ধর্মের। তা তরুণীর সঙ্গে এই প্রেমঘটিত বিবাহ জিন্নার আধুনিক এবং গোঁড়ামিবর্জিত অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার লক্ষণ। তবে তাঁর প্রথম বিবাহ হয় ১৯ বৎসর বয়সে তদানীন্তন প্রথা অনুযায়ী বিলাতযাত্রার প্রাক্কালে। বালিকা বধূ এমিবাই অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং প্রথম বার বিলাত থেকে প্রত্যাবর্তনের পর জিন্না আর তাঁকে দেখতে পাননি।
১২. সমগ্রন্থ; ১২৫ পৃষ্ঠা।
১৩. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১২৬। এমনকি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দেও জিন্না কট্টর ইসলাম অনুসারীদের কী পরিমাণ বিরোধী ছিলেন তার বিবরণ এক সাম্প্রতিক গ্রন্থে (ডঃ আফজল ইকবাল; Islamisation of Pakistan, ইদারাহ-ই-অদাবিয়ৎ-ই-দিল্লি; দিল্লি (১৯৮৪), পৃ. ২৫) পাওয়া গেছে। প্রবীণ লীগনেতা ও ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনের মন্ত্রী এম.এ.হারুণ লেখককে জানান যে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে একবার জিন্নাকে যখন বলা হয় যে তিনি ইসলাম সম্বন্ধে বলার সময় শরীয়তের উল্লেখ করেন না জারী বলে উলেমারা তাঁর সমালোচক, তখন জিন্না তীব্র মন্তব্য করেন: “কার শরীয়ত? হানিফীদের? হমবলীদের? শাআফিদের? মালিকীদের? জাফরীদের? আমি নিজেকে এর মধ্যে জড়াতে চাই না। এই ক্ষেত্রে পদার্পণ মাত্র উলেমা নিজেদের বিশেষজ্ঞরূপে মাখা দাবি করে অগ্রণীর ভূমিকা নেবেন এবং আমি আদৌ চাই না যে ব্যাপারটা উলেমার বা হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক। তাঁদের সমালোচনার কথা আমি জানি। কিন্তু আমি তাঁদের ফাঁদে পা দিতে চাই না।”
১৪. সমগ্রন্থ; পৃ. ৫৫। কিন্তু চাগলা হয়তো জানতেন না যে অভিনয়কলার প্রতি জিন্নার গভীর আগ্রহ ছিল। ব্যারিস্টারি পাস করার পরও তাঁর ইংলন্ডে পেশাদার অভিনেতা হবার শখ ছিল যা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন পিতৃপ্রভাবে। আইনজীবী এবং রাজনৈতিক নেতা হিসাবে সমস্ত দিন গলদঘর্ম হয়ে পরিশ্রম করার পরও তিনি শেক্সপীয়রের তেজী রচনা আবৃত্তি করে আত্মমনোরঞ্জন করতেন (উলপার্ট; সমগ্রন্থ; পৃ. ১৪)।
১৫. সমগ্রন্থ; ১২১ পৃষ্ঠা।
১৬. ১৪.৬.১৯৮১
১৭. বসন্ত টি কৃপালনী; Jinnah’s Last Legal Battle, ২৭.৩.১৯৮৩

“লিঙ্কনস ইন” থেকে বোম্বাই হাইকোর্ট এবং দাদাভাই নৌরজীর পদাঙ্ক অনুসারী।
মুসলিম লীগের জন্মবৃত্তান্ত ৷

জিন্নার ধারাবাহিক জীবনী অবলম্বন করে আমরা প্রথমে অগ্রসর হব। তবে ভারতবর্ষে জিন্নার জীবনী নিয়ে গুরুতর আলোচনা তেমন হয়নি বললেই চলে। অথচ তাঁর পরলোকগমনের এতগুলি বছর পর অন্তত তাঁর প্রথম জীবন অর্থাৎ যখন তিনি নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী ও কংগ্রেসের স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন, তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। সুতরাং আমাকে তাঁর প্রথম জীবন অর্থাৎ ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের সূচনায় তাঁর কংগ্রেস ত্যাগ করার সময়কালের তথ্যের জন্য প্রধানত পাঁচটি(১) গ্রন্থের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। জিন্নার পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে বহু তথ্য সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। যথাস্থানে সেসব গ্রন্থের উল্লেখ করা হবে।
ঝিনাভাই পুঞ্জার প্রথম সন্তান মহম্মদ আলী জিন্নার জন্ম ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে ডিসেম্বর(২) করাচী শহরে। সিন্ধু প্রদেশে ভূমিষ্ঠ হলেও তাঁরা গুজরাতের বাসিন্দা (কাঠিয়াওয়াড়ী) শিয়াপন্থী খোজা মুসলমান এবং তাঁর পদবি ছিল ঝিনাভাই(৩)। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডন থাকাকালীন আধুনিক হবার উদ্দেশ্যে পদবির “ভাই” অংশ বর্জন করে তদানীন্তন ইংরেজ সমাজের রীতি অনুসারে নিজের নাম এম.এ.জিন্না রূপে লেখা আরম্ভ করেন। জিন্না নামেই তিনি সমধিক পরিচিত।
১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে করাচীর এক মাদ্রাসায় তাঁর বিদ্যারম্ভ হয়।(৪) পরবর্তী বৎসরে তিনি মাদ্রাসা-তুল-ইসলামে ভর্তি হন। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে বোম্বেতে তাঁর পিসিমার বাড়িতে থেকে গোকুলদাস তেজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়লেও পরের বছর আবার করাচীতে ফিরে এসে পুরাতন মাদ্রাসাতেই ভর্তি হন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে করাচীর ক্রিশ্চান মিশনারি সোসাইটির হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি(৫) ইংলন্ডে রওনা হন। পিতার উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায়সূত্রে পরিচিত তাঁর এক ইংরেজ বন্ধুর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে তাঁকে শিক্ষানবীশ করিয়ে ঐদিকে অভিজ্ঞ করে তোলা। কিন্তু সে পেশা তাঁর ভাল না লাগায় বিলাতে পৌঁছবার কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লিঙ্কনস ইনে যোগদান করেন। ঐ অল্প বয়সে দূর দেশে ভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজের ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া কম মনোবলের পরিচায়ক নয়। বলা বাহুল্য এইভাবে জীবনের পথ পরিবর্তন করার জন্য তাঁর পিতা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। তিনি যদি বিলাতে পুত্রের তিন বছর খরচ চলার জন্য টাকা আগাম না জমা রাখতেন তবে জিন্না শেষ অবধি পড়াশুনা চালাতে পারতেন কি না সন্দেহ। ভবিষ্যৎ কায়েদ-এ-আজম হবার বীজ জিন্নার মনে পাঠরত অবস্থাতেই উপ্ত হয়েছিল বলা চলে। লিঙ্কনস ইন থেকে সময় করতে পারলেই তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবনে দর্শকের আসনে বসে মুগ্ধচিত্তে আইরিশ হোমরুল এবং নারীমুক্তি সম্বন্ধে সদস্যদের আলোচনা অথবা দাদাভাই নৌরজীর (তিনি তখন পার্লামেন্টের সদস্য) বক্তৃতা শুনতেন। জিন্নার অপর দুটি অবসর-বিনোদনের কেন্দ্র ছিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পাঠাগার এবং রবিবারের হাইড পার্ক যেখানে নানা বক্তা বিচিত্র সব বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে অন্যতম তরুণ ভারতীয় ছাত্ররূপে জিন্না ব্যারিস্টারি পাস করলেন। তবে ইতিমধ্যে
পৃষ্ঠা: ১০

তিনি ভারতবর্ষের “গ্রান্ড ওল্ড ম্যান” দাদাভাইকে মনে মনে গুরুরূপে বরণ করে নিয়েছেন। ইচ্ছা, ভারতে ফিরে গিয়ে তিনি গুরুর মতোই লিবারাল এবং সংবিধান অনুসারী পার্লামেন্টারিয়ান হবেন।
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে জিন্না হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি আরম্ভ করলেন। ইতিমধ্যে দাদাভাই-এর সঙ্গে বিলাতের সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়া ছাড়া তিনি তদানীন্তন কংগ্রেসের অপর প্রথম সারির নেতা গোখলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে এসেছেন। কিন্তু (গান্ধীরই মতো) প্রথম দিকে পশার না জমায় ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তৃতীয় প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নেন। মাত্র তেসরা নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি চাকরি করলেও ঐ অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর ফৌজদারি আইনের জ্ঞানের খ্যাতি রটে যায়। ছয় মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে আবার তিনি স্বাধীন আইন ব্যবসায়ে ফিরে এলেন। এবারে ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি সদয়। দুই বছরের ভিতর তাঁর মাসিক আয় দুই হাজার টাকার উপর দাঁড়াল। সেকালের হিসাবে সেটা প্রভূত আয়। আর্থিক দিক থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে এবারে তিনি রাজনীতিতে মন দিলেন।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে অসুস্থ স্যার ফিরোজ শা মেহতার স্থলাভিষিক্ত হয়ে কংগ্রেসের প্রতিনিধিরূপে তিনি গোখলের সঙ্গে বিলাত যাত্রা করেন। উদ্দেশ্য নির্বাচনের প্রাক্কালে ভারতের স্বায়ত্তশাসনের দাবির সপক্ষে ব্রিটেনের জনমত সৃষ্টি। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬-২৯শে ডিসেম্বর কংগ্রেসের সে বছরের সভাপতি দাদাভাই নৌরজীর একান্ত সচিব হিসাবে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে যোগদান করেন এবং দুই দিন দুটি প্রস্তাবের উপর বক্তৃতা দেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ই জানুয়ারি কলকাতাতেই ইন্ডিয়ান মুসলমান অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এই স্বল্পজীবী প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ছিল “মুসলমানদের বিশেষ অভাব-অভিযোগ লোকচক্ষুর সামনে তুলে ধরা ও তাঁদের স্বার্থরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবাসীর রাজনৈতিক ও আর্থিক উন্নতির জন্য অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা।” সম্ভবত প্রতিষ্ঠানটি তার কয়েক দিন পূর্বে (১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর ৩০-৩১) ঢাকাতে প্রতিষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পাল্টা জবাব, যা ছিল কেবল মুসলমানদেরই প্রতিষ্ঠান এবং যাতে জিন্না জেনেশুনেই যোগ দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। জিন্নার প্রথম যুগের লীগের বিরোধিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পরবর্তীকালে লীগের প্রথম সারির নেতাদের অন্যতম আগা খাঁ মন্তব্য করেন যে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের কঠোরতম বিরোধী “ছিলেন জিন্না যিনি আমি এবং আমার বন্ধু যা কিছু করেছি এবং করার চেষ্টা করছিলাম তার প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিলেন। …তিনি বলেছিলেন যে আমাদের পৃথক নির্বাচন প্রথার নীতি জাতিকে খণ্ডবিখণ্ড করছিল।”(৬)
এই প্রসঙ্গে লীগের জন্মের নেপথ্য ইতিহাস(৭) ব্যক্ত করা প্রয়োজন—যা অতীব চিত্তাকর্ষক। সিপাহী বিদ্রোহ শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের নৈতিক সমর্থন ও নেতৃত্ব পাবার ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শ্বেতাঙ্গ প্রভুত্বের বিরুদ্ধে একটা ব্যাপক শক্তি হিসাবে দানা বাঁধে। বহু অভিজাত মুসলমান আবার মুসলিম শাসন প্রবর্তন করা সম্ভব হবে—এই আশায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে যোগ দেন। বিদ্রোহ দমনের পর ইংরেজরা তাই মুসলমানদের প্রতি দুয়োরানিসুলভ দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করে। আহত অহমিকার জন্য অতীতের শাসক সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী মুসলমানরাও স্বয়ং নূতন শ্বেতাঙ্গ শাসকদের থেকে দূরে সরে থাকেন। এই কারণে বিশেষ করে বঙ্গদেশ (যেখানকার নেতৃবৃন্দ বিদ্রোহের সমর্থক ছিলেন না) ও অন্যান্য প্রদেশের হিন্দুরা ইংরাজি শিক্ষা ও ইংরেজের প্রসাদপুষ্ট চাকরি ও অন্যান্য পেশা গ্রহণ করে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাপন্ন হয়ে ওঠেন। মুসলমান সমাজের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা স্যার সৈয়দ আহমদ (১৮১৭-১৮৯৮) মুসলমানদের অনগ্রসরতার কারণ উপলব্ধি করতে পেরে আলিগড়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের (পরে বিশ্ববিদ্যালয়) মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে ইংরাজি শিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের এই পরামর্শ দেন যে নিজেদের পিছিয়ে পড়া অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা যেন ইংরেজের সঙ্গে সংঘর্ষের পথে না যান। সাম্রাজ্যের স্বার্থে আলিগড়ের মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজের প্রথম তিন ইংরেজ অধ্যক্ষও স্যার সৈয়দ এবং তাঁর পরলোকগমনের পর কলেজের পরবর্তী কর্তৃপক্ষদের নীতিকে প্রভাবিত করেন। অধ্যক্ষ তিনজন যথাক্রমে বেক্ (১৮৮৩-১৮৯৯), থিয়োডর মরিসন (১৮৯৯-১৯০৫) এবং আর্চবোল্ড। হিন্দু বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং রাজনৈতিক ধ্যানধারণায় অনুপ্রাণিত ভারতবাসী ব্রিটিশ প্রজা হিসাবে সমানাধিকার এবং প্রতিনিধিত্বমূলক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে মুখর হতে থাকেন। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বীজ বপন করে তাঁদের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করার জন্য বঙ্গভঙ্গের ব্যবস্থা করা হয়। প্রধানত বাঙালি হিন্দু এবং প্রথম দিকে কিছু মুসলমান নেতাও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাই অন্তত মুসলমানদের সপক্ষে আনার জন্য লর্ড কার্জন ঢাকায় গিয়ে প্রকাশ্য সভায় বলেন যে বঙ্গভঙ্গের দ্বারা মুসলমানদের জন্য নিজ অভিরুচি অনুসারে চলার উদ্দেশ্যে একটি পৃথক প্রদেশের সৃষ্টি করাও তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য। নবসৃষ্ট পূর্ববঙ্গ প্রদেশের লেফ্টন্যান্ট গভর্নর স্যার ব্যামফুল্ড ফুলারের মুসলমানদের তাঁর সুয়োরানি আখ্যা দেবার কাহিনীও সর্বজনবিদিত। এইভাবে বিভাজনের একদা-বিরোধী ঢাকার নবাব সলিমুল্লা ও আরও অনেক বিশিষ্ট মুসলমানকে কার্জন ব্রিটিশ শাসনের অনুকূল করেন এবং শুরু হয়ে যায় মুসলিম-তোষণের পালা।
বঙ্গভঙ্গ নবজাগ্রত রাজনৈতিক নেতৃত্বের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে স্বাধিকারের দাবিকে দুর্বল করার পরিবর্তে আরও উত্তাল করে তুলল। বৈধানিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। অগ্নিযুগের বাণী: “আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগো রে সকল দেশ!” ইংরেজ শাসকদের প্রতিক্রিয়া হল রোমান সাম্রাজ্যবাদীদের অনুসারী devide et Impera বা ভেদনীতি।
মুসলিম শিক্ষা-সংস্কৃতির তদানীন্তন পীঠস্থল আলিগড় কলেজের সম্পাদক নবাব মহসীন-উল-মুল্ককে কলেজের অধ্যক্ষ আর্চবোল্ড ভারত সরকারের গ্রীষ্মাবাস সিমলায় গভর্নর জেনারেলের একান্ত সচিব কর্নেল ডানলপ স্মিথ ও আরও কয়েকজন বড়লাটের পার্যদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ই আগস্ট একটি চিঠি লেখেন। সে পত্রে এই পরামর্শ দেওয়া হয় যে তিনি যেন অবিলম্বে বড়লাটের কাছে মুসলমানদের একটি প্রতিনিধিমণ্ডল পাঠাবার ব্যবস্থা করেন যাঁরা তাঁকে একটি স্মারকপত্র দেবেন। কেমন ভাষা ও ভঙ্গীতে আবেদনপত্র লিখতে হবে এবং তার বক্তব্য কি হবে সে সবই আর্চবোল্ড ছকে দিয়েছিলেন ও এও জানিয়েছিলেন যে যবনিকার অন্তরালে থেকে তিনি এ ব্যাপারে সব রকমের সাহায্য করতে প্রস্তুত। তদনুসারে নবাব মহসীন-উল-মুল্কের উদ্যোগে ও আগা খাঁর নেতৃত্বে ৭০ জনের একটি প্রতিনিধি দল ১লা অক্টোবর বড়লাটের সঙ্গে দেখা করেন।
কীভাবে ঐদিন সেই প্রতিনিধিমণ্ডলের দ্বারা মুসলমানদের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিমূলক স্বায়ত্তশাসনের বদলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে মনোনীত প্রতিনিধিদের স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বড়লাট মিন্টো “কংগ্রেসি আন্দোলনকারী”দের প্রভাব থেকে ৬ কোটি ২০ লক্ষ মুসলমানদের পৃথক করে দেন এবং ব্যাপারটি যে লেডি মিন্টোর মতে “ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা”, একথা তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ঘটনার বিবরণ পেয়ে উল্লসিত ভারতসচিব লর্ড মর্লি ২৬শে অক্টোবর মিন্টোকে লেখেন: “আপনার মুসলমানদের সম্বন্ধে যা কিছু আপনি জানিয়েছেন তা হৃদয়গ্রাহী। আমার একটাই দুঃখ যে ঐদিন আমি অশরীরী ভাবে আপনার বাগান-পার্টিতে ঘোরাফেরা করতে পারিনি। সমস্ত ব্যাপারটাই যতটা সম্ভব ভাল হয়েছে এবং ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে আপনার পদমর্যাদা ও ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব সপ্রমাণ করেছে। আপনার কর্তৃত্বের আর একটা সুফল হল এই যে এর ফলে এখানকার সমালোচকদের পরিকল্পনা ও কৌশল একেবারে বানচাল হয়ে গিয়েছে। আর তাঁরা একথা উচ্চারণ করতে পারবেন না যে ভারত সরকারের কার্যকলাপ হল আমলাতন্ত্রের সঙ্গে জনসাধারণের সংঘাতের প্রচলিত ইতিবৃত্ত।”
বড়লাটের কাছে দরবার করে ঐসব মুসলমান নেতারা যে উৎসাহ পেয়েছিলেন তার জের টেনে তাঁরা নভেম্বরের ৬ই নবাব সলিমুল্লা সহ আরও অনেক মুসলমান নেতাদের একটি পরিপত্র পাঠিয়ে মুসলমানদের জন্য পৃথক একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রস্তাব করেন। তদনুসারে বছরের শেষের দিকে ঢাকায় মুসলমান নেতৃবৃন্দের এক সর্বভারতীয় সম্মেলনের শেষে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। জন্মলগ্নেই লীগ তার চারিত্র ধর্মের পরিচয় দিল বঙ্গভঙ্গের সমর্থন এবং বয়কট আন্দোলনের বিরোধিতামূলক প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে মুসলমানদের কেবল ব্যবস্থা পরিষদেই নয়, এমনকি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠানসমূহেও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা, চাকরির ক্ষেত্রে এমনকি প্রিভি কাউন্সিলেরও আসনসংরক্ষণ ইত্যাদি বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি সময়ে সময়ে মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে উত্থাপিত হত। অবশ্য পরে আমরা দেখব যে ঘটনাচক্রের আবর্তনে এক এক সময়ে লীগের ভূমিকায় কি রকম পরিবর্তন হচ্ছে।
যাইহোক পূর্বে যেমন বলা হয়েছে, জাতীয়তাবাদী জিন্না জন্মমুহূর্তে লীগের সঙ্গে যুক্ত হওয়া থেকে বিরত ছিলেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জিন্না সুরাট কংগ্রেসে যোগ দিয়ে ঐ প্রতিষ্ঠানের নরম ও চরম পন্থায় বিভক্ত হবার দক্ষযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তী বৎসরের ২৪শে জুন বোম্বে হাইকোর্টে তিলকের কারামুক্তির দাবি জ্ঞাপন করেন। ডিসেম্বরে কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ইতিমধ্যে লীগ মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য দাবি করছে বলে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের পয়লা আগস্ট খুব সম্ভব মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্জুমান-ই-জিয়া-উল- ইসলাম আহূত এক বিরাট জনসভায় এই মর্মে জিন্না প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে মুসলমান নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ ব্যতিরেকে যেন তাঁদের জন্য পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন ক্ষেত্র নির্ধারণ করা না হয়। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি বোম্বের মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত (১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারের সৌজন্যে প্রবর্তিত) আসন থেকে বোম্বে কাউন্সিলের বেসরকারি সদস্যদের দ্বারা জিন্না বড়লাটের কাউন্সিলের (ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে) সদস্য নির্বাচিত হন। দাদাভাই নৌরজীর মতো পার্লামেন্টারিয়ান হয়ে তাঁর দেশসেবার ইচ্ছা এইভাবে পূর্ণ হয়।
এইবার আর এক দফা জিন্নার জীবনপঞ্জী পরিক্রমা স্থগিত রেখে ভারতবর্ষের শাসন সংস্কারের ইতিহাস এবং বিশেষ করে মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। কারণ এর সঙ্গে জিন্নার পরবর্তী জীবনপ্রবাহের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ।


পাদটীকা

১. শরীফ অল-মুজাহিদ; Quaid-I-Azam Jinnah – Studies in Interpretation; কায়েদ-এ-আজম অকাদেমি, করাচী (১৯৮১); এস.কে. মজুমদার, Jinnah and Gandhi-Their Roles in India’s Quest for Freedom; ফার্মা কে. এল. মুখোপাধ্যায়, কলিকাতা (১৯৬৬); উলপার্ট; Jinnah; এম.এইচ. সঈদ; The Sound of Fury-A Political Study of Mohammad Ali Jinnah; (Sound of Fury রূপে উল্লেখিত) ডকুমেন্ট প্রেস, নূতন দিল্লি (১৯৮১) এবং বলিথো; Jinnah।
২. এ তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে।
৩. এ পদবী গুজরাতের হিন্দুদের মধ্যেও আছে। পূর্ববর্তী অধ্যায়ের ১২ সংখ্যক পাদটীকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিব রাও-এর গ্রন্থের উদ্ধৃতি দ্রষ্টব্য।
৪. এই তারিখ ও স্থান নিয়ে মতভেদ বিদ্যমান।
৫. কোনো কোনো গবেষকের মতে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ।
৬. মহামান্য আগা খাঁ; The Memories of Aga Khan; (১৯৫৪); উলপার্ট কর্তৃক পূর্বোক্ত গ্রন্থে (পৃ. ২৬) উদ্ধৃত।
৭. এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্যের জন্য রাজেন্দ্রপ্রসাদের India Didived; হিন্দ্‌ কিতাবস, বোম্বাই (১৯৪৬) পৃ. ৯৪-১১৯ এবং রামগোপালের Indian Muslims – A Politi- cal History (1858-1947) (অতঃপর Indian Muslims রূপে উল্লেখিত); এশিয়া পাবলিশিং হাউস, বোম্বাই (১৯৫৯) পৃ. ৯৭-১০২ দ্রষ্টব্য।

ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউনসিলের মুসলমান সদস্য

ভারতবর্ষের শাসন সংস্কারের কথা আলোচনা করতে গেলে স্বভাবতই সর্বাগ্রে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কথা এসে পড়ে, যদিও তার পূর্বসূরী প্রতিষ্ঠান ও নেতৃত্বের কথা বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। তবে এ ব্যাপারে কংগ্রেসের প্রমুখ ভূমিকার জন্য সঙ্গত কারণেই পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলির তথ্যের জন্য কংগ্রেসের সরকারি ইতিহাসের(১) উপর নির্ভর করতে হয়েছে।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের পরিণামে ভারত শাসনের দায়িত্ব প্রত্যক্ষ ভাবে ইংলন্ডের ব্রিটিশ সরকারের উপর বর্তাল। সেখানে তখন মোটামুটি গণতন্ত্র ও সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাম্রাজ্যের কালা আদমিদের খোদ ইংরেজদের তুলনায় কিছুটা নিকৃষ্ট দরের মানুষ মনে করার মানসিকতা থাকলেও ওদের রাজনৈতিক অধিকারাবলী থেকে মহারানির ভারতীয় প্রজারা একেবারেই বঞ্চিত থাকবে—এমন কথা ওদেশের বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এছাড়া ইংরাজি শিক্ষা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভারতবাসীদেরও পরিচয় হচ্ছে। তাই স্বভাবতই ব্রিটিশ নাগরিকরা যেসব অধিকার ভোগ করে তা পাবার জন্য ভারতবাসীদের মধ্যেও প্রথমে মৃদুকণ্ঠে এবং তারপর বেশ সরব দাবি উঠতে লাগল। প্রজাবিদ্রোহ কি রূপ নিতে পারে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দেই ইংরেজ কর্তৃপক্ষ তার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তাই তাঁরা অত্যন্ত সীমিত মাত্রাতে হলেও মহারানির ভারতীয় প্রজাদের স্বায়ত্তশাসন, সংবাদপত্রের ও বাক্- স্বাধীনতা, সরকারি চাকরিতে স্থান, অস্ত্র রাখার অধিকার এবং বিচার-ব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে একটু একটু করে অধিকার দেবার নীতি মেনে নিলেন। এই উদ্দেশ্যে ১৮৮১ থেকে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এদেশে প্রথম হাইকোর্ট এবং সর্বতোভাবে মনোনীত সদস্য সমন্বিত ব্যবস্থাপক সভার (লেজিসলেটিভ কাউন্সিল) প্রবর্তন হল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের জন্ম এবং এতে কোনো আশ্চর্যের কারণ নেই যে এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম-এর মতো মডারেট ইংরেজরাও ছিলেন, যাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীদের রাজনৈতিক চেতনার জাগৃতি যেন বিস্ফোরক অবস্থায় না যায়। ডাফরিনের মতো তদানীন্তন এবং ডালহাউসি ও রিপনের মতো ভূতপূর্ব বড়লাটের সমর্থনও এর পিছনে ছিল। অতীতের বড়লাটেরা ছাড়াও ইংলন্ডের অনেক জননেতা হিউমের অনুরোধে বিলাতে ভারতের দাবির অনুকূলে জনমত তৈরি করতেও সম্মত হন।
কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনেই ব্যবস্থাপক সভার সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি ও নির্বাচিত সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি এবং উত্তর পশ্চিম প্রদেশ, অযোধ্যা ও পাঞ্জাবে ব্যবস্থাপক সভা, ঐসব ব্যবস্থাপক সভার অধিকাংশ সদস্যদের প্রতিবাদের শুনানীর জন্য ভারতসচিবের কাউন্সিল বাতিল করে হাউস অফ কমন্সে এক স্থায়ী কমিটি ইত্যাদির দাবি জানানো হয়। দ্বিতীয় বৎসরে কংগ্রেসের দাবি হল ব্যবস্থাপক সভার অর্ধেক সদস্য যেন জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত হয়। এছাড়া মিউনিসিপ্যালিটি এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ, বণিকসঙ্ঘ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রাদেশিক স্থানীয় কাউন্সিলসমূহে পরোক্ষ নির্বাচন এবং স্থানীয়
পৃষ্ঠা: ১৫

কাউন্সিল থেকে উচ্চতম কাউন্সিলেও পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা ঐ বৎসরের দাবির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পরবর্তী কয়েক বৎসরেও কংগ্রেসে এজাতীয় প্রস্তাব গৃহীত হল। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস এই অভিমত ব্যক্ত করল যে ভারতের জনসাধারণকে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা আইন সভায় স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে না দেওয়া পর্যন্ত এদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্রসের “কাউন্সিল রিফর্ম” আইন গৃহীত হয়। এতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠানসমূহ ও অন্যান্য নির্বাচক মণ্ডলীকে ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচনের অধিকার দিলেও আইনত সে নির্বাচন কেবল সুপারিশ মাত্র ছিল। কারণ ঐ তথাকথিত নির্বাচিত সদস্যদের থেকেই ব্যবস্থাপক সভার সদস্য কে কে হবেন তা বাছাই-এর অধিকার সরকারের হাতে রেখে দেওয়া হয়েছিল, যদিও সাধারণত ঐভাবে নির্বাচিত সদস্যদেরই মনোনীত করা হত। পূর্বোক্ত শাসন সংস্কার আইনে উচ্চতম কাউন্সিলে মাদ্রাজ, বোম্বে, বঙ্গদেশ ও উত্তর পশ্চিম প্রদেশ—তখনকার এই চারটি প্রাদেশিক আইনসভার বেসরকারি সদস্যদের মনোনয়নের দ্বারা এক এক জন করে সদস্য নেবার অধিকার দেওয়া হয়। তাই কংগ্রেস পরবর্তী পাঁচ বছর এর ত্রুটিবিচ্যুতিসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং পাঞ্জাবের জন্য প্রাদেশিক বিধানসভার দাবি জানাতে থাকে।
কংগ্রেসের এইসব প্রস্তাব দ্বারা জনমত জাগ্রত করা এবং দেশে পশ্চিমী শিক্ষার বিস্তার ও ব্রিটেনের সংসদীয় প্রথা এবং ইউরোপ আমেরিকার গণতন্ত্রের উদ্ভব-প্রয়াসের সঙ্গে শিক্ষিত ভারতবাসীর আরও বেশি মাত্রায় পরিচয় ইত্যাদির জন্য দেশের প্রায় অদ্বিতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য দাবি উত্তরোত্তর প্রবল হতে আরম্ভ করল। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দ্বারা প্রতি প্রদেশ থেকে দুইজন করে প্রতিনিধি কমন্‌স সভায় নেবার দাবি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় আইন সভাগুলিতে আর্থিক বিষয়ের উপর ভোটাভুটির ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব করল। এছাড়া বড়লাটের শাসন পরিষদ (একজিকিউটিভ কাউন্সিল) এবং ভারত সচিবের পরিষদেও ভারতবাসীদের সদস্য হিসাবে নেবার দাবি জানাল কংগ্রেস।
এসব দাবির প্রতিক্রিয়া ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে হল দ্বিবিধ প্রকারে। একদল ভারতে শাসন সংস্কারের সপক্ষে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা আরম্ভ করলেন। অপর দল যাঁরা প্রশাসন যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন, তাঁরা যাতে ক্ষমতা না ছাড়তে হয় এর জন্য ভেদনীতির শরণ নিয়ে জনমতের কণ্ঠরোধ করার পরিকল্পনা করলেন।(২) বাংলা এই আন্দোলনে অগ্রণী ছিল বলে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের আদেশ পূর্বোক্ত পরিকল্পনার প্রথম ধাপ রূপে দেখা দিয়েছিল—এ আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দেখেছি। আমরা এও দেখেছি যে মুসলমানদের জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যে প্রয়াস শুরু হয় তার পরিণতি কিভাবে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হয়। পূর্ব অধ্যায়ে একথাও বলা হয়েছে যে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক বয়কট আন্দোলন ছাড়াও ভারতের রাজনীতিতে ম্যাৎসিনী, গ্যারিবল্ডি ও ডি ভ্যালেরার আদর্শে অগ্নিযুগের প্রবর্তন হয়েছিল। অর্থাৎ দেশের নবজাগরণকে ব্যাহত করা গেল না।
১৯০৫ থেকে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতি বৎসর কংগ্রেসে ভারতীয় জনমতের অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দাবির সোচ্চার সমর্থন হতে লাগল। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকারের ভারতে শাসন সংস্কারের অনুকূল লবিও সক্রিয় হয়েছে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস তাই আসন্ন শাসন সংস্কারকে আগাম অভিনন্দন জানাল এবং আশা ব্যক্ত করল যে বিশদ প্রস্তাব যেন উপযুক্ত উদারতাপূর্বক রচিত হয়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের শাসন সংস্কার আইন (যার সঙ্গে তদানীন্তন ভারতসচিব জন মর্লি ও বড়লাট মিন্টোর নাম যুক্ত) প্রবর্তিত হল। এর মূল ধারা নিম্নরূপ: উচ্চতর বা সুপ্রিম কাউন্সিলে আরও ৬০ জন সদস্য থাকবেন, যার ২৭ জন হবেন নির্বাচিত। বাকি সদস্যদের মধ্যে ২৮ জন হবেন রাজকর্মচারী এবং অন্যান্য ৫ জন বড়লাট দ্বারা মনোনীত বিভিন্ন সম্প্রদায় ও স্বার্থের বেসরকারি প্রতিনিধি। নির্বাচিত সদস্যরাও বহুলাংশে বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবেন। সাতটি প্রদেশ থেকে জমিদার, পাঁচটি প্রদেশ থেকে মুসলমান এবং একটি প্রদেশ থেকে (পালা করে) মুসলমান জমিদার এবং বণিক সঙ্ঘগুলি দ্বারা দুই জন নির্বাচিত হবেন। বাকি আসনগুলি অসংরক্ষিত রূপে বিবেচিত হবে এবং ঐ আসনগুলি ভরা হবে (তখনকার) নয়টি প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদের বেসরকারি সদস্যদের দ্বারা। এছাড়াও এই শাসন সংস্কারের মাধ্যমে বড়লাট এবং বিভিন্ন প্রদেশের ছোটলাট ও লেফটন্যান্ট গভর্নরদের শাসনপরিষদে এক এক জন করে ভারতীয় সদস্য নেবার প্রথা প্রবর্তিত হল।
পাঠক লক্ষ করে থাকবেন যে এইভাবে মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচনের সূত্রপাত হয়েছিল। এছাড়া মুসলমানদের জন্য জনসংখ্যার হারের তুলনায় অধিক আসন বা সংরক্ষণ দেবার ব্যবস্থাও এই প্রস্তাবে ছিল। অর্থাৎ আগা খাঁর নেতৃত্বাধীন মুসলিম প্রতিনিধিমণ্ডলকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা দীর্ঘদিন বিষবৃক্ষের যে বীজ গোপনে লালন-পালন করেছিলেন এইভাবে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তা উপ্ত হল।
কংগ্রেস স্বভাবতই ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের অধিবেশনে চারটি প্রস্তাবের মাধ্যমে এ সম্বন্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল। সীতারামাইয়া বলছেন:
“প্রথম প্রস্তাবে ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করার ব্যাপারে (কংগ্রেস) আপত্তি জ্ঞাপন করল। নিম্নোক্ত ধারার জন্যও কংগ্রেস অসন্তোষ ব্যক্ত করল: (ক) এক বিশেষ ধর্মমতে অনুগামীদের একান্তভাবে অনুচিত মাত্রাতিরিক্ত প্রতিনিধিত্ব দেওয়া; (খ) নির্বাচকমণ্ডলী এবং ভোটার ও প্রার্থীদের যোগ্যতার ক্ষেত্রে মহামান্য সম্রাটের প্রজাদের মধ্যে অন্যায় ও অপমানজনক ভাবে মুসলমান ও অমুসলমানের পার্থক্য করা।”(৩)
প্রস্তাবের অপরাংশ এবং অন্য তিনটি প্রস্তাব গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের প্রতি কংগ্রেসের আগ্রহের দ্যোতক হলেও আমাদের বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক বোধে উল্লেখ করা হল না।
নিজেদের কৃতি সম্বন্ধে লর্ড মর্লি অবশ্য স্বীকার করেছিলেন যে, “কেউ যদি একথা বলেন যে শাসন সংস্কারের এই অধ্যায়ের ফলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভারতবর্ষে সংসদীয় প্রথার প্রবর্তন হয়েছিল, তবে আমি অন্তত তা মানতে পারব না।” পরবর্তী শাসন সংস্কারের প্রবর্তক মন্টেগু এবং চেমসফোর্ডের বক্তব্য ছিল: “পূর্বতন সংস্কার ভারতীয় জনমতের সন্তুষ্টিবিধানে অক্ষম এবং আর বেশিদিন ঐ সংস্কার অনুসারে চললে ভারতীয় সদস্যদের সঙ্গে সরকারের মতভেদ আরও তীব্র হবে এবং দায়িত্বের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত সমালোচনা আরও উচ্চকণ্ঠ হবে।”
যাই হোক, তাবৎ আপত্তি সত্ত্বেও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ভারতবাসী মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারকে প্রত্যাখ্যান করেনি। আর আমরা দেখেছি যে এই ব্যবস্থা অনুসারে বোম্বে থেকে মুসলমান সদস্যরূপে নির্বাচিত হয়ে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে জানুয়ারি জিন্না কলকাতায় (তখন ভারতের রাজধানী) বড়লাটের কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে আসন গ্রহণ করেন। অতঃপর আমরা আবার জিন্নার রাজনৈতিক জীবনের ধারা অনুসরণ করব।


পাদটীকা

১। ডা. বি পট্টাভি সীতারামাইয়া: The History of the Congress; প্রথম খণ্ড (১৯৩৫) ও দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৪৭)।
২। এর একটি প্রাচীন নিদর্শন বড়লাটের শাসন পরিষদের একদা সদস্য স্যার জন স্ট্রেটির India নামে ১৮৮৮ খ্রি. প্রকাশিত পুস্তক যা কেমব্রিজে পাঠরত হবু ভারতী সিভিলিয়ানদের জন্য রচিত হয়। ভারতের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ রূপে পরিচিত স্ট্রেটির উপদেশ, “ভারত সম্বন্ধে তাঁদের (ভবিষ্যৎ প্রশাসকদের) সর্বাগ্রে এই সর্বাধিক জরুরি কথা জানতে হবে যে ভারত নামে কোনো এক অখণ্ড দেশ নেই, কস্মিন কালেও ছিল ডিগ্রী না।… ভারতের কোনো এক দেশে কখনও জাতীয় সংবেদনশীলতার সৃষ্টি হলেও হতে পারে… তা কখনও মোটামুটি সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়বে এবং পাঞ্জাব বঙ্গদেশ, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মাদ্রাজের মানুষ মনে করবে যে তারা সবাই ভারত রাষ্ট্রের, তা একান্তই অসম্ভব।” রামচন্দ্র গুহ; India After Gandhi: The History of World’s Largest Democracy; ২০০৭ খ্রি.; পৃ. (XII)। স্ট্রেচি মনে রাখার দরকার বোধ করেননি যে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশের তিন বৎসর পূর্বেই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সাপ্রতিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে।
৩। সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; পৃ. ৪১-৪২।

বড়লাটের সঙ্গে অসিযুদ্ধা

বড়লাটের কাউনসিলের সদস্য হিসাবে গোখলের প্রেস বিলের সংশোধনী প্রস্তাব সমর্থন (৮ই ফেব্রুয়ারি) ছাড়াও যে বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে খোদ বড়লাটের সঙ্গে বাগযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে জিন্না ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নূতন ইতিহাস সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে পার্লামেন্টারিয়ান হিসাবে দেশবাসীর বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেন তা হল দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত ভারতবাসীদের স্বাধিকার অন্দোলনের সমর্থন। ভারতের যে দুই নেতাকে ভবিষ্যতে দুই বিরোধী শিবিরের কর্ণধার হতে হয়েছিল তাঁদের প্রথম পরিচয় (সাক্ষাৎভাবে না হলেও) পরস্পরের গুণগ্রাহী হিসাবে—এ ইতিহাসের আর এক খামখেয়ালী। যাই হোক গোখলে কর্তৃক উত্থাপিত ঐ প্রস্তাবের সমর্থনে জিন্না বলেন:
“মাই লর্ড, গোড়াতেই আমি এমন একটি বিষয় সম্বন্ধে বলতে চাই যা অত্যন্ত বেদনাজনক। এই সমস্যাটি এদেশের সর্বস্তরের মানুষের আবেগকে উত্তাল করে তুলেছে এবং তাদের ঘৃণা ও আতঙ্কের ভাবকে উত্তুঙ্গে উপনীত করেছে। বিষয়টি হল—দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতবাসীর প্রতি অত্যন্ত রূঢ় ও নিষ্ঠুর আচরণ।
সভাপতি (বড়লাট লর্ড মিন্টো):
“মান্যবর মহোদয়কে শান্ত হতে (to order) বলতে হচ্ছে। আমার মতে ‘নিষ্ঠুরতা’ শব্দটি অত্যন্ত কঠোর। মাননীয় সদস্য মনে রাখবেন যে তিনি সাম্রাজ্যের এক বন্ধুত্বসম্পর্কযুক্ত অঙ্গের সম্পর্কে কথা বলছেন এবং তাই তাঁর ভাষাও পরিস্থিতি অনুকূল হওয়া উচিত।”
মাননীয় শ্রীযুক্ত জিন্না:
“মাই লর্ড, আমার আরও কঠোর শব্দ প্রয়োগের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমি এই কাউন্সিলের বিধান সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে সচেতন এবং তাই আমি এক মুহূর্তের জন্যও সে বিধান ভঙ্গ করতে চাই না। তবুও আমি বলছি যে ভারতবাসীদের প্রতি যে ব্যবহার করা হচ্ছে তা অকল্পনীয় রকমের রূঢ়তম এবং পূর্বেই আমি যে কথা বলেছি, এর কারণে এদেশের মনোভাব বাদ-বিবাদের ঊর্ধ্বে।”(১)
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬-২৯শে ডিসেম্বর এলাহাবাদের ২৫তম কংগ্রেস অধিবেশনে জিন্না সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন ব্যবস্থার নিন্দা করে এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। (২) মাত্র কিছুদিন পূর্বে মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারের মাধ্যমে মুসলমানরা এই অধিকার পেয়ে উল্লসিত। ঐসময়ে এর প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে বুকের পাটার দরকার ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখনীয়, আর এক জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতা এবং রাজেন্দ্রপ্রসাদের প্রায় গুরুস্থানীয় বিহারের মৌলভী মজরুল হক্ ছিলেন এই প্রস্তাবের সমর্থক। বক্তৃতাপ্রসঙ্গে জিন্না মিউনিসিপ্যালিটি ও জেলা বোর্ড প্রমুখ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবির বিরোধিতা করে মন্তব্য করেন যে এ মত “তাঁর ব্যক্তিগত” এবং “মুসলমান সম্প্রদায়ের দ্বারা -অধিকৃত হয়ে’(৩) তিনি এ প্রস্তাব করছেন না।
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের নববর্ষেও জিন্না এলাহাবাদে স্যার উইলিয়াম ওয়েডারবানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হিন্দু মুসলমান ঐক্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ৫ই জানুয়ারি ওয়েডারবানের নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলমান সদস্যদের দ্বারা গঠিত এক প্রতিনিধিমণ্ডলের বিশিষ্ট সদস্যরূপে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ১৬ই মার্চ গোখলের “এলিমেন্ট্রি এডুকেশান” বিলের সমর্থনে কাউন্সিলে বক্তৃতা দিলেন। ইতিমধ্যে গোখলে-জিন্না জুটি ভারতবর্ষের সংসদীয় রাজনীতিতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। “উভয়েই উভয়কে পছন্দ ও বিশ্বাস করতেন। দেশের উন্নয়নের জন্য উভয়ে সম্মিলিত ভাবে কাজ করতেন। শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু তাঁর ‘অ্যামবাসাডার অফ ইউনিটি’ গ্রন্থে বলেছেন যে জিন্না সে সময়ে বলতেন যে তাঁর আকাঙ্ক্ষা হল গোখলের পদচিহ্ন অনুসরণ করা।”(৪) এই প্রসঙ্গে উল্লেখনীয় যে গান্ধীও গোখলেকে তাঁর রাজনৈতিক গুরুর অভিধা দিয়েছিলেন।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে জিন্না বড়লাটের কাউন্সিলে ভূপেন্দ্রনাথ বসুর পুলিশ প্রশাসন পদ্ধতি ও গোখলের “এলিমেন্ট্রি এডুকেশান” বিলের সমর্থনে বক্তৃতা দেন। তিনি দিল্লি দরবারেও(৫) যোগ দেন। ডিসেম্বরের ২৬-২৮শে কংগ্রেসের অধিবেশনে তাঁর নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিতে নির্বাচন স্বীকৃতি পেয়েছে। ডিসেম্বরের ৩১শে বাঁকিপুরে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভায় বিশেষ আমন্ত্রিত হিসাবে যোগদান করে(৬) তিনি “ভারতবর্ষের পক্ষে উপযুক্ত স্বায়ত্তশাসন” প্রাপ্তি ও “জাতীয় ঐক্য স্থাপনকে” যাতে লীগ তার লক্ষ্যরূপে স্বীকার করে তার জন্য অভিমত ব্যক্ত করেন।
ইতিমধ্যে দিল্লির বিগত (১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে) লীগ অধিবেশন থেকে প্রতিষ্ঠানের পালে যে নূতন হাওয়া লেগেছিল তার কথাও এখানে উল্লেখ করা দরকার। সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়ে যাওয়ায় ঐ অধিবেশনে আগা খাঁ ও আমীর আলী মন্তব্য করেন যে অতঃপর হিন্দুদের সঙ্গে সহযোগিতা করা যেতে পারে। লীগে এই নূতন হাওয়া দেখে তার প্রশংসা করার সঙ্গে সঙ্গে ঐ বছরের কংগ্রেসের সভাপতি উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন প্রস্তাব করেন যে এলাহাবাদের হিন্দু-মুসলিম সম্মেলনে কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্গে লীগের প্রতিনিধিরাও যোগ দিন। কিন্তু ব্রিটিশ স্বার্থের সংরক্ষকদের প্রবল প্রতিরোধে এটা সম্ভবপর হয়নি। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে কলকাতার লীগ অধিবেশনেও হিন্দুদের প্রতি অনুকূল মনোভাব প্রকাশ করা হয়। জিন্না লীগের পালে লাগা এই নূতন হাওয়াকেই পুষ্ট করলেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মে মুসলিম লীগের তদানীন্তন সম্পাদক সৈয়দ ওয়াজির হাসানকে জিন্না এক পত্রে লেখেন যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদের একটি সম্মেলন আহ্বান করা দরকার এবং হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে দুই সম্প্রদায়ের ছাত্ররা যাতে পরস্পরের সঙ্গে যথাসম্ভব অধিক মিত্রতাবন্ধনে আবদ্ধ হয় তার জন্য একই বিদ্যালয়ে পৃথক পৃথক শাখা খুলে হিন্দু মুসলমান ছাত্রদের স্থান দিতে হবে। আজ এদিকে দেশের মুসলমানদের মধ্যেও তখন জাতীয়তাবাদের জোয়ার জাগছে, যদিও তা বহুলাংশে ঐস্লামিক সাযুজ্য-কেন্দ্রিক। তুরস্ক ও পারস্যের (ইরান) জাতীয়তাবাদ যেমন তাঁদের প্রভাবিত করেছিল, তেমনি তুরস্ককে উপলক্ষ করে ডাঃ আন্সারী এবং চৌধুরী খলিকুজ্জমাঁ প্রমুখ আরও অনেকের চিকিৎসা মিশন নিয়ে ঐ দেশে যাওয়া, “জমিন্দার পত্রিকার সম্পাদক মৌলানা জাফর আলীর কন্সটান্টিনোপলে গিয়ে তত্রস্থ ভিজিরকে ভারতীয় মুসলমানদের তরফ থেকে সংগৃহীত টাকার তোড়া দেওয়া ইত্যাদিও তাঁদের মধ্যে নবচেতনা আনার কাজে সাহায্য করে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর উর্দু আল- হিলাল পত্রিকার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের পাঞ্চজন্য নির্ঘোষ প্রচার করতে থাকেন। মৌলানা মহম্মদ আলীর ইংরাজি “কমরেড” এবং উর্দু “হমদর্দ” পত্রিকাও মুসলমানদের আত্মস্থ হয়ে জাতীয়তাবাদের ধারায় অবগাহন করার প্রেরণা দিতে থাকে।
“লীগও এর প্রভাব এড়াতে পারল না এবং ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে লখনউ-এ অনুষ্ঠিত এর অধিবেশনে প্রতিষ্ঠানের সংবিধানে পরিবর্তন হয়। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্যার ইব্রাহিম রহিমতুল্লা। অন্যান্য আদর্শের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে ভারতের উপযুক্ত স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা এর লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারিত হয়। আরও স্থির হয় যে জাতীয় ঐক্যের ব্যাপ্তি, ভারতবাসীর মধ্যে জনসেবার চেতনার বৃদ্ধি ঘটিয়ে প্রচলিত প্রশাসন পদ্ধতিতে ক্রমাগত উন্নতি সাধন করতে হবে। আর এই লক্ষ্য সাধনে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করা হবে। এইভাবে লীগের আদর্শকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অনুকূল করা হয় এবং তার পরিণামে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পথ প্রশস্ত হয় ও অচিরে দুটি সংগঠনের পক্ষে সম্মিলিত পদক্ষেপ করাও সম্ভবপর হয়ে ওঠে।”(৭)
লীগের মার্চের ঐ অধিবেশনে শ্রীমতী নাইডুর সঙ্গে জিন্নাও বিশেষ আমন্ত্রিত হিসাবে যোগদান করেন। সভাপতি স্যার শফী নূতন সংবিধান উপস্থাপিত করে মন্তব্য করেন, “আমার বন্ধু মাননীয় শ্রীযুক্ত জিন্নার সঙ্গে আমি এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ সহমত যে কাউন্সিল প্রস্তাবিত পন্থার পরিবর্তে অপর যে কোনো পন্থা অবলম্বন করা একেবারেই অবিজ্ঞোচিত কাজ হবে।”
লীগ বাঁকিপুরে দেওয়া তাঁর পরামর্শ মেনে নেওয়ায় জাতীয়তাবাদী জিন্নার পক্ষে মুসলিম লীগের সদস্যপদ গ্রহণে আর বাধা রইল না। ১০ই অক্টোবর ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিধিবদ্ধ ভাবে মুসলিম লীগের সভ্য হলেন।


পাদটীকা

১. কাউন্সিলের বক্তৃতার বিবরণ; মজুমদার; সমগ্রন্থ; ২১ পৃষ্ঠা।
২. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; ১৮৭ পৃষ্ঠা।
৩. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৫১৫ পৃষ্ঠা।
৪. মজুমদার; সমগ্রন্থ; ২২ পৃষ্ঠা।
৫. ইতিমধ্যে (ডিসেম্বর ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের সম্রাটের ঘোষণায়) বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেছে এবং বিহার ও উড়িষ্যাকে বাংলা থেকে পৃথক এক প্রদেশে পরিণত করার আয়োজন হচ্ছে।
৬. কিছুদিন পূর্বে ত্রিপোলী ও বল্কান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং মুসলমান ধর্মগুরু ও পার্থিব ব্যাপারেও প্রধান খলিফার পীঠস্থান তুরস্ক এই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে। উভয় যুদ্ধেই ইংরেজ তুরস্কের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করায় ভারতীয় মুসলমানদের ভিতর তুরস্কের সপক্ষে ও ইংরেজদের বিপক্ষে একটা মানসিকতা দানা বাঁধতে থাকে। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়া কর্তৃক পারস্যের অংশবিশেষ গ্রাস এবং ইংরেজদের রাশিয়ার প্রতি সমর্থনও মুসলমানদের ইংরেজের সমালোচক করে তোলে। এ ছাড়া বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় লীগের নেতারা ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। স্বভাবতই মুসলিম লীগের কার্যকলাপেও তাই পূর্বের ইংরেজদের অনুগত ভূমিকার পরিবর্তে ইংরেজবিরোধী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। জিন্নার প্রতি লীগের আকর্ষণ বোধহয় এই সব কারণে। এ ছাড়া জিন্না তখন ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে সমানতালে পাঞ্জা লড়িয়ে দীন তরুণ হিরো এবং দেশের প্রথম সারির নেতা। লীগের তদানীন্তন নেতৃত্ব এমন একজন মুসলমান নেতাকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাবৃদ্ধি করতে মা চাইবেন—এইটাই স্বাভাবিক।
৭. রাজেন্দ্রপ্রসাদ; সমগ্রন্থ; ১১৮ পৃষ্ঠা।

“হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজদূত”– গোখলে

জিন্নার মুসলিম লীগে যোগদান করা সম্বন্ধে সরোজিনী নাইডু লিখেছেন:
“নিজের উদাহরণ দ্বারা জিন্না যে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গী সম্প্রসারিত করার জন্য ইতিমধ্যে এত করেছিলেন, অবশেষে তাতে তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগদান করলেন। তাঁর বিশিষ্ট উচ্চকোটির এবং হয়তো বা কিয়ৎ পরিমাণ উন্নাসিক সম্মানবোধের জন্য ঐজাতীয় একটা সাদাসিধা অনুষ্ঠানও প্রায় একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের রূপ নিল। তাঁর নাম সুপারিশকারী দুইজনকে(১) এই মর্মে এক আগাম পবিত্র প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছিল যে, তাঁর মুসলিম লীগ ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি আনুগত্য কোনোক্রমেই বা কোনো সময়েই, যে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের সাধনে তাঁর জীবন উৎসর্গীত, তার পথে বিন্দুমাত্র বাধক হতে পারবে না।”(২)
জাতীয়তাবাদী মানসিকতার কোন্ উচ্চস্তরে জিন্না উঠেছিলেন, তার নিদর্শন পাওয়া যায় উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে।
যাই হোক জিন্না মুসলিম লীগে যোগদান করে প্রতিষ্ঠানটিকে কংগ্রেসের কাছাকাছি আনার সর্ববিধ প্রচেষ্টা করতে লাগলেন। ঐ বৎসরই আগ্রায় অনুষ্ঠিত লীগের অধিবেশনে (ডিসেম্বর ৩০-৩১) যোগ দিয়ে তিনি “মহম্মদ আলীর সেই সংশোধনী প্রস্তাব সমর্থন করেন যাতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠানসমূহে সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রস্তাবকে আরও এক বছরের জন্য মুলতুবি রাখার কথা বলা হয়।”(৩) কারণ এজাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থা দেশকে দুটি পরস্পর সম্পর্কবিহীন জলনিরোধক কামরার মতো বিভক্ত করে। সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের স্বাদপ্রাপ্ত লীগনেতৃত্ব জিন্নার সে পরামর্শ অগ্রাহ্য করলেও প্রধানত তাঁর উদ্যোগে নিম্নোদ্ধৃত প্রস্তাব স্বীকার করে:
“নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নিজের এই দৃঢ় বিশ্বাসের কথা স্পষ্ট করে ব্যক্ত করতে চায় যে ভারতবর্ষের অধিবাসীদের ভবিষ্যৎ বিকাশ এবং প্রগতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সখ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ও পারস্পরিক সহযোগিতার উপর নির্ভর করে এবং তাই লীগ আশা করে যে উভয় পক্ষ মাঝে মাঝে একত্র হয়ে জনহিতের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ সম্বন্ধে সম্মিলিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেবার উপায় উদ্ভাবন করবেন।”(৪)
মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর পূর্বের দৃঢ় সম্পর্ক বজায় ছিল। কংগ্রেস ও লীগকে কাছাকাছি আনার জন্য তাঁর নিরন্তর প্রয়াস এবং হিন্দু- মুসলিম ঐক্যের জন্য ঐকান্তিক চেষ্টা দেখে গোখলে এই সময়ে জিন্নার সম্বন্ধে তাঁর বিখ্যাত মন্তব্য করেন: “তাঁর ভিতর সাচ্চা বস্তু আছে আর আছে তাবৎ সাম্প্রদায়িক পক্ষপাত ও গোঁড়ামি থেকে মুক্ত সেই মানসিকতা যার জন্য তিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজদূত হতে পারেন।”(৫) ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে ডিসেম্বর তিনি করাচী কংগ্রেসে কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার কার্যকলাপে সংস্কার সাধনের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন এবং তার উপর বিস্তারিত বক্তৃতা দিলেন। নবাব সৈয়দ মহম্মদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ অধিবেশনে ভূপেন্দ্রনাথ বসু লীগের নূতন ভূমিকার প্রশংসা করে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। জিন্নার উদ্যোগে কংগ্রেসের ঐ অধিবেশনে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে কংগ্রেস ও লীগ উভয় প্রতিষ্ঠানেরই ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের বাৎসরিক অধিবেশন বোম্বেতে হবে।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তিনি ভূপেন্দ্রনাথ বসু, লাজপৎ রায়, মজরুল হক্ প্রমুখের সঙ্গে কংগ্রেসের তরফ থেকে শাসন সংস্কারের কথা বলার উদ্দেশ্যে এক প্রতিনিধিমণ্ডলের সদস্যরূপে লন্ডনে যান এবং দলের অন্যতম প্রবক্তারূপে কংগ্রেসের দাবির কথা বিলাতের অনেক অনুষ্ঠানে বলেন। জুনের ৩ তারিখে লন্ডনের “টাইমস” পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতির মাধ্যমে ভারতসচিবের কাউন্সিলে মনোনয়নের বদলে নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতীয়দের যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব দেবার যৌক্তিকতা প্রদর্শন করেন। ঐ মাসেই লীগের সম্পাদক ওয়াজির হাসানকে লীগের পরবর্তী অধিবেশন কংগ্রেসেরই মতো বোম্বেতে আহ্বানের প্রস্তাব করেন এবং লীগ কাউন্সিলের কিছু সদস্যের বিরোধিতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হয়। লন্ডনে থাকাকালীন ৮ই আগস্ট সিসিল হোটেলে অনুষ্ঠিত গান্ধীর (ভারতে স্থায়ীভাবে প্রত্যাবর্তনের মুখে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তখন তিনি বিলাতে) এক সংবর্ধনা সভায় আনন্দ কুমারস্বামী এবং সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতবাসীদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের নেতার ভূয়সী প্রশংসা করেন।(৬) ভারতের বর্তমান শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাসে যে দুই নেতার ভূমিকা সর্বাগ্রগণ্য, এই তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎকার। কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে (ডিসেম্বর ২৮-৩০) নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই ফেব্রুয়ারি বোম্বের মুসলমান ছাত্র ইউনিয়নের উদ্বোধকের ভাষণে বলেন যে, শৃঙ্খলাযুক্ত নৈতিক জীবন গড়ে তোলার সঙ্গে তারা যেন “রাজনীতিতে আগ্রহশীল হয়, তবে আন্দোলনাত্মক রাজনীতির সংস্রব এড়িয়ে চলে।”(৭) মে মাসে লোকান্তরিত গোখলের স্মরণ-সভায় তাঁর স্মারক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অক্টোবরে “টাইমস অফ ইন্ডিয়া” পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রে কংগ্রেস ও লীগের অধিবেশন একই স্থানে আয়োজিত করে ভারতের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আলোচনার প্রস্তাব করেন। নভেম্বরের ১১ই মুসলিম নেতা ও জনসাধারণকে আবেদন জানান যে তাঁরা যেন “হিন্দুদের”(৮) সঙ্গে একসাথে চলার উদ্দেশ্যে এবং এক সম্মিলিত ফ্রন্ট গড়ার জন্য “নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হন।”(৯)
বিগত বছরে কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে পরস্পরের কাছাকাছি আসার যে প্রবণতা দেখা দিয়েছিল তা আরও পুষ্টিলাভ করে। টেন্ডুলকরের মতে “শ্রীযুক্ত মহম্মদ আলী জিন্নার জন্যই প্রধানত এই নূতন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল।”(১০) স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে একটি প্রস্তাবের (১৯তম) মাধ্যমে কংগ্রেস “নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিকে শাসন সংস্কার এবং নিরবচ্ছিন্ন কাজ, গণশিক্ষা ও প্রচারের জন্য একটি পরিকল্পনা রচনা করার নির্দেশ দিল। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিকে এই অধিকারও দেওয়া হল যাতে এই উদ্দেশ্যে লীগ কমিটির সঙ্গে আলোচনা করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।”(১১) দিনকয়েক পর (১লা জানুয়ারি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ) ঐ বোম্বেতেই লীগের অধিবেশনে হসরৎ মোহানী ও আরও কিছু কট্টরপন্থীদের প্রবল বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে জিন্নার নিম্নোক্ত মর্মের প্রস্তাব বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে গৃহীত হয় “…. কংগ্রেসের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরামর্শক্রমে শাসন সংস্কারের পরিকল্পনা রচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হল। তাবৎ রাজনৈতিক দল যেন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয় এই আশা ব্যক্ত করা হল। ঘোষণা করা হল যে কংগ্রেস ও লীগ হল ভারতবর্ষের দুই প্রধান প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।”(১২) তাঁর প্রস্তাবক্রমে(১৩) হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধানকল্পে লীগ ও কংগ্রেসের একটি যুক্ত কমিটি গঠিত হয়। লীগ অধিবেশনের সভাপতি মজহরুল হক প্রকাশ্য সভায় জিন্নার এই ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। লীগের ঐ অধিবেশনে আরও অনেকের সঙ্গে গান্ধী, মালব্য ও সরোজিনী নাইডু প্রমুখ কংগ্রেস নেতারা যোগ দিয়েছিলেন। দুই প্রতিষ্ঠানের একই শহরে বার্ষিক অধিবেশনের এই প্রথা কংগ্রেস ও লীগের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণকে এত কাছাকাছি আনে যে পরে মৌলানা মহম্মদ আলী সে সম্বন্ধে নিম্নোদ্ধৃত এক মন্তব্য করেছিলেন:
“মুসলমানদের প্রগতি এত দ্রুত হয়েছে যে তাঁদের মধ্যে থেকেই এক রসিক সমালোচক এই মন্তব্য করেছেন যে লর্ড সিনহা…তাঁর বিহারী প্রতিবেশী এবং মুসলিম লীগের অধিবেশনের সভাপতি আইনজীবী ভ্রাতার সঙ্গে একই রেলগাড়ির কামরায় ভ্রমণ করেছিলেন এবং তুলনামূলকভাবে বিচার করার জন্য একে অপরকে স্ব স্ব সভাপতির অভিভাষণ দেখতে দিয়েছিলেন। কিন্তু…উভয় সভাপতিই তারপর নিজ নিজ অভিভাষণ ফেরত নিতে ভুলে যান। ফলে দৈবের নির্বন্ধে মৌলানা মজহরুল হক্ তাঁর মুসলমান শ্রোতৃমণ্ডলীর সম্মুখে নিজের বলে যে ভাষণ পড়েন তাতে বাঙালিসুলভ তীক্ষ্ণ বাগ্মিতা ছিল। আর অনুরূপ পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের সামনে লর্ড সিনহা যে অভিভাষণ পাঠ করেন তাতে পাওয়া যায় চিরকালের রাজানুগত মুসলমানদের সতর্কতা ও থেকে থেকে থমকে দাঁড়ানোর সুর।”(১৪)
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের প্রথমার্ধে ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে নবচেতনার যে প্রবল ভাগীরথীপ্রবাহ, তার আবাহনকারী ভগীরথত্রয়ের মধ্যে জিন্না অন্যতম। অপর দুইজন তিলক ও শ্রীমতী বেসান্ত। ৬ই জুন “প্রেস আইনের” প্রতিবাদে সরকারকে একটি স্মারকপত্র দেবার জন্য বোম্বের এক জনসভায় যে কমিটি গঠিত হয়, জিন্না তার সদস্য মনোনীত হন। ২১শে জুন আবার ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। আগস্টের ৭-১২ই পুণার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে রাজদ্রোহমূলক বক্তৃতার অভিযোগে অভিযুক্ত তিলকের পক্ষ সমর্থন করেন। অক্টোবরের ২১শে আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত ষোড়শ বোম্বাই প্রাদেশিক সম্মেলনের সভাপতিরূপে শাসন-সংস্কারের সপক্ষে বলার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। যদিও কংগ্রেসের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্কের ব্যাপারে সরকারি বক্তব্য (Moral and Material Progress and Conditions of India) প্রামাণ্য নয়, তবু জিন্নার সেই সময়কার ভূমিকা উপলব্ধি করতে ঐ প্রতিবেদনের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি মূল্যবান: “১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে বোম্বেতে যখন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অধিবেশন হয় তখন হিন্দু-মুসলিম সমঝোতা প্রথম রূপ নেওয়া আরম্ভ করে; ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে আহমেদাবাদে শ্রীযুক্ত এম.এ. জিন্নার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনে পূর্বোক্ত বোঝাপড়া বিপুল শক্তিশালী হয়। তাঁকে তখন লীগের পরবর্তী বাৎসরিক অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচন করা হয়েছে। তিনি হিন্দুদের কংগ্রেস দলের একটি সম্মেলনেরও সভাপতিত্ব করেন, যে দল কিনা ইতিপূর্বে একান্তভাবে হিন্দু- প্রভাবিত ছিল।”(১৫)
পৃষ্ঠা: ২৫

ঐ বৎসর বোম্বের অনুকরণে লখনউ-এ অনুষ্ঠিত প্রথমে কংগ্রেসের (২৫-২৮ ডিসেম্বর) ও পরে (ডিসেম্বর ৩০-৩১) লীগের অধিবেশনকে জিন্নার বিজয়- বৈজয়ন্তীশোভিত অধিবেশন বলা চলে। লখনউ কংগ্রেসেই সরোজিনী নাইডু মুসলিম ঐক্যের জন্য জিন্নার প্রয়াসের ভূয়সী প্রশংসা করার সময় তাঁর সম্বন্ধে গোখলের বিখ্যাত উক্তির পুনরুদ্ধৃতি দেন— “হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজদূত।” সেবারে কংগ্রেস অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন অম্বিকাচরণ মজুমদার। ইতিমধ্যে কংগ্রেস ও লীগের যৌথ কমিটি এলাহাবাদ ও কলকাতায় মিলিত হয়ে বাংলা ও পাঞ্জাব ছাড়া আর সব প্রদেশের আইনসভায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নের একটা সর্বজনমান্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। সে ব্যাপারেও জিন্নার বিশেষ ভূমিকা ছিল। বাকিটুকু লখনউ-এ সমাধা হল। কংগ্রেস-লীগ সমঝোতাতে শতকরা ২০জন মনোনীত সদস্যের অবকাশ থাকলেও প্রশাসকদের আইনসভার অধীন করার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আসন বাঁটোয়ারার প্রশ্নের মীমাংসা করা হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় মুসলমান সংখ্যালঘুদের জন্য আসন বণ্টন হল নিম্নহারে:
“পাঞ্জাবে নির্বাচিত সদস্যদের অর্ধেক, সংযুক্ত প্রদেশে শতকরা ৩০ ভাগ, বাংলায় শতকরা ৪০ ভাগ, বিহারে শতকরা ২৫ ভাগ, মধ্যপ্রদেশে শতকরা ১৫ ভাগ, মাদ্রাজে শতকরা ১৫ ভাগ এবং বোম্বাই প্রদেশে তিন ভাগের এক ভাগ, ইম্পিরিয়াল অথবা প্রাদেশিক কোনো নির্বাচনেই তাঁরা এই বিশেষ স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের কোটার বহির্ভূত আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। এই ব্যবস্থাও রইল যে, ‘…এক অথবা অপর সম্প্রদায়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিল…নিয়ে কেবল তখনই আলোচনা হবে যদি সংশ্লিষ্ট আইনসভার সেই সম্প্রদায়ের সদস্যদের অন্তত তিন-চতুর্থাংশ সেই বিলের বিরোধিতা না করেন।’ ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলের… নির্বাচিত ভারতীয় সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ হবেন মুসলমান। তাঁরা নির্বাচিত হবেন মুসলমানদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা যার অনুপাত হবে… যে হারে তাঁরা প্রকৃত মুসলমান ভোটারদের দ্বারা প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে প্রতিনিধিত্বপ্রাপ্ত।’(১৬)
পূর্বোক্ত সমঝোতা আর কয়েকদিন পরেই ঐখানে জিন্নার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত লীগের অধিবেশনেও গৃহীত হয়, লীগকে দিয়ে ঐ চুক্তি অনুমোদন করিয়ে নেবার জন্য বিশেষ ভূমিকা নেওয়া ছাড়াও সভাপতির অভিভাষণে জিন্না বলেন:
“হিন্দুদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী হবে শুভেচ্ছা এবং ভ্রাতৃভাবাপন্ন। আমাদের চালক নীতি হবে দেশের স্বার্থে তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা। দুই ভ্রাতৃপ্রতিম মহৎ সম্প্রদায়ের ভিতর যথার্থ বোঝাপড়া এবং হৃদ্যতাপূর্ণ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হলেই কেবল ভারতবর্ষের যথার্থ প্রগতি আপনার সম্ভবপর হবে। (১৭)
জিন্নার কণ্ঠে এক নূতন সুর যা মুসলিম লীগের মঞ্চে অতীতে কখনও শোনা যায়নি: “প্রথম নিখিল ভারত মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রধান ভিত্তি ছিল— ভারতবর্ষের রাজনৈতিক বিবর্তনের গতিপথের প্রতিটি বাঁকে যখন যে কোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থাপিতকরণের অবকাশই আসুক না কেন, মুসলমান সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যকে দৃঢ় এবং অবিকৃত রূপে রেখে দেওয়া। এই সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক জীবন ও চিন্তাধারার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পূর্বোক্ত নীতিরও বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ ঘটেছে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সামান্য দৃষ্টি- ভঙ্গী ও আদর্শের ক্ষেত্রে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দণ্ডায়মান এবং সামগ্রিক ভাবে ভারতবর্ষের অগ্রগতির উদ্দেশ্যে যে কোনো দেশাত্মমূলক প্রয়াসের অংশীদার হতে প্রস্তুত।'(১৮)
লখনউ-এর ঐ চুক্তির বৈশিষ্ট্য এই যে কেবল তিলকের(১৯) মতো চরমপন্থী নেতাই তার প্রশংসা করেননি, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নরমপন্থী নেতাও এর সমর্থনে বলেছিলেন, “…হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভাবগত ঐক্যের চূড়ান্ত নিদর্শন এ। আজ মুসলমান সমাজের নেতৃবৃন্দ কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের আমি ভূয়সী প্রশংসা জানাই। দুই বাহু সম্প্রসারিত করে তাঁরা আমাদের গ্রহণ করেছেন।”(২০) এর অপর বৈশিষ্ট্য হল এই যে আসন বাঁটোয়ারার ঐ হার এমনকি মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের প্রস্তাবেও গৃহীত হয়েছিল।
লখনউ-এর ঐ বোঝাপড়া এইজন্য সম্ভবপর হয়েছিল যে জিন্না ও অপরাপর মুসলমান নেতৃবৃন্দ একথা স্পষ্টভাবে জানান যে পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা ও অন্যান্য রক্ষাকবচ একান্তভাবে সাময়িক ব্যবস্থা। এ কেবল ততদিনের জন্যই যতদিন না মুসলমান সমাজ তার বর্তমান অনগ্রসর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারছে। ভবিষ্যতে এর প্রয়োজন আর থাকবে না। মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের প্রস্তাব বিবেচনার জন্য গঠিত পার্লামেন্টারি কমিটির সম্মুখে সাক্ষ্য দেবার সময়ে জিন্না দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একথা ঘোষণা করেন। নিম্নে জিন্নার সাক্ষ্য থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হচ্ছে:
“মেজর অমসবি গোর, এম.পি. – আপনি বললেন যে আপনি ভারতবর্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে বলছেন। আপনি কি তবে ভারতের জাতীয়তাবাদী হিসাবে বলছেন?”
“শ্রীযুক্ত জিন্না—আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“মেজর গোর—অর্থাৎ আপনার বক্তব্য হল রাজনৈতিক জীবনে যথাসম্ভব শীঘ্র মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে পার্থক্য করা বন্ধ হোক—এই আপনি চান।”
“শ্রীযুক্ত জিন্না—আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার কাছে ঐ শুভ দিনটির থেকে অধিকতর আনন্দদায়ক আর কিছু হতে পারে না।”(২১)
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে জিন্না ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেগুলি হল ভারতীয়দের সশস্ত্র বাহিনীতে অফিসারের পদ দেওয়া, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, সরকারি চাকরির ভারতীয়করণসহ অন্তত আই.সি.এস.-দের অর্ধেক পদ ভারতবাসীদের দেওয়া, ভারত ও বিলাত উভয় দেশে যুগপৎ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা গ্রহণ, ঢাকা ও পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় বিল, ভারতবাসী ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সমতা প্রবর্তন ইত্যাদি। এছাড়া তিনি এই বছর শ্রীবাস শাস্ত্রী, তেজবাহাদুর সপ্রু এবং ওয়াজির হাসানের সঙ্গে কংগ্রেস ও লীগের এক যুক্ত প্রতিনিধিমণ্ডলের সদস্য হিসাবে লন্ডনে গিয়েছিলেন লখনউ চুক্তির ভিত্তিতে শাসন সংস্কারের দাবি নিয়ে। ২৮শে জুলাই বোম্বেতে হোমরুল লীগের বন্দী নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে লীগ কাউন্সিল ও নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সম্মিলিত সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন। ইতিমধ্যে হোমরুল লীগের সভানেত্রী শ্রীমতী বেসান্ত ও তাঁর অন্যান্য সহকর্মীদের অন্তরীণ করার সরকারি আদেশের প্রতিবাদেই যেন তিনি হোমরুল লীগে যোগ দিয়ে তার বোম্বে শাখার সভাপতি হন এবং শ্রীমতী বেসান্তকে পাঠানো এক চিঠিতে লেখেন: “মুসলমানদের প্রতি আমার নিবেদন হল এই যে তাঁরা যেন তাঁদের হিন্দুভাইদের হাতে হাত মেলান। হিন্দুদের প্রতি আমার নিবেদন হল—আপনাদের অনগ্রসর ভাইদের উত্থানের সহায়ক হোন। এই আদর্শ নিয়েই যেন হোমরুল লীগের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং তাহলে আমাদের পক্ষে আর ভয়ের কারণ থাকবে না।” অক্টোবরের ৬ তারিখে অনুরূপ উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত লীগ ও কংগ্রেসের সম্মিলিত সভায় যোগদান করেন এবং উক্ত সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে এক নিখিল ভারতীয় প্রতিনিধিমণ্ডলের সদস্য হিসাবে ২৬শে অক্টোবর বড়লাটের সঙ্গে দেখা করেন। এছাড়া জুলাই-এ দুবার ও নভেম্বরে একবার বোম্বেতে এবং অক্টোবরে একবার এলাহাবাদে হোমরুল লীগের সভায় যোগ দেন এবং শেষোক্ত সভায় বলেন যে ভারতের স্বায়ত্ত শাসনের জন্যই তিনি হোমরুল লীগে যোগ দিয়েছেন।
ঐ বছরেও কংগ্রেস ও লীগের বাৎসরিক অধিবেশন একই সময়ে ও একই শহরে অর্থাৎ কলকাতায় হল। কংগ্রেসের সভাপতি অ্যানি বেসান্ত এবং লীগের জিন্না। উভয় অধিবেশনেই কংগ্রেস-লীগ প্রস্তাব গ্রহণের দাবি উঠল। কংগ্রেস অধিবেশনে জিন্না এতদ্‌সংক্রান্ত প্রস্তাবের সমর্থনে যুক্তিজাল বিস্তার করেন। লীগের অধিবেশনে গান্ধী ও সরোজিনী নাইডু যোগ দিয়ে আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের মুক্তির স্বপক্ষে উত্থাপিত প্রস্তাবের উপর বক্তৃতা দিলেন। হিন্দুদের অভিসন্ধি সম্বন্ধে সংশয়িত লীগের সহকর্মীদের উদ্দেশে জিন্না বললেন, “আপনাদের শত্রুদের প্ররোচনায় আতঙ্কিত হয়ে হিন্দুদের সঙ্গে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকবেন না। কারণ স্বায়ত্তশাসন প্রাপ্তির জন্য এই সহযোগিতা অপরিহার্য।”(২২)
ভারতের জনমতও ঐসময় উদ্দাম হয়ে উঠেছিল হোমরুলের দাবিকে কেন্দ্র করে। অ্যানি বেসান্ত, এরুন্ডুলে প্রমুখ—এর নেতাদের অন্তরীণ করলেও জনমত অবদমিত হয়নি। এছাড়া আলী ভ্রাতৃদ্বয় এবং মৌলানা আজাদও বন্দী। বিভিন্ন প্রাদেশিক কংগ্রেস ও লীগ কমিটি বন্দীমুক্তি নিয়ে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের কথা বিবেচনা করছে। এর মধ্যে ভারতের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা শাসন সংস্কারের কথা বলছেন, যদিও অপর একদল এর প্রতিকূল। কিছু কিছু রক্ষণশীল ব্রিটিশ নেতা লখনউ চুক্তি অনুযায়ী ইম্পিরিয়াল কাউনসিলের ১৯জন নির্বাচিত সদস্যের (এতে জিন্নারও প্রচুর ভূমিকা ছিল) প্রস্তাবে “বিদ্রোহ” ও “জার্মান ষড়যন্ত্রের” গোপন হস্ত দেখে তার বিরোধিতা করছেন। পাঞ্জাব ও মাদ্রাজের ছোটলাটরা ভারতীয়দের আরও ক্ষমতা দেবার প্রস্তাবের আদৌ অনুকূল নন।
বছরের মাঝামাঝি মেসোপটেমিয়ায় (যেখানে অধিকাংশ ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধরত ছিল) ইংরেজদের শোচনীয় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবার ফলে প্রথম মহাযুদ্ধে ভারতীয় সৈনিকদের সদুপযোগের প্রশ্নে তদানীন্তন ভারতসচিব অষ্টিন চেম্বারলেন পার্লামেন্টে তীব্রভাবে সমালোচিত হন। ফলে তিনি পদত্যাগ করলেন এবং পার্লামেন্টে তাঁর সমালোচক ও ভারতদরদীরূপে খ্যাত ৩৬ বছর বয়স্ক মন্টেগু তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। ২০শে আগস্ট মন্ত্রিসভার তরফ থেকে তিনি ঘোষণা করলেন যে ভারতবর্ষে ক্রমশ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করে ভারতবাসীদের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করাই ব্রিটিশ সরকারের নীতি। এর ফলে শ্রীমতী বেসান্ত ও তাঁর সহকর্মীরা মুক্ত হলেন এবং পূর্বে উল্লিখিত ৬ই অক্টোবরের লীগ কাউন্সিল ও নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সম্মিলিত সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সংঘর্ষের পথে না গিয়ে বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডের কাছে এক প্রতিনিধিমণ্ডল পাঠানো হল। ইতিমধ্যে গান্ধীর পরামর্শে কংগ্রেস-লীগ প্রস্তাবের অনুবাদ ভারতীয় ভাষাসমূহে করিয়ে তার সমর্থনে ২০ লক্ষ দেশবাসীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করে জনমত তৈরি করার একটা ব্যাপক কর্মসূচী পালিত হল। মন্টেগু স্বয়ং ভারতবর্ষে চেমসফোর্ডের সঙ্গে নানাস্থানে সফর করে শাসন সংস্কার সম্বন্ধে সবার মতামত যাচাই করলেন।
মহাযুদ্ধের প্রতি ভারতের দৃষ্টিকোণ কি হবে এ নিয়ে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকেই জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছিল। জিন্না গান্ধীর মতো নৈতিক কারণে যুদ্ধপ্রচেষ্টার নিঃশর্ত সমর্থনের মতাবলম্বী ছিলেন না। তাঁর ভূমিকা ছিল—এর জন্য প্রথমে ভারতবাসীদের “ইউরোপীয় ব্রিটিশ প্রজাদের সঙ্গে এক পর্যায়ের বলে স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন”। জিন্নার ভূমিকাকে বড়লাট চেমসফোর্ড “দরাদরি” বলে ভর্ৎসনা করায় জিন্না প্রকাশ্যভাবে এর প্রতিবাদে অকুতোভয়ে বলেন: “আমার স্বদেশের সম্রাটের সমান অধিকারসম্পন্ন প্রজা হিসাবে নিজের আত্মসম্মানপরবশ আমি যদি আমার সরকারের মুখের উপর বলি যে আজকের বিধিনিষেধ দূর করতেই হবে—তবে তা কি দরাদরি করা? মাই লর্ড, নিজের স্বদেশে আমাকে ইউরোপীয় ব্রিটিশ প্রজাদের সমমর্যাদা দেওয়া হোক দাবি করা কি দর কষাকষি? এর নাম কি দরাদরি?”(২৩) ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে বড়লাট কর্তৃক আহূত “যুদ্ধসম্মেলনে” জিন্নার বক্তব্য সরকারি প্রস্তাবের বিরোধী বলে বড়লাট তা বিধিবহির্ভূত বলে বাতিল করায় জিন্না এক তারবার্তায় লর্ড চেমসফোর্ডকে জানান: “আমাদের স্বদেশের জন্য যে নীতি অস্বীকার করা হয়েছে, তার কারণ আমাদের যুবকদের যুদ্ধ করার জন্য আমরা বলতে পারি না।… সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য ভারতবর্ষকে যদি যথেষ্ট আত্মত্যাগ করতে হয় তাহলে তা সম্ভব সাম্রাজ্যের অংশীদার হিসাবে, তার অধীন হিসাবে নয়।…প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে কংগ্রেস-লীগ পরিকল্পনার ভিত্তিতে পার্লামেন্টের অনুমোদনক্রমে নির্ধারিত একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা হোক এবং অবিলম্বে এর জন্য পার্লামেন্টে একটি বিল উপস্থাপিত করা হোক।”(২৪)


পাদটীকা

১. সম্ভবত মহম্মদ আলী এবং ওয়াজির হাসান।
২. Mohammad Ali Jinnah, an Ambassador of Unity। পৃ. ১১। মজুমদার কর্তৃক সমগ্রন্থের ২৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৩. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ, ৫১৭ পৃষ্ঠা।
৪. মতলুবুল হাসান সঈদ; Mohammad Ali Jinnah: A Political Study (অতঃপর Jinnah রূপে অভিহিত হবে); লাহোর (১৯৪৫); পৃ. ৫১। মজুমদার কর্তৃক সমগ্রন্থের ২৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৫. সঈদ; Jinnah; পৃ. ৫১। মজুমদার কর্তৃক সমগ্রন্থের ২৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৬. ডি.জি.টেন্ডুলকর; Mahatma; প্রথম সংস্করণ (১৯৫১); প্রথম খণ্ড; ১৮৭ পৃষ্ঠা।
৭. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৫১৮ পৃষ্ঠা।
৮. সমগ্রন্থ; ৫১৮ পৃষ্ঠা।
৯. সকল সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় স্বায়ত্তশাসনের জন্য আগ্রহী রূপান্তরিত মুসলিম লীগ।
১০. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড, ২৪ পৃষ্ঠা।
১১. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ, প্রথম খণ্ড; ২০৯ পৃষ্ঠা। ১২. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৫১৮ পৃষ্ঠা।
১৩. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; ২১৮ পৃষ্ঠা।
১৪. সঈদ; Jinnah; পৃ. ১২০। মজুমদার কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১৫. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; ২৩১ পৃষ্ঠা।
১৬. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড, ৪৩-৪৪।
১৭. সঈদ; Jinnah পৃ. ৬৪। মজুমদার কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৬ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১৮. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; ২৩৫ পৃষ্ঠা।
১৯. সুরাট কংগ্রেসের দক্ষযজ্ঞের পর এই আবার চরমপন্থীরাও কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন।
২০. এম. আর. জয়াকর; The Story of My Life; ভারতীয় বিদ্যাভবন, বোম্বাই পৃ. ১৫৬। মজুমদার কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৫ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২১. জয়াকর; The Story of My Life; পৃ. ১৬১। মজুমদার কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৭ ৮ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২২. সঈদ; Jinnah, পৃ. ১৫৯। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৫৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২৩. কেন্দ্রীয় আইন সভার বাজেট বিতর্ক। ১৯১৭-১৯১৮। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৫৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২৪. সঈদ; Jinnah; পৃ. ১৮। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৫৫ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।

রাউলাট বিলের বিরোধ ও কাউনসিল থেকে পদত্যাগ

অবশেষে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের জুনে মন্টেগু-চেমসফোর্ড বা সংক্ষেপে মন্টফোর্ড প্রস্তাব প্রকাশিত হল। পূর্বেই যেমন বলা হয়েছে, এতে আসন বণ্টনের ব্যাপারে কংগ্রেস-লীগের যৌথ প্রস্তাব মোটামুটি স্বীকৃত হয়। কিন্তু এতে আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল মন্ত্রীসভার প্রস্তাব থাকলেও যথার্থ স্বায়ত্তশাসন এবং ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, আইনের সামনে ইংরেজ ও ভারতীয়দের সমান মর্যাদা ইত্যাদির অবকাশ ছিল না বলে বোম্বেতে হাসান ইমামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে হতাশা ব্যক্ত করা হল। এছাড়া আলী ভ্রাতৃদ্বয় ও মৌলানা আজাদ তখনও বন্দী এবং শ্রীমতী বেসান্ত, বিপিনচন্দ্র পাল ও তিলকের উপর দেশের কোনো কোনো জায়গায় যাবার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত না হওয়ায় ব্রিটিশ শাসকদের সদিচ্ছার প্রতিও সন্দেহের কারণ ছিল। এই নিয়ে বড়লাটের কাছে কংগ্রেসের যে প্রতিনিধিমণ্ডল গিয়েছিল জিন্না ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। একই সময়ে মাহমুদাবাদের রাজার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত লীগের অধিবেশনেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২৬-৩১শে ডিসেম্বর দিল্লিতে মদনমোহন মালব্যের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশন হয়। জিন্না এতে যোগ দেন এবং পুনরপি নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য মনোনীত হন।
ইতিমধ্যে প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান ঘটেছে এবং আমেরিকার রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ প্রভৃতি নিজেদের সপক্ষে আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতির জয়গান করেছেন। স্বভাবতই কংগ্রেস মন্টফোর্ড শাসন সংস্কারের প্রস্তাবকে মিত্রপক্ষের ঐ সুউচ্চ আদর্শের আলোকে বিশ্লেষণ করে তার ত্রুটি-বিচ্যুতি জনসমক্ষে তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে প্রদেশসমূহে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে রাউলাট কমিটির রিপোর্ট, ভারতরক্ষা আইন, প্রেস আইন ইত্যাদির প্রতি বিরোধ জ্ঞাপন করল।
লীগের বাৎসরিক অধিবেশনও ঐ দিল্লিতেই হল এবং অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ডাঃ আন্সারী ও মূল সভাপতি ফজলুল হক্ উভয়েই ছিলেন কংগ্রেসপন্থী। জিন্না তো ছিলেনই। সেবারকার লীগের অধিবেশনে শাসন সংস্কারের সম্বন্ধে কংগ্রেসের অনুরূপ প্রস্তাব গ্রহণ করা ছাড়াও আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল যার উল্লেখ করা প্রয়োজন। মহাযুদ্ধে জার্মানির সঙ্গে থাকলেও তুরস্কের খলিফার(১) কোনোরকম ক্ষতি করা হবে না— মহাযুদ্ধ চলাকালীন এই মর্মে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার খলিফার অধিকার খর্ব করার ব্যবস্থা করলেন। স্বভাবতই অন্যান্য দেশের মুসলমানদের মতো ভারতবর্ষের মুসলমানরাও খিলাফৎ বজায় রাখার জন্য উন্মুখ হলেন। লীগের দিল্লি অধিবেশনে এই মর্মে এক প্রস্তাব এলে জিন্না এই বলে তার বিরোধিতা করলেন যে এ ব্যাপারে অভিমত ব্যক্ত করার বৈধানিক অধিকার লীগের নেই, কারণ খিলাফৎ সরকারের বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে লীগ প্রতিনিধিদের অধিকাংশকে স্বমতে আনতে না পারায় জিন্না কয়েকজন সমমতাবলম্বী প্রতিনিধিসহ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে চলে যান।(২) জিন্নার সংবিধাননিষ্ঠ চরিত্র এবং প্যান-ইসলামিক মানসিকতার প্রতি তাঁর দৃষ্টিকোণ বোঝার
পৃষ্ঠা: ৩১

জন্য ঘটনাটির গুরুত্ব আছে।
জিন্নার জীবনের ঘটনাবৃত্ত সম্পূর্ণ করতে এবার আমরা একটু পিছনের দিকে ফিরে যাব এবং ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলে তাঁর ক্রিয়াকলাপের কথা বাদ দিয়ে অন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে ঐ বছর তিনি যুক্ত ছিলেন তার উল্লেখ করব। ১০ই জুন জিন্না বোম্বেতে সরকারি “যুদ্ধ সম্মেলনে” যোগ দিয়ে হোমরুল লীগের আনুগত্য, সিভিল সার্ভিসের ভারতীয়করণ এবং দেশে দায়িত্বশীল সরকার স্থাপনের প্রশ্নে ছোটলাট লর্ড উইলিংডনের সঙ্গে প্রকাশ্য বাকবিতণ্ডায় প্রবৃত্ত হন। ছোটলাটের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ সম্মেলনে জিন্নার বক্তৃতা কেবল নৈতিক সৎসাহসেরই দ্যোতক নয়, রাজনীতি বিষয়ে তাঁর দূরদৃষ্টিরও পরিচায়ক, যা ঐ বক্তৃতার অংশবিশেষ থেকে স্পষ্ট হবে। যুদ্ধজয়ের জন্য কেবল ভাড়াটে সিপাহী দিয়ে কাজ হবে না, ভারতের যুবকদের দ্বারা জাতীয় সৈন্যবাহিনী গড়ার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বললেন: “তারা এই কথা অনুভব করা পছন্দ করে যে তারা সাম্রাজ্যের নাগরিক। আর এইরকম হলেই তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসবে ও স্বার্থত্যাগ করবে।… আমরা কেবল কথা শুনতে চাই না। এ ব্যাপারটার নিষ্পত্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতুবি করা হোক এও আমরা চাই না। আমরা চাই কাজ এবং অবিলম্বে তার ক্রিয়ান্বয়ন।…ভারতবর্ষকে সাম্রাজ্যের অংশীদার না করা পর্যন্ত, তাকে বিশ্বাস না করা পর্যন্ত আমরা ভারতের যথার্থ প্রতিরক্ষায় সফল হব না, সাম্রাজ্যকে সাহায্য করা তো আরও দূরের কথা।”(৩) বলা বাহুল্য জাতীয়তাবাদের পক্ষে এত স্পষ্ট অভিমত এবং তাও ছোটলাটের মুখের উপর, সভাপতির ভাল লাগেনি এবং সভাপতি ছোটলাট উইলিংডন জিন্নার বক্তৃতায় পদে পদে বাধা দিয়েছিলেন।
সাতদিন পরে বোম্বের এক জনসভায় হোমরুল লীগের প্রতি ছোটলাটের অপমানজনক দৃষ্টিকোণের জন্য জিন্না তাঁর খোলাখুলি নিন্দা করেন। ঐ মাসেই সংবাদপত্রের এক বিবৃতিতে মন্টেগু-চেমসফোর্ড প্রস্তাব সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেন যে প্রশাসকদের (executive) উপর ব্যবস্থা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ থাকা চাই। পরের মাসে এলাহাবাদের “ইন্ডিয়ান রিভিউ” পত্রিকায় মন্টফোর্ড প্রস্তাবের দ্বৈতশাসনের বিরোধিতা করেন। আরও ২৯ জন জননেতার সঙ্গে স্বাক্ষরিত এবং ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়ায়” ৮ই নভেম্বরে প্রকাশিত এক পত্রে জনমতবিরোধী বলে ছোটলাট লর্ড উইলিংডনকে কোনো বিদায় সংবর্ধনা দেবার অনুষ্ঠানের আয়োজন না করার পরামর্শ দেন। ডিসেম্বরের ১১ই বোম্বের টাউন হলে আয়োজিত ছোটলাটের বিদায়সভা পণ্ড করার জন্য তাঁর পত্নীসহ আরও অনেকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন। ঐ ব্যাপারে তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতি হিসাবে জনসাধারণের দানে বোম্বেতে “জিন্না হল” নির্মাণের ব্যবস্থা হয় এবং ঐ মাসেই শ্রীমতী বেসান্ত তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জিন্না হল পরবর্তীকালে সভা-সমিতির কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বোম্বের সর্বজনিক জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান গ্রহণ করে।
রাউলাট আইন (রিপোর্টের প্রথম প্রকাশ ১৯শে জানুয়ারি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) হল ভারতবাসীদের প্রতি ইংরেজ শাসকদের নববর্ষের উপহার। গান্ধী তিলক প্রমুখ ভারতীয় নেতার যুদ্ধ প্রচেষ্টার প্রতি সক্রিয় সহযোগিতা এবং ধন ও জনের দ্বারা ভারতবাসীর যুদ্ধে মিত্রশক্তিকে সাহায্য করার প্রতিদান ঐ ব্যক্তি-স্বাধীনতা খর্বকারী কালা কানুন। বিশেষ করে মুসলমানরা ক্ষুব্ধ, খিলাফৎ ছাড়াও বিগত লীগ অধিবেশনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ডাঃ আনসারীর বক্তৃতার নিষিদ্ধকরণ এবং কানপুরের দাঙ্গা দমনের জন্য মুসলমানদের উপর প্রয়োজনাতিরিক্ত চাপ ইত্যাদির জন্য। বিলের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করে গান্ধী জনমত তৈরি করেছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা পরিষদে আরও অনেকের সঙ্গে জিন্নাও আইন পাস করার বিরুদ্ধে প্রবল যুক্তিজাল বিস্তার করলেন। জিন্না বললেন: “বিচার-বিভাগের ক্ষমতা প্রশাসকদের দিলে প্রচণ্ড রকমে ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ প্রশস্ত হবে।…কোনো সভ্য দেশের আইনের ইতিহাসে এমন আইন প্রণয়নের নজির বা উদাহরণ নেই।…এজাতীয় আইন করার সময়ও এখন নয়, কারণ সুদূরপ্রসারী শাসন-সংস্কার সম্বন্ধে প্রচণ্ড আশা জনসাধারণের মনে সৃষ্টি হয়েছে।… প্রস্তাবিত ব্যবস্থাসমূহ গৃহীত হলে তার পরিণামে অভূতপূর্ব অসন্তোষ ও আন্দোলনের সৃষ্টি হবে এবং সরকার ও জনসাধারণের মধ্যেকার সম্পর্কে এর পরিণাম হবে বিপজ্জনক।”(৪)
কিন্তু তাবৎ ভারতীয় সদস্যদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ৩৪জন সরকারি সদস্যের ভোটের জোরে মার্চ মাসে রাওলাট আইন পাস হল। এর দিনকয়েক পরই ২৮শে মার্চ জিন্না তাঁর বোম্বের নিবাস থেকে বড়লাটের কাছে ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলের সদস্যপদে ইস্তফা দিয়ে যে কঠোর পত্র পাঠালেন তা তাঁর জাতীয়তাবাদী চরিত্র ও দৃঢ়চেতা স্বভাবের দ্যোতক। জিন্না লিখলেন:
“এই বিল পাস করে আপনার সরকার মাত্র এক বছর পূর্বে যুদ্ধসম্মেলনে ভারতবাসীর সাহায্য চেয়ে যেসব যুক্তি দিয়েছিল তার প্রতিটিকে সক্রিয়ভাবে নস্যাৎ করেছে। গ্রেট ব্রিটেন যেসব নীতি সংরক্ষণার্থ যুদ্ধ করেছিল, সরকারের এই পদক্ষেপের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে তা পদদলিত হয়েছে। ন্যায়বিচারের মূলনীতি উৎসাদিত হয়েছে এবং যখন রাষ্ট্রের সামনে কোনোরকম সত্যিকারের সঙ্কট নেই তখন জনসাধারণের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। আর এটা করা হয়েছে এমন এক মাত্রাতিরিক্ত ন্যাক্কারজনক ও অযোগ্য আমলাতন্ত্রের দ্বারা যার না জনসাধারণের প্রতি কোনো উত্তরদায়িত্ব আছে এবং না আছে যথার্থ জনমতের সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ।…সুতরাং এই বিল পাস করা এবং যেভাবে তা পাস করা হয়েছে তার প্রতিবাদে আমার ইস্তফা পাঠাচ্ছি। কারণ আমি মনে করি বর্তমান অবস্থায় কাউন্সিলে থেকে আমি দেশের জনসাধারণের কোনো কাজে লাগব না। এছাড়া কাউন্সিলের সদস্য জনপ্রতিনিধিদের অভিমতের প্রতি যে সরকার এমন প্রচণ্ড তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে তার প্রতি সহযোগিতা করা কারও আত্মমর্যাদার অনুকূল নয়। কাউন্সিলের বাইরে যে অগণিত জনসাধারণ রয়েছেন তাঁদের মনোভাব এবং আবেগের মর্যাদা রক্ষার্থেও আমার এই সিদ্ধান্ত। আমার মতে যে সরকার শান্তির সময়ে এ জাতীয় আইন প্রণয়ন করে সে আর নিজেকে সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারে না…।”(৫)
সবার প্রতিবাদ উপেক্ষা করে রাউলাট আইন পাস হবার পর তাকে কেন্দ্র করে দেশবাসী বিক্ষোভে যেন ফেটে পড়ল। ৬ই এপ্রিল উপবাস ও হরতালের মাধ্যমে গান্ধী দেশবাসীকে সক্রিয় প্রতিবাদ জানাতে আহ্বান করলেন। একটি সরকারি প্রতিবেদন (India 1919) অনুসারে তখন অবস্থা নিম্নরূপ:
“জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত উত্তেজনার একটি দৃষ্টিগোচর বৈশিষ্ট্য ছিল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে অভূতপূর্ব হৃদ্যতা। নেতাদের ঐক্য বেশ কিছুদিন যাবৎ জাতীয়তাবাদী মঞ্চের একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনার রূপ নিয়েছিল। জনসাধারণের মধ্যে এই উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যের সময়ে এমনকি নিম্ন শ্রেণীয়রাও অন্তত একবারের জন্য তাদের মধ্যেকার ভেদাভেদ বিস্মৃত হতে প্রস্তুত হয়েছিল। এই ভ্রাতৃত্ববোধের অসাধারণ দৃষ্টান্ত পরিদৃষ্ট হল। হিন্দুরা প্রকাশ্যে মুসলমানদের হাত থেকে জল নিয়ে পান করা আরম্ভ করলেন এবং মুসলমানরাও অনুরূপ করা শুরু করলেন। শোভাযাত্রাসমূহে যেসব ধ্বনি উচ্চারিত হত এবং যেসব উদ্‌ঘোষ লেখা ব্যানার বহন করা হত তার মূল বক্তব্য ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। মসজিদের বেদী থেকে এমনকি হিন্দু নেতাদের বক্তৃতা দিতে দেওয়া হয়েছিল।”(৬)
কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড (১৩ই এপ্রিল) এবং পাঞ্জাবের সামরিক শাসন সরকারি দমননীতি ও নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠা হয়ে দাঁড়াল। হান্টার কমিশনের সামনে জালিয়ানওয়ালাবাগের খলনায়ক জেনারেল ডায়ারের দম্ভপূর্ণ স্বীকারোক্তি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল। কংগ্রেসের সমান্তরাল তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রশাসনের হৃদয়হীনতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতাদের মতোই ঐসময়ে জিন্না বহু অনুষ্ঠানে রাউলাট আইন ও জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছিলেন।
মে মাসে জিন্না বিলাত গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য দ্বিবিধ। লীগের প্রতিনিধিমণ্ডলের নেতা হিসাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে আসন্ন প্যারিস সম্মেলনে অন্তত একজন মুসলমান প্রতিনিধি নিয়োগ করতে সম্মত করা। যুদ্ধোত্তর ঐ সম্মেলন বসেছিল তুরস্কের সঙ্গে শান্তিচুক্তি নির্ধারণে যাতে খলিফার ভাগ্য নির্ধারিত হবার কথা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ভারতসচিব মন্টেগুর সঙ্গে তাঁর ভারত সফরকালীন পরিচয়ের সুযোগ নিয়ে রাউলাট আইন মঞ্জুর না করতে রাজী করা। কিন্তু বোম্বের ভূতপূর্ব ছোটলাট উইলিংডন এবং তদানীন্তন ছোটলাট মন্টেগুকে জিন্নার সম্বন্ধে বিরূপ করে রেখেছিলেন। সুতরাং উভয় প্রয়াসেই ব্যর্থ হয়ে জিন্নাকে খালি হাতে নভেম্বরের মাঝামাঝি ভারতে প্রত্যাবর্তন করতে হল।
জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ভারতবর্ষে তখন বিদ্রোহবহ্নি লেলিহান হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় মন্টেগু-চেমসফোর্ডের শাসন-সংস্কার প্রস্তাব আইনে পরিণত হলেও বিদ্রোহী নেতৃত্বের কাছে আর তা যথেষ্ট মনে হল না। বছরের শেষে অমৃতসরে মোতিলাল নেহরুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে দেশের পরিস্থিতির মূল্যায়ন ছাড়াও দেশবন্ধুর প্রস্তাবানুসারে মন্টেগু-চেমসফোর্ডে ডায়ার্কির বদলে অবিলম্বে পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকারের দাবি জানানো হল। জিন্না কংগ্রেস অধিবেশনে দেশবন্ধুর প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তৃতা করেন।


পাদটীকা

১. ইসলামের প্রথা অনুযায়ী ধর্মগুরু এবং প্রথম দিকের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নিবাস আরবদেশের রাষ্ট্রপ্রধান একই ব্যক্তি এবং তাঁর উপাধি হল খলিফা। প্রথম খলিফা হজরৎ আবু বকর-এর (৬৩২-৬৩৪ খ্রি.) পর আরও কয়েকজন খলিফা আরবদেশের হলেও কালক্রমে খলিফার পদ তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধানের আয়ত্তাধীন হয়। মুসলিম ধর্মস্থানগুলিও তাঁর শাসনের অধীনে ছিল। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের পর ইংরেজের প্রশ্নয়ে আরবরা তুর্কীদের সঙ্গে তাঁদের পুরাতন বিবাদের নিষ্পত্তি করার সুযোগ পায় এবং তাঁরা খলিফাশাসিত তুরস্ক থেকে পৃথক হয়ে যান। এর পরিণামে আরব ও মেসোপোটামিয়ায় (ইরাকে) অবস্থিত মুসলিম ধর্মস্থানগুলি খলিফার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো ভারতের মুসলমানরাও এর জন্য ইংরেজের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। ইংরেজদের অনেক অনুরোধ-উপরোধ করা সত্ত্বেও। তুরস্কের সঙ্গে চূড়ান্ত শান্তিচুক্তি করার সময়ে খলিফার পূর্ব কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় খলিফার কর্তৃত্ব বা খিলাফৎ আবার প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন ভারতবর্ষের মুসলমানরা আরম্ভ করেন।
২. চৌধুরী খলিকুজ্জমাঁ; Pathway to Pakistan; লংম্যানস গ্রীন; লাহোর (১৯৬১); ৪৩ পৃষ্ঠা।
৩. সৈয়দ শরীফুদ্দীন পীরজাদা (সম্পাদিত); Quaid-e-Azam Correspondence; মেট্রোপোলিটান বুক কোং; দিল্লি (১৯৮২); ৮৩-৮৪ পৃষ্ঠা।
৪. মহম্মদ ইউসুফ খাঁ; The Glory Quaid-e-Azam; লাহোর (১৯৭৬); ৩০-৩১। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৬১ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৫. পীরজাদা (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; ৬৫ পৃষ্ঠা।
৬. সীতারামাইয়া, সমগ্রন্থ, প্রথম খণ্ড, ২৭৫ পৃষ্ঠা।

জিন্না ও গান্ধীর প্রথম প্রকাশ্য সংঘর্ষ

১৯২০ খ্রিস্টাব্দ ভারতবর্ষের সঙ্গে সঙ্গে জিন্নার রাজনৈতিক জীবনেও এক গুরুত্বপূর্ণ কাল।
জানুয়ারিতে ডাঃ আন্সারীর নেতৃত্বে খিলাফতের যে মুসলমান প্রতিনিধিমণ্ডল বড়লাটের কাছে দরবার করেছিলেন তাঁরা নিরাশ হয়েছেন। মার্চে মহম্মদ আলীর নেতৃত্বে অপর একটি প্রতিনিধিদল বিলাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জসহ আরও অনেকের সঙ্গে দেখা করলেও শেষ অবধি শূন্য হাতে ফিরতে বাধ্য হয়। তাই দেশে তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল। আহত ও ক্ষুব্ধ মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধিকারের দাবিতে অপরাপর সম্প্রদায়ও ব্রিটিশ-শাসনের বিরুদ্ধে মুখর। বিদেশি শাসনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নেবার জন্য দেশবাসী উন্মুখ। বিগত এক বছর ধরে গান্ধী অসহযোগের কর্মসূচীর পক্ষে বিভিন্ন মঞ্চ থেকে জনমত তৈরি করছেন। ১৯শে মার্চের দেশব্যাপী উপবাস ও প্রার্থনা, জালিয়ানওয়ালাবাগের স্মরণে ৬ থেকে ১৩ই এপ্রিল জাতীয় সপ্তাহ পালন ইত্যাদি ঐ জনমত জাগ্রত করার কর্মসূচী। ১৪ই মে শেষ অবধি ঘোষিত হল যে খিলাফৎ থাকবে না। প্রায় একই সময়ে ভারতে হান্টার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যাকে জওহরলালজির ভাষায় জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাবলীর উপর “চুনকাম করা” ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। দেশবাসীর ব্রিটিশ-বিরোধ উত্তুঙ্গ শিখরে। ২৮শে মে বোম্বাই-এ খিলাফৎ কমিটি গান্ধীর অসহযোগ ছাড়া পথ নেই—এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিল। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ৩০শে মে মিলিত হয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করল। এলাহাবাদে দোসরা জুন সর্বদলীয় সম্মেলনে অসহযোগের বিস্তৃত কর্মসূচী প্রণীত হল। ১৮০০০ মুসলমান দার-উল-হারব ভারত থেকে দার-উল-ইসলাম রূপে বিবেচিত আফগানিস্তানে প্রচণ্ড দুঃখ-কষ্টের মধ্যে হিজরৎ শুরু করে মুসলিম-মানসের তীব্রতা ও তিক্ততার নিদর্শন পেশ করলেন। গান্ধীর কার্যক্রম ছাড়া আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার পক্ষে গ্রহণীয় অপর কোনো কর্মসূচীও দেশের সামনে নেই।
তবু সংবিধাননিষ্ঠ এবং অসাম্প্রদায়িক জিন্না খিলাফৎ নিয়ে আন্দোলন ও অসহযোগের বিরোধিতা করছেন, এ আমরা পূর্ব অধ্যায়ে দেখেছি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে (৪-৯ সেপ্টেম্বর) অসহযোগের প্রস্তাব স্বীকৃত হলেও তিনি ঐ প্রবাহে আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। বিষয়-নির্বাচনী সভার তাবৎ মুসলমান সদস্যদের মধ্যে একমাত্র জিন্নাই ছিলেন এর বিরোধী। তিলকের অবর্তমানে এ ব্যাপারে তখনও অ্যানি বেসান্ত ও শ্রীনিবাস শাস্ত্রী ছাড়াও দেশবন্ধু এবং বিপিনচন্দ্র পালের মতো নেতারা তাঁরই পথের পথিক।
বিগত কয়েক বৎসরের প্রথা অনুসারে একই শহরে একই সময়ে (৭ই সেপ্টেম্বর) লীগেরও বিশেষ অধিবেশন। ফেব্রুয়ারি মাসেই জিন্না তার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তুরস্কের প্রতি অবিচার ও অত্যাচারের জন্য জিন্না ইংরেজদের প্রতি আস্থার অভাব ঘোষণা করলেন। আধুনিক ও সংবিধাননিষ্ঠ জিন্না খিলাফৎ ও গান্ধী-প্রস্তাবিত অসহযোগের বিরোধী হলেও হয়তো কিছুটা প্রতিনিধিদের অভিমতের প্রতি গণতান্ত্রিক মর্যাদাবশত এবং হয়তো বা
পৃষ্ঠা: ৩৬

অংশত রাজনৈতিক গগনের নবোদিত সূর্য গান্ধীর প্রতি সমীহ বশতঃ অধিবেশনে যে ভাষণ দিলেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেকালের(১) প্রথা অনুসারে সেই অধিবেশনে একদিকে যেমন গান্ধী, মোতিলাল, লাজপৎ রায়, দেশবন্ধু, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ ও আবুল কালাম আজাদের মতো কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ উপস্থিত, তেমনি অধিবেশনে যোগদান করেছিলেন সৌকত আলী, জাফর আলী খাঁ, আজমল খাঁ ও ফজলুল হকের মতো লীগ নেতৃবৃন্দ। গান্ধীর প্রতি গভীর সমীহ প্রকাশ প্রসঙ্গে জিন্না বললেন:
“দেশবাসীর সম্মুখে খিলাফৎ সম্মেলনের সমর্থন নিয়ে মহাত্মা গান্ধী তাঁর অসহযোগের কর্মসূচী উপস্থিত করেছেন। এবারে আপনাদেরই স্থির করতে হবে যে আপনারা ঐ কর্মসূচীর মূল নীতি অনুমোদন করেন কিনা? আর করলে বিস্তারিতভাবে এর কার্যক্রম স্বীকার করেন কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। এই পরিকল্পনাকে রূপ দেবার সময় আপনাদের প্রত্যেকের উপর ব্যক্তিগত আঘাত পড়বে। তাই একমাত্র আপনাদের উপরই কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পূর্বে নিজ নিজ শক্তির পরিমাপ করার এবং প্রশ্নটির সব দিক নিয়ে চিন্তা করার দায়িত্ব বর্তাচ্ছে। তবে একবার যদি আপনারা সামনের দিকে কুচকাওয়াজ করার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে কোনো অবস্থাতেই যেন আর পশ্চাঁদপসরণ না করেন (না, না, কখনই না)….আমি আর আপনাদের আটকে রাখতে চাই না। তবে বসে পড়ার পূর্বে কেবল এইটুকু বলতে চাই যে মনে রাখবেন—সম্মিলিত হলে আমরা খাড়া থাকব আর বিভাজিত হলে ধরাশায়ী হব (সাধু, সাধু এবং করতালি)।”(২)
কিন্তু এর সার্ধ তিন মাস পরই (২৮শে ডিসেম্বর) নাগপুর কংগ্রেসে জিন্নার ভিন্ন মূর্তি। দেশবন্ধু বাংলার দলবলসহ অসহযোগের বিরোধিতা করতে অনেক তোড়জোড় করে নাগপুরে উপস্থিত হলেও গান্ধীর প্রভাব বলয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। অভিজাত এবং সংবিধাননিষ্ঠ জিন্না ও তাঁর নেতৃত্বে প্রভাবিত মুষ্টিমেয় কিছু নেতার “গেঁয়ো মানুষদের ক্ষেপানোর এই মেঠো কর্মসূচী”র সাফল্যে গভীর সন্দেহ। জিন্না তাই বিধিবদ্ধভাবে অসহযোগের বিরোধিতা করলেন। তিনি কংগ্রেসের প্রস্তাবিত নূতন সংবিধানের লক্ষ্য— শান্তিপূর্ণ ও বৈধ উপায়ে স্বরাজ অর্জনের আদর্শেও অবিশ্বাসী। কারণ তাঁর মতে রক্তপাত ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না এবং দেশবাসীর যেহেতু হিংসার শরণ নেবার ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই, তাই বর্তমান অবস্থায় নির্ভেজাল স্বাধীনতার কথা বলা হঠকারী ব্যাপার। তিনি সেইজন্য মালব্যজীর মতই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বাধীনতার সমর্থক।(৩)
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুসারে নাগপুর কংগ্রেসে গান্ধী-প্লাবন সম্বন্ধে স্পষ্টত উপলব্ধি করলেও জিন্না সাহস ও স্বভাবোচিত ব্যক্তিত্বসহকারে এককভাবে অসহযোগের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। সেই বিরোধিতা অনেক তীব্র, তীক্ষ্ণতায় কুলীশ-কঠোর। জিন্নার মতে অসহযোগের কর্মসূচী দেশের পক্ষে কেবল বিপজ্জনকই নয়, এর জনক গান্ধী বরাবরই সংগঠনে বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন। তাই প্রস্তাবিত কর্মসূচী দেশকে সর্বনাশের অভিমুখে নিয়ে যাবে। মাত্র কয়েক মাস পূর্বে কলকাতাতে যাঁকে তিনি লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর মতো “মহাত্মা” অভিধায় সম্বোধন করেছিলেন, এবার তাঁকে কেবল “মিস্টার গান্ধী” রূপে কংগ্রেস প্রতিনিধিদের প্রকাশ্য অধিবেশনে উল্লেখ করলেন। বক্তৃতা প্রসঙ্গে মহম্মদ আলীর নামের পূর্বেও তিনি “মৌলানা” যোগ করেননি। প্রতিনিধিরা তাঁর বক্তৃতায় বার বার বাধা দিয়ে গান্ধীজীকে মহাত্মা ও মহম্মদ আলীর নামের পূর্বে মৌলানা ব্যবহারের জন্য পীড়াপীড়ি করলেন। কিন্তু জিন্না অবিচল। মহম্মদ আলী তাঁর সংবিধান-নিষ্ঠাকে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবিদ্রূপে বিদ্ধ করে অসহযোগের সমর্থন করলেন।(৪) দেশবন্ধু ও লাজপৎ রায় তো গান্ধীর প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেনই। অসহযোগের বিরুদ্ধে জিন্নার মন্তব্যে ক্ষিপ্ত মৌলানা সৌকত আলী জিন্নার প্রতি কটূক্তি করতে করতে মুষ্টিবদ্ধ হাতে তাঁর দিকে তেড়ে গেলেন, যদিও অন্যেরা বাধা দেওয়ায় জিন্নাকে আর সর্বজনসমক্ষে প্রহৃত হতে হয়নি। প্রতিনিধিদের সমর্থনের অভাব উপেক্ষা করেও গান্ধীব্যক্তিত্বের প্রবল প্লাবনের মধ্যেও জিন্না নিজের বিশ্বাসের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে দ্বিধাবোধ করেননি: “আমার পথই যথার্থ— সাংবিধানিক পথই যথার্থ।”(৫)
কংগ্রেসের অসহিষ্ণু(৬) প্রতিনিধিদের অপমানজনক এবং অগণতান্ত্রিক আচরণে ক্ষুব্ধ দুঃখিত জিন্না অধিবেশন বর্জন করে সেই রাতেই চলে গেলেন। একই স্থানে আহূত মুসলিম লীগ অধিবেশনে তাঁর অভিমতের কি দশা হবে অনুমান করে নিয়ে তাতে যোগদান করার জন্যও অপেক্ষা করলেন না। এইভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে তাঁর দুই দশকের সম্পর্কের উপর যবনিকাপাত হল। সঙ্গে সঙ্গে জিন্নার রাজনৈতিক জীবনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অবসান ঘটল।
কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা জিন্না সুখে দুঃখে যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় বিশ বছর ওতপ্রোত হয়ে ছিলেন, তাঁর পক্ষে এতদিনের সম্পর্কচ্ছেদ করা সহজ ছিল না। আমরা দেখেছি যে নিজের লিবারেল ও সংবিধাননিষ্ঠ বিশ্বাসের জন্য কংগ্রেসের নূতন অর্থাৎ গান্ধীনেতৃত্বের সঙ্গে জিন্নার আদর্শগত মতভেদ ছিল। গান্ধীনেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য ছিল ইংরাজি আদব-কায়দাদুরস্ত অভিজাতদের বদলে ভারতীয় গ্রামীণ সংস্কৃতির বুনিয়াদ সাধারণ মানুষ— নিরক্ষর অর্ধশিক্ষিত কৃষক-মজুরদের গণআন্দোলন ও প্রত্যক্ষ অহিংস সংগ্রাম। মোতিলাল ও দেশবন্ধুর মতো অনেকের পক্ষে নূতন যুগের চাহিদা অনুসারে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনকে রূপান্তরিত করা সম্ভব হলেও জিন্নার কাছে এটা ছিল অভাবনীয়। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এত আয়ের আইন-ব্যবসা ছেড়ে দিলে কিছুদিন পূর্বে জাত কন্যা এবং ধনীর দুলালী অর্থব্যয়ে দরাজহস্ত স্ত্রীর ভরণপোষণের কি ব্যবস্থা হবে—এ প্রশ্নও তাঁর মনে এসময় জেগেছিল কি না তা আমাদের পক্ষে বলা দুরূহ।
যাই হোক, আমরা এও দেখেছি যে জিন্নার মতো দীর্ঘদিনের অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেস নেতার বদলে নূতন নেতার ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন(৭) নিয়ে আরব্ধ সংবিধান বহির্ভূত আন্দোলনে মৌলানা মহম্মদ আলী, সৌকত আলী এবং তাঁদের মতো আরও অনেক মূলত সাম্প্রদায়িক এবং প্যান-ইসলামবাদী নেতাদের বেশি করে কোল দেবার জন্য জিন্নার মনে স্বাভাবিক গান্ধী-বিরোধও জেগেছিল। এছাড়া নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিত্বের সংঘাত তো ছিলই, যার কারণ জিন্নার তুলনায় ভারতের রাজনীতিতে সেদিনকার নেতা গান্ধীর নেতৃত্ব মেনে নিয়ে পিছনের সারিতে সরে যাওয়া তাঁর পক্ষে সহজ ছিল না। হয়তো বা ভবিষ্যতে “গান্ধীর সত্যে”র আবিষ্কার প্রয়াসী এরিখ এরিকসনের মতো কোনো মনোবিজ্ঞানী জিন্নার জীবনের এইসব দিকের উপর আলোকপাত করতে সমর্থ হবেন। তবুও এইভাবে একেবারে ভিন্ন মেরুতে চলে যাবার তৎকালীন রাজনৈতিক কারণ থাকা স্বাভাবিক। অতঃপর আমরা তার অনুসন্ধান করার চেষ্টা করব।
নাগপুরের ঘটনার কিছুদিন পূর্বে হোমরুল লীগ থেকে জিন্না ও তাঁর সমমতাবলম্বীদের পদত্যাগ প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানিয়ে গান্ধী তাঁদের অসহযোগকে কেন্দ্র করে সমবেত হবার অনুরোধ জানান। জবাবে জিন্না লেখেন: “আপনি অনুগ্রহপূর্বক প্রস্তাব করেছেন যে দেশের সামনে যে নবীন জীবনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে আমি যেন তাতে অংশগ্রহণ করি। আপনার এই প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ জানাই। ‘নবীন জীবন’ বলতে আপনি যদি আপনার কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচীর প্রতি ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলে আমার ভয় হচ্ছে যে আমি তা গ্রহণ করতে অক্ষম। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এ আমাদের ধ্বংসের অভিমুখে নিয়ে যাবে।…আপনার কর্মপদ্ধতি ইতিমধ্যেই সেই সব প্রতিষ্ঠানে বিভাজন এবং দলাদলি সৃষ্টি করেছে যার সঙ্গে আপনি যুক্ত হয়েছেন। দেশের জনজীবনেও আপনার অবদান অনুরূপ। কেবল হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যেই নয়—হিন্দু ও হিন্দু, মুসলমান ও মুসলমান, এমনকি পিতা-পুত্রের মধ্যেও বিবাদ সৃষ্টি হয়েছে এবং দেশের সর্বত্র জনসাধারণ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আপনার চরমপন্থী কর্মসূচী এখনকার মতো প্রধানত অনভিজ্ঞ যুবক সম্প্রদায় এবং অজ্ঞ ও নিরক্ষরদের মনে সাড়া জাগিয়েছে। এসবের তাৎপর্য হল আগাগোড়া গোলমাল ও বিশৃঙ্খলা। এর পরিণাম যে কি হবে তা ভাবতেও আমার হৃৎকম্প হচ্ছে।…জাতীয়তাবাদীদের সামনে একমাত্র পথ হল সম্মিলিত হয়ে যথাসম্ভব শীঘ্র পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বজনমান্য কোনো কর্মসূচী অনুসারে কাজে লেগে পড়া। এজাতীয় কর্মসূচী কোনো ব্যক্তিবিশেষ চাপিয়ে দিতে পারেন না, দেশের তাবৎ জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনুমোদন ও সমর্থন চাই এর পিছনে। আর এই লক্ষ্যের পরিপূর্তির জন্য আমি এবং আমার সহকর্মীরা কাজ করে যাব।”(৮)
পূর্বোদ্ধৃত পত্রে জিন্নার তদানীন্তন সামগ্রিক মনঃস্থিতির চাবিকাঠি থাকলেও এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে পত্রের “আপনার কর্মপদ্ধতি ইতিমধ্যেই সেইসব প্রতিষ্ঠানে” অংশ লক্ষণীয়। গান্ধী, কংগ্রেস ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি জিন্নার কঠোর বিরূপতা ও উদ্ধৃত পত্রাংশের ভাষার উষ্মার রহস্য খুব সম্ভব ঐখানে নিহিত। লীগের কলকাতার বিশেষ অধিবেশনে গান্ধীর সঙ্গে পূর্বোক্ত ধরনের সৌজন্যমূলক ব্যবহার করার মাত্র সাড়ে তিন মাসের মধ্যে জিন্নার আচরণে এমন পরিবর্তন ঘটে যাবার একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ঐ সময়ে ঘটে, যে তথ্য বহুল প্রচারিত নয়।
ঘটনাটি হল অল ইন্ডিয়া হোমরুল লীগ নিয়ে। আমরা পূর্বেই দেখেছি এর প্রতিষ্ঠাত্রী এবং সভানেত্রী শ্রীমতী অ্যানি বেসান্তের গতিবিধির উপর ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুন নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপনের পর জিন্না এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে এর অন্যতম নেতা হয়ে ওঠেন। স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রতিষ্ঠানটি সমগ্র দেশে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে। কালক্রমে জিন্না এর বোম্বে শাখার সভাপতি হন এবং পরবর্তীকালে লিবারেল নেতারূপে পরিচিত জয়াকর হন এর সম্পাদক। ১৯১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধী যখন উদীয়মান জনপ্রিয় জননেতা তখন শ্রীমতী বেসান্তের পদত্যাগের পর জিন্নাই হোমরুল লীগের এক সভায় পরবর্তী সভাপতি হিসাবে গান্ধীর নাম প্রস্তাব করেন। সভাপতি হবার কিছুদিন পরই ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে তিলকের ঘোষণাপত্রের পাশাপাশি গান্ধী যে বিবৃতি দেন তাতে হোমরুল লীগকে তাঁর কর্মসূচীর পরিপূর্তির বাহন হিসাবে কাজে লাগাবার ইঙ্গিত থাকায় প্রতিষ্ঠানের পুরাতন নেতারা প্রমাদ গণেন। আর তেসরা অক্টোবর বোম্বেতে অনুষ্ঠিত হোমরুল লীগের সাধারণ সভায় যখন প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে (ভারতীয় ভাষায়) স্বরাজ্য সভা রাখার এবং এর মূল নীতিতেও (creed) পরিবর্তন করার প্রস্তাব করা হয়, তখন জিন্না, জয়াকর, যমুনাদাস দ্বারকাদাস, মঙ্গলদাস পাকবাসা ও কানহাইয়ালাল মুন্সী প্রমুখ প্রতিষ্ঠানের পুরাতন নেতারা এর তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু গান্ধীর জনপ্রিয়তার জন্য এবং সম্ভবত মোতিলাল নেহরুর বাগ্মীতার সমর্থন পাওয়ায় বহু বাদবিবাদের পর এই প্রতিবাদ ১০৯ বনাম ৪২ ভোটে অগ্রাহ্য হয়ে যায়। জিন্না এবং আরও কয়েকজন সভার সভাপতি গান্ধীর অবৈধানিক নির্দেশের প্রতিবাদে সভা বর্জন করেন। পরে (২৫শে অক্টোবর ১৯২০) জিন্নাসহ অনেকে এ ঘটনার প্রতিবাদে হোমরুল লীগ থেকে পদত্যাগ করে এক প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে বলেন: “আমাদের…মত এই যে লীগের যে সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছে…তা ইতিপূর্বে লীগ অনুসৃত উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং কর্মপদ্ধতি থেকে মূলগতভাবে পৃথক।…আমরা এও মনে করি যে সংবিধানের এইসব পরিবর্তন এমন পদ্ধতিতে করা হয় যা লীগের নিয়মকানুনের পরিপন্থী। আমরা বলতে চাই যে উক্ত পদ্ধতির সপক্ষে আপনি যে নির্দেশ (ruling) দেন তা একাধারে ভ্রান্ত ও একদেশদর্শী।—তাই অতীব দুঃখের সঙ্গে আমরা লীগের সাধারণ সভ্যপদ এবং আর যে সব পদে আসীন আছি তার থেকে পদত্যাগ করছি।”(৯)
অবশ্য গান্ধীর পক্ষেরও বক্তব্য ছিল। অধিকাংশ সদস্যের সমর্থনে গান্ধীর ভূমিকার শক্তি তো প্রত্যক্ষ হয়েই ছিল। এছাড়া স্বরাজ্য সভা বা হোমরুল লীগের সংযুক্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ১৮ই অক্টোবর বোম্বে ক্রনিকালে প্রকাশিত জওহরলাল নেহরুর সম্পাদককে লিখিত পত্রেও(১০) ইতিহাস ও সংবিধানের দিক থেকে গান্ধীর ভূমিকার যৌক্তিকতার প্রদর্শন করা হয়েছিল। তবুও গান্ধী-জিন্না সংঘর্ষের যে অশনি-সংকেত ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারিতে গুর্জর সভায় গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর জিন্নার ইংরাজিতে প্রদত্ত ভাষণকে কেন্দ্র করে একবার এবং ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে দিল্লির “যুদ্ধ সম্মেলনে” গান্ধীর সরকারি প্রস্তাবকে সমর্থন ও জিন্নার তার প্রতি তীব্র বিরোধকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয়বার দেখা দিয়েও ঘটনাচক্রে তিরোহিত হয়েছিল, হোমরুল লীগের অধিবেশনকে কেন্দ্র করে তা এবার বজ্র-বিদ্যুৎ সহযোগে প্রকাশ পেল। নাগপুর কংগ্রেসে অসিতে অসিতে দ্বৈরথ প্রথম সংঘর্ষেরই ব্যাপ্তি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-সংগ্রামের যে দুই মহারথীর এই সংঘাত আধুনিক ভারতের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তিত করে, তার সম্বন্ধে পরে কিঞ্চিৎ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাবে। বর্তমানের মতো এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে হোমরুল লীগের এই পরিণতির জন্য জিন্না গান্ধীকে ক্ষমা করতে পারেননি। কলকাতার প্রায় তিন মাস পরে নাগপুরের কংগ্রেস অধিবেশনে এবং তারপরও তাঁর প্রবল গান্ধীবিরোধী ভূমিকার অন্তরালে এই বিরূপ মানসিক প্রতিক্রিয়ার বিশেষ প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক।


পাদটীকা

১. ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে খর্ব করার জন্য কী ভাবে মুসলিম লীগের জন্ম হয়, তা আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখেছি। এক বিচিত্র আকস্মিকতা হল এই যে হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাও কয়েক বৎসর পরই। তবে বিশের তো বটেই এমনকি ত্রিশের দশকের প্রথমার্ধেও কংগ্রেসের নেতারা হিন্দু-ধর্মাবলম্বী হলে হিন্দু মহাসভায় এবং মুসলমান হলে মুসলিম লীগের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকতেন তার নজির আছে। জিন্না, আলী ভ্রাতৃদ্বয়, হাকিম আজমল খাঁ, ডাঃ আন্সারী, ফজলুল হক, চৌধুরী খলিকুজ্জমাঁ প্রভৃতি এইভাবে যুগপৎ লীগ ও কংগ্রেসের উচ্চপদস্থ নেতা ছিলেন। জাত অনুরূপভাবে লালা লাজপৎ রায়, পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য প্রমুখ অনেকে কংগ্রেস। কারও হিন্দু মহাসভা উভয় প্রতিষ্ঠানেরই প্রথম সারির নেতারূপে পরিগণিত হতেন। আবার মৌলানা আজাদ, রফি আহমদ কিদওয়াই, মোতিলাল, দেশবন্ধু ও গান্ধীর ছামতো এর ব্যতিক্রমও ছিল।
২ . অধ্যাপক শান মহম্মদ; The Indian Muslims; সপ্তম খণ্ড; মীনাক্ষী প্রকাশন, মীরাট।
৩. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ১৩৬ পৃষ্ঠা।
৪. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ৫৭ পৃষ্ঠা।
৫. খলিদ-বীন-সঈদ; Pakistan, The Formative Phase; ৬৫-৬৬ পৃষ্ঠা। জে.জে.পাল কর্তৃক Jinnah and Creation of Pakistan; সিধুরাম ৪৫ পাবলিকেশনস; দিল্লি (১৯৮৩); গ্রন্থের ৪৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৬. সব দেশের সব যুগের আদর্শবাদীদের ভূমিকার এই দুঃখজনক দিক সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়াও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।
৭. বহুকাল যাবৎ বিচ্ছিন্নতাবাদের শিকার মুসলমান জনসাধারণকে জাতীয় আন্দোলনের মূল প্রবাহে সম্মিলিত করার উদ্দেশ্যে গান্ধী খিলাফতের সমর্থন এবং অসহযোগের জী নেতৃত্ব করার মতো ঝুঁকি নিয়েছিলেন—এমন একটা অভিমতও গান্ধীর সপক্ষে নাম আছে। কিন্তু গান্ধীর ভূমিকা আমাদের মূল আলোচ্য নয়।
৮. পীরজাদা; সমগ্রন্থ; ৮৭-৮৮ পৃষ্ঠা।
৯. জয়াকর; Story of My Life; প্রথম খণ্ড; ৪০৫ পৃষ্ঠা। মজুমদার কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৩৮-৩৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১০. ড. গোপাল (সম্পাদিত) Jwaharlal Nehru – Selected Works; ওরিয়েন্ট লংম্যানস্, নূতন দিল্লি; প্রথম খণ্ড, ১৬৭-৬৯ পৃষ্ঠা।


কংগ্রেস বর্জন করলেও নিষ্ঠাবান জাতীয়তাবাদী

জিন্না কংগ্রেস ছেড়ে চলে গেলেও ভারতের রাজনীতি থেকে বিদায় নেননি। গান্ধী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের প্রতি বিরূপ হলেও যথার্থ অর্থে তিনি শিভলরাস ইংরেজ ভদ্রলোক। তাই পুণার ফার্গুসন কলেজে গোখলের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে অসহযোগের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্রদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জনের প্রকাশ্য নিন্দা করলেও, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সরকার অসহযোগবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের যে তালিকা তৈরি করছিলেন তাতে তিনি নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে দিতে সম্মত হননি। এছাড়া জয়াকরসহ গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বড়লাটের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ারও চেষ্টা তিনি করেন, যদিও শেষ অবধি অসহযোগনিষ্ঠার কারণে গান্ধী তাতে সম্মত হননি।(১)
তাঁর ভদ্রলোক বৃত্তির অপর একটি নিদর্শন তাঁর এবং মালব্যজি ও জয়াকর প্রভৃতি কর্তৃক আহূত বোম্বের সর্বদলীয় সম্মেলন উপলক্ষে পাওয়া যায়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৪- ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সম্মেলনের শেষে সম্মেলনের সভাপতি স্যার শঙ্করণ নায়ার সংবাদপত্রে প্রদত্ত একটি বিবৃতিতে কিছু ভুল তথ্য দেবার সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। সম্মেলনের অপর দুই সম্পাদক জয়াকর ও নটরাজনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে জিন্না স্যার শঙ্করণের বিবৃতির প্রকাশ্য খণ্ডন করেন।(২) এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে কংগ্রেস ছাড়ার পরও ঐ প্রতিষ্ঠান এবং গান্ধীজীর প্রতি অভিমানে দূরে সরে না গিয়ে অসহযোগের পরবর্তী রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য পূর্বোক্ত সম্মেলনের প্রস্তাবাবলী (আন্দোলন প্রত্যাহার ও দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার উপায় উদ্ভাবনের জন্য গোলটেবিল বৈঠক) নিয়ে অপর দুই সম্পাদকসহ জিন্না বড়লাটের সঙ্গে বার বার পত্র ও তারবার্তা বিনিময় করেন। ঐ সম্মেলনের তরফ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের দোসরা ফেব্রুয়ারি তিন সম্পাদক গান্ধীজীকে যে পত্র লেখেন তাতে তাঁকে “মহাত্মাজী” রূপে সম্বোধন করা হয় এবং পত্রে হস্তাক্ষরকারীদের মধ্যে প্রথমজন ছিলেন জিন্না।(৩)
ইতিমধ্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক মোড় নেওয়া শুরু করেছে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে খিলাফৎ ও অসহযোগের প্রবল উদ্দীপনায় মুসলমানরা বহু স্থানে হিন্দুদের মনোভাবের সমাদর করার জন্য বকর-ঈদের সময় স্বেচ্ছায় গো-কোরবাণী বর্জন করেছিলেন এবং অসহযোগী নেতা হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে দিল্লির জুম্মা মসজিদে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে সমবেত মুসলমানদের সামনে তাঁর বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।(৪) কিন্তু ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে কেরলের খিলাফতী মোপলা মুসলমানরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু প্রতিবেশীদের প্রতি সন্দেহপরায়ণ হয়ে তাঁদের গৃহে লুটপাট অগ্নিসংযোগ এবং এমনকি জোর করে ধর্মান্তরিত করার কাজও করেন। আর মৌলানা হসরৎ মোহানীর মতো জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতাও মোপলাদের ঐসব দুষ্কৃতির সাফাই গান। এর প্রতিক্রিয়ায় কারামুক্ত হয়ে শ্রদ্ধানন্দ “শুদ্ধি” আন্দোলন আরম্ভ করেন এবং পণ্ডিত মালব্যের নেতৃত্বে শুরু হয় হিন্দুদের “সংগঠন” আন্দোলন। মুসলমানদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় “তবলিগ” ও “তঞ্জিম” আন্দোলন। খিলাফতের স্বল্পকালীন
পৃষ্ঠা: ৪২

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য মিলিয়ে যায় এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষে মুলতানের দাঙ্গায় হিন্দুদের উপর হত্যা লুণ্ঠন ও অন্যবিধ অত্যাচারের কালো মেঘ নেমে আসে। তারপর নানাস্থানে দফায় দফায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটতে থাকে, উভয় সম্প্রদায়ই যার শিকার হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রভূত যুক্তি ও তথ্য সহকারে রাজেন্দ্রপ্রসাদ দেখিয়েছেন যে সম্ভবত কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষের গোপন অঙ্গুলিহেলনে তখনই ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিয়েছে যখনই সকল সম্প্রদায় ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য মুখর হয়েছেন।(৫)
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও দুঃসময়ের আবির্ভাব ঘটে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৮-১০ জুলাই করাচীতে অনুষ্ঠিত খিলাফৎ সম্মেলনের প্রস্তাবে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে স্বরাজ খিলাফতীদের আদৌ বিবেচ্য নয়, তাঁরা মূলত প্যান-ইসলামী সাম্প্রদায়িকতাবাদী।(৬) ডিসেম্বরে আহমেদাবাদে এই পর্যায়ে শেষবারের মতো বিগত কয়েক বৎসরের ঐতিহ্য অনুসরণ করে কংগ্রেস ও লীগের অধিবেশন একই জায়গায় ও একই সময়ে হয়। লীগের অধিবেশনে মৌলানা হসরৎ মোহানী সভাপতিত্ব করলেও একথা প্রকট হয়ে ওঠে যে লীগ গণসংগ্রামের পথে আর অগ্রসর হতে অক্ষম। লীগের ঐ অধিবেশনে কংগ্রেস অথবা এমনকি খিলাফৎ বা জমায়েত-উল-উলেমা-ই-হিন্দের সম্মেলনের মতো আইন অমান্যের (civil disobedience) প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। লীগের এইভাবে পিছিয়ে পড়ার কারণ আবিষ্কার প্রসঙ্গে মৌলবী সঈদ তুফায়েল আহমদ বলেন যে কারণ লীগের জন্ম- ইতিহাসে নিহিত। তাই লীগ যা-ই করতে যাক না কেন, সিমলার বড়লাটের কাছে আগা খাঁর নেতৃত্বে দরবারের মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। “লীগের রাজনীতি হল শুধু এই – হিন্দুরা যেসব অধিকার ও পদ অর্জন করবে, তাতে মুসলমানদের ভাগ নির্ধারিত করতে হবে। একে যথার্থ রাজনীতি বলা চলে না। যথার্থ রাজনীতির কারবার সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণের অধিকার নিয়ে এবং এই ক্ষেত্রে রাজনীতি ধর্মের মতোই শক্তিশালী। এই শক্তির অভাবের কারণ মুসলিম লীগের কোনো সদস্যকে কোনো রকম আঘাতের সম্মুখীন হবার জন্য প্রবুদ্ধ করা যায় না। নিজের মধ্যে তাই তিনি উচ্চগ্রামের দৃঢ়চিত্ততা ও সাহসও খুঁজে পান না।”(৭)
এইখানে উল্লেখযোগ্য যে মুসলিম রাজনীতির পুনর্বার সাম্প্রদায়িক রূপ নেবার পরিপ্রেক্ষিতে জিন্না কিন্তু ঐ প্রবাহে গা ভাসাননি। জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ জিন্নার পক্ষে ঐ সময়ে খিলাফতী বা মুসলিম লীগের সুরে সুর মেলানো সম্ভব হয়নি। অপর দিকে গান্ধী-নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগী কংগ্রেসে ফিরে যাওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি নূতন মডারেট রাজনৈতিক দল গঠন করার জন্য জয়াকর এবং মোতিলালের মতো সমভাবে ভাবিত বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু তাঁরা কেউই এ ব্যাপারে উৎসাহ না দেখানোর জন্য জিন্নার সে ইচ্ছা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে জিন্না হয়ে পড়েন এক বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব।
সাময়িক সংগ্রামের ঘৃণাবর্তে পড়ে মুসলিম লীগও প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে লীগের লখনউ অধিবেশন কোরামের অভাবে বাতিল করতে হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ নবীন তুরস্কের নেতা কামাল পাশা খলিফার পদ রদ করে দিয়ে খিলাফৎ আন্দোলনের মূলে কুঠারাঘাত করেন। এর ফলে মুসলিম রাজনীতি এমন বিভ্রান্ত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য মিলিয়ে যায় এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষে মুলতানের দাঙ্গায় হিন্দুদের উপর হত্যা লুণ্ঠন ও অন্যবিধ অত্যাচারের কালো মেঘ নেমে আসে। তারপর নানাস্থানে দফায় দফায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটতে থাকে, উভয় সম্প্রদায়ই যার শিকার হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রভূত যুক্তি ও তথ্য সহকারে রাজেন্দ্রপ্রসাদ দেখিয়েছেন যে সম্ভবত কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষের গোপন অঙ্গুলিহেলনে তখনই ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিয়েছে যখনই সকল সম্প্রদায় ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য মুখর হয়েছেন। (৫)
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও দুঃসময়ের আবির্ভাব ঘটে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৮-১০ জুলাই করাচীতে অনুষ্ঠিত খিলাফৎ সম্মেলনের প্রস্তাবে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে স্বরাজ খিলাফতীদের আদৌ বিবেচ্য নয়, তাঁরা মূলত প্যান-ইসলামী সাম্প্রদায়িকতাবাদী।(৬) ডিসেম্বরে আহমেদাবাদে এই পর্যায়ে শেষবারের মতো বিগত কয়েক বৎসরের ঐতিহ্য অনুসরণ করে কংগ্রেস ও লীগের অধিবেশন একই জায়গায় ও একই সময়ে হয়। লীগের অধিবেশনে মৌলানা হসরৎ মোহানী সভাপতিত্ব করলেও একথা প্রকট হয়ে ওঠে যে লীগ গণসংগ্রামের পথে আর অগ্রসর হতে অক্ষম। লীগের ঐ অধিবেশনে কংগ্রেস অথবা এমনকি খিলাফৎ বা জমায়েত-উল-উলেমা-ই-হিন্দের সম্মেলনের মতো আইন অমান্যের (civil disobedience) প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। লীগের এইভাবে পিছিয়ে পড়ার কারণ আবিষ্কার প্রসঙ্গে মৌলবী সঈদ তুফায়েল আহমদ বলেন যে কারণ লীগের জন্ম- ইতিহাসে নিহিত। তাই লীগ যা-ই করতে যাক না কেন, সিমলার বড়লাটের কাছে আগা খাঁর নেতৃত্বে দরবারের মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। “লীগের রাজনীতি হল শুধু এই – হিন্দুরা যেসব অধিকার ও পদ অর্জন করবে, তাতে মুসলমানদের ভাগ নির্ধারিত করতে হবে। একে যথার্থ রাজনীতি বলা চলে না। যথার্থ রাজনীতির কারবার সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণের অধিকার নিয়ে এবং এই ক্ষেত্রে রাজনীতি ধর্মের মতোই শক্তিশালী। এই শক্তির অভাবের কারণ মুসলিম লীগের কোনো সদস্যকে কোনো রকম আঘাতের সম্মুখীন হবার জন্য প্রবুদ্ধ করা যায় না। নিজের মধ্যে তাই তিনি উচ্চগ্রামের দৃঢ়চিত্ততা ও সাহসও খুঁজে পান না।”(৭)
এইখানে উল্লেখযোগ্য যে মুসলিম রাজনীতির পুনর্বার সাম্প্রদায়িক রূপ নেবার পরিপ্রেক্ষিতে জিন্না কিন্তু ঐ প্রবাহে গা ভাসাননি। জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ জিন্নার পক্ষে ঐ সময়ে খিলাফতী বা মুসলিম লীগের সুরে সুর মেলানো সম্ভব হয়নি। অপর দিকে গান্ধী-নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগী কংগ্রেসে ফিরে যাওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি নূতন মডারেট রাজনৈতিক দল গঠন করার জন্য জয়াকর এবং মোতিলালের মতো সমভাবে ভাবিত বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু তাঁরা কেউই এ ব্যাপারে উৎসাহ না দেখানোর জন্য জিন্নার সে ইচ্ছা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে জিন্না হয়ে পড়েন এক বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব।
সাময়িক সংগ্রামের ঘৃণাবর্তে পড়ে মুসলিম লীগও প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে লীগের লখনউ অধিবেশন কোরামের অভাবে বাতিল করতে হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ নবীন তুরস্কের নেতা কামাল পাশা খলিফার পদ রদ করে দিয়ে খিলাফৎ আন্দোলনের মূলে কুঠারাঘাত করেন। এর ফলে মুসলিম রাজনীতি এমন বিভ্রান্ত ও দিশাহারা হয়ে পড়ে যে তার জের দীর্ঘদিন ধরে থাকে। ইতিপূর্বে চৌরীচেরায় গণহিংসার জ্বালামুখীর বিস্ফোট দেখার পাঁচদিন পর গান্ধী দেশ প্রস্তুত নয় বলে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন (১১ই ফেব্রুয়ারি ১৯২২)। অতঃপর তিনি কারারুদ্ধ হলেও অসহযোগী এবং খিলাফতী—উভয় নেতাদেরই সমালোচনার পাত্র হন। খিলাফতীদের বিশেষ ক্ষোভ- গান্ধী মুসলমানদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে জিন্না বোম্বাই মুসলিম আসনের নির্দলীয় প্রার্থী হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুর্ননির্বাচিত হন। রাউলাট আইনের প্রতিবাদে পদত্যাগের পর এই তাঁর পুনরায় সংসদীয় কার্যকলাপে যোগদান করা। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে জানুয়ারি দিল্লিতে নবগঠিত পরিষদের প্রথম সভায় যোগ দেবার পরই ২৩ জন নির্দলীয় সদস্যদের একটি গোষ্ঠী নিজের নেতৃত্বে গঠন করেন। তারপর মোতিলাল ও দেশবন্ধুর স্বরাজী দলের ৪২ জন সদস্যের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পরিষদে এক জাতীয়তাবাদী দলের গঠনে অগ্রণী হবার ভূমিকা গ্রহণ করেন, যে দল স্বরাজীদের অসহযোগ আন্দোলনের অনুপূরক সর্ববিষয়ে সরকারের বিরোধিতা করার নীতি গ্রহণ না করা পর্যন্ত পরিষদে গঠনমূলক বিরোধীর ভূমিকা অবলম্বন করে। এর ফলে তদানীন্তন সরকারকে বেশ কিছুদিন পরিষদের সভায় বিব্রত হতে হয়। এ ব্যাপারে তাঁর অন্যান্য সঙ্গীরা ছিলেন পণ্ডিত মালব্য, বিপিনচন্দ্র পাল, পুরুষোত্তম ঠাকুরদাস, ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী, এন.সি. কেলেকার প্রমুখ সেকালের নেতৃবৃন্দ। ঐ পর্যায়ে তাঁর সংসদীয় কার্যকলাপের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান হল সৈন্যবাহিনীর ভারতীয়করণ, ভারতীয় মুদ্রায় সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বিলাতী পণ্য কেনার (রুপি টেন্ডার) প্রস্তাব এবং বিপিনচন্দ্র পালের ভারতকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত উপনিবেশের মর্যাদা দেবার প্রস্তাবের জোরালো সমর্থন। মে মাসের ২৪-২৫ লাহোরে অনুষ্ঠিত লীগের বিশেষ অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে পরবর্তী তিন বৎসরের জন্য লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
খিলাফতের ব্যর্থতার পর মুসলমান সমাজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং অসহযোগ-আন্দোলন-উত্তর কংগ্রেসের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলার জন্য লীগের সভাপতিরূপে জিন্নার অভিভাষণে ঐকান্তিক প্রয়াস করার নিদর্শন লক্ষ করা যায়। অধিবেশনের প্রাক্কালে জনৈক সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে অপরাপর বিষয়ের মধ্যে জিন্না বলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য হবে: “…নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মাধ্যমে যথোপযুক্ত সময়ে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের মতোই পুনরায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণ বোঝাপড়া কায়েম করা।”
অতঃপর তিনি বলেন যে, “আমি যতদূর বুঝেছি লীগ কোনোমতেই এমন কোনো নীতি বা কর্মসূচী গ্রহণ করবে না, যা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বিন্দুমাত্র বিরোধী হতে পারে।…পক্ষান্তরে আমার বিশ্বাস লীগ এমন পন্থা অনুসরণ করবে যা জাতীয় স্বার্থের পরিপুষ্টির অনুকূল হয়, যদিও এর জন্য মুসলমান সম্প্রদায়ের বিশেষ স্বার্থের কথা বিস্মৃত হওয়া চলবে না।”(৮)
সভাপতির ভাষণে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: “মহাত্মা গান্ধীর অভিপ্রেত কাউন্সিল বয়কট করার কার্যসূচী কার্যকরী অথবা (জাতীয় স্বার্থে) অনুকূল হয়নি…যে খিলাফৎ সংগঠন খাড়া করা হয়েছিল তাও এর তুলনায় ভাল কিছু করতে সক্ষম হয়নি…। গত তিন বৎসরের যুদ্ধের পরিণামে আমরা অবশ্য ভারতবর্ষে স্বরাজ প্রাপ্তির অনুকূলে এক প্রকাশ্য আন্দোলন গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছি। ভারতে অবিলম্বে ঔপনিবেশিক দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হোক—এই বক্তব্যের সপক্ষে এক নির্ভীক ও যতিবিরতিহীন দাবি উঠেছে।”(৯)
বক্তৃতার উদ্ধৃত অংশের দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। কারও চাপ ছাড়াই এবং ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এযাবৎ গান্ধীর সঙ্গে তীব্র মতভেদ থাকা সত্ত্বেও জিন্না স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে গান্ধীজীকে আবার “মহাত্মা” অভিধায় উল্লেখ করেছেন এবং অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও এর অন্যতম চারিত্রধর্ম যা আবার এর শক্তিরও আধার, অর্থাৎ প্রকাশ্য গণ-আন্দোলন ও তজ্জনিত জনজাগরণের স্বীকৃতি দিয়েছেন।
ঐ ভাষণে তিনি আরও বলেন, “স্বরাজ অর্জনের এক অপরিহার্য শর্ত হল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য…আমি এই কথা বলতে চাই যে, যেদিন হিন্দু ও মুসলমান মিলিত হবে সেইদিনই ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবে।”(১০)
গান্ধীজীও জিন্নার হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এই ঐকান্তিক আগ্রহের স্বীকৃতি দেন ইয়ং ইন্ডিয়াতে ২৯শে মে তারিখে প্রকাশিত তাঁর এক বিখ্যাত সুদীর্ঘ প্রবন্ধে। (১১)
সেই অধিবেশনে মুসলিম লীগ স্থির করে যে প্রতিষ্ঠান “…স্বরাজের জন্য প্রয়াস করবে। স্বরাজের সংজ্ঞা দেওয়া হয় সম্পূর্ণভাবে ‘সাধারণ ও সামান্য স্বার্থের’ বিষয় সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন স্বল্পসংখ্যক বিষয় ছাড়া ‘সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়ন্ত্রিত’ (অটোনমাস) প্রদেশসমূহের স্বেচ্ছামূলক (ফেডারাল) ঐক্যবন্ধন। ‘সকল সম্প্রদায়কে পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে এবং ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা’ বজায় থাকবে, কারণ যৌথ নির্বাচনব্যবস্থা ‘বিবাদ ও অনৈক্যের উৎস’ এবং এ প্রথা ‘উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করতে সম্পূর্ণভাবে অপারগ।”(১২) এছাড়া লীগের ঐ অধিবেশনে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার জন্য জিন্নার সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয় এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনে স্থানে স্থানে সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নিয়ে কনসিলিয়েটারি বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
জিন্না এই প্রথম মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনব্যবস্থার অপরিহার্যতার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করলেন, যদিও আমরা দেখব যে পরে একাধিকবার সুযোগ হলেই পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পরিহার করার জন্য তিনি উৎসুক হয়েছেন। যাই হোক, গোড়ার দিকে এর তীব্র বিরোধ করলেও ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে জিন্না পৃথক মুসলিম নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতিনিধি হিসাবেই এতবার কেন্দ্রীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। ঐসব নির্বাচনের অপেক্ষাকৃত নিরাপত্তা কি তাঁকে পৃথক নির্বাচনের অনুকূল করেছিল? অথবা কংগ্রেস ছাড়ার পর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একমাত্র মুসলিম লীগই তাঁর আশ্রয় হবার জন্য তার অধিকাংশ সদস্য ও সমর্থকদের ধ্যানধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন জিন্না? সম্ভাব্য তৃতীয় কারণটি কি এই যে ইতিমধ্যে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে এবং তদনুসারে পাঞ্জাব ও বঙ্গ উভয় প্রদেশেই মুসলমানরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠরূপে প্রমাণিত হওয়ায় ঐসব প্রদেশের ব্যাপারে লীগের প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাও লখনউ চুক্তির উক্ত দুই প্রদেশের আসন বণ্টন ব্যবস্থায় আর সন্তুষ্ট নন? অথবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে যেমন
পৃষ্ঠা: ৪৫

হয়—অল্পাধিক সব কারণগুলির সমন্বয়েই তাঁর ঐ ভূমিকা—এ কথা সুস্পষ্ট ভাবে বলার মতো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।
যাই হোক, সে বছরের কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা মহম্মদ আলী কৃত তদানীন্তন লীগ ও তাঁর নেতৃত্বের এক বিরূপ সমালোচনার উত্তরে সংযত ভাষায় জিন্না বলেন:
“সবাই ভালভাবে জানেন যে আমি পৃথক নির্বাচন-প্রথা ও সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব- ব্যবস্থার প্রেমীদের দলে নই। কিন্তু এ ব্যাপারে মুসলিম জনমত এমন প্রবল যে আমাদের হয়তো অন্তত সাময়িকভাবে একে অপরিবর্তনীয় সত্য বলে স্বীকার করে নিতে হবে। এর ভিত্তিতে মুসলমানরা যেখানে সংখ্যালঘু সেখানে তাঁদের যথেষ্ট এবং কার্যকরী প্রতিনিধিত্ব দিতে হবে।…আমি তাই আশা করি যে হিন্দুরা আমাকে ভুল বুঝবেন না, কারণ আজও আমি পোড় খাওয়া জাতীয়তাবাদী এবং মুসলমানদের যদি সংগঠিত করতেই হয় তাহলে জাতীয় অগ্রগতির বা স্বার্থের বিনিময়ে হবে না। পক্ষান্তরে এ হবে তাঁদের অন্যান্য ভারতবাসীদের সমপর্যায়ে আনার উদ্দেশ্যে।”(১৩)
২৫শে অক্টোবর যে অর্ডিন্যান্সের বলে বাংলা সরকার কংগ্রেস ও স্বরাজ্য দলের কার্যালয় এবং তার নেতাদের বাড়ি খানাতল্লাসী করে সুভাষচন্দ্র প্রমুখ চল্লিশজনকে বিনা বিচারে আটক রাখে, গান্ধী এবং আরও অনেকের সঙ্গে জিন্নাও তার তীব্র প্রতিবাদ করেন।(১৪) ২১শে নভেম্বর কংগ্রেস সভাপতি মহম্মদ আলী সরকারের এই দমননীতির পরিপ্রেক্ষিতে কর্তব্য নির্ধারণের জন্য সকল দল এবং বিশেষ করে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে যাঁরা কংগ্রেস ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। আরও অনেকের সঙ্গে জিন্নাও এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সম্মেলন “সকল রাজনৈতিক দলকে পুনরায় কংগ্রেসে সম্মিলিত করার শ্রেষ্ঠ পন্থা উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে এবং সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানসহ স্বরাজ প্রাপ্তির পরিকল্পনা রচনার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি নিয়োগ করে যাকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে মার্চের মধ্যে তার প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।”(১৫) ডিসেম্বরের শেষে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত লীগের অধিবেশনেও বাংলার অর্ডিন্যান্সের নিন্দা করে হিন্দুদের সঙ্গে সংযুক্ত মোর্চা গড়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। জিন্নাও এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। লীগের ঐ অধিবেশনে তাঁর এই মর্মের প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, “বিধানসভাসমূহ, অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে তাঁদের দাবি নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠিত হোক।”(১৬)
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারি জিন্না কেন্দ্রীয় পরিষদে বাংলায় বিগত বছর অক্টোবরে জারি করা অর্ডিন্যান্সের এবং বিপ্লবীদের প্রতি সরকারি নীতির বিরোধিতা করলেন। মার্চে অর্ডিন্যান্সের ঐ ধারাসমূহ আইনে পরিণত করার জন্য এক বিল এলে তারও বিরোধিতা করলেন এবং অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতায় সে বিল বাতিল হয়ে গেল। এছাড়া রঙ্গচারী, সম্মুখম্ চেট্টি প্রমুখের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে জাতীয়তাবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে একাধিক বিলের প্রবর্তন বা বিরোধিতা করলেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্যদের নিয়ে ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টি নামে জাতীয়তাবাদীদের এক নূতন গোষ্ঠীর জন্ম হয় এবং জিন্না তার নেতা নির্বাচিত হন। বাজেট ও ফাইন্যান্স বিলে স্বরাজ্য দলের সদস্য মোতিলাল নেহরু ও বিঠলভাই প্যাটেলের বিরোধিতা করলেন। আবার বিঠলভাই পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় তাঁকে অভিনন্দন জানালেন। দেশবন্ধু ও রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের তিরোধানে তাঁদের প্রতি শোকাঞ্জলি নিবেদন করলেন। মদ্য উৎপাদন এবং এর আমদানি ও বিক্রির বিরুদ্ধে এক বিলের সমর্থন করলেন। এছাড়া সরকারের শাসন সংস্কার অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হিসাবে সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর প্রতিবেদন সমর্থন করার পরিবর্তে সংখ্যালঘুদের প্রতিবেদন সমর্থন করেন।(১৭) কেন্দ্রীয় পরিষদেও সংখ্যালঘু অভিমত সমর্থন প্রসঙ্গে মোতিলালের সংশোধনী প্রস্তাবের সমর্থন করেন এবং তা গৃহীত হয়। এই প্রসঙ্গে দেশের সাংবিধানিক সমস্যার সমাধানের জন্য এক রয়াল কমিশনের নিয়োগ প্রস্তাব করত: সংবিধান সম্বন্ধে আদর্শ ব্যক্ত করেন।
ঐ বৎসরের রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে দিল্লিতে জানুয়ারি মাসে গান্ধীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য এবং মুসলমানরা যেসব প্রদেশে সংখ্যালঘু সেখানে তাঁদের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। সম্মেলনে মোতিলাল, আলী ভ্রাতৃদ্বয়, আজাদ, শ্রীমতী বেসান্ত, শ্রীমতী নাইডু, শ্রদ্ধানন্দ, কুঞ্জরু, চিন্তামণি ও জয়াকর প্রমুখ নেতারা অংশগ্রহণ করেন। ২২শে মে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বোঝাপড়া সৃষ্টির জন্য জয়াকরের সহযোগিতা চেয়ে তাঁকে এক পত্র লেখেন। ডিসেম্বরের ৩০-৩১শে আলী ভ্রাতৃদ্বয়, ডাঃ কিচলু এবং আসফ আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দসহ আলীগড়ে মুসলিম লীগের বাৎসরিক অধিবেশনে যোগ দেন। লীগের ঐ অধিবেশনে মুসলমানদের জন্য বহুবিধ রক্ষাকবচসহ স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। জিন্না ঐ সম্মেলনে স্বরাজ্য দলের বাধাসৃষ্টিকারী ও আইন-অমান্যকারী ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে জিন্নার সর্বজনিক জীবনের ক্রিয়াকলাপ মূলত সংসদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কেন্দ্রীয় পরিষদে তিনি ভারতীয় শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি, কানপুর কংগ্রেসে লালা লাজপৎ রায়ের বক্তৃতার বিবরণযুক্ত তার পাঠানোর বিলম্ব, মধ্যবিত্তদের কর্মহীনতা, দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের অবস্থা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে শাসন-সংস্কারের যৌক্তিকতা প্রভৃতি বিষয়ে বলেন। এছাড়া ভারতে শাসন-সংস্কারের জন্য রাজকীয় কমিশন নিয়োগ করার দাবিও পুনরায় উত্থাপন করেন এবং বলেন যে এর সদস্যরা যেন ভারতীয় জনমত কর্তৃক গ্রহণযোগ্য হয়। তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে ৪ঠা এপ্রিল বোম্বেতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল পার্টির সভায় যোগদান করা (এখানে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সম্বন্ধে আলোচনা হয়) এবং দিল্লিতে ২৯-৩১শে ডিসেম্বর লীগের অধিবেশনে যোগ দেওয়া উল্লেখযোগ্য। নভেম্বরে জিন্না বোম্বের মুসলমান (নগর) কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসাবে পুনর্বার কেন্দ্রীয় পরিষদে নির্বাচিত হন।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের সংসদীয় কার্যকলাপের কথা ছেড়ে দিলে জিন্না কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০শে মার্চ দিল্লিতে মুসলিম সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন, যেখানে মুসলমানদের দাবিসমূহের চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়। রাজনীতির ক্ষেত্রে এর জনপ্রিয় নাম দিল্লির মুসলিম প্রস্তাব। ২৯শে মার্চ পূর্বোক্ত প্রস্তাব প্রসঙ্গে সংবাদপত্রে এক বক্তব্যের মাধ্যমে এই অভিযোগ করেন যে হিন্দু বা মুসলমান—কোনো পক্ষই মুসলমান নেতাদের যৌথ নির্বাচন প্রথার পূর্ণ তাৎপর্য অনুধাবন করছেন না। মে মাসে বোম্বেতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ঐ প্রস্তাবসমূহ অনুমোদন করে।(১৮) এই প্রস্তাবের সারমর্ম হল: “এই শর্তে তাঁরা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহে যৌথ নির্বাচন প্রথায় রাজী যে (ক) সিন্ধুকে এক পৃথক প্রদেশে পরিণত করতে হবে; (খ) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানকে অন্যান্য প্রদেশের সমমর্যাদা দেওয়া হবে; (গ) পাঞ্জাব ও বঙ্গে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব জনসংখ্যাভিত্তিক হবে এবং (ঘ) কেন্দ্রীয় পরিষদে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব মোট সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের কম হবে না।” চৌধুরী খলিকুজ্জমাঁ বলেছেন, “স্যার শফী অবশ্য জিন্নার এই যুক্ত নির্বাচন প্রথা মেনে নেওয়ায় অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলেন এবং আমরা দেখব যে পরবর্তীকালে এই কারণে তিনি পাঞ্জাবে ‘শফী লীগ’-এর প্রতিষ্ঠা করেন।”(১৯)
৩১শে অক্টোবর জিন্না বড়লাটকে প্রস্তাবিত শাসন-সংস্কার কমিশনে অন্তত দুজন ভারতীয় সদস্য নেবার জন্য অনুরোধ জানান। ৮ই নভেম্বর বড়লাট সাইমন কমিশন নিয়োগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এর সকল সদস্য শ্বেতাঙ্গ হওয়ায় প্রতিবাদে জিন্না একে বয়কট করার সিদ্ধান্ত করলেন এবং ইংলন্ডের শ্রমিক দলকে তারবার্তার দ্বারা সেকথা জ্ঞাপন করলেন। কংগ্রেসের সঙ্গে একযোগে সাইমন কমিশন বয়কট করার পদক্ষেপ নেবার জন্য জিন্নার প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট তদানীন্তন ভারতসচিব বার্কনহেড লর্ড উইলিংডন এবং স্যার জন সাইমনকে এমন কৌশল অবলম্বন করার পরামর্শ দেন যাতে জিন্নাকে “উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়”। ডিসেম্বরের ৩০শে থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি পর্যন্ত কলকাতায় লীগের ১৯তম প্রকাশ্য বাৎসরিক অধিবেশনে(২০) লীগকেও সাইমন কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকার প্রস্তাব গ্রহণের জন্য তিনি অনুপ্রাণিত করেন। জিন্নার প্রভাবে লীগের ঐ অধিবেশনে ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য লীগ কাউনসিল কর্তৃক একটি উপসমিতি গঠন করার প্রস্তাবও স্বীকৃত হয়। লীগ অধিবেশনে স্যার আলী ইমাম যখন এই উক্তি করেন যে, “মুসলমানরা ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার ব্যাপারে সমানাধিকারের ভিত্তিতে অংশ গ্রহণ করতে চায়”, জিন্না তখন তা হল “ন্যূনতম” এই মন্তব্য করেন। লীগের ঐ অধিবেশনে “দিল্লি মুসলিম প্রস্তাব” ও অনুমোদিত হয় যাতে শর্তসাপেক্ষে পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা বর্জনের স্বীকৃতি ছিল এবং শফী লীগ তার দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য নিন্দিত হয়।(২১) লীগের ঐ অধিবেশনে সরোজিনী নাইডু ও অ্যানি বেসান্ত সম্মানিত অতিথি রূপে যোগ দিয়েছিলেন। সভাপতির অভিভাষণে জিন্না বলেন, “…পণ্ডিত মালব্যকে আমি স্বাগত জানাই এবং কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার মঞ্চ থেকে হিন্দু নেতারা আমাদের প্রতি যে সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেছেন, তা আমি পরম সমাদরে গ্রহণ করছি। আমার কাছে তাঁর এই প্রস্তাব ব্রিটিশ সরকারের প্রদেয় তাবৎ সুযোগ-সুবিধার থেকে অধিক মূল্যবান। সুতরাং তাঁদের বন্ধুত্বের হাত যেন আমরা গ্রহণ করি।”(২২) এইভাবে জিন্নার নেতৃত্বে লীগ পুনরপি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের কাছাকাছি আসে।


পাদটীকা

১. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ৭৫ পৃষ্ঠা।
২. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; ৩৮৯ পৃষ্ঠা
৩. পীরজাদা; সমগ্রন্থ; ৩৬-৪৫ পৃষ্ঠা।
৪. রাজেন্দ্রপ্রসাদ; সমগ্রন্থ; ১২২-১২৩ পৃষ্ঠা।
৫. সমগ্রন্থ; পৃ. ১২৪-১২৬। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শাসক-শক্তির ভূমিকা সম্বন্ধে কি খলিকুজ্জমাঁর গ্রন্থেরও ৭০-৭৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
৬. খলিকুজ্জমাঁরও এই মত। তাঁর গ্রন্থের ৭৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
৭. এম.তুফাইল আহমদ, Roshan Musitaqubal; পৃষ্ঠা ৪১০। রাজেন্দ্রপ্রসাদ কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১২২ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৮. সঈদ; Jinnah; পৃষ্ঠা ৩০৫। মজুমদার কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১০৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৯. সৈয়দ শরীফুদ্দীন পীরজাদা; Foundations of Pakistan: All India Muslim League Documents (অতঃপর Foundations রূপে উল্লেখিত); করাচী (১৯৬৯) প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৫৭৬-৫৭৭। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৮২ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১০. সঈদ; Jinnah; পৃ. ৩০৯-৩১০। মজুমদর কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১০৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১১. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ১৭৯ পৃষ্ঠা।
১২. পীরজাদা; Foundations; প্রথম খণ্ডের ৫৮১ পৃষ্ঠার উদ্ধৃতির ভিত্তিতে। উলপার্ট; সমগ্রন্থ; পৃ. ৮৩।
১৩। সঈদ; সমগ্রন্থ; ১১৭ পৃষ্ঠা।
১৪. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ২১৫ পৃষ্ঠা।
১৫. সমগ্রন্থ; ২২২ পৃষ্ঠা।
১৬. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ ৫৪০ পৃষ্ঠা।
১৭. জিন্নার এই ভূমিকা গান্ধীরও পরোক্ষ স্বীকৃতি পায়। দ্রষ্টব্য—টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ২৫৭ পৃষ্ঠা।
১৮. এ তথ্য শরীফ অল মুজাহিদ প্রদত্ত (সমগ্রন্থ; পৃ. ৫৫০)। সীতারামাইয়া নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক এজাতীয় এক ফর্মুলা গৃহীত হবার কথা বললেও (সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; পৃ. ৫২৮-৫২৯) এবং তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার এর জন্য উন্মুখ ছিলেন স্বীকার করলেও এর সঙ্গে জিন্না বা লীগের সম্বন্ধের কথা উল্লেখ করেননি। টেন্ডুলকর অবশ্য এ ব্যাপারে জিন্নার ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন (সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ৩৮০-৩৮১ এবং ৪০২ পৃষ্ঠা)।
১৯. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ৮৯ পৃষ্ঠা।
২০. স্যার মহম্মদ শফীর নেতৃত্বাধীন লীগ লাহোরে মিলিত হয়। সরকারি অংশ জিন্নার নেতৃত্বে কলকাতায় অধিবেশনের অনুষ্ঠান করে।
২১. খলিকুজ্জমাঁ, সমগ্রন্থ; ৯১ পৃষ্ঠা।
২২. উলপার্ট, সমগ্রন্থ; ৯০ পৃষ্ঠা।

“নেহেরু রিপোর্ট”–জাতীয়তাবাদী জিন্নার সম্মুখে এক জিজ্ঞাসা-চিহ্ন

জিন্নার ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের সংসদীয় কার্যকলাপের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল লালা লাজপৎ রায়ের প্রস্তাবের উপর বক্তৃতাপ্রসঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন এবং হিন্দুদের মধ্যে অনগ্রসর শ্রেণীর অবস্থার উন্নতির জন্য জয়াকরের প্রস্তাবের সপক্ষে অভিমত জ্ঞাপন।
রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে সাইমন কমিশনের বয়কটের সিদ্ধান্তের কথা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বৎসরের প্রথম দিকে জিন্না কোমর বেঁধে এ কাজে লেগেছিলেন। কলকাতায় লীগের অধিবেশনের সমাপ্তির কিছুদিন পরই জিন্নার প্রত্যক্ষ কর্মক্ষেত্র বোম্বেতে কমিশনের সদস্যদের প্রথম পদার্পণের কথা ছিল। বয়কটের ব্যাপারে জিন্নার ভূমিকা সম্বন্ধে চাগলা নিম্নোক্ত তথ্য দিয়েছেন:
“বোম্বেতে আমরা একটি কমিটি গঠন করেছিলাম, যার সম্পাদক ছিলাম আমি এবং জিন্না ছিলেন সভাপতি। আর আমাকে এ কথা বলতেই হবে যে কমিশনকে বয়কটের ব্যাপারে জিন্না পাথরের মতোই দৃঢ় ছিলেন। কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিলেন যে বয়কট কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই হবে, সামাজিক ক্ষেত্রে নয়। জিন্না এতে রাজী হননি এবং নিজের ভূমিকা থেকে তিলমাত্র বিচলিত হননি। তিনি বলেছিলেন যে বয়কট মানে বয়কট এবং একে সর্বাত্মক হতে হবে। বয়কট প্রচারে আমরা বহু সভা করেছিলাম।”(১)
সাইমন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের তেসরা ফেব্রুয়ারি সদলবলে বোম্বেতে এসে সর্বাত্মক বয়কটের সম্মুখীন হন। এই ঘটনা প্রসঙ্গে গান্ধী তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন যে, “সংগঠকদের এই বিপুল সাফল্যে আমি আমার অভিনন্দন জানাই। …এ ব্যাপারে লিবারেল, নির্দলীয় এবং কংগ্রেসিরা একই মঞ্চে সম্মিলিত রয়েছেন দেখে আমার আত্মা শান্তি পেয়েছে।”(২)
তবে ঐ বছরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হল নেহরু কমিটির রিপোর্ট প্রণয়ন এবং তার বিবেচনার জন্য সর্বদলীয় সম্মেলন।
ভারতবাসীর শাসন-সংস্কার দাবি প্রসঙ্গে এদেশবাসীর অনৈক্যের কথা ইংরেজ শাসকেরা প্রায়ই বলতেন। সাইমন কমিশন নিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে তদানীন্তন ভারতসচিব লর্ড বার্কনহেড ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে খোলাখুলিই চ্যালেঞ্জ জানালেন যে পারলে তাঁরা একটা সর্বজনগ্রাহ্য সংবিধান রচনা করুন। এর প্রত্যুত্তরে ডাঃ আন্সারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ডিসেম্বর ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের মাদ্রাজ কংগ্রেসে দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার জন্য একটি সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করার সিদ্ধান্ত হয়। কংগ্রেস কর্তৃক সাইমন কমিশন বয়কট করার আন্দোলন চালাবার সঙ্গে সঙ্গে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে সর্বপ্রথম ঐ সর্বদলীয় সম্মেলন আহৃত হয়। জিন্না ঐ সম্মেলনে যোগ দিয়ে লক্ষ করেন যে জয়াকর, মালব্য ও লাজপৎ রায় প্রমুখের প্রভাবে সম্মেলন কংগ্রেস কর্তৃক স্বীকৃত বিগত বৎসরের দিল্লির মুসলিম প্রস্তাবের প্রতিকূল ভূমিকা গ্রহণ করতে চলেছে। রাজনৈতিক দরাদরি এমন বিকট রূপ ধারণ করে যে কংগ্রেসের অন্যতম সম্পাদক জওহরলাল নেহরু সৈয়দ মাহমুদকে
পৃষ্ঠা: ৫০

১৭.৩.১৯২৮ তারিখে লিখিত এক পত্রে মন্তব্য করেন, “এ ছিল দুই তরফের কিছুসংখ্যক চরমপন্থীদের লড়াই, জিন্না ও তাঁর দলবল একদিকে এবং হিন্দুমহাসভা গোষ্ঠী অপরদিকে…উভয় গোষ্ঠীর প্রতিই আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি।”(৩) সম্মেলনের সমাপ্তির পরও এ ব্যাপারে একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হবার জন্য তিনি একটানা দশদিন ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেন যাতে দিল্লির মুসলিম প্রস্তাবের শর্তাধীন (পূর্ব অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য) যুক্ত নির্বাচনপ্রথার সুপারিশ গৃহীত হয়। মার্চে তাই লীগ কাউনসিল দিল্লিতে তাঁর সভাপতিত্বে মিলিত হয়ে এক প্রস্তাবের মাধ্যমে এই বলে খেদ প্রকট করে যে হিন্দুমহাসভা লীগের প্রস্তাবকে কার্যত বাতিল করেছে।
বোম্বেতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের তৃতীয় বৈঠকে (১৯শে মে) ২৯টি রাজনৈতিক দলের উপস্থিত প্রতিনিধিদের সম্মতিক্রমে মোতিলাল নেহরুর সভাপতিত্বে পরবর্তী ১লা জুলাইয়ের মধ্যে সংবিধানের মূল নীতির খসড়া রচনার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি নিযুক্ত হয়।(৪) জিন্না তখন বিদেশযাত্রী এবং লীগের অপর কোনো প্রতিনিধি ঐ সম্মেলনে যোগদান করেননি। নানা দৃষ্টিভঙ্গীর নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর কমিটি তার রিপোর্ট প্রস্তুত করে। এই নেহরু রিপোর্ট সম্বন্ধে আরও জনমত সংগ্রহের জন্য ২২শে ডিসেম্বর ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এক সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলন ( convention) আহূত হয়। এও স্থির হয় যে কংগ্রেস ও লীগের বাৎসরিক অধিবেশনও ঐ সময়ে কলকাতায় হবে যাতে বিগত বৎসরের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে উভয় প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।
সর্বাধিক বিতর্কিত প্রসঙ্গ নির্বাচন-ব্যবস্থা সম্বন্ধে নেহরু কমিটির সুপারিশ ছিল নিম্নরূপ:
“(১) ভারতবর্ষের সর্বত্র যৌথ এবং মিশ্র নির্বাচক মণ্ডলী থাকবে; (২) প্রতিনিধি সভায় (কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ) কোনো আরক্ষিত আসন থাকবে না; এর একমাত্র ব্যতিক্রম হবে মুসলমানরা যেসব প্রদেশে সংখ্যালঘু সেখানকার মুসলমান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অমুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে। এই জাতীয় আরক্ষণ হবে মুসলমানরা যেসব প্রদেশে সংখ্যালঘু এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সংখ্যালঘু অমুসলমানদের জনসংখ্যার হারের সঙ্গে কঠোরভাবে সামঞ্জস্য রেখে। মুসলমান বা অমুসলমান—যেখানেই তাঁদের আসনের ব্যাপারে সংরক্ষণ দেওয়া হবে সেখানে তাঁরা অতিরিক্ত আসনের জন্যও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন; (৩) (ক) পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশে কোনো সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হবে না, (খ) পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশ ছাড়া অন্যান্য প্রদেশের জনসংখ্যার ভিত্তিতে মুসলমান সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হবে এবং তাঁদের অতিরিক্ত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারও অধিকার থাকবে; (গ) অনুরূপভাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে অমুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখা ছাড়াও তাঁদের অতিরিক্ত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার দেওয়া হবে; (৪) এই আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থা দশ বছরের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকবে; (৫) আর্থিক ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তদন্ত করে নেবার পর সিন্ধুকে বোম্বাই থেকে পৃথক একটি প্রদেশে পরিণত করা হবে; (৬) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সহ তাবৎ নূতন প্রদেশে পুরাতন প্রদেশগুলির মতোই শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে।”(৫)
লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হবে যে নেহেরু রিপোর্টের সুপারিশের সঙ্গে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বর্ণিত দিল্লির মুসলিম প্রস্তাবের (২০শে মার্চ ১৯২৭) মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। অথচ ঐ মুসলিম প্রস্তাব কংগ্রেস গ্রহণ করেছিল এবং ঐ প্রস্তাবের ভিত্তিতেই মুসলিম লীগ কংগ্রেসের আহ্বানে সর্বদলীয় সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। সুতরাং অল্প সময়ের মধ্যে কংগ্রেসের দৃষ্টি- ভঙ্গীতেও এ জাতীয় মৌলিক পরিবর্তন ঘটার কারণ আবিষ্কার করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে দেশের কোথাও না কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হওয়াতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠছিল। এর সঙ্গে সঙ্গে একদিকে আর্য সমাজ এবং মদনমোহন মালব্য প্রমুখের শুদ্ধি এবং অন্যদিকে গোঁড়া মুসলমানদের তবলীগ ও তঞ্জীম আন্দোলন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের ভাব সৃষ্টির কারণ হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে “১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পরিষদের যে নির্বাচন হয় তার ফলে দেশের কোনো রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক দল অধিকাংশ ভারতীয় ভোটারদের তরফে কথা বলার অধিকারী—এমন প্রমাণ পাওয়া গেল না। প্রত্যুত তাদের মধ্যে কোনো দলই সংখ্যাগুরু হিন্দু অথবা মুসলমান ভোটারদের মুখপাত্র হবার দাবি করার যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের শাসন সংস্কার আইন অবশ্য শতকরা মাত্র চার ভাগ নাগরিকদের ভোটের অধিকার দিয়েছিল। তবে একথা অনুমান করলে ভুল হবে যে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি ভোটারদের তুলনায় জনসাধারণের মধ্যে অধিক জনপ্রিয় ছিল। বরং সাধারণ মানুষের তুলনায় ভোটাররা ঐসব সংগঠন সম্বন্ধে অধিকতর ওয়াকিবহাল ছিলেন। স্বরাজ্য দল কংগ্রেসের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের তুলনায় বহুলাংশে জনসমর্থন হারিয়েছিল। অধিকাংশ হিন্দু ভোটারদের মন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল, সখেদে স্বীকার করতে হয়েছিল যে খিলাফৎ আন্দোলন এক প্রচণ্ড ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং এর কারণ হিন্দু জনসাধারণের দৃষ্টি হিন্দু মহাসভার উপর পড়ল। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং নিখিল ভারত খিলাফৎ কনফারেন্স তখনও হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। ভোটাররা কিন্তু নির্দলীয় প্রার্থীদের সাম্প্রদায়িক ভূমিকার দ্বারা প্রভাবিত হল। সুতরাং সঙ্গত কারণেই স্বরাজ্য দল মাদ্রাজে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করল, যেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আত্মপ্রকাশ করেনি। কিন্তু পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশের মতো যেখানে হিন্দু-মুসলমান পথেঘাটে পরস্পরের মাথা ফাটাচ্ছিল সেখানে স্বরাজ্য দল শোচনীয় ভাবে পরাজিত হল। বিভিন্ন আইন সভায় মুসলমানদের অবস্থাও ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ল— কোনো মুসলমান প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি ধোপে টিকল না।
“তবে কেন্দ্রীয় পরিষদে হিন্দু ও মুসলমান জনপ্রতিনিধিরা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ভিত্তিতে বিভক্ত হননি। স্বরাজ্য দল ছিল কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিনিধি এবং জনকয়েক মুসলমান সদস্য তখনও ঐ দলে ছিলেন। জিন্নার নিজের গোষ্ঠীতে দু’জন হিন্দু এবং জনাকয়েক মুসলমান সদস্য। কিন্তু স্বরাজ্য দল বহির্ভূত প্রায় সব হিন্দু মিলিত হয়ে হিন্দু মহাসভার নেতা মদনমোহন মালব্য ও লাজপৎ রায়ের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী দলরূপে সংগঠিত হলেন। অধিকাংশ মুসলমান সদস্য অসংগঠিত গোষ্ঠীরূপে পৃথক পৃথক আসন গ্রহণ করলেন।”(৬)
এই পটভূমিকায় দিল্লিতে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে সর্বদলীয় সম্মেলন (conference) বসল। মুসলিম লীগ প্রতিনিধিরা প্রথম থেকেই লক্ষ করলেন যে সম্মেলন- দিল্লি মুসলিম প্রস্তাব মেনে নিয়ে এগোচ্ছে না, বরং সেই প্রস্তাবের সুপারিশসমূহও বিতর্কের বিষয়। তাছাড়া ইতিপূর্বে এজাতীয় দরকষাকষি হয়েছে সাধারণত কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগের মধ্যে। কিন্তু সম্মেলনের প্রায় ৭০টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের মধ্যে খ্রিস্টান, শিখ, পার্শী এবং হিন্দুদের বহু গোষ্ঠী উপগোষ্ঠী ও এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্র বহির্ভূত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ছিলেন। সম্মেলনে হিন্দু মহাসভা এবং শিখ লীগের প্রতিনিধিরা অত্যন্ত সরব এবং আর সবাইও নিজের কোলে ঝোল টানতে সমভাবে উন্মুখ। কংগ্রেসি প্রতিনিধিরা ইতিপূর্বে মুসলমানদের কাছে প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধার কাটছাঁট করে অপর সবাইকে সন্তুষ্ট করার জন্য ব্যগ্র। কিংকর্তব্যবিমূঢ় লীগ প্রতিনিধিরা এই পরিস্থিতিতে লীগের পরামর্শ চাইলেন এবং তাড়াহুড়ো করে ডাকা লীগ কাউন্সিলের এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে সম্মেলনের লীগ প্রতিনিধিরা লীগের প্রস্তাব স্বীকার করিয়ে নেবার জন্যে জোর দেবেন এবং এই হবে তাঁদের সম্মেলনের পরবর্তী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকার শর্ত। এই শর্ত পালিত না হওয়ায় লীগের প্রতিনিধিরা সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনের মাঝখানে (১১ই মার্চ) সম্মেলন পরিত্যাগ করেন এবং সম্মেলনের কাজকর্মের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেননি।
সম্মেলনে অতঃপর যে দুজন মুসলমান প্রতিনিধি রয়ে গেলেন তাঁরা হলেন স্যার আলী ইমাম এবং শোয়েব কুরেশী, যাঁরা উভয়েই ছিলেন কংগ্রেসি ভাবাপন্ন। এঁদের মধ্যে স্যার আলী ইমাম অসুস্থতার জন্য শেষ অবধি সব অধিবেশনে যোগ দিতে পারেননি এবং কুরেশী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে লিখিতভাবে ভিন্ন মত ব্যক্ত করেছিলেন।(৭) এ অবস্থায় অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিদের দ্বারা মুসলিম স্বার্থ কতটা রক্ষিত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
বঙ্গদেশ ও পাঞ্জাবে মুসলমানদের আসন সংরক্ষণের জন্য হিন্দু মহাসভা ও শিখ লীগ রাজী হয়নি এই যুক্তিতে যে ওখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলমানদের বক্তব্য— সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ঐ দুই প্রদেশে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের আইনের ধারার জন্য মুসলমান ভোটারদের সংখ্যা কম এবং তাই নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ। সম্মেলনে আসন বণ্টন প্রাপ্তবয়স্কদের মতাধিকারকে ভিত্তি করে নির্ধারিত হলেও তা যে শীঘ্র এদেশে প্রবর্তিত হবে—এ ভরসা মুসলমানদের ছিল না। (১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের শাসন-সংস্কার আইন মুসলমানদের এই আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে। সুতরাং নেহরু রিপোর্ট সমস্যার সমাধান করতে সমর্থ হল না।(৮)
জিন্না নেহরু রিপোর্ট রচনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। দিল্লিতে সর্বদলীয় সম্মেলনে (মার্চ) যোগ দেবার পর তেসরা এপ্রিল তিনি ইংলন্ডে রওনা হন। ইতিমধ্যে তাঁর স্ত্রী তাঁকে ত্যাগ করে মায়ের সঙ্গে ইউরোপে চলে গেছেন। বিদেশে থাকাকালীন গুরুতররূপে অসুস্থ স্ত্রী রত্তির চিকিৎসা ও সেবাশুশ্রূষার জন্য যথাসাধ্য ব্যবস্থা করে ইউরোপের কয়েকটি দেশভ্রমণের পর ২৬শে অক্টোবর তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তবে দেশের মাটিতে পা রাখার পূর্বেই, মনে হয় এডেনের ঠিকানায় লেখা মোতিলাল নেহরুর দোসরা আগস্টের(৯) এক চিঠি পান যাতে এই উল্লেখ আছে যে খসড়া রিপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশও তাঁকে পাঠানো হল এই উদ্দেশ্যে যে তিনি যেন এ ব্যাপারে নিজ অভিমত গঠন করতে পারেন। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে মোতিলাল তাঁকে লেখেন যে, “আপনি বোম্বেতে এ সম্বন্ধে যে দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করবেন, তার উপরই এই রিপোর্ট এবং প্রত্যুত সমগ্র সংবিধানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।” জিন্নার যোগ দেবার সুবিধার জন্য নেহরু রিপোর্ট বিবেচনা করার জন্য লখনউ- এর সভা মোতিলাল ২৫শে আগস্ট থেকে কয়েক দিনের জন্য পিছিয়ে দেন এবং তাঁকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান যে, “আপনার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আমাকে সুযোগ দেবার পূর্বে আপনি এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে কোনো মতামত দেবেন না।” নেহরু কমিটির অন্যতম সদস্য সুভাষচন্দ্রের মোতিলাল লিখিত এ চিঠির মর্ম সম্বন্ধে জানা না থাকায় সম্ভবত রিপোর্ট সম্বন্ধে লীগ কাউন্সিলের কোনো অভিমত জানতে না পেরে তাঁর ১৭ই নভেম্বরের স্বহস্ত লিখিত পত্রে জিন্নার কাছে এক উদ্বেগভরা চিঠি লেখেন।(১০) ভারতবর্ষের তদানীন্তন রাজনীতিতে জিন্নার প্রভাব সম্বন্ধে উপলব্ধি করার জন্য এই দুটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট।
বলা বাহুল্য দেরিতে দেশে ফেরার জন্য জিন্নার পক্ষে লখনউ-এর সভায় যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ফেরার পর থেকেই তিনি নেহরু রিপোর্ট সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কারণ সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানের দিক থেকে এর অসীম গুরুত্ব ছিল। ২৫শে নভেম্বর এক পত্র লিখে তিনি লীগ সম্পাদককে ঐ রিপোর্ট সম্বন্ধে লীগের মনোভাব স্থির করার জন্য তৎপর হতে পরামর্শ দেন। স্যার শফীর লীগ তো নেহরু রিপোর্টের সুপারিশের বিরুদ্ধে ছিলই, জিন্নার লীগও এ ব্যাপারে বিভক্ত ছিল। জিন্না স্বয়ং নেহরু রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছিলেন। ২২শে ডিসেম্বর লীগের ২৪ জন প্রতিনিধির তরফ থেকে কলকাতার সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলনে তিনি বক্তব্য পেশ করেন।
সংক্ষেপে জিন্নার প্রস্তাব ছিল নিম্নরূপ:
“(১) কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপরিষদে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব এক-তৃতীয়াংশের কম হবে না; (২) নেহরু রিপোর্টে প্রস্তাবিত প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার স্বীকৃত না হলে পাঞ্জাব ও বঙ্গ প্রদেশ জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন পাবে এবং তার থেকে বেশি নয়। তবে দশ বছর পর এর পুনর্বিচার করা যেতে পারে; (৩) বাদবাকি সব ক্ষমতা থাকবে প্রদেশগুলির হাতে, কেন্দ্রের হাতে নয়।”(১১)
একথা সত্য যে বেশ কিছু বিশিষ্ট মুসলিম নেতা যথা মৌলানা আজাদ, ডাঃ আন্সারী, স্যার আলী ইমাম, মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব (একই সময়ে একই শহরে অনুষ্ঠিত লীগের বাৎসরিক অধিবেশনের সভাপতি) এবং ডাঃ কিচলু প্রমুখ নেহেরু রিপোর্টের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু একথাও সত্য যে সাধারণ ভাবে মুসলিম জনমত এর বিরুদ্ধে ছিল এবং তার প্রতিফলনের বিবরণ আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে পাব। সৈয়দ আহমদের অনুগামী নবাব মহসীন-উল-মুল্কের পরামর্শে এবং ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট লর্ড মিন্টোর কাছে আগা খাঁর দরবারের পর ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থার যে সুবিধা পেয়েছিলেন এবং যা ক্রমশ উভয় সম্প্রদায়ের ভিতর বিভেদকে সুদৃঢ় করছিল, তার বিলোপনের একটা রাস্তা বহু বিরোধিতা সত্ত্বেও জিন্না বার করেছিলেন ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের দিল্লির মুসলিম প্রস্তাবের মাধ্যমে। কংগ্রেস এবং অবিভক্ত লীগ উভয় প্রতিষ্ঠানই তা স্বীকার করে পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা রদের মাধ্যমে ভবিষ্যতের বৃহত্তর বিভেদের সম্ভাবনা দূরীকরণের পথে অগ্রসর হতে পারত। তাই সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলনের প্রতিনিধিদের কাছে জিন্না তাঁর কুশলী আইনজীবীর যাবতীয় কলা প্রয়োগ করে ব্যাকুল মিনতি জানালেন: “আমরা যা চাই তা হল—আমাদের লক্ষ্য সাধিত না হওয়া পর্যন্ত হিন্দু ও মুসলমানেরা সম্মিলিতভাবে পথ পরিক্রমা করবে। সুতরাং দেখা জরুরি যে আপনারা কেবল মুসলিম লীগকেই সঙ্গে পাননি, ভারতবর্ষের মুসলমানদেরও সহযোগী রূপে পেয়েছেন এবং একথা আমি মুসলমান হিসাবে বলছি না, বলছি একজন ভারতবাসী রূপে। আর আমি এটা দেখতে চাই যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের সঙ্গে সাত কোটি মুসলমান যেন সমান তালে পা ফেলে চলেন। আপনারা কি জনকয়েকের সহযোগিতাতেই তুষ্ট হবেন? আপনারা কি আমার এজাতীয় কথা শুনে সন্তুষ্ট হতে পারেন যে কেবল আমি আপনাদের সঙ্গে আছি? ভারতবর্ষের মুসলমানরা আপনাদের সঙ্গে একসাথে চলুন—এ আপনারা চান কি চান না? শিখ, খ্রিস্টান ও পার্শী কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিন্দুমাত্র অসম্মান না করে আমি বলতে চাই যে আপনাদের একথা মনে রাখতে হবে ভারতবর্ষের দুটি প্রধান সম্প্রদায় হল হিন্দু ও মুসলমান। তাই এই দু সম্প্রদায়কে পরস্পরের প্রতি সদ্ভাবসম্পন্ন ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে—তাঁদের বুঝতে হবে যে তাঁদের মধ্যে কোনো স্বার্থসংঘাত নেই এবং তাঁরা এক সর্বজনীন মঙ্গলের অভিমুখে সম্মিলিতভাবে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে চলেছেন।…তাই আমি চাই যে আপনারা স্যার তেজবাহাদুর সপ্রু বর্ণিত দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কবৃত্তির উচ্চ শিখরে উঠুন। সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের কোনো কিছু দিতে সমর্থ নয়। সুতরাং আপনাদের ভাষায় যাকে “এইসব ছোটখাটো ব্যপার” বলছেন, আমি যেন তার জন্য দাবি না করি—এসব কথা আমাকে বলে কোনো লাভ নেই। এসব যদি ছোটখাটো ব্যাপারই হয়, তাহলে মেনে নিতে দোষ কি?”(১২)
একাধিক দেশের সংবিধানের নজির উল্লেখ করে তিনি বললেন যে, সংখ্যালঘুরা সর্বদা সংখ্যাগুরুদের আতঙ্কে দিনযাপন করে। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা তাঁর মতে সচরাচর নিপীড়ক ও অত্যাচারী হয়। সুতরাং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দাবি করার অধিকার সর্বদাই আছে। অতঃপর তিনি বললেন:
“এসব বড় বড় প্রশ্ন, যার সমাধান করতে হলে উচ্চকোটির রাষ্ট্রনায়কসুলভ মানসিকতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রয়োজন। আবার আমি তাই আপনাদের অনুরোধ জানাচ্ছি যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে আপনারা এ ব্যাপারে ভাল করে খুঁটিয়ে বিচার করুন। আমি যা বলেছি তাতে কোনো পক্ষকে কোনো রকম শাসানী দেওয়া হয়েছে বলে যেন দয়া করে মনে করবেন না এবং আমি আশা করি যে আমাকে ভুল বোঝা হবে না। আজ যদি আপনারা এ প্রশ্নের সমাধান না করেন, তবে আগামী কাল তা করতে হবে এবং ইতিমধ্যে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ব্যাহত হবে। আমরা সবাই এই দেশের সন্তান। আমাদের সম্মিলিতভাবে থাকতে হবে, মিলেমিশে কাজ করতে হবে। আমাদের মধ্যে যে যে বিষয়েই মতভেদ থাকুক না কেন, আমরা যেন তার অধিকন্তু আর পারস্পরিক দ্বেষ সৃষ্টি না করি। যদি আমরা সহমত হতে না পারি, আমরা যেন ভিন্নমত পোষণ করার ব্যাপারে সহমত হতে পারি এবং যেন বন্ধু হিসাবে এখান থেকে যেতে পারি। আমার কথা বিশ্বাস করুন যে হিন্দু ও মুসলমানরা মিলিত হতে না পারলে ভারতবর্ষের অগ্রগতি হবে না। তাই একটা আপোষ নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে কোনোরকম যুক্তি-তর্ক, দর্শন অথবা বাদ-বিবাদ যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য প্রত্যক্ষ করার চেয়ে আর কিছু আমাকে তেমন সুখী করতে পারবে না।”(১৩)
মুসলিম দাবির ওকালতি করলেও তখনও জিন্না জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দুমুসলিম
পৃষ্ঠা: ৫৫

ঐক্যের প্রবক্তা। কিন্তু সম্মেলনের অপর তিন প্রধান বক্তার মধ্যে কংগ্রেসের প্রতিনিধি মহম্মদ আলী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উগ্র ও ওজস্বিনী ভাষায় নেহরু রিপোর্টের বিরুদ্ধে এবং মুসলিম দাবির সপক্ষে বক্তব্য পেশ করেন। প্রসঙ্গত বলা যায় যে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের পর এই প্রথম জিন্না ও মহম্মদ আলী একই মঞ্চ থেকে নিজ নিজ ভঙ্গী ও ভাষায় একই দাবি উত্থাপন করেন। দ্বিতীয় বক্তা তেজবাহাদুর সপ্রু জিন্নার প্রস্তাব মেনে নেবার সুপারিশ করলেও তৃতীয়জন অর্থাৎ হিন্দু স্বার্থের প্রতিনিধি জয়াকর এর তীব্র বিরোধিতা করলেন। সম্মেলনের কংগ্রেসি প্রতিনিধিদের একাংশও তাঁর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেননি এবং কী মানসিক চাপ ও উদ্বেগের মধ্যে জিন্নাকে তাঁর ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে তা অনুধাবন করবার পরিবর্তে তাঁরা চিৎকার করতে থাকেন যে জিন্না মুষ্টিমেয় সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মুসলমানদের প্রতিনিধি এবং তাই তাঁকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। গভীর রাত্রি পর্যন্ত আলোচনার পরও জিন্নার একটি সংশোধনী প্রস্তাবও গৃহীত হল না। সম্ভবত অমুসলমানদের প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করার জন্য লীগ ও খিলাফৎ কমিটির প্রতিনিধিরা জিন্নার সংশোধনী প্রস্তাবের সপক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, যদিও আহমদীয়া মুসলমান প্রতিনিধিরা সংশোধনী প্রস্তাবের সপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। আহত হৃদয়ে জিন্না সম্মেলন থেকে বিদায় নিলেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জিন্নার জনৈক পার্শী সুহৃদ পরদিবস যখন রেল স্টেশনে জিন্নাকে দিল্লিতে রওনা করে দিতে গেলেন তখন তাঁর হাত ধরে সজলচক্ষে জিন্না বললেন, “জামসেদ, এবার আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেল।”(১৪) প্রকাশ্যে জিন্নার চোখে জল আসার যে বিরলসংখ্যক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় এ তার অন্যতম।
নেহরু রিপোর্টের ব্যর্থতা-প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তদানীন্তন কংগ্রেস-লীগ নেতা এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অন্যতম প্রবক্তা চৌধুরী খলিকুজ্জমাঁ মন্তব্য করেছেন: “হিন্দু নেতৃত্ব তাঁদের প্রিয় বিষয় যৌথ-নির্বাচন প্রবর্তনের সুযোগ হারাল এবং এর প্রতি শ্রীযুক্ত জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ প্রথমে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ২০শে মার্চ আনুগত্য প্রকাশ করেছিল ও পরবর্তীকালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ভারতবর্ষের হিন্দু যুবকরা যেন মুসলমানদের ভারত বিভাজনের জন্য দায়ী করার পূর্বে তাঁদের সেই সময়কার নেতৃবৃন্দের এই বিরাট ভ্রান্তি সম্বন্ধে চিন্তা করেন।”(১৫)
রাজেন্দ্রপ্রসাদ এই ঘটনা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, “এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে মুসলমানদের সঙ্গে বোঝাপড়া হল না। এর ফলে সম্মেলন শেষ হবার পরেই মুসলমানদের এক সর্বদলীয় সম্মেলন হল যাতে বহুসংখ্যক কংগ্রেসি মুসলমানও যোগ দেন।…এরপর মুসলমানদের এক প্রভাবশালী দল স্পষ্টত কংগ্রেস থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। এইভাবে যে সমস্যার সমাধানের জন্য ঐ সম্মেলন তা সফল হবার বদলে আরও জটিল হয়ে উঠল এবং এর কুপরিণাম পরে দৃষ্টিগোচর হল।”(১৬)
এ প্রসঙ্গে অপর একটি নিরপেক্ষ অভিমত প্রণিধানযোগ্য “…নেহরু কমিটি এবং সর্বদলীয় সম্মেলনের সামনে এক উভয়সঙ্কট দেখা দিল: ত্রিশজন মুসলমান নেতার ফর্মুলাকে যদি এক সুপ্রতিষ্ঠিত এবং অপরিবর্তনীয় তথ্য হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া হয় তাহলে হিন্দু মহাসভা ও শিখ লীগ কর্তৃক বয়কটের সমস্যা দেখা দেয়। আর মুসলিম ফর্মুলা যখন বড় বেশি হলে লীগের জিন্না গোষ্ঠীর বক্তব্য তখন হিন্দু মহাসভা ও শিখ লীগের বয়কটের ঝুঁকি নিয়ে লাভ কি? কংগ্রেস ঐ ফর্মুলা ইতিপূর্বে স্বীকার করে নিলেও তার নেতারা ফর্মুলার প্রতি আনুগত্য অবিচল রাখলে সম্মেলন ভেঙে যেত। কারণ প্রতিনিধিরা প্রচণ্ডভাবে তার বিরোধী ছিল। আজ এত দিন পরে যখন ঘটনা ঘটে যাবার পর বিজ্ঞ সাজা সহজ তখন মনে হয় যে হিন্দু মহাসভার ছাপযুক্ত বিকল্প, যার ন্যায়শাস্ত্রসম্মত অন্তর্নিহিত তত্ত্ব মুসলমানদের কাছে ভরসাজনক প্রতীয়মান হতে পারে না তা গ্রহণ করার পরিবর্তে সম্মেলন ভেঙে যাবার ঝুঁকি নেওয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হত।”(১৭)
সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলনে যোগদানকারী মাহমুদাবাদের রাজা, জিন্না, ডাঃ কিচলু, চাগলা, লিয়াকৎ আলী, খলিকুজ্জমাঁ, আক্রাম খাঁ প্রমুখ লীগের প্রতিনিধিদের নিজেদের প্রয়াসের ফলাফল লীগের কাছে বিজ্ঞাপিত করার কথা ছিল। পূর্বেই বলা হয়েছে যে লীগের বাৎসরিক অধিবেশনও ঐ সময়ে কলকাতায় হচ্ছিল। সম্মেলন থেকে শূন্য হাতে প্রত্যাবর্তনকারী প্রতিনিধিরা ২৯শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লীগের বিষয় নির্বাচনী সমিতিতে যোগ দিয়ে দেখলেন যে সেখানেও নেহরু রিপোর্ট নিয়ে তীব্র মতানৈক্য।(১৮) শর্তসাপেক্ষে নেহরু রিপোর্ট গ্রহণ করা, একেবারেই বাতিল করা এবং দু-চারটি শব্দের হেরফের করার পর গ্রহণ করা—এই তিন অভিমত লীগের বিষয় নির্বাচনী সমিতির সভায় সমান তীব্রতার সঙ্গে আলোচিত হতে লাগল। পরের দিন ভোররাত (তিনটে) পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হল না। ৩০শে ডিসেম্বর বেলা দশটায় লীগের প্রকাশ্য অধিবেশনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে স্থির হয়েছিল। কিন্তু লীগ প্রতিনিধিদের মধ্যে নেহরু রিপোর্টকে কেন্দ্র করে বাদ-বিবাদের ফলে এমন হতাশা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল যে প্রকাশ্য অধিবেশনে উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। নির্বাচিত সভাপতির (মাহমুদাবাদের রাজা) অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জিন্না বাৎসরিক অধিবেশন স্থগিত বলে ঘোষণা করলেন।


পদটীকা

১. চাগলা; সমগ্রন্থ; ৯৪ পৃষ্ঠা।
২. Collected Works of Mahatma Gandhi (অতঃপর CWMG রূপে উল্লেখিত হবে); প্রকাশন বিভাগ, ভারত সরকার, নূতন দিল্লি; খণ্ড ৩৬; ১৫ পৃষ্ঠা।
৩. ড. গোপাল (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; তৃতীয় খণ্ড; ৩৭ পৃষ্ঠা।
৪. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; ৫৪৬-৫৪৭ পৃষ্ঠা।
৫. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২০১ পৃষ্ঠা।
৬. সমগ্রন্থ; ১৮৬ পৃষ্ঠা।
৭. সমগ্রন্থ; ২১২ পৃষ্ঠা।
৮. নেহরু রিপোর্টের বিষয়মুখ ইতিহাস ও বিশ্লেষণের জন্য সমগ্রন্থের পৃ. ১৯৮-২০৪ দ্রষ্টব্য। এ প্রসঙ্গে শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; পৃ. ১৫৮-১৬৫ এবং খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ৯৩-৯৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
৯. পীরজাদা; সমগ্রন্থ; ২২-২৪ পৃষ্ঠা।
১০. সমগ্রন্থ; ২১ পৃষ্ঠা।
১১. রাজেন্দ্রপ্রসাদ; সমগ্রন্থ; ১৩০ পৃষ্ঠা।
১২. সঈদ; Jinnah; ৪৩৩-৪৩৪ পৃষ্ঠা।
১৩. সমগ্রন্থ; ৪৩৪-৪৩৫ পৃষ্ঠা।
১৪. হেক্টর বলিথো; সমগ্রন্থ; ৯৫ পৃষ্ঠা।
১৫. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ৯৫ পৃষ্ঠা।
১৬. আত্মকথা (হিন্দি); সাহিত্য সংসার, পাটনা (১৯৪৭); ৩০৪ পৃষ্ঠা।
১৭. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২০৪ পৃষ্ঠা।
১৮. এখানে উল্লেখযোগ্য যে খলিকুজ্জমাঁ তাঁর গ্রন্থে লীগের অধিবেশনে গোলযোগের কথা স্বীকার করলেও বলেছেন যে, “যাই হোক, এই সভার সময়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে জ্যাক্স ওঠে এবং তা হল এই যে কেউই পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা বজায় রাখার ব্যাপারে তার সুপারিশ করেননি এবং উভয় গোষ্ঠীই যুক্ত নির্বাচন প্রথার পক্ষে ছিলেন। (সমগ্রন্থ; বলতে পৃ. ৯৯) জিন্নার নেতৃত্বাধীন তদানীন্তন লীগের এ এক কৃতিত্ব স্বীকার করতে হবে।

‘চোদ্দ দফা” – আপোষের সূত্র?
১০

ইতিমধ্যে মুসলমান সমাজের ভিতর নেহরু রিপোর্টের বিরুদ্ধে আর একটি প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, যার কথা অতঃপর বলা প্রয়োজন।
ছতারীর নবাব, সালেমপুরের রাজা প্রমুখ নেহরু রিপোর্টের বিরোধী শফী লীগের নেতা এবং তালুকদার ও জমিদারেরা সম্মিলিত ভাবে দিল্লিতে মুসলিম সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করেন ঐ রিপোর্ট বিবেচনা করার জন্য। সম্মেলনের সভাপতিত্বের জন্য নির্বাচন করা হয় আগা খাঁ-কে যাঁর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিমণ্ডল ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন বড়লাট লর্ড মিন্টোর সঙ্গে দেখা করার পর মুসলিম লীগের জন্ম এবং যাঁদের “দাবি”র পরিপূর্তির জন্য পরবর্তীকালে পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থার সূত্রপাত। সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয় ৩১শে ডিসেম্বর যাতে জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের কলকাতা অধিবেশনে যোগদানকারীদের পক্ষে সেই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা সহজ না হয়। আমরা পূর্বেই দেখেছি যে লীগে জিন্নার যোগদান এবং নেতৃত্ব আগা খাঁ ও নবাব মহসীন-উল-মুল্ক প্রমুখের নেতৃত্বের প্রভাব থেকে ঐ প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত করার কারণ হয়েছিল। সুতরাং দিল্লির মুসলিম সর্বদলীয় সম্মেলনের উদ্দেশ্য ও চারিত্রধর্ম সম্বন্ধে বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
স্বভাবতই জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ ঐ সম্মেলনে যোগ দেবার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে। কলকাতার লীগ অধিবেশনে মহম্মদ করিম চাগলা কর্তৃক উত্থাপিত এতদ্‌সম্পর্কিত প্রস্তাবে বলা হয় যে লীগের “দৃঢ় অভিমত হল এই যে সম্প্রদায়ের সামনে সমুপস্থিত প্রতিটি সঙ্কটের সময়ে যদি এজাতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী ও অ্যাডহক প্রতিষ্ঠান গজিয়ে ওঠে তবে তা মুসলিম স্বার্থের পক্ষে বিপজ্জনক হবে।” চাগলা এই দাবিও করেন যে “…লীগই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি এবং মন্তব্য করেন যে ঐ সম্মেলন আহ্বান করা লীগকে অপমান করার সমতুল্য। কারণ লীগ বিশ বৎসরেরও অধিক কাল যাবৎ মুসলিম স্বার্থের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে।”(১) লীগের অধিবেশনে দিল্লির ৩১শে ডিসেম্বরের প্রস্তাবিত সম্মেলনে কিছুসংখ্যক প্রতিনিধির যোগদানের প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়ে গেলেও জিন্না-লীগের অনেকে ঐ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ৩০শে লীগের প্রকাশ্য অধিবেশন ক্ষীণ উপস্থিতির জন্য স্থগিত হয়ে যাবার এও এক কারণ।
এদিকে মৌলানা মহম্মদ আলী খোলাখুলি কংগ্রেস-নীতি বিরোধী মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীর ভূমিকায় আসরে নেমে পড়েছেন। কলকাতার সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলনে তাঁর তীব্র ভাষায় নেহরু রিপোর্টের বিরোধিতা করার প্রসঙ্গ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বার বার যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, টি. প্রকাশম্ প্রমুখ কংগ্রেস এবং সি.ওয়াই চিন্তামণি প্রমুখ লিবারাল প্রতিনিধিদের ছাড়াও আরও অনেকের কাছ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হন। ঘটনাচক্রে বাধাদানকারীরা সবাই ছিলেন হিন্দু। ২৩শে ডিসেম্বরের ঐ ঘটনার পর মহম্মদ আলী আর সম্মেলনে প্রত্যাবর্তন করেননি। এরপর তিনি বিহার-উড়িষ্যা মুসলিম সর্বদলীয় সম্মেলন ও নিখিল ভারত খিলাফৎ কনফারেন্সে নেহরু রিপোর্ট এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রায় জেহাদ ঘোষণা করে মুসলিম-মানসকে বিচ্ছিন্নতাবাদের অনুকূল করার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের বিরূপ করে তোলার ভূমিকা গ্রহণ করেন। নিখিল ভারত খিলাফৎ কনফারেন্সে তো তিনি ভারতের সবাইকে ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানের নিদান দেন।(২) সংযুক্ত প্রদেশের সর্বদলীয় মুসলিম সম্মেলনে তাঁর ভাই সৌকত আলীও হিন্দুদের বিরুদ্ধে অনুরূপ ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেন।
ইতিপূর্বে (২১শে ডিসেম্বর ১৯২৮) বাংলার খিলাফৎ কমিটির সভা মহম্মদ আলী জোরজবরদস্তি করে পণ্ড করার পর নেহরু রিপোর্টের সমর্থকদের বাদ দিয়ে এর বিরোধীদের নিয়ে মনোমত প্রতিনিধিমণ্ডল গঠন করেন। আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের অগণতান্ত্রিক গায়ের জোর নির্ভর কার্যকলাপের ফলে(৩) পাঞ্জাব বিহার ও সীমান্ত প্রদেশের খিলাফৎ কমিটিগুলির নেহরু রিপোর্টের প্রতি অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গী পুষ্ট হবার সুযোগ পায়নি। কৌশলে কেবল নেহরু- রিপোর্টের বিরোধীদের প্রতিনিধি নির্বাচন করায় ধীর ও শান্ত বুদ্ধির স্যার আবদার রহিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলার মুসলিম সর্বদলীয় সম্মেলন সভাপতির পরামর্শ—“একে (নেহরু রিপোর্ট) পুরোপুরি বাতিল করা এক মারাত্মক রাজনৈতিক ভ্রান্তি হবে”–অগ্রাহ্য করা হয়। অর্থাৎ মুসলমানদের ভিতর নেহরু রিপোর্টকে কেন্দ্র করে এক সাম্প্রদায়িক হিস্টিরিয়া জাগ্রত করার প্রক্রিয়াও সে সময়ে দেশে চলছিল।
এইভাবে নানা প্রদেশের মুসলিম সর্বদলীয় সম্মেলনের পর দিল্লির সম্মেলনের অনুষ্ঠান হয় ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের শেষদিনে। এতে যোগ দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাসমূহের একশোর বেশি সদস্য, মুসলিম লীগের শফী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিবর্গ, জমায়েত-উল-উলেমা এবং অপর কয়েকটি মুসলিম প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির দল। বলা বাহুল্য অনেকের বক্তৃতা ইত্যাদির পর সিদ্ধান্ত যা হবার ছিল তা-ই হল। অর্থাৎ এখনই পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থার সুযোগ ছেড়ে দেবার সময় আসেনি। কখন এবং কি শর্তে যৌথ নির্বাচন সম্ভব সে সম্বন্ধে সম্মেলন মৌন রইল। ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থা ফেডারেল ধরনের হবে এবং সংঘবদ্ধ রাজ্যগুলিকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও বাদবাকি (residuary) ক্ষমতা দেওয়া হবে বলার সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলা হয় যে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের দিল্লির মুসলিম প্রস্তাবের অনুসরণে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদে মুসলমানদের জন্য রক্ষাকবচের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং ভবিষ্যৎ সংবিধানে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে হবে।
নেহরু রিপোর্টের সমর্থন ও বিরোধিতার অন্তর্দ্বন্দ্বে জিন্না-লীগ পর্যুদস্ত। দিল্লির সর্বদলীয় মুসলিম সম্মেলনের দ্বারা আসর সরগরম করার চেষ্টা করলেও শফী লীগের অবস্থাও সুবিধার নয়। বাস্তব অবস্থার খাতিরে এবং মধ্যস্থদের প্রয়াসে উভয় লীগের ভিতর পরস্পরের কাছাকাছি আসার প্রবণতা দেখা গেল। দলছুট শফী লীগের কার্যকরী সমিতি জিন্না-লীগে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিল এবং জিন্নার সভাপতিত্বে উভয় গোষ্ঠীর সম্মিলিত সভা হল। ঐ সভা জিন্নাকে লীগের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন মতাবলম্বীদের সঙ্গে আলোচনা করে লীগের আগামী প্রকাশ্য অধিবেশনে (কলকাতায় যা মুলতুবি হয়েছিল) মুসলিম দাবি সম্পর্কে একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রস্তাব পেশ করার দায়িত্ব দিল।
ইতিমধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে এক গভীর শোকাবহ ঘটনা ঘটেছে। ২০শে ফেব্রুয়ারি তাঁর ২৯তম জন্মদিনে জিন্নার সহধর্মিণী রতনবাই বা রত্তি দীর্ঘ রোগভোগের পর ইহলোক ত্যাগ করে জিন্নাকে নিঃসঙ্গতার সমুদ্রে নিক্ষেপ করে গেছেন।
পৃষ্ঠা: ৬০

২৮শে মার্চ, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে লীগের ঐ প্রকাশ্য সম্মেলন আহূত হয়েছিল। মুসলিম রাজনীতির বিবদমান গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে মনের এই অবস্থায় এত অল্প সময়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে এক সর্বজনগ্রাহ্য ফর্মুলা উদ্ভাবন করার মতো দুরূহ কাজে আত্মনিয়োগ করা কম কৃতিত্বের পরিচায়ক নয়। লীগের ঐ অধিবেশনে ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার প্রসঙ্গে মুসলিম স্বার্থরক্ষাকল্পে জিন্নার বিখ্যাত চোদ্দো দফা (আসলে পনের দফা। কিন্তু পঞ্চদশ দফা পঞ্চম দফারই বিস্তারিত ব্যাখ্যা বলে চোদ্দো দফা বলা হয়) অনুমোদিত হয়। দফাগুলি নিম্নরূপ:
১. ভবিষ্যৎ সংবিধান ফেডারেল ধরনের হবে এবং বাদবাকি (residual) ক্ষমতা প্রদেশগুলির হাতে থাকবে। সংবিধানে নির্দেশিতব্য কয়েকটি সাধারণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারের উপরই মাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
২. সকল প্রদেশকে একই ধরনের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হবে।
৩. দেশের যাবতীয় আইনসভা এবং নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানসমূহকে এই জাতীয় এক সুনির্দিষ্ট নীতির আধারে পুনর্গঠিত করতে হবে যাতে প্রতিটি প্রদেশের সংখ্যালঘুরা যথেষ্ট ও কার্যকরী প্রতিনিধিত্ব পান অথচ কোনো প্রদেশের সংখ্যাগুরু যেন সংখ্যালঘু অথবা এমনকি সমমর্যাদাসম্পন্ন গোষ্ঠীতে পরিণত না হয়।
৪. কেন্দ্রীয় আইন সভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব মোট সদস্য-সংখ্যার এক- তৃতীয়াংশের কম হবে না।
৫. সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিত্ব বর্তমানের মতোই পৃথক নির্বাচনব্যবস্থার মাধ্যমে হতে থাকবে। তবে যে-কোনো সম্প্রদায়ের যে-কোনো সময়ে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বদলে যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণ করার অধিকার থাকবে।
৬. ভবিষ্যতে প্রদেশগুলির সীমার কোনোরকম পরিবর্তন করার প্রয়োজন দেখা দিলে তা এমনভাবে করা হবে না যাতে পাঞ্জাব, বঙ্গ ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যাহত হয় ৷
৭. সকল সম্প্রদায়কে পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতার অর্থাৎ ধর্মীয় বিশ্বাস উপাসনা, আচার-অনুষ্ঠান পালন, প্রচার, সভা-সম্মেলন ও শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৮. কোনো আইনসভা বা নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের মোট সদস্যদের তিন-চতুর্থাংশ যদি এই কারণে কোনো বিল, প্রস্তাব বা তার অংশবিশেষের বিরোধিতা করেন যে তা সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের স্বার্থের প্রতিকূল, তাহলে তা স্বীকৃত হবে না। এ সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দেবার জন্য অবশ্য আবার কোনো কার্যকরী উপযুক্ত বিকল্প ব্যবস্থার উদ্ভাবন করা যেতে পারে।
৯. সিন্ধুকে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকে পৃথক করা হবে।
১০. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানে অন্যান্য প্রদেশের মতো শাসন সংস্কার প্রবর্তন করতে হবে।
১১. যাবতীয় সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে অন্যান্য ভারতবাসীর সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদেরও উপযুক্ত অংশ দেবার নির্দেশ সংবিধানে রাখতে হবে, অবশ্য এক্ষেত্রে তাদের কাজের যোগ্যতার প্রতিও উপযুক্ত দৃষ্টি রাখতে হবে।
১২. মুসলিম ধর্ম, সংস্কৃতি ও ব্যক্তিগত (personal) আইন সংরক্ষণের জন্য সংবিধানে ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া মুসলিম শিক্ষা-ব্যবস্থা, ভাষা, ব্যক্তিগত আইন, দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকাশেরও উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা চাই এবং ঐসব প্রতিষ্ঠান সরকার ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে সাহায্যের উপযুক্ত অংশ পাবে।
১৩. কেন্দ্রে অথবা প্রদেশে এমন কোনো মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হবে না যার অন্তত এক- তৃতীয়াংশ সদস্য মুসলমান নন।
১৪. ভারতীয় ফেডারেশনের সদস্য অঙ্গরাজ্যগুলির সম্মতি ব্যতিরেকে কেন্দ্রীয় আইনসভা সংবিধানের কোনো পরিবর্তন করবে না।(৪)
জিন্নার রাজনৈতিক জীবনে এবং আধুনিক ভারতের ইতিহাসে চোদ্দোদফার স্থান গুরুত্বপূর্ণ বলে এ সম্পর্কে আর একটু আলোচনা করা প্রয়োজন।
এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক কৌশলে রোপিত ভেদনীতির বীজ—পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বিরোধিতার স্থায়ী সমাপ্তি। জিন্না বা মুসলিম লীগ এরপর আর কখনও যৌথ নির্বাচনের সপক্ষে কোনো কথা বলেননি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের নাগপুর অধিবেশনের শেষে কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য হবার পর অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী জিন্নার ভূমিকায় ক্রমশ পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল। ইতিপূর্বে (ষষ্ঠ অধ্যায়) মহম্মদ আলীর বিবৃতির প্রতিবাদ প্রসঙ্গে আমরা দেখেছি যে জিন্না পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা আপাতত বজায় রাখার সপক্ষে মৃদুকণ্ঠে ওকালতি করেছেন। একদিক থেকে অবশ্য তাঁর উপায়ান্তরও ছিল না। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর আর যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রইল এবং যার প্রথম সারির নেতা তিনি তা হল মুসলিম লীগ। সুতরাং তার অধিকাংশ সদস্য ও সমর্থকদের মনোমতো ভূমিকা না নিলে সে দলেও তাঁর স্থান কোথায়? ভোটার ও সমর্থকদের মুখাপেক্ষী হয়ে চলা—রাজনৈতিক নেতাদের এই ট্র্যাজিডি কেবল একালের বৈশিষ্ট্যই নয়। ঐ বছর (১৯২৪) ডিসেম্বরে লীগ অধিবেশনে জিন্নাকে আমরা “মুসলিম দাবি” উত্থাপন করতে দেখেছি। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনেও জিন্না মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার প্রবক্তা। অর্থাৎ পাকেচক্রে জিন্না কেবল মুসলমান সমাজের নেতায় পর্যবসিত, যদিও তখনও তিনি তাঁর নেতৃত্বাধীন সম্প্রদায়-বিশেষের ভারতবাসীর স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন করছেন জাতীয়তাবাদের চৌহদ্দির মধ্যেই।
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দেও তিনি লীগ নেতৃত্বের একাংশের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও বোম্বের লীগ অধিবেশনে কংগ্রেসের বহু হিন্দু নেতাদের আমন্ত্রণ জানান এবং লীগ প্রতিনিধিদের সামনে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপিত করার সুযোগ দেন। অনুরূপভাবে গান্ধীর সভাপতিত্বে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন জিন্না। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের লীগ অধিবেশনে কংগ্রেসের সঙ্গে মিলেমিশে শাসন সংস্কারের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত এবং সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলনে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানের জন্য ঐকান্তিক আহ্বান ইত্যাদিও এই মানসিকতার লক্ষণ। পরে আমরা দেখব যে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দেও জিন্না নিজেকে “প্রথমে ভারতবাসী, তারপর মুসলমান” বলেছেন। তখনও তাঁর বিশ্বাস, “মুসলমানদের স্বার্থ উপেক্ষা করলে কোনো ভারতবাসী কখনো তাঁর স্বদেশের সেবা করতে সমর্থ হবেন না। কারণ মুসলমানদের উৎসাহ দিয়ে এবং তাঁদের রাষ্ট্রের উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করলেই কেবল আপনারা আপনাদের স্বদেশের সেবা করতে সক্ষম হবেন।”(৫) এমনকি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে যখন সাধারণ নির্বাচনের প্রচার উপলক্ষে জিন্না ও তদানীন্তন কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল পরস্পরের প্রতি চোখা চোখা বাক্যবাণ নিক্ষেপ করছেন, তখনও জিন্না ভারতবর্ষের স্বায়ত্তশাসনই(৬) যে তাঁর লক্ষ্য—একথা বলেছেন। সাম্প্রদায়িক ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে এরকম জাতীয়তাবাদের ক্ষণপ্রভার ঝিলিক জিন্নার জীবন ও কর্মে এরপর দেখা যাবে। তবুও একথা যথার্থ যে কলকাতার সর্বদলীয় সম্মেলনের ব্যর্থতার পর কুণ্ঠিত চরণে এবং কিছুটা বিলম্বে জিন্নার বিংশ শতাব্দীতে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জনক আগা খাঁ-র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দিল্লির সর্বদলীয় মুসলিম সম্মেলনে যোগদান তাঁর জীবনে আর এক দফা পালা বদলেরই দ্যোতক। মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শিবিরে জিন্নার যোগদানে উল্লসিত আগা খাঁ এ সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, “ঐ সম্মেলনের বৈশিষ্ট্য ছিল বহুদিন পর জিন্নার পুনর্বার তাঁর সমধর্মাবলম্বী মুসলমানদের সঙ্গে সহমত হওয়া। ঐ সহমত অবশ্য আপাত ব্যক্তিগত এবং প্রকাশ্য স্বীকৃতিবিহীন ছিল। কিছু পূর্বেই শ্রীযুক্ত জিন্না কলকাতায় কংগ্রেসের সভায়(৭) যোগদান করেছিলেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে কংগ্রেস বা অপর কোনো তথাকথিত নিখিল ভারত প্রতিষ্ঠানে তাঁর কোনো স্থান নেই। কারণ সেগুলি আসলে হিন্দু প্রভাবিত প্রতিষ্ঠান। শেষ অবধি আমরা তাঁকে স্বমতে আনতে সমর্থ হয়েছিলাম।”(৮)
ডাঃ আন্সারী, তসদ্দুক আহমদ খাঁ শেরওয়ানী, ড. মহম্মদ আলম, ড. সৈয়দ মাহমুদ, চাগলা প্রমুখ মুসলিম নেতারা নেহরু রিপোর্টের সমর্থন ও চোদ্দো দফার বিরোধিতা করলেও মৌলানা মহম্মদ আলী এবং লীগের অধিবেশনে সমবেত প্রতিনিধিদের অধিকাংশের সমর্থনে চোদ্দো দফা স্বীকৃত হয়। এর মাধ্যমে মুসলমানদের অন্যান্য এবং বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য যেভাবে খাড়া করে দেওয়া হয়, ব্রিটিশ শাসকরা তার পূর্ণমাত্রায় সুযোগ নিয়েছিলেন। শরীফ-অল-মুজাহিদের মতে, “চোদ্দো দফা সমসাময়িক মুসলিম আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্যোতক ছিল বলে সেগুলি কেবল ভারতের ভবিষ্যৎ গোলটেবিল বৈঠকে (১৯৩০-৩২) মুসলিম দাবির ভিত্তি হয়ে ওঠেনি, সংবিধান সম্বন্ধে আলোচনা এবং তার প্রণয়নের জন্য লন্ডনে আহূত সম্মেলনগুলিতে সেগুলি মুসলিম ভারতের ম্যাগনা কার্টাতে পরিণত হয়।”(৯) জামিলুদ্দীন আহমদের মতে, “দফাগুলি খুঁটিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে কোনো না কোনো প্রকারে ওগুলিতে পরবর্তীকালে পাকিস্তান সৃষ্টির বীজ অন্তর্নিহিত ছিল।…কায়েদ-এ-আজম যেমন সাবলীল এবং যুক্তিযুক্তভাবে চোদ্দো দফা থেকে পাকিস্তানের দাবিতে উত্তরণ করেন এবং এর ফলে যেভাবে সমগ্র উপমহাদেশের জন্য এক অদ্বিতীয় রাজনৈতিক কাঠামো খাড়া করার ব্যাপারে ব্যর্থতার দায়িত্ব হিন্দু নেতাদের উপর বর্তায়, তা প্রবল রাজনৈতিক ভূয়োদর্শনের দ্যোতক।”(১০) রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেছেন, “শ্রীযুক্ত ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ বা বাঁটোয়ারাতে ঐগুলিকে (দফা) একরকম হুবহু গ্রহণ করা হয়।”(১১)

১০
পাদটীকা

১. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২১১ পৃষ্ঠা।
২. সমগ্রন্থ; ২০৬ পৃষ্ঠা।
৩. সমগ্রন্থ; ২০৬-২০৯ পৃষ্ঠা।
৪. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৪৭৯-৪৮১ পৃষ্ঠা।
৫. সঈদ; Jinnah ; ৫০৩ পৃষ্ঠা।
৬. ড. গোপাল (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; অষ্টম খণ্ড; পৃষ্ঠা ২৪ (পাদটীকা সংখ্যা ৬ তারা দ্রষ্টব্য)।
৭. পাঠক দেখেছেন যে এ তথ্য ভুল। কংগ্রেসের সভায় নয়, জিন্না সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।
৮. আগা খাঁ; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২২১। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১০৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৯. সমগ্রন্থ; ২০ পৃষ্ঠা
১০. Glimpses of Quaid-i-Azam, করাচী (১৯৬০); পৃ. ৭৪-৭৫। শরীফ অল … মুজাহিদ কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১১. রাজেন্দ্রপ্রসাদ; সমগ্রন্থ; ১৩২ পৃষ্ঠা।

প্রথম গোলটেবিল বৈঠক। ইকবালের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাজ্যের প্রস্তাব
১১

কিন্তু চোদ্দো দফা সত্ত্বেও বিবদমান মুসলমান রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা জিন্নার পক্ষে সহজ হল না। এক দিকে জিন্নার লীগে তখনও নেহরু রিপোর্ট গ্রহণ করার সপক্ষে এক প্রবল গোষ্ঠী বিদ্যমান, অন্য দিকে শফী লীগ সাম্প্রতিক মুসলিম সর্বদলীয় সম্মেলনের বাইরে এক পা-ও যেতে প্রস্তুত নয়। কোনোমতে যদি পরস্পরবিরোধী মতাবলম্বী দুই গোষ্ঠীকে একটা বোঝাপড়ার জন্য একত্র করা গেল তো “যে-কোনো মূল্যে পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থায় জন্য শফী লীগের জেদাজেদির ফলে তাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়ে গেল।”(১) উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে মনোমালিন্য এমন তীব্র হয়ে উঠল যে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জিন্নার লীগের প্রকাশ্য অধিবেশনে (মার্চ ১৯২৯) জিন্নার সাময়িক অনুপস্থিতিতে (তিনি তখন শফী লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আপোষ মীমাংসার জন্য আলোচনা করেছিলেন বলে শর্তাধীনে নেহরু রিপোর্টের সমর্থক ড. আলমকে সাময়িকভাবে অধিবেশনের সভাপতিত্ব করার জন্য মনোনয়ন করা হয়েছিল) নেহরু রিপোর্টের বিরোধীরা জোরজবরদস্তি করে অধিবেশন-প্রাঙ্গণে ঢুকে মারধর করে রিপোর্টের সমর্থকদের তাড়িয়ে দিয়ে সভাস্থল দখল করে।(২) কিছুক্ষণের মধ্যেই জিন্না সভাস্থলে আসায় আপাত শান্তি স্থাপিত হয় বটে, তবে পুনর্বার অশান্তির আশঙ্কায় জিন্না অধিবেশন সমাপ্তির ঘোষণা করেন।(৩)
ইতিমধ্যে জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে মুসলমানদের আবার একত্র করার জন্য এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বিরুদ্ধে তাঁদের সঙ্ঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের নেতৃবৃন্দ এলাহাবাদে একত্র হয়ে মুসলিম ন্যাশনালিস্ট পার্টি গঠন করেন। ডাঃ আন্সারী এর সভাপতি এবং খলিকুজ্জমাঁ সম্পাদক হন। কিন্তু দানা বাঁধার পূর্বেই দলের অকালমৃত্যু ঘটে। সরোজিনী নাইডুর মধ্যস্থতায় বোম্বেতে কংগ্রেস ও মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে সামঞ্জস্য আনার জন্যে জিন্না ও আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে গান্ধীর একটি সাক্ষাৎকার হয়।(৪) কিন্তু তাও ফলপ্রসূ হয়নি।
চাগলাও একটা বোঝাপড়ার জন্য জিন্নাকে মোতিলাল নেহরুর (সে বছরের কংগ্রেস সভাপতি) সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব করে এক পত্র লেখেন। তার জবাবে ৫ই আগস্ট জিন্না চাগলাকে লেখেন, “আমার আশঙ্কা হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নামে পরিচিত প্রশ্নটির সমাধান ততদিন পর্যন্ত সম্ভবপর হবে না, যতদিন না আমরা সবাই যারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছি তারা এই কথা উপলব্ধি করি যে এটি এক জাতীয় সমস্যা এবং নিছক সাম্প্রদায়িক বিবাদ নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় ও নেতারা যতক্ষণ পর্যন্ত না এই মোদ্দা কথাটা বুঝতে পারছেন এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটি সমাধানের জন্য ব্রতী হচ্ছেন ততদিন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো জাতীয় কর্মসূচীর সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভবপর হবে না।”(৫) লক্ষণীয় এখানেও জিন্না বলেছেন যে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছেন এবং হিন্দু-মুসলিম মতভেদকে সাম্প্রদায়িক নয়, জাতীয় সমস্যার আখ্যা দিচ্ছেন।
এদিকে সাইমন কমিশনের কাজ ১৪ই এপ্রিল সমাপ্ত হয়। কিন্তু তার অল্প কয়েকদিন পরই (মে ১৯২৯) কমিশন নিয়োগকারী টোরী দলের বদুইন সরকার নির্বাচনে পরাজিত
পৃষ্ঠা: ৬৫

হয় এবং শ্রমিক দলের রামসে ম্যাকডোনাল্ড ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। ভারতে শাসন-সংস্কার প্রবর্তন সম্বন্ধে অপেক্ষাকৃত উৎসাহী শ্রমিক সরকার আলোচনার জন্য বড়লাট আরউইনকে (জুন, ১৯২৯) ইংলন্ডে আহ্বান করে। দীর্ঘ আলোচনান্তে ভারতবর্ষে ফিরে ৩১শে অক্টোবর তিনি ঘোষণা করেন যে সাইমন কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিসহ প্রমুখ ভারতীয় নেতাদের নিয়ে লন্ডনে এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করতে মনস্থ করেছে। বড়লাটের ঘোষণাপত্রের একাধিক স্থলে ভারতের ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দেওয়াই যে ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য— একথা বলা হয়েছিল। অক্টোবরে বড়লাট জিন্নাকে এই মর্মে এক পত্রও দিয়েছিলেন। কংগ্রেস, লীগ এবং লিবারেলসহ তাবৎ রাজনৈতিক দলের নেতারা বড়লাটের ঘোষণাকে স্বাগত জানান।
গান্ধী, মালব্য, সপ্রু প্রমুখ নেতারা আশা ব্যক্ত করেন যে লন্ডনের ঐ আলোচনা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি মেনে নিয়ে হবে। ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা এই পরিপ্রেক্ষিতে এই জন্য প্রাসঙ্গিক যে নেহরু রিপোর্ট অনুসারে সংবিধানের মূল নীতি এবং শাসন-সংস্কারের সুপারিশ রচিত হয়েছিল ভারতে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এই অনুমানকে ভিত্তি করে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের কলকাতা কংগ্রেস নেহরু রিপোর্টের সঙ্গে সঙ্গে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের আদর্শ সাময়িকভাবে—মাত্র এক বছরের জন্য গ্রহণ করে। সুভাষচন্দ্র এবং জওহরলাল প্রমুখ কংগ্রেসের তরুণ নেতৃবর্গ এবং পূর্ণ স্বাধীনতাকে কংগ্রেসের লক্ষ্য রূপে অবিলম্বে ঘোষণা করার আন্দোলনকারীদের চাপে কলকাতা কংগ্রেসে স্থির হয়েছিল যে পরবর্তী এক বৎসর অর্থাৎ ৩১শে ডিসেম্বর ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংরেজ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে কংগ্রেস সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানাবে ও তার জন্য সংগ্রাম শুরু করবে। সেই সময়সীমা অতিক্রম হতে আর দুই মাস মাত্র বাকি ছিল।
বড়লাট এ ব্যাপারে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলোচনা করতে আগ্রহী ছিলেন। বিঠলভাই প্যাটেল ও জিন্নাও চাইছিলেন যে বড়লাটের সন্ধির জন্য প্রসারিত হাতের যেন মর্যাদা করা হয় এবং এইভাবে বৈধানিক উপায়ে শাসনসংস্কারের পথে যেন এগিয়ে যাওয়া যায়। এই উদ্দেশ্যে জিন্না ইতিপূর্বে (১৯শে জুন) ইংলন্ডের নূতন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পূর্ব-পরিচিত ম্যাকডোনাল্ডকে এক দীর্ঘ পত্র লিখে ভারতীয় নেতাদের নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান এবং অবিলম্বে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন দেবার সপক্ষে ব্রিটিশ সরকারের অভিপ্রায় ঘোষণার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারণ তাঁর মতে এর কমে পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে ক্রমশ জাগ্রত জনমতকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হবে না। ম্যাকডোনাল্ড জিন্নার চিঠির এক অনুকূল উত্তর দেন ১৪ই আগস্ট। সুতরাং বড়লাটের ঘোষণা তাঁর প্রস্তাবেরই প্রতিধ্বনি মনে করে এ ব্যাপারে জিন্নার বিশেষ আগ্রহী হবার কারণ ছিল।
বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য গান্ধী যাতে উদ্যোগী হন তার জন্য জিন্না বিঠলভাই প্যাটেলের সঙ্গে ৩০শে নভেম্বর সবরমতী আশ্রমে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু ২৩শে ডিসেম্বরের পূর্বে বড়লাটের পক্ষে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা সম্ভবপর হয়নি। আলোচনায় বিঠলভাই ও জিন্নার সঙ্গে ভারতীয় প্রতিনিধিদলে ছিলেন গান্ধী, কংগ্রেস সভাপতি মোতিলাল ও সঞ্চ। মোতিলাল ও গান্ধী বড়লাটের কাছে প্রতিশ্রুতি চাইলেন যে ভারতবর্ষকে অবিলম্বে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে—এই ভিত্তিতে বৈঠকে আলোচনা চলবে। বড়লাট সেরকম কোনো প্রতিশ্রুতি দেবার ব্যাপারে অক্ষমতা জানালেন। স্বভাবতই আলোচনা ভেঙে গেল। যে আলাপ-আলোচনায় বসার জন্য জিন্না পর্দার অন্তরালে অনেক পরিশ্রম করেছিলেন এবং যার দ্বারা শাসন-সংস্কারের লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য তিনি বেশ কিছুটা আশা করেছিলেন, তা এইভাবে ব্যর্থ হওয়াতে সঙ্গত কারণেই জিন্না ক্ষুব্ধ হবেন—একথা অনুমান করা যায়।
এর কয়েক দিন পরই রাবীর তটে লাহোরে জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের শর্তযুক্ত নেহরু রিপোর্টকে “রাবীর জলে বিসর্জন” দেবার সিদ্ধান্ত নেবার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ স্বাধীনতাই কংগ্রেসের লক্ষ্য—একথা ঘোষণা করা হল। এই লক্ষ্যপ্রাপ্তির জন্য কংগ্রেস সদস্য ও কর্মীরা আইনসভার সদস্যপদ ইত্যাদি বর্জন করে আইন অমান্য, কর দেওয়া বন্ধ করা এবং ঐ জাতীয় প্রত্যক্ষ অহিংস সংগ্রাম শুরু করবেন স্থির হল।
কংগ্রেসের আইনসভা বর্জন এবং আইন অমান্যের সিদ্ধান্তের সম্বন্ধে ভারতবর্ষের মুসলমান সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। খলিকুজ্জমাঁ এবং তাঁর মতো যাঁরা তখনও পর্যন্ত কংগ্রেস ও লীগ উভয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কংগ্রেস অধিবেশন থেকে স্ব স্ব স্থানে ফেরার পথে তাঁরা প্রস্তাবিত আন্দোলন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ সম্বন্ধে খলিকুজ্জমাঁর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য: “আমার মনে হল যে এরকম প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হতে দিয়ে তিনি (মোতিলাল) তাঁর পুত্রের প্রতি ভালবাসার বেদীমূলে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। স্ব স্ব স্থানে যাবার জন্য ডাঃ আন্সারী, তসদ্দুক এবং আমি অপমানিত, নিরাশাপীড়িত ও ক্রুদ্ধ অন্তরে সন্ধ্যাবেলায় লাহোর থেকে রওনা হচ্ছিলাম।…নেহরু রিপোর্টকে রাবীর জলে বিসর্জিত করার পর আমরা আর ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করার দায়িত্ব নেবার অবস্থায় ছিলাম না। কারণ মুসলমানরা এ লড়াইকে কেবল হিন্দুদের সংগ্রাম বলে বিবেচনা করতে বাধ্য।”(৬)
মহম্মদ আলীও আইন অমান্য আন্দোলন থেকে মুসলমানদের দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে বললেন, “শ্রীযুক্ত গান্ধী সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দুমহাসভাপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি হিন্দুধর্মের প্রভুত্ব এবং মুসলমানদের আত্মসমর্পণের জন্য কাজ করেছেন।”(৭) স্বাধীনতার অর্থ তৃতীয় পক্ষ ব্রিটিশ শক্তির অপসারণ। তাঁদের মধ্যস্থতা বিনা বিবদমান গোষ্ঠীগুলি নিজেদের চেষ্টায় একটা আপোষ রফা করতে পারবেন, পারস্পরিক অবিশ্বাসের জন্য এ ভরসা বহু মুসলমান নেতার মধ্যেই ছিল না। আত্মরক্ষার তাগিদে তাঁরা তাই মধ্যস্থ ব্রিটিশের উপস্থিতির সমর্থক এবং সেই কারণে পূর্ণ স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন। লিবারেল ও বিধাননিষ্ঠ জিন্নার এ আন্দোলনকে ভাল চোখে না দেখার এক অতিরিক্ত কারণ ছিল। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসন-সংস্কারের অভিমুখে অগ্রসর হবার উদ্যোগ করার জন্য কয়েক মাস যাবৎ যে পরিশ্রম তিনি করেছিলেন, তা ব্যর্থ হওয়ায় একে তিনি তাঁর নিজের ব্যক্তিগত পরাজয় রূপে নিয়েছিলেন। তাঁর এই ক্ষোভ ও হতাশার যে কারণ ছিল না, তা বলা যায় না। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে গান্ধীনেতৃত্বে কংগ্রেস তথা ভারতীয় রাজনীতির যে রূপান্তরের সূচনা তার মোদ্দা কথা হল জনতা-মুখী হওয়া। লাহোর কংগ্রেসে যেন রূপান্তরের পূর্ণাহুতি হল। কেবল পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাবই পুরাতন ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ নয়, ভবিষ্যতে কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশন আর বড়দিনের বন্ধে হবে না—দরিদ্র দেশবাসীর পক্ষে যাতে অহেতুক শীতবস্ত্র ইত্যাদি জোগাড় করার জন্য হয়রান না হতে হয় তার জন্য তাঁদের অনুকূল সময়ে হবে ইত্যাদি সিদ্ধান্ত এবং আলোচনা কংগ্রেস তথা ভারতীয় রাজনীতির ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্বন্ধ বিচ্ছেদ। আর ব্রিটিশ লিবারেল ঐতিহ্যে লালিতপালিত জিন্না গান্ধীর প্রত্যক্ষ গণ-সংগ্রামের ভাষা ও কলা- কৌশল জানেন না। সুতরাং এ জাতীয় রাজনীতিতে তিনি কোনোরকম ভূমিকা গ্রহণে অক্ষম। স্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে বিচ্ছেদ এবং পরে তাঁর মৃত্যুতে নিঃসঙ্গ জিন্নার জীবনে রাজনীতি চলে গেলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে কেবল আইনের পেশা তা পূর্ণ করতে পারবে না। এ পরিস্থিতিকে স্বীকার করে নেওয়া তাঁর সত্তার—অস্তিত্বের অবলুপ্তি। স্বভাবসিদ্ধ তীক্ষ্ণ ভাষায় কংগ্রেসের স্বাধীনতা প্রস্তাবকে “রাজনৈতিক হিস্টিরিয়া” আখ্যা দিয়ে জিন্না গান্ধীর প্রতি তীব্র আক্রমণ করে বললেন, “ফ্রান্সের বুরবদের মতো গান্ধীর ধাতই কোনো কিছু শিখতে বা ভুলতে অসমর্থ এবং তাঁর অতীতের হিমালয়-সদৃশ ভ্রান্তিও বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে তাঁর চোখ খুলে দিতে অক্ষম।”(৮) তবে আইন অমান্য আন্দোলনের প্রতি এই জাতীয় মানসিকতার শিকার কেবল জিন্নাই হননি, তাঁর চারিত্র্যধর্মযুক্ত আরও কিছু ভারতীয় নেতাও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। জিন্নাকে লেখা সপ্রুর ৫।১।১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের চিঠি এর এক অন্যতম নিদর্শন।
বলা বাহুল্য কংগ্রেসের নিষ্ঠাবান মুসলমান নেতা ও কর্মীরা কিন্তু পূর্ণোদ্যমে এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। জমায়েত-উল-উলেমা নেহরু রিপোর্টের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে সাময়িক ভাবে কংগ্রেস থেকে দূরে সরে গেলেও আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে আবার কংগ্রেসের কাছাকাছি এল। অনুরূপ ভাবে পাঞ্জাবের অহর পার্টি এবং বাদশা খাঁ ও তাঁর ভাই ডাঃ খাঁসাহেবের নেতৃত্বাধীন খুদা-ই-খিদমদার বা লাল কুর্তাবাহিনী সীমান্ত প্রদেশে এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মার্চ সবরমতী আশ্রম থেকে ৭৮ জন সহকর্মী সহ ২৪১ মাইল দূরবর্তী দাণ্ডীর উদ্দেশে গান্ধীর কুচ করার পর তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী “হিন্দুস্থান উথল পড়েগা” সত্য প্রমাণিত হল। ইতিপূর্বে ২৬শে জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবসের সঙ্কল্পবাক্য পাঠ ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার দ্বিতীয় গণ-আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। লবণ আইন ভঙ্গ এবং খাজনা বন্ধ করার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরবর্তী বারো মাস ভারতবাসী দেশবিদেশের মানুষের সপ্রশংস দৃষ্টির সামনে যে নূতন ইতিহাস সৃষ্টি করে, তার বিস্তারিত উল্লেখের অবকাশ এখানে নেই।
সপ্রুর উৎসাহে ইতিমধ্যে আর এক দফা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ব্যর্থ প্রচেষ্টা করলেন জিন্না। সংগ্রামরত কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা না থাকলেও নানা ধর্ম ও প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০ জন প্রতিনিধি ২৬শে ফেব্রুয়ারি এক সর্বদলীয় সম্মেলনে দিল্লিতে একত্র হলেন। কংগ্রেসকে বাদ দিয়েও তাঁদের পক্ষে কোনো সমাধান সূত্র আবিষ্কার করা সম্ভব হল না।
মার্চের ৭ তারিখে কেন্দ্রীয় পরিষদে শাসন পরিষদের ব্যয়-বরাদ্দের দাবিতে প্রশাসকদের আইন সভার প্রতি দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জিন্না বললেন, “হিন্দুরা আমাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করুন বা না-ই করুন, আমরা এগিয়ে যেতে চাই এবং আমরা এদেশে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের জন্য যথেষ্ট রক্ষাকবচ ব্যবস্থাযুক্ত দায়িত্বশীল সরকার চাই।” ১০ই মার্চ সর্দার প্যাটেলের গ্রেপ্তার ও দণ্ডদানের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় পরিষদে মদনমোহন মালব্যের প্রস্তাবের উপর বলতে গিয়ে গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলনের পুনরায় নিন্দা করেন এবং মুলতুবি প্রস্তাবের উপর ভোটদানে বিরত থাকেন। সেপ্টেম্বরের ভিতর লর্ড আরউইনের সঙ্গে একাধিক পত্র বিনিময় হয় প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকের স্থান ও তারিখ নিয়ে। তিনি যে ধরনের রাজনীতিতে অভ্যস্ত তার একমাত্র সাধন ঐ বৈঠক আরম্ভ হওয়ার বিলম্ব দৃষ্টে তাঁর উদ্বেগ ও ব্যাকুলতা ঐ চিঠিগুলিতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। আরউইন ও জিন্না দৃষ্টিভঙ্গীর অভিন্নতার জন্য পত্র বিনিয়ের মাধ্যমে পরস্পরের গুণগ্রাহী এবং আস্থাভাজনও হয়ে ওঠেন। ১৩ই সেপ্টেম্বর তদানীন্তন ভারতসচিব ওয়েডজউড বেনকে জিন্নাকে সাক্ষাতের সুযোগ দানের অনুরোধ জানানোর প্রসঙ্গে বড়লাট আরউইন তাঁর সম্বন্ধে লেখেন, “বেশ কিছুদিন যাবৎ আমি জিন্নার কার্যকলাপ লক্ষ্য করেছি এবং যদিও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী সর্বদা সরকারের সঙ্গে অভিন্ন নয়, তবু এরকম সূক্ষ্ম বুদ্ধি অথবা স্বাধীন দৃষ্টিকোণবিশিষ্ট কম ভারতবাসীর সঙ্গেই আমার পরিচয় ঘটেছে।”
ইতিমধ্যে সপ্রু ও জয়াকরের কংগ্রেসের সঙ্গে সরকারের একটা আপোস রফা করবার প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। অন্তর্দ্বন্দ্বে ছিন্নবিচ্ছিন্ন তদানীন্তন লীগের রাজনীতির প্রতি জিন্না বীতশ্রদ্ধ ছিলেনই। অপরাপর রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর উপেক্ষায় অধিকন্তু হিসাবে তিনি আহত। সম্যক রাজনৈতিক কার্যকলাপের অভাবে নিঃসঙ্গ জিন্না এই দৌত্যের সঙ্গে যুক্ত না থাকায় যেন আরও বিচ্ছিন্ন। গোলটেবিল বৈঠকরূপী তাঁর উপযুক্ত রাজনৈতিক কার্যকলাপের সূত্রপাত এই দৌত্যের ফলে বিলম্বিত হচ্ছে দেখে বিচলিত জিন্না এই সময়ে (১৮ই আগস্ট) বড়লাটকে এক চিঠি লিখে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সম্বন্ধে “দৃঢ় ও সুনিশ্চিত” হবার পরামর্শ দেন।(৯) ব্রিটিশ সরকারকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করার জিন্নার প্রথম প্রয়াস হিসাবে পত্রটির ঐতিহাসিক মূল্য আছে।
অতঃপর গোলটেবিল বৈঠক আহূত হল এবং বলা বাহুল্য সরকারের সঙ্গে সংগ্রামরত কংগ্রেসের কোনো প্রতিনিধি এতে আহূত হননি বা যোগ দেননি। ১২ই নভেম্বর লন্ডনে এর সূত্রপাত এবং প্রায় দশ সপ্তাহ পরে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের সমাপ্তি। ব্রিটিশ ভারত থেকে বড়লাট কর্তৃক মনোনীত ৫৮ জন প্রতিনিধির মধ্যে জিন্নাও অন্যতম। মনোনীত জমিদারগোষ্ঠী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সাম্প্রদায়িক নেতৃবর্গ এবং লিবারেলদের মধ্যে সপ্রু, জয়াকর, শ্রীনিবাস শাস্ত্রী ছাড়াও আগা খাঁ, স্যার শফী, আলী ভ্রাতৃদ্বয় এবং ড. আম্বেদকর ও ড. মুঞ্জেও প্রভৃতি প্রতিনিধিদলে · ছিলেন। এছাড়া দেশীয় রাজন্যবর্গের ১৬ জন এবং ইংলন্ডের রাজনৈতিক দলসমূহের ১৩জন প্রতিনিধিও বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বৈঠকের সাধারণ সভায় ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত-শাসনের সপক্ষে বলা ছাড়াও জিন্না ব্রিটিশ ও ভারত সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে “সফল হবার দৃঢ়সঙ্কল্পযুক্ত” সহযোগিতা দেবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এর ফেডারেল কাঠামো সম্পর্কিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপসমিতির সদস্যরূপে প্রস্তাবিত ফেডারেশনের নানা দিক সম্বন্ধে তাঁর সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করেন। এছাড়া প্রতিরক্ষা এবং সিন্ধু সম্পর্কিত উপ-সমিতির সদস্যরূপে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সীমান্ত প্রদেশে শাসন-সংস্কারের পক্ষেও ঐ বৈঠকে ওকালতি করেন। আলোচনা প্রসঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ব্রিটিশ সরকার, দেশীয় রাজন্যবর্গ, হিন্দু এবং মুসলমান—এই চারটি “পক্ষের” মধ্যে রফা হওয়া উচিত মন্তব্য করে ভারতের রাজনীতিতে মুসলমানদের এক নূতন ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রতিনিধিত্বকে কেবল মুসলমানদের মধ্যে সীমিত করেন। পরবর্তী কালে পাকিস্তানের বীজ স্বরূপ মুসলমানদের এই নূতন ভূমিকা—তাদের একটি স্বতন্ত্র “পক্ষ” মনে করা আরও বিকশিত হয়। বক্তৃতা প্রসঙ্গে জিন্না সরকারকে একবার এই প্রচ্ছন্ন শাসানিও দিয়েছিলেন যে সাত কোটি মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পক্ষে সন্তোষজনক সমাধান না করলে তারাও অতঃপর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেবে।
অনেক আলাপ-আলোচনা সত্ত্বেও বৈঠকে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হল না। সম্ভবত ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ছিল না এবং পরস্পরবিরোধী স্বার্থের প্রতিনিধিদের——যাদের পক্ষে কখনই সহমত হওয়া সম্ভব নয়—আমন্ত্রণ করে একত্র করা তারই দ্যোতক। সম্ভবত ভারতের সর্বাপেক্ষা জনসমর্থনপুষ্ট প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা বৈঠকে অংশগ্রহণ না করায় ব্রিটিশ সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ভরসা করেননি। কারণ বৈঠকে বার বার অনুপস্থিত কংগ্রেসের দাবির কথা উঠেছিল। সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জানুয়ারি প্রধানমণ্ডলী ম্যাকডোনাল্ড ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে এক ভাসাভাসা বিবৃতি দিলেন:
“মহামান্য সম্রাটের সরকারের অভিমত এই যে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাসমূহের উপর ভারত শাসনের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তবে তার পূর্বে কিছু কিছু দায়- দায়িত্ব এবং সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার রক্ষার জন্য অন্যবিধ বিশেষ স্থিতিজনিত যে সব রক্ষাকবচ প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করতে হবে।
“অন্তর্বর্তীকালে এজাতীয় যেসব বৈধানিক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হবে এবং তার জন্য যেসব সংরক্ষিত অধিকার বিধিবদ্ধ ও প্রযুক্ত হবে তার ফলে নূতন সংবিধানের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে স্বদেশের শাসনকার্য পরিচালন করার জন্য যে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হবে তাতে যেন কোনো রকম বাধা না পড়ে তা দেখাও মহামান্য সম্রাটের সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য হবে।”(১০)
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাবলীর বর্ণনা শেষ করার পূর্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের উল্লেখ করা দরকার। ৩০শে ডিসেম্বর এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত লীগের (ইতিমধ্যে শফী-লীগ মূল অর্থাৎ জিন্না-লীগের সঙ্গে মিশে গেছে) বাৎসরিক অধিবেশনে জিন্নাসহ গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী মুসলমান নেতাদের প্রশংসা করার সঙ্গে সঙ্গে জিন্নার মনোনীত সভাপতি কবি (বারিস্টার এবং ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে তখন পর্যন্ত লীগের সক্রিয় কর্মী) ড. মহম্মদ ইকবাল এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভিতর বা বাইরে একটি মুসলিম রাষ্ট্রগঠনের প্রস্তাব করেন।(১১) ইকবালের ঐ বক্তব্যের সংবাদ গোলটেবিল বৈঠকের হিন্দু ও শিখ প্রতিনিধিদের কাছে পৌঁছানোর পর তাঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন এবং বৈঠকে মুসলমানদের প্রস্তাবসমূহ সম্বন্ধে তাঁদের সন্দিহান করে তোলে। বৈঠকের মুসলমান সদস্যরা ইকবালের প্রস্তাবে গুরুত্ব না দিলেও রামগোপালের মতে, “…প্রতিনিধিদের আশেপাশে সমবেত একদল মুসলমানের চিন্তায় এ প্রস্তাব আলোড়ন সৃষ্টি করল। মুসলমান প্রতিনিধিদের তাঁরা ইকবালের বক্তৃতাকে গোলটেবিল বৈঠকে মুসলিম দাবির ভিত্তিরূপে উপস্থাপিত করার জন্য অনুরোধ করলেন। বৈঠকে প্রতিনিধিদের কাছ থেকে খুব একটা মনোযোগ লাভে অসমর্থ হবার পর
পৃষ্ঠা: ৭০

তাঁরা নিজেদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে এই আদর্শ প্রচারে ব্রতী হলেন।” (১২) পাকিস্তান শব্দের জনক চৌধুরী রহমৎ আলী ও তাঁর কেমব্রিজ গ্রুপের সূত্রপাতের এই কাহিনী সম্বন্ধে পরে বলা হবে।

১১
পাদটীকা

১. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২২০ পৃষ্ঠা।
২. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ১০১ পৃষ্ঠা।
৩. এটা রামগোপাল এবং উলপার্টের দেওয়া তথ্য। কিন্তু খলিকুজ্জমাঁর বক্তব্য: “এই সভায় মুসলিম লীগ কর্তৃক চোদ্দো দফা…স্বীকৃত হয় এই শর্তে যে যখন কংগ্রেস আর সমস্ত দফা মেনে নেবে তখন লীগ যুক্ত নির্বাচন-ব্যবস্থাতে রাজী হতে পারে।” তাঁর গ্রন্থের ১০১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
৪. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ৪৯১ পৃষ্ঠা
৫. চাগলা; সমগ্রন্থ; ৯৭ পৃষ্ঠা।
৬. সমগ্রন্থ; পৃ. ১০৪। সংগ্রামে অনীহা এবং ব্রিটিশ ছত্রছায়া (ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন) থেকে বঞ্চিত হবার আশঙ্কা সম্ভবত তাঁদের এজাতীয় মানসিকতা গঠনের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করে। তবে খলিকুজ্জমা বা ডাঃ আন্সারী তখনই কংগ্রেস ছাড়েননি। আইন অমান্য আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় কংগ্রেসের “ডিক্টেটার” মৌলানা আজাদ গ্রেপ্তার হবার পর ডাঃ আন্সারী এবং সেপ্টেম্বরে তিনিও গ্রেপ্তার হবার পর খলিকুজ্জমাঁ “ডিক্টেটার” নিযুক্ত হন। যদিও ইতিপূর্বে কংগ্রেসের নির্দেশে রফি আহমদ কিদওয়াই কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করলে সেই আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জানে নির্বাচিত হয়ে খলিকুজ্জমাঁ কংগ্রেসের নির্দেশের অবহেলা করেছিলেন। সমগ্রন্থ; ১০৭ পৃষ্ঠা।
৭. জামালউদ্দীন আহমদ সুলেরী; My Leader; প্রথম খণ্ড; পৃ. ৫২৯। জে. জে. পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৬৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৮. মজুমদার; সমগ্রন্থ; ১২৫ পৃষ্ঠা।
৯. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১১৭ পৃষ্ঠা।
১০. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; ৭১৭ পৃষ্ঠা।
১১. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ১০৮-১০৯ পৃষ্ঠা।
১২. সমগ্রন্থ; ২৩১-২৩২ পৃষ্ঠা।

ইংলন্ডে বসবাস। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে উপেক্ষিত
১২

প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের শেষে প্রধানমন্ত্রী যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তার একটু পরিশিষ্ট ছিল এবং তা হল এই: “…যাঁরা বর্তমানে আইন অমান্য আন্দোলনে ব্যাপৃত তাঁদের কাছ থেকে যদি ইতিমধ্যে বড়লাটের আবেদনে সাড়া আসে, তাহলে তাঁদের সাহায্য নেবারও ব্যবস্থা করা হবে।” এর সূত্র ধরে বড়লাট ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে জানুয়ারি এক বিবৃতি দিয়ে গান্ধীসহ আইন অমান্য অন্দোলনে গ্রেপ্তার নেতাদের নিঃশর্তে মুক্তি দিয়ে এবং কংগ্রেসের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়ে ঐ প্রতিষ্ঠানের নেতাদের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব বিবেচনা করার অনুরোধ জানালেন। অতঃপর গান্ধী-আরউইন চুক্তি সম্পাদিত হল এবং মার্চের করাচী কংগ্রেসে স্থির হল যে প্রতিষ্ঠানের একক প্রতিনিধি হিসাবে গান্ধী দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করবেন। মাঝখানে আবার দমননীতি শুরু করা এবং গান্ধীর অনুরোধে ডাঃ আন্সারীকে গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ করতে রাজী হয়েও সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার জন্য গান্ধীর ঐ বৈঠকে যোগদানের ব্যাপারে সমস্যা দেখা দিলেও শেষ অবধি তিনি ১৪ই সেপ্টেম্বর থেকে ঐ বৈঠকে যোগ দিলেন, যদিও তা শুরু হয়ে গিয়েছিল তার এক সপ্তাহ পূর্বেই।
এই অবকাশে মুসলিম ন্যাশনালিস্ট পার্টির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যার সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের দ্বারা ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম সাম্প্রদায়িকতামূলক মুসলিম সর্বদলীয় সম্মেলনের প্রত্যুত্তর হিসাবে একই বৎসর জুলাই মাসে। জিন্না লীগের কেউ কেউ এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হলেও জিন্না স্বয়ং কিন্তু এর থেকে দূরে ছিলেন। মুসলিম ন্যাশনালিস্ট পার্টি কয়েকটি প্রদেশে দানা বাঁধা শুরু করেছিল এবং ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে লখন-এ এর বাৎসরিক সম্মেলনের সভাপতি স্যার আলী ইমাম ঘোষণা করলেন: “…যদিও তিনি স্বয়ং একদা সেই রাজনৈতিক মতাবলম্বীদের সঙ্গে ছিলেন যাঁরা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার উপর খুবই গুরুত্ব দিতেন এবং তিনি লর্ড মিন্টোর কাছে দরবারকারী মুসলিম প্রতিনিধিমণ্ডলের অন্যতম সদস্যও ছিলেন, গভীর ভাবে বিচার- বিবেচনা করার পর তিনি এই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা কেবল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিপন্থীই নয়, এ প্রথা প্রত্যক্ষভাবে স্বয়ং মুসলমানদের পক্ষে ক্ষতিকারক।(১)
কিন্তু একথা দুঃখজনক হলেও সত্য যে জমায়েত-উল-উলেমা, অর্হর পার্টি এবং মুসলিম ন্যাশনালিস্ট পার্টির সম্মিলিত প্রয়াস সত্ত্বেও অন্তত শিক্ষিত মুসলমান সমাজের মধ্যে জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে স্থাপনা করার ব্যাপারে খুব একটা প্রগতি করা সম্ভবপর হয়নি। রামগোপাল মন্তব্য করেছেন, “প্রত্যুতপক্ষে যেসব মুসলমানেরা পাশ্চাত্য শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং ধর্মের ক্ষেত্রস্থ মানুষদের তুলনায় যাঁরা গণতান্ত্রিক শাসন- ব্যবস্থার ধ্যান-ধারণার সঙ্গে বেশি পরিচিত ছিলেন তাঁরা সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের দিকে হেলে পড়লেন।”(২) একটু অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও এই আপাত বিরুদ্ধ মানসিকতার কারণ আবিষ্কারে ড. রামমনোহর লোহিয়ার বিশ্লেষণী বুদ্ধির সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। তাঁর
পৃষ্ঠা: ৭২

মতে, “সাযুজ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিম্ন জাতি অথবা অল্পশিক্ষিতদের প্রবণতা এবং শাসক ও অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত জাতিসমূহের প্রবণতা হল সংঘাত—এটা বোধহয় এক রকম প্রাকৃতিক বিধানের সমতুল্য। সম্ভবত সঙ্কটকালে সাযুজ্য অস্তিত্ত্বলুপ্তিতে পর্যবসিত হয় এবং সংঘাত কঠোর ভূমিকা নেবার ফলে স্বকীয়তা বজায় রাখতে সমর্থ হয়।”(৩)
জিন্না কিন্তু প্রথম গোলটেবিল বৈঠক সমাপ্ত হবার পর ভারতে প্রত্যাবর্তন করেননি। মনে মনে ইংলন্ডে স্থায়ীভাবে থাকার প্রস্তুতি নিয়ে সেবার তিনি বিলাত গিয়েছিলেন এবং বৈঠক সমাপ্ত হওয়ার পর তার জন্য প্রস্তুতি করছিলেন। শফী লীগের সঙ্গে আভ্যন্তরীণ বিবাদ মিটে গেলেও স্বদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর কাছে শ্বাসরুদ্ধকারী মনে হচ্ছিল।(৪) একই কারণে গোলটেবিল বৈঠকেও তিনি নিঃসঙ্গ বোধ করছিলেন এবং মাঝে মাঝে তদনুরূপ আচরণও করেছেন। এ সম্বন্ধে স্যার মীর্জা ইসমাইলের সাক্ষ্য প্রণিধানযোগ্য: “তিনি (জিন্না) কারও সঙ্গে সহমত হতেন না, শেষ পর্যন্ত এমনকি তাঁর মুসলমান প্রতিনিধিমণ্ডলের সঙ্গেও না। অধিকাংশ বিষয়েই তাঁর নিজস্ব মতামত ছিল এবং একগুঁয়ে হয়ে তিনি এই সব অভিমত আঁকড়ে থাকতেন।…মুসলমান প্রতিনিধিমণ্ডলের নেতা স্যার শফীকে একবার উঠে দাঁড়িয়ে বলতে হয় যে জিন্না নিজের অভিমত ব্যক্ত করছেন প্রতিনিধিমণ্ডলের নয়।”(৫) মুসলমান প্রতিনিধিদের নেতা সরকারিভাবে যিনিই হন না কেন, বাস্তব ক্ষেত্রে এর নেতৃত্বের উপর কব্জা করেছিলেন জমকালো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আগা খাঁ। প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে জিন্নার ভূমিকা সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে রামগোপাল বলেছেন: “মুসলমান প্রতিনিধিদের মধ্যে জিন্না একক সংখ্যালঘু ছিলেন; তিনি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি যৌথ নির্বাচনের ভিত্তিতে একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হবার জন্য আলোচনা করতে প্রস্তুত ছিলেন।”(৬)
বিলাতে থাকা স্থির করে ২৫শে মার্চ তাঁর আসামের অনুগামী আবদুল মতিন চৌধুরীকে সেকথা জানিয়ে লেখেন, “…পরবর্তী দুই তিন বৎসর লন্ডন ভারতের শাসন- সংস্কারে নাটকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি হতে চলেছে।”(৭) জুন মাসে প্রিভি কাউন্সিলে আইনব্যবসা করার ব্যবস্থা পাকা করে বিলাতে পাকাপোক্তভাবে থাকার জন্য ভগ্নী ফতিমা ও কন্যা দীনাকে বিলাতে আনার ব্যবস্থা করলেন এবং লন্ডনের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দিয়ে হ্যাম্পস্টেডে একটি বাড়ি কিনে গুছিয়ে বসলেন।
প্রিভি কাউন্সিলে আইন ব্যবসায়ের সঙ্গে সঙ্গে বহুদিনের অভ্যাসের কারণ জিন্নাকে ভারতের রাজনীতির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হয়েছিল। লীগের আবদুল মতিন চৌধুরী, মাদ্রাজের জাস্টিস পার্টির স্যার এ. পি. পাত্র প্রমুখের সঙ্গে পত্রালাপ এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। ভারতের নূতন বড়লাট লর্ড উইলিংডন (বোম্বের ছোটলাট হিসাবে তাঁর বিরুদ্ধে জিন্নার প্রকাশ্য সংঘর্ষের কাহিনী স্মরণীয়) পুরাতন বিবাদ ভুলে গিয়ে ভারতে রওনা হবার পূর্বে ২১শে মার্চ লন্ডনে জিন্নার বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। অনুমান করা যায় জিন্নার মুসলমান নেতা রূপে রূপান্তরই এই অস্বাভাবিক সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারের মূলে। দুজনের মধ্যে ভারতবর্ষের রাজনীতির কথা অবশ্যই আলোচিত হয়ে থাকবে। পরবর্তীকালে প্রায়শ উইলিংডনের সংখ্যালঘু স্বার্থের দোহাই দিয়ে যাবৎ জাতীয়তাবাদী দাবির বিরোধিতা করার প্রবণতার অন্যতম সূত্র হয়তো জিন্নার সঙ্গে এই যোগাযোগে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
তাঁর গুরু দাদাভাই নৌরজীর মতো জিন্না ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হবার জন্যও চেষ্টা করলেন। প্রথমে “আদর্শে মিল আছে” বলে শ্রমিক দলের দরজায় করাঘাত করলেন। কিন্তু গোলটেবিল বৈঠকে তাঁর ভূমিকায় অসন্তুষ্ট প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড এ ব্যাপারে সাহায্য করা তো দূরের কথা, এমনকি তাঁর সঙ্গে দেখা করার “সময় করে উঠতে পারলেন না।” অতঃপর আগা খাঁর সহায়তা নিয়ে রক্ষণশীল দলের দ্বারস্থ হলেন। সে দলের মনোনয়ন পাবার জন্য “কংগ্রেসের বিপ্লবী ভূমিকার একমাত্র কার্যকরী আভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম দাবিসমূহের প্রতি (ঐ দলের) ক্রমবর্ধমান আগ্রহের উপর ভরসা করতে পারেন বলে আশা করলেন।”(৮) কিন্তু সে দলও তাঁকে পার্লামেন্টের জন্য কোনো নির্বাচন ক্ষেত্রের সুবিধা করে দিতে প্রস্তুত হল না। আশাহত জিন্নার মনে আর একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল—প্রিভি কাউন্সিলের বিচারক হওয়া। কিন্তু এ ব্যাপারেও শেষ অবধি ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি প্রসন্ন হননি।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে একটি মোকদ্দমা উপলক্ষে তিনি ভারতবর্ষে গিয়েছিলেন। সে সময়ে লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতা ও তাতে অংশগ্রহণকারী হিন্দু নেতাদের আচরণে তাঁর হতাশার কথা তিনি ব্যক্ত করেন। সিমলাতে গিয়ে কেন্দ্রীয় পরিষদের সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে দেশের মুসলিম নেতৃত্বে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তার কথা তাঁর ভূতপূর্ব সহকর্মীরা জানান। নিজের বাসস্থান ভারতবর্ষ নয়, ইংলন্ড—এই মর্মের তথ্যযুক্ত নূতন পাসপোর্ট নিয়ে ইংলন্ডে ফিরে যাবার মুখে বোম্বের মুসলিম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সংবর্ধনার প্রত্যুত্তরে জিন্না মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদকে প্ররোচনাদানকারী এক প্রতিভাষণ দিলেন এবং সেই বক্তৃতা প্রসঙ্গে সমগ্র হিন্দু সমাজকে বুদ্ধিহীন আখ্যা দিয়ে ধিকৃত করলেন।(৯) তাঁর এক কালের রাজনৈতিক অনুগামী এবং আইন ব্যবসায়ের শিষ্য মহম্মদ করীম চাগলা প্রকাশ্য বিবৃতিতে ভূতপূর্ব গুরুর সাম্প্রদায়িকতাবাদী মানসিকতার তীব্র সমালোচনা করলেন।
জিন্না দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকেরও প্রতিনিধি মনোনীত হয়েছিলেন এবং পূর্ববৎ পূর্ণোদ্যমে নানা উপসমিতির আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ফেডারাল স্ট্রাকচার উপসমিতিতে প্রস্তাবিত আইন সভার উভয় অংশের ক্ষমতা বণ্টন, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক কারণের জন্য দুটি “হাউস” রাখার যৌক্তিকতা, প্রস্তাবিত সংবিধানে রাজন্যবর্গের স্বার্থকে গুরুত্ব দেবার অযৌক্তিতা প্রস্তাবিত ফেডারেল সরকার ও প্রদেশের মধ্যে রাজস্ব বণ্টন, ফেডারেল আদালত প্রভৃতি বিষয়ে তিনি নিজ অভিমত ব্যক্ত করেন। ফেডারেল স্ট্রাকচার উপসমিতির ৪৫তম বৈঠকে প্রস্তাব করেন, “সংবিধান সম্পর্কে বা তার অন্তর্গত কোনো বিষয়ে কোনো রাজ্যের সঙ্গে মতদ্বৈধ হলে তার নিরাকরণ করবে ফেডারেল আদালত— প্রাদেশিক আদালতসমূহ নয়।”
পূর্বোক্ত সমিতির ১৬ই নভেম্বরের সভায় মন্তব্য করেন, “মুসলিম দাবিসমূহ এবং রক্ষাকবচগুলি সংবিধানের অঙ্গীভূত না হওয়া পর্যন্ত তা আমাদের নিকট গ্রহণীয় হবে না।” ২৬শে নভেম্বর ঐ উপসমিতির সভায় বলেন, “যতক্ষণ না মুসলমানদের জন্য এমন রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করছেন যা তাঁদের মনে পরিপূর্ণ ভাবে নিরাপত্তা ও ভারত সরকারের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে বিশ্বাসের ভাব সৃষ্টি করে, এবং যতক্ষণ না আপনারা তাঁদের সহযোগিতা ও স্বেচ্ছামূলক স্বীকৃতি প্রাপ্ত হন, ততক্ষণ আপনারা ভারতবর্ষের জন্য যে সংবিধানই রচনা করুন না কেন, তা চব্বিশ ঘণ্টার বেশি কাজ করবে না।”
২৭শে নভেম্বরের সভায় উক্ত উপসমিতির সভাপতির সঙ্গে এই অভিযোগ করে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হন যে তিনি হিন্দু ঘেঁষা দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছেন। ইতিপূর্বে ১৪ই অক্টোবর সপ্রু ও গান্ধীর সঙ্গে এবং ২৩শে অক্টোবর জাফরুল্লা খাঁ ও স্যার শফীর সঙ্গেও উপসমিতির বৈঠকে নানা প্রসঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ হয়।(১০)
তবে প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের মতো দ্বিতীয় বৈঠকেরও বাস্তবিক নায়ক জিন্না ছিলেন না। সে মর্যাদা পান ভারতবর্ষের অর্ধনগ্ন বিদ্রোহী ফকির গান্ধী। তাঁর দিকেই সবার দৃষ্টি। সংবাদপত্র এবং এমনকি সাধারণ ব্রিটিশ নরনারী সবার সপ্রশংস দৃষ্টি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং ব্যবস্থাকে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ প্রদানকারী গান্ধীর দিকে। জিন্না এমনকি মুসলমান প্রতিনিধিদের অবিসংবাদী নেতাও হতে পারেননি। আগা খাঁ ও শাসন পরিষদের সদস্য ফজল-ই-হাসানের কৌশলে সে ভূমিকা পালন করেন গোঁড়া সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা। স্বভাবতই জিন্নার অহমিকা এতে আহত হল।
প্রথম বৈঠকের মতো দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকও একই কারণে অর্থাৎ প্রতিনিধিদের পরস্পরবিরোধী ভূমিকা ও দাবির জন্য সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান-সূত্র আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়। অবশ্য এই ব্যর্থতার বীজ প্রতিনিধি মনোনয়নের মধ্যেই নিহিত ছিল। উদাহরণ স্বরূপ কংগ্রেস ও গান্ধীর প্রয়াস সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের কোনো প্রতিনিধিকে মনোনীত করা হয়নি, যদিও হিন্দুদের বিভক্ত করার জন্য তপশিলী সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক প্রতিনিধি ছিলেন এবং ভেদনীতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ড. আম্বেদকর তপশিলীদের জন্যও পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থার দাবি করেন। গোলটেবিল বৈঠক এবং সংবিধানসম্মত পন্থায় ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্তির ব্যর্থতার এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের ভেদনীতি—এ সত্য পদে পদে লক্ষিত হবে।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক প্রসঙ্গে খলিকুজ্জমাঁর জবানিতে জিন্নার এক ভূমিকার কথা উল্লেখযোগ্য, যদিও অপর কোনো সূত্র থেকে তার প্রত্যক্ষ সমর্থনসূচক প্রমাণ মেলে না। (১১) খলিকুজ্জমাঁ বলেছেন: ‘মুসলমানরা তাঁদের তরফ থেকে কংগ্রেসের কথা বলার দাবি খণ্ডন করেছিলেন এবং নিজ দাবিতে অবিচল ছিলেন। এই ভাবে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। কিছুদিন পর মিস্টার জিন্না আমাকে বলেছিলেন যে একটি পর্যায়ে এমনকি স্যার শফীও যৌথ নির্বাচনের প্রস্তাবে রাজী হয়েছিলেন যদি অবশ্য পাঞ্জাব ও বাংলার মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠতার নিশ্চয়তা থাকে। তিনি জানান যে তিনি স্বয়ং এই প্রস্তাব নিয়ে গান্ধীজীর কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু মালব্যজী এবং অপরাপর হিন্দু ও শিখ প্রতিনিধিদের প্রতিরোধের ফলে গান্ধীজী হিন্দু ও শিখ জনমতের প্রকাশ্য অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে যাবার ব্যাপারে তাঁর অক্ষমতার কথা জ্ঞাপন করেন।”(১২)
কালে-ভদ্রে কোনো কাজে ভারতবর্ষে যাওয়া ছাড়া ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ পর্যন্ত জিন্না বিলাতেই ছিলেন। এই সময়ে ভারতবর্ষে ফিরে গিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন মুসলিম লীগের নেতৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে তার মাধ্যমে মুসলিম রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণের জন্য জিন্নার কাছে যেসব নেতা আগ্রহ করতেন তার মধ্যে সস্ত্রীক লিয়াকৎ আলী খাঁ এবং আসামের আবদুল মতিন চৌধুরী প্রমুখ। কিন্তু ভারতবর্ষের তদানীন্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হতাশ ও বীতশ্রদ্ধ জিন্নার মনে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের কোনো ইচ্ছা জাগেনি। তাঁর ঐ সময়কার মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় আবদুল মতিন চৌধুরীকে লিখিত
পৃষ্ঠা: ৭৫

কয়েকটি পত্রে।(১৩) ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে মার্চ জিন্না তাঁকে লেখেন:
“ওখানে আমি এখন কি যে করতে পারি তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না। আপনি অতি সঙ্গত প্রস্তাবই করেছেন—আমার আইন সভায় প্রবেশ করা উচিত। কিন্তু সেখানেও যে খুব একটা কিছু করা যাবে এমন আশা করা যায় কি? এই সব প্রশ্নের কারণ আমার মনে এখনও এই ধারণা বিদ্যমান যে ভারতবর্ষে আমার সেবার কোনো অবকাশ নেই। তবু আমাকে সখেদে এই কথার পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে যে হিন্দুরা সঠিক অবস্থা উপলব্ধি না করা পর্যন্ত ভারতবর্ষকে বাঁচাবার জন্য কিছু করার উপায় নেই।” ২৭শে এপ্রিল তাঁকে লেখেন, “আমাকে ভারতবর্ষে যেতে বলা হয়েছিল—কিন্তু কি করতে? নির্দিষ্ট কোনো কিছু করার প্রস্তাব নেই। এছাড়া ওখানে এখন তেমন কিছু করারও নেই। মতপার্থক্য ও মতভেদ অনেক বেশি গভীর এবং প্রত্যহ এই বিভেদ আরও শোচনীয় রূপ ধারণ করছে। ভারতে জনমত বলে যেটুকু আছে তাও এলোমেলো। এখন বেশ কিছুদিন এ অবস্থার সংশোধন করা যাবে না।…লোকে বলে না—প্রতিটি দেশ নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সরকার পায়। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই।”
হিন্দু নেতৃত্বের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ জিন্না ক্রমশ নিছক মুসলমান নেতায় পর্যবসিত হচ্ছেন—তার নিদর্শনও এই সময়ে পাওয়া যায়। বোম্বের মুসলিম স্টুডেন্স ইউনিয়নের যে বক্তৃতার প্রকাশ্য সমালোচনা চাগলা করেন, তার কথা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের দোসরা মার্চ আবদুল মতিন চৌধুরীকে যে “ব্যক্তিগত ও গোপনীয় পত্র” জিন্না লেখেন তাতেও এই মানসিকতার প্রতিচ্ছবি: “মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে।…হাতের তাস কিভাবে খেলতে হয় তা যদি মুসলমান নেতারা জানেন তাহলে নিঃসন্দেহে সম্প্রদায় যা চান তা পাবেন। আর এ চাহিদাও খুব একটা কিছু নয়।… কেন্দ্রেও দায়িত্ব নেওয়া হবে যদি আমরা যেসব রক্ষাকবচ চাই তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়।” ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর আবদুল মতিন চৌধুরীকে যে সংক্ষিপ্ত চিঠিটি লেখেন তার শেষ ছত্রটি পরবর্তীকালে দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন রূপে প্রতিপাদিত হয়, “জনসাধারণই যখন বিভক্ত তখন আর কি আশা করা যেতে পারে? এ ভারতবর্ষের বিধিলিপি।”
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক থেকে প্রত্যাবর্তন করামাত্র গান্ধী জানতে পারলেন যে সরকারি নীতির পরিবর্তন ঘটেছে—জওহরলাল, সীমান্ত গান্ধী প্রমুখ নেতারা আবার কারাগারের অন্তরালে। অনতিবিলম্বে গান্ধীও বন্দী হলেন এবং স্বভাবতই কংগ্রেস আবার যুদ্ধের পথ গ্রহণ করল। যেসব ভারতীয় নেতা কারাগারের বাইরে ছিলেন তাঁরা দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানের সূত্র খুঁজে বার করার যে চেষ্টা আরম্ভ করলেন, তার অন্যতম নিদর্শন হল ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে মদনমোহন মালব্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এলাহাবাদের ঐক্য সম্মেলন। এতে হিন্দু ছাড়াও লীগপন্থী ও জাতীয়তাবাদী মুসলমান এবং শিখ প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ সম্বন্ধে খলিকুজ্জমাঁ বলেছেন: “ঐক্য সম্মেলন যে প্রশ্নটি নিয়ে সর্বাগ্রে আলোচনা করে তা হল কেন্দ্রীয় সরকারে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব। হিন্দুরা শতকরা ২৫ ভাগ দিয়ে আরম্ভ করেন এবং শতকার ৩২ ভাগ মেনে নেবার জন্য পাঁচদিন সময় নষ্ট করেন। মুসলমানরা তবুও অসন্তুষ্ট ছিলেন। এর পরদিন অর্থাৎ ১৭ই আগস্ট লন্ডন থেকে রয়টার এক তারবার্তায় জানাল যে, বাঁটোয়ারার দ্বারা মুসলমানদের কেন্দ্রীয় পরিষদের শতকরা ৩৩.৩৩ ভাগ আসন দেওয়া হয়েছে এবং বোম্বাই থেকে সিন্ধুকে এক পৃথক প্রদেশে পরিণত করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে। সুতরাং ঐ সম্মেলনের কপাল পুড়ল।”(১৪)
জি সাম্রাজ্যবাদী ভেদনীতির এই ভূমিকা সম্বন্ধে প্যারেলালের মন্তব্যও প্রণিধানযোগ্য: “…এলাহাবাদের ঐক্য সম্মেলনে হিন্দু ও মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে প্রায় একমত হয়েছিলেন এবং সিন্ধুর পুনর্গঠন একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ অনির্ধারিত বিষয়রূপে বিবেচ্য ছিল। প্রস্তাব ছিল—সিন্ধুকে (বোম্বাই থেকে) পৃথক করে এক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে পরিণত করা হবে এবং পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থার বদলে যৌথ নির্বাচন-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে। কিন্তু যে- মুহূর্তে সম্মেলনের মুসলমান প্রতিনিধিরা এই শর্তে যৌথ নির্বাচন-ব্যবস্থায় রাজী হয়েছেন যে সিন্ধুকে একটি পৃথক প্রদেশে পরিণত করা হবে, ভারত সচিব স্যার স্যামুয়েল হোর অস্বাভাবিক তৎপরতার সঙ্গে যৌথ নির্বাচন ছাড়াই ঐ দাবি মেনে নিলেন। এর পরিণামে ঐ সম্মেলন ব্যর্থ হল।(১৫)
ম্যাকডোনাল্ডের ১৭ই আগস্টের ঘোষণায় এছাড়া প্রাদেশিক বিধানসভাসমূহে পাঞ্জাবে জমিদার ও তোমানদারদের প্রতিনিধিসহ মুসলমানদের এক ধরনের নামমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিলেও (জনসংখ্যার ভিত্তিতে মুসলমানদের শতকরা ৫৫ ভাগ আসন পাবার কথা) বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না দিয়ে ইউরোপিয়ান (জনসংখ্যার শতকরা ০.০১ ভাগের জন্য শতকরা ১০ ভাগ আসন) ও ইঙ্গ-ভারতীয়দের মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের জন্য ৩০টি আসন নির্ধারণ করা হয়। পাঞ্জাবে হিন্দুদের আসন জনসংখ্যার অনুপাতে হ্রাস করে শিখ ও অন্যান্য স্বার্থের পুষ্টিসাধন করা হয়। অনুরূপ ভাবে বঙ্গেও হিন্দুদের জন্য জনসংখ্যার ভিত্তিতে শতকরা ৪৪.৮ ভাগ আসন না দিয়ে ৩২ ভাগ আসন নির্ধারিত করা হয়। মুসলমানরা যেসব প্রদেশে সংখ্যালঘিষ্ঠ বিধানসভায় সেখানে তাঁদের জনসংখ্যার তুলনায় বেশি আসন দেওয়া হয় এবং সিন্ধু ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে হিন্দুরাও জনসংখ্যার অনুপাতে বেশি আসন পান। এছাড়া অতঃপর কেবল শিখ ও ভারতীয় খ্রিস্টানদের জন্যই পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা করা হয়নি (ইউরোপীয়ান ও ইঙ্গ-ভারতীয়দের জন্য তো বটেই), হিন্দুদের থেকে তপশিলীভুক্ত জাতিদের পৃথক করে তাঁদের জন্যও পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা করা হয়। সংক্ষেপে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করার সম্ভাব্য সকল রকমের ব্যবস্থা করা হয়।
কারাপ্রাচীরের অন্তরালে বন্দী মহাত্মা গান্ধী তপশিলীভুক্ত জাতিদের হিন্দুসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে ২০শে সেপ্টেম্বর থেকে আমরণ অনশন শুরু করে নিজের প্রাণকে বিপন্ন করেন। এর ফলে দেশে এক প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আম্বেদকর সহ তাবৎ হিন্দু নেতাদের ভিতর সৎবুদ্ধি জাগ্রত হয় এবং তপশিলীভুক্ত জাতিদের জন্য সংখ্যার অনুপাতে অধিক সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থাযুক্ত তাঁদের “পুণা চুক্তি”র ফলে সরকার তাঁদের জন্য পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেন।
ম্যাকডোনাল্ডের ঘোষণার যে ধারার (সংশ্লিষ্ট পক্ষরা যদি নিজেদের মধ্যে কোনো বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পারেন তাহলে তদনুসারে ঘোষণার প্রাবধানে পরিবর্তন করা যেতে পারে) পরিপ্রেক্ষিতে “পুণা চুক্তি” ও তপশিলীভুক্ত জাতিদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বর্জিত হয়েছিল। এর অনুসরণে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা সকলের গ্রহণযোগ্য একটা সমাধানসূত্র খুঁজে বার করার জন্য তেসরা নভেম্বর এলাহাবাদে পণ্ডিত মালব্যের সভাপতিত্বে এক সম্মেলনে মিলিত হন। কয়েক দিনের চেষ্টায় এই সমাধানসূত্র স্বীকৃত হয় যে শর্তসাপেক্ষ যৌথ নির্বাচন-ব্যবস্থার বিনিময়ে মুসলমানদের কেন্দ্রীয় পরিষদে শতকরা ৩২ ভাগ আসন দেওয়া হবে এবং কেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব সহায়তা চাওয়া না হলে সিন্ধু এক পৃথক প্রদেশে পরিণত হবে। এ ছাড়া পাঞ্জাব ও বঙ্গে মুসলমানরা শতকরা ৫১ ভাগ আসন পাবেন এবং হিন্দুরা যেসব প্রদেশে সংখ্যালঘু সেখানে তাঁদের জন্য ম্যাকডোনাল্ডের ঘোষণার তুলনায় কিছু কিছু অধিক সংখ্যক আসন বরাদ্দ করা হবে। কিন্তু সম্মেলন চলাকালীন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে ডিসেম্বর ভারতসচিব স্যার স্যামুয়েল হোর ঘোষণা করেন যে কোনো রকম শর্ত ছাড়াই তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকে মুসলমানদের জন্য কেন্দ্রে শতকরা ৩৩.৩৩ ভাগ আসন এবং অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় সাহায্যসহ সিন্ধুকে স্বতন্ত্র প্রদেশরূপে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং স্বভাবতই সাম্রাজ্যবাদী সরকারের চালের কাছে ভারতীয়দের অপর একটি ঐক্য-প্রয়াসও ব্যর্থ হয়ে গেল।
তৃতীয় বা শেষ গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেসের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। কংগ্রেস তখন আবার সরকারের সঙ্গে সংগ্রামরত এবং গান্ধী নেহরু আজাদ প্রমুখ নেতারা কারানির্বাসিত। জিন্নাও তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক থেকে নির্বাসিত—সম্ভবত তাঁর পুরাতন প্রতিদ্বন্দ্বী স্যার ফজল-ই-হাসানের প্রভাবে তাঁকে প্রতিনিধিরূপে মনোনীতই করা হয়নি। আগা খাঁ, জাফরুল্লা খাঁ, সপ্রু, জয়াকর, আম্বেদকর এবং পাত্র প্রমুখেরা যেখানে হার্ডিঞ্জ, আরউইন, অ্যাটলী ও জেটল্যান্ড প্রভৃতির সঙ্গে ভারতের সাংবিধানিক প্রশ্ন নিয়ে পাঞ্জা লড়ছেন, জিন্নাকে সেখানে সুপরিকল্পিতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি লিনলিথগোর সভাপতিত্বে গঠিত পার্লামেন্টের জয়েন্ট সিলেক্ট কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিতেও তাঁকে আহ্বান করা হয়নি। এই উপেক্ষা জিন্নার অহমিকাকে নিঃসন্দেহে প্রবল ভাবে আঘাত করে থাকবে। তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকের অবসানে (২৪শে ডিসেম্বর ১৯৩২) আসন বণ্টন সম্বন্ধে ভারতসচিব যে ঘোষণা করেন তার কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঐ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে শাসন-সংস্কারের আইন রচিত হতে কিন্তু আরও আড়াই বছর সময় লাগল। ভারতসচিব এতদসংক্রান্ত শ্বেতপত্র ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে পার্লামেন্টে পেশ করলেন এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে নূতন ভারত-শাসন আইন বিধিবদ্ধ হল।

১২
পাদটীকা

১. রাজেন্দ্রপ্রসাদ; সমগ্রন্থ; ১৩৪ পৃষ্ঠা।
২. সমগ্রন্থ; ২২৭ পৃষ্ঠা।
৩. ড. রামমনোহর লোহিয়া; Guilty Men of India’s Partition. রামমনোহর লোহিয়া সমতা বিদ্যালয় ন্যাস; হায়দ্রাবাদ – ১২ (১৯৭০); ৯ পৃষ্ঠা।
৪. এর বড় একটি কারণ সম্ভবত মুসলিম নেতৃত্বের উগ্র সাম্প্রদায়িকতাপন্থী অংশের ভূমিকা। প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের প্রতিনিধিরা ভারতে ফেরার পর পারস্পরিক বোঝাপড়ার যে আবহাওয়া তৈরি হচ্ছিল, তাতে বাদ সাধল এপ্রিলে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত অখিল ভারত মুসলিম সম্মেলনের সুপারিশসমূহ। প্রস্তাবিত ফেডারেল সংবিধান সম্বন্ধে “ঐ সম্মেলন ফেডারেশনের অঙ্গীভূত অংশগুলির জন্য স্বায়ত্ত্বতা দাবি করল . এবং…(বলল যে) তাদের হাতেই বাদবাকি (residuary) সব ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে।” বস্তুত পার্লামেন্ট থেকে তাবৎ ক্ষমতার হস্তান্তরণ হবে প্রদেশগুলির হাতে এবং…ফেডারেশনের স্বায়ত্ত্বশাসিত একগুলির পারস্পরিক সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো বিষয়কে ফেডারেশনের কর্তৃত্বাধীন করা যাবে না। এর তাৎপর্য হল এই যে প্রদেশগুলির মতোই দেশীয় রাজ্যসমূহে আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব সমান শক্তিশালী হবে, মুসলমানরা কেন্দ্রকে কেবল ততটুকুই ক্ষমতা ছেড়ে দেবে যতটুকু দেশীয় রাজন্যবর্গ স্বেচ্ছায় ছাড়তে প্রস্তুত হবেন। মুসলমানদের কেন্দ্রীয় আইনসভার এক- তৃতীয়াংশ আসন দিতে হবে। এটা কোনো নূতন দাবি ছিল না সত্য কিন্তু গোলটেবিল বৈঠকে অখিল ভারতীয় ফেডারেশান সম্বন্ধে আলোচনা হবার পূর্বে এ দাবি কেবল ব্রিটিশ ভারত সম্বন্ধেই প্রযোজ্য ছিল। অতঃপর মূলত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ … দেশীয় রাজ্যসমূহের বিষয় বিবেচিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অখিল ভারতীয় কেন্দ্রের জন্যও একই দাবি করা হল।…মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা বজায় থাকবে বলা হল। শাসন পরিষদ এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে মুসলিম স্বার্থ স্বীকৃত হয়। কোনো আইন সভাতেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো বিষয়ের আলোচনা হবে না যদি মুসলমান সদস্যদের তিন-চতুর্থাংশ তার বিরোধিতা করে।”(আর জে. মূর; Endgames of Empire; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি, – (১৯৮৮); পৃষ্ঠা ৪৯-৫০।
মুসলিম জনমতের এই অংশকে আলাপ আলোচনার দ্বারা জাতীয় দাবির মূল প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য গান্ধীর মে মাসের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় প্রধানত বড়লাটের শাসন- পরিষদের সদস্য মিঞা ফজল-ই-হাসানের উদ্যোগে ও মুসলিম সংবাদপত্রসমূহের প্রচারে। ফলে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের মুসলমান প্রতিনিধিরা পৃথক নির্বাচন- ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য মন তৈরি করে তাতে যোগ দেন।
জিন্নাবিহীন তদানীন্তন ভারতের মুসলিম নেতৃত্বের মানসিকতা সম্বন্ধে আরও দুটি প্রমাণও এ প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়। কারণ পাকিস্তানের পূর্বাভাস এতে মেলে। ভারতে সফররত জনৈক সাংবাদিকদের অধ্যয়নের ভিত্তিতে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুন ইংলন্ডের ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ানে নিম্নোক্ত বিবরণ প্রকাশিত হয়: “মুসলমানরা দেখছেন যে যদি কখনো নূতন ফেডারেল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে তাতে হিন্দুদের প্রভূত সংখ্যা-গরিষ্ঠতা থাকবে। দেশীয় রাজ্যগুলির যোগদানের ফলে এই সংখ্যা-গরিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পাবে। কারণ সেখানকার জনসাধারণ প্রধানত হিন্দু। এই স্থায়ী সংখ্যা-গরিষ্ঠতাকে বাধা দেবার জন্য মুসলমানদের মধ্যে একটি প্রবল প্রবণতা হল উত্তরে মুসলমান অধ্যুষিত এক বৃহদায়তন প্রদেশগোষ্ঠী সৃষ্টি করা। ঐ অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় হিন্দুরা স্বভাবত কেন্দ্রে ও দক্ষিণে তাঁদের সমধর্মাবলম্বীদের সদাচারের জন্য প্রতিভূ হয়ে থাকবেন।…বহু মুসলমানই ফেডারাল ভারতের স্থায়িত্বে বিশ্বাসী নন এবং তাঁরা উত্তরে করাচী থেকে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি মুসলিম রাজ্যের সম্ভাবনা দেখতে পান। লেখক এই ‘প্রতিভূ তত্ত্ব বহুল প্রচলিত লক্ষ্য করেন।” অনুরূপভাবে সেপ্টেম্বরে এক “ক্যাবিনেট পেপার”-এ সাম্প্রদায়িক সমস্যা বনাম কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয় “মুসলমানদের ‘প্রাথমিক উদ্দেশ্য’ হল এক মুসলিম ভারত-এর সৃষ্টি; পরবর্তী লক্ষ্য ভ্যান হল প্রতিভূ তত্ত্ব প্রয়োগ করে অন্যত্র মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ।”(মূর; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৫০)।
৫. My Public Life; জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন, লন্ডন (১৯৫৪); ৬৮ পৃষ্ঠা।
৬. সমগ্রন্থ; ২৩৩ পৃষ্ঠা।
৭. পীরজাদা (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; ২১ পৃষ্ঠা।
৮. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১২৬ পৃষ্ঠা।
৯. মহম্মদ করীম চাগলা; সমগ্রন্থ ১০২-১০৩ পৃষ্ঠা। এম.এইচ.সঈদের Sound of Fury অনুসারে (১৭১ পৃষ্ঠা) “আমি প্রথমে ভারতীয় তারপর মুসলমান” মন্তব্য করার পর কাজী জিন্না ঐ বক্তৃতায় বলেন: “এর সঙ্গে সঙ্গে আমি একথাও বিশ্বাস করি যে . মুসলমানদের স্বার্থ উপেক্ষা করে কোনো ভারতবাসী কখনও তাঁর স্বদেশের সেবা করতে পারবেন না।…একথা আমি প্রকাশ্যে বলেছি। কোনো দলবিশেষের প্রতি আমার নজর নেই। জনপ্রিয়তার প্রতি আমার কোনো আকাঙ্ক্ষাও নেই। খোলাখুলি আমি আপনাদের বলছি যে হিন্দুরা মূর্খ, তাঁরা যে দৃষ্টিভঙ্গী আজ গ্রহণ করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে বলব যে তাঁরা একান্তভাবে মূর্খ। অধিকাংশ হিন্দুরই নিজেদের মস্তিষ্ক ও মনের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই—আপনারা একথা না জানলেও আমি একথা জানি। আমি আপনাদের বলতে পারি যে হিন্দুদের ভিতর সাহস ও বিশ্বাসের সৃষ্টি না হলে (তাঁরা মুসলমানদের ভয়ে ভীত) এই ভারতবর্ষ কোনোদিনই স্বরাজ পাবে না। ব্যাপারটা – যৌথ বা পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা অথবা পাঁচ-দশটা আসনের নয়। হিন্দুদের প্রয়োজনীয় সাহস নেই এবং হিন্দুরা মুসলমানদের সম্বন্ধে ভীত।
১০. দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে জিন্নার ভূমিকা সম্বন্ধিত তথ্য শরীফ-অল-মুজাহিদের গ্রন্থের ৫৬৫-৬৭ পৃষ্ঠা থেকে গৃহীত।
১১. স্যার শফী কর্তৃক পৃথক নির্বাচন-প্রথার কট্টর সমর্থকের ভূমিকা ছেড়ে কিছুটা দেওয়া- নেওয়ার ভিত্তিতে একাধিক বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ার পরোক্ষ সমর্থন অবশ্য মেলে (দ্রষ্টব্য রামগোপাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২৩২-৩৩)। এছাড়া দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠকের প্রাক্কালে ভারতবর্ষে সফরকালীন ৮ই আগস্ট ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে সংযুক্ত প্রদেশ মুসলিম সম্মেলনে জিন্নার ভাষণের অংশবিশেষও এ প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়। তিনি বলেন:
“আমার মতে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল হিন্দু-মুসলিম সমঝোতার সমস্যা। এ সম্বন্ধে আমি কেবল এইটুকুই বলতে পারি যে আমার আন্তরিক বিশ্বাস এই যে • হিন্দুদের পাঞ্জাব ও বঙ্গে মুসলমানদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেবার প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া উচিত। আর তা যদি তাঁরা দেন তবে অত্যল্প সময়ের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে যেতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।
“দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, পৃথক বনাম যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থার। সবাই প্রায় জানেন যে পাঞ্জাব ও বঙ্গে (মুসলমানদের) সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেনে নিলে, আমি ব্যক্তিগতভাবে
পৃষ্ঠা: ৮০

যৌথ নির্বাচন-ব্যবস্থার ভিত্তিতে বোঝাপড়ায় উপনীত হওয়া পছন্দ করব (করতালি)। তবে আমি একথাও জানি যে মুসলমানদের মধ্যে অনেকে—আমার মনে হয় অধিকাংশই পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার সমর্থক। আমার ভূমিকা হল এই যে আমি বরং পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার ভিত্তিতেও একটা বোঝাপড়া কাম্য মনে করব। করব এই আশা ও বিশ্বাস নিয়ে যে যখন আমরা নূতন সংবিধানকে রূপ দেব এবং হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই যখন অবিশ্বাস, সন্দেহ ও পারস্পরিক ভীতির প্রভাবমুক্ত হবে এবং যখন তারা তাদের স্বাধীনতা পাবে, আমরা তখন কালোপযোগী মানসিকতার পরিচয় দিতে পারব ও সম্ভবত আমাদের মধ্যে অনেকের ধারণার এ তুলনায় অনেক তাড়তাড়ি পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার অবসান হবে।”(রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২৩৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত)।
১২. সমগ্রন্থ; ১১৩ পৃষ্ঠা।
১৩. পীরজাদা (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; ২১-২৪।
১৪. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ১১৮ পৃষ্ঠা।
১৫. Mahatma Gandhi – The Last Phase (অতঃপর Last Phase রূপে উল্লেখ করা হবে) প্রথম খণ্ড; নবজীবন, আহমেদাবাদ (১৯৬৫); ৭৫ পৃষ্ঠা।

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা — জিন্নার সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত
১৩

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে জিন্না ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করলেন। তবে প্রথমেই একেবারে স্থায়ীভাবে নয়। বেশ কিছুদিনের জন্য মাঝে মাঝে লন্ডনে ফিরে গেছেন। তারপর পাকাপোক্ত ভাবে আবার বোম্বেতে বসতি।
দেশে ফেরার কারণ হিসাবে তাঁর গুণগ্রাহী এবং অনুগামী সস্ত্রীক লিয়াকত আলী খাঁ এবং আবদুল মতিন চৌধুরীর প্রয়াসের কথা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত ও শক্তিহীন মুসলিম লীগের কিছু কিছু নেতার জিন্নার কাছে ঐ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হাতে নিয়ে মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেবার আবেদন অবশ্যই তাঁর মনে সাড়া জাগিয়েছিল। উদ্ধারকর্তা হবার বাসনা সুযোগ পেলে কার মনেই না জাগে? অপর একটি সম্ভাব্য কারণ—তাঁর পিছনে কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং জনমতের সমর্থন আছে, এই নিদর্শন পেশ করা। তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকে এবং জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে তাঁর উপেক্ষা হয়তো তাঁকে এইভাবে শক্তিসম্পন্ন হবার জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকবে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের শেষে অনুষ্ঠিত কলকাতার সর্বদলীয় সম্মেলনে তিনি কার প্রতিনিধি—এ প্রশ্ন তাঁর বিরোধীরা তুলেছিলেন। তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকে অনিমন্ত্রিত থাকার আঘাত হয়তো তাঁর মনে সেই পুরাতন ক্ষতের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছিল। বার বার একই কারণে আঘাত পাওয়া স্বভাবতই তিনি এড়াতে চাইবেন। এছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাঁর বিলাত ছাড়ার। এ সম্বন্ধে তাঁর এক কালের জুনিয়ার ব্যারিস্টার চাগলা লিখেছেন, “প্রিভি কাউন্সিলে তাঁর আশানুরূপ পশার জমেনি। কারণ মূলত তিনি আইনজ্ঞের (lawyer) বদলে উকিল (advocate) ছিলেন। আর প্রিভি কাউন্সিলে সবল ব্যক্তিত্ব ও অপরকে স্বমতে আনার মতো ওকালতির ক্ষমতার অতিরিক্ত কিছু চাই।”(১)
তাঁর দেশে ফেরার পূর্বে মুসলিম লীগের বিবদমান দুই গোষ্ঠীর নেতারা (পেশওয়ারের মিঞা আবদুল আজীজ ও খাঁ বাহাদুর হাফিজ হিদায়েৎ হোসেন) পৃথক পৃথক ভাবে নিজ গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য সমাপ্ত করে জিন্নার সভাপতিত্বে (মার্চ মাসে জিন্না লীগের স্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হন) পুনর্গঠিত লীগের অঙ্গীভূত হয়ে যান। জিন্না দিল্লিতে ঐক্যবদ্ধ লীগ কাউন্সিলের সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং উপস্থিত সদস্যগণ কর্তৃক বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। সভাশেষে এক সংবাদপত্র প্রতিনিধির কাছে বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন, “লীগ বেশ স্বাস্থ্যসম্পন্ন ও সুস্থই আছে। আর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে ভারতের স্বার্থ সাধনের জন্য মুসলমানরা আর সব সম্প্রদায়ের তুলনায় পিছিয়ে থাকবে না।” ছিন্নভিন্ন লীগের কর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করে তাঁদের বৃহত্তম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানের নূতন কর্ণধারের পক্ষে এজাতীয় উক্তি করাই স্বাভাবিক। তাই পূর্বোক্ত বিবৃতিতে তিনি বললেন, “আমরা কি এই শেষ মুহূর্তেও লড়াই শেষ করতে পারি না এবং প্রত্যাসন্ন বিপদের সামনেও কি অতীত বিস্মৃত হওয়া একেবারেই অসম্ভব? দেশবাসীর বিবেকের কাছে পূর্বোক্ত আবেদন জানিয়ে তিনি নিজের বিশ্বাসের পুনরুক্তি করলেন: “…হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণ সহযোগিতা ও মৈত্রী স্থাপনার চেয়ে আর কোনো কিছু আমার কাছে তেমন সুখকর নয় এবং আমার এই বাসনাপূর্তির ব্যাপারে আমার মনে হয় মুসলমানদের অবিচল সমর্থন রয়েছে।…জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের দাবি জ্ঞাপন করার ব্যাপারে মুসলমানরা অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। সুতরাং মোদ্দা প্রশ্ন হল: মুসলমানদের আমরা কি পূর্ণত ভরসা দিতে পারি যে তাঁরা যে সমস্ত রক্ষাকবচের উপর এতটা গুরুত্ব দেন, সেগুলি ভারতবর্ষের সংবিধানে স্থান পাবে?”(২)
লক্ষণীয়, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দেও ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কথা তিনি অন্তত বলছেন না। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ঐ বছরের সেপ্টেম্বর মাসেও তিনি বলেছেন যে, “আমি প্রথমে ভারতবাসী, তারপর মুসলমান।”(৩) এর পাঁচ মাস পরও ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে তিনি নিজের বিশ্বাসের পুনরুক্তি করে বলেছিলেন, “… হিন্দু ও মুসলমানরা যত দিন না ঐক্যবদ্ধ হয় ততদিন ভারতবর্ষের পক্ষে আশার কিছু নেই—একথা আপনাদের বলতে পারি এবং আমরা (উভয় সম্প্রদায়ই) বিদেশী প্রভুত্বের অধীন থাকব।”(৪) সে সময় পর্যন্ত তিনি যা চাইছেন তা হল মুসলমানদের জন্য কিছু কিছু রক্ষাকবচ এবং সংবিধানে তার স্থায়ী স্বীকৃতি। তবে এসময়ে এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তাঁর গোলটেবিল বৈঠকের ভূমিকা অনুসরণে জিন্না ভারতের রাজনীতিতে কেবল মুসলমানদের নেতা—তাঁদের স্বার্থের সংরক্ষক। এ সম্বন্ধে চাগলা লিখেছেন, “এই সময়ে হাইকোর্টের বার লাইব্রেরিতে তাঁর সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছিল, তার কথা মনে পড়ছে। মুসলিম লীগকে পুনর্জীবিত করার জন্য তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে বলেছিলেন। আমি জবাব দিয়েছিলাম যে সেটা অসম্ভব। আমি এও বলেছিলাম আমাদের যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আসলে কাজ করা উচিত তা হল হিন্দু ও মুসলমানদের নিয়ে এক সম্মিলিত রাজনৈতিক দল গঠন এবং এই দল কংগ্রেস এবং (হিন্দু) মহাসভার মাঝামাঝি থেকে কাজ করবে।…জিন্না উত্তরে বলেছিলেন যে আমি আদর্শবাদী কিন্তু তাঁকে কাজ করতে হবে তাঁর আশেপাশে যেসব উপাদান রয়েছে তার সহায়তায়। সেই সময়ে আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে সাম্প্রদায়িক মঞ্চ থেকে কাজ করা এবং সাম্প্রদায়িক পদ্ধতির সহায়তায় নিজের নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে তিনি মনঃস্থির করে ফেলেছেন।”(৫)
নির্বাচনে প্রথম অংশগ্রহণ করা অবধি জিন্না কেন্দ্রীয় পরিষদে বোম্বাই-এর মুসলমান আসনের প্রতিনিধি এবং তিনি বিলাতে থাকলেও ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ফেব্রুয়ারি ঐ একই আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তাঁর বন্ধুরা তাঁর কাছ থেকে মনোনয়নপত্র ইত্যাদি আনিয়ে দাখিল করেছেন।(৬) এছাড়া ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের গোড়ায় কংগ্রেস ছাড়ার পর থেকে যে রাজনৈতিক দল তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে, নূতন করে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে আবার স্থান করে নেবার জন্য তার ভরসা ছেড়ে ঐ বয়সে (৫৮ বছর) আর কোথাও যাবার ব্যাপারে ঝুঁকি না নেবারই কথা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের নিরাপত্তার জন্য তাঁর মুসলিম সাম্প্রদায়িক স্বার্থের প্রবক্তা হওয়াই স্বাভাবিক।
যাই হোক, পূর্বোক্ত এক অনুচ্ছেদে সংবাদপত্র প্রতিনিধির কাছে বিবৃতি দান প্রসঙ্গে জিন্না যে “আসন্ন বিপদের” প্রতি সঙ্কেত করেছিলেন, তার প্রতি এবার দৃষ্টিপাত করা যাক। এই বিপদ হল নূতন ভারতশাসন আইন প্রণয়ণের উদ্দেশ্যে ইংলন্ডের পার্লামেন্টে যে শ্বেতপত্র বিবেচিত হচ্ছিল এবং যা অবলম্বন করে শীঘ্রই ভারতের কেন্দ্রীয় পরিষদে প্রস্তাব উঠবে তার ধারাগুলি। ম্যাকডোনাল্ডের বাঁটোয়ারায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত আসন সংখ্যা ঘোষণা করে দেশবাসীর মনোযোগ ভিক্ষান্ন নিয়ে টানাহেঁচড়ার উদ্দেশ্যে নিয়োগ করলেও যে শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা উঠেছিল তাতে ভারতবাসীর হাতে সত্যকার ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছার কোনো প্রতিফলনই ছিল না। ভোটার হবার যোগ্যতা ছিল সীমাবদ্ধ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ছোটলাট বা বড়লাটের অনুগ্রহে কাজ করবেন। তাবৎ ক্ষমতা ব্রিটিশরাজের হাতে ন্যস্ত থাকবে।
বলা বাহুল্য দেশের যাবতীয় রাজনৈতিক দল সহ লীগ এবং জিন্নাও শ্বেতপত্রের এই অগণতান্ত্রিক প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। ইতিমধ্যে নভেম্বরে জিন্না বোম্বাই-এর মুসলিম আসন থেকে কেন্দ্রীয় পরিষদে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন এবং পূর্ববৎ নানা সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে গঠিত তাঁর ইন্ডিপেনডেন্ট গোষ্ঠীর নেতাও হয়েছেন। সুতরাং শ্বেতপত্রের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কস্টিটিউশনালিস্ট জিন্না কেন্দ্রীয় পরিষদরূপী চমৎকার মঞ্চ পেয়ে গেলেন।
তবে সে সম্বন্ধে বলার পূর্বে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা সম্বন্ধে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারণ পরবর্তীকালের ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বিদ্যমান। বাঁটোয়ারায় জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যযুক্ত আসন নির্ধারিত না হওয়ায় ভারতবর্ষের কোনো সম্প্রদায় অথবা তার নেতারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। পক্ষান্তরে এর ভিত্তিতে আসন্ন নির্বাচনরূপী প্রলোভন উপস্থিত করে সাম্রাজ্যবাদ তার অভিসন্ধি- ভারতবাসীদের মধ্যে এই নিয়ে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিবাদ খাড়া করার ব্যাপারেও কৃতকার্য হয়েছিল। সুতরাং অধিক সংখ্যক ভারতবাসীর নৈতিক সমর্থনপ্রাপ্ত সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসের পক্ষে এ ব্যাপারে মনঃস্থির করা সহজ হয়নি। নানা স্বার্থের আকর্ষণ- বিকর্ষণে বিব্রত কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি অবশেষে বোম্বেতে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭-১৮ জুন মিলিত হয়ে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা সম্বন্ধে “না গ্রহণ না বর্জন” নীতি গ্রহণ করে।
কংগ্রেসের পার্লামেন্টারি বোর্ডের তদানীন্তন সভাপতি মালব্যজী এবং পার্লামেন্টারি বোর্ড ও ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মাধব শ্রীহরি আণে ওয়ার্কিং কমিটির এই সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ তাঁদের মতে এতে হিন্দুস্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। এর প্রতিবাদে তাঁরা নিজ নিজ পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং এমনকি গান্ধীজী কর্তৃক উদ্ভাবন করা এক ফর্মুলায় তাঁদের এবং তাঁদেরই মতো অপরাপর কংগ্রস নেতাদের বিবেকের অনুশাসনে চলার ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারে সম্মত হননি। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি অত্যন্ত খেদের সঙ্গে তাঁদের পদত্যাগ গ্রহণ করে যে উচ্চ নৈতিক কারণে তাঁরা পদত্যাগ করেছেন, তার প্রশংসা করে। এর পর ১৮-১৯ আগস্ট তাঁরা কলকাতায় সমভাবে ভাবিত কংগ্রেস কর্মীদের এক সভা আহ্বান করে আইন সভার ভিতরে এবং বাইরে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা এবং শ্বেতপত্রের প্রস্তাবসমূহের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কংগ্রেসেরই আদর্শে এক নুতন দল গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।(৭) প্রত্যুত ঐ (কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী) দল পৃথক ভাবে কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং এর ১১জন নির্বাচিত সদস্য সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ছাড়া আর সব প্রশ্নে কংগ্রেসের (বা স্বরাজ্য দলের, কারণ কংগ্রেসের পার্লামেন্টারি কার্যকলাপ ঐ নামেই চলত) ৪৪জন সদস্যের সঙ্গেই মিলেমিশে কাজ করতেন।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা দ্বারা সাম্রাজ্যবাদ অপর এক ক্ষেত্রেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ক্ষীণবল করার ব্যাপারে সাফল্য লাভ করে। কেন্দ্রে এবং মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহে মুসলমানদের জন্য আইনসভায় জনসংখ্যার তুলনায় অধিক আসন বরাদ্দ করায় এবং হিন্দুরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হওয়ায় রাজনৈতিক চেতনাযুক্ত মুসলিম জনমত বাঁটোয়ারার সপক্ষে চলে যায়। বাঁটোয়ারার প্রতি কংগ্রেসের বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী সত্ত্বেও কংগ্রেস নেতৃত্বের অধিকাংশ হিন্দু হওয়ায় রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মুসলিম জনমত নূতন করে কংগ্রেস-বিরোধী হয়ে ওঠে। এর পরিণামে একদিকে জাতীয়তাবাদী মুসলমানেরা কংগ্রেসের হিন্দু নেতাদের একাংশের চোখে সন্দেহের পাত্র হয়ে পড়েন এবং অন্যদিকে তাঁদের পক্ষে মুসলিম প্রতিষ্ঠানের প্রার্থী হিসাবে ছাড়া আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হবার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত হয়।
রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মুসলিম জনমতের ইচ্ছার—মুসলিম স্বার্থে মুসলিম ভোট যেন ভাগ হয়ে না যায়—মর্যাদা রাখতে মুসলিম ইউনিটি বোর্ড কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচনে উত্তর ভারতের বহু মুসলমান আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং কোথাও কোথাও মুসলিম লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও মোট এক-তৃতীয়াংশ আসনে সাফল্য অর্জন করে। তবে বোর্ড জিন্নার বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থী দেয়নি এই যুক্তিতে যে কংগ্রেসও মালব্য ও আণের বিরুদ্ধে দলীয় প্রার্থী দাঁড় করায়নি। যাই হোক, কোনো মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এযাবৎ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এমন সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। মুসলিম ইউনিটি বোর্ডের সদস্যরা তাঁদের জাতীয়তাবাদী চারিত্রধর্মের অনুসরণে কেন্দ্রীয় পরিষদে কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মোটামুটি কংগ্রেস ও স্বরাজ্য দলের সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিলেও পরে আমরা দেখব যে এই বোর্ড মুসলিম লীগে আত্মবিসর্জন করে কংগ্রেস ও মুসলমানদের সঙ্গে বিচ্ছেদ প্রায় সম্পূর্ণ করে। জিন্না অবশ্য যথারীতি স্বতন্ত্র প্রার্থীরূপে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় পরিষদে তাঁর নেতৃত্বাধীন ২২জনের ইন্ডিপেনডেন্ট গোষ্ঠীতে মুসলমান ছাড়াও অন্য সম্প্রদায়ের সদস্যরাও ছিলেন।
ফেব্রুয়ারি মাসে জিন্না কেন্দ্রীয় পরিষদে নূতন ভারত শাসন আইন সংক্রান্ত শ্বেতপত্র সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনটি ধারাযুক্ত নিম্নোক্ত মর্মের সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন:
“১. সম্বন্ধিত বিভিন্ন সম্প্রদায় কর্তৃক এর কোনো বিকল্প সম্বন্ধে সহমত না হওয়া পর্যন্ত এই পরিষদ সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা মেনে নিচ্ছে।
“২. প্রাদেশিক সরকারসমূহের পরিকল্পনা সম্বন্ধে এই সভার (House) অভিমত এই যে তা একান্তভাবে অসন্তোষজনক এবং হতাশাব্যঞ্জক। কারণ এতে একাধিক অসন্তোষজনক ধারা রয়েছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় চেম্বার, গভর্নরদের অসাধারণ ও বিশেষ ক্ষমতাবলী, পুলিশ আইন সম্পর্কিত ধারাসমূহ এবং গুপ্তচর বিভাগসমূহ। এর ফলে প্রশাসক ও আইনসভার যথার্থ নিয়ন্ত্রণ ও দায়িত্ব শিথিল হয়ে পড়ে। তাই যতক্ষণ না এইসব আপত্তিকর দিকগুলি বিদূরিত হচ্ছে, প্রাদেশিক সরকারের পরিকল্পনা ভারতীয় জনমতের কোনো অংশকেই সন্তুষ্ট করতে সমর্থ হবে না।
“৩. কেন্দ্রীয় সরকার বা নিখিল ভারত ফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা সম্বন্ধে এই সভার সুস্পষ্ট অভিমত হল এই যে ব্রিটিশ ভারতের অধিবাসীদের কাছে এটা মূলত খারাপ এবং সম্পূর্ণরূপে গ্রহণের অযোগ্য। এই সভা তাই ভারত সরকারের কাছে আবেদন
পৃষ্ঠা: ৮৫

জানাচ্ছে যে তার তরফে মহামান্য সম্রাটের সরকারকে যেন পরামর্শ দেওয়া হয় এই পরিকল্পনার ভিত্তিতে কোনো আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা যেন না করা হয়। এই সভা ভারত সরকারের কাছে এই আবেদনও জানাচ্ছে যে কেবল ব্রিটিশ ভারতে যাতে যথার্থ ও পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে সে সম্বন্ধে বিবেচনা করার জন্য যেন অবিলম্বে প্রয়াস শুরু করা হয় এবং এই উদ্দেশ্যে আর কালহরণ না করে ভারতীয় জনমতের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সমগ্র পরিস্থিতির পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা করা হয়।”(৮)
এই প্রসঙ্গে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের কেন্দ্রীয় ফেডারেশন পরিকল্পনা সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে রাখা প্রয়োজন। ইংরেজের শাসন এদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার সময়ে ছোট বড় পাঁচ শ-এর মতো দেশীয় রাজ্য ছিল যেগুলির নৃপতিবর্গ আভ্যন্তরীণ শাসনের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করতেন। সে অধিকার নিয়ন্ত্রিত হত বড়লাটের দ্বারা পলিটিক্যাল এজেন্টদের মাধ্যমে এবং সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের স্বার্থে। পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা ইত্যাদির প্রশ্নে অবশ্য দেশীয় রাজ্যগুলি পুরোপুরি বড়লাটের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল।
ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ স্বভাবতই সামন্ততন্ত্রের দ্বারা পিষ্ট দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিভিন্ন রাজ্যের “প্রজা সম্মেলন” কিছু কিছু স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আন্দোলনও করত। গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে এদেশে শাসন- সংস্কার প্রবর্তনের প্রচেষ্টার সঙ্গে তাই ইংরেজ সরকার দেশীয় রাজ্যের রাজাদের প্রতিনিধিদেরও যুক্ত করেন। নিজেদের স্বার্থে অনেক দ্বিধার পর তাঁদের অনেকে কেন্দ্রে এক ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হবার পরিকল্পনা মেনে নিলেও সেখানে প্রতিনিধিত্বের জন্য নিজ প্রজাদের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না। কী রাজ্যের অভ্যন্তরে, কী ফেডারেশন স্তরে—কুত্রাপি তাঁরা প্রজাদের সপক্ষে নিজেদের অধিকার সমর্পণে সম্মত হননি। ব্রিটিশ সরকারও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে রাজন্যবর্গের এই সামন্ততান্ত্রিক ভূমিকায় বাধা দেননি। গণতন্ত্রের প্রবক্তা রূপে কংগ্রেস নৃপতিবর্গের অধিকারাবলীর বিরোধী ছিল। আগা খাঁ প্রমুখ তদানীন্তন মুসলিম নেতৃবৃন্দের অবশ্য হায়দ্রাবাদ, ভূপাল প্রমুখ রাজ্যের মুসলমান শাসকবর্গের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল বলে “মুসলিম স্বার্থে” তাঁরা রাজন্যবর্গের ক্ষমতা হ্রাস করার সমর্থক ছিলেন না। তা ছাড়া মুসলমান শাসকবর্গের অধিকাংশ প্রজাই হিন্দু হওয়ায় তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার শেষ অবধি হিন্দুদের শক্তিশালী করবে—এই ছিল তাঁদের ধারণা। আর ঐ নেতৃত্বের অভিজাত চারিত্রধর্মের জন্য তাঁরা গণতন্ত্রকামী প্রজাদের তুলনায় অভিজাত শাসকদের সঙ্গে অধিকতর আত্মীয়তা বোধ করবেন একথা বলাই বাহুল্য।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জোড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও ইংরেজ বণিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ভারতে এক কেন্দ্রীয় সরকার ও শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা ইংলন্ডের সরকার উপলব্ধি করলেও সে সরকার খুব শক্তিশালী হোক—এটা তার বাঞ্ছনীয় ছিল না। সুতরাং সাইমন কমিশন থেকে শুরু করে গোলটেবিল বৈঠক পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যের সমবায়ে কেন্দ্রে এক শিথিল ধরনের ফেডারেল সরকার ও আইনসভা স্থাপনা করার কথা হয়। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে একটি পৃথক অধ্যায়ে এই পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করা হয়। বলা বাহুল্য শতবিধ ত্রুটি সত্ত্বেও এই পরিকল্পনায় এক অবিভক্ত ভারতের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তখনই কেন্দ্রে যথার্থ ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ইংরেজের ছিল না বলে সরকার এই কাগুজে ফেডারেশন পরিকল্পনাও পরে কার্যকরী করা হবে বলে ঘোষণা করে এবং আপাতত প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্ব-শাসনের পরীক্ষা- নিরীক্ষা আরম্ভ হবে স্থির হয়। রাজন্যবর্গকে ফেডারেশন পরিকল্পনার দ্বারা ভারতের শাসনতান্ত্রিক প্রগতির পথে “ভিটো” দেবার অধিকার দেওয়া হয়েছে, দেশীয় রাজ্যগুলিকে বাদ দিয়ে ফেডারেশন হবে না, নৃপতিবর্গের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করা চলবে না, দেশীয় রাজ্যে প্রজাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থাকছে না ইত্যাদি শর্ত এবং সীমিত ক্ষমতাযুক্ত ফেডারাল সরকার দুর্বল হবে বলে কংগ্রেস এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে। গোঁড়া মুসলমান নেতৃবৃন্দ প্রাদেশিক স্বায়ত্ত-শাসনে কেন্দ্র-নিরপেক্ষ ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া যাবে না এবং ফেডারাল আইন-সভায় জনসংখ্যার অনেক বেশি—এক-তৃতীয়াংশ আসনের নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার মূলত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে বলে ফেডারেশনের সমর্থক ছিলেন না। দেশীয় রাজ্যের শাসকেরা নয়, প্রজা কেন্দ্রীয় পরিষদে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে—কংগ্রেসের এই দাবি মুসলমান নেতৃবৃন্দের মনের এই আশায় আঘাত হানল যে নিজাম ও ভূপালের নবাব প্রমুখের মতো মুসলমান শাসকদের মাধ্যমে ঐ জাতীয় দেশীয় রাজ্য থেকে মুসলমান প্রতিনিধি এসে ফেডারাল আইন-সভায় কংগ্রেসের (স্বভাবত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ) প্রভাবের ক্ষেত্রে মুসলমানদের পক্ষে ভারসাম্য রচনায় সহায়ক হবে। তাঁদের ফেডারেশনের সম্বন্ধে উৎসাহ হারানোর এও এক কারণ। শ্রীনিবাস শাস্ত্রীর মতো বিরাট নেতা অবশ্য ফেডারেশন বর্জিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিপদ-সঙ্কেত দেখতে পেয়ে দেশবাসীকে সে সম্বন্ধে সতর্ক করেছিলেন।(৯) পরে আমরা দেখব যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে জিন্নার দাবির কাছে নতিস্বীকার করে সরকার ফেডারেশন প্রস্তাবকে চিরতরে বিসর্জন দেয়।
অতঃপর কেন্দ্রীয় পরিষদে জিন্নার সংশোধনী প্রস্তাব প্রসঙ্গে প্রত্যাবর্তন করা যেতে পারে। আরও একাধিক সংশোধনী প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও কুশাগ্র রাজনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন আইনজ্ঞ জিন্নার সংশোধনী প্রস্তাবই গৃহীত হয়। এর কারণ হল এই যে ভোটের জন্য প্রস্তাবটির প্রথম ধারাটিকে অপর দুটি ধারা থেকে পৃথক করা হয়। কংগ্রেসের সংশোধনী প্রস্তাব নিজ দলের ৪৪জন সদস্য ছাড়া আর কারও সমর্থন না পেয়ে বাতিল হয়ে যায়। তাই স্বভাবতই কংগ্রেস সদস্যরা জিন্নার সংশোধনী প্রস্তাবের প্রথম ধারার উপর ভোট গ্রহণের সময় নিরপেক্ষ থাকেন এবং সরকারি ও নির্বাচিত ইউরোপীয় সদস্যদের সমর্থন পেয়ে তা স্বীকৃত হয়। এইভাবে পাকে-প্রকারে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা আইনসভার স্বীকৃতিলাভে সমর্থ হয়। আবার সরকারি সদস্যরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারার বিরুদ্ধে ভোট দেন এবং এবার কংগ্রেস সদস্যরা জিন্নার সংশোধনী প্রস্তাবের ঐ অংশের সমর্থন করায় তা সহজে গৃহীত হয়ে যায়। এই সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করানো এবং সেই উপলক্ষে কেন্দ্রীয় পরিষদে তাঁর বক্তৃতা পার্লামেন্টারিয়ান হিসাবে তাঁর সাফল্যের অন্যতম নিদর্শন।
এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তৃতার অংশবিশেষ উল্লেখনীয়:
“আমার সংশোধনী প্রস্তাবে….সম্বন্ধিত সম্প্রদায়সমূহ কর্তৃক এর কোনো বিকল্প স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সম্ভবত আমাদের হিন্দু বন্ধুরা সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারায় সন্তুষ্ট নন। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে এই সভাকে জানিয়ে দিতে চাই যে মুসলমান বন্ধুরাও এর প্রতি সন্তুষ্ট নন।…আর ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে বলব যে আমরা যতক্ষণ আমাদের নিজেদের পরিকল্পনা রচনা করতে না পারছি ততক্ষণ আমার আত্মমর্যাদার সন্তুষ্টি কোনোমতেই হবে না।…তাহলে কেন আমি এই পরিকল্পনাকে স্বীকার করে নিচ্ছি?…এইজন্য আমি স্বীকার করছি যে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়ায় উপনীত হবার জন্য যা কিছু করা দরকার এযাবৎ আমরা তা করেছি।…সুতরাং আমি পছন্দ করি আর নাই করি আমি একে স্বীকার নিয়েছি। কারণ একে স্বীকার করে না নিলে সংবিধান অনুসারী কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারে না।… প্রশ্নটি সংখ্যালঘু সম্পর্কিত এবং বিষয়টি রাজনৈতিক।… সংখ্যালঘু বলতে একাধিক বিষয়ের সমাহার বোঝায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের দেশের অন্যান্য নাগরিকদের থেকে ভিন্ন ধর্ম থাকে। তাঁদের ভাষা পৃথক হতে পারে। জাতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতে পারে। আর ধর্ম সংস্কৃতি জাতি ভাষা চারুকলা সঙ্গীত এবং ঐ জাতীয় আরও অনেক উপাদানের সম্মিলনে কোনো রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের পৃথক অস্তিত্ত্বের ভিত্তি রচিত হয়। তখন সেই পৃথক সত্তা নিজের জন্য রক্ষাকবচ দাবি করে। সুতরাং নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসাবে এই সমস্যার সম্মুখীন হওয়া উচিত। এ প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে চলবে না, এর সমাধান করতে হবে।”(১০)
জিন্নার বক্তৃতার উপরোক্ত অংশে স্পষ্ট হয়েছে যে তিনি নূতন ভারত শাসন আইনের সপক্ষে ছিলেন না। কেন্দ্রীয় পরিষদের পরবর্তীকালের বক্তৃতাতেও তাঁর একই অভিমতের প্রতিধ্বনি শোনা যায়:
“আমি বিশ্বাস করি যে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের অভিমুখে প্রগতি করার ব্যাপারে ব্রিটিশ ভারত গত ৫০ বছর যাবৎ যা কিছুর প্রতীক এবং যা কিছুর বিকাশ সাধন করেছে সেটা তার সে সব কিছুকে জলাঞ্জলি দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। কোনো প্রদেশের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। প্রস্তাবিত শর্তে দেশীয় রাজন্যবর্গ কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের অঙ্গীভূত হতে চান কি না সে বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার কোনো নৃপতির সঙ্গে পরামর্শ করেননি। আমার আপত্তির অপর একটি কারণ হল এই যে এই পরিকল্পনাকে রূপ দেওয়া সম্ভব নয়।”(১১)
এপ্রিলের শেষভাগে তিনি আর এক দফা দীর্ঘ সময় (অক্টোবরের শেষ ভাগ পর্যন্ত) বিলাতে ঘুরে এসে মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এদিকে বর্ষাকালে তাঁর বিলাতে থাকাকালীন নূতন ভারতশাসন আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে।
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের প্রসঙ্গ শেষ করার পূর্বে ঐ বছরের গোড়ার দিকে (২৩শে জানুয়ারি থেকে মাঝখানে সাময়িক বিরতি ছাড়া ১লা মার্চ পর্যন্ত) কংগ্রেস সভাপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানসূত্র খুঁজে বার করার জন্য জিন্নার আলোচনার কথা উল্লেখযোগ্য। সীতারামাইয়ার মতে এ আলোচনা, “কোনো নির্দিষ্ট পরিণাম বিনাই সমাপ্ত হয় এবং দেশবাসীর মনে এর জন্য প্রভূত হতাশার সৃষ্টি হয়।”(১২) কংগ্রেসের সরকারি ইতিহাসকার এত সংক্ষেপে বিষয়টির উল্লেখ শেষ করলেও ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জিন্না ও রাজেন্দ্রপ্রসাদ কোনো বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পারলে কেন্দ্রীয় পরিষদে নূতন ভারতশাসন আইন সম্পর্কিত বিতর্কে তার প্রতিফলন হত এবং প্রত্যুত এই উদ্দেশ্যেই ডাঃ আন্সারীর উদ্যোগে তাড়াহুড়ো করে দিল্লিতে এই আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। জিন্নাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ—এমনকি কেন্দ্রীয় পরিষদের বিতর্ক ও আগা খাঁর নিমন্ত্রণ বাদ দিয়ে এই আলোচনায় সাগ্রহে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
যাই হোক এ সম্বন্ধে কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের নিজের বক্তব্য(১৩) শোনা যেতে পারে। তিনি জানিয়েছেন যে উভয়ে এই বিষয়ে রাজী হন যে ম্যাকডোনাল্ড রোয়েদাদে মুসলমানদের জন্য যে আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয়েছে, যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে তা বজায় রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে মুসলমান ভোটারদের যোগ্যতার মান শিথিল করতে হবে। কিন্তু জিন্না দাবি করলেন যে এ প্রস্তাবে পণ্ডিত মালব্যেরও সম্মতি চাই। রাজেন্দ্রপ্রসাদ এই যুক্তি দেখিয়ে এ দাবি মেনে নিতে নিজের অসমর্থতা জ্ঞাপন করলেন যে এ আলোচনা কংগ্রেস ও লীগের সভাপতিদের মধ্যে হচ্ছে বলে তৃতীয় কোনো দলের নেতার সম্মতির নিশ্চয়তা দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া জিন্নার এই দাবিও কংগ্রেস সভাপতির পক্ষে স্বীকার করে নেওয়া সম্ভব হয়নি যে মুসলিম লীগই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান। জিন্নার অন্যতম জীবনীকার সঈদ এ সম্বন্ধে বলেছেন, “এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না যে মুখ্য অংশগ্রহণকারী রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও মহম্মদ আলী জিন্না তাঁদের আলোচনাকে সফল পরিণতিতে পৌঁছে দেবার জন্য উৎসুক ছিলেন। অধিকাংশ কংগ্রেস কর্মী এবং মুসলিম লীগের দক্ষিণপন্থী অংশেরও সেই ইচ্ছা ছিল। অবিশ্বাস ছিল পাঞ্জাব ও বঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে। আর শিখরা ছিলেন বাঁটোয়ারার তীব্রতম সমালোচক।”(১৪)
রাজেন্দ্রপ্রসাদের আপত্তির কারণ দুটি একটু খতিয়ে বিচার করা যেতে পারে। এই অধ্যায়েই আমরা দেখেছি যে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে পণ্ডিত মালব্য কংগ্রেস ছেড়ে তাঁর কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করে স্বতন্ত্রভাবে কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও কিভাবে তিনি ও তাঁর দল প্রত্যুত কংগ্রেসেরই উপদল হিসাবে কাজ করছিলেন। হিন্দু মহাসভার সঙ্গে মালব্যজির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথাও সর্বজনবিদিত এবং মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারেও ঐ প্রতিষ্ঠানের আপোস-বিরোধী ভূমিকার কথাও কোনো গোপন তথ্য ছিল না। সুতরাং কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় পুষ্ট ও হিন্দু মহাসভা প্রভাবিত নেতার ভবিষ্যৎ ভূমিকা সম্বন্ধে নিশ্চয়তার দাবি করে জিন্না খুব একটা অযৌক্তিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন—এমন কথা বলা যায় না। জিন্নার দ্বিতীয় দাবি সম্বন্ধে এই মন্তব্য করাই যথেষ্ট যে যদিও কাগজেকলমে তা মেনে নেওয়া জাতীয়তাবাদের ভূমিকা সমন্বিত কংগ্রেসের পক্ষে আত্মহত্যারই সমতুল্য, তবু অতীতে (এবং প্রকারান্তরে ভবিষ্যতেও) কংগ্রেস মুসলিম লীগকে বার বার কার্যত এই মর্যাদাই দিয়ে এসেছিল এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইন অনুযায়ী প্রাদেশিক বিধানসভাসমূহের যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে যে রাজনৈতিক দল মুসলমানদের সর্বাধিক সমর্থন পায় তা হল মুসলিম লীগ।

১৩
পাদটীকা

১. চাগলা; সমগ্রন্থ; ১০৩ পৃষ্ঠা।
২. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১৩৫ ও ১৩৬ পৃষ্ঠা।
৩. গুলাম আলী আল্লানা; Quaid-i-Azam Jinnah: The Story of a Nation; লাহোর (১৯৬৭); ২৩৯ পৃষ্ঠা। অ্যালেন, হেইস মিরিয়াম কর্তৃক Gandhi VS Jinnah: The Debate over the Partition of India; মিনার্ভা অ্যাসোসিয়েটস, কলিকাতা (১৯৮০) গ্রন্থের ৪০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৪. সৈয়দ আবদুল লতিফ; The Great Leader; লাহোর (১৯৬১); ১২৫ পৃষ্ঠা। অ্যালেন-হেইস মিরিয়াম কর্তৃক সমগ্রন্থের ৪০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৫. চাগলা; সমগ্রন্থ; ১০৩-১০৪ পৃষ্ঠা।
৬. শরীফ-অল-মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৫৬৮ পৃষ্ঠা।
৭. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড); ৯৬৪-৯৬৮ পৃষ্ঠা।
৮. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড); ১০০০-১০০১ পৃষ্ঠা।
৯. ফেডারেশন প্রসঙ্গে বিস্তৃত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য: মূর; Endgames of Empire; পৃষ্ঠা; ৩৭-৬৬।
১০. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১৩৭-১৩৮ পৃষ্ঠা।
১১. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১৩৯ পৃষ্ঠা।
১২.. সমগ্রন্থ; (প্রথম খণ্ড); ১০০৯ পৃষ্ঠা।
১৩. আত্মকথা (হিন্দি); ৪২৫-৪২৭ পৃষ্ঠা।
১৪. Sound of Fury; ১৭৯ পৃষ্ঠা।

১৯৩৬-৩৭ খ্রীষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে লড়ার
হাতিয়াররূপে লীগকে গড়ে তোলা
১৪

১৯৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দ ভারতবর্ষের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে জিন্নার জীবনেও এক সংক্রান্তিকাল। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইনে তার সমাবেশ নির্ধারিত আসন-সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের—বিশেষ করে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। এক সম্প্রদায়ের নেতারা অপরাপর সম্প্রদায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সমালোচনায় অবতীর্ণ। সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের ফলে ম্যাকডোনাল্ডের প্রস্তাবের সংশ্লিষ্ট পক্ষের সম্মতিভিত্তিক বিকল্প খুঁজে পাবার সম্ভাবনা তিরোহিত। এই পরিবেশে প্রাদেশিক আইনসভাসমূহের নির্বাচন প্রত্যাসন্ন হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার ছিটেফোটা প্রাপ্তির সম্ভাবনায় এই “গৃহবিবাদ”ও তুঙ্গে ওঠার উপক্রম হয়।
তবে নির্বাচন প্রসঙ্গে যাবার পূর্বে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জিন্নার অপর ক্ষেত্রস্থ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৃতির উল্লেখ করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় আইনসভায় বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কে প্রবৃত্ত হওয়া ছাড়াও লাহোরে গিয়ে শহীদগঞ্জ মসজিদের কর্তৃত্ব নিয়ে মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায়ের আন্দোলন যে বিস্ফোরক স্থিতিতে উপনীত হচ্ছিল, তার উপশমে জিন্না অশেষ পরিশ্রম করেন। জিন্নার এক জীবনীকারের (হেক্টর বলিথো) মতে এই উপলক্ষে তিনি জীবনে সর্বপ্রথম সাধারণ মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসেন। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি পুনঃস্থাপনার এই মিশনে এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে স্বসম্প্রদায়ের সদস্যদের আন্দোলনের পথ ছেড়ে বৈধানিক পথ ও আইনের সহায়তা গ্রহণ করার পরামর্শ দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, “অপর এক ভ্রাতৃস্থানীয় সম্প্রদায়ের নিরন্তর বিরোধিতা করা অথবা তাঁদের উপর চাপ দেবার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। অতীতে তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন এবং আমরাও তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। কিন্তু শিখেরা এক মহৎ সম্প্রদায়। তাই তাঁদের সঙ্গে কোনো সম্মানজনক আপোস নিষ্পত্তির মতো অপর কিছুই আমাকে অত সন্তুষ্ট করতে পারবে না এবং এই উদ্দেশ্যে আমরা যে-কোনো রকমের প্রয়াস করতে প্রস্তুত আছি।”(১)
সাম্প্রদায়িক বিবাদে জিন্নার মধ্যস্থতা করার প্রয়াস বহুলাংশে সফল হয় এবং পাঞ্জাবের ছোটলাট তাঁর প্রচেষ্টার প্রকাশ্য প্রশংসা করে বলেন, “অবস্থার উন্নতিসাধনে শ্রীযুক্ত জিন্না যে প্রচেষ্টা করেছেন, তার জন্য আমি তাঁর কাছে অতীব কৃতজ্ঞ। তিনি যে কাজ করেছেন এবং এখনও করছেন তার জন্য আমি তাঁকে ভূয়সী প্রশংসা জানাই। শ্রীযুক্ত জিন্না তাঁর প্রথম দায়িত্ব সাফল্য সহকারে পালন করেছেন এবং মুসলমানদের আন্দোলনকে একান্তভাবে বৈধানিক এবং আইননির্ভর পথে নিয়ে এসেছেন। এইভাবে তিনি সরকার যে পদক্ষেপ নেবার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তা সম্ভবপর করে তুলেছেন।”(২)
এপ্রিলের প্রথম ভাগে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জমায়েৎ-উল-উলেমা-ই-হিন্দের সম্মেলনে পুনর্গঠিত লীগের নেতা হিসাবে জিন্না আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের দায়- দায়িত্ব সম্বন্ধে নিজের ধারণা ব্যক্ত করেন।(৩) তখন তিনি একান্তভাবেই মুসলিম স্বার্থের প্রবক্তা (ঐ বক্তৃতায় তিনি হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথকভাবে সংগঠিত হবার পরামর্শ দেন
পৃষ্ঠা: ৯১

কারণ “একবার উভয়েই সংগঠিত হলে, তারা পরস্পরকে ভাল করে বুঝবে এবং সে অবস্থায় আমাদের বোঝাপড়ায় উপনীত হবার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে না।”) এবং সম্ভবত বেশ কয়েক বৎসর পর ভারতবর্ষের রাজনীতিতে প্রমুখ অংশ নিচ্ছেন বলে তাঁর উক্তিতে কিছুটা অতিরিক্ত সতর্কতা ও দ্বিধার ছাপ বিদ্যমান। তবুও তাঁর বক্তব্যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং সে বিষয়ে গঠনমূলক ভূমিকা পালনে তাঁর ইচ্ছার পরিচয় সুস্পষ্ট। “তিনি বলেছিলেন যে ভারতবর্ষের আট কোটি মুসলমান ভারতমাতার স্বাধীনতার জন্য ইচ্ছুক এবং এমনকি অপর যে কোনো সম্প্রদায়ের তুলনায় অধিক পরিমাণে উদ্‌গ্রীব। …যাবতীয় রাজনৈতিক দলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সরকার যে এসব শাসন-সংস্কার চাপিয়ে দিয়েছেন তার কারণ হল ভারতবাসীরা ঐক্যবদ্ধ নয় এবং তাঁরা তাঁদের ঘরোয়া বিবাদের নিষ্পত্তি করতে পারেননি।”
উক্ত বক্তৃতায় আগামী দিনের জ্বলন্ত সমস্যা—প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা বনাম সংখ্যালঘু স্বার্থ সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার… অর্থ হল…সংখ্যাগুরুদের শাসন এবং তাই স্বভাবতই সংখ্যালঘুদের মনে আশঙ্কা যে সংখ্যাগুরুরা কি করবেন। সংখ্যাগুরুদের পীড়নকারী হবার সম্ভাবনা থাকে। ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব মানুষকে মদমত্ত করে থাকে। তাই গণতান্ত্রিক সংবিধানসঙ্গত যে-কোনো ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুদের জন্য রক্ষাকবচের ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। আমরা কি অগ্রসর হতে মনস্থ করেছি এবং আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে ভারতবর্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অপেক্ষাকৃত বৃহৎ সমস্যাবলীর প্রতি নিবদ্ধ করছি? অন্তত সাময়িক ভাবেও সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা সম্পর্কিত বিতর্ক বন্ধ করুন এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা হলে আমরা ওর থেকে ভাল আপোস নিষ্পত্তি করতে পারব।” গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুদের সমস্যা সম্বন্ধে জিন্নার এই উক্তিকে যথার্থই আর্যদৃষ্টি সম্পন্ন বলা যেতে পারে। আমরা দেখব যে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারির নির্বাচনের পরই এ সমস্যা প্রবল হয়ে কিভাবে জিন্না ও লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিমুখে নিয়ে যায়।
১১ই এপ্রিল বোম্বেতে সৈয়দ ওয়াজির হাসানের সভাপতিত্বে লীগের অধিবেশনে ভারতশাসন আইনের নানাবিধ ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য এর নিন্দা করা সত্ত্বেও এর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অংশকে একবার পরখ করে দেখার উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক আইনসভাসমূহের আসন্ন নির্বাচনে লীগ অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উক্ত অধিবেশনে জিন্নার সভাপতিত্বে ৩৫ জনের একটি পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে লীগের নির্বাচনের ঘোষণাপত্রও রচিত হয়। এতে বলা হয়:
“বিভিন্ন বিধানসভায় আমাদের প্রতিনিধিরা যেসব মূল নীতি অবলম্বনে কাজ করবেন তা হল: (১) বর্তমানের প্রাদেশিক এবং প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় সংবিধানের পরিবর্তে অবিলম্বে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনমূলক সংবিধান চাই; (২) ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিধানসভায় মুসলিম লীগের সদস্যরা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের প্রচলিত সংবিধানের মধ্যেই যতটুকু কল্যাণসাধন করতে পারেন তার উদ্দেশ্যে ঐসব আইনসভাকে কাজে লাগাবেন। যতদিন পর্যন্ত পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে ততদিন আইনসভাসমূহে মুসলিম লীগ দল গঠন করতেই হবে। তবে যেসব দল বা দলসমূহের সঙ্গে লীগের লক্ষ্য ও আদর্শের মোটামুটি সামঞ্জস্য আছে তাদের সঙ্গে অবাধ সহযোগিতা চলবে।”(৪)
লীগের ঐ কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোদ্ধৃত চোদ্দো দফা কর্মসূচী গ্রহণ করে:
“১. মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকারসমূহ রক্ষা করা। একান্ত ভাবে ধর্মীয় বিষয়সমূহ সম্বন্ধে জমায়েৎ-উল-উলেমা-ই-হিন্দ এবং মুজাহিদদের অভিমতের উপর যথোচিত গুরুত্ব দেওয়া হবে।
২. যাবতীয় দমনমূলক আইনের প্রত্যাহারের জন্য সর্বপ্রকারে চেষ্টা করা হবে।
৩. যেসব বিধি-বিধান ভারতবর্ষের স্বার্থের প্রতিকূল এবং যা জনসাধারণের মৌলিক স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং যার পরিণামে দেশের আর্থিক শোষণ হতে পারে তার বিরোধিতা করা হবে।
৪. প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের উচ্চ ব্যয়ভার হ্রাস করে জাতিগঠনমূলক বিভাগসমূহের জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করা হবে।
৫. ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর জাতীয়করণ করা ও সামরিক ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস করা।
৬. কুটির শিল্পসহ যাবতীয় শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা।
৭. দেশের আর্থিক বিকাশের স্বার্থে মুদ্রাব্যবস্থা, বিনিময়ের হার ও মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ।
৮. গ্রামীণ জনসাধারণের সামাজিক, শিক্ষাগত ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন।
৯. কৃষকদের ঋণের বোঝা হ্রাস করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ।
১০. প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হবে।
১১. উর্দু ভাষা ও তার লিপিকে সংরক্ষণ দান ও তার প্রসার।
১২. মুসলমানদের সাধারণ অবস্থার উন্নয়নের জন্য উপায় উদ্ভাবন।
১৩. বর্তমানের প্রচণ্ড করভার হ্রাস করার ব্যবস্থা গ্রহণ।
১৪. দেশের সর্বত্র সুস্থ জনমত এবং সামান্য রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলা।”(৫)
খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রথম কর্মসূচীটি ছাড়া এতে এমন কোনো কর্মসূচী নেই যার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কোনো ভারতবাসীর অসহমত হবার কারণ থাকতে পারে।
লীগের নির্বাচন সম্পর্কিত ভূমিকা সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে রামগোপাল বলেছেন:
“এ সময়ে মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িকতার কথা একরকম বলেনই নি এবং নির্বাচনের কর্মসূচীর ব্যাপারে নিজেকে প্রায় কংগ্রেসের সমপর্যায়ে উন্নীত করে।(৬) কংগ্রেসও কখনও লীগের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল না এবং নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে লাগল লীগের প্রতি কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গী আরও অনুকূল হয়ে উঠল। এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হতে দেওয়া হল যে প্রতিষ্ঠান দুটি পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে না। সংযুক্ত প্রদেশে কংগ্রেস ও লীগ নির্বাচনপ্রচারে পরস্পরকে সাহায্য করবে এমন একটা প্রকাশ্য বোঝাপড়ায় উপনীত হল।”(৭)
লীগের ঐ অধিবেশনে প্রস্তাবিত ফেডারেল ব্যবস্থার প্রতি যে বিরূপতা ব্যক্ত করা হয় তাতে প্রস্তাবের রচয়িতা জিন্নার উদার মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। রাজেন্দ্রপ্রসাদ এ সম্বন্ধে বলেছেন, “…এই জন্য ফেডারেল পরিকল্পনার বিরোধিতা করা হয়েছিল যে এর অভিসন্ধি ছিল ভারতবর্ষের অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য—সম্পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠাকে যাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিলম্বিত ও রুদ্ধশ্বাস করে দেওয়া যায়। এর বিরোধিতার কারণ ছিল এই যে ভারতবর্ষের স্বার্থে এর রূপায়ণ সম্ভব নয়। ফেডারেল সংবিধান মেনে নেওয়া বা অন্য প্রকারে মুসলমানদের স্বার্থের হানি হবে—এ ধারণা কারও মনে ছিল না।”(৮)
লীগের ঐ অধিবেশনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে জিন্না বললেন, “হিন্দু ও মুসলমানদের লক্ষ্য বহুলাংশে এক। যে-কোনো হিন্দু জাতীয়তাবাদীর মতো মুসলমানরাও স্বদেশের হিতের প্রতি জাগরুক এবং তার মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে উদগ্রীব।” নূতন আইনে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসননীতির স্বীকৃতি এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘুদের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচের আবশ্যকতার উপর জোর দিয়ে দেশবাসীর কর্তব্যনির্ধারণ প্রসঙ্গে অতঃপর তিনি বলেন, “…তাঁদের কাছে একমাত্র সংবিধানসম্মত আন্দোলনের পথ খোলা। এর…অর্থ হল আইনসভায় তাঁরা এমনভাবে কাজ করবেন যাতে ব্রিটিশ সরকারকে তাঁদের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করতে হয়। কিন্তু…এ কাজ একা মুসলমানদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। দুটি প্রধান সম্প্রদায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলেই কেবল এ উদ্দেশ্য সাধন সম্ভবপর।” কিন্তু এ ব্যাপারে “সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান” কংগ্রেসের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে খেদ ব্যক্ত করে জিন্না বললেন, ‘আমি সাহস করে বলতে পারি যে মুসলমানদের কাছে আবেদন না করা পর্যন্ত কংগ্রেস যে লক্ষ্যে উপনীত হতে চায় এবং আমরাও চাই, সেখানে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে না।’…মুসলমানদের সঙ্গে যতদূর সম্পর্ক, জিন্না বললেন যে শুধু স্ব-সম্প্রদায়ের প্রতিই নয়, দেশের প্রতিও তাঁদের কর্তব্য আছে।”(৯)
এ সম্বন্ধে উলপার্ট বলছেন, “স্যার সৈয়দ (ওয়াজির) হাসানের সভাপতির অভিভাষণে জিন্নার চিন্তাধারার প্রতিধ্বনি ছিল। তিনি প্রস্তাব করেন যে কংগ্রেস লীগ সম্মিলিত ভাবে দেশের আর সব ‘প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল’কে এই উদ্দেশ্যে আমন্ত্রণ জানাবে যে তাঁরা যেন পারস্পরিক সম্মতির এমন একটা ন্যূনতম কর্মসূচী নির্ধারণ করেন যাতে আমরা মিলিতভাবে কাজ করতে পারি…ভারতবর্ষের জন্য একটা সংবিধান রচনা করতে পারি।’ বলা বাহুল্য ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের লখনউ চুক্তির অনুসরণে এ জাতীয় পদক্ষেপ নেবার কথা তাঁর মাথায় এসেছিল। লীগের নির্বাচনী ইস্তাহারে লখনউ চুক্তির সময়কার অনুকূল পরিবেশের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয় যে সেই সময় থেকে মুসলমানরা “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন্য অপরাপর ভ্রাতৃপ্রতিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে।” আরও বলা হয় যে, “তাঁরা যদি এই দাবি জানিয়ে থাকেন যে সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে সংখ্যালঘু হিসাবে তাঁদের অধিকার সম্বন্ধে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা থাকুক তাহলে তা সাম্প্রদায়িকতা নয়। বিশ্ব-ইতিহাস সম্বন্ধ ওয়াকিবহাল যে কোনো ব্যক্তি একথা উপলব্ধি করবেন যে এ এক স্বাভাবিক দাবি এবং সংখ্যালঘুদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ও আন্তরিক সহযোগিতা পাবার জন্য এটা অপরিহার্য। কারণ সংখ্যালঘুদের মধ্যে এই অনুভূতির সৃষ্টি হওয়া দরকার যে পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও নিরাপত্তা সহকারে তাঁরা সংখ্যাগুরুদের উপর নির্ভর করতে পারেন।”(১০)
উলপার্ট আরও বলেছেন, “তিনি (জিন্না) এমনকি এতদূর অগ্রসর হয়ে ছিলেন যে চার দফার এক কর্মসূচী এই আশা দিয়ে রচনা করেছিলেন যে তার দ্বারা জওহরলালের কংগ্রেস, লিবারেলদের এবং সম্ভবত এমনকি (হিন্দু) মহাসভাপন্থীদেরও একটি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে এবং সে বৈঠক হবে এবারে ভারতবর্ষের মাটিতে:
১. প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এক গণতান্ত্রিক দায়িত্বশীল শাসন-ব্যবস্থা।
২. যাবতীয় অতীব দমনমূলক আইন প্রত্যাহার এবং মতপ্রকাশ, সংবাদপত্র ও সংগঠনের স্বাধীনতার ব্যবস্থা।
৩. অবিলম্বে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া। সরকার কর্তৃক শিক্ষিত এবং শিক্ষার সুযোগে বঞ্চিত ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান। দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘণ্টা করা এবং শ্রমিকদের জন্য নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ।
৪. অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন।”(১১)
স্বভাবতই জিন্নার প্রাক-নির্বাচনী প্রকাশ্য বক্তৃতাতেও কংগ্রেসের সঙ্গে এইভাবে মানিয়ে চলার মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। “তাঁর বক্তৃতাগুলির মূল বক্তব্য ছিল—মুসলমানদের আন্দোলন কারও বিরোধী নয়। তাদের আন্দোলন যাবতীয় ভ্রাতৃপ্রতিম সম্প্রদায়ের প্রতি মৈত্রীর দ্যোতনাযুক্ত এবং যদি তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মোটামুটি মিল দেখা যায় তাহলে লীগ যে কোনো গোষ্ঠী বা গোষ্ঠী সমুদায়ের সঙ্গে সহযোগিতা ও মিলেমিশে কাজ করতে ইচ্ছুক। বোম্বেতে তিনি ঘোষণা করলেন যে মুসলিম লীগ ভারতবর্ষের জনসাধারণের জন্য পূর্ণ জাতীয় স্বায়ত্তশাসন চায়। হিন্দু মুসলমান ও অপরাপর সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য ও সম্মানজনক বোঝাপড়াই হচ্ছে সেই একমাত্র চক্র-নাভি যার উপর নির্ভর করে ৩৮ কোটি ভারতবাসীর জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি রচিত হতে পারে এবং তা চলতেও পারে।”(১২) জিন্নার এই মানসিকতার নিদর্শন হিসাবে তাঁর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি বিশেষ ভাবে স্মরণীয়: মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের আদর্শের কোনো পার্থক্য নেই—উভয়ের আদর্শই হল ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা। এমন কোনো আত্মমর্যাদাশীল ভারতবাসী থাকতে পারেন না যিনি বিদেশী প্রভুত্ব পছন্দ করেন বা যিনি স্বদেশের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন না চান।”(১৩)
“জিন্না কেন্দ্রীয় (পার্লামেন্টারি) বোর্ড কর্তৃক সৃষ্ট যে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে মুসলিম লীগের প্রার্থীরা ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তা প্রায় কংগ্রেসেরই অনুরূপ ছিল…এর (লীগের কর্মসূচীর) প্রত্যেকটিই দীর্ঘকাল যাবৎ কংগ্রেসের জাতীয় দাবির অপরিহার্য অঙ্গ ছিল এবং গভর্নর ম্যালকম হেলির প্রশ্রয়ে সৃষ্ট সংযুক্ত প্রদেশের এগ্রিকালচারালিস্ট পার্টির মতো অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল মুসলিম রাজনৈতিক দলগুলির কাছে ঐসব কর্মসূচী ছিল অবাঞ্ছনীয়। তবে লীগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকার সঙ্গে কংগ্রেসের একটি ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল যা জিন্নার সঙ্গে নেহরু ও সুভাষ বসুর মৌলিক মতপার্থক্যের কারণ। লীগ ব্যক্তিগত সম্পত্তি কেড়ে নেবার যে কোনো আন্দোলনের প্রবল বিরোধী ছিল। ভারতবর্ষের দারিদ্র্যের সমস্যার সমাধানের জন্য জওহরলাল যতই সমাজবাদী সমাধানের উপর উত্তরোত্তর বিশ্বাস ন্যস্ত করছিলেন, জিন্না ততই পূর্বের তুলনায় অধিকমাত্রায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির দুর্গের অন্তরালে আশ্রয় গ্রহণ করছিলেন। জমি ও ঘর-বাড়ির প্রতি তাঁর ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ এবং নিজের ক্রমাগত স্ফীত বিষয়-সম্পত্তির বিলি-ব্যবস্থার প্রতি তাঁর ক্রমশ অধিকমাত্রায় সময় নিয়োগ প্রত্যুত কিছুদিনের জন্য তাঁর রাজনীতির প্রতি আকর্ষণের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। অদৃষ্টের পরিহাসে তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনের শেষ দশ বছর ভারতবর্ষের মাটিতে স্থায়ীভাবে প্রোথিত তাঁর ব্যক্তিগত
পৃষ্ঠা: ৯৫

বিষয়সম্পত্তির প্রতি প্রবল আকর্ষণ এবং তার প্রতি তাঁকে যে পরিমাণ মনোযোগ ও উদ্যম নিয়োগ করতে হয় তা প্রায় তাঁর পাকিস্তানের প্রতি অনুরাগের সমতুল্য হয়ে ওঠে।”(১৪)

১৪
পাদটীকা

১. সঈদ; Sound of Fury; ১৮৩-১৮৪ পৃষ্ঠা।
২. হেক্টর বলিথো; সমগ্রন্থ; ১১১ পৃষ্ঠা।
৩. সঈদ; Sound of Fury; ১৮৫-১৮৬ পৃষ্ঠা।
৪. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২৪৪ পৃষ্ঠা।
৫. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ৪১৭ পৃষ্ঠা।
৬. এই পর্যায়ে জিন্নার প্রবল সমালোচক জওহরলালও এমনকি একথা স্বীকার করেছিলেন। দ্রষ্টব্য ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ডিসেম্বর এবং ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের। ২০শে ফেব্রুয়ারি জওহরলাল কর্তৃক যথাক্রমে নবাব মহম্মদ ইসমাইল খাঁ ও জিন্নাকে হী লিখিত পত্র। ড. গোপাল (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; অষ্টম খণ্ড; ২০১ ও ২২৩ পৃষ্ঠা। এ প্রসঙ্গে তাঁর ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি প্রদত্ত সংবাদপত্রের বিবৃতিও তার উল্লেখযোগ্য; সমগ্রন্থ; ২০৯ পৃষ্ঠা।
৭. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২৪২ পৃষ্ঠা।
৮. India Divided; ১৪২ পৃষ্ঠা।
৯. সঈদ; Sound of Fury; ১৮৭-১৮৮ পৃষ্ঠা।
১০. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; চতুর্থ খণ্ড; ১০৮ পৃষ্ঠা।
১১. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১৪০ পৃষ্ঠা।
১২. জে. জে. পাল; সমগ্রন্থ; ৭২ পৃষ্ঠা।
১৩. স্যার বিজয় প্রসাদ সিংহরায়; Parliamentary Government in India; থ্যাকার স্পিঙ্ক, কলিকাতা (১৯৪৩); পৃ. ৩৬৭। জে. জে. পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২২ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১৪. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১৪৪-১৪৫ পৃষ্ঠা।

জিন্না ও জওহরলাল — দুই ভিন্ন ধরণের চরিত্র
১৫

পূর্ববর্তী অধ্যায়ের শেষ অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতিতে নেহেরু এবং তাঁর সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর যে উল্লেখ আছে, তার প্রভাব জিন্নার কর্মপদ্ধতির বিবর্তনের ইতিহাস বোঝার পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সে সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে প্রায় ছিন্নভিন্ন এবং মৃতপ্রায় মুসলিম লীগের কর্ণধার হয়ে প্রাদেশিক বিধানসভাসমূহের নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে জিন্না তাতে যে নবজীবনের সঞ্চার করেন, তার উল্লেখ করা প্রয়োজন।
পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে বিবদমান দুই স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের মতো আচরণকারী মিঞা আবদুল আজীজ এবং খাঁ বাহাদুর হাফিজ হিদায়েৎ হোসেনের লীগের সংযুক্তি হয় তাঁকে কেন্দ্র করে। কিন্তু জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক সংগঠনরূপে সেই লীগ অথবা তার পূর্বেরও মুসলিম লীগের অবস্থা কেমন ছিল? এ সম্বন্ধে খলিকুজ্জমার সাক্ষ্য স্মরণীয়:
“… এ সময়ে (১৯৩৪ খ্রি.) লীগ একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। সরকারি খেতাবধারী ভদ্রলোক, নবাব, জমিদার এবং জি হুজুরেরা লীগে প্রভুত্ব করতেন। তাঁরা সাধারণত সদিচ্ছাপরায়ণ ব্যক্তি হলেও মুসলমানদের স্বার্থে তাঁরা ততটুকুই অগ্রসর হতে ইচ্ছুক ছিলেন যাতে সামাজিকভাবে অথবা সরকারি দরবারে তাঁদের গায়ে আঁচ না লাগে। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এর জন্মলগ্ন থেকে মুসলিম লীগের কার্যকলাপ বরাবরই কোনো ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যে সীমিত ছিল। এমনকি এর বাৎসরিক অধিবেশনগুলিও অনুষ্ঠিত হত সুসজ্জিত শামিয়ানার নীচে বা কোনো বড় হলঘরে যেখানে বিশেষ আমন্ত্রণ-লিপি পাঠিয়ে কিছুসংখ্যক সম্মানীয় অতিথিকে প্রবেশ করতে দেওয়া হত। মুসলিম লীগে প্রকাশ্য জনসভার ব্যাপার ছিলই না। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় যখন এর প্রতিষ্ঠা হয় তখন থেকে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল আলীগড়ে এবং লীগ ছিল সেখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুচ্ছস্বরূপ। সে সময়কার লীগকে এক স্বতন্ত্র মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের আখ্যা দেওয়া যায় না। কারণ আলীগড় তখন রাজনৈতিক সহ মুসলমানদের তাবৎ কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু। প্রধান কার্যালয় লখনউ-এ স্থানান্তরিত করার পর লীগ রাজনৈতিক ব্যাপারে মাথা ঘামানো শুরু করল বটে, তবে বেশ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। সদস্যতা এবং বার্ষিক চাঁদা থেকে এর আয় এমন হত না যে এমনকি এর দপ্তরটুকু ঠিকমত চালানো যায়— জনসাধারণের মধ্যে কাজ করার মতো টাকা তো দূরের কথা। মাহমুদাবাদের রাজা যে বার্ষিক ৩০০০টাকা অনুদান দিতেন তাতে কোনোমতে লীগের খরচ চলত। ঐ ছিল তার স্থায়ী আয়ের প্রধান সূত্র।
“খিলাফৎ আন্দোলনের দিনে এর অস্তিত্ব ছিল কেবল কাগজে-কলমে। যেখানে যেখানে খিলাফৎ সম্মেলন বা কংগ্রেসের অধিবেশন হত মুসলিম লীগও সেখানে মিলিত হত। খিলাফৎ শেষ হয়ে যাবার পর একদল নূতন নবাব এই সুলক্ষণযুক্ত শিশুটির অভিভাবকত্ব গ্রহণ করলেন। কারণ এর মাধ্যমে সম্মান ও খেতাব পাবার বিপুল সুযোগ তাঁদের হস্তগত হল। মুসলমান সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক দুর্গের এই সব রক্ষাকর্তাদের আত্মত্যাগের নিদর্শন ছিল লীগের বাৎসরিক অধিবেশনে যোগ দেওয়া এবং এত কষ্ট করে রেলের প্রথম শ্রেণীর কামরায় সফর করে তাঁদের শহরে পদার্পণ করে তাঁদের অতিথি হয়ে সুসজ্জিত সর্বসুবিধাযুক্ত গৃহে থেকে ও অত্যুৎকৃষ্ট খাদ্যসম্ভারে ক্ষুন্নিবৃত্তির পর তাম্বুল চর্বণ করতে করতে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার জন্য যে শহরে অধিবেশন হচ্ছে সেখানকার ঐ জাতীয় সম্মানভাজন আয়োজকদের মুখে নিজেদের ভূয়সী প্রশংসা শ্রবণ। অধিবেশনের পর তার বিবরণী যথারীতি সংবাদপত্রে পাঠানো হত। কিন্তু তার বহু পূর্বেই ব্রিটিশ কর্মচারীরা তাঁদের গোপন সূত্র থেকে সভায় কে কি বলেছেন তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পেয়ে যেতেন। অধিবেশনের সমাপ্তির পরই সে বছরের মতো প্রতিষ্ঠানের সব কাজ সমাপ্ত হয়ে যেত এবং ভারত সরকারের মহাফেজখানার বিবরণে লিপিবদ্ধ হওয়া ছাড়া অধিবেশনে কে কি বলেছেন সে সম্বন্ধে কেউ খেয়ালও করতেন না।”(১)
মুসলিম লীগরূপী ভগ্নস্তূপের এই মাল-মশলা নিয়ে জিন্না এক নূতন ইমারৎ তৈরি করার কাজ শুরু করলেন। লক্ষ্য—প্রাদেশিক আইনসভাসমূহের আগামী নির্বাচনে মুসলমানদের এক শক্তিশালী মিলিত ফ্রন্ট খাড়া করা, যাতে ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থায় মুসলমানদের যথাযোগ্য স্থান থাকে এবং তার বলে যাতে মুসলমানরাও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে উপনীত হতে পারেন। বোম্বের লীগ অধিবেশনেই তাই স্থির হল যে প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন খরচ চালাবার জন্য ৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করা হবে। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লীগের জন্য তরুণ স্বেচ্ছাসেবক সংগৃহীত হল। এ প্রচেষ্টা অসহযোগ আন্দোলনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কটের দ্বারা গান্ধীর কংগ্রেসে নূতন রক্ত আমদানির চেষ্টা এবং তিলক স্বরাজ্য ফান্ডের জন্য ১ কোটি টাকা সংগ্রহের সঙ্গে তুলনীয়। এ ছাড়া লীগের ঐ অধিবেশন থেকে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠল। কংগ্রেস ও রাজনীতিকে জনমুখী করার গান্ধীর প্রয়াসের সঙ্গে রুচিতে না মেলা অভিজাত জিন্নার ঐ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার অন্যতম কারণ। জিন্না অতঃপর বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে গান্ধীর সেই পথই গ্রহণ করলেন। লাহোরে শহীদগঞ্জ মসজিদের আন্দোলন প্রসঙ্গে মুসলিম জনসাধারণের সঙ্গে জিন্নার যে প্রথম পরিচয়, বোম্বে অধিবেশন এবং তারপর তা ক্রমশ দৃঢ় হতে হতে পরবৎসর লখনউ-এর লীগের বাৎসরিক অধিবেশনে জিন্না একরকম গণনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করলেন, যদিও তা বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের।
লিয়াকত আলী খাঁ এবং আবদুল মতীন চৌধুরীর মতো তরুণ গুণগ্রাহীরা ইতিপূর্বেই জিন্নার শিবিরে ছিলেন। লীগের অধিবেশনের পরই জিন্না ব্যাপকভাবে ভারত ভ্রমণ করে বিভিন্ন প্রদেশে মুসলমান সমাজের সর্বজনমান্য নেতাদের লীগের পতাকাতলে সমবেত করার প্রয়াস আরম্ভ করলেন। সর্বাগ্রে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের প্রবক্তা কবি ইকবালকে নিজের সঙ্গী করলেন, যাঁকে তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদের লীগ অধিবেশনের সভাপতিত্বে বরণ করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে গোলটেবিল বৈঠকের সময়ে ইকবালের সঙ্গে একাধিকবার মিলিত হয়ে মুসলিম রাজনীতি সম্বন্ধে তিনি মতবিনিময় করেন এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে একাধিক পত্র বিনিময় হয়। পরবর্তীকালে জিন্না স্বীকার করেন যে ভারত ব্যবচ্ছেদ যে অপরিহার্য এই বিশ্বাস তাঁর মনে সৃষ্টি করার ব্যাপারে ইকবাল এক নিশ্চিত ভূমিকা পালন করেন।(২) “সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা”-এর কবি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম নানা ধর্মের অধিবাসীদের বাসভূমি ভারতের অঙ্গচ্ছেদ করে এক মুসলমান রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করবেন এবং ১৯৩৬- ৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে জিন্নাকে সক্রিয়ভাবে এর জন্য প্রভাবিত করে এই দেশবিভাগ করত পাকিস্তান নামক ঐস্লামিক রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে তাঁকে অনুপ্রাণিত করবেন—এও ইতিহাসের এক বিচিত্র পরিহাস।
যাই হোক, পাঞ্জাবের অদ্বিতীয় নেতা স্যার ফজল-ই-হাসান জিন্নার প্রতি আদৌ প্রসন্ন ছিলেন না বলে জিন্নার আহ্বানে সাড়া দিতে ইতস্তত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু জিন্নার পথ প্রশস্ত করে দিল। ইকবাল ও রাজা গজনফর আলীসহ পাঞ্জাবের মোট এগারজন বিশিষ্ট মুসলিম নেতা লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্যপদ স্বীকার করলেন। এইভাবে বঙ্গে ঢাকার নবাব, শহীদ সুরাবর্দী, ইস্পাহানী প্রমুখ আটজন, উত্তর প্রদেশের নবাব ইসমাইল খাঁ, মাহমুদাবাদ ও সালেমপুরের রাজাদ্বয়, সৌকত আলী ও খলিকুজ্জমাঁ প্রমুখ সাতজন এবং মাদ্রাজ, সিন্ধু, বিহার, সেন্ট্রাল প্রভিন্স, দিল্লি, আসাম ও বোম্বের প্রমুখ মুসলমান নেতাদের তিনি নিজ সহযাত্রী করেন। ব্যতিক্রম ছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খাঁ ভ্রাতৃদ্বয় এবং মৌলানা আজাদ, রফি আহমদ কিদওয়াই, আসফ আলী এবং বিহারের ড. মাহমুদ, অধ্যাপক আবদুল বারী প্রমুখের মতো কংগ্রেসের প্রথম সারির মুসলিম নেতৃবৃন্দ যাঁরা কেনো অবস্থাতেই জিন্নার সহযাত্রী হতে প্রস্তুত ছিলেন না। জিন্নার এই সময়কার সফরে বাংলার নাজিমুদ্দীন এবং বোম্বের চুন্দ্রীগড় প্রমুখও তাঁর সঙ্গে যোগদান করেন এবং কালক্রমে তাঁরা ভারত ও পাকিস্তানের শাসনকার্য নির্বাহের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে বন্দী জওহরলাল পত্নীর অসুস্থতার জন্য ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে কারামুক্ত হয়েই অসুস্থ স্ত্রীর শয্যাপার্শ্বে থাকার জন্য সুইজারল্যান্ডে যান। স্ত্রীর মৃত্যুর পর কিছুদিন ইউরোপে ঘোরার পর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং পরের মাসে লখনউ কংগ্রেসে রাজেন্দ্রপ্রসাদের উত্তরাধিকারী রূপে কংগ্রেসের সভাপতি হন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ফৈজপুর কংগ্রেসে তিনি পুনর্বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। অর্থাৎ প্রাদেশিক আইনসভাসমূহের নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনযুদ্ধ পরিচালনার সময় এবং নির্বাচনোত্তর কালে মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের সময়ে নেহরু কংগ্রেসের সারথি। এ প্রসঙ্গে আরও স্মরণীয় যে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের কংগ্রেসের সময়ে গান্ধীজী প্রত্যক্ষ রাজনীতি ছেড়ে প্রধানত গঠনকর্মে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অতঃপর জওহরলালজীই কংগ্রেসের অদ্বিতীয় নেতা হওয়ায় কংগ্রেসের তরফ থেকে নির্বাচন পরিচালনা এবং তার পরিণামে মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের ব্যাপারে তাঁর ভূমিকাই সর্বপ্রধান ছিল।
কংগ্রেসে সেই ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে সুভাষচন্দ্র প্রমুখ তরুণতর নেতাদের সঙ্গে জওহরলাল প্রগতিপন্থী রূপে পরিচিত। ভারতীয় রাজনীতিতে সমাজবাদ-সাম্যবাদ ইত্যাদির প্রসঙ্গ প্রবর্তনের ব্যাপারেও তিনি একজন পথিকৃৎ। ১৯৩৫-৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে থাকার সময়ে তিনি সমাজবাদী এবং গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা সম্বন্ধে পাশ্চাত্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হন। তাই কংগ্রেস সভাপতি হবার পর বিভিন্ন সভা-সমিতিতে এই সব বিষয় সম্বন্ধে মন্তব্য করতে থাকেন। কংগ্রেস সহ দেশের আরও অনেক রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী ও নেতাদের ভিতর সমাজবাদ ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী কোনো ভূমিকা লক্ষ করছেন মনে করলেই জওহরলাল তার প্রকাশ্য সমালোচনা করতেন। আর সাধারণ নির্বাচন তো প্রায় বাগযুদ্ধের ব্যাপার যার জন্য ১৯৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে জওহরলাল কৃত এইসব সমালোচনা ব্যাপক হয়ে ওঠে।
এই প্রসঙ্গে জওহরলালের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধেও কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। ধনীর দুলাল, দেশ-বিদেশে উচ্চশিক্ষিত সুদর্শন তরুণ জওহরলাল স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ত্যাগ ও কৃচ্ছ্রসাধনার জন্য জাতীয়তাবাদীদের হৃদয়-সম্রাট রূপে বন্দিত হতেন। কিন্তু তথাকথিত দাম্ভিক অহঙ্কারী এবং কোপন স্বভাবের জন্য বিশেষ করে অন্তরঙ্গ পরিচিত মহলে তাঁর সমালোচকের সংখ্যাও কম ছিল না। আমরা কিন্তু তাঁর বিপুলসংখ্যক গুণগ্রাহী ও সমালোচকদের বাদ-প্রতিবাদের গহন অরণ্যে প্রবেশ করার দুঃসাহস করব না। আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ গুণগ্রাহী সহকর্মী আজাদ ও সীতারামাইয়ার মন্তব্যের অংশবিশেষ এবং নেহরুর স্বকীয় চরিত্র-চিত্রণের কিছুটা উদ্ধৃত করব। নেহরু সম্বন্ধে “আমরা প্রিয়তম সুহৃদদের মধ্যে একজন এবং ভারতের জাতীয় জীবনে তাঁর অবদান অদ্বিতীয়” মন্তব্য করে আজাদ বলেছেন, “…সময় সময় তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে তিনি এত প্রভাবিত হয়ে পড়েন যে পরিস্থিতির বাস্তব দিকের তিনি সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন না।…কখনো কখনো তিনি আবেগতাড়িত হয়ে যান।”(৩) সীতারামাইয়া বলেছেন, …জওহরলাল বরাবরই দ্বিবিধ মানসিকতা চালিত হয়েছেন। এর প্রথমটি হল এক ধরনের শ্রেষ্ঠত্ববোধের মনোভাব যার জন্য তিনি নিজেকে ভারতবর্ষের আর সবার থেকে উঁচুদরের মানুষ বলে মনে করেন। দ্বিতীয়টি হল এক ধরনের হীনম্মন্যতা—এই বুঝি তাঁকে গান্ধীর নীচে স্থান দেওয়া হল।”(৪)
নেহরুর আত্মচিত্রণ উচ্চকোটির শিল্পকর্ম এবং তাঁর চরিত্রবৈশিষ্ট্য অধ্যয়নের চাবিকাঠি স্বরূপ। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ই অক্টোবর নিজের সম্বন্ধে তিনি লেখেন, “একটুখানি মোচড় দিলেই জওহরলাল হয়তো একজন ডিক্টেটরে পরিণত হয়ে শ্লথ গতিসম্পন্ন গণতন্ত্রের সব সাজ-সরঞ্জাম ঝেঁটিয়ে একপাশে সরিয়ে দেবেন। তখনও হয়তো তিনি গণতন্ত্র ও সমাজবাদের ভাষা ও স্লোগান প্রয়োগ করবেন। কিন্তু আমরা সকলে জানি যে ফ্যাসিবাদ কেমনভাবে এই ভাষায় পুষ্ট হয়েছে এবং তারপর অপ্রয়োজনীয় বস্তুরূপে একে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।…জওহরলাল ফ্যাসিস্ট হতে পারবেন না। কিন্তু তবুও তাঁর ভিতর ডিক্টেটর হবার যাবতীয় উপাদান রয়েছে—প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হবার উপযুক্ত দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, উদ্যম, অহমিকা সাংগঠনিক ক্ষমতা, যোগ্যতা, দার্ঢ্য আর জনসমুদ্রের প্রতি তাঁর প্রবল ভালবাসা, অপরের প্রতি অসহিষ্ণুতা এবং দুর্বল ও অক্ষমদের প্রতি কিছুটা উপেক্ষা।”(৫)
জিন্নার সম্বন্ধে নেহরুর অনীহা এত প্রবল ছিল যে গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীজীকে জিন্নার কথা শুনতে হচ্ছে এও তাঁর সহ্য নয়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর গান্ধীকে লিখিত এক পত্রে জিন্না সম্বন্ধে ব্যঙ্গভরে জওহরলাল মন্তব্য করেন: “আমার প্রিয় বন্ধু জিন্নার চোদ্দ দফারূপী বিশুদ্ধ আবোলতাবোল যদি কিছুক্ষণের জন্যও আমাকে শুনতে হত, তাহলে আমাকে দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপে পালিয়ে বাঁচার কথা চিন্তা করতে হত—যেখানে হয়তো এমন কিছু মানুষের দেখা পাবার সম্ভাবনা যাঁদের এতটুকু বুদ্ধি বা অজ্ঞতা আছে যে তাঁরা চোদ্দ দফার আলোচনা করেন না।”(৬) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে জিন্নার চোদ্দ দফার অধিকাংশ যখন স্থান পায় তখন জওহরলাল জিন্না সম্বন্ধে নিজের অভিমত পরিবর্তন করেছিলেন কিনা তা জানা নেই।
পৃষ্ঠা: ১০০

জওহরলালের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে এই আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ গান্ধীর পরই যাঁর সঙ্গে জিন্নার ভিন্ন মানসিকতাজনিত বিরোধ প্রবল হয়ে ওঠে এবং যাঁর কারণে তিনি ক্রমশ আরও আপোষবিহীন সাম্প্রয়িকতাবাদী ভূমিকা গ্রহণ করেন তিনি হলেন নেহরু। তবে জিন্নাও কম দাম্ভিক ও অহঙ্কারী ছিলেন না। এ সম্বন্ধে তিনটি উদাহরণ দেওয়াই যথেষ্ট হবে। তাঁর বিখ্যাত দম্ভোক্তি, “আমি পাকিস্তান লাভ করেছি আমার সচিব ও তাঁর টাইপরাইটারের সাহায্যে”(৭) তো প্রায় চিরায়ত উক্তিতে পরিণত হয়েছে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে কলকাতায় মুসলিম লীগের অধিবেশনে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে সেই অভিনব আন্দোলনের জনককে স্বীকৃতি দেবার ঔদার্য না দেখিয়ে অথবা সোজাসুজি সেই কর্মসুচীকে গ্রহণ না করে ব্যক্তিগত অহমিকা চালিত হয়ে শাসকদের আত্মসংশোধন করার জন্য সতর্ক করে দেবার সময়ে জিন্না বলেন, “…তা না হলে জনসাধারণের সামনে অসহযোগের নীতি গ্রহণ করা ছাড়া অপর কোনো পথ খোলা থাকবে না—তবে সে অসহযোগ সে শ্রীযুক্ত গান্ধীর কর্মসূচীই হবে, এমন কোনো কথা নেই।”(৮)
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই অক্টোবর লীগের লখনউ অধিবেশনের বিষয় নির্বাচনী সমিতিতে লীগের নীতি (creed) সম্বন্ধে খলিকুজ্জমাঁর সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সংশোধনী প্রস্তাবের বক্তব্য ছিল, লীগের নীতি হল, “ভারতবর্ষে যথার্থ গণতান্ত্রিক রাজ্যসমূহ রূপে পূর্ণ (complete) স্বাধীনতা অর্জন।” জিন্না এর বিরোধিতা করে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত সংশোধনী প্রস্তাবের প্রতিকূল যুক্তিজাল বিস্তার করতেই থাকলেন। অবশেষে লীগের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কিছু নেতা যখন তাঁর কাছে আবেদন করলেন যে তিনি যেন লীগের বিলুপ্তির কারণ না হন তখন, “তিনি অনেকটা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন: ‘ঠিক আছে, আমি বলছি সম্পূর্ণ (full) স্বাধীনতা, পূর্ণ স্বাধীনতা নয়।” এ সম্বন্ধে মন্তব্য প্রসঙ্গে খলিকুজ্জমাঁ বলেছেন, “এই ছিলেন শ্রীযুক্ত জিন্না—এর থেকে তাঁর সমগ্র আভ্যন্তরীণ চরিত্রের আভাস পাওয়া যায়। কখনো তিনি পরাজয় স্বীকার করবেন না। জনসভায় হোক অথবা অন্যত্র, এক চূড়ান্ত ঔদাসীন্যভরে তিনি পরাভবকে বিজয়ে পরিণত করবেন।”(৯)
এর উপর জওহরলাল এবং তাঁর সমাজবাদী-গণতান্ত্রিক “বুলি” সম্বন্ধে জিন্নার সবিশেষ অবজ্ঞার কারণ কেবল ইতিপূর্বে উল্লেখিত তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তিনিষ্ঠাই নয়। যাঁর পিতার সঙ্গে জিন্না সমান স্তরে রাজনীতি করেছেন, তাঁর “উন্নাসিক” পুত্রকে জিন্না আমল দিতেই প্রস্তুত ছিলেন না। বিশেষ বিংশ শতাব্দীতে এই দ্বিতীয়বার যখন মুসলিম পুনর্জাগরণের ভাগীরথী প্রবাহিত হবার সূচনা দেখা দিয়েছে এবং এর ভগীরথ স্বয়ং জিন্না, যাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্ভাবনা একদা যেন শূন্য থেকেই নিক্ষিপ্ত গান্ধীর কারণে বিনষ্ট হয়েছিল। ইতিহাসে ব্যক্তিরও যে বিশিষ্ট ভূমিকা আছে, তা গান্ধী-জিন্না বিরোধের মতো নেহরু-জিন্না বিরোধেও প্রমাণিত হয়।
যাই হোক, আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাভিলাষী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সভাপতি জওহরলাল ও জিন্না পরস্পরকে বাছাই করা সুতীক্ষ্ম বাক্যশায়কে বিদ্ধ করার উল্লাসে মত্ত হলেন। পুনর্গঠিত লীগের নেতা হিসাবে লীগের নির্বাচনী ইস্তাহার এবং নিজের ব্যক্তিগত ভূমিকা এবং বক্তৃতা-বিবৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে জিন্না সমউদ্দেশ্য সাধনের জন্য কংগ্রেসের প্রতি যে সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেছিলেন, তাকে রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে কলকাতায় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ই নভেম্বর এক জনসভায় জওহরলাল ঘোষণা করলেন, “যতই উদার চেহারা নিয়ে দেখা দিক না কেন, আমরা কোনো সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উপর নির্ভর করতে যাব না।”(১০)
যে-কোনো দলের রাজনৈতিক নেতার নির্বাচনী-বক্তৃতা সাধারণত অন্তঃসারশূন্য ও বাহ্বাস্ফোটে পূর্ণ হয়। পূর্বোক্ত ঘটনার পর জিন্না ও নেহরুর নির্বাচনী বক্তৃতাসমূহ যেন তদতিরিক্ত পরস্পরকে বাক্যের ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করার উদ্দেশ্যযুক্ত হয়ে দাঁড়াল। এই চাপান-উতোরের প্রক্রিয়ায় নেহরু বললেন, “দেশে মাত্র দুটি শক্তিই বিদ্যমান, কংগ্রেস ও সরকার।” জবাবে জিন্না “এদেশে এক তৃতীয় পক্ষও আছে এবং তা হল মুসলমানদের” বলার সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করলেন, “আমরা কোনো দলের তল্পিবাহক হব না। সমান অংশীদার রূপে আমরা কাজ করতে প্রস্তুত আছি।”(৩।১।১৯৩৭)। ১০ই জানুয়ারি জওহরলাল এক বিবৃতিতে জিন্নার মানসিকতাকে “মধ্যযুগীয় ও সেকেলে” আখ্যা দিয়ে দাবি করলেন, “মুসলিম লীগের অধিকাংশ সদস্যদের চেয়ে আমি অধিক মাত্রায় মুসলমান জনসাধারণের সম্পর্কে আসি।” জিন্না হুঙ্কার ছাড়লেন, “জনসাধারণের সমর্থনবিহীন অপর সম্প্রদায়ের জনকতক ভাগ্যসন্ধানী এবং সবকিছু বিশ্বাস করতে প্রস্তুত মানুষ নিয়ে অসাম্প্রদায়িকতার তকমা আঁটায় লীগ আস্থা রাখে না।”(১৯।১।১৯৩৭)। জওহরলাল জবাব দিলেন, “কংগ্রেসে এমন মুসলমান আছেন, যাঁরা হাজার জিন্নার প্রেরণাস্থল।”(৯।২।১৯৩৭)। জিন্না জওহরলালকে “পিটার প্যান”, “ডিক্টেটর” ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মন্তব্য করলেন যে তিনি সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের মতো আচরণ করছেন। জওহরলালও অনুরূপ ভাষায় জিন্নার প্রত্যুত্তর দিলেন।(১১)
নেহরু-জিন্নায় বাগযুদ্ধ সম্বন্ধে উলপার্ট মন্তব্য করেছেন, “…তাঁর জীবনের এ এক অতীব মারাত্মক ভ্রমাত্মক কার্য যা দ্বেষ ও রূঢ়তা চালিত হয়ে তিনি করেছিলেন। ইকবালের চেয়েও নেহরু বেশি করে লীগকে এক নূতন গণমুখী কর্মকৌশল নিতে প্ররোচিত করেন। এর পিছনে ছিল জিন্নাকে তাঁর বৈঠকখানার রাজনীতি ছেড়ে যেসব লক্ষ লক্ষ মুসলিম জনসাধারণ দিনের অধিকাংশ সময়ে গ্রামের ক্ষেতখামারে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজ করেন তাঁদের কাছে পৌঁছানোর জন্য জিন্নাকে খোঁচা দেওয়া এবং চ্যালেঞ্জ জানানো। সেইসব জনসাধারণকে অন্দোলিত করার, তাঁদের জাগরুক করে মুসলিম নেতৃত্বের পিছনে পিছনে মিছিল করে চলতে অনুপ্রাণিত করার একটিই মাত্র সম্ভাব্য উপায় লীগের কাছে ছিল। ইসলাম বিপন্ন, একমাত্র দীনই (ধর্ম) বিবেচ্য—এই অতঃপর হয়ে উঠল মুসলিম লীগের একমেব ভূমিকা।”(১২)

১৫
পাদটীকা

১. খলিকুজ্জমা; সমগ্রন্থ; ১৩৭-৩৮ পৃষ্ঠা।
২. ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাস থেকে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের মধ্যে ইকবাল মা জিন্নাকে ১৩টি পত্র লিখে মুসলমানদের পৃথক বাসভূমির যৌক্তিকতা প্রদর্শন করেন। জিন্নাও পত্রগুলির উত্তর দেন, যার নকল অবশ্য পাওয়া যায় না। পত্রগুলি পুস্তিকার আকারে প্রকাশের সময় জিন্না তার ভূমিকাতে লেখেন “তাঁর (ইকবালের) বক্তব্য বহুলাংশে আমার অভিমতের অনুকূল ছিল এবং ভারতবর্ষের সাংবিধানিক সমস্যাসমূহের অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়নের পর তাঁর বক্তব্য আমাকে একই সিদ্ধান্তের অভিমুখে নিয়ে যায়। এই সিদ্ধান্ত কালক্রমে মুসলিম ভারতের সম্মিলিত ইচ্ছায় পরিণত হয় এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব— জনসাধারণের মধ্যে যা “পাকিস্তান প্রস্তাব” রূপে খ্যাত—রূপপরিগ্রহ করে।” ইকবালের চিঠিগুলির মধ্যে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২১শে জুনের চিঠির নিম্নোদ্ধৃত অংশ বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য; “… পূর্বে আমি যেভাবে বলেছি মুসলিম প্রদেশগুলির এক পৃথক ফেডারেশনই হচ্ছে একমাত্র পন্থা যার দ্বারা আমরা ভারতবর্ষে শান্তি স্থাপন করতে পারি এবং অমুসলমানদের আধিপত্য থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে পারি। উত্তর-পশ্চিম ও বঙ্গের মুসলমানদের কেন ভারতবর্ষের এবং ভারতের বাইরের অন্যান্য জাতির মতো পৃথক জাতি মনে করা যেতে পারে না যারা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারী?” পীরজাদা (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; ১৩৮-১৪২ পৃষ্ঠা। পাকিস্তান সৃষ্টির ব্যাপারে ইকবাল ও জিন্নার পারস্পরিক ভূমিকা সম্বন্ধে সি.এম. নঈম (সঃ) Iqbal Jinnah and Pakistan; জিন্না পাবলিশিং হাউস, দিল্লি (১৯৮২) এক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
৩. আজাদ; সমগ্রন্থ; (১৯৫৯ সংস্করণ) ১৬০ পৃষ্ঠা। ১৯৮৮ খ্রি. পূর্ণাঙ্গ সংস্করণে অবশ্য এই উদ্ধৃতির শেষাংশ বর্জিত হয়েছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে নূতন সংস্করণে জওহরলালের প্রকৃতি সম্পর্কে ইতিপূর্বে অপ্রকাশিত মৌলানার যেসব মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তা পূর্বের তুলনায় অধিকতর সূচীমুখ ও কুলীশ-কঠোর। দ্র: পৃষ্ঠা ১৩৮-৪০, ১৬২, ১৭০, ১৮৩-৮৪, ১৯৮-২০০।
৪. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ (দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৬৯); ৯ পৃষ্ঠা।
৫. ড. গোপাল (সঃ); অষ্টম খণ্ড ৫২১-২২ পৃষ্ঠা। রচনাটি প্রথমে ছদ্মনামে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের Modern Review (কলকাতা) পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সেকালে বহুল আলোচনার বিষয়বস্তু হয়।
৬. সমগ্রন্থ; পঞ্চম খণ্ড; ৪৭ পৃষ্ঠা।
৭. সঈদ; Sound of Fury; ৩৪৭ পৃষ্ঠা।
৮. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ৬৮ পৃষ্ঠা।
৯. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ১৭২ পৃষ্ঠা। এই রকম অপর একটি উদাহরণ—ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক আইনকে ultra vires বলে চাগলার সঙ্গে তর্ক করা—চাগলা তাঁর গ্রন্থের ৫৩-৫৪ পৃষ্ঠায় দিয়েছেন।
১০. ড. গোপাল (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; অষ্টম খণ্ড; ৫৩৮ পৃষ্ঠা।
১১. বিস্তারিত বিবরণের জন্য সমগ্রন্থ ১-৪২ এবং ১১৯-২৪৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
১২. সমগ্রন্থ; ১৪৮ পৃষ্ঠা।

উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসী মন্ত্রীমণ্ডল—লীগ ক্ষমতার ভাগ থেকে বঞ্চিত
১৬

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের রাজেন্দ্রপ্রসাদ-জিন্না আলোচনা ব্যর্থ হবার পিছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল—মুসলমানদের যথার্থ প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান কোনটি? ফেডারেশন, বিশেষ ক্ষমতা, ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের সীমাবদ্ধতা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রশ্ন ও ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিশেষ গুরুত্ব পায়। দেখা গেল তাবৎ দুর্বলতা সত্ত্বেও এবং মুসলিম ভোটের শতকরা মাত্র ৪.৭ ভাগ পেলেও একমাত্র লীগই সর্বভারতীয় দৃষ্টিতে সঙ্গতভাবে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের দাবি করতে পারে। কারণ কংগ্রেসের এত ধর্মনিরপেক্ষতার কথা সত্ত্বেও ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির ১৪৩ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ৬ জন মুসলমান ছিলেন। এঁদের মধ্যে তিনজন খুদা-ই-খিদমদগার প্রভাবিত সীমান্ত প্রদেশের, একজন বিহার এবং অপরজন উত্তরপ্রদেশ থেকে। ষষ্ঠ সদস্য মৌলানা আজাদ ছিলেন ভূতপূর্ব সভাপতি রূপে। কংগ্রেস স্বয়ং নিজের দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন ছিল। তাই মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত প্রাদেশিক আইনসভাসমূহের ৪৮২টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এইজন্য উপরের স্তরে জিন্না ও জওহরলালের বাগ্যুদ্ধ সত্ত্বেও উভয় দলের প্রাদেশিক স্তরের নেতারা মনে করতেন যে কংগ্রেস ও লীগের শক্তি মিলিত হলে সরকারি আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থীদের পরাজিত করা সম্ভবপর হতে পারে।
“নির্বাচনের ফলাফল প্রতিটি দলের সামনে আয়নার মতো খাড়া হয়ে নিজের সম্বন্ধে নিজ ধারণায় কোথায় কোথায় ত্রুটি ছিল তা স্পষ্ট দেখিয়ে দিল। বঙ্গ ছাড়া মুসলিম লীগ আর সব মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে ধরাশায়ী হয়েছিল। আর ঐ প্রদেশেও মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট ১১৯টি আসনের মধ্যে মাত্র ৪০টি পায়। পাঞ্জাবে বৃহত্তম দল হয়ে দাঁড়ায় সম্প্রতি পুনঃসংগঠিত মুসলমান ও হিন্দু জমিদারদের ইউনিয়নিস্ট পার্টি। লীগ ওখানে ৮৬টি মুসলমান আসনের মধ্যে মাত্র দুটি পায়। তার অবস্থা কংগ্রেসের চেয়ে কোনো অংশে ভাল হয়নি কারণ কংগ্রেসের আসন সংখ্যাও ছিল দুই…হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত ৪৪টি সাধারণ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১৮টিতে বিজয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় এবং এই কথা প্রমাণ করে যে হিন্দুদের তরফ থেকে কথা বলার অধিকার কংগ্রেসেরই বেশি।
“বঙ্গে যে মুসলিম লীগ ৪০টি আসন পেয়েছিল তা নিখিল ভারত মুসলিম লীগের হুবহু প্রতিরূপ নয়। এ হল প্রাদেশিক মুসলিম লীগ, যে প্রতিষ্ঠান যৌথ নির্বাচনের(১) পক্ষে নিজের একক কণ্ঠস্বর বার বার তুলেছে।…তাড়াহুড়া করে সংগঠিত কৃষক প্রজা পার্টিও…লীগের তুলনায় ভাল ফল করে। প্রজা পার্টি কৃষকদের রায়তী স্বত্বের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিল এবং এই দলের নেতৃত্ব প্রধানত মুসলমানদের হাতে থাকলেও পার্টি মুসলমান নাম গ্রহণ করেনি অথবা মুসলমান ভোটারদের দরবারে মুসলিম প্রতিষ্ঠান হিসাবে উপস্থিত হয়নি। এর থেকে এই সত্য প্রতিপাদিত হয় যে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের আলাপ-আলোচনায় স্বতঃনিযুক্ত মুসলমান নেতাদের পক্ষ থেকে যে জাতীয় প্রচার করা হত ভোটারদের মন তাতে সাড়া দিতে প্রস্তুত ছিল না। এছাড়া কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হক্ যখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য অপর দলের সহযোগিতার জন্য ইচ্ছুক হলেন, তখন তিনি লীগের বদলে কংগ্রেসের(২) কাছে যাওয়াই পছন্দ করেছিলেন।
“উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস একক বৃহত্তম দল হয়েছিল এবং নির্বাচনে লীগের ভরাডুবি ঘটেছিল। পরে কয়েকজন নির্দলীয়ের সহায়তায় কংগ্রেস ঐ প্রদেশে মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করতে সমর্থ হয়েছিল। সিন্ধুতেও লীগ হাতে কিছুই পায়নি। কংগ্রেস ঐ প্রদেশে মুসলিম আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে কিছু জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের সাহায্য করেছিল। আর কিছু নির্দলীয়দের সঙ্গে মিলিত হয়ে এঁরা ঐ প্রদেশে এক কংগ্রেসি মানসিকতাযুক্ত মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করেছিলেন।
“উত্তর প্রদেশে নির্বাচনের প্রাক্কালে লীগের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি কংগ্রেস একরকম মেনে নিয়েছিল।(৩) কংগ্রেস সাকুল্যে ৯টি মুসলিম আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই আত্মতৃপ্ত ছিল এবং (মোট ৬৬টি আসনের মধ্যে) বাকি সব আসন মুসলিম লীগকে ছেড়ে দিয়েছিল। নির্বাচনে কংগ্রেস ঐ ৯টি আসনেই পরাজিত হয় এবং এইভাবে লীগ মুসলমানদের প্রতিনিধি—কংগ্রেসের এই পরোক্ষ স্বীকৃতি বাস্তবে প্রমাণিত হয়। তবে এই ঘটনা ছাড়া মুসলিম লীগ কর্তৃক কংগ্রেসের আস্থার মর্যাদা পূর্ণত বা প্রধানত সপ্রমাণ করা সম্ভবপর হয়নি। লীগ মাত্র ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়, বাকিগুলি নির্দলীয় মুসলিম প্রার্থীরা পান। কংগ্রেস অধিকাংশ হিন্দু আসনে জয়লাভ করে এবং এককভাবে সরকার গঠন করার শক্তি অর্জন করে। নির্বাচনযুদ্ধে প্রবৃত্ত হবার মুখে কংগ্রেস সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্বন্ধে সুনিশ্চিত ছিল না এবং ঐ দলের প্রাদেশিক নেতৃবর্গের মুসলিম লীগের সঙ্গে নির্বাচনের ব্যাপারে একটা মিতালী করার অন্যতম কারণ ছিল ভবিষ্যতে মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করার সময় লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন করার সম্ভাবনা।”(৪)
ছোটলাটরা তাঁদের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত মন্ত্রীদের গণতান্ত্রিক অধিকার কুণ্ঠিত করবেন না—তাঁদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি দাবি এবং বন্দীমুক্তি ইত্যাদির প্রশ্নে কংগ্রেস পাঁচটি প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অবিলম্বে মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করেনি। অথচ গান্ধী ও কংগ্রেস সভাপতি জওহরলালের মতো নেতারা কংগ্রেসের মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের ব্যাপারে উৎসাহী না হলেও অধিকাংশ নেতা ক্ষমতা সীমিত হলেও তা পাবার জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন। ছোটলাটদের কাছ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি না পেলেও অবশেষে ওয়ার্কিং কমিটির ৭ই জুলাই-এর প্রস্তাবানুসারে কংগ্রেস মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম অধ্যায়ে মৌলানা আজাদের মন্তব্যে আমরা দেখেছি যে উত্তর অর্থাৎ তদানীন্তন সংযুক্ত প্রদেশে কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডল গঠনকে কেন্দ্র করে যেহেতু ভারত বিভাগের বীজ বপিত হয়েছিল, তাই সে সম্বন্ধে আমরা একটু বিশদভাবে আলোচনা করব।
সংযুক্ত প্রদেশের সরকারের আশীর্বাদপ্রাপ্ত জমিদারদের এগ্রিকালচারিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে মোটামুটি একইরকম রাজনৈতিক আর্থিক ও সামাজিক কর্মসূচীভিত্তিক নির্বাচনী ইস্তাহারের ভিত্তিতে গুটিকয়েক মুসলিম আসন ছাড়া কংগ্রেস প্রধানত সাধারণ আসনে এবং লীগ মুসলমান আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, এ আমরা দেখেছি। স্বয়ং জওহরলালের স্বীকারোক্তি আছে যে লীগের প্রার্থী প্রতিক্রিয়াশীল না হলে এবং সে আসনে কংগ্রেসের প্রার্থী না থাকলে
পৃষ্ঠা: ১০৫

তিনি নির্বাচনী প্রচারে লীগের প্রার্থীর সমর্থন করেছিলেন, যদিও নিখিল ভারতীয় স্তরে জিন্নার সঙ্গে তাঁর প্রবল বাগ্যুদ্ধ চলছিল। আমরা এও দেখেছি যে কংগ্রেস তাবৎ মুসলিম আসনে পরাজিত হলেও সাধারণ আসনে ভাল ফল করেছিল এবং মুসলিম লীগ ২৭টি মুসলমান আসনে জয়ী হয়েছিল। স্বভাবতই তাই নির্বাচনের পরে মুসলিম লীগের তদানীন্তন নেতা (নিজ স্বীকৃতি অনুযায়ী যিনি কৌশলগত কারণে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে কংগ্রেস ছেড়ে লীগে যোগ দেন) খলিকুজ্জমাঁর সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা গোবিন্দবল্লভ পন্থের নির্বাচনপূর্ব বোঝাপড়া অনুসারে কোয়ালিশন মন্ত্রীমণ্ডল গঠন সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হয়, যদিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে কংগ্রেসের অপর কারও সাহায্য বিনাই মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের ক্ষমতা ছিল। কিন্তু জুলাই-এর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কংগ্রেসের হাইকমান্ড মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের অনুমতি না দেওয়ায় প্রদেশে ছোটলাটের মনোনীত অস্থায়ী সরকার সংখ্যালঘু সরকার হিসাবে গঠিত হয় এবং কংগ্রেসের নির্বাচনযুদ্ধের সাথী হিসাবে লীগ ছতারীর নবাবের সেই মন্ত্রীমণ্ডলে যোগ দেবার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে দলের চরিত্র ও আদর্শবাদের পরিচয় দেয়। শুধু তাই নয়, লীগের সদস্য সালেমপুরের রাজা সেই মন্ত্রীমণ্ডলে যোগ দেওয়ায় খলিকুজ্জমাঁ উদ্যোগী হয়ে তাঁকে বহিষ্কৃত পর্যন্ত করেন। ইতিমধ্যে ঐ প্রদেশে একটি মুসলিম আসন শূন্য হয় যাতে লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। জিন্না এই মর্মে প্রকাশ্য ঘোষণা করেন যে ঐ আসন লীগের এবং কংগ্রেস যেন ওখানে প্রার্থী দেবার চেষ্টা না করে। তবু জিন্নার নির্দেশকে একরকম অগ্রাহ্য করে প্রদেশের মুসলিম লীগ বোর্ড আসনটি বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা রফি আহম্মদ কিদওয়াইকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।(৫) ইতিমধ্যে প্রাদেশিক লীগে আভ্যন্তরীণ বিবাদের কারণ লীগকে নির্বাচনযুদ্ধে জয়ী করার অন্যতম নায়ক কংগ্রেসি ভাবাপন্ন জমায়েৎ-উলেমার সৈয়দ আহম্মদ সহ আরও কিছু কর্মী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগকারীদের মধ্যে লীগের জনৈক বিধানসভা সদস্য হাফিজ মহম্মদ ইব্রাহিমও(৬) ছিলেন। সংযুক্ত প্রদেশে কংগ্রেস সেই মুসলমান বিধানসভা সদস্যকে নিজ দলে গ্রহণ করায় এইভাবে কংগ্রেসি শিবিরে দুইজন মুসলমান বিধানসভা সদস্য হয়ে যায়।
কংগ্রেস মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই সংযুক্ত প্রদেশের মুসলিম লীগ নেতৃত্ব আশা করে যে তাঁদের প্রতিনিধিও মন্ত্রীমণ্ডলে থাকবেন। যদিও ইতিমধ্যে বুন্দেলখণ্ডের এক মুসলিম আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস-লীগ বিবাদ বেশ জোর ধরেছে। যাই হোক, প্রদেশে নির্মায়মান কংগ্রেসী মন্ত্রীমণ্ডলে লীগ নিজের তরফ থেকে খলিকুজ্জমাঁ ছাড়াও প্রাদেশিক লীগের সভাপতি নবাব মহম্মদ ইসমাইল খাঁর নাম প্রস্তাব করে। গোপালের মতে “জিন্না নিজে অবশ্য কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন বা যাকে তিনি ‘যুক্তফ্রন্ট’ আখ্যা দিতেন, তার পক্ষে ছিলেন।” এ সম্বন্ধে আলোচনার জন্য কংগ্রেস পার্লামেন্টারি বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত সদস্য মৌলানা আজাদ গোবিন্দবল্লভ পন্থ সহ কংগ্রেস সভাপতি জওহরলালের কাছে গেলে তিনি কোয়ালিশনে তাঁর তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও দীর্ঘ আলোচনার অন্তে অবশেষে রাজী হন এই শর্তে যে “আমরা সংযুক্ত প্রদেশের মুসলিম লীগ দলকে কঠোর শর্ত দেব এবং তারা যদি তা ষোল আনা মেনে নেয় তাহলে তাদের ভিতর থেকে দুইজনকে মন্ত্রীমণ্ডলে নেব।…তবে আমরা তাদের নিজ মূল প্রতিষ্ঠান লীগের সঙ্গে সকল প্রকার সম্বন্ধ বিচ্ছেদের কথা বলিনি…আমরা আশা করেছিলাম যে সংযুক্ত প্রদেশের মুসলিম লীগ মূল প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক হয়ে যাবে…খলিক (খলিকুজ্জমাঁ) দুটি ছাড়া আর সব শর্তে রাজী হয়েছিল এবং এই দুটি হল—লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের অবলুপ্তি এবং উপনির্বাচনে পৃথক প্রার্থী না দেওয়া…খলিক বলেছিল যে ব্যক্তিগত ভাবে সে এতে রাজী কিন্তু এরকম করার অধিকার তার নেই। তবে সে এ কথাও জানিয়েছিল যে যে- কোনো দিনই এমনটা ঘটতে পারে।”(৭)
জিন্নার সম্মতি ব্যতিরেকেই(৮) খলিকুজ্জমাঁ আপোষের জন্য এতটা হাত বাড়িয়েছিলেন। লখনউ-এ তাঁর সঙ্গে আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মৌলানা আবার জওহরলালের কাছে গেলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে কিছু কিছু কংগ্রেস কর্মীদের চাপের জন্য (জওহরলালের স্বীকারোক্তি অনুসারে তাঁরা জাতীয়তাবাদী মুসলমান। সম্ভবত মন্ত্রীত্বের পদাভিলাষীও) জওহরলাল বলেন যে বাকি দুটি শর্তও আগাম মেনে না নিলে বোঝাপড়া হবে না। তাই স্বভাবতই আলোচনা ভেঙে গেল।
ঘটনার যে বিবরণ মৌলানা আজাদ দিয়েছেন তার সঙ্গে পূর্বোক্ত তথ্যের কিছু কিছু বিরোধ থাকলেও একটি মূল বিষয়ে ঐক্য আছে এবং তা হল এ ব্যাপারে জওহরলালজীর ভূমিকা। কিন্তু ড. গোপাল এর এক ভিন্ন বয়ান দিয়েছেন(৯) এবং তিনি জওহরলালকে তাঁর “হিরো” রূপে বর্ণনা করেছেন বলে এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যের বিচার করা দরকার। মৌলানার গ্রন্থের লিপিকার হুমায়ুন কবীর পুস্তকের পাণ্ডুলিপি জওহরলালজীকে দেখিয়েছিলেন এবং তিনি এক পত্রের মাধ্যমে তা কোনোরকম পরিবর্তন বিনাই প্রকাশ করার পরামর্শ দেন। এছাড়া লোকসভার এক বিতর্ক প্রসঙ্গে (২৩শে মার্চ ১৯৫৯) এই গ্রন্থের কোনো কোনো বক্তব্য স্মৃতি থেকে লিখিত বলে সঠিক নয়—এই মর্মে পরোক্ষভাবে বলা ছাড়া মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের এই ঘটনার বিবরণের কোনো রকম প্রকাশ্য প্রতিবাদ নেহরু করেননি। একে অবশ্য ডাঃ গোপাল তাঁর স্বভাবসুলভ ভদ্রতা বলে ব্যাখ্যা করেছেন। সদ্য পরলোকগত বিশিষ্ট সহকর্মীর প্রতি নিছক সৌজন্যবশত জওহরলাল মৌন থেকে এমন গুরুতর অপবাদের বোঝা নিজের ঘাড়ে নেবেন, একথা বিশ্বাস করা দুরূহ। যাই হোক সমঝোতা না হবার কারণ সম্বন্ধে ডাঃ গোপালের বক্তব্য: “…লীগের সঙ্গে যে কোনো রকমের কোয়ালিশনের তাৎপর্য কংগ্রেসের পক্ষে হিন্দু চারিত্রধর্ম (orientation) স্বীকার করে নেওয়া এবং সকল ভারতবাসীর পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকার বর্জন করা।” তাছাড়া, “জওহরলাল এ ব্যাপারে খুব উৎসাহীও ছিলেন না। কারণ কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলকে ভূমি সংস্কার ব্যবস্থা করতে হবে এবং এর পথে জমিদারি স্বার্থের প্রতিভূ লীগের সঙ্গে কোনো রকম চুক্তি করার জন্য বাধা আসুক এ তিনি চাইছিলেন না।”
একটু খতিয়ে দেখলেই পূর্বোক্ত যুক্তি দুটির অন্তঃসারশূন্যতা ধরা পড়বে। ইতিপূর্বে উল্লিখিত (পাদটীকা ৭) রাজেন্দ্রপ্রসাদকে লেখা চিঠিতে জওহরলাল লীগের দুজন মুসলমান মন্ত্রী নেবার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের রফি আহমদ কিদওয়াইকেও মন্ত্রীমণ্ডলে নেবার কথা জানিয়েছিলেন। সুতরাং কংগ্রেসকে কেবল হিন্দুদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কথা উঠতে পারে না। লীগ নেতৃত্ব জমিদারদের সমর্থক ছিল—এ যুক্তিতেও ধার নেই। কারণ সরকারি আশীর্বাদপ্রাপ্ত জমিদারদের এগ্রিকালচারালিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও লীগ জোট বেঁধেছিল এবং শুধু লীগের কর্মসূচীই কংগ্রেসের অনুকূল ছিল না, কংগ্রেসের সাধারণ কর্মীরা তো বটেই(১০) এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে জওহরলাল স্বয়ং লীগের প্রার্থীর অনুকূলে প্রচার করেছিলেন (রাজেন্দ্রপ্রসাদকে লিখিত জওহরলালের পূর্বোক্ত পত্র দ্রষ্টব্য)। এছাড়া ঐ সময়ে কংগ্রেসেও যে জমিদারসহ বিত্তবানদের প্রবল প্রভাব ছিল, একথা ড. গোপাল তাঁর নেহরু জীবনীতে স্বীকার করেছেন এবং এই কারণে কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডল জমিদারি উন্মূলন আইন ঐ সময়ে তো করতেই পারেনি, এ হয় স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পর। কিন্তু জমির সমান বা ন্যায়সঙ্গত পুনর্বণ্টন স্বাধীনতার এতবছর পরও সম্ভবপর হয়নি। অবিভক্ত বঙ্গে হক্ সাহেবের সঙ্গে কংগ্রেসের কোয়ালিশন বা এমনকি মন্ত্রীমণ্ডলের বাইরে থেকেও তাঁর মতো কৃষকদরদী নেতার মন্ত্রীসভাকে সমর্থন সম্ভব না হবার অন্যতম কারণ ছিল ঐ প্রদেশে কংগ্রেস-নেতৃত্বের ভূমির মধ্যসত্ত্বভোগী “ভদ্রলোক”দের চারিত্রধর্ম। কারণ হক্ সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টি ভাগচাষিদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের ঋণের বোঝা কমানোর জন্য ঋণ সালিশী বোর্ড ইত্যাদি গঠন করার যে কর্মসূচী নিয়েছিল তা স্বভাবত বহু কংগ্রেস নেতার স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। কংগ্রেস নেতৃত্বের এই মধ্যস্বত্ত্বভোগী চারিত্রধর্ম অন্যান্য অনেক প্রদেশেই ছিল।
সাজা কংগ্রেস নীতিগতভাবে কোয়ালিশনের বিরোধী ছিল—এ যুক্তিও ধোপে টেকে না। কারণ প্রথমে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে এবং তার কিছুদিন পর আসামে কংগ্রেস অন্য দল বা নির্দলীয়দের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। তবে সত্যের খাতিরে একথা স্বীকার করতে হবে যে এ ব্যাপারে একা জওহরলালকে দায়ী করা চলে না। রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাঁর আত্মকথায় বলেছেন যে, “ঐ সময়ে প্রদেশের প্রমুখ কংগ্রেসিরা এতে রাজী হলেন না।”(১১) তাঁদের মধ্যেই এতজন মন্ত্রীত্বের পদাকাঙ্ক্ষী থাকতে উমেদারের সংখ্যা আর বাড়ানো কেন? সেই সময়কার সংযুক্ত প্রদেশের একজন আদর্শবাদী ও চরিত্রবান কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, পরে যিনি দীর্ঘকাল প্রদেশের মন্ত্রীপদ অলঙ্কৃত করেন তিনি বর্তমান লেখকের প্রশ্নের উত্তরে যা লিখেছেন, তাতেও এই সত্যের সমর্থন পাওয়া যায়। তাঁর বক্তব্য: “নির্বাচনে কংগ্রেস প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল ! আর কংগ্রেসের স্বার্থপরায়ণতা বৃদ্ধি পেল। জওহরলালও ঐ প্রবাহে ভেসে গেলেন। অথবা বলা যায় যে কংগ্রেসের “অহং”- এর সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল তাঁর ভিতরেই। এই কারণে সে সময়ে মুসলমানদের উপেক্ষা করা হয়েছিল। আর তার দুষ্পরিণামও হল প্রবল। পাকিস্তানের জন্মের মূলে এই কারণ। দীর্ঘদিন যাবৎ আমার এই অভিমত পাকিস্তান সৃষ্টির মূল দায়িত্ব আমাদের—হিন্দু সম্প্রদায়ের। অর্থাৎ কংগ্রেসেরও।”(১২)
এ ব্যাপারে সব দায়িত্ব জওহরলালের উপর চাপিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে প্রচার করাও মৌলানার পক্ষে উচিত হয়নি। এই ব্যর্থ আলোচনা থেকে যা স্পষ্ট হয় তা হল পারস্পরিক বিশ্বাস এবং ক্ষমতা ভাগ করে ভোগ করার ইচ্ছার অভাব। নচেৎ জওহরলাল লীগকে “কঠোর শর্ত” দেবার কথা ভাবতেন না এবং খলিকুজ্জমাঁ এতটা এগোতে রাজী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সহযোগিতার হাত প্রত্যাখ্যান করা হত না। শুধু তাই নয়, মৌলানাও প্রাদেশিক লীগকে নিম্নোক্ত অবমাননাকর শর্ত দিতেন না:
“সংযুক্ত প্রদেশের বিধানসভায় মুসলিম লীগ দল এক স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসাবে কাজ করা থেকে বিরত থাকবে।
প্রাদেশিক বিধানসভার মুসলিম লীগ দলের বর্তমান সদস্যরা কংগ্রেস দলের অঙ্গীভূত হবেন। তাঁরা কংগ্রেস দলের নিয়ন্ত্রণ-শৃঙ্খলার অধীনে আসবেন।
এই সব সদস্য সহ বিধানসভার যাবতীয় কংগ্রেস সদস্য কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত নীতিসমূহ এবং বিধানসভার সদস্যদের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কংগ্রেসের ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংগঠনের নির্দেশাবলী বিশ্বস্ততা সহকারে পালন করবেন।
সংযুক্ত প্রদেশের মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের অবলুপ্তি সাধন করা হবে এবং তারপর কোনো উপনির্বাচনে উক্ত বোর্ড কর্তৃক কোনো প্রার্থী খাড়া করা হবে না। অতঃপর বিধানসভার কোনো আসন খালি হলে কংগ্রেস সেই আসনে যে প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে মুসলিম লীগ দলের সমস্ত সদস্য তাঁকে সক্রিয় ভাবে সমর্থন করবেন।”(১৩)
এর সঙ্গে সঙ্গে ষোল আনা দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মন্ত্রী হবার জন্য খলিকুজ্জমাঁকে কংগ্রেসের শপথ বাক্য লিখিত ভাবে স্বীকার করে দলের পুরোপুরি সদস্য হবার জন্য যে প্রস্তাব দেওয়া হল, তার পরিণাম যা হবার তা-ই হল। প্রাদেশিক লীগ নেতারা এই সব শর্তকে স্বহস্তে মৃত্যুপরোয়ানায় হস্তাক্ষর করা বা রাজনৈতিক হারাকিরী করা মনে করলেন এবং আলোচনা ভেঙে গেল। শুধু তাই নয়, এরপর নির্দলীয় ও লীগের পাঁচজন বিধানসভা সদস্যকে কংগ্রেসে গ্রহণ করায় ঐ প্রদেশে মুসলিম জনমতের সর্বাধিক প্রতিনিধি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান লীগ নেতৃবৃন্দের মনে কংগ্রেসের প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণা পুঞ্জীভূত হল। লীগ নেতৃত্বের মনে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগল যে সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম আসনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবার পর মন্ত্রীমণ্ডলে মুসলমান প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে এজাতীয় মনোভাব গ্রহণ করা কতটা নীতিসম্মত? আর দল ভাঙানোর এই খেলাই বা কতটা সুনীতিসঙ্গত? উত্তর প্রদেশের মতো অতটা নগ্নভাবে না হলেও বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রদেশেও কংগ্রেস লীগের বিধানসভা সদস্যদের মন্ত্রীমণ্ডলীতে গ্রহণ করার সহযোগিতার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করল। সুতরাং লীগ নেতাদের মনে এই ধারণা দৃঢ়মূল হওয়া আরম্ভ করল যে চিরকালের সংখ্যালঘু হবার জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে ভারতবর্ষে ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার সম্ভাবনা কোনো দিনই তাঁদের হবে না। ক্ষমতাপ্রাপ্তির ইচ্ছার জন্য লীগনেতৃত্বকে নিন্দা করা যায় না। কারণ ক্ষমতাপ্রাপ্তির জন্যই রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনও এক অর্থে ক্ষমতাধীশ ইংরেজকে বদলে ভারতীয়দের ক্ষমতাপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষার পরিণতি। আর গান্ধী-নেহরুর মতো অত প্রভাবশালী নেতাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ক্ষমতাপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষার জন্য গভর্নরদের প্রতিশ্রুতির জন্য অপেক্ষা না করেই কংগ্রেসের মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের উদাহরণ তো চোখের সামনেই ছিল।
লীগকে সমান মর্যাদা দিয়ে তার সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে অনিচ্ছার এই ঘটনাপ্রসঙ্গে ভারতের তদানীন্তন রাজনীতি সম্বন্ধে অভিজ্ঞ এবং কেন্দ্রীয় পরিষদে ইংরেজ গোষ্ঠীর নেতা স্যার পার্সিভ্যাল গ্রীফিথস পরে মন্তব্য করেন: “অপরাপর দলকে বাদ দেবার এই একদেশদর্শী নীতি গ্রহণের পূর্ণ অধিকার কংগ্রেস দলের ছিল এবং সে দল হয়তো একথা ভেবে থাকতে পারে যে তারা স্বাভাবিক পরিষদীয় পদ্ধতিরই অনুসরণ করছে। তবে সন্দেহাতীতভাবে ঐ পদক্ষেপ ছিল এক বিপজ্জনক কৌশলগত ভ্রান্তির পরিচায়ক। কংগ্রেস-লীগের কোয়ালিশনকে অস্বাভাবিক বা কার্যকরী করার অনুপযুক্ত মনে করার মতো সামাজিক বা আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে কোনোরকম উল্লেখযোগ্য মতবিরোধ ছিল না। তাই সঙ্গত অথবা অসঙ্গত—যে কারণেই হোক, মুসলমানদের তারপর মনে হল যে কংগ্রেস মূলতঃ হিন্দু প্রতিষ্ঠান বলেই কেবল তাঁদের মন্ত্রীপদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়।”(১৪)

১৬
পাদটীকা

১. ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের তেসরা এপ্রিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী মুসলিম লীগ এ সম্বন্ধে নিম্নোদ্ধৃত প্রস্তাব গ্রহণ করে: “…সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থা যে উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত আজ হয়েছিল তার পরিপূর্তি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এবং এ ব্যবস্থা সম্প্রদায় ও দেশের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক রূপে প্রতিপাদিত হয়েছে।… হিন্দু ও মুসলমান জনসাধারণ, যারা আজ সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের কারণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন তারা যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্বার্থে একত্র না হলে প্রত্যুত জনগণের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন অসম্ভব। পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা বাংলার জনসাধারণের জন্য শক্তি অথবা সমৃদ্ধি— জানি কোনো কিছুরই ব্যবস্থা করতে পারেনি এবং সেই কারণে জনগণ আজ স্বার্থপর ব্যক্তিদের দ্বারা তাদের স্বার্থসাধনের জন্য শোষিত হচ্ছে।”(রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২৪১ পৃষ্ঠা)। পরবর্তী বৎসরের ২৬শে নভেম্বরও বাংলার লীগ কর্তৃক অনুরূপ মর্মে এিক প্রস্তাব গৃহীত হয় ৷
২. কিন্তু বঙ্গীয় কংগ্রেসের নেতা শরৎচন্দ্র বসু ফজলুল হকের পরামর্শদাতা ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী নলিনীরঞ্জন সরকারের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে বিরূপ হবার জন্য কোয়ালিশনে রাজী না হওয়ায় শ্রীযুক্ত সরকার লীগের সঙ্গে কৃষক প্রজা পার্টির কোয়ালিশনের ব্যবস্থা করে দিয়ে ফজলুল হককে লীগের শিবিরে যুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গদেশে তা লীগের প্রভাব বৃদ্ধি এবং বঙ্গবিভাজনের পথ প্রশস্ত করেন। (দ্র. ড. শীলা সেন; Muslum Politics in Bengal 1937–47; ইমপেক্স ইন্ডিয়া, নূতন দিল্লি (১৯৭৬); পৃষ্ঠা ১৩। এ প্রসঙ্গে কালীপদ বিশ্বাসের যুক্তবাংলার শেষ অধ্যায়; ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, কলিকাতা (১৯৬৬); পৃষ্ঠা ৩২ ও ৩৬-৩৭ দ্রষ্টব্য।)
৩. খলিকুজ্জমার মতে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর ও ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতা গোবিন্দবল্লভ পন্থ প্রথমবার কিদওয়াই ও দ্বিতীয়বার মোহনলাল সাকসেনার সঙ্গে তাঁর বাড়িতে এসে মুসলিম ইউনিটি বোর্ডের সঙ্গে সহযোগিতায় প্রদেশের আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য অনুরোধ করেন। সমগ্রন্থ; পৃ. ১৪৩)। দীর্ঘকালের কংগ্রেস নেতা মুসলিম আসনে জেতার নির্বাচন কৌশল হিসাবে মুসলিম ইউনিটি বোর্ডের অন্যতম স্রষ্টা ঐ একই কারণে লীগের নামে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মনস্থ করায় সংযুক্ত প্রদেশে কংগ্রেস ও লীগ একটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এছাড়া কংগ্রেস পার্লামেন্টারি বোর্ডের বিশিষ্ট সদস্য মৌলানা আজাদ সহ আরও অনেকের বক্তব্যই এর সপক্ষে। পরোক্ষভাবে বললেও কংগ্রেসের সরকারি ইতিহাসকার জেরী। ড. সীতারামাইয়ার সাক্ষ্যও এর অনুকূলে। (দ্র. সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৮৯-৯০)।
৪. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২৪৫-২৪৭ পৃষ্ঠা।
৫. ড. সর্বপল্লী গোপাল; Jwaharlal Nehru – A Biography; প্রথম খণ্ড; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস; দিল্লি (১৯৮১); ২২৭ পৃষ্ঠা।
৬. হাফিজ সাহেবও পুরাতন কংগ্রেসি যিনি একই কৌশলগত কারণে অর্থাৎ মুসলমান আসনে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসাবে জয়ী হওয়া সহজ মনে করে লীগের হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন। রামগোপালের মতে তাঁকে মন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে লীগ ছাড়তে প্ররোচিত করা হয় যদিও পরে তিনি বিধানসভার সদস্যপদে ইস্তফা দিয়ে নিজের জনপ্রিয়তার জন্য কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে পুননির্বাচিত হন।
৭. রাজেন্দ্রপ্রসাদকে নেহেরু কর্তৃক ২১শে জুলাই ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে লিখিত পত্র; ড. গোপাল (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; অষ্টম খণ্ড। ১৬৯-৭০ পৃষ্ঠা।
৮. ড. সর্বপল্লী গোপালের মতে: “জিন্নার মনে এই আশঙ্কা জেগেছিল যে খলিকুজ্জমা হয়তো কোয়ালিশনের থেকেও এগিয়ে গিয়ে লীগকে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত করতে রাজী হয়ে যাবেন। তাই তিনি স্বয়ং লখনউ-এ উপনীত হয়ে পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখার ভিত্তিতে আলোচনা চালিয়ে যাবার অধিকার দেন।”(Jwaharlal Nehru; প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা ২২৭ পৃষ্ঠা)।
৯. সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড; ২২৩-২২৮ পৃষ্ঠা।
১০. Times of India দৈনিকের ১৮ই নভেম্বর ১৯৮৮ (দিল্লি সং) দ্বিতীয় অংশের পৃষ্ঠা ৩-এ তদানীন্তন কংগ্রেসের যুবক কর্মী শ্রীপরমানন্দের স্বীকৃতিমূলক পত্র প্রকাশিত হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের তদানীন্তন বিশিষ্ট কংগ্রেস কর্মী এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে লোকসভার কংগ্রেসি সদস্য আন্সার হারবানীর অনুরূপ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণের জন্য ঐ পত্রিকারই ২৫শে নভেম্বর, ১৯৮৮ (বোম্বাই সংস্করণ, দ্বিতীয় অংশের প্রথম পৃষ্ঠা) দ্রষ্টব্য।
১১. ৪৮১ পৃষ্ঠা।
১২. শ্রীগান্ধী আশ্রমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমানে তার মূল সংস্থার সম্পাদক শ্রীযুক্ত বিচিত্রনারায়ণ শর্মার ১৪ই জুলাই ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের পত্র।
১৩. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২৪৮ পৃষ্ঠা।
১৪. The British Impact on India; 1952; 380 পৃষ্ঠা। হেক্টর বলিথো কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১১৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।

জিন্নার প্রতিক্রিয়া— সাম্প্রদায়িক ভূমিকা
১৭

সাম্রাজ্যবাদীদের অন্যতম নীতি হচ্ছে শাসিতদের মধ্যে বিভেদের সুযোগ নেওয়া। সুতরাং এই গোলযোগে তারাই বা হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন কেন? ইংরেজ সরকার ভাল ভাবেই জানত যে ছোটলাটদের কাছ থেকে কংগ্রেস তাঁদের বিশেষ অধিকার প্রয়োগ না করার যে আশ্বাস চেয়েছে তার উদ্দেশ্য হল জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজকর্মে সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ না করার গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি। কিন্তু জল ঘোলা করার উদ্দেশ্যে এর বিরোধ প্রসঙ্গে এবং বিশেষ অধিকারের সপক্ষে ভারতসচিব জেটল্যান্ড বললেন, “মন্ত্রীমণ্ডলের দ্বারা সংখ্যালঘুদের স্কুলের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া স্পষ্টত কংগ্রেসের কর্মপদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কারণ এজাতীয় পদক্ষেপ আইনের পরিধির অন্তর্গত এবং আদৌ সংবিধানসঙ্গত কার্যকলাপ ছাড়া অপর কিছু আখ্যা দেওয়া চলতে পারে না। সুতরাং গভর্নরদের আর সংখ্যলাঘু স্বার্থরক্ষা করার উপায় থাকবে না। প্রত্যুতপক্ষে এজাতীয় কাজ করার সম্ভাবনা সংবিধানের পরিধির মধ্যে থেকে যাবে একথা উপলব্ধি করেই পার্লামেন্ট রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করেছে।”(১) বলাই বাহুল্য যাঁদের উত্তেজিত করার জন্য পূর্বোক্ত ধরনের প্ররোচনা তাঁরা তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন। কংগ্রেসের তরফ থেকে লীগের প্রতি অবিশ্বাস লীগের নেতাদের মনেও কংগ্রেসের প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দিল। ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবার ক্ষোভ ও আক্রোশ তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা বিদ্বেষে পরিণত হল। সাম্রাজ্যবাদী কৌশল সেই অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়ে লীগ-নেতৃত্ব এবং তাঁদের মাধ্যমে মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশের মনে এই ধারণার সৃষ্টি করতে সাহায্য করল যে কংগ্রেসের দাবির মূলে সংখ্যালঘুদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক—প্রত্যুত সর্বক্ষেত্রে উৎসাদনের অভিসন্ধি। আর তাঁদের এই সম্ভাব্য সঙ্কটে পরিত্রাতা হলেন ইংরেজ গভর্নরের দল ও তাঁদের বিশেষাধিকারসমূহ।
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইনেই অবিশ্বাস ও বিরোধের বীজ নিহিত ছিল। প্রাদেশিক—বিশেষ করে সংযুক্ত প্রদেশের মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের ব্যাপারে কংগ্রেসের “কৌশলগত ভ্রান্তি” অনুকূল পবনের কাজ করে এই ভুল বোঝাবুঝি ও বিরোধের আগুনকে লেলিহান করে তুলল। বিরোধের ক্ষেত্রকে দুই ভাগে ভাগ করে আমরা প্রথমে এর সাংবিধানিক দিকের কথা আলোচনা করব।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে এবং বিশেষ করে সংযুক্ত প্রদেশের মন্ত্রীমণ্ডলে লীগ প্রতিনিধিত্বের আশা পোষণ করেছিল কেবল নির্বাচন-পূর্ব সমঝোতার জন্য নয় সাংবিধানিক প্রাবধানের জন্যও বটে। এ বিষয়ে আইনের ধারা সংখ্যা ৫২(১) (খ)-তে বলা হয়েছিল যে, “নিজের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে গভর্নরের নিম্নোক্ত বিশেষ দায়িত্বসমূহ থাকবে এবং তা হল: সংখ্যালঘুদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা।” বলা বাহুল্য “সংখ্যালঘুদের ন্যায়- সঙ্গত স্বার্থ” কথাটির বিস্তারিত ব্যাখ্যার অভাবে ভুল বোঝাবুঝির যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। এর লীগ প্রচারিত ভাষ্য হল—১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইন অনুসারে মুসলিম জনপ্রতিনিধিদের ভিতর থেকে মুসলমান মন্ত্রী নিয়োগের অধিকার গভর্নরদের। যে যে হিন্দুপ্রধান প্রদেশে লীগ
পৃষ্ঠা: ১১২

যথেষ্ট সংখ্যক আসন পায় সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমান মন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে গভর্নরকে এবং লীগ সদস্যদের ভিতর থেকে।
মন্ত্রীদের নিয়োগের ব্যাপারে গভর্নরদেরকে প্রদত্ত নির্দেশের অষ্টম ধারায় বলা হয়: “আমাদের গভর্নর তাঁর মন্ত্রীমণ্ডল নিয়োগের সময় নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে তাঁর মন্ত্রীদের বাছাই করার জন্য সবিশেষ প্রয়াস করবেন। মন্ত্রীদের তিনি সেই ব্যক্তির পরামর্শে বাছাই করবেন (এতে বাস্তবে যতটা সম্ভবপর গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা থাকবেন) তাঁর বিচারে যিনি সম্মিলিত ভাবে আইনসভায় বিশ্বাস অর্জনে সর্বাধিক সমর্থ। তবে এইভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করার সময়ে সর্বদাই তিনি তাঁর মন্ত্রীদের ভিতর যৌথ দায়িত্বের মানসিকতা অভিবৃদ্ধির কথা স্মরণ রাখবেন।” অর্থাৎ এর উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ ধাঁচের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সরকার গঠন যার পরিণামে মন্ত্রীমণ্ডলীর যৌথ দায়িত্ব পালন করা সম্ভবপর হয়। এতদনুসারে গভর্নররা অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দল হিসাবে কংগ্রেসকে মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু এর ফলে কংগ্রেসের সামনে অপর একটি সমস্যা খাড়া হল। ক্ষমতালোভে বঞ্চিত ক্ষুব্ধ ও হতাশাপীড়িত লীগনেতৃত্ব তাঁদের স্বধর্মীদের এই কথা বলা শুরু করলেন যে দলীয় সরকারের কংগ্রেসের ব্যাখ্যা অনুসারে অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের বিধানসভায় শাসকগোষ্ঠীতে সর্বদাই হিন্দুরা থাকবেন আর বিরোধীগোষ্ঠীতে থাকবেন মুসলমানরা। আর এজাতীয় পরিস্থিতিতে বিরোধী অর্থাৎ মুসলমান সংখ্যালঘুরা কদাপি শাসকগোষ্ঠীতে পরিণত হবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না। তাহলে এদেশে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ কি? তাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতা পাবেন কিভাবে?
লীগ নেতৃত্ব গভর্নরদের প্রতি প্রদত্ত নির্দেশের দশম ধারার প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন যেখানে বলা হয়েছে ““আমাদের গভর্নর সংখ্যালঘুদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ সুরক্ষিত করার তাঁর বিশেষ দায়িত্বের ব্যাখ্যা এইভাবে করবেন যাতে সংখ্যাল্পতা অথবা শিক্ষা বা আর্থিক ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা কিংবা অপর কোনোবিধ কারণে যে সব জাতীয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিধানসভায় বিশেষ প্রতিনিধিত্বপ্রাপ্ত এবং যাঁরা যৌথ রাজনৈতিক কার্যকলাপের উপর নিজেদের কল্যাণসাধনের জন্য পূর্ণত নির্ভর করতে অসমর্থ, সামান্যত তাঁদের কোনো অসুবিধা না হয় কিংবা তাঁদের মনে আশঙ্কা, উপেক্ষা বা উৎপীড়নের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণের উদ্রেক না হয়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে নিছক ভিন্ন মত পোষণ করার জন্য কোনো গোষ্ঠী তাঁর সংরক্ষণের অধিকারী হবেন না।”
গভর্নররা মনে করলেন যে সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার তাঁদের বিশেষ দায়িত্ব কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তির দ্বারা পালিত হয়েছে। তাঁদের ভূমিকার সমর্থনে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইনের পূর্বসূরী জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির প্রতিবেদনের সেই অংশ (প্রথম খণ্ড, প্রথম অংশ পৃ. ১১) ছিল যাতে এজাতীয় পরিস্থিতির অনুমান করে বলা হয়েছিল, “ভারতবর্ষে…দল বলতে আমরা যা বুঝি তার অস্তিত্ব নেই এবং এমন কোনো উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক অভিমতের সংগঠন নেই যাকে গতিশীল আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। তার পরিবর্তে আমরা হিন্দু-মুসলমানদের যুগযুগের বিরোধিতার সম্মুখীন হই এবং এগুলি কেবল দুটি ধর্মমতের নয়, দুই ভিন্ন সভ্যতার প্রতিনিধি।” প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা ৬২-৬৩-তে বলা হয়েছিল: “তবে একথা স্মরণ রাখতে হবে যে ভবিষ্যতে প্রাদেশিক মন্ত্রীমণ্ডলীগুলির দুটি দিক থেকে অতীতের তুলনায় অধিকতর অসুবিধা দেখা দেবে। প্রথমত তারা আর সরকারি সদস্যদের উপর নির্ভর করতে পারবে না যার সম্বন্ধে সাইমন কমিশন বলেছে যে, আজকের আইনসভায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভার- অসাম্য হ্রাস করার পক্ষে এ সহায়ক এবং এর অস্তিত্বের ফলে মন্ত্রীদের স্বপদে বহাল থাকা অপেক্ষাকৃত কম সঙ্কটজনক হয়েছে।” দ্বিতীয়ত ইতিপূর্বেই আমরা যেমন উল্লেখ করেছি প্রতিটি মন্ত্রীমণ্ডল যৌগিক ধরনের (composite) হবে। আইনসভাগুলির প্রতিনিধিত্ব হবে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এবং গভর্নরকে তাঁকে দেওয়া নির্দেশ অনুসারে দেখতে হবে যে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা যেন যথাসম্ভব তাঁর মন্ত্রীমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত হন। এইভাবে গঠিত মন্ত্রীসভার লক্ষ্য হবে প্রতিনিধিত্বমূলক হওয়া—যদিও ইংলন্ডের ধরনে নয়। সেদেশে কোনো একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা এমনকি কোয়ালিশন দল দ্বারা এ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। এখানে এতদ্ব্যতিরেকে সংখ্যালঘুদের যোগদান দ্বারাও মন্ত্রীমণ্ডল প্রতিনিধিত্বমূলক হওয়া দরকার।”
পূর্বোক্ত সাংবিধানিক প্রাবধানের পরিপ্রেক্ষিতে অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডল গঠন এবং তৎপরবর্তী মুসলিম লীগের তীব্র প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে বিবেচনা করতে হবে।
কিন্তু কংগ্রেসও ছিল নিরুপায়। লীগের ভূমিকার সঙ্গে আপোষ করার অর্থ নিজের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়ে এতদিনের ইতিহাসকে অস্বীকার করা। কংগ্রেস তাই লীগের ভূমিকার বদলে মুসলমান জনসাধারণকে নিজের ধর্মনিরপেক্ষতার ভূমিকা বোঝাতে কংগ্রেস সভাপতি জওহরলালজীর উদ্যোগে “মুসলিম গণসংযোগের কর্মসূচী” গ্রহণ করল।
এই প্রসঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের তদানীন্তন রাজনৈতিক দলগুলির চারিত্রধর্ম সম্বন্ধে কিছুটা আলোচনা করা যেতে পারে। আমরা পূর্বেই দেখেছি যে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসের চরিত্র ছিল অভিজাত। এর কারণ বিভিন্ন সম্প্রদায় জাতি (caste) অথবা গোষ্ঠীতে যাঁরা নিজ নিজ বিশিষ্ট অবদানের জন্য নেতৃস্থানীয় হতেন, তাঁরাই কংগ্রেসেরও নেতা হতেন। খলিকুজ্জমার বিবরণে আমরা দেখেছি যে লীগের চরিত্রও একই ধরনের ছিল, তফাত ছিল কেবল এইটুকু যে ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষেত্র শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হিন্দু মহাসভা অথবা দেশের আর সব প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও ছিল একই ধরনের। যাই হোক, গান্ধী তাঁর গণমুখী অসহযোগ আন্দোলনের দ্বারা সর্বপ্রথম ভারতীয় রাজনীতির এই অভিজাত ধারার পরিবর্তন করে অন্তত স্থানীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বহুলাংশে সাধারণ মানুষের ভূমিকাকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পথ করে দেন। কিন্তু কংগ্রেস সহ তাবৎ রাজনৈতিক দলের নিখিল ভারতীয় নেতৃত্ব তো বটেই এমনকি প্রাদেশিক এবং জেলার নেতৃত্বও ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ এবং তার পরও বহুলাংশে অভিজাতই থেকে যায়।
কংগ্রেসের চরিত্রকে আরও গণমুখী করার জন্য গান্ধী ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে গঠনকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। সাধারণ মানুষদের মধ্যে তাদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে থেকে খাদি কুটির শিল্প প্রমুখ কর্মসূচীর দ্বারা তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করে এবং হরিজন নারীজাতি ও আদিবাসীদের প্রতি যে বৈষম্য চলছিল তা দূরীকরণের জন্য চেষ্টা করে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা জাগাবার দ্বারা গান্ধী একেবারে ভিত্তিভূমিতে এক গণ-নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রয়াস শুরু করে ভারতীয় রাজনীতিকে অভিজাত প্রভাবমুক্ত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু জওহরলাল সহ তখনকার কংগ্রেস নেতৃত্বের একটা বড় অংশের এই আদর্শের প্রতি ঔদাসীন্য ও উপেক্ষার ফলে (কারণ তাঁরা নিজেরাই ঐ অভিজাত রাজনীতির সৃষ্টি) গান্ধীর এ প্রয়াস তেমন ব্যাপক বা ফলবতী হয়নি। এছাড়া এজাতীয় জীবন-সাধনা অভিজাত বা আন্দোলনমূলক রাজনীতির মতো অত সহজও নয়। পরবর্তীকালে তাই কংগ্রেসের অভিজাত রাজনীতির শোচনীয় পরিণাম ক্ষমতায় দ্বন্দ্ব ও দুর্নীতি দেখে গান্ধীকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে কংগ্রেসকে ভেঙে দিয়ে গণমুখী রাজনীতির (বিনোবার মতে লোকনীতি) বাহন লোকসেবক সঙ্ঘ গড়ার পরিকল্পনা রচনা করতে হয়। অবশ্য আকস্মিক মৃত্যুর জন্য পরিকল্পনা রচনা ছাড়া এ ব্যাপারে আর কিছুই তিনি করে যেতে পারেননি। যাইহোক, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জওহরলাল লীগের রাজনীতির দুর্বলতা—তার অভিজাত চারিত্রধর্ম সম্বন্ধে সচেতন হয়ে গণসমর্থনের জন্য গণসংযোগের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন—এ তাঁর দূরদৃষ্টিরই পরিচায়ক। কিন্তু স্বয়ং অভিজাত রাজনীতিধর্মী হবার জন্য তিনি রাজনীতিকে গণমুখী করার উদ্দেশ্যে প্রারব্ধ গান্ধীর গঠনমূলক কর্মসূচীর তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেননি। তাই তাঁর কর্মসূচী গান্ধীর মতো কোনো প্রত্যক্ষ আর্থিক বা সামাজিক প্রশ্নের সমাধানের প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে কেবল প্রচার ও বক্তৃতা ইত্যাদিতেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং নেহরুর এই প্রয়াসের ব্যর্থতার কারণও এইখানে।
তবু কংগ্রেসের মুসলিম গণসংযোগের কর্মসূচীতে লীগনেতৃত্ব আতঙ্কিত হল এই কথা ভেবে যে এর মাধ্যমে তাঁদের প্রভাবের একমেব আধারকেই নষ্ট করে দেবার “ষড়যন্ত্র” হচ্ছে। তাঁরা তাই ভীষণভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। লীগের ভিতর কট্টর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অস্তিত্ব তো বরাবর ছিলই এবং জিন্না প্রমুখ অপেক্ষাকৃত মডারেটদের অনেক দিন ধরে তাদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হয়েছে। ইতিমধ্যে অপর একটি ব্যাপার ঘটেছে। মৌলানার উদ্যোগে আহুত এলাহাবাদের ১৭ই মে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের উলেমা সম্মেলন লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে নিঃশর্তে কংগ্রেসে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় লীগ- নেতৃত্বের মনে তাঁর নিজস্ব ক্ষমতার আধার-ভূমির অবক্ষয়ের আশঙ্কা জাগার সঙ্গে সঙ্গে লীগকে বেশি করে কট্টরপন্থীদের হাতে তুলে দেবার কারণ হয়েছে। স্বভাবতই জিন্না আজাদের এই কার্যকে কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারেননি। অতঃপর সেই কট্টর গোঁড়া ও প্রাচীনপন্থীরা কংগ্রেসবিরোধী জেহাদে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন। “ইসলাম বিপন্ন”—এই হল তাঁদের ধুয়ো এবং এইটাই হল মন্ত্রীমণ্ডল গঠনোত্তর বিরোধের দ্বিতীয় বা প্রচারযুদ্ধের দিক।
একথা ঐতিহাসিক তথ্য যে জওহরলাল এবং তাঁর মতো দু-চারজন উদার গণতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন নেতা ছাড়া কংগ্রেসের আর কেউ নিজ প্রতিষ্ঠানের মুসলিম গণসংযোগের কর্মসূচীর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেননি। জওহরলালজীও সংগঠক ছিলেন না বলে এই কর্মসূচী উপস্থাপিত করা এবং এর সপক্ষে ভাসা-ভাসা ধরনের আবেগমূলক কিছু বক্তৃতা ও বিবৃতি দেওয়া ছাড়া বিধিবদ্ধ ভাবে এর রূপায়ণের জন্য আর কিছু করতে না পারায় এ কর্মসূচী নিছক স্লোগান ও প্রচারের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। প্রবল ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও মুসলিম গণসংযোগের যেটুকু রাজনৈতিক কর্মসূচী কংগ্রেস আরম্ভ করেছিল, লীগের সর্বাত্মক
পৃষ্ঠা: ১১৫

আক্রমণের ফলে অত্যল্প কালের মধ্যেই তা সমাপ্ত হয়ে গেল। কারণ ভয়, আশঙ্কা, ঈর্ষা প্রমুখ মানুষের নিম্নতর পর্যায়ের স্ব-ভাবের প্রতি আবেদন অন্তত প্রারম্ভিক পর্যায়ে চিরকালই তার মহত্তর স্ব-ভাবের প্রতি আবেদনের তুলনায় ত্বরিৎ ও ব্যাপক ফলপ্রসূ হয়ে থাকে।
প্রচারযুদ্ধরূপী লীগের আক্রমণ হল দ্বিমুখী। প্রথমত মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে “বিপন্ন ইসলাম”কে রক্ষা করার জন্য একটা জেহাদী মানসিকতা সৃষ্টি এবং দ্বিতীয়ত লীগের ছত্রছায়াতলে মুসলিম-শক্তিকে সংহত করার প্রয়াস। জেহাদ মনোবৃত্তি গড়ে তোলার ভূমিকা সম্বন্ধে সংযুক্ত প্রদেশের লীগ পরিষদ দলের নেতা খলিকুজ্জমার জবানবন্দী উল্লেখনীয় “কৌশলের দিক থেকে আমি এই কথা ভাবলাম যে বিধানসভায় কংগ্রেসের সরাসরি বিরোধিতার দ্বারা আমরা কেবল মুসলিম লীগেই নবপ্রাণ সঞ্চার করতে সমর্থ হব না, মুসলিম জনসাধারণের মধ্যেও নবোদ্দীপনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হব। কারণ ইতিমধ্যেই তাঁরা অতীব অধীর ও চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন এবং তাই আমাদের কংগ্রেস-রাজনীতির বিরোধিতা গণমনকে মুসলিম লীগকেন্দ্রিক করার সূত্রপাত করবে। কারণ তাঁরাও শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, উভয় সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্বন্ধের ক্ষেত্রেও যেসব পরিবর্তন ঘটছিল তা লক্ষ করছিলেন।”(২) স্থানান্তরে তিনি বলেছেন, “… বিধানসভার মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেল এবং কোনো বিল বা মোশানকেই বিনা বিরোধিতায় স্বীকার করা হত না। মুলতুবী প্রস্তাব একটা প্রথা হয়ে দাঁড়াল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা পরাজিত হতাম। কিন্তু এই লড়াই আমাদের দুর্বল করার পরিবর্তে বিধানসভার মধ্যে আমার সহকর্মীদের মধ্যে নূতন প্রাণ সঞ্চার করত এবং বিধানসভার বাইরে মুসলমান সম্প্রদায়ের মনোবলকেও প্রভাবিত করত।”(৩)
কে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিধানসভার বিতর্ক ছাড়াও উত্তর প্রদেশের কয়েকটি উপনির্বাচন মুসলিম-মানসে এই দুয়োরানির পুত্রসুলভ মানসিকতাসঞ্জাত জঙ্গী-বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রসারে সহায়ক হয়েছিল। মন্ত্রীমণ্ডল গঠনের পূর্বে বুন্দেলখণ্ডের উপনির্বাচনে লীগপ্রার্থীর সপক্ষে আল্লা ও কোরানের দোহাইযুক্ত উর্দু ইস্তাহার বিলি করা হয়েছিল এবং এতে এমনকি জিন্নার নামও যুক্ত করা হয়েছিল। অবশ্য জওহরলালের চিঠির উত্তরে জিন্না জানিয়েছিলেন যে তাঁর অজ্ঞাতসারে এবং সম্মতি ব্যতিরেকে তাঁর নাম ঐ ইস্তাহারে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ঐ নির্বাচনে মুসলিম ভোট পাবার জন্য মোল্লা-মৌলভীদেরও কাজে লাগানো হয়।(৪) কিন্তু বিজনোর উপনির্বাচনের সময় লীগের সাম্প্রদায়িকতাবাদী প্রচার তুঙ্গে উঠছিল।(৫) ইসলাম বিপন্ন, কংগ্রেস ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর, কংগ্রেসি রাজত্বে আল্লার বদলে গান্ধীর সামনে প্রণতি করতে হবে, কংগ্রেস উর্দু ভাষা ও তার লিপির লোপ করবে, তাজিয়া ও গো-কোরবানী বন্ধ হয়ে যাবে এবং সবাইকে পাজামার বদলে ধুতি পরতে বাধ্য করা হবে ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবর্ধনকারী অপপ্রচার হতে থাকে। এর সঙ্গে আগে পরে যুক্ত হয় জাতীয় পতাকা (গোড়ায় কংগ্রেস দলের হলেও ক্রমশ ঐতিহাসিক কারণে জনমানসে জাতীয় পতাকার মর্যাদা পায়), বিধানসভায় বন্দেমাতরম্ সঙ্গীত।(৬) কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলসমূহ কর্তৃক সরকারি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানের প্রোৎসাহন(৭) দিয়ে মুসলিম সংস্কৃতিকে খর্ব করা এবং এমনকি কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডল কর্তৃক প্রবর্তিত গান্ধীজীর বৃত্তি মূলক বুনিয়াদী শিক্ষা, বিদ্যামন্দির (পৌত্তলিকতার প্রভাবযুক্ত অভিযোগে) নামে সরকারি বিদ্যালয় স্থাপন এবং আরও কিছু কিছু কর্মসুচীকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসকে হিন্দু-প্রতিষ্ঠান নাম দিয়ে তার বিরোধ। আদর্শ শাসন-ব্যবস্থাকে গান্ধী কর্তৃক “রামরাজ্য” আখ্যা দেওয়াও মুসলমানের মধ্যে কম বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ হয়নি। কংগ্রেসের জনৈক মুসলমান নেতা ঐ সময়ে রেলগাড়িতে সফরকালীন এক লীগ কর্মী দ্বারা ছুরিকাহত হলেও কোনো দায়িত্বশীল লীগ-নেতা তার প্রকাশ্য নিন্দা পর্যন্ত করেননি। সংক্ষেপে সংযুক্ত প্রদেশের রজনীতিকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও লীগ একরকম প্রকাশ্য যুদ্ধের পথ গ্রহণ করে।
কিঞ্চিৎ বিলম্বে হলেও কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল লীগের সঙ্গে এই বিবাদ মিটিয়ে ফেলার জন্য নবাব মহম্মদ ইসমাইল খাঁ ছাড়াও জিন্নার সঙ্গে প্রথমে সংবাদপত্রের বিবৃতির মাধ্যমে এবং তারপর প্রত্যক্ষ পত্রযোগে বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে জিন্না আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে এমন এক অনমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, যা অতঃপর প্রায় তাঁর স্বভাবের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সঠিক কি অভিযোগ জওহরলালের চিঠির উত্তরে জিন্না খুলে না লিখে বলবেন যে তা সর্বজনবিদিত। আর সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাঁর উক্তি থেকে কিছু উদ্ধৃত করে সেইটাই তাঁর অভিযোগ কি না জানতে চাইলে তিনি বলবেন যে তাঁর বক্তব্য যথাযথভাবে উদ্ধৃত হয়নি অথবা তার অপলাপ করা হয়েছে। জিন্না নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ আলোচনার বিরোধী নন। কিন্তু মতভেদের কোন্ কোন্ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা দরকার তা খুলে লিখবেন না—বলবেন এসব চিঠিতে লেখার বিষয় নয়। জওহরলাল-জিন্নার পত্রালাপে দেখা যায় যে জিন্নার এই অদ্ভুত নেতিবাচক ভূমিকার জন্য একটা সমাধানে উপনীত হতে উৎসুক জওহরলালের শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। অবশেষে হতাশ হয়ে আহমেদাবাদের মুসলমানদের এক সভায় (১৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৩৭) নেহরু ঘোষণা করলেন যে মুসলিম লীগের অস্তিত্ব মাত্র কয়েকটি প্রদেশে এবং “তাও উচ্চ বর্ণের কিছুসংখ্যক মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।” সুতরাং ঐ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কংগ্রেসের কোনোরকম বোঝাপড়া সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য জিন্নার তরফ থেকে এর কঠোরতর প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। তবে সেই প্রসঙ্গে যাবার পূর্বে আর দুটি বিষয়ের উল্লেখ করে নেওয়া দরকার।
প্রথমটি হল রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে জিন্নার নূতন ধারা, অতঃপর যার প্রবল প্রভাব ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হবে। এ সম্বন্ধে তাঁর এক আধুনিক জীবনীকার মন্তব্য করেছেন: “ঘড়ির দোলকধর্মী আলাপ-আলোচনায় তিনি চরম কুশলী ছিলেন। জিন্না প্রথমে কোনো বিরুদ্ধবাদীর দুর্বল দিকগুলি খুঁজে বার করতেন এবং তারপরই অপর প্রতিপক্ষের অসুরক্ষিত দিকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এ প্রক্রিয়ায় ভূতপূর্ব শত্রু’কে নিজের ক্ষেত্রে নিয়ে আসার জন্য সর্বদাই তিনি নিজ ভূমিকার পরিবর্তন করতেন। এতে আশ্চর্যের কি আছে যে উভয়পক্ষই তাঁকে অবিশ্বাস করবেন। তবুও উভয়পক্ষ তাঁর শক্তিকে খাটো করে দেখতেন এবং এই প্রক্রিয়ায় একথা উপলব্ধি করতে পারতেন না যে তিনি প্রত্যুত তাঁর মক্কেলদের জন্য ব্রিটিশ ও কংগ্রেস প্রতি পদক্ষেপে যেসব সাংবিধানিক সুযোগ-সুবিধা দিতে ইচ্ছুক, তা আদায় করে নেবার অত্যন্ত কুশলী ব্যবহারজীবী। যখনই কোনো পক্ষ মনে করত যে এবারে তাঁকে বেশ বাগে পাওয়া গেছে, জিন্না একবার ঘুরপাক খেয়ে অবলীলাক্রমে তার আয়ত্তের বাইরে চলে যেতেন।”(৮)
দ্বিতীয় বিষয়টি হল মধ্যস্থ হবার জন্য গান্ধীর প্রতি তাঁর স্বতঃপ্রবৃত্ত অনুরোধ। এর মূলে সম্ভবত জওহরলালের প্রতি তাঁর তীব্র বিরূপতা। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে বোম্বাই প্রেসিডেন্সীর কংগ্রেস পরিষদ দলের নেতা এবং হবু প্রধানমন্ত্রী বালাজী খের জিন্নার সঙ্গে দেখা করেন। ঐ প্রদেশের বিধানসভায় কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না। খেরের উদ্দেশ্য ছিল বিধানসভার ২০ জন লীগ সদস্যের সমর্থনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া এবং লীগের দুইজন সদস্যকে নিজ মন্ত্রীমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত করা। তাঁর মাধ্যমে জিন্না ওয়ার্ধার আশ্রমে গঠনকর্মে আত্মনিয়োগকারী মহাত্মাকে একটি “বিশেষ গোপন বার্তা” জানালেন। গান্ধী ২২শে মে জবাব দিলেন:
“খের আমাকে আপনার বার্তা জানিয়েছেন। কিছু করার ইচ্ছা আমার খুবই; কিন্তু আমি একান্ত ভাবেই অসহায়। ঐক্যে (হিন্দু মুসলিম) আমার বিশ্বাস চিরকালের মতোই প্রবল। কেবল নীরন্ধ্র অন্ধকারের মধ্যে আমি দিবালোকের কোনো আভাসই দেখতে পাচ্ছি না। এই দুঃখজনক স্থিতিতে আমি ঈশ্বরের কাছে আলোর জন্য উচ্চ কণ্ঠে প্রার্থনা জানাচ্ছি।”(৯)
সংক্ষিপ্ত এই চিঠিটির বক্তব্য কয়েক মাস পরে দুই নেতার পত্রালোচনায় যথেষ্ট গুরুত্ব পায় বলে এর সম্বন্ধে আরও কিছু আলোচনা বাঞ্ছনীয়। চিঠিটিতে মর্মস্পর্শী হতাশার ছাপ স্পষ্ট যা গান্ধীর স্বভাবসঙ্গত নয়। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সম্ভাবনা সম্বন্ধে তিনি নিরাশ হননি, একথা চিঠিতেই স্পষ্ট। তবে কেন তিনি আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন না, যার জন্য জিন্না কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়েও কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার ব্যাপারে তিনি নিজেকে অসমর্থ জ্ঞান করলেন? বাধা কি ভিতর থেকে—তাঁর আপনজনদের কাছ থেকে? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর আরও গবেষণাসাপেক্ষ। কারণ, এই পত্রের পটভূমিকা সম্বন্ধে টেন্ডুলকর এবং গান্ধীর সম্পূর্ণ রচনাবলীর সম্পাদকেরা মৌন। অনুরূপভাবে অপর একটি ঘটনার উপরও আলোকপাত হওয়া প্রয়োজন এবং তা হল মৌলানার দেওয়া এই তথ্য যে সংযুক্ত প্রদেশে মুসলিম লীগকে মন্ত্রীসভায় না নেবার ভুল সংশোধন করার জন্য হস্তক্ষেপ করতে তাঁর অনুরোধে গান্ধী প্রথমে সম্মত হলেও পরে জওহরলালের প্রভাবে মত পরিবর্তন করেন।(১০)
তবে পরবর্তীকালে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৩৭) এরকম আভ্যন্তরীণ বাধার প্রমাণ মেলে। ২৫শে সেপ্টেম্বর জিন্নার ব্যক্তিগত বন্ধু ও তদানীন্তন কংগ্রেস নেতা দেওয়ান চমনলাল এবং অপর একজন কংগ্রেস নেতা রায়জাদা হংসরাজ গান্ধীকে এক পত্রে লেখেন যে জিন্না “সাম্প্রদায়িক সমস্যা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্বন্ধে কেবল আলোচনা করতেই প্রস্তুত নন, একটা বোঝাপড়াতেও উপনীত হতে ইচ্ছুক।” পত্রের নকল কংগ্রেস সভাপতি জওহরলালকে ২৮শে সেপ্টেম্বর পাঠিয়ে তিনি গান্ধীকে উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। চমনলালের পত্রে অসন্তুষ্ট নেহরু গান্ধীকে ৩০শে সেপ্টেম্বর লেখেন যে, “..এই সময়ে আপনার ও জিন্নার মধ্যে একটি সাক্ষাৎকার কেবল নিরর্থকই হবে না, ক্ষতিকারকও হতে পারে।”(১১) ‘গান্ধী বল্লভভাইকে অক্টোবরের প্রথম পক্ষে লিখিত এক পত্রে জানান, “বর্তমানে জিন্নার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। জওহরলাল এটা চায় না।”(১২) তাঁর “বিশেষ গোপন বার্তায়” গান্ধীর সাড়া না দেওয়া জিন্নার মতো আত্মম্ভরী ব্যক্তির পক্ষে যে প্রীতিপদ হয়নি, এ আমরা যথাসময়ে দেখতে পাব।
মুসলিম লীগের ছত্রছায়াতলে মুসলিম-শক্তিকে সংহত করার প্রয়াসের যে দ্বিমুখী প্রচারযুদ্ধের প্রতি ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তার অন্যতম শক্তিশালী নিদর্শন বঙ্গের কংগ্রেস-নেতাদের ভুলে ঐ প্রদেশের জনপ্রিয় নেতা ফজলুল হক্কে একরকম জোর করে লীগের শিবিরে ঠেলে দেবার কাহিনী ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। নির্বাচনের পর জিন্না ভারতবর্ষের নানা প্রদেশে ঘুরে খিলাফতের পর দ্বিতীয়বার মুসলিম নবজাগরণের নেতারূপে স্থান করে নেবার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় মুসলমান নেতাদের লীগের পতাকাতলে সমবেত করতে লাগলেন। তাঁর মূল বক্তব্য— যৎকিঞ্চিৎ ক্ষমতা পেয়েই যদি কংগ্রেস মুসলমানদের প্রতিনিধিস্থানীয় প্রতিষ্ঠান লীগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে ভোগ না করে এক হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এইভাবে কাজ করছে, তাহলে ইংরেজ চলে গেলে কি হবে? মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র, ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য তাই সবার মুখে যেন সম্মিলিত স্লোগান উঠল—লীগের লখনউ অধিবেশনে চলো।
লখনউ-এ ১৪ই অক্টোবর লীগের বাৎসরিক অধিবেশনে ভারতবর্ষের প্রায় সব প্রদেশ থেকে যে ৫০০০ প্রতিনিধি একত্র হয়েছিলেন, তার মধ্যে নির্বাচনের পূর্বে লীগের পতাকাতলে সমবেত নেতৃবৃন্দ ছাড়াও ছিলেন লীগের পরলোকগত বিখ্যাত নেতা স্যার শফীর জামাতা মিঞা বশীর আহমদ এবং সর্বোপরি পাঞ্জাব ও বঙ্গের প্রধান মন্ত্রীদ্বয়- স্যার সেকেন্দর হায়াৎ খাঁ এবং ফজলুল হক্।(১৩) লখনউ-এর ঐ অধিবেশনে স্যার সেকেন্দর ও তাঁর ইউনিয়নিস্ট পার্টিকে উদার শর্তে (স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখা সত্ত্বেও) লীগে গ্রহণ করে বর্তমান পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অঙ্গ পাঞ্জাবে লীগের দুর্গ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করা হয়। হক্ সাহেবের মাধ্যমে(১৪) পূর্ব ভারতের অপর মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ বঙ্গেও জিন্নার প্রভাব বিস্তৃত হয়। অনুরূপভাবে সাময়িকভাবে হলেও আসামের প্রধানমন্ত্রী স্যার সাদুল্লার মাধ্যমে ঐ প্রদেশ লীগের প্রভাবে আসে। সম্মেলনে একদিকে কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলের প্রতি মুসলমানদের ধিক্কার এবং অপর দিকে মুসলিম-সংহতির নিদর্শন জিন্না ও লীগকে যুযুধান ভূমিকা নিতে অনুপ্রাণিত করে। সভাপতির বক্তৃতা প্রসঙ্গে ১৫ই অক্টোবর জিন্না বলেন:
“কংগ্রেসের বর্তমান নেতৃত্ব—বিশেষ করে বিগত দশ বছরে—একান্তভাবে হিন্দু নীতি অনুসরণ করার ফলে ভারতবর্ষের মুসলমানদের ক্রমশ অধিকাধিক মাত্রায় বিচ্ছিন্নতাবাদের শিকারে পরিণত করার জন্য দায়ী। আর যখন থেকে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে ছয়টি প্রদেশে মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করেছেন, নিজেদের উক্তি, কার্য ও কর্মসূচীর দ্বারা উত্তরোত্তর এই কথা প্রমাণ করেছেন যে তাঁদের হাতে মুসলমানরা কোনো ন্যায়বিচার আশা করতে পারে না।…আমি জোর দিয়ে একথা বলতে চাই যে কংগ্রেস দলের বর্তমান নীতির পরিণম হবে শ্রেণীবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ এবং তার পরিণামে সাম্রাজ্যবাদীদের কর্তৃত্ব বুদ্ধি।”(১৫)
আদর্শ নেতার মতো প্রতিনিধিদের উদ্দীপ্ত করার উদ্দেশ্যে ত্যাগ তপস্যা ও তিতিক্ষার আবেদন জানিয়ে তাঁদের সংগ্রামী বৃত্তি গড়ে তোলার জন্য অতঃপর জিন্না বললেন: “নিজেদের সংগঠিত করুন, আপন সংহতি ও সম্পূর্ণ ঐক্য প্রতিষ্ঠা করুন। প্রশিক্ষিত এবং সুশৃঙ্খল সৈন্যদের মতো নিজেদের গড়ে তুলুন।… শ্রম, কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মত্যাগ ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহ কিছু পাবার যোগ্যতা অর্জন করে না। এমন অনেক শক্তি আছে যা আপনাদের ভয় দেখাবে, আতঙ্কিত করবে, আপনাদের উপর চাপ দেবার চেষ্টা করবে। এসবের জন্য আপনাদের হয়তো দুর্ভোগও ভোগ করতে হতে পারে। কিন্তু এইসব অত্যাচার-উৎপীড়নের অগ্নিপরীক্ষার ভিতর দিয়ে চলেই…এইসব অসুবিধা, কষ্ট এবং নিগ্রহের সম্মুখীন হয়ে তার প্রতিরোধ ও জয়ের মাধ্যমে, আপনাদের যথার্থ বিশ্বাস ও আনুগত্য বজায় রেখে একটি জাতির আবির্ভাব হবে। সেই জাতি হবে তার অতীত গৌরব ও ইতিহাসের উপযুক্ত এবং কেবল ভারতেই নয় বিশ্বের পটভূমিকায় নিজেদের ভবিষ্যৎ ইতিহাসকে মহত্তর ও অধিকতর গৌরবমণ্ডিত করার জন্য বেঁচে থাকবে। ভারতবর্ষের আট কোটি মুসলমানের ভীত হবার কিছু নেই।”(১৬)
লখনউ-এ জঙ্গী সাম্প্রদায়িক মুসলিম নেতারূপে জিন্নার যেন পুনর্জন্ম হল। খলিকুজ্জমাঁ স্বীকার করেছিলেন যে লীগের অধিবেশনের প্রথম দিনের বক্তৃতায় ঐজাতীয় জঙ্গী সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হয়। জিন্নার ঐ বক্তৃতায় দ্বিজাতি তত্ত্বের আভাসও স্পষ্ট। লখনউ-এ লীগ গভর্নরদের কংগ্রেসের ইচ্ছামতো মন্ত্রীসভা গড়তে দিয়ে সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার তাঁদের বিশেষ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য তাঁদের নিন্দা করার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, ‘অখিল ভারত মুসলিম লীগের উদ্দেশ্য হবে ভারতবর্ষে স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাজ্যসমূহের ফেডারেশনের ভিত্তিতে পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যেখানকার সংবিধানে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বার্থ যথাযথ ও কার্যকরীভাবে সংরক্ষিত হবে।”(১৭) তখনও লীগ ভারত ব্যবচ্ছেদের দাবি জানাচ্ছে না, চাইছে সংখ্যালঘুদের জন্য রক্ষাকবচ। ভারতবিভাগের সপক্ষে প্রকাশ্যে ঘোষণা করার জন্য লীগ- নেতৃত্বকে আরও আড়াই বছর সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

১৭
পাদটীকা

১. রাজেন্দ্রপ্রসাদ কর্তৃক সমগ্রন্থের ১৪৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ১৩৬-৬৪ পৃষ্ঠা।
৩. সমগ্রন্থ; ১৬৮ পৃষ্ঠা।
৪. এ ব্যাপারে কংগ্রেসের হাতও কালিমামুক্ত ছিল না। এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস প্রার্থী শেরওয়ানীকে লেখা জওহরলালের ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের তেসরা জুলাই-এর পত্র দ্রষ্টব্য। ড. গোপাল (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; অষ্টম খণ্ড; ১৪৮-৪৯ পৃষ্ঠা।
৫. কংগ্রেসও যে এ দোষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল তা বলা যায় না। প্রাদেশিক লীগের সভাপতি নবাব মহম্মদ ইসমাইল খাঁকে লিখিত ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ডিসেম্বরের চিঠিতে (ড. গোপাল সম্পাদিত; সমগ্রন্থ; অষ্টম খণ্ড; ২০১-২০২ পৃষ্ঠা) কংগ্রেস সমর্থক অহর ও মৌলভীরা এরকম করছেন, একথা জওহরলাল স্বীকার করেছেন।
৬. বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে যে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় এ গান গাওয়া হয়েছে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে একে মুসলিম-বিদ্বেষী বলা অযৌক্তিক হলেও গানটিকে যে পৌত্তলিকতায় অবিশ্বাসীদের গ্রহণ করা কঠিন একথা সত্য। এর জন্য সব দিক থেকে বিচার করে স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু ঐতিহাসিক স্মৃতি ও আবেগবিজড়িত এই গানটির মাত্র প্রথম দুই স্তবককে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সঙ্গত কারণেই তার ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে অক্টাবর থেকে ১লা নভেম্বরের সভায় কংগ্রেসের সভা-সমিতিতে গাইবার স্বীকৃতি দেয়। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখযোগ্য যে স্বাধীনতার পর সামরিক বাহিনীর ব্যান্ডে বাজানোর অনুপযুক্ত এই অজুহাতে প্রধানত জওহরলাল এবং অন্যান্য কংগ্রস নেতাদের উদ্যোগে বন্দেমাতরম্ গানকে জাতীয় সঙ্গীত রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
৭. . দুর্ভাগ্যগ্রমে তাবৎ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পক্ষে পীড়াদায়ক সরকারি অনুষ্ঠানে এইসব প্রথা ভারতবর্ষকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা সত্ত্বেও এদেশ থেকে অদ্যাবধি সম্পূর্ণরূপে লোপ করা সম্ভব হয়নি।
৮. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১৪১ পৃষ্ঠা।
৯. CWMG ; ৬৫ খণ্ড; ২৩১ পৃষ্ঠা।
১০. আজাদ; সমগ্রন্থ; (১৯৮৮ সং) ১৭২ পৃষ্ঠা।
১১. ডঃ গোপাল (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; অষ্টম খণ্ড; ১৮২ পৃষ্ঠা।
১২. CWMG ৬৬ খণ্ড; ২১২ পৃষ্ঠা।
১৩. নিজের কৃষক প্রজা দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং বঙ্গীয় বিধানসভায় ও তার বাইরে কংগ্রেস নেতাদের দ্বারা হক্ সাহেবের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিরূপ প্রচারের জন্য নিজ রানার মন্ত্রীমণ্ডলীর অস্তিত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে তাঁকে ইতিমধ্যে সম্পূর্ণভাবে লীগের শরণাগত হতে হয়েছে। লীগের লখনউ-এর প্রকাশ্য অধিবেশনে প্রতিনিধিদের “আল্লাহ্ লেখা আকবর” ধ্বনির মধ্যে জিন্নার সঙ্গে আলিঙ্গন করে হসাহেব লীগে যোগদান করার শি কথা ঘোষণা করেন। তাঁর লীগে যোগদান ঐ প্রতিষ্ঠানকে পুষ্ট করে। (দ্র. ড. শীলা সেন; সমগ্রন্থ; ১১৫-২২ পৃষ্ঠা)।
১৪. মূলত অসাম্প্রদায়িক কিন্তু উচ্ছ্বাস ও আবেগপ্রবণ হসাহেব প্রকাশ্য সম্মেলনে ভাষণপ্রসঙ্গে ১৭ই অক্টোবর বলেন, “হিন্দু কংগ্রেসের মন্ত্রীরা যদি নিজেদের প্রদেশে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাবার নীতি বজায় রাখেন তাহলে আমি এই মঞ্চ থেকে ঘোষণা করতে চাই যে যদি তাতে আমার প্রাণও চলে যায় তবু আমি বঙ্গে তার প্রতিশোধ নেব।” খলিকুজ্জমাঁর জবানবন্দী অনুসারে (সমগ্রন্থ; ১৭১ পৃষ্ঠা) ঐ বক্তৃতায় হসাহেব “এত দূর পর্যন্ত যান যে বলেন যে উত্তরপ্রদেশে ১০ একজনের প্রাণ যাবার শোধ তুলতে বঙ্গে তিনি দুইজনের প্রাণ নেবেন।” আবেগের তাড়নায় এজাতীয় বেফাঁস উক্তি করে হসাহেব একাধিকবার নিজের রাজনৈতিক জীবনে সমস্যা সৃষ্টি করেছিলেন।
১৫. জি. আল্লানা (সম্পাদিত); Pakistan Movement; ১৪৩ পৃষ্ঠা। অ্যালেন হেইস মিরিয়াম কর্তৃক সমগ্রন্থের ৫৮ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১৬. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১৫৩ পৃষ্ঠা।
১৭. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২১৫ পৃষ্ঠা।

কংগ্রেসের সঙ্গে আপোষ নয়
১৮

জিন্নার ঐ যুদ্ধং দেহি বক্তৃতার বিবরণ পড়ে ১৯শে অক্টোবর গান্ধী তাঁকে লিখলেন:
“আপনার লখনউ-এর বক্তৃতা আমি মনোযোগ সহকারে পড়ার পর আমার দৃষ্টি- ভঙ্গী সম্বন্ধে আপনার ভুল ধারণার পরিচয় পেয়ে গভীর ভাবে আহত বোধ করেছি।(১) আমার চিঠি আপনার কাছ থেকে পাওয়া আপনার এক বিশেষ ব্যক্তিগত সমাচারের উত্তরস্বরূপ ছিল। এতে আমি আমার হৃদয়ের গভীর অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলাম। চিঠিটি ছিল একান্ত ভাবে ব্যক্তিগত। তাকে আপনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন তা কি উচিত হয়েছে? “আপনার বক্তৃতা পড়ে মনে হল তা আগাগোড়াই যেন এক যুদ্ধ ঘোষণা। আমি কেবল এইটুকু আশা করেছিলাম যে আমার মতো এক বেচারাকে আপনি উভয়ের মধ্যে যোগসূত্র স্বরূপ বিশেষ প্রয়োজনে কাজে লাগাবেন। আমার খুবই দুঃখ হয়েছে। ঝগড়া করতে হলে দুজনের দরকার হয়। আমি যদি শান্তি সংস্থাপক নাও হতে পারি তাহলেও আমাকে অন্তত বিবাদের এক পক্ষ হিসাবে পাবেন না।”(২)
জিন্না যেন এই অবকাশেরই প্রতীক্ষায় ছিলেন। তাঁর প্রস্তাবকে উপেক্ষা করার জন্য গান্ধীকে মনের মতো জবাব দেবার সুযোগ তিনি পেয়ে গেলেন। ৫ই নভেম্বরের চিঠিতে গান্ধীর বক্তব্য সাধারণ্যে প্রকাশ করার যৌক্তিকতা প্রদর্শন করার পর জিন্না জানালেন …“আমার লখনউ-এর বক্তৃতাকে আপনি যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য মনে করেছেন বলে আমি দুঃখিত। ও বক্তৃতা নিছক আত্মরক্ষার প্রেরণাসঞ্জাত। দয়া করে ওটি আর একবার পড়বেন এবং আমার বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করবেন। নিঃসন্দেহে আপনি গত বারো মাসের ঘটনা- প্রবাহ অনুসরণ করছিলেন না।
আপনাকে এক ‘যোগসূত্র’ এবং ‘শান্তি-সংস্থাপক’ রূপে বিশেষ প্রয়োজনে কাজে লাগানোর সম্বন্ধে আমি বলতে চাই যে আপনি কি মনে করেন না যে এই এতগুলি মাস আপনার একেবারে নীরব থাকা আপনাকে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে একাত্ম করেছে—যদিও আমি জানি যে আপনি ঐ প্রতিষ্ঠানের এমনকি চার আনার সদস্যও নন।”
এ চিঠির জবাব দেবার মতো কিছু ছিল না এবং গান্ধী মাঝে বেশ অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। তবু গান্ধী তাঁর চিঠির জবাব দেননি—নেহরুর মুখে মৌলানার কাছে জিন্না এই অনুযোগ করেছেন শোনার পরদিনই (১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের তেসরা ফেব্রুয়ারি) গান্ধী জিন্নাকে যে চিঠি লেখেন তা তাঁর স্বভাবসুলভ নম্রতা ও আন্তরিকতায় ওতপ্রোত ছিল। বিগত ২২শে মে-র চিঠি সাধারণ্যে প্রকাশ করার জন্য তাঁর ক্ষোভের কথা পুনর্বার জানিয়ে গান্ধী লিখলেন:
“আপনি আমার নীরবতার জন্য অভিযোগ করেছেন। আমার নীরব থাকার কারণ অক্ষরশঃ এবং যথার্থই আমার লেখায় আছে। বিশ্বাস করুন, উভয় সম্প্রদায়কে কাছাকাছি আনার জন্য যে মুহূর্তে আমি কিছু করার মতো হব, পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাকে তার থেকে বিরত রাখতে পারবে না।
“আপনার বক্তৃতা যে যুদ্ধ-ঘোষণার তুল্য ছিল—একথা আপনি অস্বীকার করছেন। কিন্তু আপনার পরবর্তীকালীন উক্তিসমূহও প্রারম্ভিক ধারণার পুষ্টিসাধন করে। যা অনুভূতির ব্যাপার তাকে আমি প্রমাণ করি কিভাবে? আপনার বক্তৃতাগুলিতে(৩) আমি আর সেই পুরাতন জাতীয়তাবাদীকে খুঁজে পাচ্ছি না। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে যখন আমি দক্ষিণ আফ্রিকার স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে প্রত্যাবর্তন করি সকলেই তখন আপনার সম্বন্ধে বলতেন যে আপনি একজন নিষ্ঠাবান জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দু ও মুসলমান—উভয় সম্প্রদায়ের আশাস্থল। এখনও কি আপনি সেই মিস্টার জিন্না আছেন? যদি বলেন হ্যাঁ, তবে আপনার সাম্প্রতিক বক্তৃতাগুলি সত্ত্বেও আমি আপনার কথাই মেনে নেব।”(৪)
জিন্নার অন্তরের যে তারটি গান্ধী তাঁর অহিংস আবেদনের দ্বারা স্পর্শ করতে চাইছিলেন, তাতে সফলকাম হলেন না। জিন্না তাঁর ১৫ই ফেব্রুয়ারির উত্তরে নিজের কৃতকর্মের সমর্থন তো করলেনই, উপরন্তু জিন্নার জাতীয়তাবাদী ভূমিকাকে পুনর্জাগরিত করার আবেদনের প্রত্যুত্তরে জানালেন, “…ও কথা বলা আপনার উচিত হয়েছে বলে কি আপনি মনে করেন? ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জনসাধারণ আপনার সম্বন্ধে কি বলতেন এবং আজ তাঁরা আপনার সম্বন্ধে কি বলেন বা ভাবেন সে প্রসঙ্গে আমি যাব না। জাতীয়তাবাদ কোন ব্যক্তিবিশেষের একচেটিয়া সম্পত্তি নয় এবং আজকালকার দিনে এর সংজ্ঞার্থ দেওয়াও কঠিন। যাক, আমি বাদবিতণ্ডার এই প্রক্রিয়াকে আর বাড়াতে চাই না।(৫) ঐ চিঠিতে জিন্না কেবল পত্রবিনিময় না করে সাক্ষাৎ আলোচনার দ্বারা গান্ধীকে সমস্যার সমাধানের কথা বলেন, যদিও তাঁর মতে কোন্ কোন্ বিষয়ে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে স্পষ্ট জবাব দিলেন না। গান্ধী ২৪শে ফেব্রুয়ারি এর উত্তর দিলেন এবং তার জবাবে জিন্না তেসরা মার্চ যে চিঠি দিলেন তাতে গোলটেবিল বৈঠকের সময়ে হিন্দু প্রতিনিধিদের চাপে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানে গান্ধীর অক্ষমতার কথা উল্লেখ করে জিন্না দাবি জানালেন: “আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হয়েছি যেখানে এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রাখা চলবে না যে অখিল ভারত মুসলিম লীগকে আপনারা ভারতবর্ষের মুসলমানদের একমাত্র প্রামাণ্য ও প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানরূপে স্বীকার করেন এবং আপনারা কংগ্রেস ও দেশের অপর সব হিন্দু-প্রতিষ্ঠানদের প্রতিনিধি। একমাত্র এর ভিত্তিতেই আমরা অতঃপর অগ্রসর হতে পারি এবং পরস্পরের কাছে আসার একটা ব্যবস্থার কথা ভাবতে পারি।”(৬) অতঃপর আরও কয়েকটি চিঠি ও তারবার্তার বিনিময়ের পর ২৮শে এপ্রিল উভয় নেতা বোম্বেতে মিলিত হলেন।
ব্যর্থ সেই গান্ধী-জিন্না ও জিন্না-সুভাষ (তখন কংগ্রেস সভাপতি) আলোচনার বিবরণ দেবার পূর্বে লখনউ-এ লীগের অধিবেশনের পর থেকে লীগ সংগঠনের জন্য জিন্নার গৃহীত পদক্ষেপসমূহের উল্লেখ করা প্রয়োজন। লখনউ সম্মেলনে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের স্বার্থের সংরক্ষণকারী গণতান্ত্রিক রাজ্যসমূহের ফেডারেশন রূপে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন এবং বন্দেমাতরম্ বিরোধ ও হিন্দির বদলে উর্দুকে জনসাধারণের ভাষার মর্যাদা দেবার প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নোক্ত আর্থিক কর্মসূচীও গৃহীত হয়েছিল: “… কারখানার ও অন্যান্য শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে; ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ; শ্রমিকদের আবাস ও স্বাস্থ্যের অবস্থার উন্নয়ন এবং বস্তির বদলে তাদের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান নির্মাণ; গ্রামবাসী ও শহরবাসীর ঋণভার লাঘব করা এবং মহাজনী প্রথার অবলুপ্তি; আদালতের ডিক্রিপ্রাপ্ত অথবা অন্য ধরনের তাবৎ ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা।” এর সঙ্গে সঙ্গে সমউদ্দেশ্যে কর্মরত যাবতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের সহযোগিতা নেবার নীতিও স্বীকৃত হয়।
এইসব কর্মসূচীর রূপায়নের জন্য যে গণসংগঠন প্রয়োজন তা গড়ার প্রতি এবার জিন্না নজর দিলেন। কংগ্রেসেরই মতো লীগের সাধারণ সদস্যভুক্তির অভিযান শুরু হল। তবে লীগের সদস্যদের চাঁদা কংগ্রেসের অর্ধেক অর্থাৎ বার্ষিক দুই আনা নির্ধারিত হল। অত্যল্প কালের মধ্যে লীগের সম্বন্ধে মুসলমানদের মধ্যে গভীর উৎসাহের সঞ্চার হল এবং ৫ লক্ষ মুসলমান প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সদস্য হয়ে লীগের সঙ্গে মানসিক একাত্মতা বোধ করা আরম্ভ করলেন। কেন্দ্রীয় পরিষদে জিন্না এতদিন ইন্ডিপেনডেন্ট গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন, লখনউ-এর প্রস্তাবের ভিত্তিতে অতঃপর সেখানে লীগের পরিষদীয় দল গঠিত হল। বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ গঠন করে তাকে কেন্দ্রীয় লীগের সঙ্গে যুক্ত করা হল। এগারটির মধ্যে সাতটি প্রদেশের বিধানসভায় মুসলিম লীগ পার্টি সক্রিয় হয়ে উঠল। লীগে নূতন রক্ত সঞ্চারের জন্য জিন্না ছাত্রদের লীগ অভিমুখী করার প্রয়াস করলেন এবং ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কলকাতায় অখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের উদ্বোধন করলেন। মুসলিম ছাত্র-সংগঠনকে সাহায্য করার জন্য তিনি পরের বছর জানুয়ারিতে আলীগড়েও গেলেন এবং হিন্দু-রাজের কবল থেকে মুসলমানদের মুক্ত করার উপর জোর দিলেন।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে কলকাতায় অনুষ্ঠিত লীগ কাউন্সিলের সভায় জিন্নার কণ্ঠস্বর গর্জন করে উঠল: “কংগ্রেস প্রধানত হিন্দু প্রতিষ্ঠান।…মুসলমানরা একাধিকবার একথা স্পষ্ট করে বলেছে যে ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও ব্যক্তিগত আইন ছাড়াও তাদের অপর একটি সমান গুরুত্বপূর্ণ জীবন-মরণের প্রশ্ন আছে এবং তা হল এই যে তাদের ভবিষ্যৎ ও ভাগ্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অধিকার, জাতীয় জীবন, সরকার ও প্রশাসনে উপযুক্ত অংশ পাবার উপর নির্ভরিত। শেষ পর্যন্ত তার এর জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে।”
লীগের কলকাতার ঐ সভাতেই কংগ্রেসশাসিত প্রদেশসমূহে মুসলমানদের উপর অনুষ্ঠিত নানা অত্যাচার সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পীরপুরের রাজা সৈয়দ মহম্মদ মেহেদীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় যা পীরপুর কমিটি নামে সমধিক পরিচিত।
গান্ধী যদিও “ব্যাপকতম অর্থে প্রার্থনায় ও ধর্মীয় মানসিকতায়” জিন্নার বাসগৃহে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, আলোচনার সম্ভাব্য অসফলতার সুস্পষ্ট আভাস ছিল গান্ধীকে লেখা জিন্নার তেসরা মার্চের পূর্বোদ্ধৃত চিঠিতে—লীগকে মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান বলে মেনে নিতে হবে এবং গান্ধী হবেন কংগ্রেস ও অন্যান্য হিন্দু- প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। ২৮শে এপ্রিল তিন ঘণ্টা আলোচনার পর হিন্দু-মুসলিম প্রশ্ন সম্বন্ধে আরও বিবেচনা করতে হবে—এই মর্মে এক যৌথ বিবৃতির পর আলোচনা মুলতুবী হয় ৷ গান্ধী বললেন যে জিন্নার সঙ্গে ভবিষ্যৎ আলোচনা কংগ্রেস সভাপতিকেই করতে হবে এবং নূতন কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র ১২ই মে এ আলোচনা আবার শুরু করলেন। আগস্ট মাস পর্যন্ত দফায় দফায় আলোচনা, পত্রবিনিময় এবং লীগ ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দুই দলের নেতাদের পৃথক পৃথক আলোচনা সত্ত্বেও শেষ অবধি কংগ্রেস ও লীগ সভাপতিদ্বয়ের আলোচনা কোনো ফল প্রসব করল না। এর কারণ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে—কংগ্রেসের পক্ষে নিজেকে কেবল হিন্দুদের অর্থাৎ এক সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত করা সম্ভব নয় এবং একথাও স্বীকার করা সম্ভব নয় যে লীগই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
জাজা কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে জিন্না অন্যান্য কাজকর্মও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর সঙ্গে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ১৬ই আগস্ট সিমলায় অস্থায়ী বড়লাট লর্ড ব্রাবোর্নের সঙ্গে তাঁর ও স্যার সিকন্দরের গোপন আলোচনা। সিমলায় তিনি গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় পরিষদের সভায় যোগ দিতে। অস্থায়ী বড়লাটের উদ্যোগে আয়োজিত ঐ সভায় জিন্না ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে ফেডারেশন পরিকল্পনা,—কংগ্রেস ও লীগ ভিন্ন ভিন্ন কারণে যার বিরোধিতা করেছে—তাকে চিরতরে বাতিল করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে প্রভাবিত করলেন। এইভাবে অখণ্ড ভারতের একটি শক্তিশালী সাংবিধানিক সম্ভাবনার অঙ্কুরে বিনাশ ঘটানো হল। ব্রাবোর্নের দেওয়া তথ্যের আধারে তদানীন্তন ভারতসচিব লর্ড জেটল্যান্ড লিখে গেছেন, “জিন্না এই আশ্চর্যজনক প্রস্তাব সহকারে তাঁর বক্তব্যের উপসংহার করলেন যে কেন্দ্রের ব্যবস্থা যেন আমরা আজকের মতো অপরিবর্তিত রাখি। আর কংগ্রেসি প্রদেশসমূহে আমরা মুসলমানদের রক্ষা করে যেন তাদের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করি এবং আমরা তা করলে মুসলমানরাও আমাদের কেন্দ্রে রক্ষা করবে।”(৭)
এই গোপন আলোচনার পটভূমিকার প্রতি কথঞ্চিৎ আলোকপাত করা প্রয়োজন। ইউরোপে তখন হিটলারের জঙ্গী নীতি আত্মপ্রকাশ করেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন তোষণ নীতির দ্বারা হিটলারকে সাময়িকভাবে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলেও ব্রিটিশ রাজনীতিজ্ঞরা উপলব্ধি করছেন যে আজ না হোক কাল হিটলারের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য। এই যুদ্ধে সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষার জন্য তার বৃহত্তম অঙ্গ ভারতবর্ষ থেকে সৈন্য ও অর্থসাহায্য গ্রহণ অপরিহার্য। ভারতবর্ষের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা জওহরলাল জুন মাস থেকে তাঁর ইংলন্ড ও ইউরোপের সফরে — হয়তো বা বিরোধী শ্রমিক দলের প্ররোচনায়—প্রকাশ্যে ব্রিটিশ নীতির তীব্র সমালোচনা করছেন। যুদ্ধের ব্যাপারে অহিংসায় বিশ্বাসী গান্ধীর সক্রিয় সাহায্য পাওয়া অনিশ্চিত। এ অবস্থায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর একটা বৃহৎ অংশ—মুসলমান ও পাঞ্জাবিদের আনুগত্যের জন্য জিন্না এবং পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিকেন্দারের সমর্থন অপরিহার্য। এর জন্য যে দামই দিতে হোক না কেন, সাম্রাজ্যের স্বার্থে তা প্রয়োজনীয়।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকার জন্য ইতিপূর্বে কংগ্রেস নেতাদের মতো জিন্নাও ব্রিটিশ সরকারের চোখের বালি ছিলেন। ভারতসচিব স্যার স্যামুয়েল হোর ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ই এপ্রিল তদানীন্তন বড়লাট লর্ড উইলিংডনকে লিখেছিলেন, “যেসব ভারতবাসীর সঙ্গে আমি মিলিত হয়েছি তাঁদের মধ্যে আমার মনে হয় জিন্নাকেই আমার অপছন্দ সবচেয়ে বেশি। গোলটেবিল আলোচনার সময় আগাগোড়া ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে সর্পবৎ আচরণ করেছিলেন এবং কেউ তাঁকে বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না।”(৮) জিন্না স্বয়ং স্বীকার করেছেন যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে অকস্মাৎ ব্রিটিশ শাসকদের কাছে তাঁর চাহিদা খুবই বেড়ে গেল। শাসকদের কাছে মূল্যবৃদ্ধির গোপন ইতিহাসের প্রথম পর্যায় সিমলার ঐ আলোচনা।
শুধু সৈন্যবাহিনীর কারণই নয়, কেন্দ্রীয় পরিষদেও জিন্না ও তাঁর মুসলিম লীগ
পৃষ্ঠা: ১২৫

পরিষদীয় দলের সহায়তা ব্রিটিশ সরকারের প্রয়োজন ছিল। কারণ সংখ্যায় অল্প হলেও তাঁর দলের ভূমিকা—এমনকি নিরপেক্ষ থাকাও যে কোনো ভোটাভুটির প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নিজের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যপূর্তির স্বার্থে জিন্না প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় পরিষদে সরকারকে সে সাহায্য দিতেনও।
তাঁর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী ছিল অক্টোবরের ৮ই করাচীর প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করা। এই অধিবেশনকে লীগ সংগঠন পুষ্ট করার কাজে লাগিয়ে উৎসাহে উদ্দীপ্ত শ্রোতাদের জিন্না তাঁর সভাপতির ভাষণে বললেন, “বিভিন্ন শক্তি আজ দুর্নীতি এবং অসাধু প্রচারের দ্বারা মুসলমানদের ধ্বংস ও বিভক্ত করার অপকার্যে লিপ্ত। তার বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতব্যাপী মুসলমানদের যে যুদ্ধ চলছে সে সম্বন্ধে আপনাদের সতর্ক হতে হবে এবং যে অখিল ভারত মুসলিম লীগ ভারতবর্ষের মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান তার পিছনে আপনাদের সুসংহতভাবে স্থান গ্রহণ করতে হবে।”(৯) অদৃশ্য শত্রুদের বিরুদ্ধে জেহাদের আহ্বান জানিয়ে নিজেদের সম্ভাব্য অনুগামীদের সংগঠিত করার যে কৌশল রাজনৈতিক নেতারা সাধারণত অবলম্বন করে থাকেন তা কাজে লাগাবার সঙ্গে সঙ্গে জিন্না তাঁর বিরোধীদের বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল করার জন্য যোগ করলেন, “মুসলমানরা যদি তাদের জাতীয় লক্ষ্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্তির ব্যাপারে পরাজিত হয় তবে তা সম্ভব হবে আমাদেরই মধ্যে যেসব মুসলমান রয়েছেন, তাঁদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য…।”(১০) মুসলমানদের প্রসঙ্গে “জাতীয় লক্ষ্য” শব্দটি প্রয়োগ করার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। তবে তার সম্যক অর্থ আরও দেড় বছর পর তাঁর লাহোর বক্তৃতায় স্পষ্ট হবে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখনীয় যে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ঐ অধিবেশনে সর্বপ্রথম এক প্রস্তাবের মাধ্যমে বলা হয় যে মুসলমানেরা এক স্বতন্ত্র জাতি (Nation) এবং এই আভাস দেওয়া হয় যে তাঁদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমি প্রয়োজন। লাহোর প্রস্তাবের পূর্বসুরী ঐ প্রস্তাবের বয়ান নিম্নরূপ: “সিন্ধুর মুসলিম লীগের এই সম্মেলন বিশাল ভারতীয় উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি এবং হিন্দু ও মুসলমান নামে পরিচিত দুটি জাতির অবাধ সাংস্কৃতিক বিকাশ তাদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নতি এবং রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বার্থে মনে করে যে মুসলিম ও অমুসলমান অধ্যুষিত রাজ্যসমূহের ফেডারেশনের রূপে ভারতবর্ষের দুটি ফেডারেশনে বিভক্ত হওয়া একান্ত আবশ্যক।”(১১) জিন্নার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভার ঐ প্রস্তাবের তাৎপর্য অনুধাবনযোগ্য।
জিন্নার জন্মস্থল করাচী সেবার তাঁকে সাড়ম্বরে অভ্যর্থনা করেছিল। জেলাবোর্ড তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনাও জানিয়েছিল। কিন্তু একটি বিষয়ে সিন্ধু প্রদেশ তাঁকে অত্যন্ত নিরাশ করেছিল। প্রধানত মুসলমানদের দাবিতে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকে পৃথক করা ঐ মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে পাঞ্জাব ও বঙ্গের মতোই ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের প্রাদেশিক বিধানসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগ আদৌ সুবিধা করতে পারেনি—৩৬টি মুসলিম আসনের একটিতেও লীগ বিজয়ী হয়নি। সিন্ধুতে তখন আল্লা বক্সের নেতৃত্বে ও কংগ্রেসের সমর্থনে এক কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় আসীন ছিল। তাবৎ মুসলিম শক্তিকে লীগের পতাকাতলে সংহত করার পরিকল্পনার অঙ্গস্বরূপ জিন্না চেষ্টা করেছিলেন যে অন্তত পাঞ্জাবের স্যার সিকন্দরের মতো সহযোগী হয়েও যেন আল্লা বক্স লীগের সঙ্গে যুক্ত হন এবং কংগ্রেসের উপর নির্ভরতা ত্যাগ করেন। এই উদ্দেশ্যে করাচীতে থাকাকালীন বিধানসভার অনেক সদস্য ও অন্যান্যদের সঙ্গে গোপন শলা-পরামর্শ করে যবনিকার অন্তরালে অনেক কলকাঠি নাড়ার ব্যাপারে তিনি নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। একটি পর্যায়ে সব ঠিক হয়ে গেছে মনে হলেও চরম মুহূর্তে আল্লা বক্স কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করতে অস্বীকার করেন। বলা হয় যে জিন্নার মুখের গ্রাস এইভাবে ‘কেড়ে নেবার” পরিকল্পনাকার ছিলেন কংগ্রেস পার্লামেন্টারি বোর্ডের তদানীন্তন সভাপতি বল্লভভাই প্যাটেল। ১৩ই অক্টোবরের সংবাদপত্রের এক বিবৃতিতে জিন্না এজন্য আল্লা বক্স এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার করেন।
নভেম্বর মাসে পীরপুরের রাজা তাঁর রিপোর্ট পেশ করেন এবং দিল্লি থেকে মুসলিম লীগ কর্তৃক তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়। একজন সদস্যবিশিষ্ট ঐ কমিটির রিপোর্টে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অর্থাৎ কংগ্রেসি শাসনাধীন প্রদেশ সমূহের সরকার—তাদের কোনো প্রতিনিধির সাক্ষ্য না নিয়েই মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ সম্বন্ধে একতরফা রায় দেওয়া হয়। অভিযোগের ধরন সম্বন্ধে ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। কংগ্রেসি শাসনাধীন কোনো প্রদেশে নিজ শাসনের এক বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে কখনো কোনো পক্ষপাতের ঘটনা ঘটেনি অথবা কোনো মুসলমানকে তার শিকার হতে হয়নি এমন কথা জোর করে বলা যায় না। সর্বদেশে ও সর্বকালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের পক্ষপাত এক সামাজিক ও নৈতিক ব্যাধি।(১২) আর দুর্ভাগ্যক্রমে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কংগ্রেসি শাসনের সময়ে এবং তার আগে পরে কংগ্রেস-শাসন-বহির্ভূত প্রদেশসমূহেও হয়েছে। সে সবের উস্কানিদাতা কখনও হিন্দু, কখনও বা মুসলমান। অন্যান্য অভিযোগও যুক্তির কষ্টিপাথরে খুব একটা টেকে না। তবে শাসন-ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরের নেতৃত্ব অর্থাৎ মন্ত্রীমণ্ডল পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পক্ষপাত করেছেন, এর কোনো প্রমাণ পীরপুর কমিটি ছাড়াও লীগের তরফ থেকে অভিযোগের আর যে দুটি সূত্র (ফজলুল হকের Muslim Sufferings under Congress Rule এবং বিহারের লীগের প্রচার সমিতির এস.এম.শরীফের Some Grievances of the Muslim, 1938-39) নিয়ে উচ্চকণ্ঠে সর্বত্র প্রচার করা হয়, তাতেও পাওয়া যায়নি। সংযুক্ত প্রদেশের সরকারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডল পদত্যাগ করার পর সেখানকার গভর্নর স্যার হ্যারি হেইগ অস্বীকার করেন।(১৩) মুসলিম লীগ যখন এই ব্যাপার নিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রচারে পঞ্চমুখ, কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ তখন অভিযোগগুলির সত্যতা বিচারের জন্য কোনো নিরপেক্ষ বিচারকের কাছে দেবার প্রস্তাব করেন এবং এই প্রসঙ্গে ভারতের প্রধান বিচারপতি স্যার মরিস গয়ারের নাম করেন। জিন্না এ প্রস্তাব এই বলে প্রত্যাখ্যান করেন যে অভিযোগগুলি বড়লাটের বিচারাধীন। কিন্তু বড়লাট লিনলিথগো স্বয়ং জিন্নাকে জানান যে ঐসব অভিযোগ পরীক্ষা করে দেখার পর সেগুলির কোনো ভিত্তি আছে বলে বিশ্বাস করার মতো প্রমাণ তিনি পাননি।(১৪) জবাবে জিন্না কেবল এইটুকুই বলতে পেরেছিলেন যে মুসলমানদের অবস্থা তলে তলে খারাপ করার জন্য হিন্দুদের “প্রচ্ছন্ন অভিসন্ধি” রয়েছে।(১৫) পীরপুর রিপোর্টের ভূমিকা ও সাধারণ সমীক্ষা স্বয়ং জিন্না কর্তৃক লিখিত নচেৎ তাঁর দ্বারা অনুমোদিত বলে অনুমান করা হয়। এতে বলা হয়: “আমাদের বিনম্র অভিমত হল এই যে এ সমস্যা যথার্থ…। সাম্প্রদায়িক সমস্যা অসমাহিত থেকে যাবার কারণ সংখ্যালঘুদের সাম্প্রদায়িকতা নয়, সংখ্যাগুরুদের সাম্প্রদায়িকতা।”
ডিসেম্বরের ২৬শে পাটনায় বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে অনুষ্ঠিত লীগের বাৎসরিক অধিবেশনে সমাগত হাজার হাজার শ্রোতার কাছে জিন্না তাঁর কংগ্রেসের প্রতি বিরূপ মনোভাব উজাড় করে দিয়ে বললেন, “কংগ্রেস এবারে…ফ্যাসীবাদীদের রাজকীয় পদ্ধতিতে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বোঝাপড়া হবার সর্ববিধ আশাকে হত্যা করেছে।” তাঁর কণ্ঠে যেন রণভেরী বাজছে, “আমরা—ভারতবর্ষের মুসলমান সম্প্রদায় আমাদের পূর্ণ অধিকার আদায় করার ব্যাপারে মনস্থির করে নিয়েছি।” বিরোধীদের উদ্দেশে তাঁর আঘাত শাণিত হয়ে উঠেছে “কংগ্রেস এক হিন্দু প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়।…জনাকয়েক পথভ্রান্ত এবং কুপথে পরিচালিত মুসলমানদের উপস্থিতি ঐ প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় সংস্থায় পরিণত করতে পারে না।” নিজের মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদের প্রধানতম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রোতৃমণ্ডলীর বিরূপতা জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে এসবের মূলে কে—এই প্রশ্ন উত্থাপন করে নিজেই তার উত্তরদান প্রসঙ্গে জিন্না বললেন, “এর পিছনে কার প্রতিভা ক্রিয়াশীল? মিস্টার গান্ধী। আমার একথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হয়েছিল, তাকে নষ্ট করেছেন মিস্টার গান্ধী। কংগ্রেসকে হিন্দু পুনরুত্থানবাদের যন্ত্রে পরিণত করার জন্য যদি কোনো একজন ব্যক্তিকে দায়ী করতে হয় তাহলে তিনি হলেন মিস্টার গান্ধী। তাঁর উদ্দেশ্য হল এদেশে হিন্দুধর্মের পুনরভ্যুদয় এবং হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্য পরিপূর্তির জন্য তিনি কংগ্রেসকে কাজে লাগাচ্ছেন।” কংগ্রেস মন্ত্রীমণ্ডলীর শাসনাধীন বিহারের রাজধানী পাটনায় কোনো বাধা-বিপত্তি তো দূরের কথা, হাজার হাজার শ্রোতৃমণ্ডলীর উচ্ছ্বসিত করতালিধ্বনির মাঝে জিন্না গান্ধী ছাড়াও জওহরলাল, সুভাষ, প্যাটেল ও রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখ কংগ্রেস নেতাদের কঠোরতম ভাষায় নিন্দা-মন্দ করলেন।
কংগ্রেস ও তাঁর নেতৃবর্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা ছাড়াও লীগের পাটনা অধিবেশনের আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। ঐ সম্মেলনে গোঁড়া প্রতিনিধিদের বক্তব্য অগ্রাহ্য করে লীগ এক মহিলা উপসমিতি গঠন করে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের জন্য নারী কর্মীবাহিনী সংগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে লীগের ভাবধারা প্রচারে বিশেষভাবে সহযোগিতা পাওয়া যায়। মুসলমানদের প্রতি কংগ্রস শাসিত প্রদেশসমূহে “যেসব অত্যাচার হচ্ছে” তার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সংগঠিত করার জন্য অধিবেশনের এক প্রস্তাবে জিন্নাকে অধিকার দেওয়া হয়েছিল। দেশীয় রাজ্যের অধিবাসীদের ব্রিটিশ ভারতের নাগরিকদের মতোই গণতান্ত্রিক অধিকার পাবার জন্য সমর্থন জানানো দীর্ঘকাল যাবৎ কংগ্রেসের নীতি ছিল। কিন্তু এই উদ্দেশ্যে শুরু করা হায়দ্রাবাদের প্রজা আন্দোলন ঐ রাজ্যের মুসলমান শাসকদের বিরোধী বলে পাটনায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকায় দেশীয় রাজ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও যুক্ত হল। পাটনাতে জিন্না যেমন জঙ্গী ভাষা ও ভঙ্গিতে “হিন্দু কংগ্রেসে”র বিরোধিতা করে ৯ কোটি মুসলমানকে লীগের পতাকাতলে সংগঠিত হয়ে মুসলমানদের ন্যায়সঙ্গত দাবি অর্জনের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন, অধিকাংশস্থলে তার অনুকরণে এবং কোথাও কোথাও তার থেকেও জঙ্গী ভাষায় দেশের কোণে কোণে মুসলমানদের ভিতর পাটনার বাণী পৌঁছে দেবার কাজ লীগের কর্মীরা অতঃপর শুরু করেন। সমগ্র ভারতবর্ষে—বিশেষ করে মুসলিম মধ্যবিত্ত এবং ছাত্র ও তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে লীগের ভূমিকার সপক্ষে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হল। নানা জায়গায় লীগের দপ্তর খোলা হল এবং সেখানে নিয়মিত কর্মচাঞ্চল্য দেখা দিল।
জ. হঠাৎ জিন্না এত জঙ্গী সাম্প্রদায়িকতাবাদীর ভূমিকা গ্রহণ করলেন কেন? কেনই বা তিনি গান্ধীর আন্তরিকতাকে উপেক্ষা করলেন এবং কংগ্রেসের সঙ্গে কোনোরকম বোঝাপড়ায় উপনীত হবার মানসিকতা পরিহার করা আরম্ভ করলেন? মুসলমানদের প্রতি “হিন্দু কংগ্রেস” শাসিত প্রদেশসমূহে অনুষ্ঠিত “শতাধিক অত্যাচার” ষোল আনা ভিত্তিহীন না হলেও একে মাত্রাতিরিক্ত বাড়ানো হয়েছিল—একথা তাঁর মতো তীক্ষ্মধী নেতার না বোঝার কারণ ছিল না। তাহলে কংগ্রেস ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে তাঁর এই গোয়েবলসের ধরনের প্রচারযুদ্ধ চালাবার কারণ কি? জিন্নার চরিত্র ও মানসিকতা অধ্যয়ন করার জন্য এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার গুরুত্ব অত্যন্ত অধিক। তবে সেই প্রয়াসে ব্রতী হবার পূর্বে আমরা অপর একটি তথ্যও এখানে লিপিবদ্ধ করব। এ হল হিন্দু-মহাসভার সমকালীন রাজনীতি, যা হিন্দু- সংস্কৃতি ও হিন্দুর স্বাধিকার রক্ষার নামে প্রত্যুত জিন্নার এই ভূমিকাকেই পুষ্ট করেছিল।
কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু-মহাসভা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলিম- তোষণের অভিযোগ উত্থাপন করে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য নিজ সভাসমিতিতে বার বার বলা আরম্ভ করল। কংগ্রেসের মুসলিম গণসংযোগ কর্মসূচী এবং মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগদান করার জন্য আহ্বানও লীগের মতো হিন্দু মহাসভারও বিরূপতার কারণ হল। মহাসভা এর বিরুদ্ধে হিন্দু জনমত সংগঠন করার জন্য সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এর ফলে লীগের পক্ষে মুসলমানদের নিজ পতাকাতলে সমবেত করা সহজসাধ্য হয়ে উঠল। আর মহাসভার নিরন্তর মুসলিম-বিরোধিতা প্রচার এই ধারণার সৃষ্টি করল যে এই দুই ধর্মাবলম্বীরা একই জাতির (nation) অঙ্গ হিসাবে আর একত্র থাকতে পারবে না এবং এর ফলে লীগেরই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মহাসভার অধিবেশনে তার সভাপতি সাভারকার ঘোষণা করলেন, “ভারতবর্ষকে আজ আর এক অবিভাজ্য ও সুসংহত জাতি মনে করা যায় না। পক্ষান্তরে এদেশে প্রধানত দুটি জাতি—হিন্দু ও মুসলমান।”(১৬) ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মহাসভার সম্মেলনেও তিনি এই দ্বিজাতি তত্ত্বর কথা আরও জোর দিয়ে বললেন। অবশ্য তিনি ভারত বিভাজনের দাবি জানাননি। সংখ্যাগুরু বলে ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষে হিন্দুদেরই প্রমুখ স্থান থাকবে—তিনি এটা ধরে নিয়েছিলেন। মুসলমানদের অধিকার সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য ছিল: “হিন্দু মহাসভা একবার যখন “মাথা পিছু এক ভোট’ নীতি কেবল স্বীকারই করে না, তদনুসারে চলে এবং জাতি (race) ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য একই মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যোগ্যতাই একমাত্র মানদণ্ড হিসাবে চায়,…তখন আর কোনো ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা উল্লেখ করা কেবল অপ্রয়োজনীয়ই নয় বরং স্ববিরোধী। কারণ এর ফলে নূতন করে আবার সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ—সংখ্যালঘু মানসিকতার প্রবর্তন হয়।”(১৭) আদর্শবাদের ও মধুর ভাষার মোড়কে মোড়া “হিন্দুরাষ্ট্রে”র এই স্বরূপ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের কাছে মনোরম মনে হলেও মুসলমানসহ তাবৎ সংখ্যালঘুদের আতঙ্কিত করে নিজ নিজ ধর্মের সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের শরণাগত হবার প্ররোচনা দেবার পক্ষে যথেষ্ট।
অতঃপর ইতিপূর্বে উল্লিখিত জিন্নার ভূমিকায় আমূল পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধানের প্রয়াস করা হবে। এ সম্বন্ধে খলিকুজ্জমাঁ বলেছেন: “১৯২৩ থেকে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতাদের মুসলমানদের সঙ্গে বোঝাপড়া করার পথে বাধক ছিল হিন্দু গণ-চেতনা। এরপর স্বীয় অধিকার ও শক্তি-সচেতন মুসলিম গণচেতনা নিছক মন্ত্রিত্বের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে একটা নিষ্পত্তিতে উপনীত হতে আর রাজি হতে চাইল না। চিরকালের জন্যই এ সুযোগ হারিয়ে গেল।”(১৮)
জিন্না মূলত রাজনৈতিক নেতা(১৯) এবং রাজনৈতিক কর্মীদের জীবনধারণ ও কর্মপ্রয়াস সরকারি ক্ষমতা অধিগত করার জন্য। অবশ্য সব রাজনৈতিক দল এবং নেতাই ক্ষমতা দখলের পিছনে নিজস্ব বিশিষ্ট আদর্শবাদের প্রেরণা আছে বলে সাধারণ্যে একটা ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করে থাকেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসি মন্ত্রিমণ্ডল গঠনের প্রক্রিয়ায় জিন্না উপলব্ধি করলেন যে কংগ্রেস অন্তত লীগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে ভোগ করতে চায় না। তাহলে লীগের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতা লাভের উপায় কি? এবং তাঁকে ক্ষমতা পেয়ে ভোগ করতে হলে আরও যেসব সঙ্গী সাথীদের ক্ষমতার অংশ দেওয়া প্রয়োজন—যার সম্ভাবনা না থাকলে তাঁদের সমর্থন পাওয়া যাবে না—সেই লক্ষ্য কি ভাবে সিদ্ধ করা যায়? দুয়োরানি মানসিকতা অর্থাৎ আমরা নিপীড়িত ও বঞ্চিত প্রচার করা এর একটা পন্থা। সংখ্যালঘুরা সর্বত্র অল্পাধিক মাত্রায় এই মানসিকতার শিকার। কিন্তু কেবল সংখ্যালঘু হিসাবে ক্ষমতার ছিটেফোঁটা পাওয়া গেলেও অপ্রতিহত ক্ষমতা পাওয়া যায় না। আর জিন্নার ব্যক্তিগত চরিত্রের অহমিকা তাঁকে কারও কৃপাপ্রার্থীর ভূমিকায় পর্যবসিত হতে দিতে পারে না। তাই উপায়ের সন্ধান দিলেন ইকবাল। মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের মাধ্যমে। লীগের লখনউ অধিবেশনে দেখা গেল বিচ্ছিন্নতাবাদ সাধারণ মুসলমানদের লীগের পতাকাতলে সমবেত করার সঙ্গে সঙ্গে লীগের কর্মীদের সংগঠিত করার পক্ষেও প্রবল সহায়ক। উত্তরোত্তর তাই জিন্না তাঁর কথাবার্তা এবং ব্রিটিশ ও কংগ্রেস প্রমুখ ক্ষমতাপ্রাপ্তির সংগ্রামের অন্যান্য পক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীর এই ভূমিকাকে প্রমুখ করে তুললেন। মুসলিম জনসাধারণ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, অভিজাত, ছাত্র-যুবক, মহিলা—সবশ্রেণীর ভিতর স্বকীয়তা ও আত্মোপলব্ধির ছদ্মবেশে এই বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রবল অনুরণন সৃষ্টি করল। জনপ্রিয়তার ভিত্তি হয়ে দাঁড়াল বিচ্ছিন্নতাবাদ। জনসমর্থন ছাড়া ক্ষমতাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই একথা গান্ধীর গণরাজনীতির সাফল্য দেখার পর জিন্না বুঝতে পেরেছিলেন বলে নিজের অভিজাত ধরনের রাজনীতি বর্জন করে গান্ধীর ধরনে গণসংগঠন গড়ায় তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু সেই অসহযোগের দিনের মতোই তাঁর অহমিকা গান্ধীর নেতৃত্ব স্বীকার করতে অনিচ্ছুক। তাই জিন্নার গণনেতৃত্ব কিঞ্চিৎ ভিন্নরূপ ধারণ করল—হল সাম্প্রদায়িক।
সঙ্গত প্রশ্ন উঠবে—গান্ধীও কি জিন্নার মতো রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণাভিলাষী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না? সাধারণভাবে কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতাই একই পথের পথিক হওয়া সত্ত্বেও গান্ধী ও তাঁর কিছুসংখ্যক অনুগামী ছিলেন এর ব্যতিক্রম। গান্ধীর রাজনীতিতে থাকা জীবনের অপর সমস্ত ক্ষেত্রের মতো এরও “অধ্যাত্মীকরণের” জন্য। এ কেবল তাঁর স্বকীয় উক্তিই নয়, তাঁর কর্মধারাও এই সত্যের দ্যোতক। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের পর যখন রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি খ্যাতির শীর্ষে তখন তিনি কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্যপদ ও ত্যাগ করেন। রাজনীতি তিনি পরিহার করেননি ঠিকই। কারণ তখনকার রাজনীতির সঙ্গে কোটি কোটি ভারতবাসীর স্বশাসনরূপী নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রশ্নের সম্বন্ধ ছিল। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির প্রারম্ভিক সোপান রাজনৈতিক দলের উপর নিয়ন্ত্রণ তিনি স্বেচ্ছায় ছেড়ে
পৃষ্ঠা: ১৩০

দিলেন। অতঃপর কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠানগত না হয়ে কেবল নৈতিকই রয়ে গেল।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি জনগণের অদ্বিতীয় নেতা, তখন স্বেচ্ছায় রাজনীতি বর্জন করে গঠনকর্মের দ্বারা লোকসেবা এবং লোক-সংগঠনকেই নিজের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন। অতঃপর জাতীয় জীবনে কোনো গভীর সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের দ্বারা প্রবলভাবে অনুরদ্ধ না হলে (যথা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রামগড় কংগ্রেস অথবা ক্রিপস প্রস্তাবের ব্যর্থতার পটভূমিকায় আগস্ট আন্দোলনের জন্য বোম্বাই-এর অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠক ইত্যাদি) তিনি কংগ্রেসের অধিবেশন বা ওয়ার্কিং কমিটি কিংবা কংগ্রেসের অপর কোনো সভাতেও যোগ দিতেন না। তবুও ঐজাতীয় পরিস্থিতিতেও গান্ধীর মনে এমন কোনো আগ্রহ দৃষ্টিগোচর হত না যে কংগ্রেস নেতৃত্ব তাঁর পরামর্শ হুবহু মেনে নিক। রাজনৈতিক নেতার পক্ষে এমন অনাসক্ত হওয়া সম্ভব নয়।
আমরা জানি যে এই পর্যায়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রশ্নে গান্ধীর পরামর্শ চাইবার পরও কংগ্রেস নেতৃত্ব ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে। গান্ধী তখন নিঃশব্দে রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে সরে গিয়ে নিজ বিশ্বাসানুসারে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আত্মনিয়োগ করেছেন। পরবর্তীকালে আমরা দেখব যে ১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে রাজনীতি-ব্যবসায়ী সবাই যখন ক্ষমতা লাভের জন্য ক্ষমতা-কেন্দ্রের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, গান্ধী তখন কলকাতা – নোয়াখালি-বিহারে দাঙ্গাপীড়িত মানুষদের সেবা করে তাঁদের মধ্যে সাহস ফিরিয়ে আনার সাধনায় ভুলুণ্ঠিত মানবতার পুনর্বাসনের প্রয়াস করছেন।
জিন্না কিন্তু সেই সময়ে কেবল ক্ষমতা কেন্দ্রেরই আশেপাশে নয়, পরবর্তীকালে আমরা দেখব যে ক্ষমতা লাভের প্রবল আকাঙ্ক্ষায় মাউন্টব্যাটেন ভারত ও পাকিস্তান উভয় নবজাত রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল হোন এ প্রস্তাবে রাজী হয়েও অশোভন ব্যস্ততা সহকারে পাকিস্তানে স্বয়ং সেই পদ অধিকার করেছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে বিশেষ করে ভারত বিভাজনের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে গান্ধীর সঙ্গে জওহরলাল ও প্যাটেল প্রমুখের মতভেদ প্রকাশ্য হয়ে উঠলেও তখনও তাঁর জনসমর্থন এত প্রবল যে গান্ধীর মনে বিন্দুমাত্র আকাঙ্ক্ষা থাকলে তাঁর বিদ্রোহী অনুগামীরাই সাগ্রহে তাঁকে দেশের উচ্চতম রাষ্ট্রীয় পদে বরণ করে নিতেন। গান্ধী তার বদলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনের যন্ত্র কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে তার ভূমিকার পরিবর্তন করে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য এক গণ-সংগঠন বা “লোকসেবক সঙ্ঘে” পরিণত করার খসড়া রচনা করলেন তাঁর মৃত্যুর দিন।
রাজনীতি-ব্যবসায়ী হিসাবে ক্ষমতাপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ছাড়াও বয়সের ভারে ক্লান্ত হবার জন্য (তখন তিনি ষাটের ঊর্ধ্বে) হয়তো জিন্না ক্ষমতা লাভের শর্ট-কাট—সাম্প্রদায়িক ভূমিকা গ্রহণ করেন। বিশেষত ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁর শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছিল। যে কালব্যাধির কারণে তাঁর মৃত্যু হয়, তা ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দেহে ধীরে ধীরে জালবিস্তার করছিল এবং ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের গোড়ায় লাহোর অধিবেশনের পূর্বে দিল্লিতে তো বেশ কিছুদিন এর কারণে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। দেহের এই অবস্থা সম্ভবত তাঁর মনে যথাসম্ভব শীঘ্র ক্ষমতা লাভের অভিলাষকে বলবতী করে থাকবে। আর তিনি দেখেছিলেন যে “ইসলাম বিপন্ন” এই জিগিরের চেয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্তির সোপান—জনসমর্থন প্রাপ্ত হবার ত্বরিৎ পন্থা আর কিছু নেই।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ভিতরই তাঁর মন মোটামুটি ভারত বিভাজনের দাবির জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেও তখনই কেন যে প্রকাশ্য ভাবে এর কথা বলেননি তার কারণ সম্ভবত তাঁর ভিতরকার অদ্বিতীয় রণকৌশল নির্ধারক ব্যক্তিত্ব। তাঁর কৌশলের আভাস পাওয়া যায় ফেডারেশনের প্রস্তাব বর্জন ও দ্বিজাতি-তত্ত্ব থেকে আরম্ভ করে ধাপে ধাপে ভারত বিভাজনের প্রস্তাবের অভিমুখে যাবার মধ্যে। ধীরে ধীরে সইয়ে সইয়ে নিজের দাবি পেশ না করে হঠাৎ এতদিনের ধ্যান-ধারণার ওলট-পালট-সৃষ্টিকারী এই প্রস্তাব পেশ করলে প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ফলে নিজের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবার আশঙ্কা ছিল। পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ের পাদটীকায় (১৫/২) বলা হয়েছে যে ইকবালকে লিখিত জিন্নার চিঠিগুলি মহাকালের হস্তাবলেপনে অদৃশ্য। কিন্তু ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে ডিসেম্বর পাকিস্তান টাইমস- এ মহম্মদ শফীর যে রচনাটি প্রকাশিত হয় তাতে তিনি লিখেছেন যে তাঁর স্পষ্টভাবে মনে আছে যে ইকবালকে লিখিত একটি চিঠিতে জিন্না জানান যে, “আমি আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে সহমত যে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক লক্ষ্য স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু এর বাস্তব অসুবিধা হল, …. আমাদের স্বধর্মীয়রা (people) রাজনৈতিক দৃষ্টিতে অসংগঠিত, শিক্ষার দিক থেকে অনগ্রসর এবং আর্থিক ক্ষেত্রে কুত্রাপি তাদের স্থান নেই।’ সুতরাং পরে দৌড়াবার উদ্দেশ্যে আগে আমি তাদের ধাপে ধাপে টেনে তুলতে চাই।”(২০)
জিন্নার সঠিক শব্দাবলীর জন্য আমরা মহম্মদ শফীর স্মৃতির উপর নির্ভর করতে পারি বা না-ই পারি, পরোক্ষ সাক্ষ্য এবং জিন্নার এতদসংক্রান্ত মানসিকতা আমাদের উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে ব্যক্ত সিদ্ধান্তের প্রতি চালিত করে।

১৮
পাদটীকা

১. ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২২শে মে তারিখের চিঠিতে গান্ধী মধ্যস্থতা করার অনুরোধযুক্ত কালা জিন্নার যে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, লখনউ বক্তৃতায় জিন্না তার প্রকাশ্য সমালোচনা করেন। এর পূর্বে অবশ্য জুলাই মাসে এক প্রকাশ্য বিবৃতিসহ গান্ধীর ঐ চিঠিটি তিনি চার সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন। ঐ বিবৃতিতেও কিছুটা বোঝাপড়ার মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছিল। তিনি বলেন, “মুসলমানদের এবং জনসাধারণকে আমি আশ্বাস দিতে চাই চাচা যে অতীতে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, আমি আদৌ তার দ্বারা প্রভাবিত নই এবং হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটা সম্মানজনক বোঝাপড়াকে আমার মতো আর কেউ স্বাগত জানাবে না। আমার মতো অপর কেউ এ ব্যাপারে সহায়তা করার জন্য এত উন্মুখ হবেন না। আমার আন্তরিকতার নিদর্শন স্বরূপ আমি মিস্টার গান্ধীকে সূচনা পাঠিয়েছিলাম….।”; (সঈদ: Jinnah ; ৫৬২ পৃষ্ঠা)।
২. CWMG; ৬৬তম খণ্ড; ২৫৭ পৃষ্ঠা। মশার
৩. পীরজাদা (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; ৮৯ পৃষ্ঠা।
৪. CWMG; ৬৬তম খণ্ড; ৩৫০ পৃষ্ঠা।
৫. পীরজাদা (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; ৯১ পৃষ্ঠা।
৬. সমগ্রন্থ; ৯৩ পৃষ্ঠা।
৭. জেটল্যান্ড; Essayez (লন্ডন, ১৯৫৯) ২৪৭ পৃষ্ঠা। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১৬২ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। এই প্রসঙ্গে জেটল্যান্ডের অপর একটি প্রায় সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার উল্লেখ করা প্রয়োজন; নিজের স্মৃতিকথায় তিনি এই কথা বলেন যে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ‘আমার মন বিশ বৎসর পূর্বেকার বঙ্গদেশের অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করত যখন ইসলামের প্রায় অপ্রতিরোধ্য কেন্দ্রাভিমুখ শক্তি লক্ষ করেছিলাম। সেই সময় থেকে ক্রমবর্ধমান হারে আমার মনে অপরিহার্য ভাবে এই বিশ্বাস দানা বাঁধা আরম্ভ করে যে ভারত সরকারের ভবিষ্যৎ রূপ নির্ধারণ করার ব্যাপারে অখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রভাবশালী ভূমিকা গ্রহণ করবে।’ এই অভিমত তাঁর পত্রাবলীর মাধ্যমেও যথোচিতভাবে সমর্থিত।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জেটল্যান্ড লিনলিথগোকে লেখেন: “…কোনো বিষয় যদি নিশ্চিত মনে হয়ে থাকে তবে তা হল এই যে ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের কেন্দ্রীয় সরকারেরই গঠন হোক না কেন, তার আওতায় মুসলমানদের যাতে হিন্দুদের প্রভুত্ব স্বীকার করতে না হয় সে ব্যাপারে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবার উদ্দেশ্যে সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে।’ সেই সময়ে এবং ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মন্তব্য করেন ‘যে বিশিষ্ট মুসলমানরা প্রদেশগুলিকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে গোষ্ঠীবদ্ধ করার পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করছেন যা হয়তো এক দুর্বল কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের অধীনে সঙ্ঘবদ্ধ (federate) র হতে পারে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ যে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে প্রোৎসাহিত করা ছেলে হয়েছিল তা ‘পাকিস্তান’ পরিকল্পনার মাধ্যমে অভিব্যক্ত হতে আরম্ভ করে।”(মূর; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৭২-৭৩। প্রথম উদ্ধৃতিটি জেটল্যান্ডের Essayez-এর পৃষ্ঠা ২৪৭ থেকে এবং দ্বিতীয়টি বড়লাটকে লেখা তাঁর ১৩ই ডিসেম্বর ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ চিঠি থেকে গৃহীত।) তদানীন্তন মুসলিম মানসিকতা ও পাকিস্তানের পূর্ব প্রস্তুতির আভাস এতে আছে।
৮. Templewood Papers; চতুর্থ খণ্ড; ড. গোপাল কর্তৃক Jwaharlal Nehru: প্রথম খণ্ডের ২২৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৯. সঈদ; Sound of Fury; ২২০ পৃষ্ঠা।
১০. সঈদ; Jinnah; ৬২৪ পৃষ্ঠা।
১১. রামগোপাল; সমগ্রন্থ ২৬৫ পৃষ্ঠা।
১২. বিহারের তদানীন্তন মন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ড. সৈয়দ মাহমুদ মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর জওহরলালকে লিখিত এক পত্রে অভিযোগ করেন যে কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডল “উপযুক্তভাবে ও কুশলতা সহকারে শাসন করতে ব্যর্থ হয়েছে” এবং ঐ মন্ত্রীমণ্ডল ছিল “প্রাদেশিকতা, জাতিগত (caste) পক্ষপাত ও সনাতনী মানসিকতায় ওতপ্রোত।”(দ্রষ্টব্য: পাদটীকা সংখ্যা ২, পৃষ্ঠা ৩৯৭। ড. গোপাল (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; দশম খণ্ড।) এজাতীয় মানসিকতার অপর একটি নিদর্শন খুব সম্ভব উৎসাহ ও শ্রদ্ধার আতিশয্যে পণ্ডিত রবিশঙ্কর শুক্ল কর্তৃক সেন্ট্রাল প্রভিন্সের প্রধানমন্ত্রী পদে ড. খারের স্থলাভিষিক্ত হবার কিছুদিন পরই (৭।৯।১৯৩৮) এই মর্মে সরকারি আদেশ জারি করা যে সরকারি নথিপত্রে গান্ধীজীর উল্লেখ করতে হলে “মহাত্মা” অভিধা বাধ্যতামূলক। (দ্রষ্টব্য: সি. বি. দালাল; Gandhi 1915-1948: A Detailed Chronology; নূতন দিল্লি (১৯৭১) পৃষ্ঠা ১২৪, পাদটীকা ৬।) কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলীর বিরুদ্ধে লীগের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মুসলমানদের অভিযোগের বিশদ তথ্যাবলী সম্বন্ধে দ্রষ্টব্য: কে. কে. আজিজ (সম্পাদিত) Muslims Under Congress Rule-1937-39: দুই খণ্ড; রিনায়েসান্স পাবলিশিং হাউস, দিল্লি (১৯৮৬)।
১৩. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২৬৬ পৃষ্ঠা।
১৪. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১৭৩ পৃষ্ঠা।
১৫. ড. গোপাল; Jwaharlal Nehru: প্রথম খণ্ড; ২৩৯ পৃষ্ঠা।
১৬. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; ২৬৪ পৃষ্ঠা।
১৭. সমগ্রন্থ; ২৬৫ পৃষ্ঠা।
১৮. সমগ্রন্থ; ১৭৯ পৃষ্ঠা।
১৯. রাজনীতি ব্যবসায়ীদের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য—মনে এক, কথায় অন্য স্বভাবের অনেক উদাহরণ জিন্নার জীবন থেকে দেওয়া যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে হেক্টর বলিথো কর্তৃক উল্লিখিত জনৈকা শিক্ষিতা মুসলিম গৃহবধূর সাক্ষ্য উল্লেখ করাই যথেষ্ট। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জিন্না তাঁর ভগ্নী ফতিমা সহ ২৫ দিন কোয়েটাতে এক ভদ্রলোকের অতিথি হয়ে বাস করে বেলুচিস্তানের উপজাতীয় নেতাদের লীগের ছত্রছায়াতলে নিয়ে আসার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। সাধারণত পর্দাবিহীন ফতিমা প্রায় সর্বত্র জিন্নার অনুগামিনী হতেন। কিন্তু উপজাতীয়রা পর্দাপ্রথায় গভীরভাবে বিশ্বাসী এবং একে জীবী ঐ স্লামিক জীবনচর্যার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। গৃহকর্তা জিন্নাকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন যে উপজাতীয়দের প্রস্তাবিত এক জনসভায় ফতিমার জিন্নার সঙ্গে যাওয়া সমীচীন নয়। তাঁর আধুনিকা স্ত্রী স্বামীর পরামর্শের প্রতিবাদ করে বললেন যে ফতিমার অবশ্যই যাওয়া উচিত এবং এইভাবে এ কুসংস্কার উচ্ছেদের পথে এক ধাপ এগোনো যাবে। জিন্না সবিশেষ ক্রুদ্ধ হয়ে মহিলাকে বললেন, “ “এদের মধ্যে চার বছরের পরিশ্রমকে ব্যর্থ করে দেবার চেষ্টা আপনি করছেন।’ তাঁর বক্তব্যের তাৎপর্য অবশ্য ছিল উপজাতীয়দের মধ্যে মুসলিম লীগের প্রতি সহানুভূতির ভাব গড়ে তোলার জন্য তাঁর চার বছরের প্রয়াস।”(সমগ্রন্থ; ১২৩ পৃষ্ঠা)।
২০. পীরজাদা (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; ১৪২ পৃষ্ঠা।

দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য পৃথক বাসভূমি দাবি
১৯

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ভাগ কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে বোঝাপড়ার প্রয়াস এবং তার পৌনঃপুনিক ব্যর্থতার কাহিনীর কাল। ১লা জানুয়ারি জিন্না এক বিবৃতির মাধ্যমে হরিজনে প্রকাশিত গান্ধীজীর এই রচনার প্রতিবাদ জানালেন যে কংগ্রেস ভারতবর্ষের জনসাধারণের প্রতিনিধি। এই প্রসঙ্গে আবার তিনি মুসলমানদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ উত্থাপন করলেন। তেসরা জানুয়ারি জওহরলাল কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তির দ্বারা এ অভিযোগের তদন্ত করার প্রস্তাব করে পরের দিন জিন্নার কাছে এক চিঠির মাধ্যমে সেই বিবৃতির নকল পাঠিয়ে সেই প্রস্তাবের পুনরুক্তি করলেন। জিন্না জওহরলালের অধিকারের প্রশ্ন তুলে এ ব্যাপারে আর অগ্রসর না হলেও অতঃপর একটা ঐক্যসূত্র খুঁজে বার করার জন্য জিন্না ও জওহরলালের মধ্যে বেশ কয়েকটি পত্রবিনিময় হল। কিন্তু শেষ অবধি সেই পুরাতন নীরন্ধ্র প্রস্তরপ্রাচীরের অর্থাৎ মুসলিম লীগকে মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান বলে স্বীকার করে নিতে হবে এবং কংগ্রেস কেবল হিন্দুদের প্রতিনিধি—সম্মুখীন হওয়ায় আলোচনা আর অগ্রসর হতে পারল না।
মুসলমানদের প্রতি অত্যাচারের অভিযোগ প্রসঙ্গে একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনী উল্লেখযোগ্য। পাটনায় লীগের অধিবেশনে বক্তৃতাপ্রসঙ্গে পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিকন্দর বলেছিলেন, “এইসব (অত্যাচারের ঘটনা) যদি বন্ধ করা না হয় এবং যদি এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে দেওয়া হয় তবে তার পরিণামে কেবল আইন অমান্যেরই (civil disobedience) সূচনা হবে না, এর থেকেও খারাপ পরিণতি ঘটবে।…প্রয়োজনে ইসলামকে রক্ষা করার জন্য পাঞ্জাবের প্রতিটি মুসলমান তাঁর জীবন উৎসর্গ করবেন।” একজন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর অপর এক প্রদেশের প্রশাসনকে কেন্দ্র করে ঐজাতীয় মন্তব্য করা অসমীচীন মনে হওয়ায় ৪ঠা জানুয়ারি জওহরলাল স্যার সিকন্দরকে এক পত্র লিখে উত্তরপ্রদেশে এরকম কোনো ঘটনার প্রমাণ দিতে অনুরোধ জানান। স্যার সিকন্দর তাঁর ১৪ই ফেব্রুয়ারির উত্তরে একথা অস্বীকার করেন যে ঐ অধিবেশনে কোনো অবস্থায় কংগ্রেসশাসিত প্রদেশসমূহে কোনো অত্যাচার অনুষ্ঠানের অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। তাঁরা কেবল কোনো কোনো কংগ্রেসশাসিত প্রদেশে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাচারের উল্লেখ করেছিলেন।(১)
ইতিমধ্যে জিন্নার সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কবিশিষ্ট অস্থায়ী বড়লাট ব্রাবোর্নের মৃত্যু ঘটেছে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত লিনলিথগোর মনে গোড়ায় জিন্নার সম্বন্ধে অনুকূল ধারণা ছিল না।(২) তাছাড়া লিনলিথগো কেবল ফেডারেশনেরই সমর্থক ছিলেন না, লীগের সহযোগী হয়েও জিন্নার প্রতিদ্বন্দ্বী স্যার সিকন্দরের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এই জন্য যে তিনি ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি করার প্রধান এলাকা পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী। স্যার সিকন্দরকে বড়লাট এতটা গুরুত্ব দেবেন—জিন্নার এটা পছন্দ হত না; আর স্যার সিকন্দরও জিন্নার মনোভাব জানতেন এবং ভিতরে ভিতরে তাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন। তিনি তাই বড়লাটকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, “জিন্নাকে আরও ফুলিয়ে দেওয়া অথবা তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া করা দুরূহ
পৃষ্ঠা: ১৩৫

হয়ে ওঠে এমন কিছু করা উচিত হবে না।”(৩) মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় পরিষদে অর্থ বিলের উপর বক্তৃতা দেবার সময় জিন্না তাই সরকার ও বড়লাটকে একরকম শাসানী দিলেন যে সরকার তাঁদের “রক্ষা না করলে” তাঁরাও কেন্দ্রে আর সরকারকে “রক্ষা” করবেন না।(৪) কারণ কেন্দ্রীয় পরিষদে মুসলিম লীগের এমন এক ভারসাম্য রক্ষাকারী স্থান ছিল যে লীগ সদস্যরা ইচ্ছা করলেই বিরোধীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সরকারি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সহায়ক হতে পারত। কেন্দ্রীয় পরিষদকে ও মুসলিম জনমতকে নিজের অনুকূল করা ও কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ জানাবার কাজে লাগিয়ে ঐ বক্তৃতায় তিনি আরও বললেন, “আমরা যে সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী তাকে আপনারা কদাপি ধ্বংস করতে পারবেন না। ঐস্লামিক সংস্কৃতি ও চেতনা বজায় থাকবে, বজায় থাকছে এবং বজায় থেকেছে। আপনারা আমাদের চেয়ে অধিক বল সংগ্রহ করতে পারেন; আমাদের নিগ্রহ করতে পারেন; এবং আমাদের অবস্থা তার থেকেও শোচনীয় করে তুলতে পারেন। কিন্তু আমরা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি এবং এই দৃঢ় সংঙ্কল্প করেছি যে আমাদের যদি নিশ্চিহ্ন হতেই হয় তবে আমরা লড়াই করতে করতেই সেই পরিণতিতে উপনীত হব।”(৫)
১৬ই মার্চ জিন্না পীরপুর কমিটির রিপোর্টের নকল উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য বড়লাটকে পাঠালেন। ২২শে মার্চ কেন্দ্রীয় পরিষদে দেশের কোণে কোণে ব্যাপকভাবে হিন্দু- মুসলমান সংঘর্ষ হচ্ছে বলে অভিযোগ করলেন। ৮ই এপ্রিল লীগ কাউন্সিলে সভাপতির ভাষণে ঘোষণা করলেন যে তাঁর প্রতিষ্ঠান ফেডারাল ব্যবস্থা স্বীকার করে না। রাজকোটে দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের গণতান্ত্রিক অধিকার দেবার জন্য গান্ধী যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তার অঙ্গস্বরূপ রাজকোট কমিটিতে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে আপত্তি করে জিন্না ১৮ই এপ্রিল একটি বিবৃতি দিলেন এবং মুসলমানদের ঐ কমিটি বর্জন করার পরামর্শ দিলেন। ৩০শে জুলাই এক বিবৃতিতে বড়লাট ও ভারত সরকারকে অনিচ্ছুক দেশের উপর ফেডারাল পরিকল্পনা চাপিয়ে না দেবার জন্য আবেদন জানালেন। ৫ই আগস্ট বোম্বেতে এক জনসভায় বক্তৃতাপ্রসঙ্গে বললেন যে পাশ্চাত্য গণতন্ত্র “ভারতবর্ষের প্রতিভার সঙ্গে খাপ খায় না।”(৬) তাঁর কণ্ঠে স্যার সৈয়দ আহমদের সুর।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের তেসরা সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ সরকার পোল্যান্ড আক্রমণকারী জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দ্বারা সরকারিভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূত্রপাত করলেন। কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য অথবা প্রদেশসমূহে কার্যরত জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা বিনাই বড়লাট অনতিবিলম্ব ভারতবর্ষকে জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বলে ঘোষণা করলেন। অতপর তিনি হলেন যুদ্ধকালীন বড়লাট এবং একাধিক অর্ডিন্যান্সের বলে ভারতীয় নাগরিক অথবা জনপ্রতিনিধিদের যেটুকু অধিকার ছিল তা হরণ করে নেওয়া হল। বড়লাট এরপরই গান্ধী জিন্না প্রমুখ নেতাদের তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন যাতে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় তাঁদের সাহায্য পাওয়া যায়। চৌঠা সেপ্টেম্বর গান্ধী বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানালেন যে মানবতার কারণে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নৈতিক সহানুভূতি ইংলন্ড ও মিত্রপক্ষের দিকে। তবে তিনি এও জানালেন যে কংগ্রেসের তরফ থেকে এবং এ-ব্যাপারে কোনো কথা বলার অধিকার তাঁর নেই, এবং কংগ্রেস তার সিদ্ধান্ত স্বয়ং নেবে। জিন্না বড়লাটকে জানালেন যে লীগের সমর্থন পেতে হলে তাঁকে সক্রিয়ভাবে কিছু করতে হবে এবং অন্তত কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলকে পদচ্যুত করা অপরিহার্য।(৭)
পরিস্থিতি বিচার করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ৭ই থেকে ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একাদিক্রমে মিলিত হল। জাতীয় সমস্যা সম্বন্ধে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার জন্য অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে জিন্না সেই সভায় যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রিত হলেও তিনি সে আমন্ত্রণ স্বীকার করেননি। কংগ্রস নেতাদের তিনি দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে মিলিত হবার প্রস্তাব দিলেন। “গান্ধীর অভিমত এই ছিল যে আমাদের নৈতিক সমর্থন দেওয়া অবশ্য কর্তব্য, মন্ত্রীমণ্ডলকে কাজ করতে দেওয়া উচিত এবং তাঁর এই বিশ্বাস ছিল যে মন্ত্রীমণ্ডলের মাধ্যমে পূর্ণ স্বরাজ বা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের ঘোষণা তিনি আদায় করে নিতে পারবেন।”(৮) কিন্তু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিল। আক্রান্ত পোল্যান্ড ও গণতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতি ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্কিং কমিটি বলল যে ভারতবর্ষে বিগত দেড়শ বছর ধরে গণতন্ত্র নেই—এমনকি যুদ্ধ ঘোষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেও দেশবাসীর সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি, যদিচ অন্যান্য উপনিবেশের ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে। সুতরাং ভারতবাসীদের গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য যুদ্ধপ্রচেষ্টায় সহযোগিতা করতে হলে আগে এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত এবং যুদ্ধের ব্যাপারে নিজের স্পষ্ট লক্ষ্যও ইংলন্ড কর্তৃক ঘোষিত হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া বড়লাটের যুদ্ধকালীন বিশেষ অধিকারাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সম্পর্কও নির্ধারিত হওয়া দরকার।(৯) জানায় ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইনে ফেডারাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের যে প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং যা এতদিন কার্যকরী করা হয়নি, বড়লাট তাঁর ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘোষণায় তাকে লক্ষ্য হিসাবে বজায় রাখলেও তার বাস্তব প্রয়োগ অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখলেন। এতে এক দিকে যেমন কেন্দ্রে জনপ্রতিনিধিদের সীমিত ক্ষমতা হস্তান্তর করার আশা আপাতত তিরোহিত হল, অন্যদিকে লীগ এবং রাজন্যবর্গকেও সন্তুষ্ট করা হল। ফেডারাল প্রস্তাবের প্রতি কংগ্রেস, লীগ ও রাজন্যবর্গের আপত্তির কারণ ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। অধিকন্তু হিসাবে যুদ্ধে দেশীয় নৃপতিবর্গের কাছ থেকে ধন ও জনের সাহায্য পাবার জন্য তাঁদের ক্ষোভের কারণ বজায় রাখা সরকার উচিত মনে করলেন না। কিন্তু ফেডারেশন প্রস্তাব স্থগিত রাখার দ্বারা ভারত অখণ্ড থাকার অন্যতম সম্ভাবনা তিরোহিত হল।
যুদ্ধ ও বড়লাটের তৎসম্পর্কিত ঘোষণা সম্বন্ধে লীগ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত তার ১৭-১৮ সেপ্টেম্বরের জরুরি সভায় বিচার-বিবেচনা করল। কংগ্রেস-শাসিত প্রদেশসমূহে মুসলমানদের ধর্মীয় রাজনৈতিক ও আর্থিক অধিকারের ক্ষেত্রে যে “শত্রুভাবাপন্ন” দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের রক্ষা করার জন্য গভর্নরগণ ও বড়লাট তাঁদের বিশেষ অধিকার প্রয়োগ না করায় লীগ গভীর অসন্তোষ প্রকট করল। ফেডারেশন পরিকল্পনাকে কেবল স্থগিত রাখা নয়, চিরতরে বাতিল করার দাবি জানাল। প্রস্তাবে এও বলা হল যে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসনের দুই বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে সরকার যেন ভারতবর্ষের সংবিধানের সমগ্র প্রশ্নটিতে নূতন করে বিবেচনা করেন। সর্বশেষে এই দাবি জানানো হল যে ব্রিটিশ সরকার যেন “মুসলমানদের এই আশ্বাস দেন যে মুসলিম লীগের সম্মতি ও স্বীকৃতি ব্যতিরেকে ভারতবর্ষের সাংবিধানিক অগ্রগতির প্রশ্ন সম্বন্ধে কোনো রকম ঘোষণা করা হবে না।”(১০) অর্থাৎ লীগের জন্য পরিপূর্ণ ভিটোর অধিকার দাবি করা হল।
লিনলিথগো আদৌ কংগ্রেস অথবা জওহরলালের (তাঁর মতে “কেতাবী বুদ্ধি…এবং বৈদেশিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চ সম্বন্ধে অ্যামেচার জ্ঞানসম্পন্ন”(১১) গুণগ্রাহী ছিলেন না। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য যে কোনো উপায়ে সৈন্য ও অর্থ সংগ্রহ করে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় সাহায্য করা। সুতরাং মুসলিম লীগের এই একরোখা ভূমিকা বড়লাটকে সুবর্ণ সুযোগ দিল। ভারতবাসীদের সহযোগিতা পাবার জন্য তিনি তাঁর শাসন পরিষদের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে কিছু রাজনৈতিক নেতাকে তাতে স্থান দেবার কথা বললেও এদেশবাসীকে যথার্থ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি, এমনকি নিছক যুদ্ধের লক্ষ্য ঘোষণা করা সম্বন্ধেও কোনো কথা দিলেন না। গান্ধী-জিন্না-নেহরু এবং আরও অনেক ভারতীয় নেতার সঙ্গে ২৬শে সেপ্টেম্বর তাঁর দ্বিতীয় দফা সাক্ষাৎকার অথবা নেহরু-রাজেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর তেসরা অক্টোবরের আলোচনারও কোনো পরিণাম হল না। বড়লাট কংগ্রেস-নেতাদের লীগের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে শাসন-সংস্কারের প্রস্তাব দেবার পরামর্শ দিলেন এবং বাস্তব অবস্থার জন্য তার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। অতএব আবার অচলাবস্থা এবং যথার্থ ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা থেকে ভারত সরকারের নীতিনির্ধারকদের নিষ্কৃতি লাভ। ভারতসচিব জেটল্যান্ডও ভারত সরকারের এই ভূমিকায় সন্তুষ্ট।
কোনো দাবিই পূর্ণ না হওয়ায় সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে তদানীন্তন পরিস্থিতিতে ইচ্ছা থাকলেও কংগ্রেসের পক্ষে ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধপ্রচেষ্টার সঙ্গে সহযোগিতা করা অসম্ভব এবং প্রদেশগুলির কংগ্রেস সরকার যেন ৩১শে অক্টোবরের মধ্যে পদত্যাগ করে। স্থির হল যে এই মর্মে বিধানসভাসমূহে প্রস্তাব গ্রহণ করার পর কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলগুলি পদত্যাগ করবে। তদনুসারে বিধানসভাসমূহে প্রস্তাব উত্থাপিত হলে লীগের তরফ থেকে সর্বত্র একই ধরনের সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করা হয়, যদিও তা যে অগ্রাহ্য হবে তা পূর্ব থেকেই জানা ছিল। এতে লীগ ওয়ার্কিং কমিটির ১৭-১৮ সেপ্টেম্বরের বক্তব্যের সারমর্ম ছাড়াও বলা হয় যে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্বন্ধে যুদ্ধ চলার সময়ে অথবা তার পরও কোনো আলোচনার প্রাক্কালে ব্রিটিশ সরকারকে একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, “বর্তমান সংবিধানের অনুসারী গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টারি প্রথার শাসনব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে কারণ তা এদেশের পরিস্থিতি এবং দেশবাসীর প্রতিভার একান্ত প্রতিকূল” এবং তাই সমস্ত ব্যাপারটা সম্বন্ধেই নূতন করে ভাবতে হবে। এই কারণে ভবিষ্যৎ সংবিধানের মূলনীতি বা অন্য কিছু সম্বন্ধে “অখিল ভারত মুসলিম লীগের— একমাত্র যে প্রতিষ্ঠান ভারতবর্ষের মুসলমানদের প্রতিনিধিস্থানীয় ও তাঁদের পক্ষে কথা বলার অধিকারী—অনুমোদন, স্বীকৃতি ও যাবতীয় প্রধান সংখ্যালঘু ও অন্যান্য স্বার্থের সম্মতি ব্যতিরেকে” ব্রিটিশ সরকার কোনোরকম প্রতিশ্রুতি দেবেন না। এখানে অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উল্লেখ করার কারণ হল এই যে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হবার সময় থেকে “শত্রুর শত্রু আমাদের মিত্র”—কূটনীতির এই প্রাচীন নির্দেশ অবলম্বনে জিন্না আম্বেদকর ও দক্ষিণে দ্রাবিড় কাজঘমের নেতাদের সঙ্গে সখ্যভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। পরে আমরা দেখব যে হিন্দু-সমাজের একাংশ তপশিলী সম্প্রদায়ের কিছু প্রতিনিধিকে এই ভাবে লীগের শিবিরভুক্ত করা এমনকি ভারত বিভাজনের সময়ও জিন্নার পক্ষে কেমন সহায়ক হয়েছিল।
পূর্বোক্ত সিদ্ধান্ত অনুসারে অক্টোবরের শেষে এবং নভেম্বরের প্রথমে আটটি প্রদেশের কংগ্রেসি সরকার পদত্যাগ করল। এর ফলে শুধু বড়লাট ও ভারত সরকারই নয় লীগের সামনেও সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত হল। কারণ সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কংগ্রেস এবং ক্ষমতার বাইরে কংগ্রেসের শক্তি ও প্রভাবে আকাশপাতাল পার্থক্য। সরকারের পক্ষে ভারতবর্ষের জনশক্তি ও ধনবলকে কাজে লাগিয়ে তাদের যুদ্ধপ্রচেষ্টা অপ্রতিহত গতিতে চালাবার অবকাশ জুটে গেল। আর কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলের পদত্যাগের ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হল তা পূর্ণ করার জন্য যবনিকার অন্তরালে লীগ প্রস্তুতই ছিল। দুই প্রধানমন্ত্রী স্যার সিকন্দর ও ফজলুল হকের মাধ্যমে যুদ্ধপ্রচেষ্টার সাহায্য মেলার সঙ্গে সঙ্গে লীগও দুই প্রদেশে শক্তিশালী হচ্ছিল, যদিও নেতৃত্বের ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে উভয়ের সঙ্গেই জিন্নার সম্পর্ক ভাল ছিল না। ২২শে অক্টোবর এক প্রস্তাব গ্রহণ করে লীগ জানাল ব্রিটিশ সরকার ভবিষ্যৎ সংবিধানে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলে লীগ যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য করবে। স্বদেশবাসীর বদলে জিন্না ও লীগের ইংরেজ শাসকদের উপর এত ভরসা করার প্রবণতার সমালোচনা করে গান্ধী “হরিজনে” এক প্রবন্ধ লিখলেন। যাই হোক, এই পদত্যাগের ফলে অতঃপর অন্যান্য প্রদেশে লীগ শক্তিশালী হবার সুযোগ পেল। পরবর্তীকালে আমরা দেখব যে মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহে লীগের সংগঠন ও প্রচার এই সুযোগে বৃদ্ধি পেল। পাকিস্তানের দাবির পরিপূর্তির পক্ষে এ সুযোগ কম সহায়ক হয়নি।
১লা নভেম্বর গান্ধী এবং কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও লীগ সভাপতি জিন্না বড়লাটের আমন্ত্রণক্রমে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। নেতাদের আগ্রহে বড়লাট লিখিতভাবে নিম্নোক্ত ভাষায় তাঁর প্রস্তাব জানালেন: “কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারূপে আমি আপনাদের এবং উপস্থিত অন্যান্য ভদ্র মহোদয়বর্গকে যে প্রস্তাব বিবেচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম তা হল এই যে কেন্দ্র মিলেমিশে কাজ করার আত্যন্তিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে আপনারা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় প্রবৃত্ত হবেন। সেই আলোচনার উদ্দেশ্য হবে— আপনারা প্রাদেশিক ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পারেন কি না তা আবিষ্কার করা। বোঝাপড়ার এজাতীয় ভিত্তি আবিষ্কৃত হলে আপনারা আমার সমক্ষে উপযুক্ত প্রস্তাব পেশ করবেন এবং তাহলে আপনাদের উভয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের অবিলম্বে শাসন পরিষদের সদস্য হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হবে।”(১২) বলা বাহুল্য বড়লাটের এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ইংলন্ডের বিরোধী শ্রমিক দল এবং ভারতের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল আর সবাইকে দেখানো যে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর সহযোগিতা পেতে ইচ্ছুক। এতদনুসারে দফায় দফায় গান্ধী-জিন্না- রাজেন্দ্রপ্রসাদ আলোচনা ছাড়াও জিন্না-জওহরলাল আলোচনা ও পত্র বিনিময় হল। কিন্তু এই সব আলাপ-আলোচনা নিষ্ফল হওয়া অবধারিত ছিল। একদিকে বড়লাট এক নূতন পূর্ব- শর্ত—প্রাদেশিক স্তরেও মতৈক্য(১৩) জুড়ে দিয়েও সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলেছিলেন। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক বিভেদের প্রশ্নকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বা স্বাধীনতার প্রশ্নকে মুলতুবি রাখা হচ্ছিল। কংগ্রেসের বক্তব্য ছিল— সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান ভবিষ্যৎ গণপরিষদ করবে। স্বভাবত কংগ্রেসের এ ভূমিকা জিন্নার মনোমতো হল না এবং সে কথা তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণাও করলেন। কারণ ভারত বিভাজনের দাবির জন্য তাঁর মন তখন তৈরি হয়ে গিয়েছে এবং সেকথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করার অনুকূল অবসর তিনি খুঁজছিলেন। দুই চারিটি অতিরিক্ত মন্ত্রীপদ বা অনুরূপ কিছুর বিনিময়ে মূল লক্ষ্য থেকে চ্যুত হবার মতো রাজনীতিবিদ্ তিনি ছিলেন না। মূল দাবি ঘোষণা না করা পর্যন্ত রণকৌশল হিসাবে তিনি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ৫ই নভেম্বর বড়লাট কংগ্রেস ও লীগের মতভেদের জন্য তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে বলে ঘোষণা করলেন।
এর পরও গান্ধী অবশ্য আশা করেছিলেন যে জিন্না ও জওহরলালের মধ্যে আলোচনা সাম্প্রদায়িক শান্তি প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হবে। জিন্না ও নেহরুর মধ্যে পত্র বিনিময় ও আলোচনার সূত্রপাত হয় স্যার সিকন্দরের ১১ই অক্টোবরের বিবৃতিকে কেন্দ্র করে যাতে তিনি বলেছিলেন যে, “…মিস্টার জিন্নাকে যদি আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত ভাবেও আমন্ত্রণ জানানো হয় তাহলে তিনি সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক হবেন। জওহরলাল এই বিবৃতি দেখে মৌলানা ও কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদকে লিখলেন যে এ ব্যাপারে চেষ্টা করা উচিত এবং প্রয়োজনে তিনি জিন্নার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে প্রস্তুত। ১৮ই অক্টোবর জওহরলাল জিন্নাকে আন্তরিকতা সহকারে এ সম্বন্ধে লিখলেন। ৬ই নভেম্বর সংবাদপত্রে এক বিবৃতির মাধ্যমে বড়লাটের সমালোচনা প্রসঙ্গে জওহরলাল জিন্নার সঙ্গে বহু বিষয়ে মত্যৈকের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে একথাও বললেন যে তাঁদের পারস্পরিক আলোচনা অনেক ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে সমর্থ হয়েছে। রাজেন্দ্রপ্রসাদের কাছে ১৪ই নভেম্বর এবং জাকির হোসেনের কাছে ২৪শে নভেম্বর লিখিত পত্রে জওহরলাল অনুরূপ মানসিকতার পরিচয় দেন। ১লা ডিসেম্বক জিন্নাকে লিখিত পত্রে জওহরলাল জানান যে পূর্বতন সাক্ষাৎকারের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর সঙ্গে পুনরায় মিলিত হবার জন্য জিন্নার চিঠির অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু ৯ই ডিসেম্বরের চিঠিতে জওহরলাল জিন্নাকে জানান, যেহেতু প্রদেশসমূহ থেকে কংগ্রেসের শাসনের অবসানের জন্য বিগত দোসরা লীগকে তিনি আগামী ২২শে মুক্তি ও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের দিবস পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন, তাই তিনি আর জিন্নার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছুক। কারণ তাঁদের মধ্যে আর আলোচনার অনুকূল সাধারণ ভিত্তিভূমি নেই এবং এই সিদ্ধান্তের দ্বারা জিন্না এই কথা সপ্রমাণ করেছেন যে নেহরুর সঙ্গে তাঁর “মূল্যবোধ জীবন ও রাজনীতির লক্ষ্যও” একেবারে ভিন্ন।(১৪) কৌশলগত কারণে জিন্না অবশ্য তখনই নেহরুর সঙ্গে পত্র বিনিময় বন্ধ করলেন না—পরবর্তী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যর্থ পত্রালাপ চলল।
দোসরা ডিসেম্বরের ঐ বিবৃতিতে জিন্না অত্যন্ত কঠোর ভাষায় কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলীগুলির বিরুদ্ধে মুসলমানদের তথাকথিত অত্যাচারের পুরাতন অভিযোগ সমূহের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। কেবল জওহরলাল, গান্ধী অথবা কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারাই নয়, বাংলার লীগের নেতা ইস্পাহানীও তাঁর এক পত্রে জিন্নার এই সিদ্ধান্তের জন্য মনোবেদনা ব্যক্ত করে মন্তব্য করেন যে তিনি ক্রমাগত প্রতিক্রিয়াশীল ও জী হুজুরদের কবলিত হচ্ছেন। লীগের অপর এক নেতা আবদুর রহমান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বঙ্গীয় আইনসভার ১৬জন সদস্য জিন্নার এই কার্যকে “জাতীয় মর্যাদার প্রতি অপমান” এবং “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি চাটুকারিতা” আখ্যা দিয়ে দলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন।(১৫) জিন্না কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে নিজ সিদ্ধান্তের সমর্থনে কংগ্রেস ও তাঁর বিরোধীদের প্রতি তীব্রতর ভাষা প্রয়োগ করে আর একটি বিবৃতি দিলেন এবং কংগ্রেসের শাসনাধীন প্রদেশসমূহে মুসলমানদের উপর “অত্যাচারে”র জন্য একটি রয়াল কমিশন নিয়োগের দাবি জানালেন।
পৃষ্ঠা: ১৪০

১৩ই ডিসেম্বর জওহরলালকে তিনি লিখলেন যে, লীগকে মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকার না করলে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনোরকম আলাপ- আলোচনা করবেন না। ২২শে ডিসেম্বর মুসলমানদের কর্মবিরতি পালন করতে ও সভাসমিতির মাধ্যমে কংগ্রেসি “অপশাসন” থেকে মুক্তি পাবার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে বলা হয়েছিল। জিন্না ভেবেচিন্তেই দিনটি নির্ধারিত করেছিলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার এবং মসজিদে মুসলমানদের স্বাভাবিকভাবে একত্র হবার দিন। আর এক দফা ধর্মস্থানগুলিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হল এবং মসজিদে মসজিদে “হিন্দু” কংগ্রেস-বিরোধী বক্তৃতার অগ্ন্যুদ্‌গার হল। মুসলমানরা ছাড়াও দক্ষিণের দ্রাবিড় কাজঘম্ দলের তরফ থেকে রামস্বামী নাইকার, ড. আম্বেদকারের নেতৃত্বাধীন তফশিলী সম্প্রদায় ফেডারেশন এবং ভারতীয় খ্রিস্টানদের একাংশ এই কংগ্রেস-বিরোধী জেহাদে লীগের সঙ্গে যুক্ত হলেন। উপযুক্ত রণকৌশল পরিকল্পনাকারী জিন্না নিজ শিবিরকে শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী পক্ষে বিভাজন সৃষ্টির সনাতন যুদ্ধনীতিতে সাফল্যের পরিচয় দিলেন।
২৩শে ডিসেম্বর বড়লাট জিন্নাকে তাঁর ৫ই নভেম্বরের চিঠির জবাবে জানালেন যে মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনো পদক্ষেপ করা সরকারি নীতি নয়।(১৬) ১লা জানুয়ারি গান্ধীকে লিখিত এক পত্রে জিন্না ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে তাঁর ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন।(১৭) ১৯শে জানুয়ারি লন্ডনের “টাইম অ্যান্ড টাইড” পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর এক রচনায়(১৮) এই অভিমত ব্যক্ত হল যে পাশ্চাত্য ধরনের সংসদীয় গণতন্ত্র মুসলিম স্বার্থের বিরোধী। কংগ্রেসের বিরেধিতা করার জন্য জিন্না মুসলমান ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে মিলিতভাবে কর্মসূচী গ্রহণ করছেন এবং এটা তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার দ্যোতক এবং প্রশংসনীয়-পরোক্ষভাবে এই অভিমতযুক্ত গান্ধীর পত্রের জবাবে ২১শে জানুয়ারি গান্ধীকে জিন্না লিখলেন যে তাঁর পদক্ষেপের গান্ধীকৃত ব্যাখ্যা ভিত্তিহীন। তিনি আবার জানালেন যে মুসলমানরা এক পৃথক জাতি (nation) এবং বস্তুনিষ্ঠ হবার জন্য গান্ধী যেন তাঁর অহিংসা খদ্দর প্রভৃতি “বাতিক” বর্জন করেন।(১৯) ২৩শে ফেব্রুয়ারি লিনলিথগোকে একটি চিঠি লিখে দাবি জানালেন যে যুদ্ধরত ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে কোনো মুসলিম দেশ বা শক্তির বিরুদ্ধে যেন নিয়োগ করা না হয়।(২০)
ইতিমধ্যে অখিল ভারত লীগ ওয়ার্কিং কমিটির ৪ঠা ফেব্রুয়ারির সভায় ফেডারেল শাসন ব্যবস্থার বদলে পশ্চিম ও পূর্বের দুটি মুসলমান অঞ্চলে (zone) পৃথক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন বা ভারত বিভাজনের দাবি সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয় এবং এর দুই দিন পর বড়লাটের সঙ্গে দেখা করে জিন্না জানিয়ে দেন যে লীগের আগামী মাসের লাহোর অধিবেশনে তাঁরা ভারত বিভাজনের দাবি তুলবেন। বড়লাট জানান যে এ সম্বন্ধে ভারতসচিব জেটল্যন্ডের কাছ থেকে তিনি ইতিমধ্যে খবর পেয়ে গেছেন।(২১) ১৩ই মার্চ তিনি আবার বড়লাটের সঙ্গে দেখা করেন এবং “সেই সময়ে তিনি বড়লাটকে এই আশ্বাস দেন যে মুসলমানদের পূর্বস্বীকৃতি ছাড়া কংগ্রেসের সঙ্গে কোনোরকম রাজনৈতিক বোঝাপড়া করা হবে না—এই মর্মে ভরসা দিলে মুসলমানরা যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় বাধা সৃষ্টি করবে না। বড়লাট…অনুকূল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং বলেন যে তিনি জিন্নার অভিমত লন্ডনে জানিয়ে দেবেন।”(২২)
লীগের বাৎসরিক অধিবেশনে যোগ দিতে জিন্না ২২শে মার্চ একরকম অনাড়ম্বরভাবে লাহোরে উপনীত হলেন। আড়ম্বর না করার কারণ ১৯শে গোঁড়া মুসলমান আধা সামরিক প্রতিষ্ঠান খাকসারদের নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকদের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অস্ত্রসহ শোভাযাত্রা করার জন্য লাহোরের পুলিশ গুলি চালায়। হতাহতের সংখ্যা অনেক হওয়ায় শহরে তীব্র উত্তেজনা ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী স্যার সিকন্দর এমনকি জিন্নাকে লীগের অধিবেশন মুলতুবি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। জিন্না সে পরামর্শ অগ্রাহ্য করে জানান যে তাঁকে নিয়ে শোভাযাত্রা ইত্যাদি যেন করা না হয়। লাহোরে উপনীত হয়ে তিনি প্রথমে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত খাকসারদের কুশলবার্তা জিজ্ঞাসা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারা। এই পদক্ষেপের দ্বারা সাধারণ নাগরিক ও খাকসারদের প্রশংসা অর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে প্রচ্ছন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী স্যার সিকন্দরকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়া। একই উদ্দেশ্যে লীগের ঐ অধিবেশনে তিনি স্বয়ং সিকন্দরবিরোধী খাকসারদের উপর থেকে “বেআইনি” সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং তাদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করার এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
পরদিন বিকেলে লীগের প্যান্ডেলে ভারতবর্ষের নানা অঞ্চল থেকে সমবেত প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধি ও দর্শকদের সম্মুখে জিন্না তাঁর ঐতিহাসিক দ্বিজাতি তত্ত্ব ও ভারত বিভাজনের প্রস্তাবযুক্ত বক্তব্য উপস্থাপিত করেন, যার ভিত্তিতে পরদিবস লীগ তার বিখ্যাত লাহোর বা পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করে। মাত্র এর কয়েক দিন পূর্বেই (১৯শে মার্চ) বিহারের রামগড়ে নূতন কংগ্রেস-সভাপতি মৌলানা আজাদ তাঁর সভাপতির অভিভাষণে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবির পুনরুল্লেখ করার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের এক বৈশিষ্ট্য—বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্বের প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংস্কৃতি-সমন্বয়ের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখার উপর জোর দিয়েছেন। মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের দ্যোতক জিন্নার লাহোর বক্তৃতা যেন মৌলানা আজাদের বক্তব্যেরই প্রত্যুত্তর। প্রত্যুত ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে এইটাই যেন হয়ে দাঁড়ায় জিন্নার রাজনৈতিক চালের বৈশিষ্ট্য—কংগ্রেসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া রূপে নিজ ভূমিকা নির্ধারণ।
জিন্না জানতেন যে ভারত বিভাজনের যে তত্ত্ব বিগত প্রায় আড়াই বছর ধরে ক্রমশ তিনি যুক্তি দিয়ে গ্রহণ যোগ্য করার চেষ্টা করেছেন, তার প্রকাশ্য অভিব্যক্তির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তাই জনসাধারণের সামনে বক্তৃতা দেবার ব্যাপারে তাঁর যাবতীয় কুশলতা প্রয়োগ করে ঐ ভাষণ দিয়েছিলেন যার জন্য তাঁর বক্তব্যের প্রারম্ভিক অংশ ছাড়া অধিকাংশ ইংরাজিতে হলেও এবং তাঁর শ্রোতৃমণ্ডলীর অধিকাংশ তা না বুঝলেও তাঁরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো জিন্নার দু’ঘণ্টার অভিভাষণ শুনেছিলেন। জিন্নার এই বাক্‌নৈপুণ্যকে নিখুঁত করতে সাহায্য করেছিল তাঁর অভিনয়কুশলতা, পিতৃপ্রভাবে স্থায়ীভাবে রঙ্গমঞ্চে যোগ না দিলেও দীর্ঘদিনের অনুশীলনে যা তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছিল। বক্তৃতাকালে জিন্নার কণ্ঠস্বর কখনও আবেগ, কখনও উষ্মা বা অনুকম্পা, কখনও ব্যঙ্গ, কখনও বা রঙ্গবিদ্রূপে মুখর হয়ে উঠছিল। ভ্রূকুটি, তর্জনী সঙ্কেত, মুষ্টি আস্ফালন, যুক্তকরে আবেদন ইত্যাদি সহায়ক অঙ্গভঙ্গী তাঁর বক্তব্যকে শ্রোতৃমণ্ডলীর হৃদয়ে গেঁথে দিতে সাহায্য করল।(২৩) মূল বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই “ইসলামের সেবক”, “পবিত্র কর্তব্য” এবং “আমার স্বধর্মীয়দের প্রতিভা” ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক ও গোষ্ঠীগত আবেদনযুক্ত বাক্যাংশ ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি তাঁর মুসলিম শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে নিজের বক্তব্যকে অপ্রতিরোধ্য করে তুললেন।
প্রথমে কংগ্রেস ও গান্ধীর ভূমিকার তীব্র তীক্ষ্ণ সমালোচনা করার পর জিন্না বললেন যে কংগ্রেসের নূতন “টোপ”- গণপরিষদের দ্বারা ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনা — লীগ গলাধঃকরণ করবে না। কারণ যে গান্ধী তাঁকে ভাই(২৪) বলেন, তাঁর (অর্থাৎ হিন্দুদের) তিন ভোটের বদলে তাঁর নিজের মাত্র একটি ভোট। তাই তাঁর বক্তব্য হল: হিন্দু-মুসলমান সমস্যা আর ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ প্রশ্ন বা সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর ব্যাপার নয়। এই বিবাদকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করে তিনি ঘোষণা করলেন: “ভারতবর্ষের সমস্যা আন্তঃসাম্প্রদায়িক চারিত্রযুক্ত নয়। প্রকাশ্যত এটা আন্তর্জাতিক ধরনের এবং তাই অবশ্যম্ভাবীরূপে একে তদনুরূপ বিবেচনা করতে হবে। এই মূলীভূত ও মৌলিক সত্য উপলব্ধি না করা পর্যন্ত যে সংবিধানই রচনা করা হোক না কেন, তা এক দুর্বিপাকেরই সৃষ্টি করবে। তা কেবল মুসলমানদের পক্ষেই ধ্বংসাত্মক এবং ক্ষতিকারক বলে সিদ্ধ হবে না, ব্রিটিশ ও হিন্দুদের উপরও তার একই পরিণাম হবে। ব্রিটিশ সরকার যদি এই উপমহাদেশের অধিবাসীদের শান্তি ও সুখের জন্য যথার্থই আন্তরিকতাসম্পন্ন হন তাহলে আমাদের সকলের সামনে যে একমাত্র পথ খোলা আছে তা হল ভারতবর্ষকে ‘স্বয়ংশাসিত জাতীয় রাষ্ট্রে’ বিভক্ত করে প্রমুখ জাতিগুলিকে (nations) পৃথক পৃথক বাসভূমি পেতে দেওয়া।”
অতঃপর দ্বিজাতিতত্ত্বের সপক্ষে যুক্তিজাল বিস্তার প্রসঙ্গে বললেন, “একথা উপলব্ধি করা অত্যন্ত কঠিন যে কেন আমাদের হিন্দু বন্ধুরা ইসলাম এবং হিন্দুধর্মের সঠিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। প্রচলিত অর্থে এদের ধর্ম বলা চলে না। এগুলি আসলে পৃথক এবং স্বাতন্ত্র্যবিশিষ্ট সমাজ-ব্যবস্থা। হিন্দু ও মুসলমানেরা আদৌ কোনোদিন এক জাতিতে পরিণত হবে—এ এক স্বপ্ন। এক ভারতীয়তার এই ভ্রান্ত ধারণা সীমাবহির্ভূত ভাবে এতদূর শিকড় বিস্তার করেছে যে এ বর্তমানের অধিকাংশ সমস্যার মূলে এবং সময়ে যদি আমরা আমাদের ধারণার সংশোধন না করি তাহলে এর পরিণতিতে ভারতবর্ষ ধ্বংস হয়ে যাবে। হিন্দু ও মুসলমানেরা দুই ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় দর্শন, সামাজিক প্রথা ও সাহিত্যের এলাকাভুক্ত। তাদের মধ্যে না বৈবাহিক বন্ধন স্থাপিত হয়, না তারা একত্রে পান-ভোজন করেন। সত্যি কথা বলতে কি তারা দুই পৃথক পৃথক সভ্যতার অঙ্গ যার ভিত্তি প্রধানত পরস্পর সংঘর্ষরত ভাবধারা ও ধারণা। জীবনের প্রতি ও তার সম্বন্ধে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী ভিন্ন। একথাও স্পষ্ট যে হিন্দু ও মুসলমান ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে নিজ নিজ প্রেরণা সংগ্রহ করেন। তাঁদের মহাকাব্য, তার নায়ক এবং ঘটনাবলীও পৃথক। প্রায়শ একের নায়ক অপরের শত্রু এবং অনুরূপভাবে তাদের জয়পরাজয়ও অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত। এই রকম দুটি জাতিকে এক রাষ্ট্রের জোয়ালে জুড়লে এর একটি হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অপরটি সংখ্যালঘু। ঐজাতীয় রাষ্ট্রের সরকারের জন্য যে ঐক্যসূত্র রচিত হবে তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে পেতে শেষ অবধি তা ধ্বংস হবে যাবে।”
ভারত বিভাজনের পক্ষে তাঁর যুক্তি হল: “বলকান এলাকায় সাত-আটটি সার্বভৌম রাষ্ট্র আছে। অনুরূপভাবে ইবিরিয়ান অঞ্চলে পর্তুগীজ ও স্পেনীয়রা বিভক্ত। তত্রাচ এক অস্তিত্বহীন ভারতের ঐক্য ও অখণ্ড জাতীয়তার দোহাই দিয়ে এদেশে এক কেন্দ্রীয় সরকারের কথা বলা হচ্ছে যদিও আমরা জানি যে গত বারো শত বৎসরের ইতিহাসে এমন কোনো ঐক্য সাধিত হয়নি এবং এই দেশ বরাবরই হিন্দু ভারতবর্ষ ও মুসলিম ভারতবর্ষ রূপে বিভক্ত থেকেছে। আজকে যে কৃত্রিম ঐক্য দেখা যায় তার সূচনা ব্রিটিশ বিজয়ের লগ্নে এবং এ বজায়ও রয়েছে তাদের অস্ত্রের বলে।” কোনোরকম অস্পষ্টতা বা দ্বিধা-সঙ্কোচ না রেখে তিনি ঘোষণা করলেন: “মুসলিম-ভারত এমন কোনো সংবিধান স্বীকার করতে পারে না যার পরিণতি স্বতঃই হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার। গণতান্ত্রিক প্রথার নাম দিয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের একত্র করে সেই প্রথা সংখ্যালঘুদের উপর চাপিয়ে দিলে তার একটিই মাত্র অর্থ হবে এবং তা হল হিন্দু-রাজত্ব। কংগ্রেস হাইকমান্ড যে ধরনের গণতন্ত্রের জয়গান করেন তার অর্থ হল ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সবকিছুর সম্পূর্ণ বিনাশ।” হিন্দু-মুসলমানের মিলন যে অসম্ভব—এই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি লাজপৎ রায়ের উক্তি উদ্ধৃত করলেন। তাই তাঁর দাবি হল, “জাতি (nation) শব্দের যে কোনো পরিভাষা অনুসারে মুসলমানেরা একটি জাতি এবং তাদের নিজস্ব বাসভূমি, এলাকা এবং রাষ্ট্র চাই”(২৫)।
পূর্বে যেমন বলা হয়েছে—এর অনুসরণে ২৩শে মার্চ অখিল ভারত মুসলিম লীগ ভারত বিভাজনের নিম্নোদ্ধৃত প্রস্তাব গ্রহণ করল:
“…অখিল ভারত মুসলিম লীগের এই অধিবেশনের সুবিবেচিত অভিমত এই যে নিম্নোক্ত মূল নীতি অনুযায়ী না হলে কোনো সাংবিধানিক পরিকল্পনা এদেশে কার্যকরী হবে না বা মুসলমানদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে না। এই মূল নীতি হল—ভৌগোলিক দিক থেকে পরস্পর সম্বন্ধিত একম্ সমূহকে প্রয়োজনীয় আঞ্চলিক ব্যবস্থাপিতকরনের (readjustment) সহায়তায় এমনভাবে পৃথক পৃথক এলাকায় পরিণত করতে হবে যে ভারতবর্ষের উত্তর- পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মতো যেসব এলাকায় মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেগুলিকে একত্র করে “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের”(২৬) (states) গঠন করা যায় যার অঙ্গীভূত একম্ সমূহ স্বয়ং শাসিত ও সার্বভৌম হবে।”(২৭)
এইভাবে মুসলমান “জাতি”র জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবি উপস্থাপিত করে একদিকে জিন্না যেমন তাঁর অনুগামীদের চোখে পাকিস্তানের জনক ঐতিহাসিক পুরুষে পরিণত হলেন, অন্যদিকে তাঁর সমালোচকদের দৃষ্টিতে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবলতম প্রবক্তারূপে পরিগণিত হলেন।

১৯
পাদটীকা

১. ড. গোপাল (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; নবম খণ্ড; ৩৫৫-৩৫৬ পৃষ্ঠা।
২. হেইসকে লেখা লিনলিথগোর ১৭.৪.১৯৩৯-এর চিঠি। ড. গোপাল; Jwaharlal ভাগ: Nehru; প্রথম খণ্ড; ২৪০ পৃষ্ঠা।
৩. লিনলিথগো কর্তৃক জেটল্যান্ডকে লেখা ৫.৯.১৯৩৯-এর চিঠি। ড. গোপাল কর্তৃক নেহরু জীবনীর প্রথম খণ্ডের ২৫৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৪. জিন্নার সঙ্গে আলোচনার বিবরণ লিনলিথগো কর্তৃক জেটল্যান্ডকে ৯.৯.১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রেরিত এবং জিন্নার সঙ্গে আলোচনার বিবরণ ব্রাবোর্ন কর্তৃক জেটল্যান্ডকে ১৯.৮.১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রেরিত। ড. গোপাল কর্তৃক তাঁর নেহরু জীবনীর প্রথম কোন খণ্ডের ২৪০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। উলপার্ট; সমগ্রন্থ; পৃ. ১৭০ দ্র.।
৫. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১৭০ পৃষ্ঠা।
৬. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৫৮৭ পৃষ্ঠা।
৭. গ্লেনডেভন; Linlithgo; পৃষ্ঠা ১৩৮। উলপার্ট কর্তৃক সমগ্রন্থ, ১৭১ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। জিন্নার ৪.৯.১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের সাক্ষাৎকারের লিনলিথগো কর্তৃক প্রস্তুত বিবরণ। ড. গোপাল কর্তৃক তাঁর নেহরু জীবনীর প্রথম খণ্ডের ২৫৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৮. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড; ১৩০ পৃষ্ঠা।
৯. সমগ্রন্থ; ১২৯ পৃষ্ঠায়।
১০. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ২১৯-২২০ পৃষ্ঠা।
১১. জেটল্যান্ডের কাছে লিখলিথগোর ১৮.৯.১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের চিঠি।
১২. সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ (দ্বিতীয় খণ্ড); ১৪৫ পৃষ্ঠা।
১৩. ভি. পি. মেনন তাঁর The Transfer of Power in India (অতঃপর Transfer of Power রূপে উল্লেখিত); ওরিয়েন্ট লংম্যানস, দিল্লি (১৯৫৭) গ্রন্থের ৭২ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে কংগ্রেসের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সমাধানের জন্য এসময়ে (নভেম্বর ১৯৩৯) জিন্না যে পঞ্চসূত্রী প্রস্তাব দেন তার প্রথম দফায় প্রদেশগুলিতেও লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার প্রস্তাব করা হয়েছিল।
১৪. এই পর্যায়ের জিন্না-নেহরু আলোচনার জন্য ড. গোপাল (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; দশম খণ্ড; পৃ. ৩৫৫-৩৯১ দ্রষ্টব্য।
১৫. শীলা সেন; সমগ্রন্থ; পৃ. ১২৭। এর কয়েক মাস পরই অবশ্য সিদ্দিকী ক্ষমাপ্রার্থনা করে আবার লীগে ফিরে আসেন।
১৬. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ ৫৯০ পৃষ্ঠা।
১৭. সমগ্রন্থ; ৫৯১ পৃষ্ঠা।
১৮. ঐ রচনায় জিন্না এমন এক সংবিধানেরও দাবি জানান যাতে, “ভারতবর্ষে উভয় জাতি ( Nations) তাঁদের একই মাতৃভূমির শাসনকার্যের অংশীদার হতে পারেন।” লাহোর প্রস্তাব পেশ করার মাত্র দুই মাস পূর্বে “উভয় জাতির” জন্য একই সংবিধান … যার দ্বারা তাঁরা “একই মাতৃভূমির” শাসনকার্যের অংশীদার হতে পারেন—একথা বলা কৌতূহলোদ্দীপক। মুসলমান সংখ্যাগুরু প্রদেশ (যাদের সমর্থন ছাড়া লীগের চলবে না) ও সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহের (যাদের হাতে প্রত্যুত লীগের নেতৃত্ব ছিল) যে স্বার্থ সংঘাতের জন্য মুসলিম লীগ প্রথমোক্ত ধরনের প্রদেশগুলির সমর্থন পেতে পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং দ্বিতীয়োক্ত ধরনের প্রদেশের মুসলমানদের স্বার্থে রক্ষাকবচের দাবির মধ্যে দোদুল্যমান ছিল এবং জিন্না নিজের রাজনৈতিক অভীপ্সা — কেন্দ্রে মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রবক্তা হবার জন্য পূর্বোক্ত দুই পরস্পরবিরোধী ভূমিকার মধ্যে আপোসের পন্থা খুঁজতেন তার চিত্তাকর্ষক বিবরণের জন্য ডঃ আয়েষা জালালের The Sole Spokesman: Jinnah, the Muslim League and the Demand of Pakistan; কেম্ব্রিজ ইউনিভারসিটি প্রেস (১৯৮৫) পৃ. ৩৫-৬০ দ্রষ্টব্য। তাঁর নিম্নোদ্ধৃত মন্তব্যও উল্লেখনীয়: “লাহোর প্রস্তাবকে তাই একটি দর- কষাকষির বিষয় হিসাবে দেখতে হবে যা (আপাতদৃষ্টে) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের দ্বারা গৃহীত হবার উপযুক্ত ছিল ও কংগ্রেসের কাছে ছিল গ্রহণের
পৃষ্ঠা: ১৪৫

একান্ত অযোগ্য এবং শেষ অবধি ব্রিটিশের কাছেও অগ্রহণীয়। এই কারণে লীগের এই বাহ্য দাবি যে মানা হবে না তার পূর্ণ নিশ্চয়তা ছিল এর মধ্যে এবং জিন্নাও প্রত্যুত সত্য সত্য এটা চাইতেন না।”(সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৫৭)।
১৯. পীরজাদা (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; ৯৮ পৃষ্ঠা।
২০. শরীফ অল মুজাহিদ: সমগ্রন্থ; ৫৯২ পৃষ্ঠা।
২১. খলিকুজ্জমাঁ; সমগ্রন্থ; ২৩৪ পৃষ্ঠা। মুর (সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৭৩) অবশ্য বলেছেন যে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ ৫ই সেপ্টেম্বর লিনলিথগোর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে জিন্না সর্বপ্রথম ভারত বিভাজনের যৌক্তিকতার কথা বলেন।
২২. গ্লেনডেভন; Linlithgo; পৃষ্ঠা ১৯১। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১৭৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২৩. Times of India-এর উপস্থিত সংবাদাতার বিবরণী। পীরজাদা; Foundations of and Pakistan; দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৭। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১৮০ পৃষ্ঠায় (উদ্ধৃত।
২৪. আসন্ন সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসের সক্রিয় কার্যকলাপ থেকে বিদায় নেবার পাঁচ বছর পর গান্ধী নিজের আগ্রহে রামগড়ে কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের সম্বোধন করেন। এই প্রসঙ্গে ১৯শে মার্চ তিনি বলেন: “হিন্দু মুসলমান পার্শী খ্রিস্টান নির্বিশেষে আমরা সবাই আমাদের স্রষ্টার সম্মুখে সমান, আমরা সকলে একই ঈশ্বরের উপাসনাকারী। তবে কেন আমরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ করি? আমরা পরস্পরের ভাই –এমনকি কায়েদ-এ-আজমও আমার ভাই। তাঁর সম্বন্ধে আমি যা বলেছি তা আমার মনের কথা। তাঁর সম্বন্ধে কখনও কোনো তাচ্ছিল্যজনক উক্তি আমার মুখ ফস্কেও নির্গত হয়নি। আর আমি একথাও বলতে চাই যে আমি তাঁকে স্বপক্ষে আনতে চাই। জনৈক বক্তা বলেছেন যে আমি তাঁকে স্বমতে না আনা পর্যন্ত * তাঁর সঙ্গে বিবাদ করব না এবং তিনি ঠিকই বলেছেন। এমন একটা সময় ছিল যখন আমি সব মুসলমানদেরই আস্থাভাজন ছিলাম। আজ আমি সেই আস্থা হারিয়েছি এবং অধিকাংশ উর্দু সংবাদপত্রে আমার প্রতি কটূক্তি করা হয়। তবে এতে আমার খেদ জানা নেই। এতে আমার এই বিশ্বাসই পুষ্ট হয় যে মুসলমানদের সঙ্গে বোঝাপড়া ব্যতিরেকে স্বরাজ সম্ভবপর নয়।” টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; পঞ্চম খণ্ড; ৩২৩ পৃষ্ঠা।
২৫. শরীফ অল মুজাহিদ্ সমগ্রন্থ; ৪৯১-৪৯৫ পৃষ্ঠা। জিন্নার এই বক্তৃতার উপর লাহোরের মজলিশ-ই-কবীর পাকিস্তান নামক প্রতিষ্ঠানের তরুণ সম্পাদক আহমদ বশীর এবং আলীগড়ের অধ্যাপক সঈদ জাফরুল হাসান, ড. এম.এ.এইচ. কাদরীর দ্বারা রচিত স্মারকলিপির প্রবল প্রভাব ছিল। মুর তাঁর গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ১১৫ ও ১১৮- ১২২) জিন্না ও তাঁদের বক্তব্যের মধ্যে কেবল ভাবগতই নয়, এমনকি যুক্তি ও ভাষার দিক থেকেও কী গভীর সাদৃশ্য ছিল তার তুলনামূলক আলোচনা করেন।
২৬. এই রাষ্ট্রসমূহ (States) শব্দের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জন্মের যৌক্তিকতা দানা বাঁধে। পরবৎসর মাদ্রাজ সম্মেলন থেকে অঘোষিত ভাবে এর বদলে লাহোর প্রস্তাবে রাষ্ট্র (State) শব্দটি ব্যবহৃত হওয়া আরম্ভ করলেও ধুরন্ধর রাজনীতিবিশারদ জিন্না এমনকি সমালোচকদের সমালোচনার প্রত্যুত্তরেও স্বয়ং কখনও পাকিস্তানের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেননি। অন্তরঙ্গ মহলে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হলে পরিহাসের ছলে তিনি নাকি বলতেন যে বুদ্ধিমান হিন্দুরা –হয়তো বা রাজাজির মতো কুশাগ্র বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো নেতাই সে কাজ করে দেবেন। পরবর্তীকালে আমরা দেখব যে তাঁর ফর্মুলার দ্বারা প্রত্যুত রাজাজি এ কাজ করেন। জিন্না স্বয়ং সর্বপ্রথম ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর গান্ধীকে লিখিত তাঁর পত্রে রাষ্ট্রসমূহ শব্দটি সম্বন্ধে মন্তব্য করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ই এপ্রিল দিল্লিতে লীগ পরিষদ সদস্যদের সভায় আনুষ্ঠানিক ভাবে এর বদলে “রাষ্ট্র” শব্দটি স্বীকৃত হয়।
২৭. শরীর অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৪৯৫-৪৯৬ পৃষ্ঠা।

মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের ইতিহাস
২০

জিন্না কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্ব বা মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রথম প্রবক্তা নন। তবে সে প্রসঙ্গের আলোচনার পূর্বে ভারতবর্ষে ইসলামের আবির্ভাব ও তার প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে সংক্ষেপে পর্যালোচনা করে নেওয়া উচিত।
নব ধর্মপ্রচারক ও উপনিবেশ স্থাপনাকারীদের মাধ্যমে ইসলামের সঙ্গে ভারতবাসীর বিচ্ছিন্ন ভাবে পরিচয় ঘটলেও সংগঠিত শাসকশক্তির মাধ্যমে ইসলামের সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রথম অভিঘাত হয় ৭১১ খ্রিস্টাব্দে আরব সেনাপতি মহম্মদ-বিন-কাশিমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে। অতঃপর ইসলাম ধীরে ধীরে সিন্ধু প্রদেশে ব্যাপ্ত হল। একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে গজনীর মামুদের বিজয়াভিযানের মাধ্যমে পাঞ্জাব থেকে মথুরা ও সোমনাথ পর্যন্ত ভূখণ্ডের অধিবাসীরা ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হন। তবে উত্তর ভারতে ইসলামের স্থায়ী দুর্গ প্রতিষ্ঠিত হয় তুর্কী মহম্মদ ঘোরীর হাতে থানেশ্বরের পৃথ্বিরাজের পরাজয় (১১৯২ খ্রি.) এবং দিল্লি বিজয়ের পর। এর বিশ বৎসরের মধ্যে তুর্কীশক্তি বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আর এক শতাব্দীর মধ্যে দাক্ষিণাত্যের মাদুরাই পর্যন্ত অর্ধচন্দ্র তারকালাঞ্ছিত পতাকা শোভা পেতে থাকে। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরে ইসলামের প্রাদুর্ভাব হয়। অতঃপর পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত পতন-অভ্যুদয়ের মধ্যে দিয়ে ইসলামই ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান রাজশক্তির ভূমিকা পালন করে।
ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের প্রায় সিকিভাগ অধিবাসী ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে গেছেন। একাধিক কারণে এটা ঘটেছিল। বিদেশাগত বিজেতা, তাঁদের সৈন্যসামন্ত, অন্য রাজপুরুষ ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষিত ইসলাম ধর্মাবলম্বী যতই আসুন, তাঁরা এদেশের মুসলমানদের এক অকিঞ্চিৎকর অংশ মাত্র ছিলেন। মুসলিম সংখ্যাস্ফীতির প্রধান ছিল হিন্দু ভারতবাসীদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষাগ্রহণ। একথা সত্য যে এ সময়ে শাসকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয়ে জোর করে ধর্মান্তরিত করার বহু ঘটনা ঘটেছে। বেশ কিছু হিন্দু, অর্থ, পদমর্যাদা এবং রাজানুগ্রহের লোভেও মুসলমান হয়েছেন। কিন্তু ইসলাম ধর্মাবলম্বনকারীদের বৃহত্তম অংশ স্বেচ্ছায় নিজেদের ধর্মমত পরিত্যাগ করেছিলেন। জাতি (caste) ও বর্ণভেদ, ছুৎমার্গের বিচার এবং উচ্চ-নীচের বিচারে পীড়িত “নিম্নবর্ণে”র দরিদ্ররা (এঁদের মধ্যে বৌদ্ধ ও অন্যান্য মতাবলম্বীরাও পড়েন, ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির পুনরভ্যুদয়ের জন্য যাঁদের স্থান “নিম্নবর্ণে”র অন্তর্ভুক্ত হয়) ইসলামের উদার সাম্যযুক্ত সামাজিক কাঠামোর মধ্যে নিরাপদ স্থান পাবার সঙ্গে সঙ্গে রাজার ধর্মের সাযুজ্য লাভ করার গৌরব অর্জন করা বাঞ্ছনীয় মনে করেছেন। ব্রাহ্মণ্য-কাঠামোয় উপেক্ষিত প্রকৃতি পূজকরাও (animists) অনুরূপভাবে ইসলামধর্ম গ্রহণ করেছেন। বঙ্গদেশে ভূতপূর্ব বৌদ্ধরা হিন্দু সমাজের প্রত্যন্ত প্রদেশে স্থান পাবার পরও উৎপীড়িত ও নিগৃহীত হচ্ছিলেন। তাঁরা যেন ব্রাহ্মণ্য প্রভাবযুক্ত হিন্দুসমাজের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্যই ব্যাপকভাবে ইসলাম ধর্মকে আলিঙ্গন করলেন।
হিন্দুদের বিপুল সংখ্যায় ইসলামের অঙ্গনে নিয়ে যাবার কৃতিত্ব মুসলিম সাধুসন্ত এবং বিশেষ করে মরমীয়া সুফী সাধক ও তাঁদের শিষ্যদের প্রাপ্য। এঁদের মধ্যে প্রমুখ ছিলেন আজমীরের খাজা মৈনুদ্দীন চিস্তি, দিল্লির খাজা কুতুব অলদীন কাকী, শেখ ফরীদ অল-দীন গঞ্জ-ই-শকর ও হজরৎ নিজামুদ্দিন আউলিয়া এবং তাঁদের শিষ্য প্রশিষ্যবর্গ। সুফীদের মধ্যে অনেকে দর্শনের ক্ষেত্রে ইসলামের সঙ্গে হিন্দুধর্মের সমন্বয়ের প্রয়াস করেন। উদাহরণস্বরূপ মৈনুদীন চিস্তির কাছে দীক্ষিত হুসেনী ব্রাহ্মণদের কথা বলা যায়। রামানন্দ, কবীর, দাদূ এবং রজ্জবের উদার সমন্বয়মূলক শিক্ষাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়। সমন্বয় সাধনার এই প্রবাহ আকবরের মতো নৃপতি এবং দারাশুকোর মতো রাজপুত্রকেও এর প্রবক্তায় পরিণত করে। ইসমাইলীয় বা খোজাদের দশাবতারের প্রতি বিশ্বাস এবং আহমদীয়া বা কাদিয়ানীদের বিশ্বাস ও আচার-বৈচিত্র্যের কথাও স্মরণীয়। যাই হোক, রাজনীতি এবং আধ্যাত্মিকতা—উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামের কাছে পরাজিত হয়ে হিন্দুরা অংশত কূর্মবৃত্তি গ্রহণ করে নিজেদের চতুর্দিকে বিধিনিষেধের নানারকম প্রাচীর খাড়া করে আত্মরক্ষায় চেষ্টা করেন। এই কড়াকড়িও আবার হিন্দু সমাজ ত্যাগ করে মুসলমান সমাজকে পুষ্ট করার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ৷
ইসলামের অভিঘাতে ভারতীয় সমাজের উপর দ্বিতীয় যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় তা হল শঙ্করদেব, নানক এবং চৈতন্য প্রমুখ সমন্বয়বাদী ভক্তিমার্গ অনুসারী সাধকদের আবির্ভাব। তাঁদের উদার সহজিয়া দর্শন ও উপাসনাপদ্ধতি বিশেষ করে লোকায়ত স্তরে ধর্মসমন্বয়ভিত্তিক এক মিশ্র (composite) সংস্কৃতির প্রবর্তন করে। এই ধারা যে কেবল হিন্দু সমাজ থেকে ইসলামের শিবিরে যাওয়াই বন্ধ করে অথবা ইসলামের অন্তরঙ্গ হয়ে স্বল্প সংখ্যায় হলেও মুসলমান সমাজ থেকে দীক্ষিত হিন্দু সংগ্রহ করে তাই নয়—এই ধর্মসমন্বয় এবং সংস্কৃতিসমন্বয় পরবর্তীকালে ভারতীয়ত্বের ভিত্তিভূমি রূপে পরিগণিত হয়।(১)
ভারতীয় সমাজে ইসলামের পূর্বোক্ত প্রকারে ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও এদেশের মুসলমানরা কোনোক্রমেই সমশ্রেণীভুক্ত (homogenous) ছিলেন না।(২) এর সর্ব পুরাতন অংশ ছিল বহিরাগত আরব, তুর্কী, পাঠান, মোগল, আফগান ও পারসীক প্রমুখ অভিযানকারী ও তাঁদের সহযোগী ও পরিবার-পরিজনবর্গ। সংখ্যালঘু হলেও এঁরাই ছিলেন মুসলমান সমাজের অভিজাত সম্প্রদায়। এঁরা প্রধানত ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। মুসলমানদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশের উদ্ভব বিদেশাগত অভিযানকারী, ভাগ্যানুসন্ধানপ্রয়াসী এবং তাঁদের সহায়কদের সঙ্গে স্থানীয় মহিলাদের মিলনের ফলে। ঐ সুদূর অতীতে অত দুর্গম পথ অতিক্রম করে পর্দানসীন মুসলমান মহিলারা কমই এসেছিলেন এদেশে। সুতরাং বিদেশাগত অভিজাতদের প্রকৃতির নিয়মে এদেশ থেকেই জীবনসঙ্গিনী গ্রহণ করতে হয় এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততিরা ভারতীয় মুসলমান সমাজের একটি বিশিষ্ট উপাদানে পরিণত হন। এঁদের অবস্থিতি স্বাভাবিক কারণে এদেশের সর্বত্র। পরবর্তীকালে ভারতীয় মুসলমানদের নেতৃত্বের বৃহৎ অংশ এসেছিল সম্ভবত এই অংশ থেকে। তবে পূর্বেই যেমন বলা হয়েছে, এদেশের অধিকাংশ মুসলমান ধর্মান্তরিত হিন্দু, বৌদ্ধ বা প্রকৃতিপূজক এবং পূর্ব থেকেই এঁরা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিলেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দেখা যায় যে ভারতবর্ষের সর্বত্র বিরাজিত এই বিপুলসংখ্যক মুসলমানদের মধ্যে সর্ববৃহৎ অংশ হল কৃষক, কৃষি-শ্রমিক এবং শিল্পী কারিগর সম্প্রদায়। এঁরা হলেন মুসলমান সমাজের ভিত্তিভূমি। মুসলিম সমাজের শিখরদেশে ছিলেন অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক জমির মালিক ও রাজকর্মচারীদের অভিজাত সম্প্রদায়। মাঝখানে অবস্থিতি একান্ত স্বল্পসংখ্যক মধ্যবিত্ত বৃত্তি অবলম্বনকারী ব্যক্তিরা। মুসলিম মধ্যবিত্তদের সংখ্যাল্পতার কারণ ছিল দ্বিবিধ। প্রথমত একটু যোগ্য ব্যক্তি হলেই মুসলমান শাসক এবং অভিজাতদের বদান্যতায় তিনি অতি দ্রুত উপরে উঠার সুযোগ পেয়ে যেতেন। দ্বিতীয়ত তাঁদের হিন্দু মধ্যবিত্তদের সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হত। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে মুসলমান ধর্মীয়দের শাসনের অবসানের সূচনা হয় এবং স্বভাবতই তাই অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সমাজকে অতঃপর গভীর সঙ্কট ও চাপের সম্মুখীন হতে হয়।
শাসনক্ষমতা হস্তচ্যুত হবার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতম সরকারি পদসমূহ কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের করায়ত্ত হয় এবং নিম্নতর পদের অধিকাংশ ইংরেজ বণিকদের সহায়করূপে হিন্দুরা দখল করে। ভূতপূর্ব শাসক এবং তাঁদের অনুগ্রহপুষ্ট মুসলমান অভিজাতদের পক্ষে তাই হয় অতীতের শাসিত সম্প্রদায়ের সদস্য হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা, অথবা আহত অহমিকার জন্য নূতন শাসকদের থেকে দূরে সরে থাকা ছাড়া গত্যন্তর রইল না। কিন্তু অন্ন-সমস্যার এতে সমাধান হয় না এবং হৃত মান-মর্যাদাও পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা দেখা দেয় না। উপরন্তু কোম্পানি ভূমি-ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং শেষ অবধি ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয় তার ফলেও বহুসংখ্যক জমির মধ্যস্বত্বভোগী অভিজাত মুসলমান উপার্জনের একমাত্র উপায় থেকে বঞ্চিত হয়ে আর্থিক সঙ্কটে পতিত হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি বিদ্বিষ্ট হন। কিছুদিন পরই অতীতের সরকারি ভাষা ফার্সীর বদলে সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসাবে ইংরাজির প্রবর্তন হয়। নূতন শাসনকেন্দ্রের আশেপাশের হিন্দুরা অতি শীঘ্র এ ভাষা শিখে সরকারি চাকরি ইত্যাদির ক্ষেত্রে আরও সুবিধা করে নিলেও মুসলমান অভিজাত ও মধ্যবিত্তরা অতীত গৌরবের সঙ্গে যুক্ত নিজেদের ভাষা ছেড়ে বিজাতী ও বিধর্মী বিজেতাদের ভাষা শেখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেন না। সুতরাং জীবন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাঁরা আরও পিছিয়ে পড়েন। ইসলামের উম ও বিকাশের কেন্দ্র আরব ও পারস্য দেশেও কালপ্রবাহে ধর্মের প্রথম দিকের তেজ ও উদ্দীপনা আর নেই। সুতরাং তার গরবে ভারতীয় মুসলমানদের আত্মগর্ব তৃপ্ত করার পথও অবরুদ্ধ।
“উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বঙ্গের সংবাদপত্রসমূহে এবং বিশিষ্ট হিন্দু নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মুসলমান শাসনের প্রতি তীব্র নিন্দা বর্ষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ শাসন-ব্যবস্থার প্রতি উৎসাহব্যঞ্জক একরকম সানন্দ অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়। দেশ যে সমস্ত সমস্যার দ্বারা পীড়িত ছিল তার প্রায় সবগুলির জন্য মুসলিম শাসনকে দায়ী করা হয়। হিন্দুরা নূতন ব্যবসার দ্বারা সর্বাধিক লাভান্বিত হন…। উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের মনে হিন্দুদের সম্বন্ধে একটা অনীহার ভাব সৃষ্টি হয় এবং তার প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুরাও মুসলমানদের সম্বন্ধে বীতস্পৃহ বোধ করেন….। বৃত্তি ও ক্ষমতাচ্যুত মুসলমান অভিজাত সম্প্রদায় এবং শিক্ষিত মুসলমানরা একরকম মরীয়া হয়ে নিজেদের ভিতর একটা বিদ্রোহের ভাব লালন করা আরম্ভ করেন এবং মুসলমান কৃষক-সম্প্রদায়কে মুসলিম গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদের সঙ্গে যোগদান করার আহ্বান জানান। তাঁদের বক্তব্য ছিল—এই পন্থাতেই স্বদেশীয়দের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব যা তাঁদের নতুন জমিদারের শোষণ থেকে পরিত্রাণ করবে।”(৩)
কয়েক শতাব্দী ভারতবর্ষে হিন্দুদের পাশাপাশি থাকার ফলে এদেশে ইসলামের
পৃষ্ঠা: ১৫০

উপরও দ্বিবিধ প্রতিক্রিয়া হয়। ইসলাম এদেশে এসে স্বাভাবিক নিয়মে হিন্দুধর্ম ও সমাজকে প্রভাবিত করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর সঙ্গে সুফী প্রভাব যুক্ত হয়ে এক হিন্দু মুসলমান মিলিত সংস্কৃতির প্রবর্তন করে যার প্রতি ইতিপূর্বেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এছাড়া এক ধরনের জাতিভেদ প্রথা বা উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, মাজার, কদম রসুল, হজরতবাল বা ঐজাতীয় প্রতীকের উপাসনা, যা মূল ইসলামে ছিল না—তাও এদেশের মুসলমানদের মধ্যে স্বীকৃতিলাভ করে। অপর দিকে পূর্বোক্ত সমন্বয় সাধনার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার তারই পাশাপাশি ইসলামকে শুদ্ধ নিষ্কল্ক রাখার ও বার বার কোরান ও হদিসের মূল প্রতি মুসলমান সমাজকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রবণতাও দৃষ্টিগোচর হয়।(৪) ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বার বার ভারতীয় ইতিহাসের গতিপথে কখনও এর প্রথমোক্ত কখনও বা দ্বিতীয়োক্ত প্রবণতার প্রাবল্য দেখা গেছে।
বিচ্ছিন্নতাবাদ ও দ্বিজাতিতত্বের আধুনিক ইতিহাস জানতে আমরা অতঃপর ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রত্যাবর্তন করব। নূতন প্রাণশক্তিতে উদ্বেল যে ইসলামের অভিঘাতে একদা ভারতীয় সমাজে একটা প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি হয় কালক্রমে তা ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক দিক থেকে মোগল শক্তির শেষ যুগ। মারাঠা ও শিখ শক্তির উদয় হয়েছে এবং অন্তরাল থেকে ব্রিটিশ শক্তি আবির্ভূত হয়ে বণিকের মানদণ্ডের অন্তরালে পূর্ণ রাজদণ্ড রূপে আত্মপ্রকাশের প্রহর গুনছে। অনতিবিলম্বে তাদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা- সংস্কৃতি এদেশকে প্লাবিত করবে।
সিপাহী বিদ্রোহ পূর্ব ভারতে মুসলিম হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের প্রথম উল্লেখযোগ্য আন্দোলন হয় আমাদেরই বঙ্গদেশে। ফরিদপুর জেলার মৌলভী শরিয়তউল্লা দীর্ঘ বিশ বৎসর কাল আরব দেশে অতিবাহিত করে প্রত্যাবর্তন করার পর ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তাঁর ফরায়েজী আন্দোলন মারফৎ মুসলমানদের কট্টর ইসলামনিষ্ঠ হয়ে নিজেদের অবস্থার সংস্কার সাধনের পরামর্শ দিলেন। তাঁর পুত্র দুদু মিঞাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজ অনুগামীদের জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেন। তবে তাঁর আন্দোলনের এই অর্থনৈতিক দিক সম্ভবত জমিদারদের বৃহদংশ হিন্দু হবার জন্য। জৌনপুরের শেখ করামৎ আলীও এমনি এক কট্টর ইসলামী আন্দোলন প্রবর্তন করেন। চল্লিশ বছর একটানা পূর্ববঙ্গে নৌকাযোগে সদলবলে সফর করে তিনি আসাম ও বঙ্গে গোঁড়া ইসলামের প্রচার করেন।
ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রবর্তক রায়বেরিলীর সৈয়দ আহমদের (১৭৮৬-১৮৩১ খ্রি.) প্রভাব অবশ্য আরও ব্যাপক ছিল। তিনি অনুপ্রাণিত হন ইসলামী ধর্মদর্শনের অদ্বিতীয় পণ্ডিত দিল্লির শাহ-ওয়ালি-উল্লা (১৭০৩-১৭৬২ খ্রিস্টাব্দ) দ্বারা। বঙ্গবিহার থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসনের বহির্ভূত শিখ-শাসিত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলকে দার-উল-হারব বা কাফের-শাসিত দেশ বিবেচনা করে তাঁর জেহাদ এবং তা সম্ভব না হলে মুজাহিদদের হিজরতের বাণী তাঁকে মুসলমান সমাজে জনপ্রিয় করে তোলে। আধুনিক ধ্যান-ধারণা গ্রহণ করার পরিবর্তে এই সন্নীতিপরায়ণ সংস্কারক অতীতে ফিরে যাওয়াকেই বাঞ্ছনীয় মনে করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল: “…মুসলমান সমাজকে আভ্যন্তরীণ অবক্ষয়ের প্রভাবমুক্ত করা এবং দেশে মুসলিম সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা… তিনি এক পৃথক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেন কারণ তাঁর মতে ইসলাম ও তার প্রথা-পদ্ধতির পুনরুভ্যুদয়ের জন্য এ একান্ত অপরিহার্য।”(৫)
নেশন স্টেটের মানসিকতা সে যুগের ভারতে গড়ে না উঠলেও স্বভাবতই এই পৃথক হবার বা থাকার মানসিকতা ভারতীয় সমাজের বৃহত্তম অংশ হিন্দুদের কাছে প্রীতিপদ মনে হয়নি। শিখ রাজত্বকে দারু-উল-হারব ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনার জন্য স্বভাবতই শিখরাও মুসলমানদের প্রতি অপ্রসন্ন হন। তাছাড়া ওয়াহাবী জেহাদের শিকার হিন্দুদেরও হতে হয় এবং শিখ সাম্রাজ্য ইংরেজদের করায়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশদের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে পুষ্ট(৬) ওয়াহাবী জেহাদীদের হাত থেকে হিন্দুরা রক্ষা পায়নি। এর পরিণামে মুসলমানরা দেশের মূল ধারা থেকে আরও দূরে সরে গেলেন।
সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজদের নীতিতে আরও একটা পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হল। বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমান অংশ গ্রহণ করলেও ইংরেজদের আক্রোশটা প্রধানত পড়েছিল মুসলমানদের উপর। আইনত ভারতসম্রাট বাহাদুর শাহকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহীরা নিজেদের কাজকে নীতিসঙ্গত রূপ দেবার চেষ্টা করেছিল। বিদ্রোহের দ্বারা প্রভাবিত বৃহত্তম অঞ্চল অযোধ্যার শাসক নবাবও ছিলেন মুসলমান। এছাড়া ছোট বড় আরও অনেক বিদ্রোহের নেতাও ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এইসব কারণে নূতন শাসক ইংরেজদের দমননীতি মুসলমান অভিজাত সম্প্রদায়ের উপর পড়ে। অতঃপর তাঁদের তফাৎ রাখাই হয় ব্রিটিশ নীতি।
মুসলমান অভিজাত আশ্রফ শ্রেণীর নূতন শাসকবর্গ কর্তৃক তাঁদের পরিহার করে চলার এই নীতি বুঝতে বিলম্ব হয়নি। তাঁরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে তাঁরাই স্বাধীন ভারতের শেষ শাসক সম্প্রদায় এবং তাই সঙ্গত কারণেই উড়ে এসে জুড়ে বসা বিদেশিদের অপসারণের পর তাঁদের হাতেই দেশের ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়া উচিত। ইংরেজদের সহচর হিসাবে হিন্দুরা তাঁদের উপর কর্তৃত্ব করছেন যদিও এর পূর্বে এই অধিকার ছিল কেবল তাঁদেরই। ভবিষ্যতে হিন্দুদের দ্বারা শাসিত হতে হবে—এই আতঙ্কও মুসলমান অভিজাতদের মনে বাসা বাঁধল। কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে আত্মমর্যাদাজ্ঞান এবং অভিমান- চালিত হয়ে তাঁরাও ইংরেজদের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে থাকার মানসিকতা ও অতীত কণ্ডূয়নবৃত্তি গড়ে তুললেন। ইংরাজি শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণের ধার দিয়ে না গিয়ে তাঁরা মাদ্রাসা-মক্তবের উর্দু-আরবী-ফার্সী ভিত্তিক শিক্ষা-সহবতকেই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান করলেন। আর চোখের সামনে দেখতে লাগলেন যে ইংরেজ শাসকদের প্রসাদপুষ্ট এবং তাদের জ্ঞান বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি গ্রহণকারী হিন্দুরা কেমন সম্পন্ন ও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছেন। এর উপর ফার্সীর পরিবর্তে ইংরাজিকে রাজকার্যের ভাষা করায় এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন ও লাখেরাজ সম্পত্তির অধিকার বাতিলের ফলে মুসলমান অভিজাতরা শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আর্থিক—উভয় ক্ষেত্রেই মার খেলেন। উপেক্ষার জন্য একদিকে অবরুদ্ধ ক্ষোভ ও দেশের মূল প্রবাহ থেকে সরে থাকা এবং অন্যদিকে হিন্দুদের প্রতি ঈর্ষা ও ভয় সিপাহী বিদ্রোহ- উত্তর মুসলমান অভিজাত সম্প্রদায়ের মানসকিতার ভিত্তিভূমি হয়ে উঠল। সত্য কাল্পনিক যা-ই হোক, পূর্বোক্ত মুসলিম মানসিকতা পরবর্তী এক শতাব্দীকালের হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
অভিজাতরা কুর্মবৃত্তি গ্রহণ করায় সাধারণ মুসলমানদের নেতা হয়ে দাঁড়ালেন যুগ এবং কালপ্রবাহ সম্বন্ধে অজ্ঞ দূরদৃষ্টিবিহীন সঙ্কীর্ণচেতা গোঁড়া ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ। সেই সব নেতাদের আদর্শ ছিল ফরায়াজী ও ওয়াহাবী আন্দোলনের তত্ত্বদর্শন। তাঁদের ধারণা ছিল— গোঁড়া ইসলামী আচার-আচরণ থেকে বিচ্যুতিই মুসলমানদের পতনের কারণ এবং কোরান- হদীস-সম্মত অতীতে ফিরে গেলেই তাঁদের গৌরব-রবির পুনরুদয় ঘটবে। তদনীন্তন মুসলমান সমাজের অবস্থা সম্বন্ধে এক মুসলমান পণ্ডিতের নিম্নোদ্ধত মন্তব্য উল্লেখযোগ্য:
“যে সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থের নির্দেশ হল মানুষের মধ্যে সাম্য এবং মানুষ এই ধরাতলে ঈশ্বরের প্রতিনিধি—একথা বিশ্বাস করা, সেই সম্প্রদায় আপন সিদ্ধান্ত ও ঐতিহ্যে নিজেদের এই পরিমাণ বেঁধে ফেলে যে ব্যক্তির যাবতীয় উদ্যম-অভিক্রম তিরোহিত হয়ে তাকে সম্পূর্ণরূপে গোষ্ঠীপতির উপর নির্ভরশীল করে তুলল(৭)
কূপমণ্ডুকতা পরিহার করে মুসলমান সমাজকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ শাসনের সুফলের অংশীদার হবার জন্য যে দুই মুসলমান নেতা সর্বপ্রথমে আহ্বান জানালেন তাঁরা হলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁ এবং সৈয়দ আমীর আলী। উভয়েই জাতীয়তাবাদী বা সকল সম্প্রদায়ের ভারতীয়দের নেতারূপে জনসেবামূলক জীবনের সূত্রপাত করলেও অনতিবিলম্বে নিজেদের প্রয়াস কেবল স্বধর্মীয়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করেন। আমীর আলী ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ আদালতের বিচারপতি হবার তেরো বৎসর পূর্বে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট্রাল ন্যাশন্যাল মহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এইটিই মুসলমানদের প্রথম উল্লেখযোগ্য সংগঠন যা তাঁদের সমস্যাবলী সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা ও পথপ্রদর্শনের প্রয়াস করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাখাযুক্ত এই প্রতিষ্ঠানে প্রথম দিকে কয়েকজন হিন্দু ও ইউরোপীয় সদস্য থাকলেও, “নিজের লক্ষ্য ও কার্যকলাপের দিক থেকে এটি প্রধানত ছিল একটি মুসলিম প্রতিষ্ঠান। তাই এর বিস্তৃত ভিত্তি সত্ত্বেও এই প্রতিষ্ঠান মুসলমানদের হিন্দুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ হয় এবং পরোক্ষ ও অচেতনভাবে তাঁদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা গড়ে তোলার সহায়ক হয়।”(৮)
স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁ (১৮১৭-১৮৯৮ খ্রি.) স্বয়ং ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও তাঁর দূরদৃষ্টিবলে পাশ্চাত্য শিক্ষার মূল্য উপলব্ধি করেছিলেন বলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে নিজ সম্প্রদায়ের ভিতর এর প্রবর্তনের জন্য অদ্বিতীয় প্রয়াস করেন। দিল্লির এই অভিজাত মুসলমান কুড়ি বছর বয়সে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি নিয়েছিলেন এবং অধস্তন বিচারকের পদে উন্নীত হন। তিনি পাশ্চাত্যের উন্নতির অন্যতম কারণ বিজ্ঞানর প্রবক্তা ছিলেন। পয়গম্বরের উপদেশ এবং কোরানের প্রামাণ্যতা মেনে নেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যুক্তিবাদকেও মনুষ্যজীবন ও কর্মে উপযুক্ত স্থান দেন। তাঁর ভূমিকা ছিল একদিকে মুসলিম গোঁড়ামির পৃথক থাকার মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াই এবং তার সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যপ্রবাহে মুসলিম সমাজকে প্রবাহিত হয়ে যেতে না দেওয়া। সঙ্গত কারণেই তাঁকে ভারতীয় মুসলমানদের নবজাগরণের জনক বলা হয়ে থাকে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের পক্ষাবলম্বন করার জন্য তাঁকে যথেষ্ট নিগ্রহ সহ্য করতে হয়। ইংরেজ রাজত্বকে তিনি দার-উল-ইসলাম বা শান্তির শাসন ব্যবস্থা বিবেচনা করতেন। এই সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে ইংরাজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুযোগ নিয়েই কেবল মুসলমানরা নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে পারে—এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। স্বসম্প্রদায়ের বিকাশের জন্য তাই ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আলীগড়ে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বীজ মহমেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজের প্রতিষ্ঠা করেন। যা ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। তিনি ইংরেজদের মন থেকে এই ধারণা দূর করার চেষ্টা করেন যে মুসলমানরাই সিপাহী বিদ্রোহের প্রধান নায়ক। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছাকাছি এনে তাঁদেরও হিন্দুদের মতো শাসকদলের প্রসাদপুষ্ট হবার সুযোগ দেওয়া। প্রথম দিকে (১৮৬৭-১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ) তিনি দেশের হিতসাধনে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রবল প্রবক্তা ছিলেন এবং উভয় সম্প্রদায়কে নিজের দুই চক্ষুর সঙ্গে তুলনা করতেন। তাঁর আলীগড় কলেজে হিন্দুরাও অর্থসাহায্য করেন এবং কোনোরকম ভেদভাব না করে যথেষ্ট সংখ্যক হিন্দু ছাত্র ও অধ্যাপক গোড়ায় ঐ কলেজে ছিলেন।
কিন্তু ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের পর তাঁর ভূমিকা পরিবর্তিত হল। এর সূত্রপাতের আভাস পাওয়া যায় বড়লাটের কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠানসমূহে ষোল আনা নির্বাচন ব্যবস্থার বদলে সরকার কর্তৃক এক-তৃতীয়াংশ মনোনয়নের অধিকারবিশিষ্ট বিলের সমর্থন প্রসঙ্গে। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি তিনি এ সম্বন্ধে দীর্ঘ বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, “…ভারতবর্ষের বর্তমান সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা কয়েক শতাব্দীর স্বৈরতন্ত্র ও কুশাসনের ইতিহাসের পরিণাম। এ হল জাতির (race) উপর জাতির, ধর্মের উপর ধর্মের প্রভুত্বের পরিণতি। জনসাধারণের ঐতিহ্য ও অনুভূতি এবং তাদের বর্তমান আর্থিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহুল পরিমাণে অতীত ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত। ব্রিটিশ শাসনের মানবীয় পরিণাম ব্রিটিশ আধিপত্যের পূর্ববর্তীকালের বিবাদ ও দ্বন্দ্বের স্মৃতি ভারতবর্ষ থেকে এখনও মুছে ফেলতে সক্ষম হয়নি। ভারতবর্ষ এক মহাদেশ বিশেষ এবং এদেশে বিভিন্ন জাতি (race) ও বিশ্বাসের বিপুল সংখ্যক অধিবাসীর বসতি। ধর্মীয় সংগঠনসমূহের কঠোরতা এমনকি প্রতিবেশীদেরও পরস্পর থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। জাতিভেদ প্রথা এখনও প্রবল ও শক্তিশালী। একই জেলার অধিবাসীদের মধ্যে নানা বিশ্বাস এবং বিভিন্ন জাতি (Nationality) দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কোনো এক গোষ্ঠীর হাতে যদি ধনসম্পত্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্য থাকে তবে অপর গোষ্ঠীর মধ্যে আছে বিদ্যার প্রচলন ও তজ্জনিত প্রভাব।…এমতাবস্থায় একথা অস্বীকার করা কঠিন যে ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রভূত আয়াসসাধ্য এবং এই প্রক্রিয়ায় সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকিও আছে।”(৯)
অতঃপর তিনি কেবল মুসলমানদের নেতা হয়ে পড়লেন। মুসলমানরা এক স্বতন্ত্র নেশন বা জাতি এবং তাঁদের নবগঠিত (১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ) ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে পৃথক থেকে ইংরেজদের প্রীতি অর্জনের মাধ্যমে স্ব-সম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধন করা উচিত ইত্যাদি হল তাঁর বক্তব্য। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে নিজ অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে স্যার সৈয়দ সুস্পষ্টভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রোৎসাহন দিয়ে বলেন, “এই পরিস্থিতিতে মুসলমান ও হিন্দু এই দুই জাতি (nations) একই সিংহাসনে একভাবে ক্ষমতা ভোগ করবেন—এ কি সম্ভব? সুস্পষ্টভাবে এ অসম্ভব। এদের মধ্যে একটিকে অপরের উপর বিজয়ী হয়ে বিজিতকে ধরাশায়ী করতে হবে। উভয়েই সমভাবে থাকতে পারে এই আসা পোষণ করা অসম্ভব এবং অভাবনীয় ইচ্ছার দ্যোতক।”(১০) ইংরেজদের হাত থেকে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা আসার অর্থ মুসলমানদের উপর সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শাসন— এই যুক্তি দেখিয়ে তিনি কোনোরকম শাসন-সংস্কার এবং বিশেষ করে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন-ব্যবস্থার দাবিরও বিরোধিতা করতেন এবং ইংরেজ শাসন চিরস্থায়ী হোক চাইতেন।(১১) স্যার সৈয়দ প্রভাবিত আলীগড় গোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবীবর্গ যাঁরা সে সময়ে এবং পরেও মুসলিম সমাজকে প্রভাবিত করেছিলেন তাঁরা হলেন শিক্ষাব্রতী মৌলভী নাজির আহমদ, মৌলভী জাকাউল্লা, ইউসুফ আলী, কবি আলতাফ হোসেন হালি এবং পাটনার পণ্ডিত ও বিদ্যোৎসাহী খুদাবকস প্রমুখ। আলীগড়গোষ্ঠীর অপর এক নেতা ভকির-উল-মুল্ক এবং কলকাতার আমীর আলীর সহায়তায় স্যার সৈয়দ তাঁর নূতন ভূমিকা পালন করতে লাগলেন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে একদিকে ওয়াহাবী আন্দোলনের অবলুপ্তি এবং অন্যদিকে ইংরেজ রাজত্ব দার-উল-হারব নয়, দার-উল-ইসলাম ও সেই কারণে তার সঙ্গে সহযোগিতা করা কতর্ব্য—এই মর্মে মৌলানা করামত আলী জৌনপুরীর ফতোয়া স্যার সৈয়দের ধারাকে পুষ্ট করল। তাঁদের মতো মুসলমান সমাজের অগ্রণীদের এইভাবে স্বীয় সম্প্রদায়কে ভারতীয়দের তদানীন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার প্রয়াস যে ফলবতী হবে এতে আর আশ্চর্যের কি আছে? বিশেষ করে অভিজাত ও মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজে যখন হিন্দু-বিদ্বেষ ছিলই। এ সম্বন্ধে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে “ইসলাম প্রচারক” নামক একটি বাংলা পত্রিকার মুসলমানদের তরফ থেকে প্রকাশিত একটি বিবৃতির তাৎপর্য অনুধাবনীয়। বিবৃতির অভিমত হল—ব্রিটিশ শাসনে মুসলমানেরা নিঃসংশয়ে অসীম শান্তি ও সুখে বসবাস করছেন।(১২)
স্যার সৈয়দ প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন-ব্যবস্থা ছাড়াও কংগ্রেসের ভারতীয়দের সিভিল সার্ভিসে নেবার দাবিরও বিরোধী ছিলেন এবং এমনকি দেওবন্দের মুসলমান নেতাদের সেই ফতোয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন যাতে মুসলমানদের বলা হয় যে ইহজাগতিক ব্যাপারে হিন্দুদের সঙ্গে সহযোগিতা করা চলতে পারে।(১৩) (অবশ্য উক্ত ফতোয়ায় এও বলা হয়েছিল যে মুসলমানদের স্যার সৈয়দের কার্যকলাপের সঙ্গে সহযোগিতা করা বাধ্যতামূলক নয়।) লখনউ-এ প্রদত্ত ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের দেড়ঘণ্টার ওজস্বিনী ভাষণে স্যার সৈয়দ মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদকে দৃঢ়মূল করেন। কখনও কখনও তিনি ইসলামের সনাতন তলোয়ারের ভাষার শরণ নেবার হুমকি দেন। তাঁর পূর্বোক্ত দুই সহকর্মী এবং অন্যান্য ভাবশিষ্যরা ও মুসলমান সমাজের অন্যান্য প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ তাঁর চতুষ্পার্শ্বে সমবেত হয়ে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদকে আরও পুষ্ট করেন।
হিন্দু প্রভুত্বের ভয় যে একেবারে অমূলক ছিল তাও বলা চলে না। ঐ সময়ে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে মুসলমানেরা যেসব এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। এই কারণে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের পুণা মিউনিসিপ্যালটির নির্বাচনে মুসলমানরা আদৌ অংশগ্রহণ করেননি। তাঁদের আশঙ্কা হয়েছিল যে তাঁরা একটি আসনও পাবেন না। মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক (বিধান) সভার নির্বাচনে হিন্দুদের তুলনায় মাত্র অর্ধেক আসন পান। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার যে দাবি উঠছিল তার মূলে রয়েছে মাথাপিছু একটি করে ভোট। এ পথে তো সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শাসনই চিরস্থায়ী হবে এবং এক কালের শাসক মুসলমানদের তাঁদের অধীন হয়েই বরাবর থাকতে হবে। সুতরাং এ পথে মুসলিম আত্মাভিব্যক্তির প্রকাশ কি করে সম্ভব?
ক্রমবর্ধমান এই বিচ্ছিন্নতাবাদের(১৪) চূড়ান্ত রাজনৈতিক রূপ হল ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত এবং লর্ড মিন্টোর কাছে আগা খাঁর মুসলিম প্রতিনিধিমণ্ডল
পৃষ্ঠা: ১৫৫

নিয়ে যাওয়া। এ সম্বন্ধে আগা খাঁর নিম্নোক্ত স্বীকারোক্তি স্মরণীয়: “লর্ড মিন্টো কর্তৃক আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হল পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্বন্ধে যেসব বিভিন্ন প্রস্তাব করেছেন তার ভিত্তি স্থাপিত হওয়া। এর চূড়ান্ত অপরিহার্য পরিণতি হল ভারত বিভাজন এবং পাকিস্তানের সৃষ্টি।”(১৫)
এ প্রসঙ্গের উপর যবনিকা টানার পূর্বে একটি সঙ্গত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবার প্রয়াস করা হবে। প্রশ্নটি হল—১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ যখন ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক আশা- আকাঙ্ক্ষার দ্যোতক ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় চলছে তখন থেকে স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁর ভূমিকায় এই আমূল পরিবর্তন ঘটার অন্তর্নিহিত কারণ কি? তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এবং কর্মসূচীর বৈশিষ্ট্য এ প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ উত্তর দিতে অক্ষম। এর উত্তর মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ণনাপ্রসঙ্গে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে—আলীগড় কলেজের প্রথম ইংরেজ অধ্যক্ষ থিয়োডর বেক্ (১৮৮৩-১৮৯৯)-এর ভেদনীতি প্রচারের কুশলী প্রয়াস। তাঁর পরবর্তী দুই ইংরেজ অধ্যক্ষ থিয়োডর মরিসন (১৮৯৯-১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ)) এবং ডবলু. এ. জে. আর্চবোল্ডের (১৯০৫) ভূমিকাও প্রথম জনেরই অনুরূপ ছিল—একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কারণে স্বভাবতই কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউমের সেই সৎপরামর্শের (ভারতবর্ষের অবস্থা সঠিকভাবে বোঝার জন্য উপযুক্ত মানসিক প্রশিক্ষণ লাভ করুন এবং ‘মুসলমানদের অংশবিশেষের একটি গুপ্ত গোষ্ঠীকে।(১৬) সন্তুষ্ট করার প্রবণতা ত্যাগ করুন) প্রতি থিয়োডর বেক্ কর্ণপাত করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি।
একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে বলে রাখা ভাল যে পূর্বে যেমন আমরা দেখেছি যে দেওবন্দ গোষ্ঠীর নেতারা একদা বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরোধিতা করেছিলেন, ভারতীয় মুসলমানদের অপর একদল নেতাও সেই সময়ে সৈয়দ আহমদের বিচ্ছিন্নতাবাদের দ্বারা প্রভাবিত হননি। এর মধ্যে প্রধান হলেন কংগ্রেসের তৃতীয় অধিবেশনের সভাপতি বদরুদ্দীন তৈয়বজী ও তাঁর সগোত্রীয়েরা। জনৈক শিক্ষাবিদের নামও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় এবং তিনি হলেন আলীগড়ের ফার্সীর অধ্যাপক মৌলানা শিবলি, তিনি সাম্প্রদায়িকতার কট্টর বিরোধী ছিলেন। মুসলমানরা জাতি অথবা এমনকি নিজেদের কল্যাণের জন্যও অগ্রণী হয় না অথচ “তাঁদের কাছে ধর্মের নামে আবেদন করে দেখুন কী বিপুল সাড়া পাওয়া যাবে!”(১৭)— এ নিয়ে তাঁর ক্ষোভের সীমা ছিল না। আরও অনেক মুসলমানও এইভাবে ভাবিত ছিলেন। কিন্তু সে বিষয় আপাতত আমাদের আলোচ্য নয়।
জিন্না-পূর্ব মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের আলোচনা প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই প্রবণতার প্রধান বাহন মুসলিম লীগের ভূমিকাও সংক্ষেপে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। স্যার সৈয়দ ও সমভাবে ভাবিত গোষ্ঠীর প্রভাবে মুসলমান অভিজাত সম্প্রদায় দেশের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাপক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসের প্রতি বিরূপ ছিলেন। একই কারণে মুসলিম জনমতের বৃহৎ অংশ বঙ্গভঙ্গের বিরোধ সহ তাবৎ সরকার-বিরোধী আন্দোলন সম্বন্ধেই নিস্পৃহ ছিল। এইভাবে কংগ্রেসকে তার ধর্মনিরপেক্ষ চারিত্রধর্ম সত্ত্বেও নিজেদের অসহযোগিতার জন্য প্রধানত হিন্দুসংগঠন রূপে গড়ে উঠতে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু চারিত্রধর্মের জন্য তার বিরূপ সমালোচনাও করতে লাগলেন। মুসলমানদের জন্য পৃথক এক রাজনৈতিক দলের পটভূমিকাও এইভাবে প্রস্তুত হল।
লীগের জন্মকাহিনী পূর্বেই বলা হয়েছে। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে লীগের নিম্নোদ্ধৃত লক্ষ্য নির্ধারিত হয়: “..মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তার বিস্তার, সরকারকে মুসলমানদের প্রয়োজনীয়তা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে অবহিত রাখা, ভারতবর্ষের মুসলমানদের ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত করা (১৮) এবং মুসলমানদের অপরাপর সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হওয়া থেকে বিরত রাখা।”(১৯) ঢাকার ঐ সম্মেলনে মুসলমানদের পক্ষে হিতকর বলে বঙ্গভঙ্গের সমর্থন করা হয়েছিল। পরবর্তী বৎসরে করাচীতে অনুষ্ঠিত লীগের অধিবেশনের সভাপতি স্যার আদমজী পীরভাই ইম্পিরিয়াল ও প্রাদেশিক কাউন্সিলসমূহে মুসলমানদের জন্য কিছু কিছু আসন সংরক্ষণের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে প্রভূত ধন্যবাদ দিয়ে মুসলমানদের সরকারের প্রতি অনুগত থাকার পরামর্শ দিলেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮-১৯ মার্চ আলীগড়ের বিশেষ অধিবেশনে সরকারের জন্য একটি স্মারকলিপি প্রস্তুত হয় এবং তাতেও মুসলমানদের জন্য নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানসমূহে স্থান-সংরক্ষণকে ভারতের সমগ্র মুসলমান সাম্রাজ্যের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্তি আখ্যা দিয়ে এর জন্য সরকারকে অজস্র ধন্যবাদ জানানো হয়।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে অমৃতসরে অনুষ্ঠিত লীগ অধিবেশনের সভাপতির অভিভাষণে সৈয়দ আলী ইমাম দ্বিজাতি তত্ত্বকে প্রোৎসাহিত করে বলেন: “যথার্থ সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে উভয় সম্প্রদায় হাজার হাজার বৎসর পূর্বের মতো পরস্পর থেকে বহুদূরে বিরাজমান।…উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রস্থ চিন্তাভাবনা একেবারেই ভিন্ন।…সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে উভয় সম্প্রদায়ের ধ্যান-ধারণাও পৃথক। এ কথা তাই স্পষ্ট যে চরিত্রের জাতিগত (ethnic) বিভিন্নতা ছাড়াও উভয় সম্প্রদায়ের চিরাচরিত ধর্ম, সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় কোনো সাধারণ মিলনক্ষেত্রই নেই।”(২০) এ ছাড়া সভাপতি ঘোষণা করেন যে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করা যায় না। ঐ অধিবেশনেই মহম্মদ আলী প্যান ইসলামের আদর্শ প্রচার করে বলেন, “…যে দেশের জনসাধারণ সমশ্রেণীভুক্ত নয়, সে দেশে ভৌগোলিক নির্বাচনক্ষেত্রের কথা বলা একান্তভাবেই অনুচিত।”(২১)
মুসলিম লীগের দাবিপূর্তির জন্য ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তন হল। এর সঙ্গে সঙ্গে ভোটাধিকারের ক্ষেত্রেও মুসলমানদের প্রতি সবিশেষ পক্ষপাত করা হয়। ভারতের রাজনীতিতে এর পরিণাম হয় সুদূরপ্রসারী। এর প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাও প্রবল হতে লাগল, যা পরবর্তীকালে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের শুদ্ধি ও মদনমোহন মালব্যের সংগঠন আন্দোলনে অভিব্যক্ত হল।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত লীগের অধিবেশনে তদানীন্তন হিন্দি উর্দু বিরোধের জেরে উর্দুকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে এবং উর্দু বিরোধকে মুসলিম-বিদ্বেষ রূপে বর্ণনা করে অনেক বক্তৃতা দেওয়া হয়। ঐ সম্মেলনে হাকিম আজমল খাঁ মুসলমানদের পৃথক রাজনৈতিক সংগঠনের সপক্ষে জোরালো দাবি রাখেন এবং “মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন প্রথার সমর্থনের জন্য ফিরোজশা মেহতা, সিনহা ও অন্যান্য মডারেট কংগ্রেস নেতাদের প্রশংসা করেন।(২২) পরবর্তী বৎসরে নাগপুর অধিবেশনে সৈয়দ নবীউল্লা ব্রিটিশ সরকারকে এই মর্মে প্রশংসা-পত্র দেন যে তাঁরা আদৌ ভেদনীতি অনুসরণ করছেন না।
পরবর্তী বৎসরগুলিতে অবশ্য একদিকে নূতন হাওয়া এবং অন্যদিকে জিন্নার প্রভাবে লীগ মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রভাবমুক্ত হওয়া শুরু করে এ তথ্য পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে দেওয়া হয়েছে। খিলাফতের জন্য হিন্দুদের সাহায্য নিলেও ঐ দাবি ছিল মূলত প্যান্ ইসলামিক। এ জাতীয় এক আন্দোলন যে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের মানসিকতাকে পুষ্ট করবে—এ অত্যন্ত স্বাভাবিক। বিশেষ করে তার ভিত্তি যদি ধর্মীয় অহমিকতাবোধ হয় এবং তাকে গতিশীল করার জন্য যদি ইকবালের মতো কবি দার্শনিকের সহায়তা পাওয়া যায়। ইকবাল তাঁর রচনাবলীর মাধ্যমে নিজ বিশ্বাস—ইসলামের সর্বব্যাপী (all embracing) সম্পূর্ণতা এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্য সংগ্রামী ভূমিকার কথা প্রচার করেন। খিলাফতের যুগে মুসলমানদের জঙ্গী মনোভাবের সঙ্গে এ খুবই খাপ খেয়ে যায়। ইকবাল প্রচার করলেন যে বিশ্বমানবের আশাস্থল অর্থ ও সম্পদের লোভে পীড়িত ইউরোপের সভ্যতা-সংস্কৃতি নয়, একমাত্র ইসলামই তার যথার্থ মূল্যবোধের আধারে জগৎকে আলোকবর্তিকা দেখাতে পারে। সৈয়দ আহমদ যদি ভারতীয় ইসলামে এক পৃথক অস্তিত্ত্বের ভাবনা সঞ্চার করে থাকেন, ইকবাল তবে তাকে এক স্বতন্ত্র ভবিতব্য সম্বন্ধে সচেতন করে তুললেন। তরুণ মুসলিম সমাজ ইকবালের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল।
সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলন ও নেহরু-রিপোর্টের সুপারিশের সংশোধন এবং সর্বশেষে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জিন্না মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের শক্তিকে ক্ষীণ করে সমন্বিত সংস্কৃতির অনুকূল সমন্বিত রাজনীতি প্রবর্তনে সহায়ক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে তা সম্ভব হল না। মুসলমানদের নেতৃস্থানীয় অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সমাজের আপন স্বার্থ এবং হিন্দুদের প্রতি তাঁদের অবিশ্বাস, ঈর্ষা ও ভয়ের ভিত্তিভূমি তো ছিলই। বিচ্ছিন্নতাবাদের রাজনৈতিক সংগঠন ও জিন্নার সংগঠনী কুশলতায় তা শক্তিশালী হয়ে উঠল। এর প্রেরক-শক্তিও ইসলাম এবং ঐস্লামিক সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে ওঠার ভয়। ইকবালের ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের এলাহাবাদের ভাষণে যে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র সৃষ্টির কল্পনা ছিল, তাকে নিয়ে কেম্ব্রিজে আদর্শবাদী ও স্বপ্নদ্রষ্টা চৌধুরী রহমৎ আলী ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে নিরন্তর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন, “ইকবালের আদর্শবাদ, রহমৎ আলীর দূরদৃষ্টি এবং মুসলমানদের ভয়(২৩) জিন্নার বাস্তব প্রতিভার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুসলমানদের মধ্যে এমন সংহতি সৃষ্টি করল যার তুলনা ব্রিটিশ শাসনকালে মেলে না এবং এর পরিণতি হল এক রাজনৈতিক নবসৃষ্টি।”(২৪) লীগের ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের অধিবেশন ভূতপূর্ব জাতীয়তাবাদী জিন্নার দুই জাতিতত্ত্বের সপক্ষে ওকালতি বৃত্তের পরিক্রমা পূর্ণ হবারই সমতুল্য।

২০
পাদটীকা

১. এ সম্বন্ধে বিস্তৃত তথ্যের জন্য ড. তারাচাঁদের Influence of Islam on Indian Culture; ইন্ডিয়ান প্রেস, এলাহাবাদ (১৯৬৩) ও পণ্ডিত সুন্দরলালের ভারতমে আংগরেজি রাজ (হিন্দি); প্রথম খণ্ড; প্রকাশন বিভাগ, ভারত সরকার; গ্রন্থের বিশেষত পৃষ্ঠা ৪০-৯৮ দ্রষ্টব্য: অধ্যাপক মহম্মদ মুজীবের The Indian Muslim দেশজ প্রভাবের জন্য ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে কেবল সংস্কৃতি-বৈচিত্র্যেরই আলেখ্য নয়, ব্যক্তিগত আইন ও মূল ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও বিভিন্নতার দলিল। মুসলমান সমাজ এবং বিশেষ করে উর্দু ভাষার ক্ষেত্রে সংস্কৃতি সমন্বয়ের বিবরণের জন্য পাকিস্তানি গবেষক ইকবাল খাঁ-এর Rise of Urdu and Partition প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য (Times of India, দিল্লি) ২, ৩, ও ৫ই অক্টোবর, ১৯৮৭। ড. জগদীশনারায়ণ সরকারের Thoughts of Trends of Cultural Contacts in Medieval India; কলকাতা (১৯৮৪) ছাড়াও ক্ষিতিমোহন সেন, কাজী আবদুল ওদুদের শাশ্বত বঙ্গ ও অন্যান্য রচনাবলী এ প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়। সুরজিৎ দাশগুপ্তের “ইসলাম ও ভারত”(রুচিরা প্রকাশন, কলিকাতা ৭২) সর্বভারতীয় এবং ডাঃ জগদীশনারায়ণ সরকারের “বাংলায় হিন্দুমুসলমান সম্পর্ক (মধ্যযুগ)”(বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলিকাতা; ১৩৮৮) বঙ্গদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতি সমন্বয়ের সম্বন্ধে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা।
২. পরবর্তী তিনটি অনুচ্ছেদ এবং এই অধ্যায়ের আরও কিছু কিছু তথ্য ভিনসেন্ট স্মিথের The Oxford History of India (১৯৬১)-এর পৃষ্ঠা ৭৯৯-৮০৭ অবলম্বনে রচিত।
৩. রামগোপাল; সমগ্রন্থ; পৃ. ২০-২১।
৪. এই প্রবণতা প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের ইসলাম সম্বন্ধে এক প্রামাণ্য গবেষক অধ্যাপক আজিজ আহমদের ( Studies in Islamic Culture in the Indian Environment); অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, (১৯৬৪) অভিমত প্রণিধানযোগ্য। … ইকবাল মাসুদের মতে (Overcoming the Trauma of Indian History; দৈনিক Indian Express, দিল্লি, দোসরা নভেম্বর, ১৯৮৬)-ও দ্র.। সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য নিম্নরূপ: “ভারতবর্ষে ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ তার সার্বত্রিক দুর্ধর্ষ টিঁকে থাকার অধ্যবসায়জনিত টানাপোড়েনের অবস্থার মতোই এক আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়াও বটে। ভারতবর্ষের প্রবল অমুসলমান পরিবেশে আত্মনিমজ্জনের আশঙ্কায় তাই ইসলামী সংস্কৃতিকে সময়ে সময়ে নানারকম আপোস রফা করতে হয়েছে। মঙ্গোল আক্রমণের আশঙ্কার পরিবেশে মুসলমানেরা নিজেদের অসুরক্ষিত বিবেচনা করতেন। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুরের আক্রমণের সময়ে মুসলিম অভিজাতমানস একদিকে মঙ্গোলদের হাতে উৎপীড়ন এবং অপরদিকে স্থানীয় হিন্দুদের বিরোধিতার প্রবল শক্তির ভীতিপীড়িত ছিল। এই ঘটনা প্রশাসন ও ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে পৃথক থাকার প্রবণতাকে প্রোৎসাহিত করে।”
৫. জে. জে. পাল; Jinnah and the Creation of Pakistan; পৃ. ২।
৬. এ সম্বন্ধে ডবলু. ডবলু. হান্টারের Indian Musalmans-এর পৃষ্ঠা ২০-২৪ দ্রষ্টব্য। হান্টারের গ্রন্থ ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং কথিত আছে যে তিনি মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে এটি রচনা করেন। বহুদিন যাবৎ হান্টারকে ভারতীয় মুসলিম বিশেষজ্ঞ মনে করা হত এবং তিনি যেভাবে মুসলিম সমস্যা উপস্থাপিত করেন তা বহু ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কোনো কোনো পণ্ডিত তাঁর বক্তব্যকে সমালোচনা করা আরম্ভ করেছেন। “মুসলমান সম্প্রদায় সম্বন্ধে (তাঁর) একতরফা সামান্য অভিমত (যা তথ্যভিত্তিক নয়) অনেকের—বিশেষ করে মুসলমান নেতা ও লেখকদের কাছে অভ্রান্ত সত্য বলে মনে হত। তাঁরা মুসলমানদের অবনতির কারণ হিসাবে ব্রিটিশ ও হিন্দুদের দায়ী করার ব্যাপারে অত্যুৎসাহী ছিলেন।”(অধ্যাপক এ.এফ.সালাউদ্দিন আহমদ; Bangladesh: Tradition and Transformation; দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা, ১৯৮৭)।
৭. মহম্মদ মুজীব; The Indian Muslims; ৫২৮ পৃষ্ঠা।
৮. জে. জে. পাল; সমগ্রন্থ; ৪ পৃষ্ঠা।
৯. খলিকুজ্জমা কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২৬৯-৭০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত একটি বাক্যের উপর গুরুত্বদান মূল লেখকের। খলিকুজ্জমাঁর মতে তাঁর সঙ্গে অধ্যাপক কৃপল্যান্ডের পাঁচ হাতে ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা প্রসঙ্গে স্যার সৈয়দের এই বক্তৃতার উল্লেখ করায় তিনি বিহুলাংশে তাঁর প্রস্তাবে ভারত বিভাজনের পরিকল্পনার সুপারিশ করতে উদ্বুদ্ধ হন।
১০. পেন্ডারেল মুন; Divide and Quit; লন্ডন (১৯৬৪); ১১-১২ পৃষ্ঠা।
১১. এ.এইচ.আলবিরৌনি; Makers of Pakistan and Modern Muslim India; (লাহোর, মহম্মদ আশরফ, ১৯৫০); ১০৯ পৃষ্ঠা। জে.জে.পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের তৈরী পৃষ্ঠা ৪-এ উদ্ধৃত।
১২. এম. নূরউল ইসলাম কর্তৃক তাঁর Bengali Muslim Public Opinion as Reflected in Bengali press. 1901-1930 (ঢাকা ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থের ৪৭ naibn পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। জে. জে. পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৫ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১৩. ঐস্লামিক শিক্ষা-সংস্কৃতির ফসল দেওবন্দ উলেমা গোষ্ঠী তাঁরা। বিজ্ঞান ও পাশ্চাত্য কালনী শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রবক্তা স্যার সৈয়দ ও তাঁর অনুবর্তীদের তুলনায় হিন্দুদের প্রতি অধিকতর উদার ও ইংরেজবিরোধী জাতীয়তাবাদী ছিলেন (খিলাফতের নেতৃত্ব নেন জাকাত প্রধানত এই উলেমা গোষ্ঠী এবং তাঁরা এর জন্য এমনকি অমুসলমান গান্ধীর পথপ্রদর্শনও স্বীকার করেন। পক্ষান্তরে জিন্না বা তাঁর মতো পাশ্চাত্য শিক্ষিতরা এ আন্দোলনের প্রতি তেমন আকর্ষণ বোধ করেননি)। আপাত বিস্ময়কর এই ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। অধ্যাপক আজিজ আহমদের অনুসরণে ইকবাল মাসুদের বক্তব্য এই যে স্যার সৈয়দের নেতৃত্ব সর্বপ্রথম যে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জের তার সম্মুখীন হয় তার কেন্দ্রবিন্দু জনৈক অভারতীয় মুসলিম শাস্ত্রানুসারী নেতা জমাল-অল-দীন আফগানী (১৮৩৯-১৮৯৭)। আফগানী স্যার সৈয়দের পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন ইত্যাদিকে ব্রিটিশের বশংবদ হবার নিদর্শন বিবেচনা করতেন এবং স্বয়ং ইংরেজবিরোধী ছিলেন। ভারতের উলেমা গোষ্ঠী আফগানী দ্বারা প্রভাবিত হবার কারণে ইংরেজের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে হিন্দুদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন। পক্ষান্তরে স্যার সৈয়দ প্রভাবিত পাশ্চাত্য শিক্ষিত অভিজাত ও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সাময়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইংরেজ বিরোধিতার পন্থা পরিহার করাই যুক্তিযুক্ত মনে করেন। ইকবাল মাসুদের সিদ্ধান্ত হল, “স্যার সৈয়দের ত্রিমুখী its আবেদন—(ইংরেজদের প্রতি) আনুগত্য, পৃথক থাকার মানসিকতা এবং ‘আধুনিকতা’ পাকিস্তানের পথ প্রশস্ত করে।”(দ্রঃ Overcoming the Trauma of Indian History; Indian Express, দিল্লি; দোসরা নভেম্বর, ১৯৮৬)।
১৪. অধ্যাপক মঈন সকিরের মতে, “মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ বিত্তবান সম্প্রদায়ের শ্রেণীস্বার্থের পরিণাম। গোড়ার দিকে সামন্তবাদী, বিভিন্ন উচ্চবৃত্তি নির্ভর এবং সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ কর্তৃক এর সাগ্রহ অনুশীলন হয়। জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম … বুর্জোয়া সম্প্রদায় দ্বারা একে সাফল্যমণ্ডিত করা হয়।” এক বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হলেও বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল অনুসন্ধান প্রসঙ্গে অধ্যাপক সকিরের বক্তব্য অনুধাবনীয়: “…প্রতিটি সম্প্রদায়ের ভিতরই শ্রেণী ও জাতিভিত্তিক ভেদ বেশ গভীর এবং প্রশস্ত ছিল। আর তা গোপন করার পথ হল ঐক্য ও সংহতির ধুয়া তোলা। এই হল বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল তথ্য।”(দ্র: Role of Minorities in Freedom Struggle; অজন্তা, নূতন দিল্লি (১৯৮৬) গ্রন্থে লেখকের Jinnah and Muslim Separatist Strategy প্রবন্ধের যথাক্রমে ৬১ ও ৫৯ পৃষ্ঠা)।
১৫. আগা খাঁ; The Memoris World Enough and Time (লন্ডন, ক্যাসেল, ১৯৫৪) ৯৪ পৃষ্ঠা। জে.জে.পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১০-১১ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১৬. রফিক জ্যাকেরিয়া; Rise of Muslims in Indian Politics: An Analysis Development from 1885-1906; ৫৯ পৃষ্ঠা। জে.জে.পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৮ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১৭. এম. নূরউল ইসলাম কর্তৃক তাঁর Bengali Public Opinion as Reflected in the Bengali press, 1901-1930 গ্রন্থের ৫৮-৫৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত। জে.জে. পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১১ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১৮. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য কেবল লীগের বিরূপ সমালোচনা করা উচিত হবে না। সেকালে তাবৎ রাজনৈতিক দলেরই এই ভূমিকা ছিল, এমনকি
কংগ্রেসেরও।
১৯. শরীফুদ্দীন পীরজাদা (সম্পাদিত); Foundation of Pakistan; প্রথম খণ্ড (করাচী, ১৯৬৯) পৃষ্ঠা ৬। জে.জে.পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ১১ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২০. এ.এস.জাঈদী; Evolution of Muslim Political Thought in India; প্রথম খণ্ড (দিল্লি, ১৯৭৫); পৃ. ১২৫। জে.জে.পাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২১ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২১. জে.জে.পাল; সমগ্রন্থ; ২২ পৃষ্ঠা।
২২. সমগ্রন্থ; ২৭ পৃষ্ঠা।
২৩. লাহোরে প্রকাশ্যে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রচারের কিছুদিন পূর্বে Manchestar Guardian পত্রিকার প্রতিনিধিকে প্রদত্ত জিন্নার বিবৃতির দুটি বাক্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য: “এমনকি প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন-ব্যবস্থা সম্বন্ধেও মুসলমানদের মনে চিরকালই ভয় ও আশঙ্কা ছিল এবং ভারতবর্ষে গণতন্ত্র যেভাবে কার্যকরী করা হচ্ছিল তার সম্বন্ধে আরও বেশি। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লি-মিন্টো শাসন-সংস্কার থেকে আরম্ভ করে হিন্দু – ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পাদিত ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ঐতিহাসিক লখনউ চুক্তি পর্যন্ত তাঁরা যে পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থা, সংখ্যাধিক্য (Weightage) ও বৈধানিক রক্ষাকবচের জেলা জন্য জোর দিয়ে এসেছেন তা পূর্বোক্ত ভয়েরই সুস্পষ্ট দ্যোতক।”(এম.এইচ.সঈদ; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ২৩৮)।
২৪. ভিনসেন্ট স্মিথ; The Oxford History of India; ৮০৭ পৃষ্ঠা।

ভারত বিভাজনের অন্যান্য পরিকল্পনা
২১

পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে আরও অগ্রসর হবার পূর্বে লাহোর প্রস্তাবের পূর্ববর্তী সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত বিভাজনের অন্যান্য পরিকল্পনা ও প্রয়াসের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।
(৪৯১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের আদেশের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। কার্জন যদিও বাংলার চট্টগ্রাম ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের সঙ্গে আসামকে যোগ করে এক মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ সৃষ্টি করেছিলেন, সে পরিকল্পনায় ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সম্ভাবনা ছিল না বলে বঙ্গভঙ্গকে ঠিক ভারত বিভাজনের প্রয়াস বলা যায় না।
অবশ্য ইতিপূর্বে আলীগড় কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ স্যার থিয়োডর মরিসনের এতদ্‌সম্বন্ধীয় একটি পুস্তিকা ইংলন্ডে প্রকাশিত হয়। তিনি মন্তব্য করেন যে ৫০ লক্ষ মুসলমানকে যদি উত্তর ভারতে বসতি স্থাপন করানো যায় তাহলে একটা জাতীয় ভাবধারার সৃষ্টি হবে এবং হয়তো এর ফলে মুসলমানদেরও সমস্যার সমাধান হবে। সর্ব সম্প্রদায়ের – ভারতবাসীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় কংগ্রেসের জন্মের পরও ১৮৮৮ খ্রি. বড়লাটের শাসন পরিষদের সদস্য স্যার জন স্ট্রেচি ভবিষ্যতের ইংরেজ প্রশাসকদের জন্য India নামে যে পাঠ্য পুস্তক রচনা করেন তাতে দুরভিসন্ধিমূলক ভাবে বলা হয় যে ভারত কোনো অখণ্ড দেশ নয় এবং এখানে বহু বিবদমান জাতির অস্তিত্ব। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে আবদুল হালিম শয়রায় সর্বপ্রথম মুসলমানদের জন্য এক পৃথক বাসভূমির প্রস্তাব করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে স্টকহলমের আন্তর্জাতিক সমাজবাদী সম্মেলনে দুই ভারতীয় প্রতিনিধি—আবদুল জব্বার ও আবদুল সাত্তার এ জাতীয় বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে খিলাফতের বিরোধী এবং ইংরেজ শাসনের প্রবল সমর্থক নাদির আলী নামক আগ্রার জনৈক ব্যবহারজীবী একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধানের অন্যতম উপায় হল ভারত বিভাজন। এর তিন বছর পর মৌলানা মহম্মদ আলী আলীগড়ে প্রদত্ত এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, ‘হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান না হলে ভারতবর্ষ হিন্দু-ভারত ও মুসলমান ভারতে বিভক্ত হবে।” ঐ বছরেই লাহোরে অনুষ্ঠিত লীগের এক সভায় এক প্রস্তাবের মাধ্যমে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে এদেশে এককেন্দ্রিক (unitary) শাসন-ব্যবস্থার বদলে ফেডারেল ধরনের শাসন-ব্যবস্থা চাই। বলা বাহুল্য এ প্রস্তাবকে যথার্থ বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেওয়া যেতে পারে না। লালা লাজপৎ রায়ও ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে একটি পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন, যাতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও পূর্ববঙ্গের চারটি মুসলিম রাজ্য (states) গঠনের প্রস্তাব ছিল।
ইকবাল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে এলাহাবাদে মুসলিম লীগের অধিবেশনে সর্বপ্রথম উত্তর-পশ্চিম মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিকে নিয়ে ফেডারেল ভারতবর্ষের মধ্যেই একটি রাজ্য (state) গঠনের প্রস্তাব করেন। তবে কি ভারতবর্ষে এবং লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে সমবেত লীগ বা অন্য মুসলিম নেতারা এর প্রতি কোনো গুরুত্ব আরোপ করেননি। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব লীগের স্যার মহম্মদ শাহনওয়াজ “জনৈক পাঞ্জাবি” ছদ্মনামে “কনফেডারেসি অফ ইন্ডিয়া” নামে একটি পুস্তক রচনা করেন। এতে পাঁচ ভাগে ভারত বিভাজনের একটি পরিকল্পনা পেশ করা হয়। বিভাগগুলি হল—সিন্ধু অঞ্চল, হিন্দু ভারত, রাজস্থান, দাক্ষিণাত্য ও বঙ্গ। তবে তাঁর পরিকল্পনায় পৃথক দেশগুলির পুনঃসংযোগকারী ভারত নামে এক শিথিল কনফেডারেশনের স্থান ছিল। পাঞ্জাবের এককালীন প্রধানমন্ত্রী স্যার সিকন্দর হায়াৎ খাঁ “আউটলাইনস অফ এ স্কিম অফ ইন্ডিয়ান ফেডারেশন” নামক এক পুস্তিকার মাধ্যমে সাতটি মোটামুটি স্বতন্ত্র অঞ্চলের সমবায়ে ভারতরূপী এক শিথিল কনফেডারেশন রচনার প্রস্তাব উপস্থাপিত করেন। খলিকুজ্জমাঁও তদানীন্তন ভারতসচিব লর্ড জেটল্যান্ড এবং তাঁর সহকারী কর্নেল মুইরহেডের কাছে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ভারত বিভাজনের এক পরিকল্পনা দাখিল করেন এবং তাঁর বক্তব্য হল এই যে সেই পরিকল্পনাই লীগ ওয়ার্কিং কমিটির ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ফেব্রুয়ারির সভায় গৃহীত হয়ে পাকিস্তান নামে ভারত বিভাগের ভিত্তি রচনা করে।
আলীগড়ের দুই অধ্যাপক সঈদ জাফর-উল-হাসান ও ড. মহম্মদ আফজল হাসন কাদরী পাকিস্তান, বঙ্গ, হিন্দুস্থান, হায়দ্রাবাদ, দিল্লি ও মালাবার—এই ছয়টি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে ভারত বিভাগের এক পরিকল্পনা প্রচার করেন। ড. এস. এ. লতিফ তাঁর “দি মুসলিম প্রবলেম ইন ইন্ডিয়া” গ্রন্থে মুসলমানদের চারটি ও হিন্দুদের জন্য আরও ছটি সাংস্কৃতিক অঞ্চলের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের এক পরিকল্পনা রচনা করেন। লাহোরের মজলিশ-ই-কবীর পাকিস্তানের সম্পাদক আহম্মদ বশীর ড. লতিফের প্রস্তাবের অপূর্ণতা দেখিয়ে ভারত বিভাজনের আর একটি পরিকল্পনা রচনা করেন। ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে অধ্যাপক সঈদ ও ড. হাসানের পরিকল্পনা জিন্নার লাহোর বক্তৃতাকে কী পরিমাণ প্রভাবিত করে। আলীগড়ের ড. জাকিউদ্দিন, ড. ফরহান আহমদ ও উবেদউল্লা দুরানী অধ্যাপক হাসান সহ ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর জিন্নার কাছে এক আবেদন প্রসঙ্গে ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিতে একাধিক স্বাধীন মুসলিম রাজ্য গঠনের কথা জোরালো ভাষায় বলেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই দশ দিন একটানা আলোচনার পর কয়েকজন মুসলমান সংবিধান-বিশেষজ্ঞ উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে পৃথক জাতীয়তার ভিত্তিতে মুসলিম অঞ্চল গঠনের জন্য জিন্নার কাছে গোপনে এক পরিকল্পনা পাঠান। সিন্ধুর স্যার আবদুল্লা হারুনের কমিটিও লীগের আহ্বানে অপর একটি ভারত বিভাজনের পরিকল্পনা রচনা করেন।
সর্বশেষে উল্লেখ করলেও এ প্রসঙ্গে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমৎ আলীর পাকিস্তান পরিকল্পনা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। লন্ডনের কিছু মুসলমান ছাত্রসহ রহমৎ আলী ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের সময়ে সমবেত মুসলমান নেতাদের সঙ্গে দেখা করে ভারতবর্ষ ভাগ করে পাকিস্তান গঠন করার প্রস্তাব প্রথম উত্থাপন করেন এবং নেতারা সে প্রস্তাব বিবেচনার অযোগ্য মনে করেন—এ তথ্য ইতিপূর্বে দেওয়া হয়েছে। দুই বৎসর পর চৌধুরী রহমত আলীসহ আরও তিনজন ছাত্র কেম্ব্রিজ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে ভারত বিভাগ করে একটি স্বতন্ত্র মুসলমান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা একটি চার পৃষ্ঠার পুস্তিকার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের ইংরাজি বানান অনুসারে P পাঞ্জাব, A আফগানিয়া বা পুস্তুভাষী অঞ্চল, K কাশ্মীর, S সিন্ধু ও Istan বেলুচিস্তানের সমন্বয়ে সেই স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে বলা হয়। তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকে সমাগত প্রতিনিধিদের মধ্যে ঐ পুস্তিকা বিতরণ করলেও মুসলমান নেতারা কেউই অথবা জিন্না তখন পাকিস্তান প্রস্তাবকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার যোগ্য মনে করেননি। Now or Never নামক সেই পুস্তিকাটিতে বলা হয় যে সে বক্তব্য পাকিস্তান বা উত্তর- পশ্চিম ভারতবর্ষের সাড়ে তিন কোটি মুসলমানের দাবি। তাঁরা গোলটেবিল বৈঠকে নির্ধারিত ফেডারেল শাসনব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল: “পাকিস্তানের মুসলমানরা এক পৃথক বৈশিষ্ট্যযুক্ত জাতি (nation)… এবং তারা এক পৃথক জাতীয় (national) মর্যাদার স্বীকৃতি দাবি করে।” শেষ গোলটেবিল বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে গঠিত জয়েন্ট সিলেক্ট কমিটির মুসলমান সদস্যদের ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজনের এই সুস্পষ্ট প্রস্তাব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে ইউসুফ আলী মন্তব্য করেন যে, ওটা “নিছক ছাত্রদের পরিকল্পনা, কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি ঐ পরিকল্পনা পেশ করেনি।” স্যার জাফরুল্লা খাঁ বলেন যে ও প্রস্তাব “বিকৃতমস্তিষ্কের কল্পনা ও অবাস্তব।” ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে চৌধুরী রহমৎ আলী পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলনের সভাপতিরূপে কেম্ব্রিজ থেকে চার পৃষ্ঠার আর একটি পুস্তিকা প্রচার করেন।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে অবস্থা যখন পাকিস্তান আদর্শের কিছুটা অনুকূল, চৌধুরী রহমৎ আলী তখন করাচী থেকে আর একটি বিবৃতি দেন যা পরে The Millat of Islam and the Menance of Indianism নামে কেম্ব্রিজ থেকে প্রকাশিত হয়। এতেও মুসলমানদের ভারতীয় ঐতিহ্য সর্বতোভাবে অস্বীকার করে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে ওকালতি করা হয়। রহমৎ আলী প্রচারিত পাকিস্তানের মানচিত্রে এঁকে তিন নামে তিনটি অংশে বিভক্ত রাষ্ট্ররূপে দেখানো হয়। উত্তর-পশ্চিম অংশের নাম যথারীতি পাকিস্তান। বঙ্গ ও আসাম মিলিয়ে বঙ্গ-ই-ইসলাম। নিজামের উসমানী বংশের নামে হায়দ্রাবাদ উসমানিস্তান নামে পরিচিত হবে প্রস্তাব করা হয়। বাস্তবে সৃষ্ট না হওয়া পর্যন্ত বিলাতে অবস্থানকারী এই স্বপ্নদ্রষ্টা মুসলমান যুবক আলাপ-আলোচনা, সংবাদপত্রে লিখিত পত্র ও প্রবন্ধ এবং প্রচার পুস্তিকার মাধ্যমে পাকিস্তানের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে নিরলস প্রচার চালিয়ে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর বিধিলিপিও অধিকাংশ আদর্শবাদী স্বপ্নদ্রষ্টার মতো শোচনীয় আশাভঙ্গের কাহিনীতে পর্যবসিত হয়েছিল। পাকিস্তানের ভাবরূপের জনক তাঁর সাধের “সব পেয়েছির দেশ”-এ বসবাস করার আগ্রহ বোধ করেননি। খলিকুজ্জমাঁ লিখেছেন: “দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার হয়েছিল। তিনি আমাকে মধ্যাহ্নভোজনে আমন্ত্রণ করেছিলেন এবং সেই সময়ে পাঞ্জাব ও বঙ্গ বিভাগের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর তীব্র বিরূপতা ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে ঐ কার্য বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল্য ছিল। আমি তাঁকে খুবই অসন্তুষ্ট দেখলাম। কারণ তাঁর মনে সন্দেহ জেগেছিল যে তাঁর নিজের শহরে তাঁর উপর দৃষ্টি রাখার জন্য সরকারি গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়েছে। অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন এবং The Great Betrayal নামক একটি পুস্তিকা রচনা করার কিছুদিন পর মৃত্যুমুখে পতিত হন। বড়ই লজ্জার কথা যে পাকিস্তানের জনসাধারণ যে রাষ্ট্রের নামে তাঁরা শপথ গ্রহণ করেন তার নামকরণকারীর উদ্দেশে এমনকি একটা ফতেহাও দেন না।”(১)
মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রোৎসাহিত করার ব্যাপারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্নেহপুষ্ট আগা খাঁর সেই ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকেই একটা প্রমুখ ভূমিকা ছিল। “১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দেই আগা খাঁ দেখতে পেয়েছিলেন যে ভারতবর্ষের মুসলমানদের নিজ দাবি পেশ করার জন্য এক সম্পূর্ণ নূতন ভিত্তিভূমি প্রয়োজন। তিনি মনে করলেন যে এর শ্রেষ্ঠ উপায় হল উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলসমূহের এবং বঙ্গদেশের মুসলমানদের এই ‘অপ্রতিরোধ্য ভূমিকার সুযোগ গ্রহণ করা। কেন্দ্রে মুসলমানদের ‘আদ্যন্ত ফেডারেশনপন্থী’ হতে হবে এবং ভারতবর্ষ যা অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার এক সংযুক্ত রাষ্ট্র—তাকে তা-ই করতে হবে।’ এই সংযুক্ত রাষ্ট্রের মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ সমূহকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করবেন। কিন্তু আমাদের ভারতের প্রতি আনুগত্যে কদাচ কোনো শঙ্কা সৃষ্টি হতে দেওয়া চলবে না এবং ‘আমাদের হিন্দু স্বদেশবাসীরা যেন একথা উপলব্ধি করেন যে তাঁদের মতই সমগ্র ভারতবর্ষের কল্যাণ আমাদের কাছেও সমান প্রিয়….।”(২)
PD যাই হোক, ভারত বিভাজনের পূর্বতন প্রস্তাবাবলীর অনুশীলন পরিহার করে আমরা ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ লীগের লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের পরবর্তী পরিস্থিতির সমীক্ষা করব। খলিকুজ্জমাঁর সাক্ষ্যে জানা যায়: “পরের দিন সকালে হিন্দু সংবাদপত্রসমূহে বড় বড় অক্ষরে প্রকাশিত হল ‘পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত’, যদিও ঐ নাম দুটি বক্তৃতার কোনোটিতেই উচ্চারিত হয়নি বা প্রস্তাবেও উল্লিখিত হয়নি। জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রসমূহ মুসলিম জনসাধারণের সামনে এক সঙ্ঘবদ্ধ ধুয়ো উপস্থাপিত করল এবং অবিলম্বে তা তাঁদের সামনে একটি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি খাড়া করল। লাহোর প্রস্তাব মুসলমানদের কাছে পৌঁছে দিতে এবং তার যথার্থ অর্থ ও তাৎপর্য তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে মুসলমান নেতাদের অনেক সময় লাগত। হিন্দু সংবাদপত্রসমূহ লাহোর প্রস্তাবের নাম ‘পাকিস্তান-প্রস্তাব’ দিয়ে মুসলিম জনসাধারণের কাছে এর তাৎপর্য বোঝানোর জন্য নেতাদের যে বহু বছরের পরিশ্রমের প্রয়োজন পড়ত তার হাত থেকে তাঁদের রেহাই দিল।”(৩) জিন্নার এককালের একান্ত সচিব পীরজাদা এই ঘটনার বর্ণনা প্রসঙ্গে জিন্নার নিম্নোক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন: “পাকিস্তান শব্দ আমরা চালু করিনি, হিন্দুরাই এই শব্দটি আমাদের উপহার দিয়েছেন। লাহোর প্রস্তাব তীব্রভাবে সমালোচনা করতে গিয়ে হিন্দুরা পাকিস্তান-প্রস্তাব রূপে এর উল্লেখ করেন। তার ফলেই এই শব্দের প্রচলন হয়। অবশ্য জিন্না হিন্দুদের এর জন্য ধন্যবাদ জানান।”(৪)
লাহোরের ঐ সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে “পাকিস্তান-প্রস্তাব”-এর অভিধা পায় পরবর্তী বৎসরের ১৫ই এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত লীগের বাৎসরিক অধিবেশনে। সেই অধিবেশনেই স্থির হয় যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই হবে লীগের মূল নীতি এবং প্রতিষ্ঠানের সংবিধানেও তা স্বীকৃতি পায়। পাকিস্তান অর্থাৎ পবিত্র দেশ অথবা পবিত্রদের দেশ নাম এই দাবির সপক্ষে মুসলিম ধর্মোন্মাদনাকে যুক্ত করার ব্যাপারে প্রবল সহায়ক সিদ্ধ হয়।
এই প্রসঙ্গে পাকিস্তান দাবিকে কেন্দ্র করে ক্রমশ ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে যে প্রবল জনমত সংগঠিত হতে থাকে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে জিন্না বিশ্বাস অথবা আচারে-বিচারে আদৌ গোঁড়া মুসলমান ছিলেন না। বরং তিনি মৌলভী-মৌলানাদের বিরোধী ছিলেন। এমনকি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দেও (১লা ফেব্রুয়ারি) বোম্বের ইসমাইলি কলেজের এক বক্তৃতায় তিনি বলেন যে ধর্ম হল “নিছক ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যেকার একটা ব্যাপার”। দেশ বিভাগের ঠিক পূর্বে রয়টারের প্রতিনিধি ডুন ক্যাম্পবেলকে জিন্না বলেন যে নূতন রাষ্ট্রটি হবে “এক আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যার সার্বভৌমত্ব থাকবে জনসাধারণের হাতে এবং ধর্ম, জাতি (caste) ও বিশ্বাস নির্বিশেষে
পৃষ্ঠা: ১৬৫

নূতন রাষ্ট্রের অধিবাসীরা নাগরিকতার সমান সুযোগ ভোগ করবেন।”(৫) প্রত্যুত ধর্মশাস্ত্রনিষ্ঠ উলেমা সম্প্রদায় ও তাঁদের সংগঠন জমায়েত-ই-উলেমা-ই-হিন্দ্ পাকিস্তান দাবির বিপক্ষে ছিলেন এই কারণে যে তাঁদের মতে ইসলাম ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নয়—ইসলামের উম্মা বা সমাজ আন্তর্জাতিক। এই কারণে প্যান ইসলাম মুসলমানদের স্বাভাবিক প্রবণতা। স্যার সৈয়দ আহমদের মতো জিন্নাকেও যে উলেমাদের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তার অন্যতম কারণ এই। এ প্রসঙ্গে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে জমায়েতের সভাপতি মৌলানা হোসেন আহমদ মাদনির জিন্না ও লীগের বিরুদ্ধে ফতোয়া এবং অহর উলেমাদের ব্যঙ্গ করে তাঁকে কাফের-এ-আজম বলার কথা স্মরণীয়। একথা সত্য যে ভারত বিভাজনের প্রাক্কালে সিলেট ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গণভোটের সময় স্বয়ং জিন্নার উদ্যোগে লীগ উলেমাদের একাংশের সাহায্য নেয় এবং তাঁদের ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতাযুক্ত(৬) প্রচার গণভোটের পরিণতি লীগের অনুকূল করতে সাহায্য করে। এইসময়ে জমায়েতের পাকিস্তান দাবির অনুকূল অংশ মূল প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জমায়েত-ই-উলেমা-ই-ইসলাম গঠন করে।
কিন্তু সেসব ছিল জিন্নার রাজনৈতিক কৌশলের অন্তর্গত। এইজন্য তিনি পাকিস্তানের প্রবল প্রতাপান্বিত কর্ণধার হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এককালের সহায়ক জমায়েত-উল্‌-উলেমা-ই- ইসলামের ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারি পেশ করা ধর্মীয় পুরুষদের সরকারি ক্ষমতার ভাগ দেবার দাবি সম্বন্ধে কোনোরকম উৎসাহ দেখাননি। পরের মাসে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধানের রূপরেখার ইঙ্গিত দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি নিঃসন্দেহ যে এ হবে গণতান্ত্রিক ধরনের যাতে ইসলামের মূল নীতির সমাবেশ থাকবে।” এবং “পাকিস্তান কোনোমতেই ধর্মীয় রাষ্ট্র হবে না যার শাসনের দায়িত্ব থাকে দৈবী উদ্দেশ্যচালিত ধর্মযাজকদের হাতে।”(৭)
মূল কথা হল—পাকিস্তানের আন্দোলন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত লিবারেল নেতারা পরিচালনা করেন এবং জিন্না স্বয়ং সেই শ্রেণীর প্রতিভূ। ব্রিটিশ শাসনে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং চাকুরি ও ব্যবসা ইত্যাদির ক্ষেত্রে হিন্দুদের তুলনায় অসুবিধাজনক অবস্থায় থাকার জন্য এই শ্রেণী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। সমাজ ও অর্থনীতির সর্বস্তরে হিন্দুদের প্রাধান্য মুসলিম অভিজাতদের মধ্যে ঈর্ষা এবং ভয়—দুই-এরই জন্ম দেয়৷ উত্তরপ্রদেশের মুসলমানদের এই ভয়ের প্রসঙ্গে এক বিশিষ্ট বিদেশি গবেষকের অভিমতও প্রণিধানযোগ্য। ১৯১৩-৩১ খ্রিস্টাব্দে কানপুরে যে পৌণঃপৌণিক বর্বর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয় তার পর্যালোচনা করে তিনি নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন: “ঐ উত্তেজিত পরিস্থিতিতে ইসলামে বিশ্বাসীদের জন্য এক অনিশ্চিত সর্বজননীন কাঠামো—যার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল একটু নিরাপদ আশ্রয়—তার স্থায়িত্ব বিধান করাই শুধু অসম্ভব হয়ে উঠল না, এককভাবে ব্যক্তিদের পক্ষেও আত্মসচেতনতা ব্যতিরেকে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ল।… সেকালের ঐ দলাদলিপূর্ণ রাজনীতিতে স্থান পাবার সম্ভাবনা বিরল হবার জন্য মুসলমান সম্প্রদায় চাপে পড়ে ভিন্ন এক ক্ষেত্রে উপনীত হল। সেই ক্ষেত্র নির্দিষ্ট—নির্ধারিত পরিমাণের অর্থাৎ প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ করা স্বীকৃতি ও ক্ষমতার। কংগ্রেসি ধরনের স্বায়ত্তশাসন যে হিন্দু জনমনোরঞ্জনকারী বৃত্তির (Populism) অভিপ্রকাশ, তা উত্তর প্রদেশের মুসলমান অতীতে যে অনিশ্চিত সর্বজনীন কাঠামোর উপর নির্ভর করতেন তার সাঙ্গীকরণে অক্ষম হল। এর সঙ্গে যুক্ত হল বিভিন্ন শ্রেণীর মুসলমানদের ভিতর নবজাগ্রত আস্মিতা ও আত্মসচেতনতা। এর পরিণামে হিংসার উপর উত্তরোত্তর আস্থা বৃদ্ধি পেল।”(৮) বিশ্লেষক লেখক ইকবাল মাসুদের মতে ভারতের দুর্ভাগ্যের মূল ঐখানে।
ইসলামের প্রথম যুগ এবং ভারতের মুসলিম শাসনের অতীত গৌরবের কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেই অভিজাত নেতৃত্ব সাধারণ মুসলমানদের (এর মধ্যে প্রাচীনপন্থী গোঁড়া ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস দ্বারা চালিত অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত মোল্লা, পীর জাতীয় ধর্মযাজকরাও পড়েন) মধ্যে ইসলামের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার এবং ইসলামের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দৃঢ়মূল করে তোলে। যে কোনো রাজনৈতিক নেতার কৃতিত্বের মূলে আছে নিজের ব্যক্তিগত স্বপ্নকে অনুগামীদের মধ্যে সঞ্চারিত করে তা সত্য বা সম্ভাব্য বলে বিশ্বাস করতে অনুপ্রাণিত করা এবং এইভাবে তাকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলা। নেতা হিসাবে জিন্নার সার্থকতা এইখানে। “জনসাধারণের মধ্যে জিন্না যে প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তার ব্যাখ্যা এই ঘটনার দ্বারা করা যায় যে তিনি এক নূতন মুসলিম রাষ্ট্রের আওতায় তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের প্রতিশ্রুতি দেন। পাকিস্তানের দাবির দ্বারা মুসলিম লীগ ভারতবর্ষে হিন্দুদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিনাই ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির আকাঙ্ক্ষার সন্তুষ্টিবিধান করছিল এবং জনসাধারণের রাজনৈতিক অভীপ্সার পরিপূর্তি ঘটাচ্ছিল।”(৯)
মুসলিম জনমতের পূর্বোক্ত দুই আপাত পরস্পরবিরোধী ধারার সফল সমন্বয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত জিন্নার নেতৃত্বের জন্য অতঃপর পাকিস্তানবিরোধী তাবৎ প্রয়াস প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মুখে বালির বাঁধের মতো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকারের ২৫শে মার্চের উক্তি—সর্বশক্তি প্রয়োগে আমরা ভারত বিভাজনে বাধা দেব, অথবা মাস্টার তারা সিং-এর ১৫ই এপ্রিলের শাসানি মুসলিম জনমানসকে যথারীতি পাকিস্তানের আরও অনুকূল করল। হরিজন পত্রিকায় এপ্রিল মাসে একাধিক প্রবন্ধের মাধ্যমে উপস্থাপিত গান্ধীর যুক্তি অথবা জওহরলাল বা কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের ভারত বিভাজনের বিরোধী বক্তব্য “হিন্দু স্বার্থ প্রভাবিত” বিধায়ে তাঁরা বিবেচনার অযোগ্য মনে করলেন। লাহোরে মার্চে বাদশা খাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সম্মেলন পাকিস্তানের দাবি এবং সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন ও চাকুরিতে সংরক্ষণ আদির তীব্র নিন্দা করল। ২৭শে এপ্রিল সিন্ধুর প্রধানমন্ত্রী আল্লাবক্সের সভাপতিত্বে এবং কংগ্রেস ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী মুসলিম সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত দিল্লির অখিল ভারতীয় আজাদ মুসলিম সম্মেলনে উপস্থিত ১৪০০ প্রতিনিধি লীগের ভারত বিভাজনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করার সঙ্গে সঙ্গে লীগই মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান—এই দাবি অস্বীকার করে। কুম্ভকোণম্-এ মহম্মদ ইউসুফ শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ ভারতের মুসলমানদের বিভেদবিরোধী সম্মেলনে দুই জাতিতত্ত্বের এবং লীগই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান— এই দাবির বিরোধিতা করে। ডিসেম্বরে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে স্যার সুলতান আহমদ এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন যে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতি পরস্পরবিরোধী এবং এদের মধ্যে সাধারণ মিলনভূমি নেই। কিন্তু এইসব সম্মানভাজন নেতৃবৃন্দ এবং সবগুলি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের বিধানসভার বহুসংখ্যক মুসলমান সদস্য (এর মধ্যে সিকন্দর হায়াৎ খাঁও ছিলেন, যিনি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নয়, আঞ্চলিকতার স্বার্থে পাঞ্জাবের স্বায়ত্তশাসনের সমর্থক হলেও এবং এই কারণে লাহোর প্রস্তাব সমর্থন করলেও এক বৎসরের মধ্যে(১০) পাঞ্জাব বিধানসভায় প্রকাশ্যে লাহোর প্রস্তাবের নিন্দা করে বলেন যে এ ব্যাপারে তাঁর কোনো দায়িত্ব নেই ও ঐ প্রস্তাবের তাৎপর্য যতই উপলব্ধি করছেন, ততই তার বিরোধী হচ্ছেন) মুসলমান জনসাধারণের মনে এই সব প্রচেষ্টা কোনো দাগ কাটতে অক্ষম হয়।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২১শে জুলাই বড়লাট জাতীয় প্রতিরক্ষা পরিষদ গঠন করে জিন্নার অনুমতি ব্যতিরেকে তাতে লীগ প্রভাবিত তিনটি প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিকন্দর (তাঁর ইউনিয়নিস্ট কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার সঙ্গে অবশ্য লীগের সম্বন্ধ ছিল আনুষ্ঠানিক), স্যার সাদুল্লা এবং ফজলুল হক সহ আরও তিনজন প্রভাবশালী মুসলমান নরনারীকে সদস্যরূপে নেন। জিন্না কৈফিয়ৎ তলব করলে প্রধানমন্ত্রীরা জানান যে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য করার অনুকূলে লীগের ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে আগস্টের প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া লীগের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, নিজ নিজ প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁরা মনোনীত হয়েছেন। কিন্তু বড়লাট লীগ সদস্যদের “লীগের সভাপতি এবং কার্যসমিতিকে এড়িয়ে’(১১) তাঁর শাসন পরিষদ ও জাতীয় প্রতিরক্ষা পরিষদে ঐসব মুসলমান সদস্য নেবার সিদ্ধান্ত করায় এবং ভারতসচিব আমেরী বিলাতের পার্লামেন্টে এই ঘোষণা করায় যে তাঁরা “মহান মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি” হিসাবে ঐ পদে নিযুক্ত হচ্ছেন, মুসলিম প্রতিনিধিত্বের একমেব দাবিদার লীগ—এই ভূমিকার প্রবক্তা জিন্না লীগ সদস্যদের বড়লাটের মনোনয়নে ঐসব পদে যোগদানের তীব্র বিরোধিতা করলেন। সঈদের মতে “ব্যাপারটা অতঃপর মুসলিম প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার এবং জিন্নার শক্তির পরীক্ষার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল।”(১২)
নামমাত্র ভাবে স্যার সিকন্দর লীগের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও ব্যক্তিগত ভাবে পাঞ্জাবের নেতৃত্বের প্রশ্নে জিন্নার বিরোধী ছিলেন। এ ছাড়া তাঁর মুসলমান-হিন্দু-শিখের মিলিত ইউনিয়নিস্ট রাজনীতির স্বার্থেও তিনি পাঞ্জাবের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে জিন্না ও মুসলিম লীগের প্রাধান্য অবাঞ্ছনীয় মনে করতেন যদিও অখিল ভারতীয় স্তরে জিন্নাকে মুসলমানদের প্রবক্তা হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হওয়ার তাই স্যার সিকন্দর প্রথমে জিন্না ও লীগের এই নির্দেশের তীব্র বিরোধিতা করলেন। কিন্তু জিন্নাও উপলব্ধি করেছিলেন যে এই প্রশ্নে পিছু হটে এলে পাঞ্জাবে লীগের ভবিষ্যৎ দীর্ঘকালের জন্য মাটি হয়ে যাবে এবং তাহলে পাকিস্তানের প্রথম অক্ষরই (P) আপাতত তাঁর হাতছাড়া হবে। স্নায়ুযুদ্ধের পরিণামে অনতবিলম্বে স্যার সিকন্দর আত্মসমর্পণ করলেন হয়তো এই ভেবে যে এর দ্বারা পাঞ্জাবে তাঁর কর্তৃত্ব হবে না। স্যার সাদুল্লাও তাঁর অনুগামী হলেন (২৫শে আগস্ট ১৯৪১)। শেরে বাঙ্গাল ফজলুল হক এই প্রশ্নে জিন্নার বিরুদ্ধে প্রথমে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করলেও বিধানসভায় তখন প্রধানত লীগ সদস্যদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছিল বলে (তাঁর কৃষক প্রজা দল ইতিমধ্যে মন্ত্রীমণ্ডলের নীতির প্রশ্নে বহুধা বিভক্ত হয়ে গেছে) শেষ পর্যন্ত জিন্নার নির্দেশের বিরুদ্ধে যাবার সাহস করলেন না। হকসাহেব পরবর্তীকালে (১৪ই নভেম্বর ১৯৪১) লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে গদি বজায় রাখলেন।(১৩) প্রধানমন্ত্রীদের ছাড়া বাকী তিনজন মুসলমান সদস্যদের একজন (ছতারির নবাব) হায়দ্রাবাদের প্রধানমন্ত্রীর পদ পেয়ে প্রতিরক্ষা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করায় জিন্নার রোষ থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন। বেগম শাহনওয়াজ ও স্যার সুলতান আহমদ তখনকার মতো লীগ থেকে বহিষ্কৃত হবার ঝুঁকি নিলেও মুসলিম রাজনীতিতে স্থান পাবার জন্য পরে আবার জিন্না ও লীগের দ্বারস্থ হন।
বিপুল জনসমর্থন যে কোনো রাজনৈতিক নেতার ভিতর দৈবনির্দেশিত পুরুষ বা চিরঅভ্রান্ততার মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারে, যদি না গান্ধীর মতো তিনি যথার্থ অধ্যাত্মবাদী হন। বিদেশের হিটলার, মুসোলিনী বা স্টালিন বা আমাদের দেশের নেহরু বা জিন্নাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। আর এই দৈবনির্দেশিত পুরুষ বা চিরঅভ্রান্ততার মানসিকতা এবং স্বৈরতন্ত্র ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। কেবল নিজ দলের স্বতন্ত্র অভিমত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্নদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রেই জিন্নার ভিতর এই সময়ে এই মানসিকতা ফুটে ওঠেনি, যাঁকে তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যস্থল ও হিন্দুসমাজের প্রতিভূরূপে বিবেচনা করতেন সেই গান্ধীর প্রতি তো বটেই, এমনকি মুসলমান সমাজে অদ্বিতীয় পণ্ডিত এবং অনন্য দেশভক্ত কংগ্রেসের তদানীন্তন সভাপতি মৌলানা আজাদের প্রতিও এই সময় তিনি এইরকম এক রূঢ় আচরণ করেন। অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুনের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবের (যুদ্ধশেষে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে— এই আশ্বাস পেলে কংগ্রেস জাতীয় সরকারে যোগ দিয়ে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় সহযোগিতা করবে) পরিপ্রেক্ষিতে লীগের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য ৮ই জুলাই আজাদ স্যার সিকন্দরের সঙ্গে দেখা করেন। পাঞ্জাবে লীগের সিকন্দরবিরোধী (আদি) গোষ্ঠী জিন্নার কাছে এই নিয়ে নালিশ করেন। সিকন্দরের মতাদর্শ এবং ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি- জিন্নার ষোল আনা বিশ্বাস ছিল না। তাই এক তারবার্তায় স্যার সিকন্দরকে সতর্ক করে দেবার সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রে এক বিবৃতির মাধ্যমে জিন্না জানান যে লীগ কর্তৃপক্ষকে ডিঙিয়ে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়ায় আসার অধিকার নেই।(১৪) আজাদ তাই জিন্নাকে এক গোপন তারবার্তা পাঠিয়ে জানান যে কংগ্রেস যে জাতীয় সরকারে যোগ দিতে রাজী হয়েছে তাতে অন্যান্য দলের প্রতিনিধিরাও থাকবেন। কংগ্রেসের সভাপতি তাই লীগের সভাপতির কাছে জানতে চাইলেন যে দ্বিজাতি তত্ত্বের পরিকল্পনাসম্মত নয় বলে লীগ কি এ জাতীয় কোনো সাময়িক ব্যবস্থাতে সম্মত হবে না?
জিন্না এ তারের যে জবাব দেন তাতে তাঁর ক্ষমতামদমত্ত স্বৈরতন্ত্রী মানসিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। তিনি জানালেন: “আপনার তারবার্তা বিশ্বাসের ভাব সৃষ্টিতে অপারগ। চিঠিপত্র অথবা অপর কোনো ভাবে আমি আপনার সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে অস্বীকার করছি এইজন্য যে আপনি মুসলিম ভারতের বিশ্বাস খুইয়েছেন। আপনি কি একথা বুঝতে পারেন না যে কংগ্রেস নিজেকে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের রঙে রঞ্জিত করতে এবং বিদেশীদের প্রতারিত করার জন্য আপনাকে মুসলমান খেলার পুতুল সভাপতি বানিয়েছে? আপনি মুসলমান অথবা হিন্দু—কারও প্রতিনিধিই নন। কংগ্রেস এক হিন্দু প্রতিষ্ঠান। আপনার যদি আত্মমর্যাদা থাকে, তাহলে অবিলম্বে পদত্যাগ করেন। এযাবৎ আপনি যতটা পেরেছেন লীগের ক্ষতির চেষ্টা করেছেন। আপনি জানেন যে এতে আপনি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। ঐ প্রয়াসে ক্ষান্তি দিন।”(১৫)
জিন্নার অহমিকা এতে তৃপ্ত হলেও এবং এজাতীয় ব্যাপারে তিনি একটা মর্ষকামী আনন্দ পেলেও তারবার্তায় যে মানসিকতা ফুটে উঠেছে তা যে আদৌ সুরুচিসম্পন্ন ছিল না এবং বিশেষ করে তাঁর ভাষায় সৌজন্যের অভাব ছিল—এ কথা লীগের প্রথম সারির নেতা খলিকুজ্জমাঁ ঘটনার বিশ বছর পর লিপিবদ্ধ করে গেছেন।(১৬)

২১
পাদটীকা

১. সমগ্রন্থ; ২০১ পৃষ্ঠা।
২. স্যার ফজল-ই-হাসানকে লিখিত আগা খাঁর পত্র। ডঃ আয়েষা জালাল কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৫২ পৃষ্ঠায় ৩১ সংখ্যক পাদটীকায় উদ্ধৃত।
৩. সমগ্রন্থ; ২৩৭ পৃষ্ঠা।
৪. পীরজাদা; The Pakistan Resolution and the Historic Lahore Session; জাত করাচী (১৯৬৮); ১৭-১৮ পৃষ্ঠা।
৫. আফজল ইকবাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩২ এবং ৩৩-৩৪।
৬. “তাঁদের বক্তব্যে যে বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হত তা সহজ: “মুসলিম লীগের পক্ষে যাঁরা ভোট দিচ্ছেন তাঁরা মুসলমান। এই এক কাজের জন্য তাঁরা বেহেস্তে যাবেন। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভোটদানকারীরা কাফের। মৃত্যুর পর তাঁদের স্থান দোজখ-এ। মুসলমানদের কবরস্তানে তাঁদের গোর দিতে দেওয়া উচিত নয়।” দ্রষ্টব্য শ্রী আফজল ইকবালের সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৩৮।
৭. আফজল ইকবাল; সমগ্রন্থ; ৩৭ পৃষ্ঠা।
৮. শ্রীমতী সান্দ্রা বি ফ্রিইটেজের Ambiguious Public Arenas and Coherent Personal Practice (Shariat and Ambiguity; ক্যাথরিক পি ইউইং সম্পাদিত; ছাত্রী অক্সফোর্ড; ১৯৮৮; পৃষ্ঠা ১৬২) দ্রষ্টব্য। ইকবাল মাসুদ কর্তৃক Partitioning Blame (Indian Express, দিল্লি); ২৭শে নভেম্বর ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের প্রবন্ধে উদ্ধৃত।
৯. আফজল ইকবাল; সমগ্রন্থ; ২৩ পৃষ্ঠা।
১০. বিধানসভায় তাঁর ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মার্চের বক্তৃতা। ড. আয়েষা জালাল কর্তৃক বলছি তাঁর গ্রন্থের ৬৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১১. বোম্বাই-এর ছোটলাট রজার লুমলে-এর এতদসংক্রান্ত ২০শে জুলাই ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের চিঠির উত্তরে জিন্নার ২১শে জুলাই-এর চিঠি।
১২. এম.এইচ.সঈদ; সমগ্রন্থ; ২৬১ পৃষ্ঠা।
১৩. তবে জিন্নার সঙ্গে ফজলুল হকের বিরোধ ভিতরে ভিতরে চলতে থাকল এবং ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের তেসরা ডিসম্বর হক্ জিন্নার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে লীগকে বাদ দিয়ে শরৎ বসু ও শ্যামাপ্রসাদ প্রমুখদের সহযোগিতায় ১১ই ডিসেম্বর এক মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করেন। কিন্তু ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে মার্চ গভর্নরের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য মীর হবার পর পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি অগৌরবজনকভাবে শেরে বঙ্গালকে জিন্নার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে পিছনের সারির নেতা হিসাবে লীগে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। মুসলিম সমাজে জিন্না ও লীগের দোর্দণ্ডপ্রতাপের পরিচায়ক জিন্না-হক্ বিরোধের কাহিনী।
১৪. খলিকুজ্জমা; সমগ্রন্থ; ২৪৯-৫০ পৃষ্ঠা।
১৫. পীরজাদা (সম্পাদিত); সমগ্রন্থ; ৩৩ পৃষ্ঠা।
১৬. সমগ্রন্থ; ২৫০ পৃষ্ঠা।
পৃষ্ঠা: ১৭০

মুসলমানদের “একমাত্র প্রবক্তা” ও ক্রিপস প্রস্তাব
২২

যাইহোক, এইভাবে ক্ষমতা-প্রাপ্তির অন্যতম সোপান মুসলমানদের একমেব নেতা রূপে ব্রিটিশ সরকার এবং কংগ্রেসসহ তাবৎ রাজনৈতিক দলের কাছে প্রতিভাত হবার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইংরেজ ও কংগ্রেসের সঙ্গে শক্ত ঘাঁটি থেকে আলাপ-আলোচনাও বজায় রাখলেন।
চলে যুদ্ধে মিত্রশক্তির অবস্থার ক্রমাবনতি হতে থাকায় ইতিমধ্যে ব্রিটিশ মন্ত্রীমণ্ডলে পরিবর্তন হয়েছে। চার্চিল প্রধানমন্ত্রী এবং আমেরী ভারতসচিব। ফলে সরকারি মহলে জিন্নার কদর বেড়ে গেল। তাঁর সাংবাদিক বন্ধু শিব রাও এ সময়ে সিমলার (ভারত সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী) সরকারি মহলের মনোভাব সম্বন্ধে মাদ্রাজের “হিন্দু” পত্রিকায় লেখেন যে তাঁদের মধ্যে জিন্নাপ্রীতির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এবং জিন্না অসন্তুষ্ট হতে পারেন এমন কোনো পদক্ষেপ যুক্তিযুক্ত হলেও কর্তৃপক্ষ নিতে অনিচ্ছুক। নূতন সরকার ভারতবাসীর সঙ্গে বোঝাপড়া করার আর একটি চেষ্টা করল। এর অঙ্গ হিসাবে বড়লাটের আমন্ত্রণে জিন্না ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে জুন তাঁর সঙ্গে দেখা করে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করার সঙ্গে সঙ্গে যেসব দাবি জানালেন তা তাঁর ১লা জুলাই-এর চিঠিতে লিপিবদ্ধ করলেন। দাবিগুলি হল: (ক) লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি এবং ভারত বিভাগের পরিকল্পনাকে ব্যাহত করতে পারে এমন কোনো ঘোষণা করা হবে না; (খ) মুসলিম-ভারতের পূর্ব-স্বীকৃতি ছাড়া ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে কোনো অস্থায়ী বা স্থায়ী ব্যবস্থা করা হবে না; (গ) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারসমূহের মুসলিম নেতৃত্বকে সমান অংশ ও অধিকার দিলেই কেবল যুদ্ধপ্রচেষ্টায় ভারতবাসীদের পক্ষে উপযুক্ত ভাবে যোগদান করা সম্ভব হবে এবং (ঘ) যুদ্ধ চলাকালীন বড়লাটের শাসন পরিষদের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে কংগ্রেসকে যদি যোগ দিতে দেওয়া হয় তাহলে অতিরিক্ত আসনে মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের সমান হবে। নচেৎ মুসলমানদের মোট আসনের অধিকাংশ দিতে হবে। কারণ তাঁদেরকেই যুদ্ধ প্রচেষ্টার অধিকাংশ দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে। প্রস্তাবিত যুদ্ধ পরিষদের সদস্য-সংখ্যাও পূর্বোক্ত ধরনে নির্ধারিত হবে এবং সেই পরিষদ ও বড়লাটের শাসন পরিষদের মুসলমান সদস্যদের মনোনীত করবে লীগ।
জিন্নার দাবি সরকারি ক্ষমতা লীগের হাতে তুলে দেবার সমতুল্য ছিল। তাঁকে এতটা সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয় বলে বড়লাট তাঁর ৬ জুলাই-এর উত্তরে জানালেন যে এ ব্যাপারে মুসলমানদের স্বার্থের দিকে পূর্ণমাত্রায় নজর রাখলেও এবং লীগের পরামর্শের প্রতি যথোচিত গুরুত্ব দিলেও সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে বড়লাট ও ভারতসচিবের হাতে। ইতিপূর্বে স্যার সিকন্দর ও ফজলুল হকের সঙ্গে জিন্নার ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষের প্রসঙ্গে আলোচিত তাঁদের জাতীয় প্রতিরক্ষা পরিষদের সদস্য হবার পটভূমিকা এই।
৭ই আগস্ট বড়লাট সরকারের নীতি ঘোষণা প্রসঙ্গে বললেন যে দেশবাসীর কোনো অনিচ্ছুক অংশের প্রতি কোন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেবার ইচ্ছা সরকারের নেই এবং যুদ্ধের অবসানে ভারতের বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধিদের নিয়ে নূতন সংবিধানের কাঠামো রচনার ব্যবস্থা করা হবে। বড়লাটের শাসন পরিষদের সম্প্রসারণ ও যুদ্ধের পরামর্শদাতা পরিষদ গঠনের কথাও তিনি জানালেন। নূতন মন্ত্রীসভার ভারতসচিব আমেরীর কণ্ঠে ভেদনীতির সনাতন সুর বেজে উঠল। তিনি বললেন—ভারতের সমস্যা সরকার বনাম দেশবাসীর মতবিরোধ নয়, ভারতবাসীদের পরস্পরবিরোধ। সুতরাং হিন্দুরা ছাড়াও মুসলমান, তপশিলী সম্প্রদায় ও দেশীয় রাজন্যবর্গের ভিতর একটা রফা হওয়া দরকার। তবে ভারত বিভাগের দাবিকে নিরুৎসাহ করার উদ্দেশ্যে তিনি এও বললেন যে ভারত এক স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং বৈশিষ্ট্যযুক্ত অঞ্চল এবং সকলের পক্ষে সমান এক প্রাচীন সভ্যতা ও পুরাতন ইতিহাসের জন্য ভারতবর্ষ ও এই দেশবাসী গর্ব করতে পারে।(১)
আবার একদফা আলাপ-আলোচনা এবং তার শেষে ২৯শে সেপ্টেম্বর জিন্না লীগ কাউনসিলের সভায় ঘোষণা করলেন যে ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার প্রস্তাবে তাঁর আপত্তি না থাকলেও বর্তমানে সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর করার ইচ্ছা নেই। তাঁরা মুসলিম জাতির (nation) ৯ কোটি সদস্যকে উপেক্ষা করছেন বলে সহযোগিতার এ প্রয়াস আপাতত ব্যর্থ হল।
টাকা কংগ্রেস শিবিরেও অনুরূপ হতাশার সৃষ্টি হল। কংগ্রেস একদিকে যুদ্ধের সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে মিত্রশক্তিকে বিব্রত করতে চায় না, অন্যদিকে ভারতবাসীর স্বাধিকার সঙ্কোচনের প্রতিও চোখ বুজে থাকতে পারে না। তাই কংগ্রেস অক্টোবর থেকে প্রতীকাত্মক ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের সিদ্ধান্ত নিল যাতে মাত্র একজন করে সত্যাগ্রহী বাক্‌স্বাধীনতার জন্য সরকারি নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে আহুত জনসভায় কেবল বলবেন যে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ধন বা জন দিয়ে সাহায্য করা পাপ বা অধর্ম। গান্ধীর ব্যক্তিগত নির্দেশে ও নেতৃত্বে পরিচালিত এই সত্যাগ্রহে সমগ্র দেশে প্রায় ৫ হাজার বাছাই করা কংগ্রেস কর্মী কারাবরণ করেন। এই সত্যাগ্রহে লীগের বিরুদ্ধে কোনো কিছু থাকার কোনো সুদূর সম্ভাবনা না থাকলেও লীগ কাউন্সিল এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সত্যাগ্রহের পিছনে গান্ধীর “সত্যকার অভিসন্ধি ও উদ্দেশ্য” “ধরে ফেলে” জানাল যে, “মুসলিম দাবির পরিপন্থী অথবা তার প্রতিকূল কোনো সুবিধা কংগ্রেসকে দিলে” লীগ তার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। অস্ত্র ধরতে হোক বা না-ই হোক, উভয়ের সাধারণ শত্রু কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এই জেহাদ ব্রিটিশ সরকারের মনঃপূত হয়েছিল— একথা বলাই বাহুল্য। ১৯শে নভেম্বর জিন্না কেন্দ্রীয় পরিষদে বক্তৃতাপ্রসঙ্গে এক চমক সৃষ্টি করলেন। মহম্মদ আলীর করাচী থেকে কলকাতা পর্যন্ত এক করিডরের দাবির উল্লেখ করলেন প্রস্তাবিত পাকিস্তানের দুই অংশের সংযোগভূমি হিসাবে। (২) পাছে প্রতিপক্ষ মূল দাবি না মানে তাই দাবির পরিধি বাড়িয়ে তাদের মনোবল ভেঙে দেবার জিন্নার কৌশলের অঙ্গ এ।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূরীকরণের জন্য আহুত বোম্বের আসন্ন নির্দলীয় সম্মেলন উপলক্ষ করে এর উদ্যোক্তা লিবারেল নেতা সপ্রু গান্ধী- জিন্না সাক্ষাৎকারের উদ্যোগ নেন। জিন্না “হিন্দু নেতা হিসাবে” তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক হলেও গান্ধীর পক্ষে সে প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। জিন্নাও মার্চে অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে যোগ না দিয়ে ব্যঙ্গ করে সম্মেলনকে ওলন্দাজ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে তুলনা করেন যাতে “সবাই সেনাপতি, সৈন্য কেউ নয়।”
এ বছরে ভারত বিভাজনের দাবির বিরোধীদের এবং তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক প্রভাবশালী নেতা গান্ধীর বক্তব্যের খণ্ডন প্রয়াস জিন্নার অন্যতম কৃতি। দোসরা মার্চ পাঞ্জাব মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন কর্তৃক আহুত পাকিস্তান সম্মেলনে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কোনো ইংরেজ ভিন্ন ধর্মগ্রহণ করলেও ইংরেজই থেকে যায়— গান্ধীর এই যুক্তির বিরুদ্ধে জিন্না বললেন যে ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সে যুক্তি খাটে না। কারণ এখানে ভিন্ন ধর্মগ্রহণকারী মাত্রেই হিন্দুদের চোখে ম্লেচ্ছ এবং “হিন্দুরা সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অথবা কোনোভাবেই তার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখে না।” এদেশের ধর্মান্তরিত “এক ভিন্ন ব্যবস্থার” সদস্য হয়ে পড়ে। ভারতবর্ষে মুসলমানরা এই সেদিন ধর্মান্তরিত— গান্ধীর এই যুক্তির জবাবে জিন্না বলেন, “প্রায় এক হাজার বছর হয়ে গেল অধিকাংশ মুসলমান এক ভিন্ন জগৎ, এক ভিন্ন সমাজ, এক ভিন্ন দর্শন এবং এক ভিন্ন বিশ্বাসের আওতায় রয়েছে। এই অবস্থাকে কি আপনারা নিছক ধর্ম পরিবর্তন, পাকিস্তান দাবির যুক্তি হতে পারে না—এই বৃথা বাগাড়ম্বরের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন?”
ইসলাম দেশবিভাগের বিরোধী — গান্ধীর এই বক্তব্যের খণ্ডন প্রসঙ্গে নাটকীয় ভাবে জিন্না বলেন, “ভদ্রমহোদয়া ও ভদ্রমহোদয়গণ! আমি শাস্ত্রজ্ঞ মৌলানা বা মৌলভী নই, আর ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে আমার জ্ঞান আছে, এমন দাবিও আমি করি না। তবে আমার ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে অল্পস্বল্প আমিও জানি এবং আমার ঐ ধর্মবিশ্বাসের আমি এক দীন কিন্তু গর্বিত অনুগামী (শ্রোতৃমণ্ডলীর উল্লাস)। ঈশ্বরের দোহাই, আমি কি একথা জানতে পারি যে, এই লাহোর প্রস্তাব কি করে ইসলামবিরোধী হল? কেন এ ইসলাম-বিরোধী?” ভারত বিভাজন মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী—এর জবাবও দিলেন তিনি অনুরূপ নাটকীয় ভঙ্গিতে। বললেন, “আমার হিন্দু বন্ধুদের আমি বলি—দয়া করে আমাদের বিরক্ত করবেন না (উল্লাস)। আমাদের ভুল দেখিয়ে দেবার জন্য আপনাদের আমরা উচ্ছ্বসিত ধন্যবাদ জানাই।…এর পরিণতির সম্মুখীন হতে আমরা প্রস্তুত।…দয়া করে নিজেদের সামলান।” দেশবিভাগে সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান হবে না, প্রস্তাবিত উভয় রাষ্ট্রেই যথেষ্ট সংখ্যক সংখ্যালঘু থেকে যাবেন—এই যুক্তির বিরুদ্ধে তিনি বললেন, “যুক্তি হিসাবে কি আপনারা একথা উল্লেখ করতে চান যে হিন্দু সংখ্যালঘুরা অথবা মুসলমান অঞ্চলসমূহের সংখ্যালঘুরা সংখ্যালঘু হয়েই থেকে যাবেন বলে ৯ কোটি মুসলমান এক কৃত্রিম ‘অবিভাজিত ভারতে’, যেখানে এককেন্দ্রিক শাসন-ব্যবস্থা চলবে সেখানে সংখ্যালঘু হিসাবে বসবাস করবেন যাতে আপনারা তাদের সকলের উপর প্রভুত্ব করতেন পারেন…?” যুক্তির দিক থেকে জিন্নার বক্তব্যের দুর্বলতা কিন্তু মুসলমান সমাজের কাছে ধরা পড়ল না। তাঁদের বড় একটা অংশ জিন্নার বক্তব্যের এই সাম্প্রদায়িক আবেদনমূলক আবেগের দ্বারা এই বিশ্বাসে আবিষ্ট হয়ে গেলেন যে, পাকিস্তান হল ‘মুসলমানদের কাছে জীবন-মরণের প্রশ্ন এবং… দরকষাকষির কোনো আখড়া নয়।”(৩)
১২ই এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত লীগের বাৎসরিক অধিবেশনের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ সম্মেলনে পাকিস্তান প্রাপ্তিকে লক্ষ্য হিসাবে লীগের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করানোর ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে জিন্না যথারীতি গান্ধী ও কংগ্রেসের তীব্র ভাষায় নিন্দা করেন। অধিবেশনে বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত তামিলনাড়ুর রামস্বামী নাইকার, সম্মুখম্ চেট্টি প্রমুখ অব্রাহ্মণ সংগঠনের নেতাদের সমর্থনে তিনি পৃথক দ্রাবিড়স্তানের দাবিরও পোষকতা করেন। এছাড়া লক্ষ্যপ্রাপ্তির জন্য একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সাহসী তরুণ সহকর্মীদের জন্য আবেদন জানান। সত্যাগ্রহ দ্বারা কংগ্রেস যে চাপ দেবার চেষ্টা করছে ব্রিটিশ সরকার যেন তার কাছে নতিস্বীকার না করে—এই পরামর্শ দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন: “যাঁরা আপনাদের পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছুক এবং যাঁরা আন্তরিকভাবে আপনাদের সমর্থন করতে অভিলাষী তাঁদের প্রতি আপনারা অনুগত নন…। আপনারা যদি সততা সহকারে মুসলিম ভারতের সাহায্য সহযোগিতা চান তাহলে হাতের তাস টেবিলের উপর ফেলুন এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করুন।”(৪) ডিসেম্বরে তিনি নাগপুরে মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের অধিবেশনে ভাষণ দিলেন এবং ফজলুল হক্ লীগ ছেড়ে কোয়ালিশন মন্ত্রীমণ্ডল গড়ায় তাঁর এবং তাঁর সহযোগী ঢাকার নবাবের তীব্র নিন্দা করলেন। হক্ সাহেবের মন্ত্রীমণ্ডল থাকা সত্ত্বেও পরের বছর ১২ই ফেব্রুয়ারি হাওড়া স্টেশনে পৌঁছালে সুরাবর্দী-সিদ্দিকী-ইস্পাহানীর ব্যবস্থাপনায় ৪০ হাজার জনতা তাঁর জয়ধ্বনি দিতে দিতে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল। কলকাতা থেকে সিরাজগঞ্জ গিয়ে জিন্না প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করলেন। বাংলার গ্রামাঞ্চলেও তখন লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে জাপান যুদ্ধে যোগদান করে পরবর্তী ফেব্রুয়ারির ভিতর মালয় সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দখল করার পর ভারতবর্ষের পূর্বদিকে যথার্থ সঙ্কটের কালো মেঘ দেখা দেয়। জাপানের সঙ্গে যুদ্ধরত চীনের নেতা চ্যাং কাইশেক ভারত সফরে এসে এবং জাতীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাঁর সহানুভূতি কোন্ দিকে তা পরোক্ষ ভাবে জানিয়ে গেছেন। আমেরিকাও এতদিনে প্রকাশ্যে মিত্রশক্তির সঙ্গে যোগ দিয়েছে এবং ঐ দেশের জনমত মনে করে যে ভারতকে পরাধীন রেখে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় যথোচিত সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়। ব্রিটেনের যুদ্ধকালীন জাতীয় মন্ত্রীমণ্ডল তাই কংগ্রেস নেতাদের কারামুক্ত করে মন্ত্রীপরিষদের সদস্য ক্রিপসের মাধ্যমে আর এক দফা ভারতবাসীর সঙ্গে রফার চেষ্টা করলেন। প্রধানমন্ত্রী চার্চিল অবশ্য এই ব্যবস্থার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এবং ভারতসচিব ও বড়লাট দুইজনেই এ ব্যাপারে চার্চিলের অনুগামী ছিলেন। তবুও ব্যর্থতার জন্য প্রস্তুত হয়েই নিছক মন্ত্রীসভার শ্রমিক দল ও যুদ্ধপ্রচেষ্টায় সহযোগী আমেরিকার জনমতের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য চার্চিল মন্ত্রীসভা ক্রিপসকে তাঁদের প্রস্তাবসহ ভারতে পাঠালেন। গান্ধী ক্রিপস প্রস্তাবের সারমর্ম জেনে প্রথম আলোচনার পরই নিরুৎসাহ হলেও ক্রিপস জওহরলাল প্রমুখ কংগ্রেস নেতাদের পূর্বপরিচিত বলে কংগ্রেসি মহলে নূতন আশার সঞ্চার হল। সঙ্গত কারণেই জিন্না সন্দিগ্ধ হলেন এবং ক্রিপসের সঙ্গে আলোচনায় সতর্ক ভাবে এগোলেন। ইতিপূর্বেই তিনি অবশ্য চার্চিলকে তারযোগে জানিয়ে ছিলেন যে, “কংগ্রেসের এজেন্ট” সপ্রুর ভারতকে অখণ্ড রেখে শাসন সংস্কারের জন্য প্রস্তাব বিবেচিত হলে মুসলমানরা বিদ্রোহী হবেন এবং যুদ্ধ প্রচেষ্টাও ব্যাহত হবে।
ক্রিপস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ দিল্লিতে এসে দফায় দফায় ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। সরকারের যুদ্ধশেষে ভারতবর্ষকে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন দেবার অভিপ্রায় থাকলেও চার্চিলের কাছে জিন্নার তারবার্তা তাঁকে অবিলম্বে ঐজাতীয় প্রস্তাব দেওয়া থেকে বিরত রাখল। ইতিমধ্যে ইন্ডিয়া অফিসের সিভিলিয়ানরা কংগ্রেসের দাবির কাছে “আত্মসমর্পণ” করে ভারতে সাংবিধানিক পরিবর্তন করলে ১০ লক্ষ সদস্যযুক্ত সৈন্যবাহিনীর উপর তার কী কুপ্রভাব পড়বে সেকথা আমেরীকে জানালেন এবং তিনি তা প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের গোচরীভূত করায় যথার্থ ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ব্যাপারে তাঁর হাত আরও পুষ্ট হল। চার্চিল লিনলিথগোকে জানিয়েও দিলেন যে ভারতীয় দলগুলি সরকারের এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলেও ব্রিটেনের আন্তরিকতার কথা জগতে প্রচারিত হয়েই যাবে।(৫)
ক্রিপস প্রস্তাবের সারমর্ম হল: “যুদ্ধশেষে দেশীয় রাজ্যসমূহসহ ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা পাবে এবং নিজের জন্য নূতন সংবিধান রচনা করবে। তবে ব্রিটিশ ভারতের কোনো প্রদেশ যদি ভারতীয় যুক্তরাজ্যে যোগ দিতে না চায় তাহলে তার স্বতন্ত্র থাকার অধিকার থাকবে। অবশ্য ইচ্ছা হলে সে প্রদেশ পরে কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। এইভাবে পৃথক থাকতে ইচ্ছুক প্রদেশ বা প্রদেশসমূহ নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র সংবিধানও রচনা করতে পারবে। ভবিষ্যৎ গণপরিষদ গঠনের পদ্ধতি বর্ণনা করে অতঃপর ঐ প্রস্তাবে ভারতীয় নেতৃবর্গকে অবিলম্বে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব নেবার জন্যও আহ্বান জানানো হয়েছিল এই শর্তে যে যুদ্ধচলাকালীন ভারতরক্ষার পূর্ণ দায়-দায়িত্ব থাকবে ভারত সরকারের হাতে।(৬)
একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে এই প্রস্তাবে যুদ্ধশেষে ভারতীয় যুক্ত রাজ্য গঠনের মাধ্যমে স্বশাসন প্রবর্তনের কথা থাকলেও প্রয়োজনে ভারত বিভাজনেরও স্বীকৃতি ছিল। তবে এ বিভাজন সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বা অটনমির নামে। আর ভারতীয় নেতাদের শাসনব্যবস্থার অঙ্গীভূত করার প্রস্তাব থাকলেও প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধ প্রচেষ্টার সমস্ত ব্যবস্থা ও উদ্যোগ-আয়োজন ইংরেজদের হাতে রাখা হয়েছিল। এতে যুদ্ধকালে প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় নেতাদের মান-মর্যাদা দিলেও যথার্থ ক্ষমতার এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ দেবারও পরিকল্পনা ছিল না।
ক্রিপসের সঙ্গে বিভিন্ন দলের নেতাদের অনেক আলাপ-আলোচনা হল যাতে বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্য শুনে প্রস্তাবের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও ভাষ্য দেওয়া হল। শেষ অবধি কংগ্রেস আত্মনিয়ন্ত্রণের যুক্তির দোহাই দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের সম্ভাবনাযুক্ত প্রস্তাবের দীর্ঘমেয়াদী অংশ অর্থাৎ যুদ্ধশেষে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন ও গণপরিষদের অংশে আপত্তি না করলেও ভারতের দ্বারদেশের বিদেশি আক্রমণকারী (জাপান) উপস্থিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ভারতবাসীদের সর্বতোভাবে সংগঠিত করার জন্য অবিলম্বে যথার্থ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় সরকার গঠন করা হচ্ছে না বলে ১০ই এপ্রিল ক্রিপস প্রস্তাব অগ্রাহ্য করল। কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত প্রচারিত হবার পরদিন লীগ প্রস্তাবে পাকিস্তানের সম্ভাবনা নিহিত আছে বলে প্রস্তাবের ঐ অংশের সমর্থন করলেও বর্তমান রূপে ঐ প্রস্তাবকে গ্রহণের অযোগ্য বিবেচনা করল। লীগের আপত্তির বিশেষ কারণগুলি হল: পাকিস্তান প্রাপ্তির সম্ভাবনা ভবিষ্যতের ব্যাপার, বর্তমানে মুসলিম জাতিকে অন্তত প্রথম দিকে হিন্দুদের সঙ্গে একই গণপরিষদে বসতে বাধ্য হবার অঙ্গীকার করতে হবে, গণপরিষদের প্রস্তাবিত গঠনপদ্ধতি মুসলমানদের মৌলিক অধিকার পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রতিকূল, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে পৃথক হয়ে যাবার জন্য গণভোট নিতে হলে সে অধিকার সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক অধিবাসীদের বদলে কেবল মুসলমানদের দিতে হবে—নচেৎ আত্মনিয়ন্ত্রণের কোনো অর্থ নেই ইত্যাদি। কংগ্রেস জাতির প্রতিনিধিরূপে কথা বলতে পারে না এবং ঐ প্রতিষ্ঠান কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সংগঠন ইত্যাদি বলে ১৩ই এপ্রিল জিন্না ঘোষণা করলেন, “সব দল যদি মুসলমানদের পাকিস্তান দাবি বা দেশবিভাগ এবং
পৃষ্ঠা: ১৭৫

আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নেয় এবং তার খুঁটিনাটি যদি যুদ্ধশেষে স্থির হবে বলে নির্ধারিত হয় তাহলে বর্তমান সম্বন্ধে আমরা কোনো যুক্তিযুক্ত বোঝাপড়ায় আসতে প্রস্তুত।”
ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পূর্বোক্ত প্রকাশ্য কারণসমূহ ছাড়াও কিছু কিছু গোপন কারণ ছিল। ড. আয়েষা জালালের মতে এর মূল ছিল লাহোর প্রস্তাবের অন্তনির্হিত স্ববিরোধে যার জন্য ক্রিপস প্রস্তাবে: “সম্প্রদায়গুলিকে নয়, প্রদেশসমূহকে কেন্দ্রের বাইরে থাকার অধিকার দেবার প্রস্তাব করায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহকে স্পষ্টত এক সাম্প্রদায়িক পতাকার আওতায় কেন্দ্রে আনার জিন্নার প্রয়াসের পক্ষে গুরুতররূপে ক্ষতিকারক হবার সম্ভাবনা ছিল। অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে প্রাদেশিক ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সঙ্গে অখিল ভারত পর্যায়ে কোনো সাম্প্রদায়িক দলের নেতৃত্ব অনুসরণ করার সঙ্গতি নেই। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে এই অস্বস্তিকর প্রশ্নেরও উদ্ভব হয়েছিল যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের মুসলমান নেতারা যদি জিন্নার ও লীগের অনুবর্তী হন তাহলে ঐসব প্রদেশের অমুসলমান সংখ্যালঘুদের অবস্থা কেমন হবে।”(৭) উপরন্তু জিন্নার প্রধান সমর্থক ছিলেন পাঞ্জাব, বাংলা বা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের মুসলমানরা নন, মুসলমান সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশগুলির মুসলমানরা। আঞ্চলিক ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে, তাঁদের কোনো সুরাহা হবে না। লিনলিথগো তাই সঙ্গত কারণেই আমেরীকে জানিয়েছিলেন যে, “সংযুক্ত প্রদেশ ও বিহারের মুসলমানদের এ প্রস্তাবে সান্ত্বনার কিছু নেই।”(৮)
এ সম্বন্ধে মন্তব্য প্রসঙ্গে ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণের সমর্থক খলিকুজ্জমাঁ লিখেছেন: “আমার অভিমত কার্যকরী হয়নি। কারণ ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশ সদস্য এই ভাবধারার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন যে, কেবল মুসলমান ভোটারদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। এ সম্বন্ধে ন্যূনতম বক্তব্য এই যে এর ফলে কোনো অঞ্চলের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের একটা নূতন ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করা হল যেখানে কেবল একটি মাত্র সম্প্রদায় এজাতীয় দাবি জানাচ্ছে এবং ইতিহাসে এর দ্বিতীয় কোনো নিদর্শন নেই।…ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানকারী লীগের প্রস্তাব ১২ই এপ্রিল গৃহীত হয়। পাঞ্জাব ও বঙ্গের বিভাজনের বীজও তার সঙ্গে সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে উপ্ত হয়।”(৯)
কংগ্রেস ও লীগ ভিন্ন ভিন্ন কারণে ক্রিপস প্রস্তাব বর্জন করায় যুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ায় সম্ভাবনা তিরোহিত হল। কংগ্রেস তাই ৮ই আগস্ট বোম্বাই- এ অনুষ্ঠিত অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে “ভারত ছাড়ো” প্রস্তাব গ্রহণ করে দেশবাসীকে আবার স্বাধিকারের জন্য গণসংগ্রামে প্রবৃত্ত হবার আহ্বান জানাল। ইতিপূর্বে ওয়ার্কিং কমিটির এতদসংক্রান্ত প্রস্তাবের উপর মন্তব্য প্রসঙ্গে ৩১শে জুলাই জিন্না এক বক্তব্যের মাধ্যমে বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, “কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুলাই-এর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত, যাতে বলা হয়েছে যে ব্রিটিশ অবিলম্বে ভারত ছেড়ে চলে না গেলে এক গণ-আন্দোলন আরম্ভ করা হবে তা মিস্টার গান্ধী ও তাঁর হিন্দু কংগ্রেসের ব্রিটিশ সরকারকে ভয় দেখিয়ে কার্যসিদ্ধি করার এবং চাপ দিয়ে ব্রিটিশ বেয়নেটের ছত্রছায়ায় এমন এক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করার সর্বশেষ প্রয়াস যার দ্বারা অনতিবিলম্বে এক হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা হবে এবং ঐ কংগ্রেসরাজের করুণার উপর মুসলমান ও অপরাপর সংখ্যালঘু স্বার্থদের নির্ভর করতে হবে।” জিন্নার এই সুস্পষ্ট অভিমতের পরও রাজাজি(১০) তাঁর সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার জন্য গান্ধীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন এবং প্রারম্ভিক কিছুটা দ্বিধার পর গান্ধী ৪টা আগস্ট বোম্বাই-এর সেই ঐতিহাসিক অধিবেশনের চারদিন পূর্বে জিন্নার উদ্দেশে তাঁদের উভয়ের পরিচিত বোম্বের জনৈক মুসলমান ভদ্রলোককে (জনাব মেকলাই) উপলক্ষ করে একটি প্রস্তাব পাঠান। সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে জিন্নার যে আলোচনা হয়েছিল তার বিবরণ তাঁর কাছ থেকে অবগত হবার পর তিনি জানান, “মুসলিম লীগ যদি কংগ্রেসের অবিলম্বে স্বাধীনতা পাবার দাবির সঙ্গে কোনোরকম কুণ্ঠা ছাড়াই পূর্ণমাত্রায় সহযোগিতা করে….তাহলে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক আজ নিজের বর্তমান যাবতীয় ক্ষমতা (সমগ্র ভারতবর্ষের তরফ থেকে) মুসলিম লীগের হাতে হস্তান্তর করার ব্যাপারে কংগ্রেসের কোনো আপত্তি হবে না।”(১১)
অবিলম্বে স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন্য উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত গান্ধী ৮ই আগস্ট অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদীদের দীর্ঘদিনের কৌশল— সাম্প্রদায়িক বিভেদের অজুহাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিলম্বের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “ভারতবর্ষের অচিরাৎ স্বাধীনতার জন্য জিন্নাসাহেব রাজী না হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারি না।” অবিলম্বে ভারতবাসীর স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেসের ঐ অধিবেশন “ভারত ছাড়ো” প্রস্তাব(১২) গ্রহণ করল এবং এর প্রতি সরকারের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল পরদিবস প্রত্যুষে গান্ধী এবং কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সমস্ত সদস্যদের গ্রেপ্তার ও অন্তরীণ করা। এর প্রতিবাদে দেশের নানাস্থানে প্রকাশ্য বিদ্রোহের পরিস্থিতি দেখা দেওয়ায় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করা ও কংগ্রেসের সর্বস্তরের কর্মীদের কারারুদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে সরকার ঐ প্রতিষ্ঠান এবং তার কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ আরম্ভ করল। বাংলা সরকারের তদানীন্তন মুখ্য সচিবের মতে ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত হল, “কংগ্রেসবিরোধী তাবৎ শক্তিকে সংহত করা। সংহতির এই প্রক্রিয়ায় সেই সব দল ও সংগঠন অন্তর্ভুক্ত হবে প্রচণ্ড গোলযোগ সৃষ্টিকারী এই সম্ভাব্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে যারা আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক।”(১৩) যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছুই নেই এবং ইংলন্ড তো তখন জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত।
সরকারকে সাহায্য করার জন্য জিন্না হাতের কাছেই ছিলেন, যদিও ভিন্ন কারণে। বোম্বাই-এ অনুষ্ঠিত লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তিনি মুসলমানদের “আন্দোলনে কোনোরকম অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার” পরামর্শ দিয়ে বললেন যে, “তাঁরা যেন নিজেদের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রার অনুশীলন করেন।” কারণ তাঁর মতে “আন্দোলন এইজন্য মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী যে তা সরকারকে কংগ্রেসের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য বাধ্য করার উদ্দেশ্যে আরম্ভ করা হয়েছে। কংগ্রেসের এই দাবি মেনে নেবার অর্থ মুসলিম স্বার্থের উপর মৃত্যুকল্প আঘাত হানা।” গান্ধী ও কংগ্রেসের উপর পূর্বেই অবিশ্বাস ছিল। “ভারত ছাড়ো” প্রস্তাবের উপর গান্ধীর পূর্বোদ্ধৃত বক্তৃতা সেই অবিশ্বাসকে আরও দৃঢ়মূল করায় স্পষ্টত জিন্নার এই কঠোর ভূমিকা।
কাউনসিল অফ স্টেটস-এর লীগ পরিষদীয় দলের সম্পাদক সৈয়দ মহম্মদ হুসেন এবং সৈয়দ আবদুল লতিফের লীগের এই ভূমিকার প্রতিবাদের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর লীগের ওয়ার্কিং কমিটির ২০শে আগস্টের সরব ভর্ৎসনা ডুবিয়ে দিল। ওয়ার্কিং কমিটির বক্তব্য হল: “যুদ্ধ শুরু হবার প্রারম্ভ এবং এমনকী তার পূর্ব থেকেই কংগ্রেস নীতির একমেব উদ্দেশ্য হচ্ছে কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা সমর্পণের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে তোষামোদ করা অথবা চাপ দেওয়া।…এর সঙ্গে সঙ্গে তারা অবশ্য ভারতবর্ষের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিও জানিয়েছে। কিন্তু এই ‘ভারতবর্ষ’ হিন্দু সংখ্যাগুরুদের অনুকূল কংগ্রেসি পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। মুসলমান জাতি (nation) নিজেদের ভবিতব্য নির্ধারণ করুন তাঁদের এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কিন্তু কংগ্রেস নিয়মিত বিরোধিতা করে আসছে।” প্রস্তাবে এও বলা হল যে, “ভারত ছাড়ো” দাবি, “যথার্থ অভিসন্ধি গোপন করার এক নিছক কৌশল এবং এর আসল লক্ষ্য হল কংগ্রেস কর্তৃক দেশের শাসন-ব্যবস্থার উপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ-প্রাপ্তি।”
শত্রুর শত্রু বরাবরই মিত্র হয়ে থাকে। সুতরাং ভারতের ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি এবং ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের কংগ্রেস নেতাদের কারামুক্ত না করা পর্যন্ত জিন্না ও লীগের চেয়ে বড় মিত্র আর কারও পক্ষে হওয়া সম্ভব ছিল না।

২২
পাদটীকা

১. উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৮৬ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
২. শরীফ অল মুজাহিদ; সমগ্রন্থ; ৫৯৬।
৩. জিন্নার বক্তব্য জামিলউদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত) M. A. Jinnah, Some Recent Speeches and Writings (লাহোর, ১৯৫২) (অতঃপর Some Recent Speeches রূপে উল্লেখিত হবে) গ্রন্থের ২৫৩-৫৬ পৃষ্ঠা থেকে অ্যালান হেইস মিরিয়াম কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ৭২-৭৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
৪. সঈদ; সমগ্রন্থ; ২৫৯ পৃষ্ঠা।
৫. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ১৯৬-১৯৭ পৃষ্ঠা।
৬. রাজেন্দ্রপ্রসাদ; সমগ্রন্থ; ১৬০ পৃষ্ঠা এবং খলিকুজ্জমা; সমগ্রন্থ; ২৭৪-276 পৃষ্ঠা।
৭. সমগ্রন্থ; ৮২ পৃষ্ঠা।
৮. সমগ্রন্থ; ৭৮ পৃষ্ঠা।
৯. সমগ্রন্থ; ২৭৮-২৭৯ পৃষ্ঠা। খলিকুজ্জমার ভূমিকার পূর্ণ তাৎপর্যের জন্য নিম্নোদ্ধৃত মাত্র তথ্যও বিবেচ্য: “১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের (৭ই) অক্টোবরে অর্থাৎ ক্রিপস প্রস্তাবের পর চৌধুরী খলিকুজ্জমাঁ জিন্নাকে এজাতীয় ‘আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাসের’ সম্ভাব্য অসুবিধার সম্বন্ধে লেখেন। পাকিস্তানের উভয় এলাকা এবং মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলির সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখার উপর তিনি জোর দেন। পাকিস্তান এলাকার সঙ্গে মুসলিম কী সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহের বিপুল দূরত্ব এবং মাঝের শত্রুতাভাবাপন্ন এলাকার ফলে মুসলিম সাংস্কৃতিক প্রভাব ব্যাহত হবে। তাছাড়া পাকিস্তান প্রস্তাবের পিছনে একটি মূল নীতি হল হিন্দু প্রদেশের মুসলমানদের বদলে মুসলমান প্রদেশসমূহে হিন্দুদের প্রতিভূ হিসাবে রাখা। আমরা যদি লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের আমাদের প্রভাব-বৃত্তের বাইরে চলে যেতে দিই তাহলে সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহে মুসলমানদের নিরাপত্তা প্রচণ্ড ভাবে হ্রাস পাবে।” ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; ৫৯ পৃষ্ঠার ৫৪ সংখ্যা পাদটীকা।
১০. ইতিপূর্বে তাঁর প্রভাবে ২৩শে এপ্রিল মাদ্রাজের বিধানসভার কংগ্রেসি সদস্যরা জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় সহযোগিতার জন্য কেন্দ্রে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে লীগের সন্দেহ দূর করার উদ্দেশ্যে ভারতের অংশবিশেষের বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার সমর্থন করে। এর সঙ্গে সঙ্গে লীগ ও অন্যান্য তার দলের সঙ্গে মিলিতভাবে মাদ্রাজে কোয়ালিশন সরকার গড়তে দেবার জন্য রাজাজি এলাহাবাদের অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় (২৯শে এপ্রিল-২রা মে) প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর প্রস্তাব বিপুল ভোটে অগ্রাহ্য হয়ে গেলেও তিনি পাকিস্তান দাবির মূল নীতির পক্ষে প্রচারকার্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
১১. CWMG; ৭৬তম খণ্ড; পৃষ্ঠা ৩৮২ এবং প্যারেলাল; Last Phase, প্রথম খণ্ড; প্রথম অংশ (১৯৬৫); ৬৬ পৃষ্ঠা।
১২. সমালোচকদের মতে আগস্ট প্রস্তাবে ভবিষ্যৎ সংবিধানের রূপরেখা বর্ণনা প্রসঙ্গে, ‘ফেডারেল ধরনের যেখানে সর্বাধিক পরিমাণে স্বয়ংশাসনের অবকাশ থাকবে এবং যেখানে বাদবাকি (residuary) ক্ষমতা ন্যাস্ত থাকবে ঐসব একম্-এর হাতে”(টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; ষষ্ঠ খণ্ড; পৃষ্ঠা ১৮৫)—এই মর্মে যে উক্তিটি করা হয়েছে তা প্রচ্ছন্নভাবে পাকিস্তানের স্বীকৃতির দ্যোতক। এই অভিমতের সমর্থকদের মতে কংগ্রেস এরও পূর্বে ক্রিপস প্রস্তাবের আঞ্চলিক ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার অধিকার মেনে নিয়ে প্রথমে ভারত বিভাজনের দাবি নীতিগতভাবে মেনে নেয়। অতঃপর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে যখন বলা হয় যে “নিজের ঘোষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো আঞ্চলিক একম্‌কে কোনো ভারতীয় যুক্তরাজ্যের মধ্যে থাকতে বাধ্য করার নীতি (কংগ্রেস) চিন্তা করতে পারে না”(সীতারামাইয়া; সমগ্রন্থ; দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৬৩৪)—তখনও আর এক দফা কংগ্রেস ভারত বিভাজনের যৌক্তিকতা স্বীকার করে নেয়।
১৩. সমস্ত জেলাশাসকদের কাছে বাংলার মুখ্যসচিবের ৫ই ও ৮ই আগস্টের ডেমি অফিসিয়াল পত্র। শ্রীমতী শীলা সেন কর্তৃক নিজ গ্রন্থের ১৫৫ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।

সাম্রাজ্যবাদী কৌশল ও ব্যর্থ জিন্না-গান্ধী আলোচনা
২৩

যুদ্ধপ্রচেষ্টায় গান্ধী বা কংগ্রেসের সক্রিয় সহযোগিতা পাওয়া যাবে না একথা ইংরেজ সরকার ধরে নিয়েছিল। আপাতত ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছাও সরকারের ছিল না। এমতাবস্থায় ভারতবাসীর মধ্যে মতভেদের জন্যই যে এটা সম্ভবপর হচ্ছে না, এটা বিশ্বের কাছে তুলে ধরা ব্রিটিশ সরকারের তদানীন্তন ভূমিকার পক্ষে অনুকূল। জিন্না সেই সুযোগ তাঁদের করে দিলেন। সুতরাং জিন্না ও লীগের প্রতি ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত বদান্য হয়ে উঠলেন। এর নিদর্শন স্বরূপ কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন।
কংগ্রেসের স্বায়ত্তশাসনের দাবি দানা বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বিঘ্নিত হতে থাকে বলে সেই ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদকে প্রোৎসাহিত করার সরকারি নীতির পরিচয় আমরা পূর্বেই পেয়েছি। উচ্চপদস্থ ইংরেজ কাজকর্মচারীদের একাংশ অতঃপর নিয়মিতভাবে ভারতের জাতীয়তাবাদী দাবির বিরোধী সর্বপ্রকারের শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করার নীতি অবলম্বন করল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূত্রপাত হতেই শাসকদের এই প্রয়াস আরও সুসংবদ্ধ রূপ ধারণ করল। জনসমক্ষে জিন্নার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য যুদ্ধ ঘোষণার পরদিবসেই (৪ঠা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ খ্রি.) বড়লাট কর্তৃক তাঁকে গান্ধীর সঙ্গে একযোগে (এই প্রথম) সাক্ষাৎকারের জন্য আমন্ত্রণ করা যুদ্ধকালীন প্রয়াসের প্রথম চরণ। তারপর যুদ্ধে সহযোগিতার শর্ত হিসাবে কংগ্রেস যখন অবিলম্বে কেন্দ্রে দায়িত্বশীল সরকার ও গণপরিষদ গঠন করার দাবি জানাল এবং লীগের এর প্রতি প্রতিকূল ভূমিকার জন্য ইংরেজের হাত শক্ত হল, তখন “লিনলিথগো উত্তরোত্তর বেশি করে জিন্না ও লীগের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। তিনি স্পষ্টভাবে স্বীকার করেন যে জিন্না ‘কংগ্রেসের দাবির বিরোধিতা করে তাঁকে বহুমূল্য সহায়তা দেন এবং আমিও সঙ্গত কারণে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ’। জিন্না যদি কংগ্রেসকে সমর্থন করে আমার সামনে সম্মিলিত দাবি উপস্থাপিত করতেন তাহলে আমার এবং মহামান্য সম্রাটের সরকারের উপর নিঃসন্দেহে মারাত্মক চাপ পড়ত…। সুতরাং একথা বলা যেতে পারে যে জিন্নার মর্যাদার সঙ্গে আমার একটা কায়েমি স্বার্থ যুক্ত ছিল।”(১)
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন কংগ্রেসের পূর্ণ স্বাধীনতা ও গণপরিষদ প্রতিষ্ঠার দাবির জবাব হিসাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক জিন্না ও লীগের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার প্রয়াসের সম্বন্ধে আরও অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণ মেলে। দুর্গাদাসের মতে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৮ই আগস্টে প্রদত্ত বড়লাটের বিবৃতি পরোক্ষভাবে জিন্নাকে সমর্থন জানায়। জিন্না “জনান্তিকে স্বীকার করেন যে লীগ এই সুবিধা লিওপোল্ড আমেরীর সৌজন্যে লাভ করে।”(২) অন্যত্র দুর্গাদাস জানিয়েছেন যে ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার পর “ইন্ডিয়া অফিস এবং বড়লাট জিন্নাকে তাঁদের তুরুপের তাস হিসাবে গড়ে তোলার ব্যাপারে সহমত হন যাতে কংগ্রেসের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া যায়। এটা আমি উপলব্ধি করেছিলাম স্যার সিকন্দরের সঙ্গে আলোচনার সময়। তিনি আমাকে জানান যে ভারতসচিবের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে বড়লাট তাঁকে ও ফজলুল হককে বলেছেন যে তাঁরা যেন মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতা হিসাবে জিন্নার মর্যাদা
পৃষ্ঠা: ১৮০

ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা না করেন।”(৩)
লীগের লাহোর প্রস্তাব কিভাবে লিনলিথগো কর্তৃক জিন্নাকে তাঁর “গঠনমূলক নীতি” জনসমক্ষে প্রচার করার পৌনঃপুনিক পরামর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয় (পূর্বেই বলা হয়েছে যে লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এর মূল নীতি স্বীকার করার পরেই লাহোরে রওনা হবার পূর্বে জিন্না বড়লাটকে এ প্রস্তাবের কথা আগাম জানিয়ে আসেন) এবং অতঃপর কিভাবে বড়লাট ও ভারতসচিব লীগ ও জিন্নাকে কংগ্রেসের দাবির বিরুদ্ধে দাবার চালের মতো ব্যবহার করেন তার তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণ ড. আয়েষা জালাল তাঁর গ্রন্থে দিয়েছেন।(৪) খলিকুজ্জমাও তাঁর গ্রন্থে(৫) স্বীকার করেছেন যে কিছু উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারী নানাভাবে পাকিস্তানের দাবিকে সমর্থন করতেন। এইসময়ে লীগ নিজ সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য যে অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলে তার উৎস যে ব্রিটিশ সরকারের অনুগ্রহভাজন “হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভারতীয় রাজন্যবর্গ, বড় বড় মুসলিম জমিদারগোষ্ঠী এবং বিশেষ করে কলকাতার ইংরেজ বণিকসমাজ”, এ তথ্য ভারতে অবস্থিত আমেরিকার কনসাল জেনারেল তাঁর স্বদেশের সরকারকে জানালে তত্রস্থ ব্রিটিশ রাজদূত লর্ড হ্যালিফক্স (ভূতপূর্ব বড়লাট লর্ড আরউইন) ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে আগস্ট এক অত্যন্ত গোপনীয় তারবার্তায় এ সম্বন্ধে ইংলন্ডের বিদেশমন্ত্রী অ্যান্টনী ইডেনকে সতর্ক করে দেন।(৬) আমেরিকান অফিসারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি জানান, “…ভারতীয় রাজন্যবর্গ ও ব্রিটিশ ব্যবসায়ী সমাজ কর্তৃক মুসলিম লীগকে সমর্থন করার উদ্দেশ্য সরকারেরই অনুরূপ। আর এই উদ্দেশ্য হল ‘ভারতবর্ষের প্রতিনিধিদের’ দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্তির পথে বাধাসৃষ্টি করা…ভারতের সমস্যাবলীর সুনির্দিষ্ট সমাধান পরিহার করা এবং বর্তমান অচলাবস্থা বজায় রাখা। মুসলমান জমিদারদের মুসলিম লীগকে সমর্থন করার প্রবণতার দ্বিতীয় কারণ হল এই যে তাঁরা কংগ্রেসের সকল প্রাকৃতিক সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিশ্বাসের প্রতি আতঙ্কিত।”(৭) কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ, ভারতরক্ষা আইনের আয়ুধে সজ্জিত প্রশাসন যদৃচ্ছ পদক্ষেপ করতে পারে, স্বাধীন জনমতের অভিব্যক্তির পথ রুদ্ধ। সুতরাং জিন্নার পক্ষে তাঁর অভীষ্টের অভিমুখে অগ্রসর হবার সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত হল।
১৩ই আগস্ট লন্ডনের হেরল্ড পত্রিকার প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন যে সরকারের কাছ থেকে যুদ্ধশেষে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি পেলে হিন্দুদের সঙ্গে সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে লীগ অন্তর্বর্তী যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে প্রস্তুত। আগস্টের ১৮ই লীগের ওয়ার্কিং কমিটি তাঁকে এই অধিকার দেয় যে কংগ্রেস সমরকালীন মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করবে কিনা সে সম্বন্ধে জানার জন্য তিনি গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। নভেম্বরের শুরুতে দিল্লির লীগ কাউন্সিলের সভায় আবার পাকিস্তান দাবির প্রতি জোর দেন। ঐ মাসের ২১শে লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে গান্ধী জেল থেকেই আগস্ট আন্দোলন প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিতে পারেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাজাজির এক চিঠির উত্তরে জানান যে গান্ধীর উপবাসের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিতে যে পরামর্শসভা বা আহুত হয়েছে তাতে যোগ দিতে তিনি অক্ষম। এপ্রিলের ২৪ ও ২৬ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত লীগের অধিবেশনে পাকিস্তান দাবি মেনে নিতে বিলম্ব হবার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে শাসানি দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি, “…কংগ্রেসকে প্রকাশ্য এবং একরকম চূড়ান্ত আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন যে ইচ্ছা করলে সমস্যার সমাধানের জন্য ঐ প্রতিষ্ঠান যেন তাঁর শরণাপন্ন হয়।”(৮) মুসলমানদের উদ্দেশে আবেগমণ্ডিত ভাবে তিনি বলেন:
“নিজেদের ভস্মাবশেষ থেকে মুসলিম ভারত যেভাবে ফিনিক্সের মতো এখন পুনর্জন্ম লাভ করেছে…তা প্রায় এক অভাবনীয় বিস্ময়। যে জাতি প্রায় হৃতসর্বস্ব হয়েছিল এবং দৈবক্রমে জাঁতার দুই চাকার মধ্যে পড়েছিল, অত্যল্প সময়ের মধ্যে তারা কেবল স্বরূপপ্রাপ্ত হয়নি—ব্রিটিশের পর সামাজিক দৃষ্টিতে তারা সর্বাপেক্ষা সংহত, সামরিক দৃষ্টিতে অত্যন্ত দুর্ধর্ষ এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিতে আধুনিক ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নির্ণায়ক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এবার এই জাতিকে গড়ে তোলার জন্য গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করার সময় সমুপস্থিত যাতে আমাদের লক্ষ্য পাকিস্তানের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়।…লক্ষ্য আর দূরে নয়, সম্মিলিত হয়ে দাঁড়ান, শক্তি সংহত করুন ও এগিয়ে চলুন।”(৯)
মুসলমানদের মধ্যে শুধু আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিই নয়, তাঁদের প্রচ্ছন্ন অহমিকাবোধকে উদ্দীপ্ত করার কৌশল অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর মতো প্রয়োগ করে জিন্না তাঁদের লীগ অর্থাৎ তাঁর নিজের নেতৃত্বের অধীনে আনার পথে এইভাবে অগ্রসর হলেন। এইসময়ে লীগের সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য জিন্না ব্যাপকভাবে পশ্চিম ভারতে সফর করেন এবং সর্বত্র ঐজাতীয় বক্তৃতায় মুসলিম অহমিকাকে জাগ্রত করে মুসলমানদের আত্মচেতনার অভিব্যক্তির জন্য লীগের পতাকাতলে সমবেত করতে থাকেন। ঐসব প্রদেশে এবং বঙ্গ ও আসামেও লীগ মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হওয়ায় মুসলিম অহমিকাবোধ পুষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে জিন্নার নেতৃত্বের প্রভাববৃদ্ধি ঘটে। লীগের সদস্যসংখ্যা প্রভূতমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। কংগ্রেসবিহীন ফাঁকা রাজনৈতিক ময়দানে লীগের মর্যাদাবৃদ্ধি ছাড়াও বিভিন্ন প্রদেশে যুদ্ধের নানাবিধ ঠিকাদারী ও অন্যান্য কাজে লীগের নেতা ও সমর্থকরা যথেষ্ট অর্থ এবং ক্ষমতা প্রতিপত্তি অর্জন করেন। আবার ঐ সমস্ত বিত্ত ও মর্যাদাও শেষ অবধি লীগ ও জিন্নার প্রভাব বৃদ্ধি করে। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক লীগের কার্যকলাপের উপর গোপনে তদারকি করার জন্য নিযুক্ত জনৈক গুপ্তচরের মতে এই সময়ে “তিনি (জিন্না) আরও আক্রমক আরও যুযুধান এবং আরও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠেন। সম্ভবত এর কারণ হল সম্প্রতি অর্জিত ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতনতা এবং তার সহায়তায় কোনো কোনো পুরাতন আঘাতের প্রতিশোধ নেবার বাসনা।”(১০)
জিন্নার এই ক্ষমতা সচেতনতার নিদর্শন দুর্গাদাসের সঙ্গে ঐ সময়ে (এপ্রিল ১৯৪৩) তাঁর এক সাক্ষাৎকারের বিবরণে মেলে। জিন্না দুর্গাদাসকে বলেন, “আমার অনুগামীরা ক্ষমতায় রয়েছে। সুতরাং কংগ্রেসকে এখন বলতে হবে যে তারা কি দিতে প্রস্তুত। বল তাদের দিকে রয়েছে। তাঁরা ক্ষমতা চান এবং ব্রিটিশ তা দিতে রাজী নয়। সুতরাং আমি এখন সর্বাপেক্ষা অনুকূল শর্ত আদায় করার সুখকর অবস্থায় রয়েছি।”(১১) তিনি যে তাঁর ষোল আনার উপর আঠার আনা আদায় করে নেবার চেষ্টা করবেন তা রাজাজির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা এবং এর প্রায় দেড় বৎসর পর গান্ধীর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনার ব্যর্থতাতেই প্রকাশ। তবে সে প্রসঙ্গের অবতারণা করার পূর্বে তাঁর ক্ষমতা সচেতনতার অন্যতম উৎস— কয়েকটি প্রদেশে মুসলিম লীগ মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হবার সংক্ষিপ্ত কাহিনী বর্ণনা করা প্রয়োজন।
ভারতের জনমতকে উপেক্ষা করে দেশকে যুদ্ধে জড়িত করার ব্রিটিশ সরকারের নীতির প্রতিবাদে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে কংগ্রেস যখন বিভিন্ন প্রদেশের মন্ত্রীমণ্ডল থেকে পদত্যাগ করে তখন বাংলার লীগ হক্ সাহেবের কোয়ালিশন মন্ত্রীসভার অংশীদার ছিল। আমরা দেখেছি যে লীগ হক্ সাহেবকে পূর্ণমাত্রায় হাতের মুঠোয় পুরতে না পেরে তাঁকে চাপ দেবার জন্য তাঁর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করায় তিনি লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা এবং নির্দলীয় সদস্যদের নিয়ে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কিন্তু হক্ সাহেবের নিজের দল কৃষক প্রজা পার্টির ভিতরকার ক্ষমতাদ্বন্দ্বে সে মন্ত্রীসভা আদৌ শক্তিশালী ছিল না। তার উপর বঙ্গের মুসলিম জনমত ক্রমশ লীগের অনুগামী হয়ে ওঠায় এবং হক্ সাহেবের উপর মুসলিম জনমানসে উত্তরোত্তর জনপ্রিয় জিন্না ও লীগের প্রচার-যুদ্ধের চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকায় তাঁর মন্ত্রীমণ্ডলের অবস্থা ক্রমশই শোচনীয় হয়ে ওঠে। এছাড়া মাথার উপর খাঁড়ার মতো বিধানসভায় ইংরেজ ও ইঙ্গভারতীয় ১৯টি আসনের শক্তি তো ছিলই এবং তাঁদের নেকনজর কোন্ দিকে তা তাঁরা কখনও গোপন করেননি। লীগের প্ররোচনায় দলবদলের দ্বারা পুষ্ট বিরোধী দলের অনাস্থা প্রস্তাব তবুও ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে মার্চ ১০ ভোটে পরাজিত হয়। এর পরের দিন ছোটলাট স্যার জন হার্বার্ট জোর করে হক সাহেবের পদত্যাগ পত্র আদায় করেন এবং এক মাস প্রশাসন নিজের হাতে রাখার পর ২৪শে এপ্রিল আরও কিছু দলত্যাগের দ্বারা পুষ্ট লীগ পরিষদীয় দলের নেতা স্যার নাজিমুদ্দীনের হাতে বঙ্গের শাসনভার অর্পণ করেন।
অপর এক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ পাঞ্জাবে মুসলমান-শিখ-হিন্দু ভূস্বামীদের ইউনিয়নিস্ট পার্টি প্রাদেশিক প্রশাসন করায়ত্ত করে এবং লীগ মাত্র ২টি আসন পায় এ আমরা পূর্বে দেখেছি। শহীদগঞ্জ মসজিদের প্রশ্নে নির্বাচনের পরই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা ঐ প্রদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও প্রধানমন্ত্রী স্যার সিকন্দর বুদ্ধি করে তাঁদের দলের মুসলমান সদস্যদের নামেমাত্র লীগে যোগদান করতে দিয়ে তাঁর তিন সম্প্রদায়ের মিলনের ভিত্তিতে গঠিত ইউনিয়নিস্ট মন্ত্রীসভাকে লীগের সাম্প্রদায়িক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হন। অবশ্য এর জন্য জিন্নার সঙ্গে এক চুক্তির ভিত্তিতে তাঁর মন্ত্রীমণ্ডলকে ইউনিয়নিস্ট লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা আখ্যা দিতে হয়। স্যার সিকন্দরের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী মালিক খিজির হায়াৎ খাঁ তিওয়ানার কাছে জিন্না ক্রমাগত দাবি জানাতে থাকেন যে তিনি যেন ইউনিয়নিস্ট মন্ত্রীসভাকে অতঃপর মুসলিম লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা রূপে অভিহিত করেন এবং ইউনিয়নিস্ট দলের মুসলমান সদস্যরা যেন পরিপূর্ণভাবে লীগের অনুশাসনের অধীন হন। নিজ দলের হিন্দু ও শিখ সদস্যদের সমর্থন বিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে খিজির শেষ অবধি জিন্নার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন, যদিও তিনি সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের দাবির সমর্থনে ঘোষণা করেন এবং মুসলমানদের কল্যাণমূলক কার্যে কায়দ-এ-আজমের সঙ্গে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন। এইভাবে পাঞ্জাবে পূর্ণমাত্রায় না হলেও জিন্না অংশত সফল হন।
প্রবলভাবে মুসলমান সংখ্যাগুরু প্রদেশ হবে—এইজন্য সিন্ধুকে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকে পৃথক করলেও সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ সেখানে একটি আসনও পায়নি। স্যার গোলাম হোসেন হিদায়েতউল্লা বিভিন্ন সম্প্রদায় ও দলের সদস্যদের নিয়ে এক মন্ত্রীসভা গঠন করার পর স্বয়ং ও নিজের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ অনুবর্তীদের নিয়ে বিধানসভায় লীগ পরিষদীয় দল সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাবৎ মুসলমান সদস্যদের নিজ নেতৃত্বে লীগের ছত্রছায়ায় আনার তাঁর পরিকল্পনা সফল হয়নি এবং তাঁর সমর্থক হিন্দু সদস্যরা আনুগত্য পরিবর্তন করায় এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই তাঁর মন্ত্রীসভার পতন হয়। অতঃপর কংগ্রেসি সদস্যদের সমর্থনে অপর একজন মুসলমান নেতা খাঁ বাহাদুর আল্লাবক্স সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে প্রধানমন্ত্রী হন। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে আল্লাবক্সকে লীগের আওতায় আনার জিন্নার ব্যক্তিগত উদ্যম কেমনভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। অতঃপর স্যার গোলাম হোসেন লীগ থেকে পদত্যাগ করে আল্লাবক্স মন্ত্রীসভায় যোগদান করায় সাময়িকভাবে সিন্ধুতে লীগের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। সিন্ধুর লীগপন্থীরা পাঞ্জাবের শহীদগঞ্জের মতোই শুক্কুরে এক মসজিদের প্রশ্ন নিয়ে ঐ প্রদেশে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে জাগিয়ে তোলেন। ঐ এলাকায় বার বার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হতে থাকে। হিন্দু মহাসভাও হিন্দু অধিকার রক্ষার আন্দোলনের নামে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে সংহত করার সুযোগ দেয়। হিন্দু মন্ত্রীদের পদত্যাগের ফলে আল্লাবক্স মন্ত্রীসভাকে সংখ্যালঘু হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়। অতঃপর মীর বন্দে আলী খাঁর লীগ ও নির্দলীয় হিন্দুদের কোয়ালিশন ন্যাশনালিস্ট পার্টির নামে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু এক বছরের মধ্যে সেই মন্ত্রীমণ্ডলেও বিভেদ সৃষ্ট হওয়ায় বন্দে আলী খাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। কংগ্রেস সদস্যদের সমর্থনে আল্লাবক্স আবার প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি প্রদেশে সাম্প্রদায়িক শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রভূত প্রয়াস করেন। কিন্তু শীঘ্রই গভর্নরের সঙ্গে নানা প্রশ্নে তাঁর মতভেদ তীব্র হয়ে ওঠে। তিনিও তাই ক্রমশ কংগ্রেসের প্রতি ঘনিষ্ঠ হন। আগস্ট আন্দোলন দমনের নামে দেশব্যাপী দমননীতি আরম্ভ করার প্রতিবাদে আল্লাবক্স ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর তাঁর সরকারি খেতাব বর্জন করে সরকারি নীতিবিরোধী এক প্রকাশ্য বিবৃতি দেন। অক্টোবরের ৮ই অনুরূপ আর এক বিবৃতি দেবার দুদিন পর তিনি পদচ্যুত হন। ২২শে অক্টোবর স্যার গোলাম হোসেন এক মন্ত্রীসভা গঠন করার পরদিবস মন্ত্রীসভার অপর চারজন সদস্যসহ পুনরায় লীগে যোগদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় সিন্ধুতে লীগ শূন্য থেকে নূতন করে শাসনব্যবস্থার কর্ণধার হবার গৌরব অর্জন করে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মার্চ সিন্ধু বিধানসভায় পাকিস্তানের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় লীগের সিন্ধু বিজয় সম্পূর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গে জিন্নার বহুদিনের সাধ পূর্ণ হয়।
সামগ্রিকভাবে আসামে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও ঐ প্রদেশে যথেষ্ট সংখ্যক মুসলমান থাকায় এবং তা প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে জিন্নার দৃষ্টি সততই ঐ প্রদেশের উপর ছিল। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ঐ প্রদেশের ৩৪টি মুসলমান আসনের মধ্যে লীগ ৯টি পেয়েছিল। একক বৃহত্তম দল হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেসের তদানীন্তন নীতি অনুসারে আসাম বিধানসভায় ঐ দল প্রথমে মন্ত্রীসভা গঠনের দায়িত্ব নেয়নি। সুতরাং ইতিমধ্যে লীগনেতা স্যার সৈয়দ মহম্মদ সাদুল্লা অন্য দল ও গোষ্ঠী থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক হিন্দু ও মুসলমান সদস্যদের সমর্থন সংগ্রহ করে সাধারণ নির্বাচনের পর কিছুদিনের জন্য আসামে লীগ মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কিন্তু একদিকে তাঁর কোয়ালিশন অন্তর্দ্বন্দ্বে ভেঙে যাওয়ায় এবং অন্য দিকে কংগ্রেস মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ঐ প্রদেশে কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হয়। কিন্তু যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারে সরকারি নীতির প্রতিবাদে অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে সঙ্গে আসামের গোপীনাথ বরদোলৈ মন্ত্রীসভাও পদত্যাগ করে। অতপর আবার আনুগত্য বদলের খেলায় বিজয়ী হয়ে স্যার সাদুল্লা আসামে লীগ মন্ত্রীসভা গঠন করেন। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মুসলমান অধিবাসীদের আসামে বসবাস করার অবাধ সুযোগ দিয়ে কংগ্রেস রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে পুনঃপ্রবেশ না করা পর্যন্ত তিনি আসামে মুসলিম লীগের শিকড় দৃঢ়মূল করেন।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলমানদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে কংগ্রেস সেখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয় এবং খাঁ সাহেবের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করে। কিন্তু অন্যান্য প্রদেশের মন্ত্রীমণ্ডলের সঙ্গে তাঁর মন্ত্রীসভাও যুদ্ধে যোগদানের প্রশ্নে পদত্যাগ করে। প্রদেশের বিধানসভায় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লীগের নাম পর্যন্ত ছিল না। তারপর সর্দার ঔরঙ্গজেব খাঁর নেতৃত্বে লীগ পরিষদীয় দল গঠিত হয়। কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডলের পদত্যাগের পর তিনি কিছুসংখ্যক নির্দলীয় হিন্দু ও শিখ সদস্যদের সহযোগিতায় চারজন মুসলমান এবং একজন শিখের এক লীগ মন্ত্রীমণ্ডল গঠন করেন। সীমান্ত প্রদেশেও লীগের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে যার নিদর্শন হল অতঃপর অনুষ্ঠিত চারটি উপনির্বাচনে লীগ প্রার্থীর জয়লাভ।
এমতাবস্থায় জিন্না অবশ্যই ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সঙ্গে কথা বলার অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর এ আত্মশক্তি সচেতনতার নিদর্শন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে এপ্রিল লীগের বাৎসরিক অধিবেশনে প্রদত্ত তাঁর সভাপতির ভাষণের অপর এক স্থলেও দেখা গিয়েছিল। কংগ্রেস ও গান্ধীর তীব্র সমালোচনা করার পর বক্তৃতায় তিনি বলেন যে গান্ধী যদি সত্য সত্যই পাকিস্তানের ভিত্তিতে তাঁর সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হতে চান তবে তাঁর থেকে কেউ বেশি খুশি হবেন না। “আর তাই যদি মিস্টার গান্ধীর অভিলাষ হয় তাহলে আমাকে এ সম্বন্ধে সরাসরি তিনি লিখছেন না কেন?…এদেশে সরকার যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আমি একথা বিশ্বাস করতে প্রস্তুত নই যে তার এতটা সাহস হবে যে আমাকে পাঠানো এরকম চিঠি সরকার আটকে রাখবে। এজাতীয় চিঠি আমার কাছে আসতে না দেবার পরিণাম গুরুতর হবে।…তাঁর হৃদয়ের যদি কোনো পরিবর্তন ঘটে থাকে…তাহলে কেবল আমাকে কয়েকটি পঙ্ক্তি লেখার অপেক্ষা। তারপর আর মুসলিম লীগ পিছিয়ে থাকবে না।”(১২)
জিন্নার ঐ ঘোষণার একটু পূর্ব ইতিহাস আছে। ঐ বছরের ২৯শে জানুয়ারি গান্ধী বড়লাট লিনলিথগোকে এক পত্র লিখে আগস্ট আন্দোলন দমন করার নামে জনসাধারণের উপর অত্যাচারের রথচক্র চালাবার তীব্র প্রতিবাদ করার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্টের পরবর্তী হিংসা ও প্রতিহিংসার জন্য সরকারি প্রচারযন্ত্রের মাধ্যম তাঁকে দায়ী করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেন। তিনি আরও বলেন যে এর প্রতিবাদে বন্দী অবস্থাতেই ৯ই ফেব্রুয়ারি জলযোগ করার পর থেকে ২রা মার্চ সকাল পর্যন্ত তিন সপ্তাহের জন্য উপবাস করবেন। ঐ চিঠিতে দেশের তখনকার রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে সম্পূর্ণ দায়ী করার পর তিনি একথাও জানান যে সরকারের এই প্রচার মিথ্যা যে আগস্ট প্রস্তাবের মাধ্যমে কংগ্রেস স্বয়ং ক্ষমতা গ্রাস করতে চেয়েছিল। বড়লাটকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে ঐ সময়ে কংগ্রেস জিন্না ও লীগের হাতে সব ক্ষমতা সমর্পণ করার প্রস্তাব করেছিল এবং যুদ্ধকালে প্রশাসন চালাতে কংগ্রেস লীগের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে
পৃষ্ঠা: ১৮৫

প্রস্তুত একথাও জানিয়েছিল। যাইহোক, পুণার আগা খাঁ প্রাসাদে বন্দী অবস্থায় অনশনরত মহাত্মার সঙ্গে দেখাশুনা করার ব্যাপারে বিধিনিষেধ শিথিল করে দেওয়া হয়েছিল। রাজাজি, যিনি ইতিপূর্বেই আত্মনিয়ন্ত্রণের যুক্তিতে লীগের সঙ্গে বোঝাপড়ার শর্ত হিসাবে ভারত বিভাজন মেনে নিয়েছিলেন, তিনি ইতিমধ্যে এই শর্তের এক ফর্মুলা রচনা করেছিলেন। অনশনরত গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করে তিনি তাঁর ফর্মুলায় গান্ধীর স্বীকৃতিও লাভ করেছিলেন। রাজাজি ফর্মুলার সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপ:
“১. নিম্নে বর্ণিত শর্তসাপেক্ষে লীগ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবি সমর্থন করে এবং যত দিন যুদ্ধ চলবে লীগ অস্থায়ী সরকার গঠন করার ব্যাপারে কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা করবে।
২. যুদ্ধের অবসানে একটি কমিশন উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব ভারতবর্ষের সেইসব জেলা চিহ্নিত করবে যেখানে মুসলমানদের পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিদ্যমান। এইভাবে চিহ্নিত এলাকাসমূহে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় অধিবাসীদের এক গণভোট হিন্দুস্থান থেকে পৃথক হবার প্রশ্নের মীমাংসা করবে। সংখ্যাধিক্যে যদি হিন্দুস্থান থেকে পৃথক এক সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয় তাহলে সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করা হবে।
৩. পৃথক হওয়া স্থির হলে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং অন্যান্য জরুরি বিষয়ের ব্যবস্থা করার জন্য পারস্পরিক চুক্তি সম্পাদিত হবে।”(১৩)
এর এক মাস পর রাজাজি জিন্নার সঙ্গে দেড় ঘণ্টা আলোচনা করলেও এবং তারপরও জিন্নার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকলেও গান্ধীর স্বীকৃতি পাবার চোদ্দ মাস অর্থাৎ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলের পূর্বে কিন্তু তাঁর ফর্মুলা এবং তাঁর প্রতি গান্ধীর সমর্থনের কথা তিনি জিন্না অথবা অপর কাউকে জানান নি।
ইতিমধ্যে লীগের “ডন” পত্রিকায় জিন্নার মহাত্মাকে সরাসরি পত্র লেখার আহ্বান পড়ে বন্দী মহাত্মা ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা মে তাঁকে নিম্নোদ্ধৃত পত্র লেখেন:
“…আমি আপনার আমন্ত্রণকে স্বাগত জানাই। তবে চিঠির মাধ্যমে আলোচনা করার চেয়ে মুখোমুখি কথা বলার প্রস্তাব আমি দিচ্ছি। অবশ্য এ ব্যাপারে আমি আপনার হাতে। “আমি আশা করি যে এ চিঠি আপনাকে পাঠানো হবে এবং আপনি যদি আমার প্রস্তাবে সম্মত হন তাহলে সরকার আপনাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দেবে।
“তবে একটি কথা আমি উল্লেখ করব। আপনার আমন্ত্রণে একটি যদি রয়েছে বলে মনে হয়। আপনি কি এই কথা বলতে চেয়েছেন যে আমার হৃদয়ের যদি পরিবর্তন ঘটে থাকে তবেই কেবল আমি আপনাকে লিখব? ঈশ্বরই কেবল মানুষের হৃদয়ের খবর রাখেন। আমি চাইব যে আমি যেমন সেই হিসাবেই আপনি আমাকে গ্রহণ করুন।…
ভারত সরকার কিন্তু জিন্নার এপ্রিলের বক্তৃতার মর্যাদা রক্ষা করতে গান্ধীর চিঠি তাঁর কাছে যেতে দেয়নি। তবে তার সারমর্ম তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। জিন্না ও অবস্থাটা মেনে নিয়ে সংবাদপত্রের এক বিবৃতিতে বলেন যে, “…মিস্টার গান্ধীর এই চিঠির তাৎপর্য হল তাঁর নিজের কারামুক্তির সহায়তায় মুসলিম লীগ যাতে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হয় তার জন্য। এটা তাঁর এক চাল ছাড়া আর কিছু নয়।”
বেলুচিস্তান সফর শেষে বোম্বেতে ফেরার পর ২৬শে জুলাই এক খাকসার (পাঞ্জাবের উগ্রপন্থী মুসলমান সংগঠন) যুবক জিন্নার উপর আক্রমণ করে। সৌভাগ্যক্রমে সামান্য আঘাত পাওয়া ছাড়া জিন্নার কোনো ক্ষতি হয়নি। যুবকটির অভিযোগ যে একদা তিনি লীগপন্থী হলেও এখন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে “কথা বলা ছাড়া লীগ মুসলমান বা মানবসমাজের জন্য আর কিছু করছে না।” দৈবক্রমে রক্ষা পাওয়ায় মুসলমানরা ব্যাপকভাবে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন দিবস পালন করেন। অক্টোবরে লিনলিথগোর বদলে ওয়াভেল নূতন বড়লাট হন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বড়লাট হিসাবে জিন্না সম্বন্ধে তাঁর গোপন মূল্যায়ন হল: “একথা বলা মোটেই অত্যুক্তি নয় যে জিন্নাই হলেন মুসলিম লীগ। তিনি এক অহঙ্কারী, খেলো ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ যিনি হয়তো মনে করেন যে বর্তমান সময় হিন্দুদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসার উপযুক্ত নয়।” একটি গোপন নোটে গান্ধী সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, “গান্ধী ও জিন্না উভয়েই স্বৈরতন্ত্রী।…গান্ধীর এরকম হবার কারণ নিজেকে সাধু-সন্ত হিসাবে গড়ে তোলা। আর জিন্নার এই ভূমিকার মূলে রয়েছে তাঁর দলে যোগ্যতায় তাঁর ধারে-কাছে পৌঁছানোর উপযুক্ত ব্যক্তির অভাব।”(১৫)
১ নভেম্বরের ১৫ই জিন্না দিল্লিতে লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সভাপতির ভাষণ প্রসঙ্গে বলেন যে তাবৎ মুসলমানের জন্য লীগের দ্বার উন্মুক্ত এবং এর নেতার বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ থাকলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁকে অপসারিত করা যেতে পারে। ১৮ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় পরিষদে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলার দুর্ভিক্ষের জন্য ভারত সরকারের নিন্দা করার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণকে সহায়তা দেবার জন্য ঐ প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের প্রশংসা করেন। ডিসেম্বরে করাচীতে লীগের একত্রিশতম সাধারণ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে আবার পাকিস্তানের দাবি জানাবার সঙ্গে সঙ্গে লীগের পুনর্জীবনের জন্য আনন্দ প্রকাশ করলেন। ঐ অধিবেশনেই তিনি তিন সদস্যবিশিষ্ট (লিয়াকৎ আলী খাঁ, খলিকুজ্জমাঁ ও হাসান ইমাম) লীগের নূতন পার্লামেন্টারি বোর্ড, পাকিস্তানের শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনার কাঠামো রচনার জন্য নবাব ইসমাইল খাঁর সভাপতিত্বে এক কমিটি অফ অ্যাকশন গঠনের কথা ঘোষণা করলেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি বোম্বেতে মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভায় তাঁদের পাকিস্তান অর্জনের জন্য কঠোর শ্রম করার পরামর্শ দেবার সঙ্গে সঙ্গে বললেন যে, “কোনো কোনো হিন্দু নেতা তাঁকে ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী করার যে প্রস্তাব দিয়েছেন” তা নেহাৎই ছলনা এবং “এসব মুসলমানদের পথভ্রষ্ট এবং বিভ্রান্ত করার জন্য” করা হচ্ছে। ঐ মাসের শেষে কেন্দ্রীয় পরিষদে ওয়াভেল তাঁর বক্তৃতায় ভারতবর্ষের “ভৌগোলিক ঐক্যের”র উপর জোর দেওয়ায় পরিষদে এবং তার বাইরে জিন্না ওয়াভেলের তীব্র সমালোচনা করে বললেন যে ক্রিপস প্রস্তাবে পাকিস্তানের যে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল ওয়াভেলের বক্তব্য তার পরিপন্থি। ওয়াভেলের জিজ্ঞাসার উত্তরে অন্তত দুটি প্রদেশের (মধ্যপ্রদেশ ও বিহার) ছোটলাট তাঁকে পরোক্ষভাবে জানালেন যে জিন্নার দাবি মেনে নেওয়া উচিত।(১৬) মধ্যপ্রদেশের ছোটলাটের মতে জিন্নার সমর্থন যুদ্ধের সময়ে না পেলে সরকারের অবস্থা শোচনীয় হত।
গান্ধীর কাছ থেকে জিন্না চিঠি পাবার প্রায় দশ মাস পর (এপ্রিল ১৯৪৪) রাজাজি দিল্লিতে জিন্নার সঙ্গে দেখা করে গান্ধীর অনুমোদনের সংবাদসহ তাঁর ফর্মুলা পেশ করলেন। জিন্না কিন্তু পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ পাকিস্তান মন্তব্য করে প্রথম আলোচনাতেই রাজাজির ফর্মুলার প্রতি বিরূপতা ব্যক্ত করেছিলেন। তবে তাঁর নিজের বা লীগের তরফ থেকে ঐ প্রস্তাব গ্রহণ বা বাতিল করার কোনো সূচনা তিনি দেননি।
জুলাই-এর ১০ই রাজাজি জিন্নাকে একটি তারবার্তার মাধ্যমে জানালেন যে তিনি তাঁর কাছে উপস্থাপিত ফর্মুলা অতঃপর জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করছেন এবং জানতে চাইলেন যে তিনি কি একথা সংবাদপত্রে জানাতে পারেন যে জিন্না তাঁর ফর্মুলা অগ্রাহ্য করেছেন? জবাবে জিন্না তার করলেন যে তিনি ঐ ফর্মুলা বাতিল করেছেন বলা ঠিক নয়। তবে গান্ধী যদি স্বয়ং তাঁকে এ সম্বন্ধে লেখেন তবে তিনি তাঁর প্রস্তাব উপযুক্ত সিদ্ধান্তের জন্য লীগের সামনে রাখতে পারেন।
কস্তুরবার মৃত্যুতে শোকার্ত এবং নিজের প্রবল অসুস্থতার জন্য অত্যন্ত দুর্বল গান্ধীকে সরকার ৬ই মে বিনাশর্তে মুক্তি দিলেন। ইতিমধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি মিত্রশক্তির অনুকূল হয়েছে বলে সরকার বন্দী অবস্থায় গান্ধীর মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক ছিল না। পাঁচগিনিতে স্বাস্থ্যেদ্ধাররত গান্ধী ১৭ই জুলাই তাই জিন্নাকে উভয়ের মাতৃভাষা গুজরাতিতে (জিন্নার সুবিধার জন্য উর্দু অনুবাদসহ) এক আন্তরিকতাপূর্ণ চিঠি লেখেন। চিঠির বয়ান নিম্নরূপ:
“ভাই জিন্না—এমন এক সময় ছিল যখন আমি মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য আপনাকে প্রবুদ্ধ করতে পারতাম।(১৭) আজও তাই সাহস করে আপনাকে মাতৃভাষায় লিখছি। জেল থেকে পাঠানো আমার আমন্ত্রণ-পত্রে ইতিপূর্বেই আমি আপনার আর আমার মধ্যে এক সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব করেছিলাম। কারামুক্তির পর এযাবৎ আমি আপনাকে লিখতে পারিনি। আজ তাই এই চিঠি লেখার প্রেরণা অনুভব করছি। আপনার অনুকূল সময়ে আমরা যেন মিলিত হই। আমাকে ইসলাম বা ভারতীয় মুসলমানদের শত্রু বিবেচনা করবেন না। সর্বদাই আমি আপনার এবং মানবজাতির সেবক ও মিত্র। আমাকে নিরাশ করবেন না।— আপনার ভাই, গান্ধী।”(১৮)
মার্চ ও এপ্রিলে খিজির হায়াৎ খাঁকে করায়ত্ত করার ব্যর্থ প্রয়াসের(১৯) পর প্রচণ্ড পরিশ্রমজনিত ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য জিন্না তখন শ্রীনগরে ছিলেন। সেখান থেকে ২৪শে জুলাই ইংরাজিতে—তাঁর ভাষায় “একমাত্র সেই ভাষায় যাতে আমার ভুল হবার সম্ভাবনা নেই”(২০) “ভাই” রূপে সম্বোধনকারী গান্ধীকে নিম্নোক্ত প্রকারে উত্তর দিলেন:
“প্রিয় মিস্টার গান্ধী—বোম্বে ফিরে যাবার পর আমার বাড়িতে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে আমি আনন্দ বোধ করব। সম্ভবত আগস্টের মাঝামাঝি আমি সেখানে ফিরব। আশাকরি তার মধ্যে আপনি পূর্ণরূপে স্বাস্থ্যোদ্ধারে সক্ষম হবেন এবং বোম্বে ফিরে আসতে পারবেন। দেখা না হওয়া পর্যন্ত এর অতিরিক্ত আর কিছু আমি বলছি না।”
৩০শে জুলাই জিন্না লাহোরে লীগ ওয়ার্কিং কমিটিকে গান্ধীর সঙ্গে তাঁর পত্র ব্যবহারের কথা জানিয়ে বললেন যে ঐ ফর্মুলা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার দায়িত্ব তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিতে পারেন না। তাঁর ওয়ার্কিং কমিটি এ ব্যাপারে গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার জন্য তাঁকে পূর্ণ ক্ষমতা দিল।
গান্ধীর সঙ্গে তাঁর আসন্ন আলোচনার সম্পর্কে জিন্নার ৫ই আগস্টের বিবৃতি – যাতে তিনি পুনর্বার এবং সম্ভবত শেষবার গান্ধীকে “মহাত্মা” বলে উল্লেখ করেন, পূর্বোক্ত অবিশ্বাসের পরিবেশের মধ্যে আশার কিঞ্চিৎ আলোকের নিদর্শন প্রকট করল। বিবৃতি প্রসঙ্গে জিন্না আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, “আমরা যাতে একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পারি তার জন্য আমাকে ও মহাত্মা গান্ধীকে আপনারা আশীর্বাদ করুন। তৃতীয় পক্ষের অস্তিত্ব বিদ্যমান এবং সে পক্ষও তার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও আমরা একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পারি কারণ গান্ধীজি দুর্নীতির ঊর্ধ্বে এবং আমার নিজের সম্বন্ধেও একই বিশ্বাস পোষণ করি।…আমরা যাতে মিলিত হই তার জন্য সার্বিক আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই আমরা যখন অতঃপর মিলিত হতে চলেছি তখন আমাদের সহায়তা করুন। আমরা ঘটনাপ্রবাহের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে চলেছি। অতীতকে বিস্মৃত হওয়া যাক।” সেবাগ্রামে গান্ধী বললেন, “আপনারা প্রার্থনা করুন যে ভারতবর্ষের স্বার্থে উভয়পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হবার জন্য ঈশ্বর যেন কায়েদ- এ-আজম এবং আমাকে সদ্বুদ্ধির আশীর্বাদ দেন।”(২১)
জিন্নার অসুস্থতার জন্য আলোচনা আগস্টের মধ্যভাগের বদলে ৯ই সেপ্টেম্বর মাউন্ট প্লেজেন্ট রোডে তাঁর বাসগৃহে দেশবাসীর এক বৃহদংশের শুভেচ্ছার মধ্যে শুরু হল। বিদেশেও এ সম্বন্ধে সাগ্রহ কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল। ২৭শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাঁরা ১৪বার মিলিত হয়েছিলেন এবং আলোচনার বিবরণ ও প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্ন লিপিবদ্ধ করার জন্য উভয়ের মধ্যে যে ২৪টি পত্রবিনিময় হয়েছিল তার শব্দসংখ্যা ছিল ১৫ হাজারেরও বেশি। কিন্তু সে আলোচনা ব্যর্থ হল। আলোচনা মূলত রাজাজি ফর্মুলাকে কেন্দ্র করে আরম্ভ হলেও লাহোর প্রস্তাবের ভাষ্য ও ব্যাখ্যা থেকে আরম্ভ করে সম্ভাব্য দেশবিভাগের তাবৎ প্রশ্ন উভয়ের মধ্যে আলোচিত হয়েছিল।
আলোচনার ব্যর্থতার কারণ: (১) জিন্নার মতে এর ফলে পাঞ্জাব ও বঙ্গের বিভাজন হবে যাতে পাকিস্তানের আয়তন হ্রাস পাবে এবং তাহলে সে পাকিস্তান হবে বিকলাঙ্গ ও কীটদষ্ট; (২) গান্ধী পাকিস্তানের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। দেশবিভাগের দাবি তিনি স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন একই পরিবারের সদস্যদের শরিকী বিবাদ মেটাবার আশায়। তাই ১৮ই সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের তিনি বলেন যে, এটা হল, “…দুই ভাই-এর মধ্যে বাঁটোয়ারা।…দুই ভাই যখন পৃথক হয় তখন বিশ্বের চোখে তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে যায় না। পৃথক হবার পরও পৃথিবী তাদের ভাই বলেই মানে।” উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে পৃথক হবার এক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিরক্ষা বা ঐজাতীয় স্বার্থবিশিষ্ট প্রশ্নের সমাধান গান্ধী চেয়েছিলেন। কিন্তু জিন্নার মতে: “একথা যখন স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে পাকিস্তান ও ও হিন্দুস্থান দুটি পৃথক ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে, তখন দেশরক্ষা ও ঐজাতীয় সাধারণ স্বার্থবিশিষ্ট ব্যাপারে কথাই উঠতে পারে না।”(তাঁর ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের চিঠি); (৩) রাজাজির প্রস্তাবে প্রস্তাবিত পাকিস্তান এলাকার সকল নাগরিকের অধিকাংশ গণভোটের মাধ্যমে ইচ্ছা ব্যক্ত করলেই কেবল দেশবিভাগ হবার কথা। জিন্না গণভোটে রাজী ছিলেন না—অন্তত অমুসলমানদের তো এ অধিকার দিতে তিনি আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। অমুসলমানরা মুসলমানদের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করার সুযোগ পাবে—এ দাবি তিনি বিবেচনার অযোগ্য মনে করেন।(২২) (৪) রাজাজি-গান্ধী প্রস্তাবিত ভারত বিভাজন স্বাধীনতার পর হবার কথা। কংগ্রেস তার এতদ্‌সম্বন্ধীয় প্রতিশ্রুতি ইংরেজ চলে গেলে মানবে—এ বিশ্বাস জিন্নার ছিল না। তাই তিনি আগে দেশবিভাগ ও পরে স্বাধীনতা চাইছিলেন।
শেষ পর্যন্ত সাময়িক শুভবুদ্ধিকে নিষ্প্রভ করে সেই পুরাতন অবিশ্বাসই জয়ী হল। লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সামনে ৩০শে জুলাই জিন্না যা বলেছিলেন তার ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন না। তাঁর বক্তব্য ছিল:
“সরল দ্ব্যর্থবিহীন ভাষায় মিস্টার গান্ধী পাকিস্তানের ভিত্তিতে মুসলিম লীগের সঙ্গে হাত মেলান এবং তাহলে আমরা ভারতবাসীর স্বাধীনতায় সমীপবর্তী হব। মিস্টার গান্ধী ও মিস্টার রাজাগোপালাচারী যখন একথা বলেন যে গ্রেট ব্রিটেন ভারতবর্ষকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর এসব শর্তের কোনো মূল্য হবে বা এগুলিকে কার্যকরী করা যাবে তখন তাঁরা ঘোড়ার আগে গাড়ি জোতার ব্যবস্থা করছেন বলতে হবে। হিন্দু এবং মুসলমানরা একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হয়ে ঐক্যবদ্ধ না হলে স্বাধীনতার কোনো সম্ভাবনা নেই। উভয় সম্প্রদায়ের এজাতীয় কোন যুক্তফ্রন্ট না হলে ব্রিটেনের শাসকদের অনিচ্ছুক হাত থেকে আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেবার উপায়ান্তর নেই।
“যাই হোক শেষ অবধি মিস্টার গান্ধী অন্তত ব্যক্তিগতভাবে বিভাজনের মূল নীতি বা ভারতবিভাগ মেনে নিয়েছেন। ভবিষ্যতে অগ্রগতির পক্ষে এটা শুভ ও অনুকূল। এখন যা বাকি রইল তা হচ্ছে এই প্রশ্নের সমাধান করা যে কবে ও কিভাবে এই বিভাজনকে কার্যান্বিত করা হবে। আশা করি আমি একথা স্পষ্ট করতে পেরেছি যে এর জন্য যে উপায় ও পদ্ধতি নিয়োগ করা হয়েছে তা আদৌ বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনার অনুকূল নয় এবং এর রূপও জোর করে চাপানো। কারণ এর পরিবর্তন-পরিমার্জনের কোনো অবকাশ নেই। প্রস্তাবের গুণাগুণ সম্বন্ধে বক্তব্য হল—মিস্টার গান্ধী যা দিতে চাইছেন তা হল মূল বস্তুর ছায়া ও খোসা মাত্র, বিকলাঙ্গ খঞ্জ ও কীটদষ্ট পাকিস্তান।”(২৩)
গান্ধী-জিন্না আলোচনা প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছিল। তাঁর ১৫ই সেপ্টেম্বরের চিঠিতে গান্ধী দ্বিজাতি তত্ত্ব মানতে অস্বীকার করে জানালেন, “ধর্মান্তরিত এবং তাঁদের বংশধরদের কোনো গোষ্ঠী পুরাতন জাতি থেকে ভিন্ন কোন জাতির সদস্য বলে নিজেদের দাবি করছেন—এর কোনো উপমা আমি ইতিহাসে খুঁজে পাই না। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ভারতবর্ষ যদি এক জাতি ছিল তাহলে তার সন্তানদের এক বৃহদংশের ধর্মপরিবর্তন সত্ত্বেও তার অদ্বিতীয় জাতীয়তা অক্ষুণ্ণ আছে।” লাহোর প্রস্তাব সম্বন্ধে গান্ধীর বক্তব্য ছিল: “এতে সমগ্র ভারতবর্ষের ধ্বংস ছাড়া আর কিছু আমি খুঁজে পাই না।” এর জবাবে তাঁর ১৭ই সেপ্টেম্বরের চিঠিতে জিন্নার বক্তব্য হল: “আমাদের বিশ্বাস ও বক্তব্য এই যে জাতির যে কোনো পরিভাষা ও মানদণ্ডে মুসলমান ও হিন্দুরা দুটি প্রধান জাতি।” কারণ তাঁর মতে মুসলমানদের “সংস্কৃতি ও সভ্যতা অপরাপরদের থেকে স্পষ্টতঃ পৃথক। তাঁদের ভাষা ও সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্য, নাম ও নামকরণের পদ্ধতি, মূল্যবোধ ও মাত্রাজ্ঞান, আইন ও নৈতিক বিধান, আচার-প্রথা ও পঞ্জিকা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য…সবই ভিন্ন। আর সেই জন্য তাঁরা এক পৃথক সার্বভৌম বাসভূমি পাবার অধিকারী।”
নিজ তবে জিন্না সম্বন্ধে গান্ধী একথা স্বীকার করেছিলেন যে, “মুসলমান জনসাধারণের উপর আপনার অদ্বিতীয় প্রভাব আছে।” সম্ভবত পূর্বোক্ত স্বীকৃতির পটভূমিকাতেই গান্ধী জিন্নার শর্তে, জিন্নার বাসগৃহে গিয়ে দীর্ঘদিন ঐ আলোচনা চালিয়েছিলেন। এর ফলে জিন্নার ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠা এমন বেড়ে গিয়েছিল যে এমনকি মৌলানা আজাদও এতটা নত হবার জন্য গান্ধীর সমালোচনা করেছিলেন।(২৪) হিন্দু ও শিখ সাম্প্রদায়িক তত্ত্বসমূহ তো গোড়া থেকেই এই আলোচনার বিরোধী ছিল এবং পরবর্তীকালে গান্ধী-হত্যাকারী নাথুরাম গডসে প্রমুখ হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কর্মীরা সেবাগ্রাম আশ্রমে গিয়েছিলেন
পৃষ্ঠা: ১৯০

জিন্নার সঙ্গে মিলিত হবার ব্যাপারে তাঁকে সক্রিয়ভাবে বাধা দিতে। বলা বাহুল্য হিন্দু ও শিখ সাম্প্রদায়িক তত্ত্বের এই সরব বিরোধিতার ফলেই আবার মুসলমানদের মধ্যে এই ধারণা বৃদ্ধি পায় যে জিন্নাই তাঁদের স্বার্থের যথার্থ প্রবক্তা এবং এই মানসিকতার দূরগামী প্রভাব পরবর্তীকালে দৃষ্টিগোচর হয়।
যাই হোক, আলোচনা ভেঙে গেলেও জিন্না প্রকাশ্য বা জনান্তিকে কোনো তিক্ততার পরিচয় দিলেন না। ২৭শে সেপ্টেম্বর আলোচনা ভেঙে যাবার খবর ও তার কারণ সম্বন্ধে নিজের মন্তব্যসহ এক বিবৃতিদান প্রসঙ্গে তিনি বললেন, “… দুঃখের সঙ্গে বলছি যে আমি গান্ধীকে স্বমতে আনার আমার কর্তব্যে ব্যর্থ হয়েছি।…তবে আশা করি যে জনসাধারণ এর জন্য তিক্ততার পরিচয় দেবেন না এবং আমারা বিশ্বাস করি যে এ আমাদের প্রয়াসের অন্তিম পরিণতি নয়।” ঐ প্রকাশ্য বিবৃতি ছাড়াও তাঁদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু কানজি দ্বারকাদাসের সঙ্গে ১৭ই অক্টোবর এ প্রসঙ্গে আলোচনার সময় অসুস্থ ও দুর্বল জিন্না মন্তব্য করেন, “এর চেয়ে ভাল কিছু দেবার মতো যদি গান্ধীর কাছে না ছিল তবে কেনই বা তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন?” দ্বারকাদাস প্রশ্ন করেন যে, তিনি কি মনে করেন যে তাঁকে দোষী প্রতিপন্ন করতে এবং তাঁর বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে গান্ধীর ঐ প্রয়াস? জিন্না উত্তর দেন, “না, না—গান্ধী আমার সঙ্গে অত্যন্ত খোলামেলা ব্যবহার করেছেন এবং আমাদের আলোচনা খুবই ভাল হয়েছিল।”(২৫)

২৩
পাদটীকা

১. ডঃ আয়েষা জালাল; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৪৯। লিনলিথগোর বক্তব্য ভারতসচিব লর্ড জেটল্যান্ডকে লেখা।
২. দুর্গাদাস; সমগ্রন্থ; ১৬৯ পৃষ্ঠা।
৩. সমগ্রন্থ; ২০৪-২০৫ পৃষ্ঠা।
৪. ৪৯-৮১ পৃষ্ঠা।
৫. পৃষ্ঠা ২৬৮। এ সম্বন্ধে প্যারেলালের (সমগ্রন্থের) প্রথম খণ্ড, প্রথম অংশের ৬৮-৮১ পৃষ্ঠার তথ্যসমূহও উল্লেখযোগ্য।
৬. সঈদ; Sound of Fury; ২৮৫ পৃষ্ঠা।
৭. এন. মানসার্গ (স:); T. P.; দ্বিতীয় খণ্ড; ৮৩৯ পৃষ্ঠা।
৮. দিল্লিতে এপ্রিলের ২৪-২৬ তারিখে অনুষ্ঠিত অধিবেশন সম্বন্ধে “একান্ত গোপনীয় নোট”। T. P.; তৃতীয় খণ্ড; ৯১৮-৯২০ পৃষ্ঠা।
৯. পীরজাদা; Foundations of Pakistan; দ্বিতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা 422। উলপার্ট কর্তৃক তাঁর গ্রন্থের ২১৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।
১০. উলপার্ট; সমগ্রন্থ; ২১৮ পৃষ্ঠা।
১১. সমগ্রন্থ; ২০৮ পৃষ্ঠা।
১২. মানসার্গ (স:); T. P.; তৃতীয় খণ্ড; ৯৮২ পৃষ্ঠা।
১৩. রাজমোহন গান্ধী; The Rajaji Story: 1937-1972; ভারতীয় বিদ্যাভবন, বোম্বাই (১৯৮৪); ৯৫-৯৬ পৃষ্ঠা।
১৪. CWMG; খণ্ড ৮৭; ৭৫ পৃষ্ঠা।
১৫. মানসার্গ (স:); T. P.; চতুর্থ খণ্ড; ২৬০ ও ২৬১ পৃষ্ঠা।
১৬. সমগ্রন্থ; ৮৭৩ ও ৮৬৯ পৃষ্ঠা।
১৭. এখানে খুব সম্ভব গান্ধী জিন্নার সঙ্গে ভারতের বুকে তাঁর প্রথম দর্শনের প্রসঙ্গে শিত উল্লেখ করছেন। ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি বোম্বাই-এ গুর্জর সভার দ্বারা প্রদত্ত এক সংবর্ধনা সভায় জিন্না চোস্ত ইংরাজিতে তাঁকে স্বাগত জানালে উভয়ের মাতৃভাষা গুজরাতীর বদলে ইংরাজিতে ভাষণ দেবার জীনার জন্য গান্ধী তাঁর প্রতিভাষণে জিন্নাকে মৃদু তিরস্কার করেছিলেন। (দ্রঃ CWMG;: ত্রয়োদশ খণ্ড; ৯ পৃষ্ঠা।)
১৮. প্যারেলাল; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড, প্রথম অংশ; ৬৭ পৃষ্ঠা।
১৯. বিশদ বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য—ডঃ আয়েষা জানাল; সমগ্রন্থ; ৯০-৯৪ পৃষ্ঠা।
২০. সঈদ; Sound of Fury; ২৯৩ পৃষ্ঠা।
২১. প্যারেলাল; সমগ্রন্থ; প্রথম খণ্ড, প্রথম অংশ; পৃঃ ৮২ এবং টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; ষষ্ঠ খণ্ড; পৃষ্ঠা ৩৩৭-৩৩৮ দ্রষ্টব্য।
২২. জিন্নার এই ভূমিকা যে অযৌক্তিক একথা সংযুক্ত প্রদেশের লীগের নেতা হিসাবে পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা এবং আইনজীবী খলিকুজ্জমাঁ ঐ রাষ্ট্রের সৃষ্টির চোদ্দ বছর পরও লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তার তাঁর মতে, “কেবল মুসলমান ভোটের ভিত্তিতে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার…এমন একটা দাবি, যার তুলনা বিশ্বইতিহাসে নেই।”(সমগ্রন্থ; ২৭৮ পৃষ্ঠা)।
২৩. টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; ষষ্ঠ খণ্ড। ৩৩৩ পৃষ্ঠা
২৪. সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ৯৩-৯৪। গান্ধীর সম্বোধন দ্বারা জিন্নার ‘কায়েদ-এ-আজম’ অভিধা জনপ্রিয় হয় এবং বিশেষ করে মুসলমানরা গান্ধীর এই স্বীকৃতি শব্দার্থে নেন—এও মৌলানার অপর এক অভিযোগ।
২৫। হেক্টর বলিথো; সমগ্রন্থ; পৃষ্ঠা ১৫১-১৫২। গান্ধীও ২৮শে সেপ্টেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলেন: “আমরা উভয়ে একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হতে সমর্থ হইনি—এ অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। তবে হতাশ হবার কারণ নেই। আলোচনা ভেঙে গেছে কেবল নামেই। আসলে আলোচনা অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতুবী হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা যে এই তিন সপ্তাহকাল সময় নষ্ট করিনি—এ বিষয়ে আমি পূর্ণতঃ সন্তুষ্ট। আর এ ব্যাপারে আমার মনে তিলমাত্র সন্দেহ নেই যে পূর্বের তুলনায় আমরা পরস্পরকে ভালভাবে জানি। অতঃপর তিনি বলেন, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে আমরা শত্রুরূপে নয়, মিত্ররূপে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি।”(টেন্ডুলকর; সমগ্রন্থ; ষষ্ঠ খণ্ড; পৃষ্ঠা ৩৫১- ৩৫৩) “আমি বিশ্বাস করি যে শ্রীযুক্ত জিন্না ভাল মানুষ। আমি আশা করি যে আবার আমাদের সাক্ষাৎ হবে।”(প্যারেলাল; সমগ্রন্থ; প্রথম অংশ; পৃষ্ঠা ৯৪)

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও তারপর। জিন্নার নেতৃত্বে লীগ নির্বাচন-যুদ্ধে জয়ী
২৪

৬ই ডিসেম্বর বড়লাটের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে জিন্না বলেন যে ভারতবর্ষ কখনই এক ছিল না এবং আপাতদৃশ্যমান ঐক্য ইংরেজের সৃষ্টি। সুতরাং তিনি আবার ভারতবিভাজনের দাবি জানান, যা মানতে ওয়াভেল অস্বীকার করেন। দিল্লি থেকে বোম্বাই গিয়ে অনাড়ম্বরভাবে নিজ জন্মদিবস পালন করার পর প্রাদেশিক লীগের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মেটাতে জিন্না প্রথমে করাচী ও সেখান থেকে আহমেদাবাদে যান। ১৪ই জানুয়ারি “গুজরাত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে” বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি নিজের অতুলনীয় মানসিক শক্তির ইঙ্গিত দেন: “আমাকে প্লেগের সমতুল্য মনে করা হত এবং লোকে আমাকে এড়িয়ে যেত কিন্তু আমি নিজেকে সবার উপর চাপিয়ে দিয়েছি এবং চলার পথ করে নিয়েছি। অনাহূত এবং অবাঞ্ছিত মনে করা সত্ত্বেও আমি সর্বত্র গেছি। তবে এখন অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে।”(১) পরদিবস এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “ভারতবর্ষের ব্যাধির একমেব চিকিৎসা হল পাকিস্তান পরিকল্পনা।”(২) ১৬ই জানুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানের দাবি সজোরে তুলে ধরে জিন্না বলেন, “ভারতবর্ষের বিভাজনের ভিত্তিতে আমরা হিন্দু জাতির (nation) সঙ্গে আলোচনায় বসতে ও একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হতে ইচ্ছুক ও প্রস্তুত। এছাড়া অগ্রগতির অপর কোনো সম্ভাবনা নেই। আমি মিস্টার গান্ধীর কাছে যাই অথবা তিনি আমার কাছে আসুন—এ ব্যাপারটা তুচ্ছ।”(৩)
ইতিমধ্যে ইউরোপে যুদ্ধের অবস্থা মিত্রশক্তির যথেষ্ট অনুকূল হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য কেন্দ্রীয় পরিষদে কংগ্রেসের নেতা ভুলাভাই দেশাই এবং লীগের সহকারী নেতা লিয়াক‍ আলী খাঁ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে কেন্দ্রে কংগ্রেস-লীগের সম্মিলিত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য এক ফর্মুলায় সহমত হন। ফর্মুলা অনুসারে ব্রিটিশ বড়লাট ও প্রধান সেনাপতিকে স্বীকার করে নিয়ে কেন্দ্রে ভারতীয়দের দ্বারা এক সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হয় যার শতকরা ৪০ ভাগ করে সদস্য হবে কংগ্রেস ও লীগের, বাকি ২০ ভাগ শিখ, তপশীলী সম্প্রদায় ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ভিতর থেকে নেওয়া হবে বলে স্থির করা হয়। ভুলাভাই দেশাই যদিও বড়লাটকে বলেন যে গান্ধী ও জিন্না ইতিপূর্বে এ প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন, জিন্না কিন্তু একথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন।(৪) যাই হোক, পরবর্তীকালে কংগ্রেস এবং লীগ— উভয় প্রতিষ্ঠানই সরকারিভাবে এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে।
মার্চে সীমান্ত প্রদেশে লীগ মন্ত্রীসভা বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাবে পরাজিত হয়ে পদত্যাগ করার পর ডাঃ খাঁ সাহেবের নেতৃত্বে আবার কংগ্রেসি মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হয়। অসুস্থ জিন্নার পক্ষে স্বয়ং সীমান্ত প্রদেশে গিয়ে ঘটনার গতি সামলানো সম্ভব হয়নি, যদিও নানা কারণে দুর্নীতি-অভিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রী ঔরঙ্গজেব খাঁর প্রতি তাঁর খুব একটা আকর্ষণ ছিল না। যাই হোক তাঁর পাকিস্তান দিবসের (২৩শে মার্চ) বাণীতে ক্ষুব্ধ হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকট হয়: “একথা বিশ্বাস করা সম্ভব নয় যে বিন্দুমাত্র আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানবিশিষ্ট কোন মুসলমান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে এমন এক মন্ত্রীমণ্ডলীকে স্বীকার করে নেবেন যা সেবাগ্রামে বসবাসকারী মিস্টার গান্ধীর নিয়ন্ত্রণাধীন হবে অথবা তাঁর বা মুসলিম আশা- আকাঙ্ক্ষা ও তাঁদের জাতীয় দাবির বিরোধী কংগ্রেসের কাছে আদেশ নেবে।”(৫) ইতিপূর্বে ১লা ফেব্রুয়ারিতে সৈয়দ আবদুল আজীজকে লিখিত এক পত্রে তিনি কংগ্রেসি মুসলমানদের “বিশ্বাসঘাতক” আখ্যা দেন।(৬)
মে মাসের ৭ই জার্মানীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয় এবং চার্চিলের যুদ্ধকালীন কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা ২৩শে মে পদত্যাগ করে। ৫ই জুলাই নূতন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত চার্চিল অবশ্য এক অস্থায়ী সরকারের কর্ণধার হন। জুনের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বিলাতে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর ওয়াভেল ভারতবর্ষের নেতাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করার প্রয়াস শুরু করার জন্য তাঁর প্রস্তাবের অনুমোদন পান। সরকারের প্রস্তাবের মূলকথা ছিল প্রধান প্রধান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে বড়লাটের শাসন পরিষদের পুনর্গঠন যাতে বর্ণ-হিন্দু ও মুসলমানদের সংখ্যাসাম্য থাকবে এবং যুদ্ধ পরিচালনা ছাড়া আর সব বিভাগ ভারতীয়দের হাতে থাকবে। প্রশাসন চলবে প্রচলিত সংবিধান অনুসারে। ১৪ই জুন ওয়াভেল এই মর্মে এক ঘোষণা করে বলেন যে ভারতীয় নেতৃবর্গ যদি মিলেমিশে শাসন পরিষদের সদস্য মনোনীত করতে পারেন তবে সর্বোত্তম, নচেৎ তাঁরা তাঁদের মনোমতো নামের তালিকা দেবেন যার থেকে বড়লাট চূড়ান্ত তালিকা রচনা করবেন। আর তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে বর্তমান ব্যবস্থাই চলবে।”
কংগ্রেসে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের অতঃপর কারামুক্ত করা হয়। ঐ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি মৌলানা আজাদ ও লীগের সভাপতি জিন্নাসহ ২২টি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বড়লাট সিমলায় ২৫শে জুন থেকে আলোচনা শুরু করবেন স্থির হয়। গান্ধীও বড়লাটের সঙ্গে আলোচনার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, যদিও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনে যোগদান করেননি। গান্ধীর এই ভূমিকাও জিন্নার দ্বারা নিন্দিত হয়েছিল। ৩০শে জুন এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন যে গান্ধী যদি পাকিস্তানের ভিত্তি স্বীকার করে নেন তাহলে প্রস্তাবিত সিমলা সম্মেলনের কোনো আবশ্যকতাই থাকবে না।
সংগঠন হিসাবে লীগ তখন অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত। এই বিবাদ প্রাদেশিক লীগে ব্যাপক এবং এমনকি কেন্দ্রে স্বয়ং জিন্নার নেতৃত্বকেও স্পর্শ করেছে। এছাড়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ—বঙ্গ ও সীমান্ত প্রদেশে লীগ মন্ত্রীমণ্ডলের পতন ঘটেছে। সিন্ধুতে লীগ মন্ত্রীমণ্ডল নামেমাত্র। কারণ তাতে মাঝবরাবর চিড় ধরেছে। পাঞ্জাবে কোনো দিনই লীগ মন্ত্রীমণ্ডল ছিল না, যদিচ একদা স্যার সিকন্দরের সৌজন্যে লীগ ইউনিয়নিস্ট দলের সঙ্গে কোয়ালিশনে থাকার মর্যাদা পেয়েছিল। নিজের পিছনে এই সমর্থন নিয়ে জিন্না ওয়াভেল প্রস্তাবের সম্মুখীন হলেন।
উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে জিন্না বললেন যে লীগ “পাকিস্তানের মৌলিক প্রশ্নের স্বীকৃতি ব্যতিরেকে কোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থায় সম্মত হবে না।” তবে বড়লাট ও ব্রিটিশ সরকারের উপর তাঁর আস্থা আছে বলে তিনি এ-জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। অনেক আলাপ-আলোচনার পরও প্রতিনিধিরা কোনো সর্বসম্মত নামের তালিকা দিতে না পারায় ২৯শে জুন বড়লাট সব দলের নেতাদের শাসন পরিষদের সদস্যপদে মনোনয়নের জন্য নিজ নিজ দলের সদস্য-তালিকা দিতে বলেন। আজাদ ও অন্যান্য অনেক নেতা এর জন্য প্রস্তুত হলেও জিন্না তাঁর ওয়ার্কিং কমিটির অনুমোদন ব্যতিরেকে এ-জাতীয় তালিকা দিতে অসম্মত হলেন। সুতরাং সম্মেলন ১৪ই জুলাই পর্যন্ত স্থগিত রাখা হল। ৮ই জুলাই বড়লাটের সঙ্গে জিন্নার দেড়ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা হয়। ওয়াভেলের বিবরণ অনুসারে “জিন্না ঐসময়ে অত্যন্ত স্নায়বিক উত্তেজনার ভিতর ছিলেন এবং আমাকে একাধিকবার বললেন, ‘আমি আমার শক্তি ও ধৈর্যের শেষ সীমায় উপনীত হয়েছি’, তিনি একথাও বলেন, ‘লীগকে ধ্বংস না করার জন্য আমি আপনাকে মিনতি জানাচ্ছি।’ স্পষ্টতঃ তিনি খুবই বিপাকে পড়েছেন। তবে নিজের ঔদ্ধত্য ও আপোসবিরোধী স্বভাবের জন্য ঐ বিপত্তি প্রধানতঃ তাঁর নিজেরই সৃষ্টি। এখন তাঁর মনে এই আশঙ্কা জেগেছে যে সম্মেলনের ব্যর্থতার জন্য তাঁকে দায়ী করা হবে। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর যাবতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি ছাড়তে প্রস্তুত নন।”(৭)
ঐ আলোচনার পরও জিন্না তাঁদের দলের সদস্য তালিকা দিতে সম্মত না হওয়ায় বড়লাট তাঁর অনুরোধ অনুসারে ৯ই তাঁকে লিখিতভাবে এ সম্বন্ধ অনুরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে খেদের সঙ্গে তাঁকে জানালেন যে, “আপনি আমার কাছে গ্যারান্টি চেয়েছেন যে প্রস্তাবিত নূতন শাসন পরিষদের যাবতীয় মুসলমান সদস্য বাধ্যতামূলক ভাবে লীগের প্রতিনিধি হবেন। কিন্তু আমার পক্ষে এতে রাজী হওয়া সম্ভব নয়…।” এর জবাবে জিন্না ঐদিনই ঐ পত্র সম্বন্ধে লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত তাঁকে জানালেন। সিদ্ধান্ত হল—যাবতীয় মুসলমান সদস্য কেবল লীগের তালিকা থেকেই নেওয়া লীগের এক “মূল নীতি” এবং তার পূর্তি না হওয়ায় লীগের তরফ থেকে কোনো সদস্য-তালিকা পেশ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখনীয়, কেবল কংগ্রেসই নয়, এমনকি ইউনিয়নিস্ট নেতা খিজির হায়াৎ খাঁও লীগের এই দাবির তীব্র বিরোধিতা করেন। বড়লাট ১১ই জুলাই আবার জিন্নার সঙ্গে এ সম্বন্ধে আলোচনা করলেন। কিন্তু জিন্না কেবল অনড়ই রইলেন না, আরও একটি নূতন দাবি তুললেন। এই দাবি হল, প্রস্তাবিত শাসন পরিষদে মুসলমান সদস্যরা কোনো প্রস্তাবে আপত্তি করলে পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি ব্যতিরেকে তা গৃহীত হবে না। বড়লাট জানিয়ে দিলেন যে দুই-এর কোনো শর্তই তাঁর পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয় এবং এইভাবে প্রথম সিমলা সম্মেলন ব্যর্থ হল।(৮)
প্রশ্ন উঠতে পারে—ওয়াভেল যখন বোঝাপড়ার জন্য এতটা উন্মুখ ছিলেন এবং লীগ ছাড়া আর সব দলই যখন তাঁর সঙ্গে সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত ছিল, তখন লীগকে বাদ দিয়ে ওয়াভেল কেন তাঁর শাসন পরিষদ পুনর্গঠন করলেন না? খলিকুজ্জমাঁর বক্তব্য যে ওয়াভেল অন্যান্য দল বা নির্দলীয় মুসলমানদের নিয়ে তাঁর শাসন পরিষদ পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন এবং এ প্রস্তাবে ভারতসচিব আমেরীর মত চেয়েছিলেন। কিন্তু আমেরী এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। খলিকুজ্জমাঁর মতে, “আর দশ দিন পর লর্ড পেথিক-লরেন্সকে নিজের দায়িত্ব সমর্পণ করার পূর্বে আমার মতে এইটাই ছিল মিস্টার আমেরীর অন্যতম অন্তিম স্মরণীয় কৃতি।”(৯)
জানি সম্মেলনের শেষদিন অর্থাৎ ১৪ই জুলাই জিন্না তাঁর বক্তৃতায় বললেন, “পাকিস্তান এবং অখণ্ড ভারত সরাসরি পরস্পরবিরোধী…। ভারতবর্ষের মুসলমানরা পাকিস্তান অর্জনে
পৃষ্ঠা: ১৯৫

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।” “১৪ই জুলাই-এর তাঁর সংবাদপত্রের বিবৃতিতে জিন্না বড়লাটের প্রস্তাবকে মুসলমানদের ‘মৃত্যু-পরোয়ানার প্রতীক এক ফাঁদ’ রূপে বর্ণনা করলেন এবং যে পরিকল্পনা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট স্বীকৃতি দেয় না পুনরায় তাকে অগ্রাহ্য করলেন।” তাঁর ভীতিমূলক মানসিক পীড়া তাঁকে এই কথা বিশ্বাস করতে প্রবৃত্ত করে যে, “সরকারের যাবতীয় মুসলমান সদস্য লীগের প্রতিনিধি হলেও মন্ত্রীমণ্ডলে তাঁরা সংখ্যালঘু অর্থাৎ মাত্র এক- তৃতীয়াংশ হবেন। জিন্না বলেন যে “তাবৎ সংখ্যালঘুদের” প্রতিনিধিরা “বাস্তব ক্ষেত্রে অবধারিত ভাবে…আমাদের বিরুদ্ধে…ভোট দেবেন…। তপশিলীভুক্ত জাতিসমূহ, শিখ ও খ্রিস্টান প্রমুখ সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য কংগ্রেসেরই অনুরূপ। তাঁদের লক্ষ্য ও আদর্শ হল—অখণ্ড ভারত। জাতিতত্ত্ব ও সংস্কৃতির দিক থেকে তাঁরা হিন্দুসমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধিত।” জিন্না কংগ্রেসের (তাঁর মতে যা হিন্দুদেরও নয়, কেবল বর্ণহিন্দুদের প্রতিষ্ঠান) বিরুদ্ধে ভারত বিভাগের দাবিকে কেন্দ্র করে যে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন, তার সম্ভাবনা যে বিলীন হয়ে গেছে এ সত্যও তাঁর এই বিবৃতিতে উদ্ভাসিত।(১০) তবে ঐ বিবৃতিতেই “অকপটতার এক বিরল মুহূর্তে জিন্না স্বীকার করেন যে শাসন পরিষদের একজন পাঞ্জাবি ইউনিয়নিস্ট ও দুইজন কংগ্রেসি মুসলমান সদস্য মুসলিম লীগের একেবারে মূল এবং অস্তিত্বেই কুঠারাঘাত করত এবং এ হত ‘আমরা যেসব আদর্শের প্রতীক তার শোচনীয় আত্মাবলুপ্তি।’ ‘এ হত মুসলিম লীগের মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনির সমতুল্য’।”(১১)
ভারতসচিব আমেরীর কাছে পরদিবস জিন্না সম্বন্ধে ওয়াভেল এক গোপন নোটে মন্তব্য করলেন, “…সংকীর্ণচেতা ও উদ্ধত… প্রধানতঃ কংগ্রেসের প্রতি ভীতি ও অবিশ্বাস চালিত। গান্ধীর মতই এঁর অপর পক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করার ধাত নেই।”(১২) সম্মেলন ভেঙে যাবার সম্ভাবনার সংবাদে উল্লসিত আমেরী ১১ই জুলাই বড়লাটকে জানিয়েছিলেন যে এই সম্মেলনের দৌলতে কংগ্রেস নেতাদের আর এক দফা বোঝানো সম্ভব হয়েছে যে “…আপনি বা আমি নই, মুসলিম লীগই তাঁদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে বাধক…। এবার তাঁদের হয় নীরবে পাকিস্তানকে স্বীকার করে নিতে হবে আর নচেৎ উপলব্ধি করতে হবে যে জিন্নার বদলে তাঁদের যেনতেনপ্রকারেণ মুসলিম সমর্থন লাভ করতে হবে এবং পোষমানা কংগ্রেসি মুসলমানরূপী ভ্রম উপস্থাপিত করে তাঁদের কোন লাভ হবে না।”(১৩) এর সঙ্গে সঙ্গে আমেরী ভারতবর্ষের জনমত যাচাই করার জন্য সাধারণ নির্বাচনের অনুষ্ঠান করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
একথা সত্য যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সাংবিধানিক আলাপ-আলোচনার প্রথম ধাপে জিন্নার দাবি স্বীকৃত হল না। তবে সঙ্গে সঙ্গে একথাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে জিন্নার অভিমতকে উপেক্ষা করে ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো পরিকল্পনা কার্যকরী করা যাবে না।(১৪) অনতিবিলম্বে কেন্দ্রে ও প্রদেশসমূহে সাধারণ নির্বাচনের ফলে জিন্নার এই ভূমিকা মুসলিম জনমতের স্বীকৃতি পেয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল।
উচ্চ পর্যায়ে সাধারণ নির্বাচনের দ্বারা ভারতের জনমত যাচাইয়ের কথা উঠলেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্তত দুটি প্রদেশের ছোটলাট কিন্তু সে সময়ে সাধারণ নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন না। বাংলার রাজপ্রতিনিধি লর্ড কেসির অভিমত ছিল যে তাঁর প্রদেশের কোনো মুসলমান নেতারই “পাকিস্তানের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা ছিল না। শেষ অবধি তাঁরা জিন্নার উপর সব কিছু ছেড়ে দিতেন। অর্থাৎ তাঁদের বক্তব্য ছিল—জিন্না এ বিষয়ে সন্তুষ্ট যে অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে পাকিস্তান যুক্তিযুক্ত এবং তাই একথা যথার্থ”(১৫) পাঞ্জাবের লাট গ্ল্যান্সীর আশঙ্কা ছিল যে তখনকার পরিস্থিতিতে নির্বাচন একটা “ধর্মীয় ব্যাপারের নিষ্পত্তি”তে পরিণত হতে পারে এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী খিজির হায়াৎ খাঁরও ধারণা ছিল অনুরূপ। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট গ্ল্যান্সী ওয়াভেলকে লিখলেন যে সিমলা সম্মেলনের পর তাঁর প্রদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাসমূহে জিন্নার প্রভাব অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। “তিনি ইসলামের রক্ষাকর্তারূপে অভিনন্দিত হচ্ছেন….। আমাকে স্বীকার করতে হবে যে পরিস্থিতি দৃষ্টে আমি অত্যন্ত বিচলিত। কারণ আমার মনে হয় অন্তত মুসলমানরা যে একেবারে একটা অলীক প্রশ্ন নিয়ে নির্বাচনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন এর এক বিপজ্জনক সম্ভাবনা বিদ্যমান…। অজ্ঞান মুসলমানদের বলা হবে যে নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁদের যে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তা হল—আপনারা কি সাচ্চা মুসলমান, না কাফের ও বিশ্বাসঘাতক?…পাকিস্তান যদি এক অপরিহার্য সত্য হয় তাহলে আমরা সোজাসুজি এক ব্যাপক রক্তপাতের দিকে ধেয়ে চলেছি।”(১৬)
আসন্ন পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্বন্ধে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের সতর্কীকরণ সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্যস্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। অন্যান্য প্রদেশের ছোটলাটরা ভারতের রাজনৈতিক অবস্থাটা পরিষ্কারভাবে বোঝার উদ্দেশ্যে সাধারণ নির্বাচনের পক্ষে তো ছিলেনই, যুদ্ধে বিজয়ী হবার পরও ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করেছিল যে ভারতবর্ষ তাদের হাতছাড়া হতে চলেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইংলন্ডের শতবিধ সমস্যায় বিব্রত শ্রমিক সরকার ভারতসাম্রাজ্যরূপী অতিরিক্ত দায়িত্বের হাঙ্গামা পোয়াতে প্রস্তুত ছিল না। নূতন ভারতসচিব লর্ড পেথিক-লরেন্স ভারতের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি প্রকাশ্যে সহানুভূতিশীল ছিলেন। মন্ত্রীসভার ভারত বিষয়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ক্রিপস ছিলেন তাঁর সহায়ক। অন্য দিকে ভারতবর্ষে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারকে কেন্দ্র করে জনমতই কেবল পুনরপি উদ্বেল হয়ে ওঠেনি, যে-কোনো আধুনিক শাসক-শক্তির শেষ ভরসা সৈন্যদলেও আনুগত্যের প্রবল অবক্ষয় পরিদৃষ্ট হয় যার জন্য প্রধান সেনাপতি অচিনলেক ২৪শে নভেম্বর এক অতি গোপন পত্রে বড়লাটকে সতর্ক করে দেন। এর তিন মাস পর (১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬ খ্রি.) প্রথমে বোম্বাই এবং তারপর করাচীর নৌ-সৈনিকরা প্রকাশ্য বিদ্রোহ করে। আম্বালার বিমান-বাহিনীর সৈন্যদলের ভিতরও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এর উপর অনাবৃষ্টির জন্য দেশজোড়া খাদ্যাভাব যার কারণেও জনমানসে অশান্তি বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ সরকার তাই ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ গণপরিষদের সঙ্গে এক চুক্তির দ্বারা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করে এবং প্রস্তাবিত গণ-পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে প্রথম ধাপ ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে জনমত যাচাই করা। বড়লাট লর্ড ওয়াভেলের ১৮ই সেপ্টেম্বরের এবং প্রধানমন্ত্রী এটলির পরদিবসের ঘোষণায় বলা হয় যে ভারতবাসীদেরকে স্বশাসনের সুযোগ দেবার প্রথম চরণ হিসাবে নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রধান প্রধান ভারতীয় দলসমূহের প্রতিনিধিদের নিয়ে বড়লাটের শাসন পরিষদ গঠন করা হবে।
আসন্ন নির্বাচনকে জিন্না তাঁর লক্ষ্য পাকিস্তান প্রাপ্তির ব্যাপারে একটা জীবনমরণের প্রশ্নরূপে গ্রহণ করে এর জন্য ব্যাপক প্রচার এবং অর্থ (তাঁর ভাষায় চাঁদির বুলেট) প্রাপ্তির কাজে কোমর বেঁধে লেগে পড়েন। বোম্বাই থেকে ৩ লক্ষ, আহমেদাবাদ থেকে ২ লক্ষ এবং এইভাবে দেশের সমস্ত এলাকা থেকে মুসলমানরা লীগের অর্থভাণ্ডারে দান করতে লাগলেন। গান্ধী এবং কংগ্রেস ও তার “সবর্ণ হিন্দুনেতৃত্বে”র প্রতি তাঁর আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগল। উলপার্টের ভাষায়, “নাগপুরে প্রকাশ্য অসম্মানের সিকি শতাব্দীর পর তিনি তাঁর যশোহানির ধূলিশয্যা ছেড়ে মৃত্যুর দ্বারদেশে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন জগতের কাছে যেন এই কথা ঘোষণা করতে যে মিস্টার গান্ধী মিস্টার জিন্নার তুলনায় কোনো অংশেই শ্রেয় নন—তিনি কেবল জিন্নারই মতো অপর এক ‘প্রমুখ জাতির’ নেতা। গান্ধী ও তাঁর আচার-আচরণ সম্বন্ধে জিন্না যেন একটা আবেশের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন এবং গান্ধীর কার্যকলাপের যাবতীয় দিক জিন্নার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা ও জিজ্ঞাসার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল।”(১৭)
জিন্নার নিম্নোদ্ধৃত বক্তৃতাংশ গান্ধীর সম্বন্ধে তাঁর মরীয়া মানসিকতার দ্যোতক। ৬ই আগস্ট তিনি বললেন, “সুবিধা মনে হলে তিনি বলেন যে তিনি কারও প্রতিনিধি নন; তিনি ব্যক্তি হিসাবে কথা বলতে পারেন; তিনি কংগ্রেসের এমনকি চার আনার সদস্য ও নন; রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসার জন্য তিনি অনশন করেন; নিজেকে শূন্যে পর্যবসিত করে তিনি নিজ অন্তরাত্মার সঙ্গে পরামর্শ করেন; তারপর যখনই আবার তাঁর পক্ষে সুবিধাজনক মনে হয় তিনি কংগ্রেসের চূড়ান্ত ডিক্টেটার হয়ে পড়েন! তিনি মনে করেন যে তিনি সমগ্র ভারতবর্ষের প্রতিনিধি। মিস্টার গান্ধী এক হেঁয়ালি…। তাঁর সঙ্গে কিভাবে একটা বোঝাপড়ায় উপনীত হওয়া সম্ভব?” সেই মাসের ১২ই বোম্বাই-এর এক প্রকাশ্য সভায় তিনি এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন যে, কংগ্রেস “ছলে বলে কৌশলে” মুসলমানদের এক “অখিল ভারতীয় ইউনিয়নে” প্রলুব্ধ করতে চাইছে এবং তিনি অভিযোগ করলেন যে, “ব্রিটিশের দায়িত্ব পালন করার জন্য তারা (কংগ্রেস) শাসকদের বেয়নেট হাতে তুলে নিয়েছে এবং এই কারণে তারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিবিধ প্রকারের পন্থা অবলম্বন করে। কখনো তারা তোষামোদ করে, কখনও গালিগালাজ বর্ষণ করে, কখনো বা ব্রিটিশের সামনে দাস্যসুখে নতমস্তক, সময়ে আবার তাদের শাসানী দিতে ব্যস্ত…। আমরা কিন্তু এমন কোনো ব্যবস্থায় রাজী হতে পারি না যা হিন্দুদের স্বাধীনতা দিয়ে ‘হিন্দু-রাজ’ প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের পক্ষে দাসত্বতুল্য হয়।”(১৮) তিনদিন পর জনৈক ইংরেজ সাংবাদিক জিন্নাকে প্রশ্ন করেন যে, অন্তত জনাকয়েক ভালো হিন্দুও কি নেই? এর জবাবে তিনি নাকি বলেন, “না—নেই।”(১৯) ১০ই অক্টোবর কোয়েটার লীগের সভায় গান্ধীর অহিংস সত্যাগ্রহের প্রতি ব্যঙ্গভরে মন্তব্য করে বলেন, “নেতৃত্ব পাবার জন্য প্রথমে পুলিশের লাঠি বর্ষণের সম্মুখে ছাগলের মতো বসে থাকা, তারপর জেলে যাওয়া এবং তারপর অভিযোগ করা যে ওজন হ্রাস পাচ্ছে এবং তারপর কায়দা করে কারামুক্ত হওয়া (উচ্চ হাস্যরোল) – আমি ও জাতীয় সংগ্রামে বিশ্বাসী নই। তবে কষ্টবরণ করার সময় যখন আসবে তখন সর্বাগ্রে আমিই বক্ষে বুলেটের আঘাত বরণ করে নেব।”(২০) কংগ্রেসের উদ্দেশ্য মুসলমানদের “বিধিলিপি জার্মানীর ইহুদীদের মতো”(২১) করা—এই জাতীয় তাঁর উক্তি ঐ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মুসলিম জনমত গঠনে সাহায্য করল। ২৭শে অক্টোবর আহমেদাবাদের এক জনসভায় তিনি এক বিচিত্র যুক্তিজাল উপস্থাপিত করলেন: “সব মুসলমানই এক অদ্বিতীয় আল্লায় বিশ্বাসী এবং সেইজন্য তারা একই জাতি (nation)। তাঁরা পাকিস্তান চেয়েছিলেন এবং তা পাবেনও। এ হল তাঁদের মন্ত্রপূতঃ কবচ, তাঁদের রক্ষামন্ত্র—যা তাঁদের শক্তি ও গৌরব বৃদ্ধি করবে…। পাকিস্তানের চন্দ্রমা কিরণ বিকীর্ণ করছে এবং আমরা সেখানে উপনীত হবই।”(২২)
২১শে নভেম্বর এক জনসভায় জিন্না বলেন, “মিস্টার গান্ধী ও কংগ্রেস আমাদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হয়েছি যে এই পৃথিবীর কোনো মানুষ মুসলিম লীগকে ধ্বংস করার শক্তি রাখে না। কংগ্রেসের সম্মুখে দুটি বিকল্প তুলে ধরে তিনি বলেন, তাঁদের হয় পাকিস্তান মেনে নিতে হবে নচেৎ মুসলমানদের পদদলিত করতে হবে। কিন্তু দশ কোটি মুসলমানকে শেষ করা যায় না।” ২৪শে পেশোয়ারের বক্তৃতায় তিনি ঘোষণা করলেন, “আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন মুসলমানদের একবিন্দু রক্তও বৃথা পাত হতে দেব না। মুসলমানদের কোনোমতেই আমি হিন্দুদের ক্রীতদাসে পরিণত হতে দিতে পারি না।”(২৩) জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য—“তাঁরা না জাতীয়তাবাদী, না সাচ্চা মুসলমান।” এক বিচিত্র যুক্তিজাল বিস্তার করে তাঁদের উদ্দেশে জিন্না বললেন—“তাঁরা যদি সাচ্চা মুসলমান হন এবং যদি মনে করেন যে লীগের কার্যকলাপ মুসলমানদের হিতের পরিপন্থী, তবে তাঁদের লীগে যোগদান করে এই প্রতিষ্ঠানকে স্বমতে চালিত করা উচিত।”
কুশল মনোবিজ্ঞানী জিন্না ভারতীয় মুসলিম মানসিকতার দুটি দিক, হিন্দুপ্রভুত্বের ভীতি এবং ইসলামী অহমিকাবোধকে তাঁর ১৯৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনী বক্তৃতায় পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগালেন। এমনকি বড়লাট লর্ড ওয়াভেলও লক্ষ করেছিলেন যে “ভারতবর্ষের মুসলমান অধিবাসীদের শতকরা ৯৯জনের মনে হিন্দু প্রভুত্বের সম্বন্ধে যে আশঙ্কা বিদ্যমান, জিন্না তাঁদের মুখপাত্র…। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে হিন্দু-প্রভুত্ব ও হিন্দু-রাজত্ব সম্বন্ধে যে ব্যাপক অকৃত্রিম ভীতি তাই হল মিস্টার জিন্নার ভূমিকার আসল শক্তি।”(২৪)
পেশোয়ারের পূর্বোক্ত জনসভায় তিনি সুকৌশলে দুয়োরানি মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে বললেন, “আমাদের কোনো সুহৃদ নেই…। ব্রিটিশ অথবা হিন্দু—কেউই আমাদের মিত্র নয়। আমাদের মনে এ বিষয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই যে উভয়ের বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই করতে হবে। (বেনে হবার জন্য) উভয়েই যদি আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়, তবুও আমরা ভীত হব না।” অতঃপর তিনি বললেন, “ওঁরা (হিন্দুরা) প্রশ্ন করেন “মিস্টার জিন্না ও মুসলিম লীগ কতটা আত্মত্যাগ করেছেন?’…আমি কিন্তু আপনাদের জিজ্ঞাসা করছি ‘১৯২০-২১ খ্রিস্টাব্দে কারা আত্মত্যাগ করেছিল?’ মি. গান্ধী আমাদের কঙ্কালের উপর চড়ে নেতৃত্বের সিংহাসনে অধিরূঢ় হয়েছেন।”(২৫) প্রায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত গান্ধীর জনপ্রিয়তার কারণে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের কেন্দ্রস্থল থেকে একদা অগৌরবজনকভাবে অপসারিত জিন্নার মনের বহুদিনের সঞ্চিত জ্বালা এইভাবে ফুটে বেরোল।
বলা বাহুল্য গান্ধী, কংগ্রেস ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে এই বিদ্বেষ ছড়ানোর একটিই মাত্র উদ্দেশ্য ছিল এবং তা হল নিজেকে মুসলমানদের একমেব স্বার্থরক্ষকরূপে তুলে ধরা ও পাকিস্তানের দাবিই যে তাঁদের কল্যাণের একমাত্র পন্থা এ সম্বন্ধে মুসলিমমানসে তীব্র আবেগ সৃষ্টি করা। পাঞ্জাব ও বঙ্গের ছোটলাটদের জিন্না ও পাকিস্তান দাবি সম্বন্ধে মূল্যায়ন ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জিন্নার এই ভূমিকা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল। বাহ্যতঃ স্বাস্থ্যের দোহাই দিলেও মূলত সংগঠনের খুঁটিনাটির ব্যাপারে তাঁর অনীহার জন্য তিনি পূর্ব ভারতে নির্বাচন প্রচারের জন্য যান নি। প্রার্থী নির্বাচনে লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডকেও তিনি বেশি সময় দেননি। লীগের এসব সংগঠনাত্মক কাজ লিয়াকৎ আলী খাঁর তত্ত্বাবধানে অন্যেরা করেন এবং প্রতিটি প্রদেশে লীগের মধ্যে প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল।(২৬) তবু লীগ ডিসেম্বরের কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচনে ৩০টির মধ্যে সব কটি এবং পরবর্তী ফেব্রুয়ারিতে প্রাদেশিক বিধানসভাসমূহের নির্বাচনে অধিকাংশ (শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ) মুসলিম আসনে বিজয়ী হয়ে জিন্নার এতদিনের দাবি—লীগই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান—সংবিধানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত করল।
মুসলমানরা মোট যত ভোট দেন তার শতকরা ৭৫ ভাগ পায় লীগ। “বঙ্গের ১১৯টির মধ্যে ১১৩টি, পাঞ্জাবের ৮৬টির মধ্যে ৭৩টি, সিন্ধুর ৩৪টির মধ্যে ২৭টি আসন লীগ লাভ করে। হিন্দু-সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহেও মুসলমান নির্বাচন ক্ষেত্রসমূহে লীগের বিজয় সমপরিমাণ উল্লেখযোগ্য হয়। সংযুক্ত প্রদেশে ৬৬টির মধ্যে ৫৪টি, বিহারে ৪০টির মধ্যে ৩৪টি, উড়িষ্যার মোট ৪টি আসনের সবগুলি, মাদ্রাজের সবগুলি অর্থাৎ ২৯টি, মধ্যপ্রদেশের ১৪টির মধ্যে একটি বাদে সব কয়টি, বোম্বাই-এর ৩০টির মধ্যে সবগুলি এবং আসামের ৩৪টির মধ্যে ৩১টি আসনে লীগ বিজয়ী হয়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস যেখানে (জমিয়ৎ উলেমা দলের ২ জন সহ) ২১টি আসন পায়, লীগের আসন সংখ্যা সেখানে ১৭টি হয়। মোট ৪৯২টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পায় ৪২৫টি। আইনসভাগুলি কাজ করতে আরম্ভ করার পর ঐ আসনসংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।”(২৭)
সংগঠনের দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল এবং নির্বাচনযুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার পাকিস্তান- দাবি অস্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও লীগের এই অভাবনীয় সাফল্যের কারণ আবিষ্কারের জন্য কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। বলা বাহুল্য এর প্রধান শক্তি ছিলেন জিন্না এবং তাঁর রণকৌশল। মুসলিম জনমানসে তাঁর শক্তিশালী আবেদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মুসলমানদের মনের হিন্দুভীতি এবং ইসলামী অহমিকাকে উস্কে দেওয়া—একথা একটু পূর্বে বলা হয়েছে। তাছাড়া শৃঙ্খলা, নীতি-নিয়ম ও আদর্শবাদ বিরহিত এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত প্রাদেশিক লীগ সংগঠনগুলি এক দিক থেকে তাঁর প্রভাব বৃদ্ধির সহায়ক হয়। ফজলুল হক, সিকন্দর হায়াৎ খাঁ, খিজির হায়াৎ খাঁ অথবা আল্লাবক্সের মতো কেউ তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে না ওঠা পর্যন্ত তিনি প্রাদেশিক লীগের যে কোনো ধরনের নেতৃত্বকেই স্বীকার করে নিতেন। শর্ত কেবল একটাই—সর্বভারতীয় স্তরের নেতা হিসাবে তাঁকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে। যিনি যে উপায়ে প্রাদেশিক লীগের ক্ষমতা করায়ত্ত করুন না কেন, বহু অভিযোগ পেলেও তাঁর বিরুদ্ধে জিন্না সাধারণত কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন না। শহরের ধনী ব্যবসায়ী এবং গ্রামের জমিদার-জোতদারদের নেতৃত্ব স্বীকার করে নিয়ে প্রাদেশিক লীগ সংগঠনগুলি শক্তিশালী হয়। জিন্না কখনো এঁদের আর্থিক স্বার্থবিরোধী কথা বলতেন না। সমাজবাদী বা সাম্যবাদীদের ঈশ্বর ও ইসলাম বিরোধী বলে তাঁদের বক্তব্যকে বিবেচনার অযোগ্য প্রতিপাদিত করায় কায়েমী স্বার্থসম্পন্ন মুসলমানদের সমর্থনে লীগ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জনসাধারণের সঙ্গে তাঁর ব্যবধান রাখার স্বভাব এ ব্যাপারে তাঁর সহায়ক হয়েছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তির তাঁর প্রতি আনুগত্য থাকলে বড় বেশি হলে লিয়াকত আলী খাঁ, খলিকুজ্জমাঁ অথবা নবাব মহম্মদ ইসমাইল প্রমুখের মাধ্যমে একটা তদন্ত করিয়ে বা জোড়াতালি দিয়ে শক্তিশালী ব্যক্তির কর্তৃত্ব তিনি বজায় রেখে নিজ সংগঠনকে পুষ্ট করেছেন।
জিন্নার প্রধান লক্ষ্য নিজেকে মুসলিম স্বার্থের একমাত্র প্রবক্তা রূপে প্রতিষ্ঠিত করা
পৃষ্ঠা: ২০০