নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমি, রংপুর
২৩ মে ‘৭১ রোববার। রংপুর শহরের লিচুবাগান এলাকা। আশপাশের বাড়িতে রাতের খাবার প্রায় শেষ। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি শৈলেন দত্ত খেতে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময় গাড়ির শব্দ শোনা গেল। সাথে হুইসেলের শব্দ। অসংখ্য বুটের আওয়াজে প্রকম্পিত হলো মহল্লা। কিছুক্ষণ পর দরজার কড়া নাড়ার শব্দ হলো। সাথে সাথে অশীল ভাষায় গালিগালাজ। স্পষ্ট বাংলায় শোনা গেল ‘শালা মালাউনের বাচ্চা দরজা খোল’। বাধ্য হয়ে দরজা খুললেন শৈলেন দত্তের বড় বোন ইলা দত্ত। দেখেন মহল্লার পরিচিত কজনের পেছনে পাকিস্তানি আর্মি। দরজা খোলা মাত্র হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ল ঘরে। শৈলেন দত্তকে ধরার জন্য আর্মিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল ছয়-সাতজন। শৈলেন দত্তকে হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়ে সাথের রাজাকাররা গিয়ে ঢুকল অন্য দুটি বাড়িতে। সেখান থেকে ধরে আনল রংপুর শহরের প্রবীণ আইনজীবী পূর্ণচন্দ্র সরকার এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শঙ্কর বণিককে। মহল্লায় তখন পিনপতন নীরবতা। এ নীরবতা ভাঙল প্রবীণ আইনজীবী পূর্ণচন্দ্রের আর্তচিৎকারে। বেদম মারপিট শুরু করে দিল রাজাকাররা মহল্লার মধ্যেই এ তিনজন অসহায় মানুষকে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকল। মারপিট করতে করতে পূর্ণচন্দ্র সরকার এবং শঙ্কর বণিককে একটি আর্মি জিপে তোলা হলো। কিন্তু শৈলেন দত্তকে জিপে উঠানো হলো না। পাকিস্তানি হায়েনারা শৈলেন-এর পা দুটো শক্ত করে বাঁধল এবং সেই রশির মাথা জিপের সাথে বেঁধে দিল। সারি বেঁধে গাড়ি ছুটে চলল। শৈলেন দত্তের আর্তনাদে সারা পাড়া মৃতপ্রায় হয়ে গেল। গাড়ি মহল্লা থেকে বের হয়ে ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে ছুটে চল্ল। শৈলেন দত্তের আর্তনাদ আর শুনতে পেল না মহল্লাবাসী। পরদিন সকালে মহল্লার মোড়েই পাওয়া গেল শৈলেন দত্তের রক্তভেজা লুঙ্গি। সবাই বুঝে গেল যা হবার হয়েছে। কারো মুখে কোনো টু শব্দ নেই। সব সুনসান। বেলা বাড়তে থাকল। সময় তখন সকাল ১১টা। খবর পাওয়া গেল রংপুর ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জ হাটে গত রাতে চল্লিশ-পঞ্চাশ জনকে গুলি করে মেরেছে পাকিস্তানিরা। অনেকেই দেখে এসেছে সে লাশগুলো। আইনজীবী পূর্ণচন্দ্র সরকার, শঙ্কর বণিকের লাশ সেখানে ছিল। ছিল না শৈলেন দত্তের লাশ।
লিচুবাগান থেকে নিসবেতগঞ্জ হাট পর্যন্ত জিপের পেছনে বাঁধা শৈলেন দত্ত মিশে গেছে ছিন্ন ছিন্ন হয়ে পথের ধূলায়। একই সময়ে রংপুরের মানুষ হারাল তাঁদের আর একজন আপন মানুষকে। তিনি হলেন সবার প্রিয় পাখিদা। পুরো নাম শ্রী বিজয় চন্দ্ৰ মৈত্র। শহরের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যমণি ছিলেন পাখিদা। প্ৰাণখোলা এ মানুষটিকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকেই দেশ ত্যাগের অনুরোধ জানান। কিন্তু তিনি অটল-অনড়। মাতৃভূমি ছাড়তে রাজি নন। দুর্দিনে দেশ ত্যাগ করা মহাপাপ এবং অন্যায়।
বৃদ্ধ পিতাকে সাথে নিয়ে গুপ্তপাড়ার বাসায় থাকতেন। অবস্থা খারাপের দিকে গেলে দুই ছেলেকে পাঠিয়ে দেন শ্বশুরবাড়ি নলডাঙ্গায় এপ্রিল মাসের দিকে। কিন্তু সেখানে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর দুই ছেলে চুনী ও মুকুলকে হত্যা করে। মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়েন পাখিদা। বাসা থেকে বের হতেন না কোথাও। ২৫ মে মধ্যরাতে গুপ্তপাড়ার বাসা থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় দখলদার বাহিনী নিসবেতগঞ্জের বধ্যভূমিতে। সবার সাথে পড়ে থাকে তাঁর লাশ।
[১৭৪] মুকুল মোস্তাফিজ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত