You dont have javascript enabled! Please enable it!

পলাশবাড়ি বধ্যভূমি ও নির্যাতন, কুড়িগ্রাম

কুড়িগ্রাম শহরে পাকিস্তানি সৈন্যদের পদানত হওয়ার পরের কাহিনী। পলাশবাড়ি গ্রামের এক মাথায় অবস্থানস্থল হিসেবে গড়ে তুলেছে হানাদার বাহিনী। সেখানে বাঙ্কার তৈরি করবে তারা। আর এ কাজে নিয়োগ করে গ্রামবাসীদের। না, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ নয়। বিনা পারিশ্রমিকে গ্রামের যুবক- প্রৌঢ়কে শ্রম দিতে হয়েছে উদয়াস্ত। যদিও স্বেচ্ছায় কেউ যায়নি কাজে। জোর করে নিয়ে যেত তাদের বাড়ি থেকে। এ ধারা অবশ্য কমবেশি ছিল প্রতিটি গ্রামে। একইভাবে পলাশবাড়ি গ্রাম থেকেও ধরে নিয়ে যায় প্রচুর লোক। তাদের দিয়ে খনন করায় বাঙ্কার। ভোরবেলা থেকে অস্ত্রের মুখে শুরু করে তারা খননকাজ। তারপর না খেয়ে, কোনো রকম বিরাম ছাড়াই কাজ করেছেন পুরো দিন। তবুও তাদের যেতে দিচ্ছে না সৈন্যরা। আটকে রেখে আরো কর্ম উদ্ধার করার প্রয়াস।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এবার বলা হলো সবাই মিলে একটা বড়সড় গর্ত খনন করেন। এটাই তা হলে শেষ কাজ। সমাপ্ত হলেই চলে যেতে পারবে যার যার বাড়িতে। তাই দ্রুত কোদালের কোপ দিতে থাকে তারা। দেখতে দেখতে প্রস্তুত হলো একটি বিরাট গর্ত। তত্ত্বাবধানকারী সৈনিকরা পরখ করে দেখে গর্তটি। কিন্তু খননকারী নিরীহ গ্রামবাসীরা জানল না গর্ত খননের কারণ। শুধুই হুকুম তালিম করে চলেছে তারা। এবারে খননকারীদের কাজ সমাপ্ত। বাড়ি যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করল সৈন্যদের কাছে। সে ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপ না করে ডেকে নেয় সবাইকে বড় গর্তের কাছে। ভেতরে প্রবেশ করতে নির্দেশ দেয় তাদের। কিছু না বুঝেই গ্রামের সহজ-সরল লোকগুলো প্রবেশ করে তাদেরই খনন করা গর্তে। সবাই যখন ঢুকে পড়েছে তখনই গর্জে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের হাতের অস্ত্র। পাখির মতো ছটফট করতে থাকে সারাদিনের মানুষগুলো। গুলিবিদ্ধ হয়ে একে অন্যের ওপর পড়ে লাফালাফি করছিল। আর্তনাদ করছে কেউ কেউ অনেকক্ষণ। কিন্তু ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল পরিবেশ। নীরব-নিথর হয়ে গেল পলাশবাড়ি এলাকার এই অসহায় মানুষগুলোর দেহ। ১১ জন শহীদের ১০ জনই ছিলেন পলাশবাড়ির। পলাশবাড়ির লোকজন জানান, তাদের গ্রামের নজমউদ্দিনের বয়স তখন ৩০ বছর। বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। পেশায় ছিলেন কৃষক। কৃষিকাজ করতেন সামাদ আলীও। বয়সে একেবারেই নবীন। টগবগে যুবক। বিশের কোঠায় তার বয়স। যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় হলেও সে সুযোগ পাননি। একই বয়সী যুবক আকবর আলী। এই তো মাত্র ক’দিন আগে বসেছিলেন বিয়ের পিঁড়িতে। ঘরে তখন নতুন বউ। সমবয়সী বন্ধু তাদের আবুল কাশেম। তারও পেশা গৃহস্থি। আর সাইফুদ্দিন ছিল ঘর কামলা। এদের সবাইকে নিয়েছিল গ্রাম থেকে ধরে। নিয়েছিল আবদুল হাকিমকেও।
আবদুল গিয়েছিল শহরে। ফিরে আসার পথে তাকেও ধরে নিয়ে হত্যা করে কোনো কারণ ছাড়াই। গ্রামবাসীর শত অনুরোধ সত্ত্বেও তার মৃতদেহটি সরিয়ে দেয়নি পাষণ্ডরা। নিজামউদ্দিন পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন কোথাও ধরলার তীর দিয়ে। যেতে যেতেই বিদ্ধ হলেন পাকসেনাদের গুলিতে। তার মৃতদেহটিও পাওয়া যায়নি অনেক অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও। ছিপত নামের অন্য একজনকেও এভাবে রাস্তায় হত্যা করেছিল।
আবু মিয়া ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী। দায়িত্ব পালন করতেই যেতে হতো তাকে শহরে। কুড়িগ্রাম শহরের হরিকেশের সেতুতে নিতান্ত খেলাচ্ছলেই তাকে গুলি করে পাকিস্তানিরা। আর সাথে সাথেই হয়ে যান তিনি স্বাধীনতার বলি। এই ১০ জন গ্রামবাসীকে বিনা কারণেই হত্যা করে। এছাড়া ছকিনা বিবিসহ বহু মহিলাকে ধর্ষণ করে পাকিস্তানি পাষণ্ডরা।
[৪৭] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!