নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন জায়গার নির্যাতন ও গণহত্যা, নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জ শহর গোটা নয় মাস বাঙালি নির্যাতন আর হত্যাকেন্দ্রে পরিণত হয়। মাসদাইয়ের নরমেধজ্ঞের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে শহীদ জসিমুল হকের কন্যা শেলী নিলুফার জানান—
পাকসেনারা আমার ঘরে ঢুকে খাটের ওপর লেপ, কাঁথা, বালিশ একত্র করে আগুন লাগিয়ে দিয়ে বের হয়ে যায়। আমি লুকিয়ে বাড়িতে ঢুকে আগুন নেভানোর চেষ্টা করি। এমন সময় একজন পাকসেনাকে বাড়ির দিকে আসতে দেখে দৌড়ে পায়খানার ট্যাঙ্কের আড়ালে শুয়ে পড়ি।
বন্দি লোকগুলোকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। লোকগুলো বাঁচার তাগিদে ছোটাছুটি শুরু করলে তিন দিক ঘিরে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতেও তারা ক্ষান্ত হয়নি। রাজাকারদের সহায়তায় এই লাশগুলোকে একত্র জড়ো করে। দক্ষিণ- পশ্চিম কোনাকুনি হাবিব মিয়ার জেলে বাড়ি হতে মূলি বাঁশের বেড়া ভেঙে লাশের উপর ঢেকে দেয়। ব্যাগ হতে সাদা মতো প্যাকেট বের করে পাউডার হাতে নিয়ে বেড়াগুলোর ওপর ছিটিয়ে দিল। একটু দূর হতে ২-৩ জন সেনা ঐ বেড়াগুলোর ওপর গুলি ছুড়ল। সাথে সাথে আগুন ধরে গেল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শ্মশানে পরিণত হলো জায়গাটা।
এপ্রিল মাসের এক রাতে খানসেনাদের একটি দল মদনগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির কাছে চিত্তবাবুর বাড়িতে হানা দিয়ে তার স্ত্রী ও মেয়েকে পাশবিক নির্যাতন করে চিত্তবাবুসহ তিনজনকেই হত্যা করে।
পাকসেনা ও তার দোসররা বন্দরে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করেও সাধ মিটল না। তাদের নির্মমতা-নিষ্ঠুরতার সীমা বাড়তেই থাকল। সোনাছড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কমান্ডার আব্দুর রশীদ বলেন —
আমাদের গ্রামে ঢুকেই পাকসেনারা আমার খোঁজে বাড়িতে আসে। আমি তখন ভারতে। মুজিববাহিনীর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আমাকে না পেয়ে হানাদাররা আমার বাবা আব্দুল খলিল, নানা ও মামাকে হত্যা করে নৃশংসভাবে।
সোনাকান্দার রাজাকার মোহাম্মদ আলী ছিল বন্দর থানার রীতমতো ত্রাস। তার প্রকাশ্য নির্দেশে নিহত হয় আওয়ামী লীগ কর্মী ছালাম মুন্সী, নির্মমভাবে হত্যা করে নবীগঞ্জের শফি চেয়ারম্যান ও সোনাকান্দা ডকইয়ার্ডের ফজল ও ফকরুলকে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে যার গান সবাইকে উজ্জীবিত করার জন্যে উদ্দীপ্ত করেছিল সেই কমলকে মোহাম্মদ আলীর নির্দেশে টিঅ্যান্ডটির মিলিটারি ক্যাম্পে ধরে আনে। দিনের পর দিন অত্যাচার করে একদিন তাকে হত্যা করে। পাকবাহিনী নবীগঞ্জ বাজার আক্রমণ করে অগ্নিসংযোগ করে দোকানে দোকানে। হত্যা করে প্রাক্তন পৌর কমিশনার দুলাল সর্দার ও তার দুই ছেলেকে। ঘাড়মোড়া আর মদনগঞ্জের প্রায় পনেরো জন লোককে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে খানসেনারা।
মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুজ্জামান উল্লেখ করেন—
এপ্রিল মাসের ২৩-২৪ তারিখে রানা বাহিনী (মিলিশিয়া) বন্দর বার্ড কোম্পানিতে ঘাঁটি স্থাপন করে। ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত তারা এখানেই অবস্থান করে। পাকসেনা কমান্ডার রানার মনোরঞ্জনের জন্যে বার্ড কোম্পানির বাগানে শ্রমিক কোয়ার্টার থেকে শ্রমিক নকু মিয়ার স্ত্রী কুলসুমকে ধরে নেয়। দীর্ঘ আট মাস কুলসুম রানার সাথেই ছিল। স্বাধীন হবার পর কুলসুমকে আর দেখা যায়নি। রাজাকাররা অন্যান্য জায়গা থেকেও যুবতীদের ধরে এনে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে দিত।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতন, ধ্বংস, হত্যার প্রতিবাদ করার জন্যে সাইদুল হক সাদুর নেতৃত্বে আদমজী জুট মিলের শ্রমিক, ছাত্ররা আদমজীনগর এলাকা থেকে বের হয়ে সদলবলে চিটাগাং সড়কের বাসস্ট্যান্ডে আসে রাস্তা কাটার জন্যে। সে সময় কাচপুর ব্রিজটি তৈরির কাজ চলছে। বিদেশী নাগরিকদের পাহারায়রত পাকসেনারা। চিটাগাং সড়কে হঠাৎ এত লোকের জমায়েত দেখে দূর থেকেই গুলি ছুড়ে হানাদারেরা। গুলিতে জনৈক এক ছাত্র ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়। পাকসেনারা জোরপূর্বক আদমজী জুট মিলের কয়েকজন মহিলা শ্রমিক ববিতা, নূরজাহান, কোহিনূর ও জমিলাকে ধরে নিয়ে গান বোটে চড়ে কোনাপাড়া ডগাইল নামক স্থানে পালিয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম বলেন—
২৮ মার্চ পাকহানাদার বাহিনী সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় প্রবেশ পথে আব্দুল বারেক ও কুতুব আলী নামে দুজন লোককে হত্যা করে। নুরুল আহম্মেদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
পদ্মা অয়েল কো. লি.-এর অপারেশনস এক্সিকিউটিভ এম.এ. বাশার জানান—
গোদনাইল ডিপো পদ্ম অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের সিনিয়র ডিপো সুপার পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনাব হাওলাদারকে সরিয়ে পাকসেনারা এখানে ক্যাম্প করে। চালায় গণহত্যা ও নির্যাতন।
বার্মা ইস্টার্নে (পদ্মা অয়েল কো. লি.) অবস্থানরত পাকসেনাদের বর্বরতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী শ্রী বিশুরাম ডোম বলেন—
বার্মা ইস্টার্নে ছিল হানাদার জল্লাদদের কসাইখানা। সারিবদ্ধভাবে ৮-১০ জন পুরুষদের দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে প্রতিদিন। যুবতীতের জোরপূর্বক ধরে এনে ১নং বাংলোতে নির্যাতন করত। অনেক মা-বোনের লজ্জা হরণ করল তারা। তাতেও তাদের সাধ মেটেনি। নির্যাতনের পর হত্যা করত এসব যুবতীদের। এসব যুবতীদের আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত হতো এই বার্মা ইস্টার্ন ডিপো। অসহায় নারীদের এতটুকু সাহায্য করতে পারিনি সেদিন। পারিনি জল্লাদদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। মৃতদেহগুলো হানাদারদের নির্দেশে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিতাম। এই হাত দিয়েই জেটির রক্ত পরিষ্কার করতাম।
রণদাপ্রসাদ সাহা ও তাঁর পুত্র ভবানীপ্রসাদ সাহার শহীদ হবার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমুদিনী অয়েল ট্রাস্টের খানপুর, নারায়ণগঞ্জের জেনারেল ম্যানেজার খন্দকার আফসার উদ্দিন জানান, এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখে রণদাপ্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানীপ্রসাদ সাহা লাট ভবনে টিক্কা খানের সাথে দেখা করেন। সেখান থেকে ফেরার পথে বঙ্গভবন থেকে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। ৫ মে ছাড়া পান। মৃত্যুগুহা থেকে ছাড়া পেয়ে পিতাপুত্র প্রথমে নারায়ণগঞ্জ ও পরে মির্জাপুর যান। ৭ মে রণদাপ্রসাদ পুত্র ভবানীপ্রসাদ ও ডা. হাফিজকে সঙ্গে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ রওনা হন। রাতের অন্ধকারে পাকসেনারা কুমুদিনী অয়েল ট্রাস্টের কার্যালয় থেকে রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা ও তাঁর পুত্র ভবানীপ্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে ধরে নেয় গৌর গোপাল সাহাকে (পাট ব্যবসায়ী)। পাকসেনারা তাদের নিয়ে কুমুদিনী অয়েল ট্রাস্টের ফটক দিয়ে বের হবার সময় ফটকের দারোয়ান ও রাখাল (গরুর) পাকসেনাদের বাধা দেয়।
পাকসেনারা প্রহরী ও রাখালকে তাদের সঙ্গে বন্দি করে কুমুদিনী অয়েল ট্রাস্টের থেকে বের হয়ে ডান দিকের পথ ধরে চলে যায়। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজির পরও আর কোনো সংবাদ জানতে পারেনি তাদের আত্মীয়-স্বজন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বার্মা ইস্টার্নে ছিল পাকবাহিনীর একটি বড় ঘাঁটি।
এস ও কোম্পানিতে (মেঘনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। আশপাশের গ্রামে চালানো হলো অকথ্য নির্যাতন। বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনে নিরীহ পুরুষদের প্রতিদিন জেটির ওপর দাঁড় করিয়ে নৃশংসভাবে সংঘটিত হতো হত্যাকাণ্ড।
বর্তমান ৫ নং তেলের ট্যাংকির নিচে রয়েছে অসংখ্য মানুষের লাশ। যুদ্ধকালীন সময়ে ট্যাংকটি তৈরির জন্যে খননকাজ শুরু হয়। যুদ্ধের জন্যে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। পাকসেনারা এই গর্তটি লাশ ফেলার কাজে ব্যবহার করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাক বোঝাই প্রায় ৫০০-৬০০ লাশ এই গর্তে ফেলা হয়।
গোদনাইল ইউনিয়নের এক মহিলাকে আগুনে পুড়িয়ে জীবন্ত দাহ করে পৈশাচিক বর্বররা। গোদনাইল বাজারটা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
১৯৭১ সালে ৮ এপ্রিল। বৃহস্পতিবার। প্রায় দুপুর দেড়টা। লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের পিয়ন সবদার খান ও তার পুত্র ইয়াকুব খান হঠাৎ এক ট্রাক মিলিটারি নিয়ে জিএমের বাংলোর বারান্দায় থামে। এই প্রসঙ্গে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পী অতুল চন্দ্র মজুমদার বলেন—
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকসেনারা পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। তারা শ্রমিক কোয়ার্টারে ঢুকে পুরুষদের বাইরে নিয়ে আসে। নিরস্ত্র নিরপরাধ মিলের কর্মচারীদের ধরে বার্মা ইস্টার্নে নিয়ে যায়। তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কান্নাকাটি, কাকুতি-মিনতি সেদিন হানাদারদের কানে প্রবেশ করেনি। খোকা মিঞা, আব্দুল খলিল, বিশ্বনাথ পাল, রমাকান্ত দাস, অরুণ চন্দ্র আইচ, ধীনেশ দাস, দীলিপ দাস, গীরিন বসাক, যোগেশ দাস, চিন্তাহরণ দে, বঙ্কিম বিহারি রায়, গোপাল দে, কালিপদ সিং, সতীশ দে, আশা রঞ্জন শীল, পুণ্য চন্দ্র দত্ত, প্রাণেশ দত্ত, মো. মমতাজউদ্দীনকে বার্মা ইস্টার্নের জেটিতে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করে। এই লাশগুলো তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর স্রোতে ভেসে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের পূর্ব পাশে নদীর কিনারে ভেড়ে।
আদমজী জুট মিল ছিল পাকসেনাদের ক্যাম্প। এখানে চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার পাকসেনা অবস্থান করত। প্রতিদিন হাজার হাজার নিরপরাধ যুবক শ্রমিককে ধরে আনত শিমুলপাড়া বিহারি কলোনিতে। এখানে অবস্থিত যমঘরে পাকসেনারা চেক করে ছেড়ে দিত রাজাকারদের হাতে। মুসলিম লীগের বাদশা মেম্বার ও বিহারি যুবকরা ধারাল অস্ত্র দিতে তাদের জবাই করত। কখনো ইলেকট্রিক শক দিয়ে তাদের হত্যা করত। তাদের মৃতদেহগুলো পুকুরে বা ডানদিকে পচা জল নিষ্কাশনের পাম্পের মুখে ফেলে দিত। জলের স্রোতে তা গিয়ে পড়ত শীতলক্ষ্যা নদীর খালে।
আড়াইহাজার, নরসিংদী, বরপা, তারাবো, কাচপুর, গুদারঘাট হতে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ধরে আনত নিরীহ যুবকদের। আদমজীর ২নং মিলের পাটগুদামের কেন্টিনের দক্ষিণ পাশে পুকুরের সামনে। এখানে পুকুরসংলগ্ন একটি গভীর নর্দমার পাশে বন্দি যুবকদের দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে হত্যা করত। নর্দমার পাশেই খনন করা হয় একটি বড় গর্ত। যে মৃতদেহগুলো নর্দমায় পড়ত না সেগুলো সুইপারের মাধ্যমে ঐ গর্তে ফেলা হতো।
মো. সুন্দর আলী পাকহানাদর বাহিনীর নির্যাতন সম্পর্কে জানান, পাকসেনারা এখানে অনেক নারীর সম্ভ্রম লুট করেছে। তিনি ১৬ ডিসেম্বর বীণা নামে এক নারীকে পাটগুদামের কেন্টিনের সামনে মুমূর্ষু অবস্থায় পান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক নির্যাতনে তার শরীরে বিভিন্ন ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সুন্দর আলী কোলে তুলে তাকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার সময়ই সে মারা যায়।
[১০১] রীতা ভৌমিক
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত