You dont have javascript enabled! Please enable it! নারিয়া গণহত্যা | মৌলভীবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

নারিয়া গণহত্যা, মৌলভীবাজার

নারিয়া গ্রাম মৌলভীবাজার জেলার পশ্চিম প্রান্তে আপার কাগাবালা ইউনিয়নের সীমানায়। বিশাল সব হাওর পরিবেষ্টিত গ্রামটির যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত বন্ধুর। রাজাকার বাহিনীর তিনজন মিলে গ্রামের মাতবরদের কাছে প্রস্তাব দেয় যেন এ গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং গ্রামের সকল যুবতী মেয়েকে মুসলমান ছেলেদের কাছে বিয়ে দেয়া হয়। শর্ত পালন করলে পাকসেনারা কখনো নারিয়া আক্রমণ করবে না আশ্বাস দেয়া হয়। মাতবররা প্রস্তাব অনুযায়ী তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ত্যাগ করতে রাজি না হওয়াতে গ্রামের সমস্ত গরু তাদের দিয়ে দিতে বলে। এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলে পাকবাহিনীর আগমন তারা ঠেকাবে বলে আশ্বাস দেয়। কিন্তু এবারেও গ্রামবাসী অসম্মতি জানালে শুরু হয় হুমকি, শাসানি ও চোখরাঙানি। দালালরা ব্যাপারটা সাথে সাথেই গোচরীভূত করে পাকবাহিনীকে। এরপর থেকে হিন্দুপ্রধান এলাকা নরিয়াবাসী হয়ে গেল দেশদ্রোহী, পরিণত হলো ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রুতে। আর সেই শত্রুদের খতম করে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে এল দুনিয়ার জঘন্যতম গণহত্যার নায়ক পাক জল্লাদ বাহিনীর একটি গ্রুপ। ৭ জনের এই পাকসেনাদলের সাথে আরো অনেক দালাল।
৫ মে দুপুর দুটোয় পাকবাহিনীর আগমন সংবাদে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গ্রামবাসী পালিয়ে যায়। কিন্তু দালালরা জীবনের নিশ্চয়তা দিয়ে তাঁদের আবার গ্রামে ফিরিয়ে আনে। সবাইকে তারা জড়ো করে কামিনী দেবের বাড়িতে। বাড়ির সামনে গ্রামবাসীদের সবাইকে একটি সারিতে দাঁড় করানো হয়। তাদের সামনে-পেছনে সশস্ত্র পাকসেনা। এই অবস্থায় তাদের দলপতির মুখ থেকে বেরোল একটি মাত্র শব্দ, ‘ফায়ার’। সাথে সাথে গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র। লুটিয়ে পড়ল ২৬ জন নিরীহ নিরপরাধ গ্রামবাসী। বাদবাকি মানুষজন পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করল।
কিন্তু ঘটনার শেষ এখানেই নয়। দালালদের দাবি অনুযায়ী গরু নিতে এবার আর কেউ বাধা দিতে এল না। নিয়ে গেল তারা গ্রামের প্রায় দু’শ গরু। গোলা উজাড় করে নিয়ে গেল কমপক্ষে পাঁচ হাজার মণ ধান। লুট করল গ্রামবাসীর সোনা-দানা-টাকা-পয়সা ও আসবাবপত্র। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে শুরু হয়েছিল পুরোদমে প্রতিযোগিতা। ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ দালালরা এক্ষেত্রে এতটুকু শৈথিল্য প্রদশন করেনি। নারী হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি পশুরা।
যুবতী মেয়েদের ওপর চালায় পাশবিক অত্যাচার। অবশেষে সারা গ্রামে লাগিয়ে দেয় আগুন। মুহূর্ত কয়েকের মধ্যেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় নারিয়া। জীবিতরা হাওর অতিক্রম করে চলে গেলেন সামনের দিকে। আশ্রয় নিলেন গৃহহীন হয়ে দূর-দূরান্তের নিরাপদ আশ্রয়ে, কেউবা খোলা আকাশের নিচে, ঝোপঝাড়ে কিংবা গাছপালার ছায়ায়। মৃতের সৎকার করার মতো লোকও থাকল না গ্রামে।
গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্ৰ আর ছিন্নভিন্ন লাশগুলোকে ঘটনাস্থলেই গর্ত খুঁড়ে দিল মাটিচাপা।
কঙ্কালে কঙ্কালে ভরে উঠল কামিনী দেবের প্রাঙ্গণ। স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা নারিয়া গিয়ে মাটি খুঁড়ে কঙ্কালগুলো তুলে নিয়ে আসে মৌলভীবাজারে। নিহতের সংখ্যা নিরূপণের পর কঙ্কালগুলো ভাসিয়ে দেয়া হলো মনু নদীর অথৈ জলে। আর বধ্যভূমি ও গণকবরটি ধীরে ধীরে পরিণত হয় ফসলের মাঠে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত