You dont have javascript enabled! Please enable it!

দাসের বাজার বধ্যভূমি, মৌলভীবাজার

বড়লেখা থানার দাসের বাজার বধ্যভূমিতে ‘৭১-এর হানাদারদের হাতে প্রাণ হারান এ অঞ্চলের কয়েকজন বাঙালি। দাসের বাজারে খানসেনারা আসে মে মাসের মধ্যভাগে। বিশ্বাসঘাতক বাঙালি দালালরা পশ্চিমা প্রভুদের পা চাটতে জড়ো হয় তাদের সঙ্গে। শুরু হয় নৃশংস বর্বরতা। নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র তাণ্ডব। নারী, শিশু কেউ ছিলেন না এ লোমহর্ষক নির্যাতন থেকে মুক্ত, নিরাপদ। জেনেভা কনভেনশনের নীতি পদদলিত হয় সেদিন বাংলার এক নিভৃত পল্লী দাসের বাজারে।
খানসেনারা গ্রামে ঢুকে বেছে বেছে হিন্দুদের গ্রামে চলল নারকীয় উল্লাস। হাতের কাছেই যাকে পেল নিয়ে আসা হলো দাসের বাজার বধ্যভূমিতে। নারীদের টেনেহিঁচড়ে লাঞ্ছিত করে জানোয়ার খানসেনারা। ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে থাকেন মানুষ। প্রাণ রক্ষার জন্য মানুষের সে কি কষ্ট!
দাসের বাজার বধ্যভূমিতে যারা নিহত হয়েছিলেন প্রায় সবাই অতর্কিত আক্রমণ বুঝে ওঠার আগেই প্রাণ হারান। বাজারে যখন চলছিল তাণ্ডব, দূর- দূরান্তের হিন্দু গ্রামের মানুষ পালাতে থাকেন বাস্তুভিটা ছেড়ে। নির্যাতন, লুণ্ঠন, হত্যা, নারী ধর্ষণ চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে খানসেনারা সন্ত্রস্ত করে তোলে নিরীহ মানুষকে।
দাসের বাজার পাকিস্তানি হানাদারদের বাঙালি হত্যার এক বেদনামাখা স্মৃতিচিহ্ন বাজারসংলগ্ন মসজিদের পাশেই এ বধ্যভূমিটির অবস্থান।
মে মাসে যখন দাসের বাজার এলাকায় হানাদাররা তাণ্ডব চালায় তখন মানুষকে সাহায্য করতেন ন্যাপকর্মী কুনু মিয়া। শরণার্থী শিবিরে ঝাঁক ঝাঁক মানুষ সীমান্ত গলিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিলেন ভারতে। প্রাণভয়ে ভারতে পলায়নরত এলাকার কিছু মানুষকে পৌঁছে দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসেন তিনি। আরো কিছু বিপদাপন্ন মানুষকে সাহায্য করার বাসনা নিয়ে ফিরে আসছিলেন এলাকায়। কিন্তু পথিমধ্যে তাকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে নিয়ে যায় দাসের বাজার বধ্যভূমিতে। পশুরা গুলি চালায় এ দেশ প্রেমিকের বুকে, নেতিয়ে পড়েন এ সোনার সন্তান দাসের বাজার বধ্যভূমিতে। কুনু মিয়াকে হত্যার পর উন্মত্ত পশুরা ছোটে তালুকদার পাড়ায় ধরে নিয়ে আসে গোপেন্দ্রনাথ ও প্রজেস নাথকে। পাকিস্তানিদের আক্রোশ ছিল ‘মালাউনদের’ প্রতি। উপরন্তু বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দুজনের রক্তে দাসের বাজার বধ্যভূমিস্নাত হয় আর একবার।
দক্ষিণ লঘাটি গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী জহরলাল দাস ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। দাসের বাজার বধ্যভূমির অদূরে তার বাড়ি। তিনি খানসেনাদের হাতে ধরা পড়ে যান। তাকেও নিয়ে আসা হয় দাসের বাজার বধ্যভূমিতে। হানাদারদের বুলেটে নিথর হয়ে পড়ে তারুণ্যে টগবগ জহরলালের দেহ। এখানেই মাটিচাপা দেয়া হয় তাকে।
হাকাললি দ্বিতীয়ারদেহী গ্রামের বৃন্দাবন দাসের পুত্র নগেন্দ্র কুমার দাসকে খানসেনারা একই দিন নিয়ে আসে এ বধ্যভূমিতে। লঘাটি গ্রামের রণধীর কুমার দাস হাল চাষ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ধরা পড়েন খানসেনাদের হাতে। উলঙ্গ করে গামছা দিয়ে চোখ বাঁধা হয় নগেন্দ্র দাসের। তারপর চোখ বাঁধা অবস্থায় ব্রাশফায়ারে প্রাণদণ্ড হয় নগেন্দ্রের। বস্ত্রহীন অবস্থায় রণধীরকে ছেড়ে দেয় পশুরা। এর মধ্যেই তারা লাভ করে বিকৃত আনন্দ। এছাড়া আরো কেউ কেউ এখানে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এমন ধারণা পোষণ করেন অনেকেই।
[৩৯৪] মোস্তফা সেলিম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!