You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.26 | তেলিগাতি ও আঠারোগাতি গণহত্যা | বাগেরহাট - সংগ্রামের নোটবুক

তেলিগাতি ও আঠারোগাতি গণহত্যা, বাগেরহাট

১৯৭১ সালে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থানার তেলিগাতি গ্রামটি ছিল আওয়ামী লীগের একটি শক্ত ঘাঁটি। হানাদার বাহিনী একাধিকবার এই ঘাঁটিকে আক্রমণ করে- যার মধ্যে ২৬ মে এবং ৭ আগস্ট তারিখের আক্রমণ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে ২৬ মে তারিখের আক্রমণের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী তেলিগাতি এলাকায় একটি হৃদয়বিদায়ক গণহত্যার ঘটনা ঘটায়।
১৯৭১ সালের ২৬ মে বুধবার ১১ জ্যৈষ্ঠ পিরোজপুরে অবস্থানরত পাকবাহিনী তেলিগাতি ক্যাম্প আক্রমণ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা আত্মরক্ষার জন্য ক্যাম্প ছেড়ে এসে পার্শ্ববর্তী চাপড়ি গ্রামের হালদার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। পাকবাহিনীর ব্যাপক গোলাগুলির মুখে সেখান থেকেও পিছু হটে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যত্র চলে যেতে হয়। ছলেমান বাহিনী চলে যাওয়ার পরপরই পাকবাহিনীর সদস্যরা বাড়িটি ঘেরাও করে। বাড়িটিতে যারা বসবাস করতেন, অন্যান্য বাড়ির লোকজনদের মতো তাঁরাও তখন দরজা-জানালা আটকে ভেতরে শুয়ে ছিলেন। এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর সদস্যরা দরজা দিয়ে বানানো ঘরের বেড়া ভেঙে ঢুকে পড়ে এবং ঐ ঘরের মধ্যে অবস্থানরত আমির আলী হালদারের চার পুত্র রফিজ উদ্দিন হালদার, সইজদ্দি হালদার, মোক্তার উদ্দিন হালদার ও হাচেন আলী হালদার এবং আমির আলী হালদারের পৌত্র ও রফিজউদ্দিন হালদারের পুত্র সাহাব উদ্দিন হালদার এবং মোক্তার উদ্দিন হালদারের পুত্র শাহাদাৎ হালদারকে ঘর টেনে বের করে গুলি করে মারে। একই সময়ে পাকবাহিনীর আর একটি গ্রুপ তেলিগাতি গ্রামভুক্ত পার্শ্ববর্তী বাড়িতে গিয়ে সে বাড়ির আবদুল লতিফ খান, খোরশেদ সরদার এবং মোবারেক শেখকে গুলি করে হত্যা করে।
রফিজউদ্দিন হালদারের স্ত্রী এবং সাহাব উদ্দিন হালদারের মা জোবেদা খাতুন গোলাগুলি শুরু হওয়ার আগেই পুকুরের পাড়ে একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন। ফিরে যাওয়ার সময়ে পাকবাহিনী তাঁকে দেখতে পেয়ে গুলি করে। একটি গুলি তাঁর ডান হাতে লাগে। আর একটি গুলি তাঁর পিঠের চামড়া কেটে বের হয়ে যায়। তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, পাকবাহিনীর কমান্ডার তার সেপাইকে বলছিল, বড় ঘরের বেটিকে আরো একটা গুলি দাও।’ তৃতীয় গুলিটি জোবেদা খাতুনের ডান পায়ে লাগে। এক সাক্ষাৎকারে জোবেদা খাতুন জানিয়েছেন, তিনটি গুলির আঘাত নিয়ে তিনি যখন তাঁর শরীরটাকে টানতে টানতে কোনোমতে উঠোনের প্রান্তে এনে ফেলেছেন, তখন তিনি আরো কঠিন এক আঘাতের মুখোমুখি হন, সে আঘাত পৃথিবীর যে কোনো গুলির আঘাতের চেয়ে মারাত্মক। প্রথমেই তিনি স্বামীর মৃতদেহটি দেখতে পান এবং পরক্ষণে তাঁর চোখে পড়ে সেই মৃতদেহকে জড়িয়ে ধরে আছে আর একটি মৃতদেহ, সেটি তাঁর ১৭-১৮ বছরের পুত্রসন্তান সাহাবের।
পাকবাহিনী ঐদিন পিরোজপুরে ফিরে যাবার পথে পার্শ্ববর্তী কচুয়া থানার আঠারোগাতি গ্রামে আর একটি গণহত্যার ঘটনা ঘটায়। সেখানে ইসমাইল শেখ এবং ইউসুফ শেখ নামের দুই ব্যক্তিকে ধরার পর তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁরা তাঁদের গ্রামের নাম তেলিগাঁতি বলামাত্রই পাকবাহিনী তাঁদের হত্যা করে। ঐ গ্রামের সুবাস বসু, নিরঞ্জন মিত্র এবং বড় মশাইকেও তারা সে সময়ে হত্যা করে পিরোজপুরে চলে যায়। এই হত্যাকাণ্ডের সময়ে পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল রাজাকার হাশেম আলী দিদার ও মোসলেম আলী খান।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত