You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.22 | ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি | নেত্রকোনা - সংগ্রামের নোটবুক

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

নেত্রকোনা-পূর্বধলা সড়কের মাঝামাঝি ত্রিমোহনীর অবস্থান। ব্রিটিশ শাসনামলে এখানে মগড়া নদীর ওপর পাকা সেতু নির্মিত হয়। একাত্তরে বর্বর পাকবাহিনী এ সেতুটিকেই হত্যাযজ্ঞের নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসই ত্রিমোহনী ছিল পাকবাহিনীর জল্লাদখানা। স্রেফ সন্দেহবশত নিরীহ বাঙালিদের ধরে এখানে এনে হত্যা করা হতো। রাত গভীর হলেই সেখানকার বাতাস ভারি হয়ে উঠত যন্ত্রণাকাতর মানুষের আর্তনাদে। গুলির শব্দে ঘুম ভাঙত আশপাশের মানুষের। কারও বুঝতে বাকি থাকত না তখন কী হচ্ছিল সেখানে। ত্রিমোহনীতে সবচেয়ে মর্মবিদারী ঘটনা ঘটে ‘৭১-এর ২২ সেপ্টেম্বর। বর্বর পাকবাহিনী সেদিন ২৫ জন নিরীহ বাঙালিকে একযোগে গুলি করে হত্যা করে। ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যান প্রফুল্ল সরকার নামে একজন। ত্রিমোহনী ট্র্যাজেডির সেই প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে আমরা জানতে পারি সেই সকরুণ ইতিহাস।
জল্লাদখানা থেকে ফিরে আসা প্রফুল্ল সরকার তখন ২০ বছরের যুবক। ‘৭১- এর ২৭ এপ্রিল নেত্রকোনা শহরের শিবগঞ্জ রোড থেকে একদল রাজাকার তাকে বিনা কারণে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। থানা থেকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট তাকে জেলহাজতে পাঠান। তাঁর মতো আরও ২৬ জনকে জেল হাজতে পাঠানো হয় এভাবে। কিন্তু কেউই জানতেন না তাদের কী অপরাধ। দীর্ঘদিন হাজতবাসের পর দু-চারজন জামিনে মুক্তি পেলেও অনেকে জামিন পাননি। এ অবস্থায় ২২ সেপ্টেম্বর ওই ২৬ জনকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। যথারীতি হাজির হন সকলেই। আদালত সকলকে নির্দোষ উল্লেখ করে বেকসুর খালাস দেন। কিন্তু আদালত থেকে মুক্তি পেলেও বর্বর পাকসেনাদের হিংস্র থাবা থেকে মুক্তি পাননি কেউ। কিছুক্ষণ কোর্ট হাজতে অবরুদ্ধ রাখার পর সকলকে নিয়ে যাওয়া হয় কাছের একটি রেস্ট হাউসে। সেখানে এক আর্মি অফিসার তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে বলে। দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় সকলকে। এরপর মিলিটারি ট্রাকে উঠিয়ে তাদের নেয়া হয় ত্রিমোহনী ব্রিজে। রাত ৮টার দিকে গর্জে ওঠে পাকসেনাদের রাইফেল। শুরু হয় একের পর এক গুলিবর্ষণ। নিমিষেই শহীদ হন ২৫ নিরীহ বাঙালি। তাঁদের নাম: সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা রায়, কামিনী কুমার চক্রবর্তী, নিশিকান্ত সরকার, সুরেন্দ্র চন্দ্র দে, কমল চন্দ্র সাহা, সুনীল চন্দ্র সাহা, সতীশ চন্দ্র সরকার, দুর্গানাথ চক্রবর্তী, ব্রজেন্দ্র চন্দ্র সরকার, মতিলাল সাহা (১) মতিলাল সাহা (২) পীযূষ কান্তি সাহা, দীপক কুমার সাহা, দিলীপ কুমার পাল, সন্তোষ চন্দ্র পাল (১) সন্তোষ চন্দ্ৰ পাল (২) রমেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, অজিত কুমার সাহা, সতীশ চন্দ্র সাহা, বিনয়ভূষণ সরকার ও দীনেশ চন্দ্র সরকার।
ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যান প্রফুল্ল সরকার। পাকসেনারা যখন তাঁদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি চালান, তখন তিনি গুলিবিদ্ধ মানুষের মতো ভান করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হত্যাযজ্ঞ শেষ করে শত্রুরা এক সময় প্রত্যেকের লাশের সঙ্গে প্রফুল্ল সরকারকেও মগড়া নদীতে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ পর চলে যায় পাকসেনারা। সারা রাত হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নদীর পানিতে হাবুডুবু খেয়ে অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যান তিনি। সেই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে প্রফুল্ল সরকার বলেন, “২৫ জন শহীদের বুকের তাজা রক্তে সেদিন মগড়ার পানি লাল হয়ে ওঠে। এরপর স্রোতের তোড়ে লাশগুলো একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়।” খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় আলবদর ও রাজাকারদের সরাসরি সহযোগিতায় চলে এসব হত্যাকাণ্ড।
[৩৪৩] সঞ্জয় সরকার

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত