You dont have javascript enabled! Please enable it!

দাকোপ থানা গণহত্যা ও নির্যাতন কেন্দ্র, খুলনা

খুলনার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবনসংলগ্ন দাকোপ থানা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা। পশুর ও শিবসা নদী পরিবেষ্টিত এই থানার মধ্য দিয়ে অসংখ্য ছোট-বড় খাল জালের মতো বিস্তৃত। ফলে এলাকার মানুষ খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। পশুর ও শিবসা নদী হয়ে এ এলাকার মানুষের ভারতের গমনাগমন সহজ ছিল। নৌযানই ছিল এলাকার মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। ফলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ পাকসেনা ও তার এদেশীয় সহযোগীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সহজে এলাকা থেকে বেরুতে পারেনি। এলাকায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়া এ সকল মানুষ চরমভাবে নির্যাতিত হয়। এখানকার রাজাকাররা চালনা খালের উত্তর তীরের চৌকিদার বাড়ি, দক্ষিণ তীরর পঞ্চানন বিশ্বাসের বাড়িসহ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। রাজাকাররা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ধরে এনে চালনা বাজারের বউমার গাছতলা নামক স্থানে প্রায়ই হত্যা করত। এ সকল হত্যাকাণ্ডের প্রধান সহযোগী ছিল চালনা মসজিদের ইমাম। ২২ এপ্রিল চালনা বাজারে পাকসেনারা হালা চালায়। এ দিন চালনা বাজারে সাপ্তাহিক হাটের কারণে শত শত মানুষ উপস্থিত হলে বেলা ১২টার দিকে মংলা থেকে পাকসেনারা শাহবাজ নামক পোর্ট কর্তৃপক্ষের একটি লঞ্চে এসে হাটুরে মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং গ্রামে প্রবেশ করে হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করে ফিরে যায়। এতে শতাধিক হাটরে হতাহত হয়।
এ থানায় স্থানীয় সংখালঘুদের হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি ভারতের উদ্দেশ্যে বাগেরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন স্থানে যাত্রাবিরতিকালে হত্যা করা হয়। এ সকল হত্যাকাণ্ডের মধ্যে চালনা বাজার, সাহেববেরাবাদের ত্রিমোহনা ও বাজুয়া স্কুলের উল্লেখযোগ্য। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
পশুর নদীর তীরে এ থানার বাজুয়া গ্রাম এবং চুনকড়ি ও ভদ্রা নদীর সংযোগ পয়েন্ট ত্রিমাহনায় সাহেবেরাবাদ অবস্থিত। এ ত্রিমোহনা হয়ে খুলনার পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের মানুষের ভারত গমনাগমন সহজ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধারাও এ পথে ভারতে গমনাগমন করত। তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকার ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা এ পথের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এ অবস্থায় খুলনার দক্ষিণ-পূর্বঞ্চলসহ বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা শুরু হলে এ সকল এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মাতৃভূমি ত্যাগ করে চলে আসতে থাকে। ২৩ এপ্রিল এ রকম একটি সংখ্যালঘু দল সাহেবেরাবাদে যাত্রাবিরতি করলে স্থানীয় মুলিম লীগ নেতা ও পিস কমিটির চেয়ারম্যান নূর আলী সানা পাকসেনাদের খবর দিয়ে এদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এতে তিন হাজার মানুষ নিহত হয়। এ ছাড়া মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ থানার বাজুয়ায় যাত্রাবিরতিকালে বাগেরহাটের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আর একটি দল স্থানীয় পিস কমিটির চেয়ারম্যান লাল মিয়া ওরফে লালু বাদিয়ার হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। লালু বাদিয়ার তাদের এখানে নিরাপদে থাকার ও পরের দিন লঞ্চযোগে ভারতে পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দেয়। পরের দিন সকালে বাজুয়া ঘাটে একটি লঞ্চ এসে থামলে উক্ত ভারতগামীরা লঞ্চে ওঠার জন্য এগিয়ে যায়। এ সময় লঞ্চে অবস্থানরত রাজাকাররা তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এ আক্রমণে প্রায় তিনশত নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হয়। এছাড়া এ থানায় বিভিন্ন গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষকে হত্যা করে তাদের বাড়িতে লুটতরাজ করা হয়।
এ থানায় বধ্যভূমির মধ্যে পানখালি খেয়াঘাট উল্লেখযোগ্য। চালনা ইউনিয়নের ঝবঝবে নদীতে এ খেয়াঘাটটি অবস্থিত। চালনার তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদে ১৯৭১ সালে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হলে এ ঘাটটিকে তারা বধ্যভূমিতে পরিণত করে। পানখালির আতিয়ার রহমান মোল্লার নেতৃত্বাধীন এ ক্যাম্পের ১২০ জন রাজাকার এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা আশপাশের গ্রামসমূহে একের পর এক লুটপাট করতে থাকে। ঘাটের যাত্রী ও এলাকার নিরীহ মানুষ ধরে এনে নির্যাতন করে এবং রাতে এ ঘাটে তাদেরকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এখানে বাগেরহাট জেলার দুজন অধ্যাপককে গুলি করে হত্যা করে বলে জানা যায়। অবশ্য রাজাকার কমান্ডার আতিয়ার রহমান মোল্লা এ সকল হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করে। তার দাবি অনুযায়ী তারা নকশালদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সবুর খান ও মওলানা ইউসুফের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে নিজেদের ও এলাকাবাসীর জানমাল রক্ষা করেছে। তবে প্রশিক্ষণের সময় পাকিস্তান রক্ষার জন্য কোরান শপথ করানো হয় বলে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে শান্তি বজায় রাখতে তারা প্রস্তুত ছিল বলে সে জানায়। এ দায়িত্ব পালন করতে যেয়েই আতিয়ার রহমান মোল্লার নেতৃত্বাধীন রাজাকাররা এ এলাকায় নভেম্বর মাস পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। তাদের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে এ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে মানুষ আত্মগোপন করে বেঁচে থাকে। থাচাড়া দাকোপ থানার শক্তিশালী রাজাকার ক্যাম্প হিসেবে এর সদস্যরা চালনা, বাজুয়া, সাহেবেরাবাদের স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর নির্যাতনের দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
[৯২] মোল্লা আমীর হোসেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!