দাগারকুটির গণহত্যা, কুড়িগ্রাম
কুড়িগ্রামের ধরলা তীরের গ্রাম দাগারকুটির। বাংলাদেশের আরো দশটি বা শতটি গ্রামের মতোই একটি জনপদ। বর্ষায় দু কূল ছাপিয়ে যাওয়া ধরলা তীরের জনগণও ধরলার মতো সংগ্রামী ও সাহসী। হয়তো ব্রহ্মপুত্র এবং ধরলার উত্তাল ঢেউ থেকেই তারা শিক্ষা নিয়েছেন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার। শিখেছেন স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে। যে যেভাবে পারেন সংগঠিত হন মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালি পুলিশ, আনসার, মুজাহিদদের সাথে নিরস্ত্র অবস্থায়ও এ অঞ্চলের কোনো কোনো ছাত্র-যুবক প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হালকা কিছু অস্ত্র নিয়ে আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ইপিআররা যেভাবে সাত দিন পর্যন্ত পাকিস্তানিদের ঠেকিয়ে রেখেছিল। আকাশ ফাটা গর্জন আগ্নেয়াস্ত্রের। বিশাল এলাকাজুড়ে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। ভস্মীভূত হচ্ছে বাড়িঘর, গাছপালা, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সবই। চিৎকার ওঠে গগনবিদারী। নারী-শিশু-বৃদ্ধদের আহাজারি আর্তনাদে। ছুটে চলছে গ্রামবাসী দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে। কিন্তু পালাতে পারছে না কেউই। উর্দি পরা আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত হাজারো পাকসেনা। ঘেরাও করে আছে গ্রাম। তাদের কোনো কোনো সদস্য এবং বশংবদ রাজাকাররা একটির পর একটি বাড়িতে ছড়িয়ে দিচ্ছে আগুনের লেলিহান শিখা। বাড়িঘর, হাট-বাজারের সাথে সাথে পুড়ছে মানুষ এবং অন্যান্য জীবজন্তু। আর আগুনে পুড়ে মরা থেকে রেহাই পেতে যারাই পালাবার চেষ্টা করেছে তারাই বন্দি হয়েছে পাকিস্তানি মানুষরূপী পশুদের হাতে। যাকে ধরতে পারেনি তার বুকে বা পিঠে বিদ্ধ করে দিয়েছে পেন্টাগনের তৈরি এক একটি বুলেট। এভাবে কত লোক সেদিন পুড়ে মরেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আজতক অজানা। জানা যায়নি পলায়নপর অবস্থায় প্রাণ দিয়েছেন কত বঙ্গসন্তান। আর কতজনই-বা ধরা পড়েছিলেন।
দীর্ঘ অপারেশনের পরে ধৃত বাঙালির সংখ্যা দাঁড়ায় হাজারের মতো। তাদের সবাইকে নিয়ে যায় অনন্তপুর বাজারের পূর্ব দিকে একেবারে দাগারকুটি গ্রামে। এরপরেই ধরলা নদী। তীরবর্তী একটি ডোবামতো স্থানকেই নির্বাচন করে তারা বধ্যভূমি হিসেবে। শত শত বাঙালিকে দাঁড় করায় একটি সুশৃঙ্খল সারিতে। একেবারে যেন সামরিক বাহিনী। বারবার পরখ করছিল হায়েনাপ্রধান। যেন সূচ্যগ্র পরিমাণও বাঁক না থাকে কোথাও। গ্রামের অনভিজ্ঞ অশিক্ষিত নিরীহ মানুষজন তখনও বুঝতে পারেননি কী ঘটছে বা কী ঘটাতে যাচ্ছে। শুধুই হুকুম তালিম করে চলছে তারা। নিখুঁত সোজা হলো মানুষের সারি। গর্জে উঠল মানুষখেকো দানবগুলোর হাতের আগ্নেয়াস্ত্র। দ্রাম-দ্রাম, গুড়ুম গুড়ুম, টেরেং টেরেং। এই কয়েক সেকেন্ড মাত্র। তারপর সবই নীরব-নিথর। ফিনকি দিয়ে ছুটল শোণিত ধারা। সৃষ্টি করল স্রোত। প্রায় শুকনো ডোবাটি রক্তে ভরে টইটম্বুর হয়ে গেল দেখতে দেখতে। এক সময় সে স্রোতও মিশে একাকার হলো ধরলার অগাধ জলে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে তখন হায়েনাগুলো। তার সাথে যুক্ত হলো বাংলার কুলাঙ্গার রাজাকাররা। কোলাকুলি করে রাজাকার আর পাক হায়েনার দল। ঢুকে পড়ে আশপাশের ঝোপঝাড়ে, দূর-দূরান্তের গ্রামে গ্রামে। যেখানে নিজকে রক্ষার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলার মা-বোনেরা। ঝাঁপিয়ে পড়ে পশুগুলো তাদের ওপর। চরিতার্থ করে তারা পাশবিক লালসা। সেখানেও ভাগাভাগি করেছে ইসলামের হেফাজতকারী পাকিস্তানি মিলিটারি এবং মুখে ইসলামের বুলি নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়কারী দল জামায়াত গঠিত রাজাকাররা।
দাগারকুটি থেকে এক সময় চলে যায় পাকসেনারা। তারও বেশ পরে আশপাশের কিছু কিছু লোক বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন বধ্যভূমির দিকে। খুঁজতে থাকেন প্রিজনের মুখ। দাগারকুটিতে তখন লাশের পাহাড়। শবদেহের ওপর শবদেহ। অনেকের লাশ সেদিন তুলে নিয়ে দাফন করেছেন প্রিয়জনরা। কিছু কিছু তো ভেসে গেছে ধরলার জলে। আর অধিকাংশ মৃতদেহকে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল ডোবার ভেতর। কিছু কিছু লোক গুলিবিদ্ধ হয়েও মরার ভান করে পড়ে থাকেন লাশের স্তূপের ভেতর। পরে উদ্ধার করা হয়েছিল এদের। সেখানে প্রাণ দিয়েছেন ৬৯৭ জন গ্রামবাসী। হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের দফাদার বা গ্রাম পুলিশ জয়নাল আবেদীন জানিয়েছিলেন শহীদের সংখ্যা ৬৫৭। বেসরকারি সংস্থা প্রশিকা কর্তৃক সংগৃহীত তালিকায় রয়েছে ৬৯৭ জন শহীদের নাম।
[৪৭] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত