You dont have javascript enabled! Please enable it!

তাজ সিনেমা হল গণকবর ও পাঠশালা স্কুল বধ্যভূমি, নওগাঁ

নওগাঁ বৃহত্তর রাজশাহী জেলার একটি মহকুমা। যমুনা নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই নওগাঁ শহর। শহর নওগাঁ একাত্তরে পরিণত হয় লাশের শহরে। গণকবর আর বধ্যভূমিতে সয়লাব হয়ে যায় নওগাঁ শহর। ‘পূর্বদেশ” প্রতিনিধি ১৯৭২ সালেই এ বিষয়ে কথা বলেছেন:
….যে কেউ নওগাঁ শহরে ঢুকলেই দেখতে পাবেন, শহরের মধ্যবর্তী যমুনা নদীর ওপর নির্মিত পুরনো অথচ অতি সুন্দর সেতুটির পাশেই বিধ্বস্ত তাজ সিনেমা হলটি। এর দক্ষিণে দেখা যাবে অসংখ্য বাঙালির বিকৃত মৃতদেহ স্তূপাকৃতি অবস্থায় পড়ে আছে। গণহত্যার এত বড় নিদর্শন দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামেও ঘটেনি।
এরই আর মাত্র সামান্য দূরে একটি পুরনো পাকা কূপ। কূপটির তিন হাত নিচ থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল গলিত ও বিকৃত লাশ আর লাশই দেখা যাচ্ছে।
আর একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে দুটি বড় ঢেউটিনের ঘর। ঘরের ভেতর ঝুলে আছে বহু দড়ি। নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে জুতো, জামা, প্যান্ট ও অন্যান্য পোশাক পরিচ্ছদ। এক নজরেই মনে হবে, এগুলো এক বা একাধিক লোকের নয়। শত শত মানুষের ব্যবহৃত কাপড়। আর মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত এবং সে রক্তের বিস্তৃতি কূপ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়। কূপটির ভেতরে প্রথমেই যে মৃতদেহটি চোখে পড়ে তা উচ্চপদস্থ লোকের বলেই মনে হয়। এরই চারপাশে দেখা যায় বহু নিহত ব্যক্তির মাথা।
তাজ সিনেমার নিকটবর্তী পুরনো পশু হাসপাতালটি অতিক্রম করে উত্তর দিকে কিছু দূর গেলেই দেখা যাবে, বাঁয়ে ছোট একটি মসজিদ। তার পাশেই রয়েছে একটি দালানবাড়ি। বসবাস করত তথাকথিত কামিজ বিহারি ব্যবসায়ী। নাম ইদ্রিস। প্রতি বছর খাজা বাবার নামে তিন দিন ধরে এ বাড়িতে উৎসব চলত। কিন্তু তার বাসার ভেতর যেতেই যে কেউ চমকে উঠবেন। দেখতে পাবেন দুই ঘরের ভেতরে নির্মম হত্যার প্রমাণ চিহ্ন। একটি ঘরে অনেক দড়ি ঝুলে আছে। আর অপরটিতে রয়েছে অসংখ্য বাঙালির রক্তের ছাপ।
বিহারি ব্যবসায়ী খানসেনাদের সহযোগিতায় যেসব বাঙালিকে ধরে এনে জবাই করত, তাদের রক্তে তার অপবিত্র হস্ত রঞ্জিত করে, তা দিয়ে তার ঘরের দরজা জানালা রাঙিয়ে নিত। যেন আলতা দিয়ে সাজানো হয়েছে। এ নারকীয় দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। …. ইদ্রিসের বাড়ির ভেতর কাঁচা কূপটি মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে।
এখনো সে কূপের ভেতরে দড়ি দেখা যায়। কূপটিতে বহু অচেনা বাঙালির লাশ চাপা রয়েছে। আর এর পাশেই দেখা যায় প্রচুর রক্তের দাগ।
অপরদিকে আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস’ গ্রন্থে নওগাঁর বধ্যভূমি বিষয়ে বলা হয়েছে:
ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে যে বধ্যভূমিটি নওগাঁবাসী আবিষ্কার করেছিল, সেখানে কোনো পুরুষের লাশ পাওয়া যায়নি। এখানে শুধু ১৪ বছরসর থেকে ৩০- ৩৫ বছরের অগণিত মহিলার লাশ পাওয়া গেছে। পার নওগাঁর পাঠশালা স্কুলই ছিল এই বধ্যভূমি। এখানে একটা বড়সড় পানির কুয়ো ছিল। যুবতী বা মহিলাদের ধরে এনে কুয়োসংলগ্ন একটা ঘরে প্রথমে পর্যায়ক্রমে তাদের কয়েক দিন ধরে পাকবাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ করত। তারপর তাদের জবাই করে অথবা জীবন্ত অবস্থায় হাত-পা বেঁধে এই কুয়োর ভেতরে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হতো। ঠিক এই রকমেরই আরেকটি কুয়ো নওগাঁর পুরাতন জনতা ব্যাংকের পশ্চিম পাশে আবিষ্কার করা হয়েছিল। এছাড়া আরো কয়েকটি বধ্যভূমি পার নওগাঁয় আবিষ্কার করা হয়েছে। এসবের মধ্যে মরদুলা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের পূর্বদিকে রউফ মিয়ার বাগানে ও পার নওগাঁর ডাক্তার হাসান আলীর বাড়ির পূর্ব-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত পরিত্যক্ত জমিতে অজস্র লাশ পাওয়া গিয়েছিল। এখন অবশ্য ওইসব জায়গায় গড়ে উঠেছে জনবসতি।
[ ১৩৭] সুকুমার বিশ্বাস

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!