You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৬ই ডিসেম্বর, শুক্রবার, ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮১

বোয়েরমার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে

ঘাটতি দেশসমূহের এখন নিদারুণ দুঃসময় বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের থলি শূন্য। নিত্যদিনের অভাব মেটাতে প্রায় সব সরকারকেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। মিল কারখানা চালু রাখা, প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের আমদানি, সবার উপরে জনসাধারণের মুখে অন্ন তুলে দেবার জন্য পরদেশের উপর নির্ভরশীলতা। এসব কাটিয়ে উঠবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব। উন্নয়ন কার্যক্রম তাই শিকেই উঠেছে অনেক দেশে।
আমাদের দেশের পরিস্থিতি আরো জটিল স্বাধীনতাত্তোরকালে ছিল শুধু কিছু ধ্বংসাবশেষ। তার উপরে বিপুল খাদ্য ঘাটতি। খরা বন্যা অবস্থাকে আরো মারাত্মক করে তুলেছে। শ্বাস নেবার অবসরটুকু নেই। এ বছরের কথাই ধরা যাক। সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতি ধরা হয়েছিল সতের লক্ষ টন। বন্যায় নষ্ট হয়েছে আরও ১৩ লাখ টন। সবমিলিয়ে ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি এবার আমাদের টানতে হচ্ছে।
বিদেশ থেকে আমদানি করে ঘাটতি পূরণের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন। কিন্তু কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রপাতির অভাবে শিল্পোৎপাদনের মন্থর গতি, রপ্তানিযোগ্য কৃষি উৎপাদন হ্রাস বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হয়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিতে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়েছে। এমতাবস্থায় খাদ্য আমদানির জন্য যথার্থ অর্থ সরকারের কাছে গচ্ছিত না থাকবারই কথা।
অথচ খাদ্য সংকটেই এখন সবচেয়ে গুরুতর সংকট। এই সংকট উত্তরণে যেমন জনসাধারণ তেমনিই সরকার ও বিশেষভাবে চিন্তিত। বিভিন্ন দেশের নিকট থেকে অবশ্য ঋণ এবং সাহায্য হিসেবে কিছু খাদ্যশস্য পাওয়া গেছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই সামান্য। এখন সরকারের সামনে দুটো মাত্র পথ খোলা রয়েছে। একঃ আভ্যন্তরীণ সংগ্রহ বৃদ্ধি এবং খাদ্যশস্যের পাচার বন্ধ করা। দুইঃ বৈদেশিক সূত্র থেকে যত বেশি সম্ভব চাল-গম ক্রয়।
বাংলাদেশের এই খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থার’ ডিরেক্টর ডঃ আঁদ্রে হেন্ড্রিক বোয়েরমাও সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি থেকেই সম্পর্কে যে সকল তথ্য প্রকাশ করেছে তা তিনি আমাদের সংকটের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার সংস্থার তরফ থেকে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্যের আশ্বাস প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট খাদ্য মজুদ রয়েছে। আমরা তার বক্তব্যে আশান্বিত হয়েছি। আমাদের ঘাটতি মেটাতে তার সংস্থা বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমরা দৃঢ় আশা প্রকাশ করছি।
আভ্যন্তরীণ সংগ্রহ খুব বেশি সফল হবে বলে কেউ মনে করছেন না। এবার ফসল ভাল হলেও পরবর্তী আবাদ সম্পর্কে এখন থেকেই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় এবং ভাদ্র আশ্বিনে সাধারণতঃ খাদ্য সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। আভ্যন্তরীণ সংগ্রহ আশাপ্রদ না হলে সে সময়টায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠবে। সম্প্রতি পাওয়ার পাম্প এর ভাড়া বৃদ্ধি খাদ্য উৎপাদনের প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে বলে অনেকের ধারণা। এমতাবস্থায় খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের আবেদন তারা যেন ‘ফাণ্ড’ প্রধানের কাছে সঠিক চিত্র তুলে ধরে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হন। সরকারি যেসকল পরিসংখ্যান এর সঙ্গে আমরা পরিচিত তা নির্ভুল বা তথ্যনির্ভর -এমন প্রমাণ সকল ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। অন্যান্য আরো অনেক বিষয়ের মত আমাদের খাদ্যশস্যের চাহিদা, উৎপাদন এবং ঘাটতির পরিমাণ এর ব্যাপারে অস্পষ্টতা বরাবরই বিদ্যমান। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক এবং বাস্তব চিত্র সামনে রেখে ‘ফাণ্ড’ প্রধানের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন বলে আমরা আশা করি।

এবারও পিণ্ডির টালবাহানা

পাকিস্তানি আমলের সম্পদের বন্টন ও বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্থানীদের স্বদেশে ফেরত নেয়ার প্রশ্নে পাকিস্তান তার অনমনীয় মনোভাবের পরিবর্তন এখনও ঘটায়নি এবং এ সম্পর্কে সাম্প্রতিককালের আরেকটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে গেছে পাকিস্তানের অসহযোগিতার দরুন। উপমহাদেশের ৩টি দেশের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা-সহযোগিতা এবং সম্পত্তির উপর সংশ্লিষ্ট তিনটি দেশ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থায়ী শান্তি বহুলাংশে নির্ভরশীল; একথাটা কেন জানিনা পাকিস্তান সরকার পুরোপুরি বুঝে উঠতে চান না। বহু বিলম্বে হলেও বাস্তবতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পাক সরকার বাধ্য হয়েছিলেন এবং পর্যবেক্ষক মহল সেদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপারে পাক সরকারের চেতনার উন্মেষকে স্বাগত জানিয়ে আশাবাদী হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ পাকিস্তান দু’দেশের মধ্যকার বাকি সমস্যাবলীর সমাধান ঐ একই বাস্তবতার নিরিখে সম্পন্ন হয়ে যাবে।
কিন্তু না, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপারে কার দীর্ঘকালের গড়িমসির মত বর্তমানের সমস্যাগুলো সমাধানের প্রশ্নে সে ওই একই ধরনের তালবাহানার আশ্রয় নিয়েছে। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হলোঃ পাকিস্তান বাংলাদেশে অবস্থিত তার নাগরিকদের ফেরত নেয়ার প্রশ্নে প্রতিশ্রুত ও চুক্তিবদ্ধ। ১৯৭৪ সালের চৌঠা এপ্রিল নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত চুক্তির গুলোর অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, পাকিস্তান বাংলাদেশে অবস্থিত ঐ সমস্ত পাকিস্তানি যারা স্বেচ্ছায় আন্তর্জাতিক রেডক্রস এর মাধ্যমে স্বদেশে ফিরে যেতে চেয়েছে; তাদেরকে ফেরত নিতে হবে। চুক্তি সম্পাদনের পর বাংলাদেশে তার পক্ষ থেকে যথাযথভাবে চুক্তির শর্ত পালন করে এসেছে। পাকিস্তান কোন সময় অন্যায় যুক্তির আবার কোনো না কোনো সময়ে সম্পূর্ণ নীরব থেকে সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু যে বিপুল সংখ্যক জনতা স্বেচ্ছায় আপন দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী; পাক সরকার তাদের সে দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করবেন কী করে?
সম্পদ ভাগবাটোয়ারার প্রশ্নে পাকিস্তান যে অন্যায় আর অযৌক্তিক আবদার জানিয়ে আসছে সাম্প্রতিককালের খবরে তার সেই সীমাহীন অন্যায় আবদার থেকে তিলমাত্র বিচ্যুত হবার কোনো আভাস আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ভুট্টো সরকার কি জানেন না যে সাবেক পাকিস্তান আমলের প্রায় বৈদেশিক সাহায্যের সিংহভাগ তার দেশেই ব্যয় হয়েছে। তিনি কি জানেন না, তারবেলা গোলাম মোহাম্মদ বাঁধের মত বিরাট বিরাট প্রকল্পে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তার প্রায় সমুদয় অর্থই বৈদেশিক সাহায্য বা ঋণ থেকে নেয়া। তাহলে তার দেশে ব্যয়িত বৈদেশিক ঋণের ভাগীদার বাংলাদেশ হতে যাবে কোন যুক্তিতে? পাক সরকার তো জানেন যে, বাংলাদেশ সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ব্যয়কৃত অর্থের দায় গ্রহণ করেছেন এবং তাদের উপর সে দায়দায়িত্ব চাপাতে উদ্যোগী নয়, এর থেকে কি ভুট্টো সরকার বাস্তবতা আর যৌক্তিকতার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন না? ভুট্টা সরকার বেমালুম অস্বীকার করতে চান সাবেক পাকিস্তান আমলের গড়ে ওঠা সম্পদের বখরা বাংলাদেশকে দিতে হবে। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানকে তিলেতিলে শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করতে চান কোন যুক্তিতে? বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য সম্পদ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে হবে এবং সেটা উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থায়ী শান্তি, সম্প্রীতি আর সহযোগিতার প্রয়োজনে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি তৃতীয় দেশের মাধ্যমে একটা আপস মীমাংসার সম্ভাবনাকে পাকিস্তান সরকার এবারও বানচাল করে দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এ ব্যাপারে তার মূল নীতি অব্যাহত রেখেছে। অমীমাংসিত প্রশ্নের ব্যাপারে বাংলাদেশ তার মত বদলায়নি। সুতরাং আলোচনা হতে পারে না।’ এর থেকে অযৌক্তিক কথা আর কি হতে পারে? যারা স্বেচ্ছায় আপন দেশে ফিরে যেতে চায় সে বিদেশিদের ব্যাপারে বাংলাদেশ তার মত পাল্টাবে কিভাবে? একদল বিদেশীকে ধরে রাখার বা তাদের দায় দায়িত্ব গ্রহণের কোন যৌক্তিকতা যে নেই পাক সরকারকে তা ভালোভাবে বুঝতে হবে, বুঝতে হবে যাদের সম্পর্কে আলোচনা তারা বাংলাদেশের কেউ নয়- সম্পূর্ন মানবিক কারণকে সামনে রেখে সরকার এইসব পাকিস্তানিকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। আর সম্পদ ভাগবাটোয়ারার প্রশ্নেও আমাদের বক্তব্য ওই একই। ন্যায্য পাওনা কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দিতে হবে এবং সেই ন্যায় সঙ্গত পাওনার প্রশ্নের বদলা-বদলির কোন কথা উঠতে পারেনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!