You dont have javascript enabled! Please enable it!

ডাকরার গণহত্যা, বাগেরহাট

বাগেরহাটের রজ্জব আলী ফকিরের রাজাকার বাহিনী সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনাটি ঘটায় রামপাল থানার পেড়িখালী ইউনিয়নের ডাকরা গ্রামে। ১৯৭১ সালের ২১ মে শুক্রবার ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮ তারিখে পুরো ডাকরা গ্রামকে তারা বধ্যভূমি করে তুলেছিল। গুলি এবং জবাই করে তারা সেদিন দুই শতাধিক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক সে ঘটনা যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেদিনের কথা মনে করতে গিয়ে এখনো তাঁরা শিউরে ওঠেন।
ডাকরা গ্রামের কালীবাড়ি ছিল তখন ঐ অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় মিলন কেন্দ্র। বাদল চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন উক্ত কালীবাড়ির প্রধান পূজারি বা সেবায়েত। সাধক ও ধর্মগুরু হিসেবে তিনি সকলের নিকট অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন এবং সকলে তাঁকে ‘নোয়াকর্তা’ হিসেবে সম্বোধন করতেন। ১১ মে তারিখের পর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকে হিন্দুরা চলে যেতে শুরু করলেও নোয়াকর্তার বিশিষ্ট ভক্তগণ মিলে সিদ্ধান্ত নেন যে, মে মাসের ২২ তারিখ তাঁরা নোয়াকর্তাকে নিয়ে একসঙ্গে দল বেঁধে সুন্দরবন হয়ে নৌকাযোগে ভারতের দিকে রওনা হবেন। আলোচনা অনুযায়ী কয়েক দিন আগে থেকেই পার্শ্ববর্তী অনেকগুলো গ্রামের অসংখ্য হিন্দু পরিবার এসে ডাকরা কালীবাড়ির আশেপাশে মংলা নদী, মাদারতলী নদী ও কুমারখালী খালের তীরে নৌকা ভিড়িয়ে অবস্থান করছিল। নৌকার সংখ্যা ছিল শতাধিক। এদের মধ্যে সায়েড়া, খানপুর, বাঁশবাড়িয়া, সাড়েচারআনি, বেতকাটা, ভোজপাতিয়া, মহিষঘাটা প্রভৃতি গ্রামের লোকজন ছিলেন বেশি। সারাদিন গ্রামের মধ্যে কাটিয়ে রাতে তাঁরা নৌকার মধ্যে ঘুমোতে আসতেন। এভাবে ২১ তারিখের দিকে ডাকরা হয়ে ওঠে বড় একটা শরণার্থী শিবিরের মতো এবং ভারত গমনেচ্ছুদের জনসংখ্যা সেখানে তখন দু-হাজার ছাড়িয়ে যায়। ইমান আলী শেখ, জোনাব আলী শেখ, দেলোয়ার হোসেন প্রমুখের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ সাধারণ গ্রামবাসী অঞ্চলটিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের নিরাপদে অবস্থানের আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। মংলা নদীর অপর তীরে অবস্থিত বাঁশতলি গ্রামের পিস কমিটির সদস্য আফসারউদ্দিনের নিকট থেকে তাঁরা এই মর্মে কমবেশি নিশ্চয়তাও পেয়েছিলেন।
কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের এভাবে একত্র অবস্থানের বিষয়টি স্থানীয় লুটকারীদের লোভাতুর করে তোলে। পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে বিরোধী পক্ষ সত্তরের নির্বাচনের শোধ তোলার কথা ভাবতে থাকেন। পত্রের মাধ্যমে তাঁরা বাগেরহাটের রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলীকে খবর পাঠান
ঘটনার দিন বেলা একটার দিকে বড় দুটি ছিপ নৌকায় করে রজ্জব আলী তার বাহিনী নিয়ে ডাকরা অঞ্চলে প্রবেশ করেন। প্রতিটি নৌকায় ১৫-২০ জন সশস্ত্র রাজকার ছিল। প্রথম নৌকাটি মংলা নদীর উত্তর পাড়ে অবস্থিত কালীগঞ্জ বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিমে গিয়ে মাদারতলী নদীর মধ্যে ঢোকে এবং ডাকরা বাজারে এসে ভিড়ে। দ্বিতীয় নৌকাটি আড়াআড়িভাবে মংলা নদী পাড়ি দিয়ে কুমারখালী খালের গোড়ায় অবস্থান নেয়। প্রথমেই অনুসন্ধান করা হয় নদী ও খালের তীরে বাঁধা নৌকাগুলোর। নৌকায় অবস্থানরত পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রথম নৌকার রাজাকাররা পশ্চিম দিক থেকে এবং দ্বিতীয় নৌকার রাজাকাররা পূর্ব দিক থেকে ডাকরা গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করে। ভারত গমনেচ্ছু শত শত শরণার্থীতে ডাকরা গ্রাম তখন পরিপূর্ণ। রাজাকাররা ডানে-বাঁয়ে যাকে সামনে পায়, তাকেই গুলি করে হত্যা করতে থাকে। গুলির শব্দ শোনামাত্রই অধিকাংশ লোক তাদের গুরু নোয়াকর্তার নিকটে এসে হাজির হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত রাজাকাররাও দুই দিক থেকে এসে কালীবাড়িতে এসে থামে। পুরুষদের এবং মহিলাদের ভেতরে যায় এবং শাড়ি-পরা অবস্থায় কয়েকজন পুরুষকে পায়। বলির পশুর মতো তাদেরও হিড় হিড় করে টেনে আনা হয়। এভাবে মন্দিরের সামনের চত্বরে সবগুলো পুরুষকে একত্র করার পর একসঙ্গে অনেকগুলো রাইফেল গর্জে ওঠে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্রাণ হারায় একসঙ্গে শতাধিক ব্যক্তি। বৃদ্ধ আকিজউদ্দিন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মজিদ কসাইকে সঙ্গে নিয়ে মৃতদেহগুলো উলটে-পালটে দেখতে থাকে, অক্ষত বা আহত কাউকে পাওয়ামাত্রই তাদের জবাই করে মারা হয়। এছাড়া হিন্দু বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়ার জন্য স্থানীয় সহযোগীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
বেলা তিনটার দিকে এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার অবসান ঘটে। হিন্দু বাড়িগুলোতে দেয়া আগুনের লেলিহান শিখা কালো মেঘের মতো ধোঁয়ার সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। কয়েকজন তরুণীকে তুলে নেয়া হয় রজ্জব আলীর নৌকায়। পরবর্তী সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলা করার জন্য স্থানীয় কয়েকজন রাজাকারকে অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করে রজ্জব আলী গং বাগেরহাট ফিরে যায়।
কালীবাড়িতে কোনো মহিলাকে মারা না হলেও নৌকা ও রাস্তার পাশে এরা বেশ কয়েকজন মহিলাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। একজন প্রত্যক্ষদর্শী রাজাকার বাহিনী চলে যাওয়ার পর রাস্তার পাশে অনেকগুলো লাশের সঙ্গে একটি মহিলার লাশ দেখতে পান। ১০-১১ মাসের একটি বাচ্চা ঐ মৃত মহিলার স্তন পান করে যাচ্ছিল এবং শিশুটির সমস্ত শরীর এবং মুখমণ্ডলে রক্ত লাগানো ছিল। গুলির শব্দ শোনামাত্র ডাকরা গ্রামের দয়ানন্দ মণ্ডল দুটো ঘরের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন। হঠাৎ একটা গুলি এসে তাঁর উরুতে লাগে এবং তাঁর অণ্ডকোষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ অবস্থায় তিনি ইমান আলী শেখদের বাড়িতে ৬-৭ দিন কাটান এবং ভোজপাতিয়া গ্রামের ড. আবদুল মান্নানের চিকিৎসায় ভালো হয়ে ওঠেন।
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর ডাকরা গ্রামে যাঁরা জীবিত ছিলেন, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই এঁদের কিছু অংশ পার্শ্ববর্তী মুসলমান পাড়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন এবং কিছু অংশ এক মুহূর্ত দেরি না করে ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান।
পেড়িখালী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ নজরুল ইসলামের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, ঐদিন কমপক্ষে ৬৪৬ জন লোককে হত্যা করা হয়েছিল। পরের দিন ড. দেলোয়ার হোসেনের উদ্যোগে কয়েকজন তরুণ কালীবাড়ির চত্বরে নিহত লাশগুলোকে মাটিচাপা দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। স্থানটি বর্তমানে মংলা নদীর গর্ভে চলে গেছে। উক্ত তরুণদের হিসেব অনুযায়ী ডোবার মতো একটা গর্তে তাঁরা প্রায় দুই শত মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়েছিলেন। এছাড়া মংলা নদী, মাদারতলী নদী এবং কুমারখালী খালে অনেক মৃতদেহ ভেসে গিয়েছিল। তারপরেও অনেক লাশ এখানে-সেখানে পড়ে ছিল, যার কোনো সৎকার হয়নি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী গিলাতলা স্কুলের শিক্ষক পরিতোষ কুমার ব্যানার্জির ধারণা, মৃতের সংখ্যা ৬০০ থেকে ৭০০-এর মধ্যে। ঘটনার দিন তিনি সপরিবারে ডাকরা বাজারের কাছে মাদারতলী নদীর তীরে নৌকা ভিড়িয়েছিলেন, রজ্জব আলীর বাহিনী সেখানে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে কোনোক্রমে পালিয়ে নিকটবর্তী গাধাঘাটা গ্রামে ডাকাত হিসেবে খ্যাত এক মুসলমান যুবকের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরিতোষ কুমার ব্যানার্জি ঐ যুবককে দুর্বৃত্ত হিসেবে বর্ণনা করে লিখেছেন : “দুৰ্বৃত্তই বটে, না হলে কি আর নিজের জীবন বিপন্ন করে পাকিস্তানের শত্রু হিন্দুদের আশ্রয়-অভয় দেয়?” পরের দিনের ঘটনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন :
পরদিন ভোরে প্রিয়জনদের মৃতদেহগুলো দেখার উদগ্র বাসনায় ডাকরা গ্রামে যাই। রাইফেল ও বন্দুকধারীরা আমাদের গ্রামে ঢুকতে দিল তো না-ই, উলটে মেরে ফেলার হুমকি দিল। ফিরে গেলাম ডাকরা থেকে দুই মাইল দূরের হিন্দু গ্রামে। গ্রাম ফাঁকা। দু-একজন বুড়ো মানুষ ছাড়া কেউ নেই। অবশেষে এক প্রাক্তন মুসলমান ছাত্রের বাড়িতে গিয়ে থাকলাম। ডাকরা থেকে বেরিয়ে আসা স্ত্রীলোকদের কাছে শুনলাম যে, মেয়েদের হত্যা করা হয়নি। বারো-তেরো বছরের বেশি বয়সের পুরুষরাই ছিল হত্যাকারীদের লক্ষ্যবস্তু। ঐ ছাত্রটি জীবন বাজি ধরে ডাকরায় লুকিয়ে থাকা কয়েকটি বাড়ি থেকে পরিবারের মহিলা ও শিশু সদস্যদের নিয়ে এল। আশ্চর্য! তাদের চোখে জল নেই। আমাকে দেখে কেউ কাঁদল না। পরিবর্তে তাদের চাউনির ভেতরে ছিল প্রচণ্ড জ্বালা, অসহ্য উত্তাপ। বুঝলাম, ঘটনার নারকীয়তা ও ভয়াবহতা তাদের অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। প্ৰাণ আছে মন নেই, স্নায়ু আছে অনুভূতি নেই।
এদিন যাঁরা নিহত হয়েছিলেন তাঁদের একটা অংশ ছিল রামপাল, বাগেরহাট ও মোরেলগঞ্জের অধিবাসী। একটি অংশ ছিল বৃহত্তর বরিশাল জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আগত নোয়াকর্তার ভক্তবৃন্দ।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!