ছাতনী বধ্যভূমি, নাটোর
জেলা সদর ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে ছাতনী গ্রাম একটি বধ্যভূমির নাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় অবাঙালি হাফেজ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৩ জুন (১৯ জ্যৈষ্ঠ) ছাতনী গ্রামে নির্যাতন, বর্বরতা, হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল। জানা যায়, ছাতনী গ্রামের হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত। স্বাধীনতার সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করাই ছিল তাদের অপরাধ।
নাটোর-তাহিরপুর পাকা সড়কের পাশে ছাতনী সুইস গেট। ছাতনী, ভাবনী, ভাটপাড়া, আমহাটি, শিবপুর প্রভৃতি গ্রামের আড়াইশর বেশি আবালবৃদ্ধবনিতাকে পাকবাহিনী ও তার দোসররা ধরে এনে তাদেরই পরনের কাপড় ছিঁড়ে বেঁধে ঐদিন ভোর ৪টার দিকে ছাতনী সুইস গেটের নিকট একত্রিত করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। এখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। গুলির পরও যারা জীবিত ছিল, তাদের অবাঙালি হাফেজ আবদুর রহমান নিজ হাতে জবাই করে হত্যা করে। নরপিশাচদের হাত থেকে নারী ও শিশুরাও রক্ষা পাননি। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও নারী নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী ভাবনী গ্রামের অধিবাসীর থেকে জানা যায় হত্যাযজ্ঞ শুরুর পূর্ব মুহূর্তে মনিরুদ্দিন সরকার পাকসেনাদের বলেছিলেন, “আমাকে তোমরা খুন করো, তার বিনিময়ে আমার গ্রামবাসীদের ছেড়ে দাও।”
কিন্তু এ কথায় পিশাচদের মন টলেনি, নৃশংসভাবে তাকেও হত্যা করা হয়। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, “ ঐদিন ভোরে গুলির শব্দে তারা জেগে ওঠে। পাকহানাদার বাহিনী ও তার দোসররা সংখ্যায় ছিল আড়াইশর মতো। এর মধ্যে সামরিক পোশাকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছিল ৫০ জনের মতো পাকহানাদার বাহিনী। বাকিরা ছিল অবাঙালি। তাদের হাতে লম্বা লম্বা ছোরা ছিল। ভোর ৪টার দিকে ওরা গ্রাম ঘিরে ফেলে। ঘরে ঘরে ঢুকে সবাইকে বের করে পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে ছাতনী সুইস গেটের নিকট নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। সকাল পর্যন্ত চলে নির্বিচারে হত্যা ও নারী ধর্ষণের তাণ্ডবলীলা। রক্তে মাটি আর খালের পানি একাকার হয়ে পড়ে।” সেদিনের হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, “ছাতনী বধ্যভূমিতে রক্ত-মাংসের স্তূপ আর আহতদের চিৎকার আর স্বজন হারানোদের আহাজারি শুনে হাজারো জনতার দীপ্তকণ্ঠের মিছিল থেমে গেল। মৃত্যুর বিভীষিকা ক্ষণিকের জন্য তাদের বাকরুদ্ধ করে দেয়।”
[৪৪৩] স্বপন দাস
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত