You dont have javascript enabled! Please enable it!

জগন্নাথ হল গণহত্যা, ঢাকা

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিশেষভাবে জগন্নাথ হল ও তৎসন্নিহিত এলাকায় কী ঘটেছিল তা একটু আলোচনার প্রয়োজন। ২৫ মার্চ সারাদিন ছিল প্রতিবাদমুখর। একটা কিছু ঘটে যাবার আশঙ্কা অনেকেই করছিলেন। তবে ঘটনার বিশালত্ব এত বড় হবে এবং এত মারাত্মক হবে তা কেউই অনুমান করতে পারেনি। যারা অনুমান করেছিলেন তারা অনেক আগেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিত্যাগ করে বাড়ি চলে গেছেন। জগন্নাথ হলের ছাত্রদের অধিকাংশই গরিব, এদের উচ্চশিক্ষার ব্যয় নির্বাহ হয় টিউশনি করে। ফলে সে সময় বহু সংখ্যক ছাত্র জগন্নাথ হলে ছিল। সে দিন রাত বারোটার পর ইউ. ও টি. সি-এর দিকের দেয়াল ভেঙে পাকবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে জগন্নাথ হলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং প্রথমেই মর্টার ছোড়ে উত্তর বাড়ির দিকে। সাথে সাথে অজস্র গুলিবর্ষণ শুরু হয়। উর্দু ও ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আত্মসমর্পণ করে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। এরপর জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে শুরু হয় নারকীয় কাণ্ড। উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষ অনুসন্ধান করে ছাত্রদের নির্বিচার গুলি করে। এমনকি টয়লেটে, বাথরুমে, পায়খানায় ও ছাদে রক্ষিত জলের ট্যাঙ্কের মধ্যে যেখানেই পাওয়া যায় লোকের সন্ধান সেখানেই চলে নির্বিচারে গুলি ও হত্যা। পশ্চিম দিকের টিনশেড অর্থাৎ পশ্চিম ভবন, ক্যান্টিন ও ক্যান্টিনসংলগ্ন ছাত্রাবাসে ধরিয়ে দেয়া হয় আগুন। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতা পালিয়েছিল; কিন্তু সর্বগ্রাসী আগুনের হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসতেই তাদের ওপর শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। ক্রমশ আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্ৰ দেবের বাসভবন। পাক বাহিনী মেরে ফেলে গোবিন্দচন্দ্র দেবকে এবং পালিত কন্যা রোকেয়ার স্বামীকে। পরে আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার, যেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান পুত্র ও আত্মীয়সহ নিহত হন। মারাত্মকভারে আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পাক মিলিটারি মধুসূদন দের (মধুদা) বাসা আক্রমণ করে হত্যা করে তার পুত্র, সদ্য বিবাহিতা পুত্রবধূ, স্ত্রী যোগমায়া — যিনি ছিলেন দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গুলিতে মধুদাও মারাত্মকভাবে আহত হন ও পরে মারা যান।
জঘন্যতম পদ্ধতি গ্রহণ করে পাকবাহিনী পরবর্তী ঘটনার অবতারণা করে। পলায়িত ও আতঙ্কগ্রস্ত ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে আসে এবং তাদের দিয়ে জগন্নাথ হলের মাঠে লাশ জড়ো করার কাজে লাগায়। পাকবাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে এদের মধ্যে দু-একজন লাশ টানার কাজে যোগদান করেনি। কিন্তু অনেকেই রাইফেল ও বেয়নেটের মুখে এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। ছাত্ররা নিহত সহপাঠীর লাশ, কর্মচারীরা গোবিন্দ দেব, মুনিরুজ্জামান ও মধুদার লাশ টেনে হলের অভ্যন্তরে জড়ো করে। এই কাজ সম্পন্ন হয় মিলিটারির পাহারায়। পরে যারা লাশ টানে তারা এবং বিভিন্ন স্থান হতে ধরে আনা লোকজনকে সারিবদ্ধ হবার নির্দেশ দেয় পাকবাহিনী। এদের মধ্যে শিববাড়ির কয়েকজন সাধু ছিলেন। মুখে ছিল তাদের দাড়ি, পরনে গেরুয়া। অন্য একজন ছিল টুপি পরিহিত মুসলমান। কিন্তু মানবতা ও ধর্ম কোনো জ্ঞানই ছিল না বর্বর পাকবাহিনীর। লাইনে দাঁড়ানো ও সমবেত জনগণের ওপর তারা চালাল মেশিনগান, এক লোমহর্ষক, হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক দৃশ্যের সূচনা হলো। দূরে বস্তিতে পালিয়েছিল মহিলাগণ, যারা স্বজন হারানোর বেদনায় আর্তনাদ করে উঠল। জগন্নাথ হলের বাতাস একটু জল ও পানির আহাজারিতে ভরে গেল। মরণ যন্ত্রণা ও প্রাণ বাঁচানোর এক করুণ দৃশ্য দেখা গেল।
কিছু সময়ের জন্য পাকবাহিনী জগন্নাথ হল ও তৎসংলগ্ন এলাকা ত্যাগ করে। বস্তি হতে ছুটে আসে মহিলাগণ। বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকেন তাদের অনেকেই। যারা অপেক্ষাকৃত কম আহত ছিলেন তাদের নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কেউ কেউ নিজের চেষ্টাতেই পালিয়ে যান জগন্নাথ হলের মাঠ থেকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে পাকবাহিনী বুলডোজার নিয়ে। একটা ছোট গর্ত করে ময়লা-আবর্জনার মতো মাটিচাপা দেয় জীবিত-মৃত, আহত-নিহত সবাইকে। মাটিচাপা দেবার কাজটাও এত অবহেলার সাথে সম্পাদন হয়েছে যে বহুসংখ্যক নিহত ব্যক্তির হাত- পা, মাথা ও দেহের অংশ মাটির উপরে ছিল। গণকবর হতে জেগে ওঠা মুষ্ঠিবদ্ধ হাত যেন স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞার প্রতীক। এর পরপরই পাকবাহিনী হল এলাকা ত্যাগ করে।
সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঊষালগ্নে কেবল ৩৪ জন ছাত্র জগন্নাথ হলেই শহীদ হন। শিক্ষকদের মধ্যে জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য শহীদ হন। হলের বাইরে থাকলেও গণহত্যার পর গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মৃতদেহ জগন্নাথ হলের গণকবরে পাক বাহিনী অমার্জনীয় অবহেলায় সমাহিত করে। ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কণ্ঠদেশে গুলি লাগে এবং শেষ পর্যন্ত তিনি হাসপাতালে মারা যান।
জগন্নাথ হলের সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তিনজন, ছাত্র ৩৪ জন ও কর্মচারী ৪ জন ২৬ মার্চই শহীদ হন। কিন্তু এছাড়া ছিল জানা-অজানা অনেক লোক। সকলের পরিচিত মধুদা (মধুসূদন দে) জগন্নাথ হলের মাটিতে মিশে আছেন। মিশে আছেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান তাঁর কয়েকজন নিকট-আত্মীয়সহ। দর্শন বিভাগের কর্মচারী খগেন দে ও তাঁর পুত্র মতিলাল দে পিতাপুত্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। গুলিতে দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যখন জগন্নাথ হলের মাঠে পিতা-পুত্র লুটিয়ে পড়েছেন তখন দুশো গজ দূরে আর্তচিৎকার করে উঠেছেন শহীদ খগেন দের স্ত্রী রেনুবালা দে। মারা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সুশীল চন্দ্র দে, বোধিরাম, দাসুরাম, ভীমরায়, মনিরাম, জহরলাল রাজভর, মন ভরণ রায়, মিস্ত্রী রাজভর, শঙ্কর কুরী প্রমুখ। এছাড়া বহুসংখ্যক অতিথিও এই রাতে পাকবাহিনীর গণহত্যার শিকার হয়েছে যার প্রমাণ সাক্ষাৎকার দানকারীদের বক্তব্যে পাওয়া যায়। ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পাল, জগন্নাথ কলেজের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমর প্রমুখ ছাত্র ও অতিথিদের নাম সাক্ষাৎকার দানকারীদের নিকট হতে জানা যায়, যারা ২৬ মার্চ জগন্নাথ হলের গণহত্যার নির্মম শিকার হয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে বলা চলে যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে যে গণহত্যা হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। অন্যদিকে জগন্নাথ হলে গণকবর রচিত হয়েছিল যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার জগন্নাথ হলের কাছাকাছি যত লোককে হত্যা করা হয়েছিল তাদের প্রায় সবাইকে এনে গণকবরে সমাহিত করা হয় বুলডোজারের মাধ্যমে। শিববাড়ির সাধুদের ধরে এনে জগন্নাথ হলের মাঠে গুলি করে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। জগন্নাথ হলের কিছু সংখ্যক ছাত্র তখন রমনা কালীবাড়িতে থাকত। ২৬ মার্চ রমনা কালীবাড়িও পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয় এবং সেখানে নিহত হয় ৫-৬ জন জগন্নাথ হলের ছাত্র। তাদের মধ্যে কেবল অর্থনীতির ছাত্র রমনীমোহন ভট্টাচার্য ব্যতীত আর কারো নাম জানা যায়নি। এমনি অনেক নাম-না জানা লোক দিয়ে প্রথমে বিক্ষিপ্ত লাশগুলো জগন্নাথ হলের মাঠে জড়ো করানো হয় এবং শেষে গণহত্যার সাক্ষীদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। সবশেষে রচিত হয় ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী-অতিথি ও জনগণের এক গণসমাধির শেষ সাম্য।
উল্লেখ্য যে শিববাড়ির ৫ জন সাধুকে ধরে এনে জগন্নাথ হলের মাঠে হত্যা করা হয়েছে। অধ্যাপক নূরুল উল্লাহর ভিডিওতে এর চিত্র দেখা যায়।
[১১০] রতনলাল চক্রবর্তী

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!