চারখাই গণহত্যা, সিলেট
২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা সিলেটের চারখাই এসে ক্যাম্প স্থাপন করে পীর বাড়িতে। পীর ইয়াজ মিয়া তাপাদার বাধ্য হন তাদের প্রাণের ভয়ে একটি ঘর ছেড়ে দিতে। জামায়াতের নেতারা ওই সময় এসে হানাদার সৈন্যদের সাথে দেখা করে। জানা যায়, জামায়াত নেতারা ওইদিন একটি তালিকা পাক সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়ে ওই তালিকায় লিপিবদ্ধ লোকজনকে হত্যা করার অনুরোধ জানায়। ২৭ এপ্রিল সকাল দশটায় জামায়াতে ইসলামী নেতা মাওলানা শামসুল হক, মাওলানা লুৎফর রহমান ও মাওলানা আবু সায়ীদ, মন্তু মিয়া, লাল মিয়া, মঞ্জুর হাফিজ, শফিক আহমদ ও খালেদ আহমদসহ বিয়ানীবাজার ও কানাইঘাট থানার দালালরা মিছিলসহ পীর বাড়ি আসে। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবক্তাদের নির্মূল করার দাবি জানায়। দালালরা ইয়াজ মিয়া তাপাদারকে প্রহার করে। এমনকি তিনি যখন পবিত্র কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন, তখন জামায়াত নেতারা পাকসেনাদের জানায় যে, আয়াজ মিয়া ‘জয় বাংলার’ পক্ষে শ্লোগান উচ্চারণ করছেন। তখনই পীর ইয়াজ মিয়াকে ঢিল ছুড়ে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়। করাও হয় তাই। তাঁর নিজের পুকুরে ফেলে জামায়াতের লোকজন ইয়াজ মিয়া তাপাদারকে উপর্যুপরি ঢিল ছুড়ে হত্যা করে। এমনকি তাঁর লাশ পর্যন্ত পুকুর থেকে তুলতে দেয়া হয়নি। এরপর জামায়াতের লোকেরাই লুট করে পীর বাড়ি। আগুনও ধরিয়ে দেয়া হয়। শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় ইয়াজ মিয়ার বৃদ্ধা স্ত্রীর ওপর। এরপর জামায়াতের লোকজন পথ দেখিয়ে পাকসেনাদের নিয়ে আসে বিয়ানীবাজার থানা সদর পর্যন্ত। ২৭ মে ভোরে দোহাল গ্রামে ঢুকে তারা হত্যা করে অ্যাডভোকেট আবদুল হাফিজকে। অথচ তিনি ছিলেন জেলা মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক। পরবর্তীকালে তারা হত্যা করে চারখাইয়ের লেবু বিবিকে। টিকরপাড়া থেকে ধরে এনে এখানে হত্যা করা হয় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে।
বাস স্টেশনের ব্যবস্থাপক মতিউর রহমানকে (মসিক মিয়া) ধরে নিয়ে যায় দালাল বচন হাজি, কালা মিয়া ও দুদু মিয়ার প্ররোচনায়। পরে তাঁকে হত্যা করে বিয়ানীবাজারের কাঁঠালতলায়। সাহেবাগের একজনকে একদিন পাকিস্তানি হায়েনারা হত্যা করে সদাখাল এলাকায়। চারখাই-জকিগঞ্জ সড়কে একদিন গুলি করে হত্যা করে ফুলবাড়ি এলাকার একজন গাড়িচালককে। আর জকিগঞ্জের রইছ আলীকে হত্যা করে চারখাই বাজারে। অন্য কোথাও হত্যা করে সাতটি লাশ নিয়ে আসে একদিন পাকসেনারা। সাথে ছিল কয়েকজন দালাল। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাঁদেরকে সমাহিত করে গদারবাজার এলাকায়। আর একদিন অন্যত্র থেকে ধরে এনে গদারবাজারে হত্যা করে দুজন অজ্ঞাত পরিচয় লোককে।
চারখাই অঞ্চল এবং কানাইঘাট উপজেলার বেশ কিছু দালাল মিলে সভা করে এই অঞ্চলের পাকিস্তান বিরোধীদের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। ২৩ জনের তালিকায় (কারো কারো মতে ৪০ জন) নাম ছিল কামরুল ইসলাম, ফখরুল ইসলাম, সুরমান আলী, দৌলতুজ্জামান, শেরুজ্জামান, রশিদ আলী, আবদুল খালিক, আবদুর রব, আরমিন আলী, নুরুল ইসলাম, মসব আলী, নূর উদ্দিন, মসদ আলী, হারিছ আলী, ময়না মিয়া, আলাউদ্দিন, লুৎফুর রহমান, সয়ফুল ইসলাম, আবদুল মালেক, রুস্তম আলী প্রমুখ। পরে তাঁদের ধরে শেওলায় নিয়ে নির্যাতন করে।
[ ৪৬ ] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত